তপাশ্রী ব্যানার্জী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
তপাশ্রী ব্যানার্জী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

এ ভূত সে ভূত নয় - তপাশ্রী ব্যানার্জী

 

এ ভূত সে ভূত নয়

 তপাশ্রী ব্যানার্জী
 

     ছোটবেলা থেকেই আমি ঠাকুমা দাদুর কাছে অনেক গল্প শুনেছি, যেমন পরী,রাজপুত্র আর রাজা রাণীর কত কী ! কিন্তু ভূতের গল্প বলতে বললেই দাদু বলতো ,"না বলবো না ,শুনলে তোদের ভয় লাগবে |" আমরা বলতাম ,"কেন ! ভূত কী আছে নাকী যে ভয় পাব ?" শুনে দাদু বলতো ,"আমি তো দেখেছি ! কী করে বলবো ,নেই | তবে এখানে মানে কোলকাতায় থাকে না মনে হয় ! কারণ এত লোকজন আর চারিদিকে যা বাড়িঘর ভর্তি !" এবার ঠাকুমা শুনে তো খুব রেগে গিয়ে দাদুকে বকতে লাগল ,"ওসব কথা ছেলেপুলেদের বললে এখন রাতদুপুরে ভয় পাবে ,তারপর জ্বরটর না এসে যায় |" একথা শুনে আমরা দুই ভাইবোন আরও উৎসাহের সঙ্গে দাদুকে বলতে লাগলাম ,"বলোই না দাদু ,দেখি আমরা ভয় পাই কিনা !" তবে তখন আর শোনা হল না বটে ,দাদু কথা দিল ; একদিন ঠাকুমা না থাকলে আমাদের বলবে | অগত্যা আমরাও অপেক্ষারত রইলাম |

     এরপর বর্ষাকালে একদিন খুব বৃষ্টির জন্য স্কুল বন্ধ থাকায় আমরা ভাইবোন বাড়িতে | ঠাকুমাও সেদিন রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত দেখলাম ,সেই সুযোগে দাদুকে নাছোড়বান্দা হয়ে ধরলাম ,আজ বলতেই হবে | অন্যদিন স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যায় ,তারপর সন্ধ্যেবেলা যথারীতি স্কুলের পড়া থাকতো ,আর তা চলতো রাত পর্যন্ত | এরপর দাদু অভ্যাসবশতঃ তাড়াতাড়ি নিদ্রা দিতো ,তাই আর হয়ে উঠতো না গল্প শোনা | আজ যখন সুযোগ পাওয়া গেছে কোন মতে তা ছাড়ার নয় | এদিকে দাদুও ভয় পাচ্ছে ,যে ঠাকুমা পাছে ধরে না ফেলে | তাই আমরা ছাদের চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে শুনবো বললাম | কিন্তু দাদু বেশি সিঁড়ি উঠতে চাইতো না বয়স হয়েছে বলে ,তবুও আজ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাদু রাজী হলো আমাদের কথামত |

     এরপর আমরা ছাদে খেলা করবো ,আর দাদু আমাদের পাহারা দেবে যাতে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে পড়ে না যাই - এই ফরমাশ মত বিল পেশ হলো ঠাকুমার কাছে | আর পাশ হলো ঘন্টাখানেকের জন্য | কেননা একে বৃষ্টি হচ্ছে ,ছাদ তাতে পিছল হয়ে গেছে | যদিও আমরা চিলেকোঠা ঘরে থাকবো বললাম ,বাইরে বেরোব না | "যথাআজ্ঞা" বলে উপরে উঠলাম | এবার শুরু করলো দাদু গল্প বলা | আসলে দাদু পূর্ববঙ্গের কুমিল্লা জেলার লোক ছিলেন | আর ঠাকুমা ছিলেন ঢাকা জেলার ,ওখানের মহিলাদের রান্নার সুখ্যাতি সারা বাংলাদেশের লোকের মুখেমুখে | দাদুর বাড়ি ছিল মেঘনা নদীর তীরে আর ঠাকুমার বাড়ি ছিল পদ্মা নদীর তীরে - গল্পে শোনা | বাংলাদেশের দুই বিখ্যাত নদীর কথা সবজনজ্ঞাত আর নদীর মাছ ও ছিল তেমনই খ্যাত | এছাড়া ইতিউতি পুকুর খালবিল তো ছিলই | তাই দাদু খুব খেতে ভালোবাসত ,সে সময় জিনিস ছিল সস্তা আর খাবারের স্বাদ ছিল একেবারে অনবদ্য | গ্রামের বাড়িতে জমিতে চাষ করা সবজি আর পুকুর ,নদীর থেকে জালে বা ছিপে তোলা মাছ আসতো প্রচুর | দোকান বাজার বলে তো কিছুই ছিল না তেমন ,যা ছিল একমাএ হাট ,তাও সপ্তাহে যেদিন বসতো ,সেখান থেকে যার যা লাগতো এনে গচ্ছিত রাখতে হতো ঘরে | কিন্তু যারা খেতে ভালবাসতো তাদের কি আর চলে একটু ভাল মন্দ না হলে ! তাই মাঝে মাঝে হাট থেকে এটা ওটা নিয়ে আসতো দাদু খাওয়ার জন্য ,যা রান্না করতে হতো ঠাকুমাকে | যেহেতু তখন অত গাড়ি ছিল না ,তাই হাঁটা পথেই ছিল বেশিরভাগ চলাফেরা |

