ওরা কেউ মানুষ নয়
রণি বসু
১
তৃতীয়বার
কলিংবেল বাজায় অবশেষে দোতলার জানলা খুলে মুখটা অল্প বাড়ালেন প্রফেসর সেন।
আর নীচে তাকিয়ে দরজার সামনে দেখতে পেলেন আমার বর্ষাতি পরা চেহারাটা। হাঁক
পাড়লেন, "কে?…..কোথা থেকে আসছেন?!….."
গলা চড়িয়ে বললাম, "আমি…..বিনায়ক! ইন্টারভিউয়ের জন্য আসতে বলেছিলেন….."
বৃষ্টি পড়ার ছন্দবদ্ধ শব্দের কারণে আমার কণ্ঠস্বর যতটা জোরে শোনা যাওয়ার
কথা ততটা জোর শোনালো না।
একটু ভেবে প্রফেসর সেন যেন কিছুটা উল্লসিত গলায় বললেন, "ওঃ, আপনি!", তারপর
জানলার ফাঁক থেকে তাঁর মাথাটা অদৃশ্য হলো। প্রফেসরের এই উল্লাসের কারণ
অবশ্য আমি আন্দাজ করতে পারছি। প্রফেসর সেনের জায়গায় অন্য কেউ হলে এইরকম
পরিস্থিতিতে হয়তো আবার অন্যদিন আসতে বলে ফিরিয়ে দিতো, কিন্তু প্রফেসর সেন
যে ফেরাবেন না সেটাও আমি জানি।
এমনি সময় প্রফেসর সেনের বাড়িতে কাজের লোক শ্যাম থাকে। এখন সে দেশের বাড়ি
গেছে। প্রফেসর বাড়িতে একাই। আমাকে ছক সাজাতে হয়েছে ভালো করে সব খবর নিয়েই।
আরও প্রায় পাঁচমিনিট পর নীচে নেমে দরজা খুললেন প্রফেসর সেন। হাতে একটা বড়ো
টর্চ। অল্প হেসে বললেন, "আমি ভাবলাম আপনি বোধহয় এই প্রবল দুর্যোগে আজ আর
আসবেন না। যাক্, ভালোই হলো!….." আমিও নিঃশব্দে হাসলাম।
টর্চের কড়া আলো আমার চোখে সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু কাজের খাতিরে এইটুকু কষ্ট তো মেনে নিতেই হবে। তাও এখন যে কারেন্ট নেই এটাই অনেক!
জবজবে ভেজা জুতো ও রেনকোট খুলে প্রফেসরের পশ্চাদনুসরণ করে দোতলায় উঠলাম।
এখানে আমি এর আগে আসিনি, এসেছিলো শঙ্খ। তাই চারদিকটায় ভালো করে নজর
বোলাচ্ছিলাম।
একতলায়
জমাট বাঁধা অন্ধকার। সেই অন্ধকারেই সার দেওয়া বন্ধ দরজাগুলো নজর করতে
পারলাম। দোতলাতেও একতলার মতই সারি দিয়ে অনেকগুলো ঘর। সিঁড়ি দিয়ে উঠে একদম
প্রথম ঘরটা ছাড়া বাকি সব ঘরেরই দরজা বন্ধ। এই ঘরটাতেই ঢুকলাম আমরা। ঘরে
একটা এমারজেন্সি লাইট জ্বলছে, যার আলোয় ঘরের বাইরেটাও বেশ আলোকিত। এই
আলোটাও আমার জন্য যথেষ্ট পীড়াদায়ক, কিন্তু কোনো উপায় নেই আমার…..।
ঘরটার চার-দেওয়াল প্রায় দেখাই যায় না, সবটাই বড় বড় বুকশেলফের আড়ালে ঢাকা।
ঘরের একদম মাঝখানে একটা আয়তাকার টেবিল, তার দুপাশে দুটো সোফা। আর ঘরের
এককোনায় একটা টুল, যার উপরেই ল্যাম্পটা রাখা।
জানি সবই, তাও কিছুই না জানার ভান করে জিজ্ঞেস করি, "একাই থাকেন নাকি আপনি?"
প্রফেসর সেন বললেন, "হ্যাঁ, থাকি বলতে গেলে একাই। আর আছে আমার দিনরাতের কাজের লোক শ্যাম, ও এই দিনকয়েক আগে একটু গ্রামে গেলো।….."
