আগমনী পাঠক লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
আগমনী পাঠক লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

পরশপাথর - আগমনী পাঠক

 

পরশপাথর
আগমনী পাঠক
 
 
 
        নীল আকাশটা বাটির মত করে উল্টানো আছে যেন, আর এই ধরিত্রী চাপা পড়েছে তার ঠিক নিচে! সৃজন নরম ঘাসের উপর পিঠ দিয়ে, শুয়ে আছে। দুপুরের গুনগুনে রোদ এখন পড়ন্ত বেলার শীতল চাদর চাপিয়ে নিয়েছে। তবে সৃজনের কিছুতেই উঠতে মন চাইছে না। শিশুর মত করে আকাশ গিলছে সৃজন।
খানিকসময় পর উঠে দাঁড়িয়ে দেখল, আশে পাশে আর কেউ নেই, দূরের পাহাড়টা নিঃসঙ্গ, ঠিক ওর মতই একা দাঁড়িয়ে আছে। সামনের এই অন্ধকার হয়ে আসা গভীরতা পেরোতে পারলেই ……
“এই যে শুনছেন? একটু এইভাবেই স্থির থাকুন প্লিজ… পড়ন্ত রোদে আপনাকে …”
একটা মেয়েলি কণ্ঠ কানে যেতেই সৃজন মুখ ঘোরাতেই, “খিচিক, খিচিক”
“বাঃ! দারুণ এসেছে বুঝলেন ছবিটা”
সৃজন ঘটনার আকস্মিকতায় একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল।
“ওহ! সরি সরি, অনুমতি না নিয়েই ছবি তুলে ফেললাম। যদি কিছু মনে না করেন , আরও কিছু ছবি তুলতে পারি?”
সামনের এই অপরিচিতার কথায় , আকস্মিকতা কাটিয়ে সৃজন বলল, “মানে?”
“বলছি, আপনার ছবি তুলতে কি পারি?”
“আমার কেন?”
“আরে! ঠিক আছে, যদি কোনও অসুবিধা থাকে তো থাক, কিন্তু যদি অনুমতি পাই তো! প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি বলুন, নয়ত এই সুন্দর সোনালি আলোটা ক্ষণিকের অতিথি!”
সৃজন কিছুটা বুঝল, অনেকটা না বুঝে একটু দ্বিধা নিয়েই সম্মতি সুচক মাথা নাড়াল……
“একটু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, মুখটা সামান্য ওই দূরের পাহাড়ের দিকে করুন প্লিজ, … হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক এইরকম…”
--“খিচিক…”
এইভাবে নানান নির্দেশ মেনে সৃজন দাঁড়ালো, বা বসল…
মেয়েটি অনেক ছবি তুলল। এরই মধ্যে পাহাড়ে ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে এল।
“অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনি যদি আপনার ইমেল আর মোবাইল নাম্বার দেন তো, এই ছবি গুলো আপনাকেও পাঠিয়ে দিতে পারি…”
“হ্যাঁ, তা না হয় দিলাম, তবে…”
“ওহ হো , এই দেখেছেন, আমি তো পরিচয়ই দিই নি। আমি দুযতি মিত্র। দুরজতি বা ধূর্জটি নয়, দুযতি ! ঠিক আছে? উম উম উম্‌্‌্‌্‌ আপনি আমাকে দুতি বলে ডাকতে পারেন”
বলে মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিল সৃজনের দিকে…
সৃজন গত ১৫ থেকে ২০ মিনিট এই মেয়েটিকে দেখছে এবং অত্যন্ত কথা বলা স্বভাবের এই মেয়েটিকে দেখতে মোহময়ী লাগেনি তবে বেশ আকর্ষণীয় লেগেছে।
“আমি সৃজন পাল। নাইস টু মিট ইউ”
“এই নিন, এতে একটু আপনার নাম্বারটা টাইপ করে দিন না” দুতি নিজের মোবাইলটা সৃজনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল।
মেয়েটি সত্যিই আকর্ষণীয়, যখন থেকে এসেছে সৃজন ওর কথাই শুনে চলছে।
“একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি?”
“হ্যাঁ, নিশ্চয়…”
হাসিমুখে দুতি জবাব দিল।
“হঠাৎ আমার ছবি কেন? না আসলে পড়ন্ত রোদে শুনেছি মেয়েদের ছবি বা ল্যান্দস্কেপ ক্যামেরা বন্দি হয়…সেখানে আমার”