     বর্ষাকালে মাঝে মাঝে প্রায় টানা বৃষ্টি চলতো | এমন একদিন হাটবারে বৃষ্টি হচ্ছে ,যদিও মাঝে মাঝে থামছে আবার হচ্ছে ,আর তাতে পথঘাট হয়েছে জলে থৈ থৈ | কাজেই কেউ আর বাড়ির বাইরে বের হচ্ছে না বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া | কিন্তু সেদিন হাট বার বলে কিছু দরকার হলে তাকে তো বের হতেই হবে ,যদিও হাটে সেদিন বেশি পসার হবে না জলের জন্য | আর বর্ষাকাল মানেই ইলিশ মাছ ,তার লোভ কি আর ছাড়া যায় ! বিশেষ করে যারা ভোজনরসিক ! এদিকে এত জল জমেছে যা ,সব দিক দিয়ে যাওয়াও যাবে না ,আর ঠাকুমা তাই ঘরের যা ছিল তাই দিয়েই কদিন চালিয়ে নিচ্ছে | বেশি জলে তো জাল ফেলাও যায় না পুকুরে ,তাই মাছ ছাড়াই খাওয়া চলছে | দাদুর হয়েছে শিয়রে সংক্রান্তি | যদিও মেঘ ডাকলে নাকী উঠোনে কই মাছ লাফিয়ে চলে আসতো ,তা ঝুড়ি দিয়ে ধরে নিত | সেটা দৈবাৎ হলে হয়। দাদুর হুঁকোর তামাক শেষ ,তাই সব ভাবনা ফেলে ওটা আনতে হাটে যেতে হবে বলে বেরিয়ে গেল |

      চারিদিক জলমগ্ন ,তাই পথঘাট জনশূন্য ,ওদিকে একটা বাগানের পথ আছে কদাচি কেউ কেউ যায় দরকার পরলে ,নচেৎ নয় | যদিও পথটা বেশ দীর্ঘ কিন্তু বাগান থাকায় বেশ উঁচু, তাই একটু জল কম জমে | দাদু তাই সেই পথটাই ধরলেন | বাগানে প্রায় শ-খানেক আম কাঁঠালের গাছ তাতে চারদিক ঘেরা আর মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে সাপের মতো লম্বা লম্বা পথ চলে গেছে দূরে | পাতার ঘনত্বের জন্য আর মেঘলা আকাশ এই দুয়ের মেলবন্ধনে পথ হয়েছে বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন | ঘড়ির সময় না জানলে সেটা দিনেরবেলা বলে বোঝা বেশ শক্ত | বেশ কিছুটা পথ যেতেই দাদু লক্ষ্য করলো কে যেন তার পিছু নিচ্ছে ,কিন্তু বর্ষার জলে আর পায়ের ছপাৎ ছপাৎ আওয়াজে মনে করলো বুঝি নিজে ভুল ভাবছে | কেননা পথটাও বেশি স্পষ্ট নয় ,ভেবেছিল এদিক দিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি হাটে পৌছানো যাবে ,আবার ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি ,মানে কখন বৃষ্টি শুরু হবে ,তাই আর কি | এ পথে দিনের বেলা হলেও খুব একটা মানুষ ঢোকে না, কারণ এই বাগানের পথ শেষ হলে শুরু হবে আরও একটা বাগান ,তার ওপর দিয়ে গিয়ে তবেই হাটের পথটি পাবে |