পিঠেব্যাগটা খুলে এমারজেন্সি লাইটটার দিকে পিঠ করে সোফায় বসলাম। আলো সরাসরি চোখে না লাগায় অস্বস্তিটা এখন অনেকটা কম হচ্ছে।
মুখোমুখি সোফাতে বসলেন প্রফেসর সেন। আড়চোখে লক্ষ্য করলাম চশমার কাঁচের
ওপাশ থেকে প্রফেসরের দু’জোড়া জ্বলজ্বলে চোখ আমাকে আপাদমস্তক মেপে নিচ্ছে।
ওই দৃষ্টি দেখেই আমার মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো, কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে
সামলে নিলাম। মনকে বোঝালাম, যা করতে হবে সুযোগ বুঝে। তাছাড়া প্রফেসরের সাথে
প্রথমে কিছুক্ষণ এমনভাবে কথা বলতে হবে, যাতে উনি আমার ব্যাপারে সম্পূর্ণ
নিঃসন্দেহ হয়ে যান। আমি তৈরী হয়েই এসেছি বটে, কিন্তু আমার প্রতিপক্ষও
ভয়ংকরভাবে শক্তিশালী।
কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে সেন বললেন, "আপনার পুরো নামটা যেন কী?….."
বিনীত কণ্ঠে জবাব দিলাম, "বিনায়ক চৌধুরী….."
প্রফেসর সেন উপর-নীচে মাথা নাড়লেন। তারপর কিছুক্ষণ নীরবতা, আর তখনই খেয়াল
করলাম যে এই ঘর থেকে বাইরে বৃষ্টির শব্দ একেবারেই শোনা যায় না।
একটু থেমে কী যেন চিন্তা করে প্রফেসর আবার কথা বললেন, "বাড়িতে কে কে আছেন?"
আংশিক সত্যি বললাম, "একাই থাকি স্যার। আটবছর আগে বাবা-মা দু'জনেই একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গিয়েছেন।….."
সেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মুরগির বাড়িতে কেউ না থাকলে তো ওনার
কাজের সুবিধা, পরে খুনের অভিযোগে ওনার নামে কেউ পুলিশ-কেস করবে না। বললেন,
"তো আপনি ফোনে বলেছিলেন যে আপনি এম এসসি. পাশ, কম্পিউটার কোর্সও করেছেন।
সার্টিফিকেট এনেছেন কিছু?"
"হ্যাঁ.....", সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে আমি ব্যাগ থেকে আমার যোগ্যতার
সার্টিফিকেটগুলো বের করায় মনোযোগ দিই। যদিও আমি ভালো করেই জানি, এই
ইন্টারভিউটা আমাদের দু'জনের কাছেই একটা অছিলা মাত্র। আমাদের অভিসন্ধি
আলাদাই।
এরপর যেটা হলো,
সেটা একটা মেকি ইন্টারভিউ ছাড়া আর কিছুই না। সেই প্রশ্নোত্তরপর্ব এখানে
তুলে ধরে আমি আপনাদের বোর করতে চাই না। এই ফাঁকে বরং জানিয়ে দিই আমার এখানে
আসার আসল উদ্দেশ্যটা।
২
দুঃস্বপ্নের
মতো সেই সন্ধেটা আমার এখনও পরিষ্কার মনে আছে, কারণ সেটাই ছিল শঙ্খের সঙ্গে
আমার শেষ কথা অর্থাৎ জীবিত শঙ্খের সঙ্গে আমার শেষ দেখা। সেদিনও ঠিক আজকের
মতই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিলো। আমি অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে, রোজকার মতই
সোফায় জমিয়ে বসেছিলাম নিউজপেপার আর চায়ের কাপ হাতে। দেখলাম শঙ্খ কোথাও একটা
বেরোচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, "এই প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যাচ্ছেন
স্যার?"
শঙ্খ জুতো পরতে
পরতে বললো, "হিরন্ময়স্যার আজ একবার যেতে বলেছেন……….কয়েকটা ভালো বই দেবেন
বললেন। দ্যাখ্ না, বেরোচ্ছি আর বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো! চিন্তা করিস্ না, বাস
পেয়ে যাবো।….."