“ওহ! এই ব্যাপার!” একটু হাসতে হাসতে দুতি বলল, “আমি একটু ব্যতিক্রমী একটা অ্যালবাম করছি, কি নাম দিয়েছি বলুন তো!” সামান্য একটু থেমে বলল, “মানুষ ও পৃথিবী”
“হুম্ম…”
“আরে, বেশি ভাব্বেন না এটুকুতেই। বলছি সবই, এখন একটু ঠাণ্ডা লাগছে চলুন ওইদিকে হাঁটতে হাঁটতে বলছি”
ওরা পাহাড়ের ধার থেকে আগেই সরে এসেছিল, এখন সামনের পথ ধরে হাঁটতে শুরু করল।
“আসলে আমার মনে হয়, পুরুষকে সেই রাফ এন টাফ দেখতে দেখতে ভিতরের কোমলতাটাকে এই সমাজ কখন যেন মেরেই ফেলেছে। তবু সময়ের প্রভাবে কখনও কখনও তা আবার বেঁচে ওঠে। আমি ঘুরতে ফিরতে সেই মুহূর্তগুলোই এই ক্যামেরাই বন্দী করছি”
“পুরুষের কোমলতা? সেটা কি সমাজ চায়?”
“কে কি চায় তা আমি জানি না বাপু, আমার এগুলো ভালো লাগে তাই করি। আর কে বলল কোমলতা চায় না? আমি তো চাই। তুমি আমি সবাই মিলেই এই সমাজ, আমি চাইছি মানেই সমাজ চাইছে…”
সৃজন এত সহজ সমাধান শুনে, একটু অন্যমনস্ক হয়ে উঠল।
“শুনুন, এই সামনের ক্যাফেতে একটু বসবেন চলুন। একটু বেশিই ঠাণ্ডা লাগছে…”
“না, আসলে আমার একটু কাজ বাকি আছে, আমি আজ আসি কেমন!”
“আরে! আরে! করেন কি , করেন কি! এক কাপ মাত্র, আপনার বেশি সময় নষ্ট হবে না…”
বলেই দুতি সৃজনের হাতটা হালকা করে ধরে নিয়ে ক্যাফের মধ্যে ঢুকে গেল… সৃজন এবারে একটু ছটফট করতে লাগল। তবুও একটা সুসজ্জিত টেবিলে বসল।
“আপনি কি করেন? আমি শখের ফটোগ্রাফি করি আর স্নাতক করছি”
“সেটা জানা কি খুব প্রয়োজন? আমাকে যেতে দিন…”
হঠাৎ হাসিখুশি মুখটা গম্ভীর করে মেয়েটি বলল, “যেতে দেব? কোথায়? আপনি তো স্বেচ্ছায় এসেছেন, বললেই কি ফিরে যাওয়া যায়!”
“মানে?”
“বাঁ হাত টা দেখুন তো, রক্ত ঝরছে। বুঝতে পেরেছেন এতক্ষণ?” দুতির কথায় সৃজন নিজের বাঁ হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল ওর শার্টের হাতাটা রক্তে মাখামাখি। অথচ ও এতক্ষণ বুঝতেই পারেনি। আবার দুতি বলল, “যে অভিপ্রায় নিয়ে ওই পাহাড়ের ঢালে এসেছিলেন, সেটি পূর্ণ করেছেন আর বুঝতেই পারেননি! আশ্চর্য!”
“হে! কি যাতা বলছেন, আমি কখন সুইসাইড করলাম। আমি তো ওখানে সময় কাটাচ্ছিলাম মাত্র! যত্তসব! বাজে বকা!” বলেই সৃজন উঠতে যাচ্ছিল,
“তাহলে বলুন আপনি এই রাস্তায় একজন লোককেও দেখেননি কেন! এতক্ষণ! আর আপনার হাতের ওই ক্ষত!”
“এটা হয়েছে , হয়ত! আমি খেয়াল করিনি”
বলতে বলতেই সৃজনের কানে এল এক সুমধুর বাঁশির শব্দ, চারিদিক কেমন যেন অন্ধকার হয়ে গেল। সৃজন দৌড়ে বাইরে এল, কোথাও কোনও আলো নেই…
মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল, “এখনও কি বিশ্বাস হচ্ছে না?”
সৃজন একবার বুকভরে শ্বাস নিল, “না হচ্ছে না। আপনি ইচ্ছা করে আলো নিভিয়েছেন, এসব প্রাঙ্ক করছেন। সব বুঝি আমি”
“ও তাই বুঝি! এই তো বললেন আপনি সুইসাইডই করবেন ভেবে এসেছিলেন, করেছেন কিন্তু বুঝতে পারছেন না হয়ত! ওই সময়ের মাঝে আটকে যাওয়া, যেমনটা গল্পে পড়েন আর কি!”
সৃজন চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করল, নিচের উপত্যকাও কালো অন্ধকার চাদরে মুড়ে আছে! “আশ্চর্য!”
“অনেক আশ্চর্য এখনও বাকি যে!”
এমনিতেই সৃজন শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল, তার উপর এইসব কথা! চোখের সামনে যেন সবটা অন্ধকার দেখতে লাগল!
 