     পথটি আছে বট অশ্বত্থ আর বেশ কয়েকটি পাকুড় শিমূল গাছে ভরা | আর আছে একটা বিশাল তেঁতুল গাছ ,তাতে বড় বড় ছড়া ভরা তেঁতুল পেকে মাটিতে পড়ে থাকলেও কেউ বড় একটা তুলতে আসে না | কি জানি সবাই বলে ,এই গাছে নাকী পেত্নীর বাসা | তাই পারতপক্ষে এ পথে মানুষের পা পড়ে না বললেই চলে | আর আজ দাদুকে যেতে হবে সেই পথ ধরেই ,কেননা ঢুকে যখন পরেছে এখন আর উপায় নেই | এদিকে আমরা তো জড়োসড়ো হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলতে লাগলাম ,"ও দাদু তুমি কি পেত্নীকে দেখেছো নাকী !" যেই না বলা ,অমনি দাদু বলল ,"দেখলি ভয় পাচ্ছিস তো দিদিভাই !এই জন্য বলি শুনতে হবে না | অন্য গল্প বলি |" অমনি ভাই আমার চেয়ে দু বছরের ছোট হলেও বেশ সাহসী ছিল ,তক্ষনি বলে উঠলো ,"না দাদু আমি ভয় পাচ্ছি না ! বলো শুনবো |" আবার গল্প শুরু হলো--এরপর দাদু কি আর করবে যেহেতু ঢুকে পড়েছে ,তাই জল কম থাকায় এই পথ দিয়েই যাবে বলে এগিয়ে গেল | আবার শুনতে পেল সেই পায়ের আওয়াজ ,মনে হচ্ছে কেউ যেন পিছু পিছু হাঁটছে | মন শক্ত করে ঠাকুরের নাম স্মরণ করতে করতে এগিয়ে গেল | এবার তেঁতুল গাছটার কাছে যেতেই ,শুনতে পাচ্ছে, কে যেন হাসছে ! কি আর করবে ,এবার আরও জোর লাগিয়ে এগিয়ে গেল ,যদিও সেদিন একটু ভয় পাচ্ছিল বটে | লোকমুখে শুনেছিল , ঐ তেঁতুল গাছটায় একটা পেত্নী থাকে ,তবে কাউকে কোনদিন তেমন কোন ক্ষতি করে নি | যদিও এর আগে চাক্ষুস করার সৌভাগ্য হয় নি দাদুর ,ভাবল আজই তবে প্রথমদিন | মনে মনে ভাবল ,ফেরার সময় অন্য পথ ধরে ফিরবে |

      এরপর কি আর করা ,ঠাকুরের নাম জপতে জপতে বেশ জোরে জোরে বাকী পথটাও এগিয়ে গিয়ে হাটের পথ ধরল | ততক্ষণে দু একজন লোকের দেখা পেয়েও গেছেন | যাক্ মনে মনে ভাবলেন ,এখনকার মতো ফাঁড়া কেটেছে | এবার হাটে গিয়ে হল একটা মিরাক্কেল ,যেহেতু জলের কারণে লোকজন কম ,তাই বিক্রীবাট্টাও কম ,এদিকে ভয় আবার কখন বৃষ্টি নামবে ,তাই ইলিশের জোগান থাকলেও ক্রেতার অভাবে সেদিন প্রায় অর্ধেক দাম পড়েছে অন্যদিনের তুলনায় | দাদু আর লোভ সম্বরণ করতে না পেরে ,বড় বড় দুখানা ইলিশ কিনে নিলেন | কিন্তু পকেটে পয়সায় টান ধরলো এমন ,যার জন্য আর অন্য কিছুই নিলেন না | দু-হাতে দুখানি ইলিশ ঝোলাতে ঝোলাতে বাড়ি আনবে ভেবে খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠল | এমন সময় বাড়ি ফেরার কথা ভাবতেই ,দাদু একটু আতঙ্কিত হয়ে পড়লো |

