খুঁত - পল্লবী পাল


খুঁত 
পল্লবী পাল


    অপারেশন থিয়েটারের দরজাটা বন্ধ হয়ে যাবার কিছুক্ষনের মধ্যেই লাল আলোটা জ্বলে উঠল। আশঙ্কা আর দুশ্চিন্তার বোঝ মাথায় নিয়ে অবসন্ন শরীরে দরজার পাশের চেয়ারে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়লো অভি। হ্যাঁ, বাস্তবিকই তার পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে। বিগত একবছর মন আর মাথার সঙ্গে অসহায়ভাবে ক্রমাগত যুদ্ধ করতে করতে আজ নিজেকে বড়োই ক্লান্ত লাগছে। সত্যি এক একবার ভাবছে নিষ্ঠুর নিয়তির কাছে বোধহয় হেরেই যেতে হবে, আবার কোথাও যেন একটা ক্ষীণ আশা ওকে অন্তরে অন্তরে আশ্বাস দিচ্ছে - সব ঠিক হয়ে যাবে, সব ঠিক হয়ে যাবে।

    অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগে স্ট্রেচারে শুয়ে যখন বিনীতার ভাষাহীন কোটরাগত চোখ দুটো থেকে নিঃশব্দে জল গড়িয়ে আসতে দেখেছিল, তখন নিজের চোখের জলকেও ধরে রাখতে পারেনি অভি। এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিল ছোটবেলায় শেখানো কথাগুলো - 'ছেলেদের কাঁদতে নেই'। কি করবে অভি ? বিয়ে হয়ে থেকে এই আড়াই বছরে বড্ডো ভালোবেসে ফেলেছে যে বিনি কে, চোখের জলটার থেকেও বিনির চোখের ওই শুন্য দৃষ্টিটা যে ওর ভিতরটাকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে। অথচ এরকম হবে ও তো কখনও ভাবেনি, সব কিছু তো সুন্দর ভাবে শুরু হয়েছিল। দুজনের আলাপ হাওয়া, একসঙ্গে পথ চলা শুরু হয়েছিল স্বপ্নের মতো।

    অভির খুব ভালো মনে আছে সেদিনের কথা। অফিস থেকে ফিরে দেখে তপা মাসি আর মা সোফায় বসে গল্প করছে। ঘরে ঢুকতেই তপা মাসি বেশ উৎসাহের সঙ্গে বললো -
---এই তো এসে গেছে অভি |
---তপা মাসি কেমন আছো? কখন এলে ?
---দুপুরে এসেছি রে, অফিস থেকে এলি যা একটু হাত পা ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে এখানে এসে বস তো, তোর সঙ্গে কথা আছে।
এই রে! কথা আছে মানেই তো বোঝাই যাচ্ছে কি কথা। মাসতুতো বোন তুহি ঘর থেকে বেরিয়েই অভিকে দেখে একগাল হেসে বললো |
---দাদাভাই, তোর বরবাদির প্ল্যান চলছে দুজনের |
---সে তো বুঝতেই পারছি, চোখে মুখে এতো খুশি আবার আমাকে দরকার, অঙ্ক মিলে গেল, তুই কেমন আছিস বল ? ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফার্স্ট ইয়ার , প্রেম টেম করছিস ?
---ধুর ধুর ক্লাসের একটাও যুতের না, যেগুলো একটু পদের সেগুলো আবার আগে থেকেই বুক , সিনিয়রদের দিকে তো এখন তাকানো যাবে না, পরের ইয়ারে চান্স নেবো |
তপা মাসি তুহির দিকে চোখ গোল করে বললো -
---হ্যাঁ পড়াশোনা বাদে ঐসবই হবে। অভি তুই আর এটাকে তোল্লাই দিস না, বরং শেখা যে প্রেম না করেও কীকরে নাইন পয়েন্টার হয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস্ করে ভালো চাকরি পেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানো যায়।

    তুহি একটু অভিযোগের সুরে বললো -
---উফফ তোমরা ইয়ার্কিও বোঝো না, আর দাদাভাই যদি প্রেম করতো তাহলে ভালোই হতো, তোমাদের পাত্রী খোঁজার এতো ঝামেলা করতে হতো না। এতদিনে নাতি নাতনি কোলে নিয়ে বসে থাকতে।
অভির পরিচিত উত্তর ---তোমরা ঐসব করো বসে বসে, আমি হাত পা ধুয়ে আসি।