                                              ******
 
চোখ খুলতেই সৃজন নিজেকে এক খাটিয়ার উপর পেল, মাথাটা বড্ড ভারী লাগছে, মাথার উপর খোলা আকাশ! একটু এদিক ওদিক মুখ ফেরাতেই লক্ষ্য করল,  সেই দুতি নামের মেয়েটি স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে কোনও কথা বলছে না। সেই সুমধুর বাঁশির সংগীত এখন সর্বত্র , চারিদিক জ্যোৎস্না ছড়িয়ে আছে।
সৃজনের বুকে যেন কিসের এক পাথর চেপে আছে, গলার কাছে কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে আছে, নামতে চাইছে না।
“কীভাবে হল?” দুতিকে উদ্দেশ্য করে বলল।
দুতি কোনও জবাব দিল না আরও খানিক ওর দিকে তাকিয়ে রইল। সৃজন মুখ দুহাতের তালুতে ঢেকে বসে রইল, হয়ত কাঁদছে কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। দুতির সাথে যখন দেখা হয়েছিল সৃজনের হঠাৎই খুব ভালো লাগছিল, ঘটনাটা একটা মিষ্টি প্রেমের গল্প তো হতেই পারত কিংবা নিদেনপক্ষে একটা মুহূর্তের ভাললাগার স্মৃতি হলেও ক্ষতি কি ছিল! এখন সৃজনের দুতিকে অসহ্য লাগছে।
“বলতে পারি, যদি সবটা বল , তো আমিও বলতে পারি তোমার অজানা অংশটুকু” দুতির কথায় সৃজন মুখ তুলল। দুচোখের কোন চাঁদের আলো পড়ে চিক চিক করে উঠল।
“আমার কথা কিছু নেই, ভালোই হয়েছে যা হয়েছে”
“ও তাই বুঝি! তাহলে ওই চোখের কোনের জলের মানে কী?”
“ও কিছু না, তবু বলছি”
“আমি শুনছি”
“আমার মায়ের নাম সৃজনী। ছোটোথেকেই মা আমাকে মানুষ করেছিল, বাবা কোন ছেলেবেলায় মারা যায়, আমার তখনও জ্ঞান হয়নি। পড়াশোনা শেষ করে আমি একটা ফার্মে চাকরি পেলাম, সেখানে কাজ বিশেষ ছিল না তবু মাইনে বেশ ভালোই হত। আমার আসলে ওটা ছিল হাতের পাঁচ, আমার লক্ষ্য ছিল কোনও এম এন সি। ওখানে দু বছর করার পর পেয়েও গেলাম কাঙ্ক্ষিত চাকরি ইনক্রিমেন্টের সাথে। নতুন জব ছিল আমার চেনা শহর ছেড়ে দূর শহরে। চলে গেলাম । প্রথম প্রথম খুব ভালো লাগত, তবে ধীরে ধীরে বুঝলাম আমি আসলে তখনও মামা’স বয় আছি। সবার সাথে পেরে উঠছিলাম না। তবু লড়ে যাচ্ছিলাম প্রাণপনে, খাপ খাইয়ে নিতে ।
তারই মাঝে জিনিয়া এল আমার জীবনে!”
সৃজনকে থামিয়ে দুতি বলল, “ওহো, সেই এক কেস!”
“না না, সবটা একই নয়। জিনিয়া যেমন এল আবার চলেও গেল! এইসবে মা ছিল সবসময় আমার পাশে। কিন্তু গতবছর মা হঠাৎ ই ইহলোকের মায়া কাটিয়ে চলে গেল! আমাকে একদম একা করে। আবার জিনিয়া এল, জানি না কেন আমাদের সম্পর্কটাকে আবার সুযোগ দিলাম। কিন্তু এখন ভাবছি হয়ত না দিলেই ভালো করতাম”
দুতি ওর পাশে এসে বসেছে, এবার কাঁধে হাত রেখে বলল, “কেন?”
“জিনিয়া এতদিনে অন্য কোম্পানিতে চলে গেছে আর আমি আমাদের কোম্পানিতে গ্রুপ লিডার। একটুও বুঝতে পারিনি ও আমার সাথে …
আমার দুবছর ধরে করা প্রোজেক্ট প্ল্যান জানাটাই উদ্দেশ্য ছিল, সেটা পেয়ে যেতেই আবার… জানো ও আসলে বিবাহিত, সবটাই ছিল বিজনেস আর মানির জন্য! আমি ভেঙ্গে গেলাম, একেবারে। এবার তো আর মাও নেই… কোথায় যাব আমি!”
“ব্যস এটুকুই!”
সৃজন দুতির এহেন উত্তরে খুব অবাক হল, তারপর, “এই অবহেলা, অবজ্ঞার জন্যই কাউকে বলিনি কোনও কথা। হয়ত সামলেও উঠতাম, কিন্তু গতকাল মিথ্যে বদনামে চাকরিটাও খোয়ালাম, সাথে জুটল অপমান। আমি নাকি এইভাবেই কোম্পানির গোপন প্ল্যান বিক্রি করি!”
“তোমাকে ছোটো করতে বলিনি, এটুকুতে ভেঙ্গে পড়লে কি তোমার মা খুশি হতেন? এটাই কি উনি শিখিয়ে ছিলেন! যতক্ষণ জীবন আছে তাকে হেলায় হারিও না। একজনকে আমি চিনি , না! চিনতাম। জানো, সে আমাদের মতই ছিল, হই হুল্লোড় হাসি মজা নিয়ে তার দিন কেটে যেত। আমার মত ফটোগ্রাফি করার শখ ছিল। সবসময়ই জীবনকে সে অদ্ভুত সুন্দর দৃষ্টি দিয়ে দেখত। সেই মেয়েটির হঠাৎ একবার এক দুর্ঘটনায় দৃষ্টি শক্তি চলে গেল। সঙ্গে তার ফটোগ্রাফিও চলে গেল। কিছুদিন একটু দমলেও জীবন থাকতে তার জীবনী শক্তি কেউ কেড়ে নিতে পারেনি। জানো এরপর সে কি করেছিল?”
“কী?”
“জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। শুরু করেছিল সংগীত চর্চা”
“তারপর?উনি কি বিখ্যাত কেউ?”
“আহা! এই তো তোমার মস্ত দোষ! সব গল্পে বিখ্যাত কেউ থাকতেই হবে! সাধারণের গল্প, তোমার আমার গল্পগুলো কি গল্প নয়? জীবনটাকে জীবন দিয়ে বাঁচাই তো জীবনের উদ্দেশ্য। এটা আমার এক বন্ধুর গল্প!”
দুতির কথায় সৃজন একটু চুপ রইল। তারপর বলল, “আচ্ছা তাহলে তুমি কেন এই পথে?”
“কোন পথে?”
“না মানে তুমিও কি সুইসাইড?”
এবার দুতি হো হো করে হাসতে লাগল। সৃজন আরও একবার হাঁ করে চেয়ে রইল,
“আরে বোকা কেউ মরেনি, তুমিও না। আমার তোমাকে দেখে মনে হল সাহায্য করি, যদিও মানছি তার ধরন অদ্ভুতরকমের বাজে। তার সাথে এই শহরের লোডশেডিং যা সাথ দিল” বলেই আরও জোরে হাসতে থাকল।
এবার সৃজনও বোকার মত হাসল, কিন্তু নিজেকে ওর খুব হালকা লাগছিল, যেন অনেকদিন পর এক নির্মল ভালোলাগা ছুঁয়ে যাচ্ছিল। এই মেয়েটির হাসি ওকে ওর মায়ের কথা মনে করাচ্ছিল। ওর মাও তো এইরকমই প্রাণোচ্ছল ছিল।
ওই স্থান দুতির কোনও এক পরিচিতের ক্যাফে, সন্ধ্যাতে বন্ধ হয়ে যায় তাই কেউ ছিল না। আর সুরটি ছিল বাঁশির সুরের রেকর্ড।
এরপর কিছু কথা বলে সৃজন আরও একটু সুস্থ হতে দুতি ওকে এগিয়ে দিল বাড়ির পথে। দুতি ফিরে যাওয়ার আগে সৃজনকে ওর তোলা ছবিগুলো দিল আর বলল, “সৃজন তোমার মা সবসময় আছে তোমার সাথে, আমাকেও তো…”
“অনেক ধন্যবাদ, দুতি, আজ তুমি আমাকে অনেক কিছু শেখালে… এবার আসি, তোমার ফোন নংটা দেবে?”
“ওই ছবিটার খামে আছে, লেখা”
“তাহলে আসছি, কাল আবার আসব এদিকে, দেখা হবে, আমি এতদিন শহরে আছি , আবার এটা আমার মায়ের জন্মস্থানও। কিন্তু এদিকে কখনও আসিনি, কি আশ্চর্য!”
“হুম, এসো”
                                        ******
 