     কিভাবে ফিরবেন ,অন্য পথ ধরে ! তা আরও খানিক দূর হবে ,সেখানে কতো না জল হয়েছে ! ফিরতে না সন্ধ্যে হয়ে যায় -- এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ পেছন থেকে একজন এসে বলে উঠলো ,"কিরে যোগেশ ,ভালই তো মাছ দুখানা নিয়েছিস ,তা কত আনা পড়ল ?" একথা শুনে, দাদু পিছন ফিরে দেখে তার বন্ধু মহেম ! দেখে যেন দাদু সম্বিত ফিরে পেল | 'এরপর সেও ফিরবে হাটের কেনাকাটা হয়ে গেছে'--শুনে একসঙ্গে রওনা দিল ,আর কিছুটা এগোতেই দাদু বলল বাগানের পথে না গিয়ে অন্য পথে যাবে | কিন্তু মহেম দাদুর বাড়ি বাগানের পথ দিয়ে গেলে আগে পরবে বলে ,সে ঐ পথেই ফিরতে চাইল | যদিও সে পেত্নীর কথাটা জানতো ,তবে বলল "দুজন আছি তো ,চল না !দেখি ,পেত্নী কি করে !" এই বলে হাঁটা লাগালো দুজনে | ক্রমে বাগানের পথ চলতে চলতে বেশ কিছুটা গিয়ে একটা বাঁক নিলেই মহেমে দাদুর বাড়ি কাছেই পড়বে | আর সেখানে জলটাও বেশ কম থাকায় সে বললেন ,"আমি যাই যোগেশ, ওদিক দিয়ে ,আর অনেকটা তো এসে পরেছি ,তুই পারবি তো একলা যেতে !" দাদু কি আর বলবে ,অগত্যা বলেই দিল ,"ঠিক আছে |"

     এরপর একা একাই হাঁটতে লাগল ,সেই বাগানের পথ ধরে | যদিও ততক্ষণে তেঁতুল গাছের পথটা ফেলে রেখে এসে পড়েছে সেই আম কাঁঠালের বাগানের পথে | হঠাৎ একটা সুন্দর গন্ধ অনুভব করল দাদু ,আর মনে মনে ভাবল সামনে বুঝি কোন চাঁপা ফুলের গাছ রয়েছে ,তার থেকে এমন সুমিষ্ট গন্ধ ভেসে আসছে | তারপর আর একটু এগোতেই দাদু শুনতে পেলো কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে আর বলছে," কিরে মাছগুলো তো বেশ কিনলি ,তবে কি একাই খাবি !" দাদু এবার বেশ বুঝতে পারল ,কেউ ওনার পিছু নিয়েছে -- তাই আর ভয় করে লাভ নেই ,এখন মনে জোর নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে | কোন উওর না দিয়ে কিছুদূর যেতেই কে আবার বলে উঠল," কি রে ! কত দিয়ে কিনলি মাছগুলো ,বেশ দেখতে হয়েছে |" এবারও দাদু কোন উওর দিল না ,আর বেশ বুঝতে পারল ,ঐ পেত্নীই তার পিছু নিয়েছে | যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি যেতে পারলে বাঁচে এযাত্রায় আর কী | এদিকে পথটাও বেশ লম্বা ,শেষ হতে এখনো বেশ কিছুটা বাকি | আবার কাউকে ডাকবে তারও উপায় নেই ,কারণ বাড়িঘর কাছাকাছি নেই বললেই চলে | যা আছে তাও অনেক দূরে ,কাজেই ডাকলে কোন সারা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই | বিপদ বুঝে দাদু নিজেকে একাই রক্ষা করতে হবে ভেবে ,যতটা সম্ভব জোর লাগিয়ে হাঁটতে লাগল |

      এদিকে মাছগুলোও বেশ বড় আর ভারী ,তাই পিছলে যাচ্ছে ,এতোটা পথ যেতে হবে আগে বুঝতে পারে নি | আর ঠাকুমার ভয়ে তাড়াতাড়ি বেরোতে গিয়ে ব্যাগ বা ঝোলা কিছুই নিয়ে আসতে পারে নি | তাছাড়া ভাবতেই পারে নি আজ এমন সুযোগ পাবে যে দু -দুটো ইলিশ কিনতে পারবে | মনে মনে ভাবল ,"অতি লোভে তাঁতী নষ্ট --- যারে কয়।" আর ভাবতে লাগল ,এবার প্রাণের দায়ে মাছগুলো না পেত্নীর পেটে যায় ! আর কী ! যেমনি ভাবা ! অমনি সামনে কি একটা পড়ে ছিল ,ঠিক ঠাওর করতে না পেরে ,দাদু হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলালো ঠিকই ,কিন্তু মাছগুলো গেল হাত থেকে পড়ে | আর মাছ গুলো যদি জলে ভেসে যায় দূরে ,তাই ভেবে দাদু তড়িঘড়ি সে দুটিকে খপাৎ করে ধরতে গিয়ে নিজের ধুতির কিছুটা অংশ দিল ভিজিয়ে | আর তা দেখে হি হি করে বিদ্যুতের গতিতে কে যেন হেসে উঠল | এবার দাদুর খুব রাগ হল | ভাবল যদি সামনে পেতাম তাহলে কষিয়ে দিতাম দু-চারটে গালে বসিয়ে | তা তো আর হবার নয় ,তাই মনের আশা মনেই রেখে ,আবার এগিয়ে চলল ,জল কেটে কেটে বাড়ির দিকে |