বললাম, "সাবধানে যাস্!…..ছাতা নিয়ে যা…..", তখনও জানি না যে এরপর আর ওর সাথে কথাই বলতে পারবো না কোনোদিন।
শঙ্খ বেরিয়ে গেলো। শঙ্খশুভ্র চৌধুরী, আমার ভাই। মা-বাবা
কার-অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাবার পরে জিনিয়া ছাড়া ওইই ছিলো আমার সবচেয়ে
কাছের। বলতে দ্বিধা নেই, আমি পড়াশোনায় বরাবরই বেশ ভালো ছিলাম, কিন্তু শঙ্খ
ছিলো আমার চেয়েও ব্রিলিয়ান্ট। সেইসাথে ওর ছবি আঁকার হাতও ছিলো দুর্দান্ত।
এইচএসে ভালো রেজাল্ট করে ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে পড়ছিলো শঙ্খ। প্রফেসর
হিরন্ময় সেন ওদের ডিপার্টমেন্টেরই প্রফেসর। শঙ্খ পড়াশোনায় ভালো বলেই হয়তো
ওকে খুব স্নেহ করতেন তিনি। প্রফেসর সেনের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে খুব দূরে
নয়, তাই শঙ্খকে মাঝে মাঝে নিজের বাড়িতেও ডাকতেন। শঙ্খও আমার কাছে প্রফেসর
সেনের খুব প্রশংসা করতো।
কিন্তু সেই সন্ধ্যায় বেরিয়ে শঙ্খ আর ফিরলো না। রাতে পুলিশ রেললাইনের উপর
থেকে ওর রক্তশূণ্য ডেডবডিটা উদ্ধার করে। কপাল ভালো যে তখনও বডিটা রেলের
চাকার নীচে যায়নি। বডির ঘাড়ে পাওয়া গেলো একজোড়া সূক্ষ্ম ক্ষতচিহ্ন, রক্ত
শুকিয়ে জমাট বেঁধে আছে সেখানে। পোস্টমর্টেমে জানা গেলো, আচমকা হৃদযন্ত্রের
ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে মৃত্যু হলেও, শঙ্খের ঘাড়ের ক্ষতগুলি দিয়ে ওর
শরীর থেকে কোনোভাবে সব রক্ত বের করে নেওয়া হয়েছে। মৃত্যুর সময় আনুমানিক
সন্ধ্যা সাতটা থেকে আটটার মধ্যে, অর্থাৎ হিসাবমতো তখন ওর প্রফেসর সেনের
বাড়িতে থাকার কথা।
কিন্তু পুলিশি জেরায় প্রফেসর সেন জানালেন যে সেই সন্ধ্যায় শঙ্খ নাকি তাঁর
বাড়ি যায়ইনি। এমনকী তাঁর বাড়ি সার্চ করেও সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া গেলোনা।
লোকাল বাসিন্দারাও জানালেন যে সেই ঝড়বৃষ্টির রাতে তাঁরা সবাই যে-যার ঘরেই
ছিলেন, তাই অস্বাভাবিক কিছু দেখেননি বা শোনেননি। শেষপর্যন্ত পুলিশ আমার
ভাইয়ের এই অদ্ভূত মৃত্যুরহস্যের কোনো কিনারাই করতে পারলো না। তারপর কেসটা
একসময় চাপা পড়ে গেলো।
আমার কেন জানি না প্রথম থেকেই মনে হয়েছিলো যে শঙ্খের মৃত্যুর সাথে প্রফেসর
সেনের কিছু না কিছু যোগাযোগ আছেই। কিন্তু শঙ্খের খুনি যে স্বয়ং প্রফেসরই,
সেটা জানতে পারলাম কয়েকসপ্তাহ পর। আমার ভূত-প্রেত-পিশাচে বিশ্বাস ছিলো না,
কিন্তু সেদিন আমার অবিশ্বাসের ভিত নড়ে গেলো।
দুপুরে খেয়ে উঠেছি সবে, দেখা করতে এলেন রক্তিম সান্যাল। নিজের পরিচয় দিলেন
হিরন্ময় সেনের প্রতিবেশী বলে। তিনি বললেন, "মিঃ চৌধুরী, শুনে আপনি
অবিশ্বাস করতে পারেন, কিন্তু এটাই সত্যি। প্রফেসর হিরন্ময় সেন আসলে মানুষের
ছদ্মবেশে ভয়ংকর এক রক্তপিশাচ। উনি আমাদের প্রতিবেশী হয়ে এসেছেন বছরচারেক
হলো। প্রথম কয়েকমাস আমরা কিছুই টের পাইনি। কিন্তু তারপর রাতদুপুরে ছাদে
উঠলে বা জানলা দিয়ে আমরা সবাই এমন কিছু জিনিস দেখতে শুরু করলাম, যেগুলো
বোধহয় না দেখাই ভালো ছিলো! জানি আপনি আমার মুখের কথা শুনে বিশ্বাস করতে
পারছেন না, তাই এই ছবিগুলো দেখুন….."