এরপর সৃজন বাড়ি এসে, খেয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবছিল, আজ কি কি ঘটল। মেয়েটি খুব সুন্দর ছবি তুলেছে ওর। কাল আরও একবার যাবে ভেবল।
পরেরদিন ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়ে গেল…
ওখানে পৌঁছানোর পর, কোথাও কিছু দেখতে পেল না।
“হয়ত ভুল দিকে এসেছি” স্বগোক্ত করে সৃজন অন্য পথ ধরল, দূর থেকেই একটা ঢালু চালের বাড়ি দেখতে পেল… “এবার ঠিক পথে আছি”
কিন্তু কাছে গিয়ে দেখল বাড়ি তো আছে কিন্তু এ তো পরিত্যাক্ত! “আশ্চর্য!”
কিছুক্ষণ এদিক ওদিক করে ফিরে আসতে গিয়ে একজনকে জিজ্ঞাসা করল,
“এই যে দাদা শুনছেন, এখানে কোনও ক্যাফে …”
“ক্যাফে? ওই বড় মার্কেটে আছে। এখানে নেই”
সৃজন একটু সঙ্কোচে ওই বাড়িটার দিকে হাত বাড়াতেই,
“এই হোটেল তো প্রায় ৩০ বছর আগেই উঠে গেছে। মালিকের একটাই মেয়ে ছিল তার বিয়ে হতেই এই দোকান বন্ধ করে উনি চলে যান মেয়ের সাথে”
“মেয়ের নাম কি বলতে পারেন?”
“নাম? … ওহ হ্যাঁ , মনে পড়েছে, সৃজনী!”
সৃজন এবার যেন আকাশ থেকে পড়ল।
ওই লোকটি কথা বলেই পাশ কাটিয়ে চলে গেল…
সৃজন একটু টাল খেয়ে রাস্তার পাশেই বসে পড়ল। ওর সাথে সেই ছবিটা ছিল। বের করে দেখল, ছবিটা একরাতেই যেন পুরানো হয়ে গেছে।
“আমার ছবিই তো এটা!”
ভাবতে ভাবতে উলটালো ছবিটা, দেখল পিছনে লেখা আছে,
“নির্মলকে সৃজনীর তরফ থেকে!”
--নির্মল সৃজনের বাবার নাম ছিল। ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে , “মা, ঠিকই বলত, আমি একেবারে বাবার মত!” দু ফোঁটা অশ্রু টপটপ করে ছবিটার উপরে পড়ল…
তাড়াতাড়ি মুছে সৃজন ওটাকে বুকে জড়িয়ে বলল, “মা, আর আমি হেরে যাব না, মা!”
.........................................
 