     এদিকে মেঘলা দিন বলে সূর্যের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না ,তাই সময়টাও বুঝতে পারছে না | ভাবল বুঝি বাড়ি ফিরতে আজ সন্ধ্যে গড়িয়ে যাবে ,আর ঠাকুমা এই মাছ দেখে কি না কুরুক্ষেএ শুরু করবে | ভাবনাই সার হল ,ঘড়ি সঙ্গে না থাকায় সময়টাও বোঝা গেল না | এখন মাছগুলোও কাউকে দিতে পারবে না যে রক্ষা পাবে | কাজেই যা আছে কপালে দেখা যাবে ,এই ভেবে এগোতে লাগল বাড়ির দিকে | এবার এগোতেই আবছা আলোতে সামনের দিকে কি যেন একটা সাদা মতো ঝুলছে দেখে কৌতুহল হল ,কোন কাপড় কি উড়ে গাছের ওপর এসে পড়েছে নাকী ! যদিও স্পষ্ট তেমন দেখতে পাচ্ছে না ,আর একটু এগোলে বোঝা যাবে | এদিকে এ পর্যন্ত শুনে আমার তো তখন হাত-পা ঠান্ডা হবার জোগার ,আর ভাই দেখছি আমার গায়ের কাছে এসে বসে আমার হাতটা চেঁপে ধরে রেখেছে | যদিও আমি ভীষণ ভীতু ছিলাম ,ছোট বেলায় ভূতের নামেই ভয় পেতাম | তাই ভাবতে লাগলাম এখন তো দিনের বেলাতেই এই অবস্থা ,আর রাতে না জানি কী হবে আমাদের ! আজ নির্ঘাত একটা কান্ড হবে বাড়িতে ,এই ভেবে মনে মনে ভয় হতে লাগল | ঠাকুমা দাদুকে বারণ করেছিল এ গল্প শোনাতে ,আর যদি তেমন কিছু হয় ,তাহলে বাড়িতে আজ একটা দক্ষযক্ষ বেঁধে যাবে | ভাবলাম ,যা কিছু হয় হোক ! গল্পটা থামানো যাবে না ,শেষটা কি হয় জানতেই হবে | তাই মন শক্ত করে বসে রইলাম দুজনে দাদুর পাশে | আর দাদু যাতে ঘুণাক্ষরেও আমাদের ভয়ের কথা কিছু টের না পায় ,তাই দাদু একটু থামতেই, বলতে লাগলাম ,"তারপর কি হলো দাদু ,বলো !" দাদু বলল ,"ওরে একটু জল খেয়ে নি ,গলা যে শুকিয়ে আসছে ! "