রক্তিমবাবু আমার চোখের সামনে ওঁর টাচফোনের স্ক্রীনটা তুলে ধরলেন। বললেন,
"জানলা দিয়ে আমার ছেলে চুপিচুপি এই ফটোগুলো তুলেছে…..দেখুন….."
মোট চারটে ফটো। ফটোগুলো দেখতে দেখতে আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমশীতল
স্রোত বয়ে গেলো। এগুলো আসলই, কোনো এডিটিং করা নয়। প্রথম দুটো ছবিতে দেখা
যাচ্ছে, অন্ধকার আকাশে ঠিক বাদুড়ের মতো ডানা মেলে উড়ছেন প্রফেসর সেন। দেখে
প্রফেসর সেনকে চেনা যাচ্ছে বটে, কিন্তু ওঁকে আর মানুষ বলে মনে হচ্ছে না।
গল্পের বইয়ে পড়া বা টিভিতে দেখা ভ্যাম্পায়ারের সাথে এই চেহারার অনেক মিল!
তৃতীয় ছবিতে প্রফেসর সেন উড়ে ওঁর বাড়ির ছাদে নামছেন, আর ওনার মুখে-ঠোঁটে
লেগে রয়েছে টকটকে লাল একটা পদার্থ - রক্ত! চতুর্থ ছবিটায় দেখা যাচ্ছে,
প্রফেসর সেন বাড়ির বাগানে দাঁড়িয়ে, আর বাগানের ঘাসের উপর একজায়গায় খুলে
গিয়েছে একটা ঢাকনি, সেখানে দেখা যাচ্ছে মাটির নীচে যাওয়ার একটা গুপ্তপথ!
কিছুক্ষণ নিঃশব্দ। নীরবতা ভাঙলেন রক্তিমবাবুই, "এখনও প্রতিদিন
ভ্যাম্পায়ারটা রাতের অন্ধকারে দূর-দূরান্তে উড়ে যায় শিকারের খোঁজে। যদিও
এখন আমাদের কাছে ব্যাপারটা গা-সওয়া হয়ে গেছে। তবে যতদূর মনে হয়, বৃষ্টির জল
সহ্য করতে পারে না ভ্যাম্পায়ারটা। কারণ বৃষ্টিবাদলার রাতে ওটা কখনও ঘর
থেকে বের হয় না।"
ভয়-দুঃখ-রাগ-হতাশায় আমার কপালের শিরাগুলো দপদপ করছে তখন। কোনোরকমে শুকনো
গলায় বলেছিলাম, "আপনারা কেউ জিজ্ঞাসাবাদের সময় পুলিশকে এসব কিছু জানালেন না
কেন? শয়তানটার তো শাস্তি পাওয়া দরকার! আর পুলিশই বা ওনার বাড়ি তল্লাশি করে
কিছু পেলোনা কেন?….."
ম্লান হেসে রক্তিমবাবু বললেন, "আমাদের কি প্রাণের ভয় নেই মিঃ
চৌধুরী?…..এমনিতেই বিকাল হলেই অমানুষটার ভয়ে সব জানলা-দরজা এঁটে ঘরে বসে
থাকতে হয়, বাধ্য হলে অন্ধকারে বেরোতে হয় প্রাণ হাতে করে! নাহলে সুযোগ পেলে
ওটা হয়তো কবেই আমাদেরও শেষ করে দিতো। আর ওটার কথা পুলিশকে বললে লাভ তো কিছু
হতোই না, বরং আমাদের জীবনই বিপন্ন হত। এ তো আর কোনো মামুলি অপরাধী নয় মিঃ
চৌধুরী, পুলিশ এদের কিছুই করতে পারবে না!"