অলঙ্করণ :-   রিচা দাস 

 

ভাবনা কারা - আগমনী পাঠক

 ভাবনা কারা
আগমনী পাঠক


    “বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এই কল্পনাতীত বিশাল ক্ষেত্রের ক্ষুদ্রাতীত ক্ষুদ্র আমাদের এই বাসভূমি। পুনশ্চ, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তুলনায় মোদের অস্তিত্ব নগন্য। তবে জানিস, হিন্দু দর্শন মতে, যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাই আছে সবথেকে ক্ষুদ্র কণাতেও, আবার মনই নাকি এসবের আধার! উফ, কীসব বকছি তোদের কাছে। আসলে, ইদানিং আমার আবার বিজ্ঞানের তত্ত্বর সাথে নানান ধর্মীয় তত্ত্ব আলোচনা পর্যালোচনার ভূত মাথায় চেপে বসেছে। এই ভূত বলতেই আমার মাথায় বেশ ইন্টারেস্টিং ঘটনা মাথায় এসেছে”
 

    মামাবাড়িতে গরমের ছুটিতে সবাই এসেছি। আমি, বাবাই, তুতাই, টুবলাই, মনি দিদি, আর ছোট্ট রিনিও এসেছে। আমি, তুতাই , টুবলাই তিনজনেই হাওড়া ঠাকুরানী উচ্চবিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেনীর ছাত্রছাত্রী। সম্পর্কে আমারা সবাই একেওপরের কাজিন্স। মনি দিদি আর টুবলাই অবশ্য সিব্লিংস। বাবাই দাদা আমার মামত দাদা। এই বাড়িটা আমাদের মামাবাড়ি ঠিক নয়, এটা মামার চাকরিসুত্রে পাওয়া কোয়াটার, কিন্তু বিএসএফ ইন্সপেক্টরের কোয়াটারকে স্বচ্ছন্দে ছোটোখাটো বাংলো বাড়ি বলা যায়।  আসামের শিলচর শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে গ্রাম্য পরিবেশে এই বিশাল বি এস এফ ক্যাম্প! এর পাশেই আর্মি ক্যাম্প, সেটা আরও বড়ো, তবে আমরা যাইনি ওখানে, দূর থেকে দেখে আর মামীমার মুখে শুনে ঠাওর করেছি ওর আয়তন। বাবাইদাদা এখন ব্যাঙ্গালরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে আর মনি দিদি কলকাতায় বালিগঞ্জে এম এস সি করছে। আমি এটুকু গল্প শুরুর আগে বলা প্রয়োজন মনে করলাম নয়ত গল্পের মাঝে আমাদের পরিচয় পেতে পাঠকের হয়ত ভালো লাগবে না। যাইহোক, আমি আবার গল্পে ফিরি। এবার নিশ্চয় বুঝেছেন যে কথা শুরু করেছে সে আমাদের মনি দিদি। মামা যেখানেই থাকুক প্রতিবার গরমের সময়ে আমরা সবাই সেখানে যাই, খুব খুব মজা করে কাটে আমাদের ছুটি। সাথে মনিদির গল্প আমাদের উপরি পাওনা।
মনিদির কথায় বেশ বুঝতে পারলাম একটু উৎসাহ দেখালেই মনিদির গল্পের ঝাঁপি খুলে যাবে।
“ইন্টারেস্টিং? মানে কি সেই হাউ মাউ খাঁউ মানুষের গন্ধ পাঁউ? এই তাহলে আমি নেই, উঠলাম, ওসব গাঁজাখুড়ি গল্প আমার পোষায় না” বাবাই দা মনিদির কথা শেষ হতেই হাঁই হাঁই করে বলে উঠল!
মনিদি সোফার উপর বসে বেশ যোগীমাতার মত মুখের ভঙ্গি করে বলল, আমি কবে শুনিয়েছি সেসব ? না, শুনতে চাইলে আমি বলবো না, যা!
উফ, এই দাদা দিদি নামেই বড়ো হয়েছে, তবু বাচ্ছাদের মত রাগ করে, যাইহোক আমি বললাম,
“আরে না না, দিদি তুমি যা বলছিলে শুরু করো, আট টা বাজতে গেল, ঠিক ৯টা পনেরো তে মামিমা আবার ডাক দেবে, খেতে যেতে হবে, তার আগে প্লিজ”
“ঠিক আছে সবাই বলছে যখন আমিও বসি” বাবাই দাদার সম্মতিতে দিদি বেশ মুখে এক প্রসন্ন হাসি এনে, আবার বলতে শুরু করল। আর, বাকিরা তো, আগে থেকেই গল্পের নাম শুনে জাঁকিয়ে বসেছে।
 