     আসলে দাদু ছিলেন স্বল্পভাষী ,আর গল্প বলতে বেশ বকতে হয় একটানা ,তাই জল খেয়ে নিয়ে বললেন ,"কিরে ভয় লাগছে ,তাহলে আজ থাক এ পর্যন্ত !" আমরা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম দুজনে, - "না ; না ; আজ বলতেই হবে তোমাকে সবটা |" ওদিকে সময় কতো হয়েছে ,তা দেখতে দাদু একবার বাইরে গিয়ে দেখে এলো | তখনকার দিনের মানুষ তো দাদু ,তাই সূর্যের আলোর গতি প্রকৃতি দেখে বুঝতে পারতেন সহজে টাইম কত হয়েছে | যদিও তখন বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল অল্প সল্প | আবার কখন নিচের থেকে দুপুরের খাবার জন্য ডাক আসবে ,তা ভেবে দাদু ছট্ পট্ গল্পটা শেষ করতে চাইলো | পাছে ঠাকুমার কাছে না ধরা পরে যান ,তার চিন্তাও রয়েছে | তাই আর দেরী না করে শুরু করলো বলতে | "কোথায় যেন শেষ করেছি ,বলেই --- ও মনে পড়েছে সেই সাদা কাপড়ের মতো কি একটা দেখলাম তাই তো !" আমরা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম ,"হ্যাঁ -- তাই |" --- এবার একটু এগোতেই দাদুর কাছে তা স্পষ্ট হলো ,একজন গাছের মগডালে দুটো পা ঝুলিয়ে বসে আছে ,তবে শরীরটা তেমন দেখা যাচ্ছে না | দাদুকে আবার তার নিচ দিয়েই যেতে হবে ,ভাবল আজ বুঝি পরাণটা এই পেত্নীর হাতে দিতে হবে | এই ছিল কপালে -- শেষে কিনা পেত্নীর খপ্পড়ে পড়া গেল ! মনে মনে ভাবল ,ছেলেবেলা থেকে দাদুও অনেক গল্প শুনেছে ভূতের ,কিন্তু বিশ্বাস করলেও কখনও চাক্ষুষ প্রতক্ষ্য করে নি ,আজ বুঝি সেই দিন এসেছে জীবনে | তাই দেখেও না দেখার ভান করে ,ভাগ্যের উপর প্রাণটা ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে চলল জলা পথ ধরে | ভাবল যদি ভগবান সাথ দেয় ,তাহলে আর কিছুটা গেলেই আজকের মতো প্রাণে বেঁচে যান আর কী ! যতটা সম্ভব জোরে চেষ্টা করল এগোতে | আর মাঝে মাঝে শুনতে পাচ্ছিল হি হি করে কে যেন হাসছে ,আর একটু এগিয়ে পিছনে ফিরে দেখলো দূরে দেখা যাচ্ছে পাদুটো তখনও কে যেন গাছের ওপর থেকে দোলাচ্ছে | যদিও ততক্ষণে দাদু অনেকটা পথ এগিয়ে চলে এসেছে বাড়ির কাছে | আর কিছুটা গেলেই বাগানের পথ শেষ হবে ,এই ভেবে যেন গলদঘর্ম অবস্থা থেকে প্রাণে একটু স্বস্তি পেল |

      এরপর আর একটু যেতেই পাশের বাড়ির একজনের সঙ্গে দেখা ,সে বাগানের একদম সামনে থেকে কি যেন তুলতে এসেছে | দূরে ওদিকে কয়েকটি বাচ্চা বাগানের সামনে কি যেন খেলা করছে | আসলে বৃষ্টি যে অনেকক্ষণ বন্ধ আছে ,ঘরে আর কতক্ষণ বন্দি থাকা যায় ! এসব দেখতে দেখতে দাদু বাড়ি পৌঁছালো আর কী | বাড়ি ফিরে দাদু যেন একটু হাঁফাতে লাগলো ,তা দেখে ঠাকুমা কিছুটা ভয় পেল বটে | তবে মাছ দুটো দেখে যেমন রাগ হবার ছিল তেমন কোন প্রভাব দেখালো না - দাদুর হাবভাব দেখে | তড়িঘড়ি ছোট পিসি দাদুকে এক গ্লাস নুন চিনির জল দিয়ে বিশ্রাম নিতে বললো | বেলা দ্বিপ্রহর হয়েছে - মাছগুলোর সদগতি করতে হবে বলে ঠাকুমা উদ্ধত হয়ে পড়লো | কেটেকুটে রাখা ,আবার রান্না করে কিছুটা হলেও পাতে ফেলতে হবে তো ! এতো জলের মধ্যে দিয়ে এতোটা পথ গিয়ে যখন এনেছে ! তাই আর দেরী না করে সেই কাজটা করতে লাগল | ভাবল যা বলার পরে বলবে ,খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে |

      এদিকে বেলা গড়িয়ে যাবে ,এই ভেবে বড় পিসিকে বললেন উনুনে আর একটু কাঠ গুঁজে দিতে ,যাতে নিভে না যায় | আর ভাবলেন এখনকার মতো কিছুটা ভাজা দিয়েই সারবেন | পরের দিন সর্ষে বাটা আর বেগুন দিয়ে ঝোল যা হয় করবেন | রান্না ঘরটা টালির চালের ছিল ,তাই কাঠের ধোঁয়া বেরোবার জন্য জানালা ছিল | যদিও সবসময় একটা জানালা খোলা থাকে কিন্তু আজ বৃষ্টির জন্য বন্ধ করে রেখেছিল | এখন বেলা হয়ে গেছে আর অন্ধকার হয়েছে বলে বাগানের দিকেরটা ,যেটা দিয়ে দূরে বাগানটা দেখা যায় খানিকটা ,আজ সেটাও খুলে দিতে হল ,কারণ তখন তো ইলেকট্রিক লাইট ছিল না ,যা ছিল কেরোসিনের লম্ফ, কুপী আর প্রদীপের আলো | কেরোসিনের অভাব ছিল যোগানে ,তাই মানুষেরা দিনের আলোয় যতটা কাজ করা যায় ,তা করে রাখতো |