    কিন্তু ফিরে আসার পর নিস্তার আর পেলো কই, তপা মাসি প্রায় ঘাড়ের ওপর উঠে মেয়ের ছবি দেখিয়েই ছাড়ে।মেসোমশাই এর পুরোনো কলিগের মেয়ে - বিনীতা। বিনীতার মা মেসোমশাইয়ের সঙ্গে চাকরি করতেন শিলিগুড়িতে। তারপর মেসোমশাই বদলি হয়ে চলে এলেন হুগলিতে। বাবা মা দুজনেই রিটায়ারের পর এখন নাকি বিনীতারা কলকাতায় এসেছে, এখানেই পড়াশোনা করছে বিনীতা। অনেকদিন পর নাকি আবার কোনো কলিগের মাধ্যমে বিনীতার মায়ের সঙ্গে মেসোমশাইয়ের যোগাযোগ হয়েছে, সেখান থেকে নাকি তপা মাসি পেয়েছে এই ঘটকালির আইডিয়া। মাসিমনির মোদ্দা কথা হলো -
'বিনীতার মতো শিক্ষিত ও মার্জিত, আধুনিক মেয়ে নাকি খুব কম আছে। দেখতেও বেশ সুন্দর। পরিবারের লোকজন খুবই ভালো, আমাদের অভির জন্য এই মেয়ে এক্কেবারে পারফেক্ট।'

    অভির মা সুদীপ্তা দেবী আবার দেখতে ভালোর থেকেও শিক্ষিত মার্জিত মেয়ে বেশি পছন্দ করেন। নিজেও স্বভাবে সেরকমই। মাসি ওই জন্য এই কথা গুলো আগে বললো। একমাত্র ছেলের বৌ হবে তাই ছেলের পছন্দের পাশাপাশি এই দাবীটুকু সবসময় করেন। অভি পরিস্থিতি যা বুঝছে তলে তলে অনেকদিন থেকেই কথা চলছে, এখন খালি অভিযান আর বিনীতার একে অপরকে পছন্দের অপেক্ষা।
'সে দেখা যাবে’ গোছের একটা কিছু উত্তর দিয়ে অভি ঘরে চলে এল। বিয়ে বড়ো ঝামেলার ব্যাপার, বন্ধুমহলে যে কজনের উইকেট পড়েছে সবার থেকে সংসার ধর্মের গল্প শুনে বেশ চাপে আছে । ইচ্ছা যে হয়না ওর তা বলা ভুল, কিন্তু সে ভাবে মনে ধরেনি কাউকে, আসলে ওতো মেশার চেষ্টাও করে না। বাবাকে অভি খুব ভয় পেত, সেই ভয়ে অনেকদিন আগেই হারিয়ে গেছে কৈশোরের ভালোলাগাগুলো। এরমধ্যে তুহি আবার কোথা থেকে বিনীতার ফেসবুক একাউন্ট নিয়ে হাজির হলো-
---দাদাভাই ওই সব ছবি ছাড়, বিনীতা দির ফেসবুক দেখ, ফেসবুক। আমি তোকে বলছি এতে না করিস না। বিনীতাদি কে খুব ভালো লাগে, আমার তো খুবই পছন্দ। তোর মাথার সবকটা চুল পড়ে যাবার আগে এবার অন্তত বিয়ে করে নে |
---তোর বিনীতাদির আমাকে তো নাও পছন্দ হতে পারে, তার তো মতামত বা অন্য কিছু থাকতে পারে |
---ওসব নেই, জিজ্ঞাসা করেছি আমি। তুই কথা বলেই দেখ, ওর তোকে পছন্দ হবেই হবে |

    অভি বিনীতার একাউন্টে চোখ বোলালো, বেশ দেখতে, নিটোল বাঙালি চেহারা, সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স এ রিসার্চ ফেলো। পড়াশোনায় তারমানে ভালোই মনে হচ্ছে। পোষ্টের লেখা দেখে তো বেশ সুন্দর চিন্তার মানুষ মনে হয়, রুচিবোধও আছে । প্রথম দেখাতেই বেশ ভালো লেগে গেল অভির।
---কীরে কি বুঝলি দাদাভাই ?
---আমার একার পছন্দে কি কিছু হবে ?
---তারমানে তোর পছন্দ ?
---আরে ওই ভাবে বলা যায় নাকি, কথাবার্তা নেই কি করে বুঝবো কেমন মানুষ?
---তা বল না কথা, আমি ইন্ট্রো করিয়ে দেব। সত্যি খুব ভালো মেয়ে রে, কথা বললেই বুঝতে পারবি। খুব মিশুকে আর ভদ্র, তা বলে হাঁদা ভোঁদা ভাবিসনা যেন। তোর থেকে স্মার্ট |
---খুব ওস্তাদি করছিস না আজকাল...??
---চুপচাপ নম্বরটা সেভ কর, আমি তারপর ফোন করে কথা বলিয়ে দেব, তারপর নিজেরা বুঝে নিস্ |

    সেই যে প্রথম আলাপ হল ফোনের ওপারে, তারপর কয়েক মাসের কথাবার্তাতেই সব কেমন ম্যাজিকের মতো বদলে গেল। পাত্র পাত্রীর সম্মতি পেয়ে মা মাসিরা কাকিমারা বিয়ের কথাবার্তা আয়োজনে মেতে থাকলো। আর চুপিসারে অভি বিনীতাকে নিয়ে মনের কোনায় বেঁধে ফেললো ঘর। সত্যি মনে হতো অভির এতদিন কোথায় ছিল বিনীতা, হয়তো এই জন্যই অভির জীবনে এতদিন কোনো নারী আসেনি। বিনীতার মনের খবর পাবার পর যেন আকর্ষণ আরো বেড়ে গেল, এরকম আকর্ষণ অভির কাছে নতুন। বিনীতার সঙ্গে অভির সম্পর্কটা সহজভাবেই আপনি থেকে তুমিতে এসে গেছে।কোনো মেয়ের প্রতি এভাবে শারীরিক আকর্ষণ অনুভব করেনি কখনো আগে। হ্যাঁ, বলিউডি বা হলিউডি সিনেমা দেখে শরীরে উত্তেজনা খেলতো ঠিকই কিন্তু এভাবে হয়নি। নিজের মধ্যে পরিবর্তন গুলো ভালোই বুঝতে পারছে, কাজের ফাঁকে ফাঁকেই বিনীতার কথা মনে পড়ে, অনেক্ষন ধরে কথা বলতে ইচ্ছে হয়। বিনীতা যখন অভির ছবি চেয়ে পাঠায়, কমপক্ষে পাঁচবার চুল ঠিক করে, দশটা ছবি তুলে তবে একটা পাঠায়। আর বিনীতার যখন ইমপ্রেস হবার রিপ্লাই আসে, বা অফিসের বা শরীরের খোঁজ খবর নেয়, কিযে ভালো লাগে। বিয়ের তখন মাত্র মাসতিনেক বাকি, একদিন আদর করে হঠাৎ বিনি বলে ডেকে ফেলেছিল অভি, খুব লজ্জা পেয়ে বিনীতা বলেছিল -
---এই নামেই ডেকো, নামটা ভীষণ আদুরে
---আর যে নাম দিলো সে ?
---সেতো এখন বোঝার উপায় নেই, অপেক্ষা করতে হবে ... হি হি...
---উফফফ...এখনও তিনমাসের অপেক্ষা, এতো সহ্য হয় বলো?
---ও হো, তর সইছেনা বুঝি, তবে তুহিনা যে বলতো দাদা বিয়েই করতে চাইছিলো না
---চাইছিলাম না তো, তখন তো আর আমার জীবনে বিনি আসেনি, তর সইছে না, একদম না, এখনই তোমাকে কাছে টেনে ভীষণ আদর করতে ইচ্ছে হচ্ছে
---ইসস... ধ্যাৎ !