    এবার যা গল্প মনিদিদির কথাতেই লিখছি আমি,
“তবে শোন, এই গল্প আমার অভিজ্ঞতা নয়, এ আমার এক রুমমেটের কথা, গল্প তোদের মামদ, জামদ বা ভ্যাম্পায়ার নিয়ে না হলেও…,” বলতে বলতেই দুম করে কারেন্ট অফ হয়ে গেল, আর বাইরে যে এতক্ষণ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে তা এতক্ষন টেরই পাইনি, এখন তারই শব্দ কাঁচ ঘেরা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে, নিঝুম পরিবেশের ছমছমে ভাবটা আরও গভীর থেকে গভীরতর করে তুলল।  
“এই ভয় বলতে বলতেই কারেন্টটা কেন যে হাওয়া হয়ে যায়, বুঝি না বাপু!” তুতাইয়ের কথা শেষ হতে না হতেই, মামি মা দুটো বড়ো বড়ো বাতি জ্বালিয়ে ঘরের দুই কোনে রেখে গেলেন। আমরা মনিদিদির আরও কাছে কাছে ঘেঁসে বসলাম।
“এই যে এখন অন্ধকার হয়ে গেল, এখন তোদের মনে হচ্ছে না, এটা যেন একটু আগেই হয়েছে বা এই একই সময় কাটিয়েছিস? বা জানিস সবটুকু কী ঘটতে পারে!”  
“দিদি, প্লিজ, কীসব বলছিস! তুই গল্প বল” টুবলাই বলল।
“হুম্, আমার রুমমেট প্রিয়া, আছে এখান থেকে সামনেই শিলং শহরে। গতবছর মার্চে বিয়ের পর পরই ও ওর বরের সাথে এই শিলং শহরে চলে আসে, ও আমার রুমমেট কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে ছিল আমার থেকে ১ বছরের সিনিয়র। তাই পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে খুব আনন্দেই শিলঙে চলে আসে। আমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, ওখানের পরিবেশের অপরূপ দৃশ্যের ছবি পাঠাত আমাকে। ছুটিতে ওখানে যেতেও অনুরোধ করে, কিন্তু তোরা তো জানিস আমার ফাইনাল ইয়ার গেল এই বছরটা । সুতরাং ছুটি পেলেও প্রোজেক্ট , রিপোর্ট, করতে করতেই কেটে যেত।
 

    প্রায়ই কথা হত। ওর ছবি বা ভিডিও থেকে আমারও ততদিনে ওদের বাড়ির  আশে পাশের পরিবেশ সহ মানচিত্র বেশ মাথায় গেঁথে গেছে। একটা সবুজ উদ্যান ঘেরা একতলা বাড়ি ওদের। ওর বর ইউনিভার্সিটির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোফেসর আর ইউনিভার্সিটির খুব কাছেই ছিল ওদের এই বাড়ি। এমনিতে দেড় কিমির মতো হলেও, সামনের এক পার্ক এর রাস্তা নিলে ৫০০ মিটার কম হাঁটতে হতো। এখানে এসে তো, তোরা পাহাড়ের সৌন্দর্য বুঝতেই পারছিস তাই ওসব আর বলবো না। মোটকথা ওখানের দৃশ্য আমি দূর থেকে ডিজিটালি দেখেই অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। এইভাবে ওর ওখানে ৮ মাস কেটে গেল, শীতকাল জাঁকিয়ে বসেছিল শিলং শহরে, আর আমার জীবনে বসেছিল সেমিস্টারের চাপ! অনেকদিন কথা হয়নি আর প্রিয়ার সাথে। এরপর একদিন হোয়াটসঅ্যাপে দেখি প্রিয়ার খুব লম্বা একটা মেসেজ”
 

    এতটুকু বলে মনিদিদি থামলো, ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রল করতে করতে মিনিট খানেক পর আমাদের সামনে মোবাইলটা এগিয়ে দিল। বাবাইদা সেটা প্রায় ছোঁ মেরে সবার আগে নিয়ে নিল। মনিদিদি বলল, “ওটা ও পাঠিয়েছিল, খুব একটা ব্যাক্তিগত কিছু নেই, তাই তোদের সরাসরি দেখতে দিলাম”। বাবাইদার পর সবার হাত ঘুরে আমার হাতে এসে পৌঁছাল সব শেষে, এস এম এস টা ছিল এইরকম।
“মনি, কতদিন তোকে ফোন করতে পারিনি, কিন্তু আজকালযে কি হয়েছে আমার! সময় যেন কেমন আমার সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে হারিয়ে যায়। গতকালেরই ঘটনা, সোমনাথ ওর রিসার্চ ল্যাবে একটু রাত অবধি কাজ করবে জানাল, আমাকে বলল ওর রাতের খাবারটা ওখানেই নিয়ে যেতে। সেইমতো আমি সব প্যাক করে নিয়ে বেরলাম, তখন সবে সাতটা বাজে কিন্তু এখন শীতের সময়, তাই বেশ অন্ধকার! নিলাম ওই পার্কের পথ, হাতে মোবাইল ছিল তবে টর্চ জ্বালানোর প্রয়োজন ছিল না, অনেক স্ট্রিট লাইট জ্বলছে। পার্কের সামনের ফাউন্টেনটা পেরিয়ে যেতেই এমন একটা রাস্তা পড়ে যার দুপাশে বড়ো বড়ো গাছ। ওই গাছের সবুজ ডাল পালাগুলো এমনভাবে রাস্তার সামনে এগিয়ে এসেছে যে সকালে নীল আকাশ উঁকি মারলেও রাতের অন্ধকারে তা দেখা যায় না। দিনে এই পথ বেশ রোম্যান্টিক লাগে কিন্তু রাতে যেন এক গুহা পথ। কাল দেখি, শুধু ওই পথেরই স্ট্রিট লাইট গুলো ঠিক করে জ্বলছে না, দুটো একেবারে বন্ধ আর দুটো জ্বলছে নিভছে। হাতের মোবাইলের টর্চটা জ্বালাতে হল না, তাড়াতাড়ি ওখান থেকে বেরতেই দেখি, একটা বেশ সাদা রঙের ছোটো কুকুর খুব লেজ নাড়াচ্ছে আর আমার সামনের দিকে এগিয়ে এসে আমার পায়ের কাছে যেন মাথা ঠেকিয়ে কিছু একটা জানাতে চাইছে, আমি বুঝলাম, ওর হয়ত খিদে পেয়েছে। আমার ব্যাগে রাতের খাবারের সাথে কিছু শুকনো খাবারও ছিল, সেটা আমি বের করে ওই কুকুরটাকে দিলাম। ও সানন্দে লেজ দুলিয়ে খাবারের দিকে মুখ ঝুঁকিয়ে খেতে শুরু করে দিল। তখন, আমার হঠাৎ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে খুব ইচ্ছা হল। মাথা নুইয়ে দিতে গিয়েই কেমন যেন একটু চোখের দৃষ্টি অন্ধকার হয়ে এলো।
 

    এরপর দেখি, কোথায় সেই কুকুর, এমনকি আমি ওই পথের অন্য প্রান্তে মানে এখনও আমি ওই রাস্তাই পার হইনি। কিন্তু কীভাবে তা হয়? ভাবলাম, আমি হয়ত অনেক বেশি ক্লান্ত, আর বেশি বেশি চিন্তা করছি, তাই মনের ভয় ভয় ভাবটা কাটিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। আর তুই তো জানিস, আমি সবসময় একটু বেশি ভাবতে থাকি। এবার যা হল,কীভাবে যে বলি! ওই সবুজ গুহাপথের ন্যায় রাস্তা আবার পেরিয়ে গেলাম ওপর প্রান্তে, আমি আবার একইভাবে ওই কুকুরটার দেখা পেলাম, কেন জানি না, মনে হল ওকে খাবার দিই। কিন্তু সেই একই ঘটনা ঘটল, মানে খাবার দিয়ে ওকে খেতে দেখতে দেখতে যেই ওর মাথায় হাত দিয়ে একটু আদর করতে গেলাম,…
দেখি কিনা, আমি আবার অন্য প্রান্তে! এরকমভাবে প্রায় তিনবার ঘটল। আমি খুব ক্লান্ত, সবথেকে অবাক কী জানিস?
আমি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম, সাতটা বেজে ১০ মিনিট আর ওই ঘটনা তিনবার ঘটার পরও দেখলাম মোবাইলের ঘড়ি জানাচ্ছে তখন সবে মাত্র ৭ মিনিট পেরিয়েছে। তাহলে কি সবই মনের মাঝে!! বেশি ভাবার জন্য কি হচ্ছে?
আমি আবার গেলাম, তবে এবার আর ওই কুকুরটার মাথায় হাত বোলানোর জন্য ঝুঁকলাম না। দেখলাম আর আমি অন্যপ্রান্তে নিজেকে আবিষ্কার করলাম না। যতটা সম্ভব দ্রুত হেঁটে ওর ইউনিভার্সিটি পৌঁছে গেলাম। গিয়ে খুব হাঁপিয়ে পড়ি, তাই ঠিক করলাম, সোমনাথের সাথেই বাড়ি ফিরব, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ওদের রেস্টিং প্লেসে বসে রইলাম।
এরপরের ঘটনা, ঐদিনই ফেরার সময় হয়।
 

    ফেরার সময় সোমনাথ সাথেই ছিল। হাঁটতে হাঁটতে ইউনিভার্সিটি এরিয়া শেষে পার্কের রাস্তা ধরলাম, তখন ও ওর ব্যাগ থেকে একটা চকলেট বের করে আমায় এগিয়ে দিয়ে বলল, “খেতে খেতে চল”। আমি নিতে গিয়ে দেখি, কোথায় পার্কের রাস্তা কোথায় চকলেট দিচ্ছে! সোমনাথ তো আমার পাশে দাঁড়িয়ে বোতল থেকে জল খাচ্ছে, আমরা পার্কের রাস্তা দিয়ে হাঁটতেই তো শুরু করিনি! ঠিক এই ঘটনা তো হাঁটতে শুরু করার আগের মুহূর্তেই ঘটল। আমি আবার দেখলাম, একই ঘটনা ঘটল, সময় এগোচ্ছে না যেন পেন্ডুলামের মত দুলছে।  
এবার হাঁটতে লাগলাম, সেই একইভাবে সোমনাথ আমার দিকে চকলেট এগিয়ে দিল! এবার আমার মাথাটা ঝিম ঝিম করতে শুরু করেছে, চকলেট না নিয়ে আমি সোমনাথের হাতটা শক্ত করে ধরলাম। এসব শুধু আমিই অনুভব করছি, সোমনাথ নয়।
জানি না রে, কী হচ্ছে আমার সাথে, কেন হচ্ছে! আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি!”
এত্ত বড়ো এস এম এসটা পড়া শেষ করতেই মনিদিদি আবার বলতে শুরু করল, “আমি প্রিয়াকে ফোন করে আরও অনেক কথা জানতে পারি, ও বলে ও নাকি জানে আমি কী কী বলবো, একই ঘটনা নাকি বারে বারে হচ্ছে,… শুধু ওর জন্য! অথচ আমি ওকে ঐদিন একবারই ফোন করেছিলাম!”
“তোর বন্ধুর স্ক্রু ঢিলা হয়ে গেছে, এতে ভয়ের কিছু নেই” বাবাইদা বলল।
বাবাইদার কথায় মনিদিদি বলল, “এতটুকু শুনে আমিও তাই ভেবেছিলাম, তাই ওর হাসবেন্ড মানে সোমনাথকে ফোন করে আমার সাথে যা কথা হয়েছে সবই বললাম, শুনে উনিও বললেন, প্রিয়া নাকি এই কদিন খুবই অন্যমনস্ক থাকে, নানান রকম অদ্ভুত কথা বলে”।
“কেমন, কেমন” তুতাই বলল,
“ওরা একদিন শিলং শহরের এক চার্চে গিয়েছিল, প্রিয়া আর সোমনাথ একদম শেষের দিকে বসে ছিল। চার্চে প্রার্থনা চলছিল। হঠাৎ প্রিয়া সোমনাথের পাশ থেকে উঠে গিয়ে কোথা থেকে এক বালতি জল নিয়ে এলো, আর তখনই দেখে, এক বাচ্ছা মেয়ের ফ্রকে বাতির আগুন থেকে আগুন লেগেছে সে ভয়ে ছুটে আসছে, আর প্রিয়া তখনই ওই জল ছুঁড়ে নিভিয়ে দেয়। সবাই সেদিন প্রিয়াকে সাক্ষাত ঈশ্বরের দূত মেনে ভূয়সী প্রশংসা করেছে, বিশেষ করে ওই মেয়েটির বাবা মা। এবার, প্রশ্ন হলো যে, প্রিয়া জানল কি করে যে ওটা হবে?
 