      এদিকে মাছ ভাজতে শুরু করেই ঠাকুমা দেখছে ,কে যেন জানালার সামনে কি একটা ছায়ার মতো আড়াল থেকে দেখছে | প্রথমে অতটা কিছু ভাবল না , কিন্তু ক্রমে ছায়াটা স্পষ্ট হচ্ছে মনে হল | তবু ভাবল গাছের জন্য এমন হতে পারে ,তাই ভেবে কাজে মন দিল | এর পর কে যেন নাকী নাকী সুরে দাদুর নাম ধরে ডাকতে লাগল ,শুনে ঠাকুমা কিছুটা হকচকিয়ে উঠল ,ভাবল এভাবে কে ডাকছে ! আর দরকার পরলে বাড়ির সামনের দিকেই বা কেন গিয়ে ডাকছে না ! এক সময় ছোট পিসিকে ডেকে বলে দিল ,"দেখ তো খুকী ,তোর বাবাকে কে ডাকচ্ছে মনে হচ্ছে !" দাদু এবার কথাটা শুনে মনে ভাবলো ,আবার কি হলো ,বলে বাইরে বেরিয়ে দেখে এলো | কিন্তু কাউকে দেখতে পেলো না | বাধ্য হয়ে ঘরে ফিরে যেতেই আবার ঠাকুমার গলা শুনতে পেলো ,এবার ভাবলেন ,পাঁকঘরে গিয়ে দেখি তো ,ব্যাপারটা কি হয় ! বলে কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই লক্ষ্য করলেন একটা ছায়া জানালার ওপারে ঘোরাঘুরি করছে আর মাঝে মাঝে কি যেন নাকী সুরে বলছে | এদিকে গল্প শুনতে শুনতে ভাই দেখলাম চোখ বুঁজে আছে ,মনে হয় ঘুমিয়েই পড়েছে | আর আমি ভয়ে কাচুমাচু মুখ করে উদগ্রীব হয়ে রয়েছি শেষে কি হয় জানার জন্য |

      মাছ যখন প্রায় ভাজা শেষ ,জানালা বন্ধ করতে যাবে ঠাকুমা ,দেখে বন্ধ করতে আর পারছে না | মনে হচ্ছে কে যেন বাইরে থেকে পাল্লাটা চেপে রেখেছে খোলা থাকার জন্য | অনেক টানাটানি করেও যখন কিছু করতে পারল না ,তখন ঠাকুমা তা ছেড়ে দিয়ে ভাজা মাছগুলো নিয়ে ঘরে আসতে যাবে ,দেখে জানালা দিয়ে এই বড় বড় হাত পেতে কে যেন মাছ চাইছে ,আর তা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে | তাই না দেখে মাছের বাটি ফেলে ঠাকুমা দৌড়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল | এদিকে মাছগুলোর কি হবে ! তা দেখতে দাদু গেল রান্নাঘরে ,গিয়ে দেখে তখনও হাত পেতে আছে জানালার ভিতরে কে যেন ! অগত্যা দাদু দু-পিস মাছ ছুঁড়ে দিল জানালার দিকে | তৎক্ষণাৎ কেউ আর নেই | কোন শব্দও শোনা গেল না আর | এবার ঘরে এসে ঠাকুমার কাছে সব বলল -- হাটে যাওয়া আসার গল্পটা পুরো | ঠাকুমা তা শুনে বলল ,এ মাছ খাবে না আর কাউকে খেতেও দেবে না | দাদুকে নির্ঘাত পেত্নীতে ভর করছে ,ছাড়ফুঁক করাতে হবে |