    সেই প্রথমবার বিনির জন্য নিজের সামসুঙের খাজা স্মার্টফোনটাকে চুমু খেয়েছিল।

    বিয়েটা ছিল পুরো রঙিন স্বপ্নের অধ্যায়, কত হাসি মজা, ইয়ার্কি ঠাট্টা আনন্দে ঝটপট করে কেটে গেল তিনটে দিন। আর ফুলসজ্জার রাতে বিনিকে নিজের মতো করে প্রথম কাছে পাবার আনন্দ, সেটা ছিল স্বপ্ন সত্যি হবার মতো। বিয়ের অনুষ্ঠানের ক্লান্তি আর ধকল থাকলেও একে অপরকে প্রথমবার ছোঁবার মারাত্মক শিহরণ সামলাতে রাখতে পারেনি দুজনের কেউই। অভির ইতস্ততা বুঝতে পেরে এক মুহূর্তে তা কাটিয়ে দিয়েছিলো বিনীতা। অভি সেই প্রথমবার হাত রেখেছিলো কোনো নারীর আবরণহীন শরীরে। বিধাতার অপরূপ সৃষ্টির নিখুঁত সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করেছিল স্বচক্ষে, প্রথমবার। নরনারীর পরস্পরের প্রতি আদিম অমোঘ শরীরী আকর্ষণ ও ক্রিয়ার সাক্ষী হয়ে থেকেছে দুজনে, বার বার, বহুবার।

    ক্রমে একসঙ্গে থাকারও প্রায় একবছর ঘুরে গেছে, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক ভালোবাসা, মান অভিমান, খুনসুটি আর ঝগড়াঝাড়ি মধ্যে দিয়ে সহজ থেকে সহজতর হয়েছে। শরীরের থেকেও মন আপন হয়ে গেছে বেশী। বিনি যখন জানালো ও পিরিয়ড মিস করেছে প্রায় দুসপ্তাহ আগে, প্রথমদিকে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল অভি। তারপর দুজনেই আশায় আশায় বুক বেঁধেছে, প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজেটিভ হওয়ায় খুশির যেন সীমা ছিল না, অফিস থেকে ফিরে অভি খুব আদর করেছিল বিনিকে। মা বাবা পরিবারের নিকত্মীয়েরা প্রাণ ভরে শুভেচ্ছা জানিয়ে ছিল বিনিকে। অভির মা তো বিনিকে খাওয়া দাওয়া আদর যত্নে ভরিয়ে দিয়েছিল। ভীষণ সাবধানী ছিল দুজনেই, ফার্স্ট ট্রাইমেস্টার, সাবধানে থাকতেই হবে।

    মিলনে সাবধানী হয়ে গেলেও অভি তো তখনও কতবার বিনিকে স্পর্শ করেছে, মাথা রেখে শান্তিতে শুয়েছে ওর নরম উন্মুক্ত বুকে। কেন যে আগে বুঝতে পারেনি যে বিনির নারীত্বের গর্ব দুটির একটিতে বাসা বেঁধেছে ক্যান্সার। সেভাবে খেয়াল করেনি দুজনের কেউই। একদিন রাতে বিছানায় এলিয়ে কথায় কথায় বিনি হাত তুলে আর্মপিটে হাত দিয়ে বলেছিল |
---দেখো তো... আমার এখানটা কেমন শক্ত শক্ত লাগছে |
---কই দেখি ? ... হ্যাঁ তো কেমন যেন ঢিলের মতো |
---দেখোনা অনেকদিন ধরেই নিপিল এ কিরকম ইচিং হচ্ছে, কেমন খসখসে হয়ে গেছে, রস কাটছে...
---প্রেগন্যান্সিতে অনেক কিছু সমস্যা হয়ে থাকে শুনেছি, একবার ডক্টরকে দেখিয়ে নেবো...
---কি জানি , আবার টিউমার হল না তো ?
---ধ্যাৎ ! তোমার না যত আজেবাজে চিন্তা, মাথা থেকে পা পর্যন্ত সুস্থ মানুষ, ওসব কেন হবে ? চলো কালকেই এপয়েন্টমেন্ট নিচ্ছি |

    গাইনোকোলজিস্ট ডক্টর ভট্টাচার্য সেদিন একটু গম্ভীর ছিলেন, বিশেষ কিছু বলেননি, শুধু ম্যামোগ্রাফি করবার কথা লিখে দিলেন। তারপর অভির ভালো মনে আছে রিপোর্ট হাতে পেয়ে হরমোন রিসেপ্টর ER - PR বোথ পজেটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সার দেখে দুজনেই পড়ি কি মরি করে ছুটতে ছুটতে ডক্টর ভট্টাচার্যর চেম্বারে এসে উপস্থিত হয়েছিল। বিনি কেঁদে যাচ্ছিলো অনবরত, অভি স্বান্তনা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যখন নিজের কানে শুনলো বিনির ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়েছে অ্যাডভান্সড স্টেজে অভি নিজেও দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। ডক্টর ভট্টাচার্য অবিলম্বে রেফার করেন ডক্টর গাঙ্গুলির কাছে। আপোয়েনমেন্ট পেতে তিনদিন দেরি হয়েছিল। টকটকে লাল চোখ নিয়ে বিনি বসে ছিল ডক্টর গাঙ্গুলির চেম্বারে, সমস্ত হিস্ট্রি শুনে আর রিপোর্ট দেখে ডাক্তারবাবু নিজেই যেন কথাটা ঠিক কিভাবে শুরু করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। কথাগুলো এখনও অভির কানে বাজে |

---ভীষণ আনফর্চুনেট সিচুয়েশন। ফার্স্ট প্রেগন্যান্সি, ফার্স্ট ট্রাইমেস্টার । টিউমারের যা স্টেজ দেখছি একে ছোট করতে হলে ওষুধের সঙ্গে কেমোথেরাপি দিতে হবে। কিন্তু এই সিচুয়েশনে তো দেয়া যাবে না, সেভেন উইকস তো... অসম্ভব। এই সময় বাচ্চার অর্গান তৈরীর আরম্ভ, কেমো নিলে বাচ্চা বিকলাঙ্গ হবে, আরো অনেক প্রব্লেম আসতে পারে। দেয়া যাবেই না, এক্ষেত্রে অপশন মাত্র দুটো বাচ্চাকে রাখতে গেলে ব্রেস্ট কেটে বাদ দিতে হবে আর নাহলে এবোর্ট করিয়ে কেমোথেরাপি ...

    ডক্টর গাঙ্গুলির কথাটা শেষ হবার আগেই মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল বিনি। অভি কোনো মতে ওকে ধরে ফেলে। বাড়িতে তখনও এই খবরটা জানায়নি কেউ। হাসিখুশি বিনির মুখ থেকে যেন হাসিতে বিদায় নিয়ে নিয়েছিল। অভি বিনিকে খুব ভালোবাসে, ওর কাছে যে আসছে তার থেকেও প্রিয় যে আছে। অনেক ভাবনা চিন্তার পর অভি বলেছিল এবোর্ট করিয়ে নিতে। কিন্তু মায়ের মন, ভূমিষ্ট হবার আগেও বাচ্চার সঙ্গে মায়ের যে কতটা এটাচমেন্ট থাকে সেটা বুঝতে পারেনি অভি। নিজের শরীরের মধ্যে একটা প্রাণশক্তিকে লালন করার যে ক্ষমতা ঈশ্বর আশীর্বাদ স্বরূপ নারীদের দিয়েছেন তার মহত্ব উপলব্ধি অনেকেই করতে পারেনা। অভিও সেভাবে পারেনি, তাই বার বার বিনিকে বলেছে তোমার আগে সুস্থ হওয়া দরকার, তোমাকে হারাতে পারবো না, এবোর্ট করিয়ে নাও, তুমি সুস্থ হলে আবার চেষ্টা করবো আমরা। বিনি পাথরের মতো শুধু শুনে গেছে, ও যে স্বপ্নেও এই ঠান্ডা মাথার খুনের কথা ভাবতে পারেনা।

    বাড়িতে একসময় জানাতেই হতো। মা বাবাদের জানানোর পর বিনীতার ওপর মানসিক চাপ আরও বেড়ে গেল। একদিকে অভির মা বাবা একদিকে বিনির মা বাবা সবাই মর্মাহত হয়ে গেলেন। কান্নাকাটি, মনখারাপ মিলে সবকিছু দুঃস্বপ্নের মতো লাগছিলো অভির, মনে মনে নিজেকে যেন আশ্বাস দিচ্ছিলো, ঘুম ভাঙলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। অভির মতে বাড়ির সবাই সায় দিল। সুদীপ্তা দেবী... যিনি নাতি নাতনির আশায় আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন তিনিও কাঁদতে কাঁদতে বিনিকে বলেন রাজি হয়ে যা মা। অভি আঁতকে উঠেছিল বিনির মতো বাস্তববাদী মেয়ের মুখে এরকম উত্তর শুনে,
---ওকে যদি মারতেই হয় মা, তাহলে আমি নিজেই বিষ খেয়ে শেষ হয়ে যাব

    অবশেষে বিনীতার ইচ্ছা মেনেই ডক্টর গাঙ্গুলি সম্মতি দিলেন সিঙ্গেল ম্যাসেকটোমিতে। এক্সিলারি লিম্মফ নোডের সঙ্গে বাদ পড়লো বিনির বাঁদিকের স্তন।

    ট্রিটমেন্ট, কাউন্সেলিং এর জন্য বিপুল টাকা দিতে দিতে টান পড়েছে দুই পরিবারের সেভিংসে, তবু সবাই চেষ্টা করে যাচ্ছে যাতে ভালো থাকে বিনীতা।
হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর থেকে ওর বিনিকে শুধু চোখের সামনে ক্ষয়ে যেতে দেখেছে অভি । পোস্ট সার্জারি নিয়মকানুনগুলো মানতে মানতে যেন হাপিয়ে উঠেছিল । বেশিরভাগ সময়ই কেমন আনমনা থাকতো, অভি জোর করে মন ভালো করা গান চালিয়ে দিত, বিনি চুপচাপ শুয়ে শুনতো। বইয়ের পাতা খোলাই রয়ে যেত, বিনির উদাসীন দৃষ্টিটা হারিয়ে যেত কালো হরফের মাঝে অন্যকোথাও। প্লেটে কেটে রাখা আপেলটুকরোগুলো মলিন হয়ে রয়ে যেত।
বিনির শারীরিক পরিবর্তনের কারণে এই মানসিক পরিবর্তনটা ভালোই বুঝতে পারতো অভি, ওর সাথে কোনো পরিচিত মহিলা দেখা করতে এলে ও একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে তাদের বুকের দিকে। অভি পাশে বসে হাত ধরলেও কেমন কুঁকড়ে যায়। ঘুম ভেঙে উঠে একদিন অভি দেখেছিল, বিনি আয়নায় একদৃষ্টে চেয়ে আছে নিজের অনাবৃত বুকের দিকে, একহাত বুকের বাঁদিকের লম্বা কাটা দাগটায় আর একহাত পেটের ওপর। অভি উঠে এসে বিনিকে একটু আদর করে আশ্বাস দিতে চেয়েছিলো। বিনি তাড়াতাড়ি বুকে চাপা দিয়ে বলে উঠেছিল
---আমাকে ছুঁয়োনা অভি, আমার আর তোমাকে কিছু দেবার নেই, আমার শরীরে খুঁত হয়ে গেছে।
কথাটা শুনে অভির ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। অভি নিজেও জানে ওদের সন্তান পৃথিবীতে আসার পর হয়তো সবকিছু স্বাভাবিক হবে না। বিনির সঙ্গে ওর শারীরিক সম্পর্কও সম্পূর্ণভাবে আগের মতো হবে না, তবু বিনিকে ও মন থেকে ভালোবাসে। বিনির শরীরটাই যে ওরকাছে সব নয় এটা অনেক অনেকবার বুঝিয়েছে অভি, হয়তো বুঝতে চায়না বিনি, ভাবে অভি করুনা করছে ওর ওপর।

    শারীরিক ভাবে দুর্বল ও মানসিকভাবে বিধস্ত থাকায় বিনির প্রেগন্যান্সিতে কমপ্লিকেশন ছিলই। আজ বিকেলে বিনির হঠাৎ প্রচন্ড ব্যাথা ওঠায় এমারজেন্সিতে ভর্তি হতে হয়। ডক্টর ভট্টাচার্য সব দেখে আর রিস্ক নিতে চাননি। ইমিডিয়েটলি সি সেকশনের জন্য ওটি রেডি করার নির্দেশ দিয়ে অভিকে বলেছিলেন
---আমাকে ঈশ্বর যতটুকু ক্ষমতা দিয়েছেন তাতে আমি গাছ আর ফল দুটোকেই বাঁচাবার চেষ্টা করবো। প্রার্থনা করো আমাকে যেন ঈশ্বর এই কঠিন পরীক্ষার মধ্যে না ফেলেন।

    অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার সময় বিনির চোখের ওই শুন্যদৃষ্টি আর নিঃশব্দে জল গড়িয়ে পড়াটা অভির চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছে। বিনির নিস্তেজ হয়ে আসা শরীর যেন সমস্ত লড়াই থেকে মুক্তি পেতে চায়। ওর নিঃশব্দ কান্না দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি অভি। ভেজা চোখে বিনির হাতটা মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে বলেছিল- "মনের জোর হারিয়ে ফেলো না বিনি, আমি আছি তো তোমার সঙ্গে, দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে, আমরা দুজনে মিলে আমাদের সন্তানকে মানুষ করব, শুনলে বিনি, তুমি আমি দুজনে..." তারপর একটা কিচকিচ শব্দ তুলে স্ট্রেচারটা ওটিতে ঢুকে যায়।

    সেই মুহূর্তে বিনিকে প্রানভরে আশ্বাস দিলেও অভি নিজের মনকে কিছুতেই স্থির রাখতে পারছে না। অতীতের হেসে খেলে কাটানো মুহূর্তগুলোকে ঢেকে দিয়ে কালো মেঘের মতো ক্রমশ জমাট বাঁধছে ভয় - এতদিনের কঠিন লড়াই শেষে হেরে যাবার ভয়, পৃথিবীর আলো দেখার মুহূর্তে ওদের ভালোবাসার সন্তানকে বিদায় জানবার ভয়, ওর আদরের বিনিকে চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেলার ভয়। না না আর ভাবতে পারছে না, শরীরের সমস্ত শক্তি যেন ফুরিয়ে আসছে। অন্তরের অস্থিরতা, আশঙ্কা, মানসিক চাপ যেন শুষে নিচ্ছে সবকিছু। দেয়ালে মাথা ঠেকায় অভি, একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে, চোখ বুজে আসে।

    এভাবে কতক্ষণ অপেক্ষা করেছে অভির তা খেয়াল নেই। কাঁধের মধ্যে একটা হাতের স্পর্শ পেয়ে অভি চোখ খুলল, বিনির বাবা ডাকছেন। অপারেশন থিয়েটারের লাল আলোটা নিভে গেছে। অভি তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করল, পারছেনা। হাত পা ভীষণ ভারী হয়ে গেছে, হাজার চেষ্টাতেও নিজেকে টেনে তুলতে পারছে না। 'অভি এস', 'অভি আয়' ডাক শুনতে পাচ্ছে। দেহের কোনায় কোনায় ভিড় করেছে এ কেমন অপ্রতিরোধ্য ক্লান্তি। অভি দেখতে পাচ্ছে বাবা মায়েরা ছুটে চলে গেল অপারেশন থিয়েটারের দরজার কাছে। ডক্টর ভট্টাচার্য এক সদ্যোজাতকে কোলে নিয়ে অপারেশন থিয়েটার থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন। রক্তমাখা একটা ছোট্ট প্রাণ প্রানপনে চিৎকার করে নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। সেই কান্নার আওয়াজটা নিস্তব্ধ বাতাসে তরঙ্গ তুলে এসে পৌঁছায় অভির কানে।

    অভির চোখের দৃষ্টিটা হঠাৎ কেমন ঝাপসা হয়ে যায়, সেই ঝাপসা দৃষ্টিতে ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে একটা দৃশ্য-
বিনি উন্মুক্ত বক্ষে তার নাড়ি ছেঁড়া ধনকে স্তন্যপান করাতে ব্যস্ত, ফুটফুটে সদ্যজাতটিও চোখবুজে তার মায়ের স্নেহরসে মগ্ন। অনেকদিন পর ওর বিনি হাসছে, সেই মন ভরিয়ে দেয়া নির্মল হাসি। বুকের অপরপাশে কাটাদাগের খুঁতটা তখনও স্পষ্ট। অভির অন্তরের সব ভয় আর আশঙ্কার কালো মেঘ সরিয়ে একচিলতে আলোর মতো ধীরে ধীরে একটা অদ্ভুত শান্তি, তৃপ্তি নেমে আসছে, এতো সুন্দর, এতো পরিপূর্ণ, এতো নিখুঁত সে দৃশ্য!

সমাপ্ত


Pallabi Paul