শয্যা - রিয়া ভট্টাচার্য

 

শয্যা
রিয়া ভট্টাচার্য 
 

 


ঘুম ঘুম ভাবটা কেটে যেতেই এক অদ্ভুত গন্ধ নাকে এসে লাগলো তমালের। 

গন্ধটা বড়ো উগ্র, যেন নাকের ভেতরের রোমকূপ জ্বালিয়ে দেয়। নাক কুঁচকে তমাল বোঝার চেষ্টা করে আদপে সে কোথায় আছে। জায়গাটা বড় প্রশস্ত, তবে অন্ধকার। স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া ও অতিরিক্ত ঠান্ডা যেন ঝিম ধরে আছে ঘরটার ভেতরে৷ ঘরটায় কোনো জানালা নেই, তবে নিঃশ্বাস নিতে অসুবিধে হচ্ছে না তমালের। ঘরে সে একাও নয়৷ এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রয়েছে বেশ কিছু মানুষ। একে অপরের সঙ্গে কথা জুড়েছে তারা। ফিসফিস শব্দে আলাপ করছে তারা, মাঝেমধ্যে ঠান্ডা চোখে তাকাচ্ছে তমালের দিকে৷ 

তড়িঘড়ি উঠে বসতে গিয়ে ব্যথাটা প্রথম টের পেলো তমাল। বুকের বাঁদিকটা যেন অবশ হয়ে আছে। যেন কোনো ভারী বস্তু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে তাকে৷ উঠে দাঁড়াতে গিয়ে একমুহূর্তের জন্য মাথা ঘুরে গেলো তার। 

টলে পড়তে গিয়েও টেবিলটা ধরে সামলে নিলো সে৷ এতক্ষণ সে এমন একটা শক্ত খটখটে টেবিলে শুয়ে ছিলো ভাবতেই মাথা গরম হয়ে গেলো তমালের। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির টপ এক্সিকিউটিভ তমাল বরাবরই বিছানা নিয়ে খুঁতখুঁতে। নরম বিছানা না হলে ঘুম হয়না তার। তবে এতক্ষণ সে কিকরে ঘুমিয়েছিল এই শক্ত টেবিলে! তবে কি অপহরণ করা হয়েছে তাকে! এই লোকগুলিই বা কারা! 

কোনোক্রমে টলতে টলতে পাশের টেবিলের দিকে এগিয়ে যায় তমাল, চোখ বন্ধ করে বাবু হয়ে বসে থাকা গম্ভীর লোকটিকে রুক্ষভাবেই প্রশ্ন করে, 

" এটা কোন জায়গা? আমি এখানে এলাম কিকরে!" 

" শ শ শ শ! "  ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে ইশারা করে লোকটা। ফিসফিস করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, 

" এখানে চিৎকার করা মানা। বস রেগে যাবেন। " 

" কে আপনাদের বস! আমায় কেন উঠিয়ে এনেছে সে! দেখুন, যদি আপনারা ভাবেন আমায় আটকে রাখলে কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট আটকে দেওয়া যাবে তবে ভুল করছেন। আমার টিম খুবই প্রশিক্ষিত। আমি না থাকলেও কালকের কনফারেন্স ঠিকই উৎরে দেবে তারা। পুলিশ ততক্ষণে ঠিকই খুঁজে নেবে আমাকে। একটাকাও মুক্তিপণ পাবেন না আপনারা৷ " 

এতগুলো কথা বলে হাঁ করে শ্বাস নেয় তমাল। আজকাল অল্পতেই বড্ড হাঁপিয়ে যাচ্ছে সে। শরীরটা ভারী দুর্বল। 

" আপনি তো আচ্ছা লোক মশাই! তখন থেকে চ্যাঁচামেচি করছেন। বলেছি তো, আপনার টাকাপয়সা বা কোম্পানির বিনিয়োগ সম্পর্কে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। " 

" তবে আমায় এখানে আটকে রেখেছেন কেন? কেন তুলে এনেছেন আমাকে!" 

" আপনাকে কেউ তুলে আনেনি। এখানে কেউ কাউকেই তুলে আনেনা, সবাই নিজের ইচ্ছায় আসে। " 

তমালকে স্তম্ভিত করে নীচু গলায় বললো লোকটা। তার কথায় এতোটাই দৃঢ়তা ছিলো যে মাথা নীচু করে বেশ কিছুক্ষণ ভাবতে বাধ্য হলো তমাল। তার খুব মনে আছে, গতকাল অফিস থেকে বেরিয়ে মেট্রো ধরে বাড়ি ফিরছিলো সে। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে যায় ট্রেনটা৷ নিভে যায় কামরার সমস্ত আলো। লোকজনের দলবদ্ধ চিৎকারের মাঝেই বুকে প্রবল ব্যথা অনুভব করে তমাল। চোখের পাতা ঝাপসা হতে শুরু করলে কোনোক্রমে সে বসে পড়ে সামনের সিটে, তারপর আর তার কিচ্ছু মনে নেই। 

" আচ্ছা এটা কি হাসপাতাল? কিন্তু হাসপাতাল তো এমন হয়না!" 

" হাসপাতাল! তা বলতে পারেন। এখানে জীবনের সব অনুভূতিগুলো কেটে বাদ দেওয়া হয়, মানুষ হালকা হয়ে যায়। " 

মুচকি হেসে বললো লোকটা। 

" মানে! কি বলতে চাইছেন!" উত্তেজিত হয়ে জানতে চায় তমাল। 

ততক্ষণে আরো কিছু মানুষ সরে এসেছে তার দিকে। উগ্র গন্ধটায় দমবন্ধ হয়ে আসছে তমালের। গন্ধটা আসছে লোকগুলোর শরীর থেকেই, কি মাখে এরা! 

খসখসে ঠান্ডা চামড়ার স্পর্শ পেতেই চমকে ওঠে সে। একটা হাত আঁকড়ে ধরেছে তাকে, যেন প্রবোধ দিতে চাইছে তাকে, নিষ্প্রাণ স্বরে বলছে, 

" ভয় পেও না তমাল! আমাদের যে এখন ভয় পেতে নেই!" 

ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেয় তমাল। মরামাছের মতো চোখধারী লোকগুলির উদ্দেশ্যে শাসানোর সুরে বলে, 

" আমায় যেতে দিন। যা চান পাবেন, কিন্তু আমায় এখানে আটকে রাখলে কিচ্ছুটি পাবেন না৷ " 

" এখানে কারো কিচ্ছু চাওয়ার নেই তমাল। আমাদের চাওয়া-পাওয়ার গণ্ডী শেষ হয়েছে অনেক আগেই। "

ধীরগলায় বলে বসে থাকা মানুষটি। 

" তবে আমায় এখানে আটকে রেখেছেন কেন! আমি বাড়ি যাবো!" 

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে একধাক্কায় সরিয়ে লোহার ভারী দরজাটার দিকে এগোয় তমাল, মাথাটা যেন ঝিমঝিম করে ওঠে তার। এই একটি দরজা ছাড়া ঘরটিতে আর কোনো দরজা নেই। ঠান্ডা ভাবটা অসহ্য হয়ে উঠছে ক্রমেই। তমাল কাঁপছে। 

অনেক কসরতের পরেও ভারী দরজাটা একচুলও নিজের জায়গা থেকে সরলো না। তমালের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নামছে। অর্গলহীন দরজা এতো ভারী হয়! 

" ওই দরজা তুমি হাজার চেষ্টা করলেও খুলতে পারবেনা তমাল। তবে চিন্তা নেই, বেশ কিছুক্ষণ পরেই এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে তুমি। তোমার পরিবার নিতে আসছে তোমাকে। " 

শান্তস্বরে বলে লোকটি। 

" এ এটা কোন জায়গা!" 

তমালের কথা যেন জড়িয়ে যায়। বাতাসে ভর দিয়ে ফিসফিস করে উত্তর আসে, 

" এটা মর্গ! তুমি লাশঘরে শুয়ে ছিলে। " 

" এসব কি বলছেন! কিচ্ছু হয়নি আমার। আমি বাড়ি যাবো। এমন অস্বাভাবিক পরিবেশে আর একমুহূর্ত থাকবোনা আমি৷ এই শক্ত টেবিলে কেউ শুতে পারে! আমার ঘুম পাচ্ছে। " 

জেদি শিশুদের মতো ঠোঁট ফোলায় তমাল। 

" এ টেবিল তোমার সাময়িক শয্যা তমাল। একটু পরেই এখান থেকে বেরিয়ে যাবে তুমি তোমার শেষ শয্যার উদ্দেশ্যে। এই টেবিলের থেকেও তা বেজায় শক্ত, উষ্ণও বটে! এত উষ্ণতা সহ্য করতে অসুবিধা হবে তোমার৷ যতোটা পারো শীতলতা মেখে নাও এখন। " 

শান্ত কথাগুলো যেন গরম সীসার মতো আছড়ে পড়ে তমালের কানে। হতভম্ব হয়ে লোকগুলোর দিকে এগিয়ে যায় তমাল। অন্ধকারে এখন চোখ সয়ে এসেছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে লোকগুলির কপালের সেলাইয়ের দাগ। তাদের পায়ের আঙুলে বাঁধা সাদা কাগজের টুকরোটা দেখা যাচ্ছে। এইতো, এমন টুকরো তো তমালের পায়েও রয়েছে! 

অজান্তেই নিজের কপালে হাত চলে যায় তার। সেলাইয়ের ক্ষত বড়ো টাটকা, কপাল বেয়ে চুঁইয়ে নামা কালো রক্ত শুকিয়ে গিয়েছে আগেই। বাইরে কিছু মানুষের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে৷ তারা এগিয়ে আসছে এদিকেই। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো পায়ে পায়ে ফিরে যাচ্ছে নিজেদের টেবিলে, আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ছে তারা, তলিয়ে যাচ্ছে ঘুমে। হঠাৎ শরীরটা পালকের মতো হালকা লাগছে তমালের। যেন এক ফুঁয়ে খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে সে, আছড়ে পড়বে বৈতরণীর পাড়ে। 

নিজের টেবিলে বসতে বসতে পাশের লোকটির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় তমাল, 

" বস কে?" 

" যার কাছে জীবন ও মৃত্যু বড়ো তুচ্ছ। শরীর ও অশরীর যার কাছে কোনো বাধা নয়৷ মানুষ তাকে ঈশ্বর ডাকে, প্রার্থনা জানায়। আমাদের কিচ্ছু প্রার্থনা করার নেই, কেবল নির্দেশ পালন করা আছে। " 

শুয়ে পড়তে পড়তে বললো লোকটা। ভারী দরজাটা ঘড়ঘড় শব্দে খুলে গেছে। সেখান থেকে ছলকে পড়ছে আলো। বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে তমালের। আলো আর সহ্য হচ্ছে না তার। একঝাঁক পরিচিত মুখ ভীড় করে আছে দরজার বাইরে। তাকে নিতে এসেছে তারা। কিন্তু তমালের এখন এই ঠান্ডা টেবিলে শুয়ে ঘুমোতে ইচ্ছে করছে, কারো সঙ্গে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছেনা তার। উগ্র গন্ধটা একটু একটু করে ঝাপসা হচ্ছে। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসার আগে এক ঝটকায় মনে পড়ে তমালের, গন্ধটা ফর্মালিনের! লাশের গায়ে লেগে থাকা একমাত্র পারফিউম।। 

(সমাপ্ত)
 
অলঙ্করণ :-   রিচা দাস