    আমি প্রিয়ার সাথে কথা বলতে,  ও আমায় বলে, ঠিক আগেই ও ওই মুহূর্তটা কাটিয়েছে, ওটা ও , না করলে মেয়েটার ডান পা নাকি মারাত্বক দগ্ধ হয়ে যেত!
প্রিয়ার এটা বিশেষ কোনও ক্ষমতা নাকি সবটাই ওর মনের মাঝে হওয়া জটিল কোনও ভাবনার বহিঃপ্রকাশ! দাঁড়া,  তোদের আরও একটা এস এম এস দেখাই,………”
মনিদিদি আবার থামল, বাইরে সমানে বৃষ্টি হচ্ছে। কাঁচের জানালায় বৃষ্টির ফোঁটা টপ টপ করে লাগছে। এরকম নিশ্চুপ বৃষ্টি আমাদের হাওড়াতে হয়না, যেন কেউ নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে। মনের মাঝে মনিদিদির গল্পটা অনেক দাপাদাপি করছে, কোনও ঘটনা ঘটার সময় অথবা ঘটে যাওয়ার পরে মনে হয়না যে ওটা যেন আগেও ঘটেছে, আগেই দেখেছি, হয়না কি আমাদের সাথে?? দিদির বন্ধু প্রিয়ার মতো আমাদের সাথে এগুলো হয়না?
এতক্ষনে বাতিগুলো থেকে মোম ঝরে বাতির গায়েই এক লম্বা স্তুপ সৃষ্টি করছে, অথচ একটু আগেই যেন কিছু ছিল না। আচ্ছা, এইমাত্র দেখলাম যেন বাতিটা নিভে আসছে আর ……
ভাবনার জালে জড়িয়ে যেতে মনিদিদির স্বর আবার বাস্তবে ফিরিয়ে আনল।
“এই এস এম এস টা দেখ, ঋতু” মনিদিদি আমাকে মোবাইলটা দিল। ওতে দেখলাম,
“জানিস, এখন এত বেশি হচ্ছে একই ঘটনার ফিরে ফিরে আসা, আমি আর পারছি না রে, মাঝে মাঝে মাথাটা যেন যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যায় এসব ভেবে ভেবে। মাথার চুল ঠিক করে নিয়ে, আয়নার সামনে থেকে সরে এসেও যেন আবার আমি আমাকে দেখতে পাই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কোনটা যে সত্যই হচ্ছে, কোনটা যে আমি আর কোনটা নয়, চার পাঁচ বার ঘটে যাওয়ার পরও দেখি সকলের জন্য সেটা মাত্র একবারই হচ্ছে। সময় যেন শুধু আমার সাথেই এই লুকোচুরি খেলছে, এই লুকোচুরিতে আমি ক্লান্ত।
আচ্ছা মনি, তোর কখনও এরকম হয়েছে যে , হয়ত তুই কারোর সাথে কথা বলছিস কিন্তু বুঝতে পারছিস যেন সে কি বলবে, যেন তুই আগেও শুনেছিস! অথবা, খাওয়ার শেষ করেও দেখছিস তোর খাওয়া হয়নি, টেবিল ভর্তি খাবার একইভাবে পড়ে আছে। কী রে হয়েছে?”
এই এস এম এস টা পড়ে দিদির মোবাইলটা ফিরিয়ে দিয়ে বাতিটার দিকে চেয়ে এবার সত্যই যেন মনে হল, এই লেখাগুলো আগেও পড়েছি।
বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে উঠল, বৃষ্টি থেমে এল, মামিমা আমাদের খেতে ডাকল, সবই যেন আগেও ঘটেছে, আবার ঘটল।
বেশি ভাবলে কি সময় পেন্ডুলামের মতো দোলে?
আপনাদের সাথেও কি এরকম হয়? আমার এই লেখা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে না? এটা আগেও পড়েছেন? কি হচ্ছে না?
 

সমাপ্ত 

 

Agamoni Pathak