একটু থেমে আবার বললেন, "সম্ভবত বাগানের ওই বেসমেন্টেই ওর সব রহস্য লুকোনো
আছে। তাই গোটা বাড়ি সার্চ করেও পুলিশের কোনো খটকা লাগেনি। আর তাছাড়া শুনেছি
ভ্যাম্পায়ারদের হিপনোটাইজ করার ক্ষমতা থাকে। পুলিশকেও হয়তো………."
আমার মাথা আর কাজ করছিলো না। কোনোরকমে বিদায় দিলাম ওনাকে। উনি নিজের
কনট্যাক্ট নম্বর দিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় বললেন, "আপনার এখানে আমার আসার খবর
প্রফেসর সেন, মানে ওই ভ্যাম্পায়ারটা যদি জানতে পারে, তাহলে আমি শেষ।
কিন্তু আমার মনে হলো আপনাকে বিষয়টা জানানো আমার কর্তব্য - তাই….."
তারপর দশটা বছর কেটে গিয়েছে। শঙ্খের মৃত্যু আমাকে মানসিকভাবে একা করে
দিয়েছিলো। জিনিয়াকেও বেশী সময় দিতাম না আর, তাই ব্রেকআপটা হয়েই গেলো। তখন
আমি শুধু ভেবে চলেছি প্রতিশোধের কথা, কীভাবে ওই ভ্যাম্পায়ারটাকে খতম করি!
তবে তার জন্য কয়েকটা বছর অপেক্ষা আমাকে করতেই হতো, কারণ সঙ্গে সঙ্গে কোনো
অজুহাতে ওনার বাড়ি গেলেও প্রফেসর সেন শঙ্খশুভ্র চৌধুরীর দাদা বলে আমাকে
চিনে ফেলতেন এবং সতর্ক হয়ে যেতেন। এই দশবছরে আমার চেহারা অনেকটাই বদলে
গেছে, তাছাড়া দাড়ির জঙ্গল আমার মুখের ভোলটাই পাল্টে দিয়েছে। এমনিতেও বিনায়ক
চৌধুরীকে প্রফেসর এতদিনে নিশ্চয় ভুলে গিয়েছেন। আমি কিন্তু রক্তিম
সান্যালকে ফোন করে মাঝে মাঝেই প্রফেসরের খোঁজখবর নিই। এবার শুধু একটা
সুযোগের অপেক্ষা!
সুযোগ
এলো অবশেষে। জানতে পারলাম, প্রফেসর সেন পার্সোনাল সেক্রেটারি খুঁজছেন।
যোগাযোগ করলাম। উনি ইন্টারভিউয়ের জন্য আজ এই সময়ে দেখা করতে বললেন।
আমি ভয়ংকরের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলাম। আমার অস্ত্র বলতে
একটা ক্রশ আর একটা মন্ত্রপড়া ছোরা। দু'টোই দিয়েছেন ফাদার গোমেজ, আমার বাবার
বন্ধু। ক্রশটা নাকি আমাকে রক্ষা করবে ভ্যাম্পায়ারটার হাত থেকে, আর
কোনোভাবে ছোরাটা ওর বুকে গেঁথে দিতে পারলেই সব জারিজুরি শেষ।
আর উপরি পাওয়া আজকের বৃষ্টি। সত্যিই যদি ভ্যাম্পায়ারদের বৃষ্টিতে
অ্যালার্জি থাকে, তাহলে প্রফেসর সেন ঘরের বাইরে বেরিয়ে পালাতে পারবেন না।
তাতে আমারই কাজের সুবিধা।
৩
কথাবার্তা
প্রায় শেষ। প্রফেসর সেন মাথা নেড়ে বললেন, "বেশ, মনে হচ্ছে আপনাকে দিয়ে
আমার কাজ চলতে পারে। তাও আমি আগামীকাল ফোনে আপনাকে ফাইনাল ডিশিসন জানিয়ে
দেবো। এমাসের তো আজ তিরিশ হয়েই গেলো……….আপনি পরশু, মানে পয়লা থেকে কাজে
জয়েন করতে পারবেন।"
যাক্, উনি তাহলে কিছু সন্দেহ করেননি। কিন্তু এবার অ্যাকশন শুরু করার সময় হয়েছে…..। আমি ব্যাগ হাতড়ে ছোরাটা খুঁজতে শুরু করি।
- "আপনি কি প্রতিশোধ নিতে এসেছেন বিনায়কবাবু?"
আচমকা কথাটা শুনে মুখ তুলেই দেখতে পেলাম প্রফেসর হিরণ্ময় সেনের আসল
চেহারাটা। মানুষের খোলস ছেড়ে নিজের রূপ ধারণ করেছে ভ্যাম্পায়ারটা। তাজা
রক্ত পাওয়ার লোভে জিভটা অল্প বের হয়ে এসেছে, দেখতে পাচ্ছি তীক্ষ্ণ
শ্বদন্তগুলোর ঝলকানি। গলার স্বরও বদলে গিয়েছে পুরোপুরি। এই ভয়ংকর চেহারা
দেখে আগে হলে হয়তো ভিরমি খেতাম, কিন্তু এখন আর নয়।
পাশবিক অট্টহাসি হেসে উঠে পিশাচটা বললো, "আপনি কী ভেবেছিলেন, এতদিন পরে
আমি সব ভুলে গেছি? আমরা কিছু ভুলি না বিনায়কবাবু। দশবছর আগের ঘটনাও আমার
স্পষ্ট মনে আছে…..আর মনে আছে আপনাকেও! টেলিফোনে আপনার নাম শুনেই আমার
সন্দেহ হয়েছিলো, এখন আপনাকে দেখে নিশ্চিত হলাম! আমি বুঝতে পারছি, আপনি
আমাকে ধ্বংস করার প্ল্যান করেই এসেছেন! কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছি না যে
আপনি আমার আসলিয়ত সম্পর্কে জানলেন কীভাবে?"
আমি কোনো সাড়া দিলাম না। নার্ভাসনেসে ছোরাটা খুঁজে পাচ্ছি না কিছুতেই,
অন্য কাগজপত্রের জন্য একেবারে তলায় চলে গিয়েছে। এখন ওটাই আমার একমাত্র
দরকার, ক্রশটা তো আর আমার প্রয়োজন নেই।
ভ্যাম্পায়ারটা সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। একটু থেমে আবার বললো, "সে যাই
হোক্…..বৃষ্টি আমাদের একদম সহ্য হয় না! তাই আজ শিকার ধরতেও বেরোতে পারতাম
না। এরকম সময়ে ঘরে বসেই একটা জলজ্যান্ত মানুষ পেলে কি তার রক্ত না চুষে
ছাড়া যায় বলুন? শঙ্খশুভ্রকে সেই দুর্যোগের রাতে মেরেছিলাম ঠিক এই কারণেই,
অবশ্য সেদিন ও আমাকে রক্ত খেতে দেখেও ফেলেছিলো। দুঃখের বিষয়, দাদারও আজ
ভাইয়ের মতোই পরিণতি হবে……….!"
এখন আমার ঠিক সামনেই এসে দাঁড়িয়েছে অমানুষিক চেহারাটা। এদিকে আমি
আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও নাইফটা পাচ্ছি না কেন?! হায় ভগবান! স্পষ্ট মনে আছে,
বাড়ি থেকে বেরোবার আগে চেক করে নিয়েছিলাম আসল জিনিসদু'টো ঠিকঠাক সঙ্গে
নিচ্ছি কিনা। কিন্তু এখন হচ্ছেটা কী?! বুঝতে পারছি ওগুলো আলাদা চেইনে রাখা
উচিত ছিলো।
এই আকস্মিক
ধাক্কায় আমি পাথরের মতো স্থাণু হয়ে গেছি, শুধু আমার ডানহাতটা বিদ্যুৎগতিতে
হাতড়ে চলেছে ব্যাগের ভিতরের জিনিসগুলো। হঠাৎ আমার হাতটা ঠেকলো ছুরির বাঁটে।
ততক্ষণে অবশ্য রক্তপিপাসু পিশাচটা আমার গায়ের উপর ঝুঁকে পড়ে আমার গলায়
কামড় বসিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু সঙ্গত কারণেই ওটার দাঁত বাতাস কেটে বেরিয়ে গেছে। কারণ এটা তো আমার
রক্তমাংসের শরীর নয়, সেটা এখন পড়ে আছে একটু দূরে রাস্তার উপর। হ্যাঁ, আমি
মারা গিয়েছি বেশ কিছুক্ষণ আগেই। এই কাজের টেনশনে একটু অন্যমনস্ক হয়েই
রাস্তা পার হচ্ছিলাম, আর একটা ধাবমান ট্রাক পিষে দিয়ে চলে গেলো আমার দেহটা।
ধাক্কায় ব্যাগটা প্রথমেই ছিটকে পড়েছিলো একটু দূরে, তাই ওটার জিনিসপত্র
অক্ষতই রয়েছে। কিন্তু মৃত্যুর পরেও আমি এখানে এসেছি শুধুমাত্র আমার ভাইয়ের
হত্যাকারীকে খতম করার জন্য।
এবার চমকে গিয়েছে পিশাচটা, একটু যেন ভয়ও পেয়েছে। আর এটাই মোক্ষম সময় ওটাকে
শেষ করে দেওয়ার। প্রতিশোধের! ওটার কুৎসিত শরীরটা আমার একেবারে কাছেই,
ছোরাটাও উঠে এসেছে আমার হাতের মুঠোয়। এখন শুধু ওটা পিশাচটার বুকে গেঁথে
দেওয়ার অপেক্ষা.....
বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে সেটাই করলাম। আমার হাতে ছোরাটা দেখে
শেষমুহূর্তে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলো ভ্যাম্পায়ারটা। কিন্তু আমার
মধ্যেও এখন অতিমানবিক শক্তি, চোখের পলকে ছোরাটা বসিয়ে দিলাম ওর বুকের
মাঝখানে।
অমানুষিক একটা
আর্তনাদ। তারপর বুকে ছোরাটা গাঁথা অবস্থাতেই আমার কাছ থেকে ছিটকে সরে গেলো
রক্তচোষাটা। কিন্তু যা হওয়ার ততক্ষণে হয়ে গিয়েছে। পিশাচটার সারা শরীরে
দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে আগুন। তবুও পিশাচটা দু'হাত দিয়ে প্রাণপণে বুক থেকে
পবিত্র ছোরাটা উপড়ে ফেলার চেষ্টা করে চলেছে, কিন্তু ওটায় আঙুল অবধি ছোঁয়াতে
পারছে না।
কিছুক্ষণ
ছটফটানি আর অমানুষিক চিৎকার। তারপর সব শেষ। ঘরের মেঝেতে পড়ে রইলো গুঁড়ো
গুঁড়ো ছাই। ছোরাটাও পড়ে রইলো পুরোপুরি অক্ষত অবস্থায়। আগুন ওটার কোনো ক্ষতি
করতে পারেনি।
আমার কাজ
শেষ। এবার শঙ্খর সাথে দেখা করার সময়। তবে চিরতরে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার আগে
শেষবারের মতো একবার নিজের বাড়িতে যাবো। তাই বাতাসে ভেসে ভেসে সিঁড়ি দিয়ে
নেমে বাইরে বেরোলাম।
এখন বৃষ্টি একেবারে থেমে গিয়েছে। আকাশের মেঘ কেটে গিয়ে গোল থালার মতো চাঁদ উঠেছে। কিন্তু গেটের সামনে একটা জটলা কীসের?
চটপট অদৃশ্য অবস্থা থেকে দৃশ্যমান হলাম। কাছে যেতেই লোকগুলো ঘুরে তাকালো
আমার দিকে। চাঁদের আলোয় ওদের মুখ স্পষ্ট দেখতে পেলাম। অধিকাংশই পুরুষ, তবে
কয়েকজন মহিলাকেও চোখে পড়ছে। আরে, ওই তো রক্তিমবাবু! তিনি আমার সামনে এগিয়ে
এসে বললেন, "আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি। কাজ হলো?"
রক্তিমবাবুও জানেন না, আমি আর জীবিত নই। তাহলে আর ওঁরা কেউ হয়তো আমার
সামনে দাঁড়িয়ে এভাবে কথা বলার সাহস পেতেন না। অল্প হেসে বললাম, "হ্যাঁ, ওই
পিশাচটাকে আমি চিরকালের মতো খতম করে দিয়েছি! অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, কারণ
আপনার সাহায্য ছাড়া এই প্রতিশোধ সম্ভব হতো না….."
কেন জানি না আমার কথা শুনে রক্তিমবাবু এবং বাকিরা অদ্ভূতভাবে হেসে উঠলেন।
তারপর রক্তিমবাবু হঠাৎ অন্যরকম গলায় বললেন, "ধন্যবাদ চাই না। আমরা আপনার
রক্ত চাই, প্লিইজ্ না করবেন না………."
আমার সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। আর কিছু বলতে পারলাম না, কারণ ওরা প্রত্যেকে
হাসছে, পৈশাচিক হাসি। আর চাঁদের আলোতে ঝিকিয়ে উঠছে ওদের দুইজোড়া সূচালো
ক্যানাইন দাঁত, যেগুলোকে বলে 'ভ্যাম্পায়ার টিথ'!
আমার থ অবস্থা দেখে রক্তিমবাবু নিজেই বলতে শুরু করলেন, "হ্যাঁ, আমরা সবাই
পিশাচ, মিঃ চৌধুরী। এটাকে পিশাচদের পাড়া বলতে পারেন। কেউ জানে না, কেউ বোঝে
না। কারণ আমরা দিনেরবেলায় সাধারণ মানুষের মাঝে মিশে থাকি, আর শিকারে নামি
রাতের অন্ধকারে। তাহলে এখন আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে আমি নিজে পিশাচ
হয়েও প্রফেসর সেনকে মারতে আপনাকে হেল্প করলাম কেন? তার কারণ, এই এলাকার
সবচেয়ে শক্তিশালী পিশাচ, মানে আপনাদের প্রফেসর সেনই এখানকার ক্ষমতা দখলে
আমার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো। কিন্তু ওকে আমি মারতে পারতাম না, কারণ
শক্তিতে ওর সাথে পেরে ওঠা আমার অসাধ্য ছিলো। ওকে খুন করে আপনি আমার পথের
কাঁটা সরিয়ে দিলেন। আপনার প্রতিশোধ পূর্ণ হলো, আর আমার স্বার্থসিদ্ধিও হলো।
আমার দশবছরের অপেক্ষা সার্থক মিঃ চৌধুরী……….এখন আমিই এখানকার সবচেয়ে
শক্তিমান পিশাচ আর আমার রাজত্ব কায়েম!…..", বলতে বলতেই অমানুষিক অট্টহাসিতে
ফেটে পড়লেন রক্তিমবাবু।
তারপর আবার বললেন, "এখন আমাদের আর আপনাকে প্রয়োজন নেই মিঃ চৌধুরী। কিন্তু
আপনার হেল্পের কথা মাথায় রেখে আপনাকে একেবারে প্রাণে না মেরে একটা অফার
দিতে চাই। আপনিও আমাদের একজন হয়ে যান। তার জন্য শুধু গলায় একটা হালকা
কামড়………."
বুঝতে পারছি
না ওদের হতভম্ব করে দিয়ে নিজেই গায়েব হয়ে যাবো, নাকি সবক'টাকে মেরে
নিশ্চিহ্ন করবো। এদিকে রক্তিমবাবুর নির্দেশে একটা মেয়ে এগিয়ে আসছে আমার
দিকে।
আমি দ্বিতীয়
রাস্তাটাই বেছে নিলাম। ইচ্ছে করেই দৌড়ে আবার বাড়িটার ভিতরে ঢুকে পড়লাম। টের
পেলাম, রক্তের লোভে ভ্যাম্পায়ারের দলটাও আমার পিছনে উড়ে উড়ে আসছে। আমাকে
যেভাবে হোক ওদের দোতলার ঘর অবধি টেনে নিয়ে যেতে হবে। ওখানেই মেঝেতে পড়ে আছে
ফাদারের ছোরাটা। ওটা দিয়েই নিকেশ করবো সবক'টাকে, শঙ্খর মতো আর কাউকে এদের
হাতে মরতে দেবো না।
(সমাপ্ত)
Roni Basu