      এবার দাদু তার বাবার কাছে শোনা এই পেত্নীর গল্পটা বলল ঠাকুমাকে | অনেক বছর আগে বাগানের পাশের পুকুরটায় এখানকার প্রতিবেশি এক বৌ স্নান করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে |তার মৃগী রোগ ছিল ,জলে এ রোগের ভয় বেশি ,জলে অজ্ঞান হয়ে পড়ায় বাড়ির লোক গিয়ে তুলতে তুলতেই শেষ | তারপর যাইহোক শ্রাদ্ধশান্তি সবই করেছিল তারা ,কিন্তু তার কিছুদিন পর থেকেই এই পেত্নীর আবির্ভাব শুরু হয় | সবাই বলছে নাকী তার কাজকর্ম ঠিকমতো হয় নি তাই এই অবস্থা | কিন্তু ওনার বাড়ির লোক কোনদিন এসব কিছু দেখেনি আর বিশ্বাস করতে চাইতো না | এখন তো ওনারা কেউ আছে কিনা তাই বা কে জানে এই বলে ঠাকুমাকে শেষে বলল ,"এই পেত্নী যদিও কারও তেমন কিছু ক্ষতি করে নি ,তবে মাঝে মাঝে এটা ওটা খেতে চায় | আর বাগানের ঐ তেঁতুল আর পাঁকুড় গাছে নাকী থাকে ,অনেকেই ও পথ দিয়ে গেলে বুঝতে পারে |" এ সব শুনে ঠাকুমা পিসিরা সব তো ততক্ষণে রাম রাম জপতে লেগেছে আর ভয়ে কাঠ হয়ে গেছে |

      এদিকে গল্প শেষ হতেই ,আর এক কান্ড হল ,ভাই ঘুমিয়ে কাঁদা ,কে নামাবে ,দাদুতো পারবে না | অগত্যা মা এসে নিয়ে গেল কোলে করে | তখন ভাই পড়ে ফোরে আর আমি পড়ি সিক্সে ,দুজনে দু-বছরের ছোট বড়ো তাই দু ক্লাস কম বেশি | ওর তখন আট আর আমার দশ ,তাই কোলে ওঠার অভ্যাসটা তখনও মাঝে মাঝে ছিল ওর | এবার নিচে এসে খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়লাম | আর ঘুম থেকে উঠতেই শুরু হল তান্ডব লীলা | এখনকার ফ্ল্যাটের মতো না বলে বাথরুমটা কাছে ছিল না আমাদের বাড়ির | যেতে হত একটু দূরে মানে কটা ঘর পেরিয়ে একটা করিডোর দিয়ে গিয়ে এক কোণায় | ওখানেই গন্ডগোল ,ভাই ঘুম থেকে উঠল সন্ধ্যেবেলা আর বাথরুমে কিছুতেই যাবে না ,যদিও তখন আমি ভাইকে পাহারা দিয়েই কাজ সারলাম | কিন্তু মাঝরাতে ঘুমের মাঝে ভাই ,"পেত্নী ধরবে গো ,আমায় পেত্নী ধরবে" বলে চিৎকার করে উঠল |

     আর তা শুনে সবাই মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে এক দক্ষযজ্ঞ শুরু করলো -- সবাই ভাইকে ধরে দেখলো ধূম জ্বর উঠেছে | যদিও ভয় যে আমার লাগছিল না তা বলবো না ,তবে ঠাকুমাকে জড়িয়ে শুয়ে পড়েছিলাম বলে অতটা মনে হচ্ছিল না | এদিকে সবাই তখন বলতে লাগল ,আমরা বোধ হয় ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছি | এই বলে দাদুর উপর ঠাকুমা বেশ রাগ দেখাতে লাগল ,অমনি দাদু মুখ ফসকে বলে ফেলল ,"না ; না ; ওরা তো ঘরে আমার কাছে গল্প শুনছিল |" ব্যাস যেই না বলা ,অমনি ঠাকুমা ধরে ফেলল ,নিশ্চয়ই আমরা দাদুর কাছে ভূতের গল্প শুনেছি ,তাই ভয় পেয়ে এসব হয়েছে | তখন দাদু কি আর করবে ,চুপ করে রইল পরিস্থিতি দেখে | তারপর সেই রাতে ঠাকুমা ,অনেক্ষণ ধরে ভাইয়ের কপালে জলপট্টি দিয়ে জ্বর নামালো | আবার পরের কদিন ঠাকুর বাড়ি গিয়ে কি সব ঝাড়ফুঁক করিয়েছিল ভয় কাটানোর জন্য | সবাই অনেক বোঝালো আমাদের ভূত বলে কিছু নেই |তারপর থেকে দাদুও প্রতিজ্ঞা করেছিল ,কোনদিন আমাদের আর ভূতের গল্প বলবে না | পরবর্তীকালে আমি অনেক ভূতের গল্প পড়েছি বা অন্য কাউর থেকে শুনেছি ,কিন্তু দাদুর কাছে শোনা এই গল্পটা আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে আর থাকবে |
 
   ।। সমাপ্ত ।।
 
 
Tapasree Banerjee
 
অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি