পাঠ প্রতিক্রিয়া লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
পাঠ প্রতিক্রিয়া লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

পাঠ প্রতিক্রিয়া - সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

 

পাঠ প্রতিক্রিয়া

সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

 

বই: অচেনা সময়ের কাব্য 
লেখক: অমিতাভ সরকার
প্রকাশক: ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি
 


 
 



ছোট্ট চেহারার একটি বই।দারুণ প্রচ্ছদপট।উৎসর্গপত্রের পর ভূমিকা একটি কবিতা দিয়ে শুরু।কবি আর কবিতার একাকার সম্পর্ক যেন উদীয়মান 
কবির ভাবনায়।সূচীপত্রে কবিতার  নামকরণগুলি বেশ অন্যরকম লাগলো। আধুনিক বাংলা কবিতাকে  সংজ্ঞায়িত 
করা,তার মূল্যায়ন করার যোগ্যতা বা ধৃষ্টতা কোনোটাই আমার নেই।একজন সাধারণ পাঠক হিসাবে আমার যেটা মনে হয়েছে সেইটাই লেখার চেষ্টা করেছি মাত্র।
ভূমিকার কবিতার শেষে কয়েকটা লাইন-

'মনের চোরাকুঠুরীর তালা 
খুলে গেছে হঠাৎই।
চাবিটা তালার গায়ে ঝোলানো। 
কেউ কি তালাটা আর লাগাবে?’

লাইনগুলো মনে রেখাপাত করে গেল।এইটা কি দেহতত্ত্বের উপলব্বি না অন্য কিছু!আমাদের  মনের তালাচাবি নিয়েই তো রোজকার চলা এ জীবন। কখন খোলা, বন্ধ হওয়া সে তো আমাদের বোঝার বাইরে।তবু  তাই নিয়েই সব।

প্রথম কবিতা বইএর নামেই।'অচেনা সময়ের কাব্য' কবিতাটির প্রথম কয়েকটি লাইন,

'সেই একই ছায়াপথে 
পাগলের মতো আনাগোনা। 
সময় বোঝায় তার দামটা।
বৃত্তে জীবন যেন আটকে।'

যে কঠিন জীবনবৃত্তে আমরা বন্দী তার স্বরূপ সুন্দরভাবে প্রস্ফুটিত।  
শব্দের ব্যবহারগুলো প্রশংসার দাবী রাখে,
যেমন,প্রকৃতির পাঠশালা, আলপিন শব্দ,ঘুম-ভাঙা বেকার,কিৎ কিৎ খেলা।
কবিতার শেষে বর্তমান সময়ের বাস্তব চেহারার সাথে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার সুর
যেন এই লাইন কয়েকটিতে

'আজও রাত আটটায়
আজানের চেনা সুর ভাসে।
মানুষ তো একই আছে।
তবু।
অচেনা সময়।

আর কতদিন? '

সত্যিই আর কতদিন এই দুর্দশা নিয়ে আমাদের চলতে হবে জানি না।
পরের কবিতা  'অর্থনীতির সূত্র' এ রূপকের অন্তরালে সেই জ্ঞানের খোঁজ। 
'অস্তিত্ব' কবিতাটি যেন আমাদের বর্তমান  অস্তিত্বকেই ফুটিয়ে তুলেছে সুনিপুণভাবে।
'অদ্ভুত খেলা' ভক্ত আর ভগবানের চিরন্তন গল্প।চৌষট্টি পাতার এই পুস্তিকার বিষয় বিন্যাস বেশ সুন্দর লাগলো।কবিতাগুলোর কিছু কিছু লাইন অসাধারণ। কখনও বিষয়বস্তুর মধ্যে গিয়ে
হঠাৎ বেরিয়ে আসা পাঠককে চমকিত করবে কিছু জায়গায়।'আকাঙ্ক্ষা' গদ্য কবিতা বেশ লাগলো। অসাধারণ লাইন,
'চলাচল কবেকার রিকশায়?
তুই একা স্কুল থেকে আসতিস। '
এই কবিতারই  পরের কবিতা 'বন্যা' যেখানে 'কুমীর-ডাঙা খেলা' জীবনের কষ্ট থেকে কবিতার শেষে আশাবাদে উত্তরণ হয়েছে। বর্তমান কালে সমাজ বন্ধু, চিকিৎসক, সাধারণ  মানুষের জীবনযুদ্ধের কাহিনী অসাধারণভাবে কবির কলমে ফুটে উঠেছে 
'আজব যুদ্ধ 'কবিতায়।'মাছ-খোঁজা ' বেশ লাগলো। কবি লিখছেন, 
'হৃদয়-গভীরে কেউ ঢোকে না।
বাইরেটা ভালো হলে সব ঠিক।'

এই কবিতারই শেষে বলা হচ্ছে,

'জ্ঞানের পুকুর-চুরি হচ্ছে।
পুকুরই সে যদি আজ অগভীর, 
দম্ভ কিভাবে সব লুটবে?'
খুবই যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন। 

'মৎসাবতার' এ নামকরণেই ইতিহাস পুরাণের স্পর্শ, যেখানে 
'সুরাসুরে সংহার পৃথিবী। ',
'জীবন তো কয়েকটা সংখ্যা;'
 লাইনগুলো সময়ের বেদনাকে বেশ সাবলীলভাবে তুলে ধরছে।
'সূর্য নামার পর' যেন  শব্দমালা দিয়ে নির্মিত  শহরে জীবনের খন্ড  চিত্র। 
' জীবন-চালচিত্র ','মনে পেরেক','শ্রদ্ধা' 'আড়ালে','বিবাহ','মুক্তি',' এপার - ওপার','পৃথিবীর অপেক্ষা ' প্রভৃতি বেশ কিছু ছোটো কবিতা  এই কবিতা সঙ্কলনের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করেছে।ইতিহাসের প্রসঙ্গ এসেছে কিছু লেখা যেমন, 'জরা','পুঁজি','বিশ্বাস'। 'ভাইরাস', 'পথ চলা','গণেশ পুজো 'কবিতাগুলি এক কথায় বলতে গেলে অসাধারণ। 'বিষ' যে কোনো কবিতার নাম হতে পারে,কবিতাটা না পড়লে বোঝা যাবে না।প্রকৃতি ও বাদ যায় নি।'মাটির টানে','চাঁদ নেমেছে','বৃষ্টি-ছোঁয়া' তে নিসর্গ ফিরে এসেছে। 'পর্বত-প্রান্তরের ডাক' পড়ে মনে হচ্ছিলো, যেন পাহাড়ে ছুটে যাচ্ছি প্রেমিকার হাত ধরে।ভারী সুন্দর। কখনো কখনো প্রেম আর প্রকৃতি যেন  একাকার 
হয়ে যাচ্ছে।'প্রেম','জলের ছোঁয়া'  বিমূর্ত প্রেমের কবিতা।  'বিবাহ' কবিতাটি পড়তে গিয়ে থামলাম। 'ভালোবাসার সন্ধানে' যেন  আমাদের জীবনেরই  কথা প্রকৃতির আভাসে।'ঘরে ফেরা', 'খবরে গণিত ' এই দুঃসহ কালের কষ্টকে ফুটিয়ে তোলে।তবে 
এর মধ্যে 'গীতবিতান','আমার রবীন্দ্রনাথ' যেন পৃথক ধর্মী অথচ শ্রান্ত মনের শ্রেষ্ঠ আবাসস্থল। যেখানে 'গীতবিতান' কবিতার কয়েক লাইন,

'সুরগুলো সব ছবির মতো ভাসে,
কথা বলে গানের বইএর পাতা।'

'কথা-সুরের ভাবের ঘরে ঢুকে
 আবার যেন কখন ফিরে আসা।'

'গীতবিতানের প্রাণের পাতা খোলা'

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের সঙ্কলন গ্রন্থ নিয়ে তরুণ কবি অমিতাভের
এই লেখনীর  অরূণোদয়ের কুর্ণিশ না করে উপায় নেই। 

'আমার রবীন্দ্রনাথ' এ কবিগুরুকে নিয়ে আমাদের মনের আশ্রয় ফুটে উঠেছে,

'ইষ্টকথার মতো ভঙ্গুর বুভুক্ষু হৃদয়ের ভিটামিন ভিটেমাটিহারাদের মাটি এনে দেয়।'


'দেহ পুড়ে বেঁচে থাকা 
চেতনার শেষ তলে।'

এই লাইনগুলো পড়তে বসে যেন কবিতা আর নিছক লেখনীতে সীমাবদ্ধ থাকে না।কবিগুরুর ব্যপ্তিতে লেখনীও লাভ করে বলিষ্ঠতা। 

ক্রিকেটার মহেন্দ্র সিং ধোনিকে নিয়ে
'ধোনি ' কবিতাটিও বেশ ভালো।

'তোমার কাজে তুমি বড়ো,
আদর্শ আজ তোমায় দেখায়।

ভালোবাসায় বাসই তোমার,
সবার মনের বিরাট জমি।'

এ তো উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান ক্রিকেট অধিনায়ক ধোনির জয়গাথা।আসলে কবিতাই কবিকে চেনায়।পাঠকেরা সেই কবিতা রূপ কথার আস্বাদ লাভ করে ভরিয়ে তোলে কালের যাত্রাপথ। 

এছাড়া 'কঠিন প্রশ্ন','ছবি আঁকা', 'রিক্ত কুলায়' কবিতাগুলির শৈল্পিকতা, অভিনবত্ব সব ধরণের  পাঠকদের ভালো লাগবে বলে আশা রাখি।
অন্য ধরণের কবিতার কথায় আসা যাক।
আসলে যে বই এর নাম 'অচেনা সময়ের কাব্য' সেখানে তো সময়কাল উপেক্ষিত হতে পারে না কোনোভাবেই। তাই কবিতাও অন্য প্রবাহে প্রবাহিত হলেও তাকে সমকালে ফিরে আসতে হয়েছে।
এই অচেনা সময়ে চেনা মানবমনের  সহজাত রূপ,প্রবৃত্তি ফুটে উঠেছে  'খাদ্য','ডাস্টবিন','করোনায় আক্রান্ত ','করোনা টেস্ট ','ত্রুটির ফাঁদে' 
কবিতায়।লেখাগুলোর সহজ সাবলীল  ভাষা সবাই উপভোগ করতে পারবেন।'টুপি খোলা ', 'দেখানো', 'পারে ফেরা' জীবন-যাত্রার এক একটি ভিন্নধর্মী সংলাপ বলে মনে হয়েছে।লেখা দীর্ঘতর হয়ে যাচ্ছে।কবিকে অভিনন্দন।তবে যতিচিহ্ন, বানানের ব্যাপারে আরেকটু নজর রাখলে ভালো হত।ওইটুকু বাদ দিয়ে 'অচেনা সময়ের কাব্য'  পঞ্চাশোর্ধ কবিতার স্বরমালিকা  বেশ ভালো  লাগলো। উদীয়মান কবির কলম 
চলতে থাকুক।বইটার দামও এই দুর্মূল্যের বাজারে বেশ কমই মনে হলো।পড়ুন,হয়তো আরও অনেক চমক লুকিয়ে আছে কবিতার গভীরে।পাঠকদের ভালো লাগবে।

বইটি প্রকাশ করেছেন  ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি,৯ শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০৭৩।প্রচ্ছদ এঁকেছেন শ্রী শঙ্খজিৎ জানা।প্রথম প্রকাশ গতবছর মহাষ্টমী ।
.................
 

 







 

পাঠ প্রতিক্রিয়া - সায়ন তালুকদার

পাঠ প্রতিক্রিয়া

সায়ন তালুকদার

 

বই: গানের ভুবন
লেখক: বুদ্ধদেব গুহ
প্রকাশক: দেজ পাবলিশিং
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১১২ পাতা
মূল্য: ৮০ টাকা




অনুভবে_ছুঁয়ে_দেখা

 

তিনি বনজ্যোৎস্নার তান্ত্রিক। তিনি বনফুলের পুরোহিত। তিনি ঝরা-বনপাতার বাউল। তাঁর সাহিত্যসাধনার সালোকসংশ্লেষে নীরবে এসে মিশেছে টাঁড়, বন, অরণ্যের নিবিড় আলো-জল-বাতাস।


 তিনি 'ঋজুদা'। তিনি বুদ্ধদেব গুহ। 


বাংলা সাহিত্যজগতকে কাঁদিয়ে, চিরঋণী করে তিনি চলে গেলেন নক্ষত্রলোকের অন্য পাড়ে,কোনও এক নামহীন অজানা দেশে...


বহু বিচিত্রতায় ভরপুর এবং অভিজ্ঞতাময় ছিল তাঁর জীবন। ইংল্যান্ড, ইউরোপের প্রায় সমস্ত দেশ, কানাডা, আমেরিকা, হাওয়াই, জাপান, থাইল্যান্ড ও পূর্ব আফ্রিকা তাঁর দেখা। পূর্ব ভারতের বন-জঙ্গল, পশুপাখি ও বনের মানুষের সঙ্গেও তাঁর সুদীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। 'সাহিত্য-রচনায় মস্তিষ্কের তুলনায় হৃদয়ের ভূমিকা বড়' - এই মতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন।


জঙ্গল তাঁর লেখায় বারে বারে ধরা দিয়েছে। তিনি জঙ্গলের প্রেমে পড়েছেন বারবার। দশ বছর বয়সে শিকার শুরু করলেও নিজেকে শিকারী বলে পরিচয় দিতে কখনও চাননি। 'জঙ্গলের জার্নাল' তার চেয়ে ভালো আর কেউ লিখেছেন কী?

 খুব সুন্দর করে চিঠি লিখতে পারতেন, তাঁর যেকোনো উপন্যাস পড়লেই তা বোঝা যায়! ‘সবিনয় নিবেদন’ উপন্যাস তো পুরোটাই পত্রপোন্যাস! ঋতি ও রাজর্ষি একজন আরেকজনকে না দেখে না শুনে চিঠির এক অদ্ভুত ব্যাকরণে বুনতে থাকে তাদের সম্পর্ককাব্য। অদেখাকেও যে চিঠি লিখে প্রিয় ব্যক্তিতে রূপ দেওয়া যায়, তার সাথে খুনসুটি করা যায়, করা যায় অভিমানী অভিযোগ, চিঠি লিখে যে কাউকে ভালোবাসাও যায়- তার এক অনবদ্য প্রমাণ ‘সবিনয় নিবেদন’।


 তাঁর লেখা 'মাধুকরী'’ বাংলা সাহিত্যের জগতে অন্যতম একটি মাইলফলক। পৃথু, কুর্চি, রুষা, মগনলাল, ঠুঠা-এই সকল চরিত্রের মধ্যে কী যে  জাদু ছড়িয়ে আছে যা এড়ানো সম্ভব নয় কোনো পাঠকের পক্ষেই। এই উপন্যাসে কেউ কারও পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান করে না, এত সমান্তরালভাবে চরিত্রগুলোকে সম্পৃক্ত রেখেও বয়ে যেতে দিতে তিনিই পারেন! 


আজ তাঁরই লেখা 'গানের ভুবন' প্রসঙ্গে আমার পাঠানুভবেই তাঁর প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ।

 
 
প্রথমেই বলে রাখি এই বই স্মৃতিকথামূলক।
লেখক যেসকল গুণী শিল্পীদের সান্নিধ্যে এসেছেন,তারই কিছু স্মৃতিকথন এ বইয়ের দু-মলাট জুড়ে। শুরুতেই লেখক জানিয়েছেন, "প্রথমেই স্পষ্ট করে বলা দরকার যে আমি একজন বিশুদ্ধ 'আতাঈ'। গানবাজনার কিছুই বুঝি না। গান গাইতেও জানি না। কিন্তু গানই আমার প্রাণ। আমার 'অ্যাকিলিসে'স হিল'।
ছাত্র বয়সে লেখক গান শিখেছিলেন তুলসী লাহিড়ীর ভাই সামু লাহিড়ীর কাছে। আকাশবাণী তখন গার্স্টিন প্লেসে। অডিশন দিতে গিয়ে গাইলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত, "মম মন উপবনে"। কিছুদিন পর অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে আসা চিঠিতে জানতে পারেন তিনি পাশ করেননি।সত্তর দশকের শেষে অথবা আশির দশকের গোড়ায় যখন সেই অডিশন-ফেল করা তাকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অডিশন বোর্ডের মেম্বার করলেন কর্মকর্তারা তখন বিষম লজ্জায় পড়েছিলেন বুদ্ধদেব গুহ। গানের স্কেল সম্পর্কে তার ধারণা, "চানঘরে ঢুকে যেদিন যত জোরে কর খুলি সেদিন কলের জল পড়ার আওয়াজ যে স্কেলে বাঁধা হয়ে যায়,সেদিন সেই স্কেলই আমার স্কেল হয়ে যায়"।
সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে বি.কম পড়াকালীন তিনি ভর্তি হন 'দক্ষিণী'-তে। 'দক্ষিণী'-র সূত্রে বিভিন্ন গুণী শিল্পীদের সংস্পর্শে আসেন লেখক। তাঁদের মধ্যে আছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত জগতের সুনীল কুমার রায়,প্রসাদ সেন,অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়,কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়,নীলিমা সেন,সুবিনয় রায়,শান্তিদেব ঘোষ প্রমুখ দিকপাল শিল্পীরা। তার স্ত্রী প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকা ঋতু গুহ ঠাকুরমার সঙ্গে আলাপও এই 'দক্ষিণী'-তেই। "একক গাইল একটি ছিপছিপে ফর্সা,সদ্যযুবতী মেয়ে,তাঁতের লাল-কালো ডুরে শাড়ি পরা। দু'বিনুনি করা। লাল ব্লাউজ,কানে রুবির একজোড়া লাল দুল। গাইল, "জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ,ধন্য হল,ধন্য হল মানবজীবন"। সে গান শুনে আমার জীবনও ধন্য হল। মহড়া শেষ হওয়ার পরে জানলাম নবীনা গায়িকার নাম ঋতু গুহঠাকুরতা এবং সে শুভ গুহঠাকুরতার মেজদাদা এন.সি.গুহর মেয়ে"।

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে লেখক বলেছেন, "মোহরদি যে খুবই সুন্দরী সে সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিলেন নিজে। সাজতেও খুব ভালোবাসতেন। ঋতুর কাছে পরে শুনেছি যে,ঋতুর মায়ের আলমারি খুলে অনেক বাছাবাছি করে শাড়ি পড়তেন উনি"।শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসবের বৈতালিকে লেখকের হাত ধরে গানের দলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতেন মোহরদি। 'আমি রূপে তোমায় ভোলাব না', 'স্বপনপারের ডাক শুনেছি' , 'দূরে কোথায় দূরে দূরে' গানগুলি মোহরদি ছাড়া আর কারও গলায় শুনতে ভালো লাগে না বলে জানিয়েছেন লেখক।

জর্জদার (দেবব্রত বিশ্বাস) কাছে গান শেখা লেখকের জীবনে এক মধুর অভিজ্ঞতা। একবার এক ঘটনা ঘটেছিল, লেখক বলছেন, "সেদিন কোন গান আমাদের গাইতে হচ্ছিল আজ আর মনে নেই তবে মনে আছে সেই গানের আভোগে বা সঞ্চারীতে অমিয় একটু ভুল করেছিল।চিরদিনের হঠকারী আমি গুনগুন করে গেয়ে অমিয়কে ভুল ধরিয়ে দিতে যেতেই জর্জদা হারমোনিয়াম ছেড়ে দিয়ে বললেন, "অন্ধ ল্যাংড়ারে পথ দেখায়"।

চিরদিনই রবীন্দ্রসঙ্গীতের টপ্পার গানের প্রতি লেখকের বিশেষ দুর্বলতা ছিল। চন্ডীদাস মালের কন্ঠে "তবে প্রেম কী সুখ হতো, আমি যারে ভালোবাসি, সে যদি ভালোবাসিত"। এই নিধুবাবুর(রামনিধি গুপ্ত) টপ্পা গানটি শুনে তিনি ঋতুকে বলেছিলেন, "আমি গান শিখব"।
"হিন্দুস্থান রেকর্ডস্" থেকে পুরাতনী গানের ক্যাসেট বেরোবে। তাতে বুদ্ধদেব গুহ "ভালোবাসিব বলে ভালোবাসিনে" গানটি রামকুমারের গায়কীতে ভালো মেলে বলে তাঁর মতো করে গেয়েছিলেন।

ওস্তাদ রাশিদ খানকেও খুব স্নেহ করতেন লেখক। তার 'আলাপ' লেখককে রীতিমতো মুগ্ধ করে। লেখকের কাছে একবার অনুযোগ করেন রাশিদা, "কাকু,আমাকে সবাই রশিদ কেন বলে?আমার নাম তো 'রাশিদ'"। রাশিদ খুব ভালো বিরিয়ানি রাঁধতে পারে এবং তা কয়েকবার খাবার সৌভাগ্য হয়েছে লেখকের। ‌

পুজোর পরে জব্বলপুরে যাচ্ছেন লেখক। ট্রেনে আলাপ হল এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। নাম সাওয়ান্ত। তিনি গান শেখান। উচ্চাঙ্গসঙ্গীত। একটি ঠুংরি এবং একটি ভজন শোনালেন অনেক অনুরোধ-উপরোধের পর। লেখকের এত উৎসাহ দেখে তিনি লেখককেও গাইতে বললেন।  বুদ্ধদেব গুহ লিখছেন, "গানের ব্যাপারে আমার কোনও হেলদোল ছিল না। গাইতে জানলে তো থাকবে! তার ছাড়া আমি তো সবসময়ই খালি গলাতেই গাই তাই বাজনা ছাড়া গাইতে কোনো অসুবিধাই হয় না। ঈশ্বরের আশীর্বাদে 'স্কেল'-এর জন্যে কোনও যন্ত্রের উপর আমাকে নির্ভর করতে হয় না"।
একবার 'দেশ' পত্রিকাতে সাগরময় ঘোষের অনুরোধে গান ও গায়ক-গায়িকা বিষয়ক দুটি বইয়ের সমালোচনা করেছিলেন লেখক। 'স্মৃতির অতলে' এবং 'কুদরত্ রঙ্গিবিরঙ্গী'।
একবার হৃষিকেশের গঙ্গার ত্রিবেণী ঘাটে একজন মারাঠি সন্ন্যাসীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল লেখকের। লেখকের জবানিতেই শোনা যাক পরবর্তী কথোপকথন। উনি বললেন, "গান ও গায়কদের প্রতি আপনার এত আগ্রহ কেন?আপনি কি গায়ক?
আমি চানঘরের গায়ক।
শুনি একটি গান।
লেখক শোনালেন, "জবনো অপনিপাদো'র বাংলা অনুবাদ "কেনো ভোলো মনে করো তাঁরে"।
উনি শুনে তারিফ করলেন। লেখক তাঁর কাছে একটি গান শুনতে চাইলে তিনি বললেন, "গান কি এখন শোনার? আপনি গভীর রাতে আসবেন। যখন ত্রিবেণী ঘাট একেবারেই সুন-সান্নাটা হয়ে যাবে,যখন শুধু নদীর জলের OBLIGATO থাকবে তখনই আপনাকে শোনাব গান। আসবেন"।

সমগ্র বই জুড়ে অজস্র স্মৃতির ঝাঁপি উপুড় করে দিয়েছেন লেখক। আমরা সেখান থেকেই খুঁজে নিই মণিমুক্তোরাশি। সমৃদ্ধ হই। আপনিও সেকালের নষ্ট্যালজিয়ায় ভেসে যেতে হাতে তুলে নিন 'গানের ভুবন' ।

........................

 


 



পাঠ প্রতিক্রিয়া - সুকন্যা দত্ত

পাঠ প্রতিক্রিয়া 

সুকন্যা দত্ত 


উপন্যাসসুপুরিবনের সারি 
লেখকশঙ্খ ঘোষ 

প্রকাশনী: অরুণা 

মূল্য: ৭০/-

 


 

'নীলুদের গ্রামটা না কি এখ অন্য একটা দেশভারি আজব কথা'—  আজব কথার সময়টা ভারত বিভাজনেরসময়টা নিজের দেশবিদেশ হয়ে যাওয়ারসময়টা তোমাদের-আমাদের এই দুইভাগে ভাগ হয়ে পাঁচিল উঠে যাওয়ার। 

"সুপুরিবনের সারি"— এ শুধুমাত্র 'কবি' শঙ্খ ঘোষের লেখা নয়, এটি একটি এমন মানুষের চোখ দিয়ে দেখা দেশভাগ, যে দেশকে নিজের আত্মার সাথে এক করেছে, সেই দেশ ছাড়তে যে শরীর থেকে আত্মাকে বিমুক্ত করার তুল্য বিজাতীয় যন্ত্রণায় আছাড়িপিছাড়ি খেয়েছে আর সেই যন্ত্রনায় কুঁকড়ে ওঠা মনেরই রূপরেখা এঁকেছেন শঙ্খ ঘোষ তাঁর 'নীলু'-র হাত দিয়ে। এক কিশোরের শেষবারের মত 'দেশে' যাওয়ার গল্প 'আর কোনোদিন দেশে না যাবার জন্য।'


একদিন দুপুরে কলেজের লাইব্রেরিতে বসে শঙ্খ ঘোষের কবিসত্ত্বাকে ছাপিয়ে আবিষ্কার করেছিলুম তাঁর দেশবোধকেতাঁর কিশোরবেলার মামাবাড়ি যাওয়ার অসীম আনন্দকেতাঁ দেশের প্রতিটি মানুষকেতাঁর বন্ধুতাঁর বাঙ্ময় দৃষ্টির তথাকথিত অর্থহীন শব্দ বলা 'পাগলীছোটমামীকেতাঁর ওপারে ফেলে আসা দিগন্ত বিস্তৃত শ্যামলিমাতাঁ সুবাসিত ফুলের বাগানতাঁর স্বচ্ছতোয়া নদীকাকচক্ষু পুকুরতাঁর দ্বাদশীর বিকেলে ঝুপ করে নেমে আসা সন্ধ্যের মুখে প্রদীপ জ্বলা তুলসীতলাআর সবচেয়ে বেশি রে সেই সুপুরিবনটাকেযার 'ওইপর্যন্তই হলো আমাদের গ্রামের সীমা। ব্যস্তারপরশেষ—' 


আবিষ্কার করেছিলুম দেশবিভাগের চুলচেরা রেখায় বিভক্ত হয়ে যাওয়া তাঁ ছোট্টবেলার বেলার বিষাদগ্রস্তএক ধাক্কায় হটাৎ বড় হয়ে যাওয়া বুঝদারভারী মনটাকেকারণ গল্পের 'নীলুযে তিনিই স্বয়ং তা লার আর অপেক্ষা রাখে না। আবিষ্কার করেছিলুম আর কখনও সেদেশে ফিরে যেতে না পারার নিষ্ফল আক্রোশের তাঁর বয়ঃসন্ধিকালকেতাঁর 'মুসলমানবন্ধুদের ব্যাকুলতাকে— 'আসিস কিন্তু আবারসামনেরবার। আসবি তোকী রেআসবি তোআসিস আবার। আসবি?', আর এর উত্তর দিতে না পারা নীলুর অপরিসীম অসহায়তাকে।নৌকায় করে নিজের দেশে ফিরতে থাকা নীলু চাইলেও কাউকেকিছুতেই বোঝাতে পারে না তার মাস্টারমশাই নির্মলবাবুর বলা কথাগুলোবাঙালি আর মুসলমান এরকম কোনো ভাগ হতে পারে না, 'দুটোয় গুলিয়ে ফেললেই মুশকিল। কটায় জাতের কথাএকটায় ধর্মেরকথা


'সুপুরিবনের সারি'- কে কিশোর উপন্যাস বলা হলেও এটি সবধরণের মানুষের মনে ঘরছাড়ার মনোবেদনা উদ্রেক করতেযথেষ্ট সক্ষম।কিশোর চোখের মধ্য দিয়ে নৈসর্গিক দৃশ্যের মাঝে জলপথে ভ্রমণের অপরূপ বর্ণনা দিয়ে শুরু হয়েছে উপন্যাসখানি। মাঝে ছুঁয়ে গেছে দেশমাতৃকার উদ্দেশ্যে জীবনের ঝুঁকি নেওয়া বিপ্লবীর কথা। রয়ে গেছে দুর্গাপুজোয় যৌথ পরিবারের পাত পেড়ে খাওয়ার আনন্দ। থেকে গেছে অনেক পরিজনের মাঝে একটি মানুষের আলাদা, নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়ার স্পর্শ। মিশে গেছে এক 'বাঙালি' কিশোর আর তার মুসলমান বন্ধুর মাঝে দেওয়াল ওঠার হাহাকার— "এইসব একদিন আমাগো হইয়া যাবে", আর এই সবকিছুর মাঝে গন্ডির মত মাথা তুলে রয়ে গেছে নীলুর দেশের সুপুরিবনের সারি। 

লেখক শক্ত শব্দার্থ বর্জিত খুব ছোট ছোট সরল সাবলীল বাক্যবিন্যাসে মাত্র ৯০টি পাতার মধ্যে জড়ো করেছেন নিজের দেশ হটাৎ বিভুঁইহয়ে যাওয়ার যাতনাকেতারসাথে যথোপযুক্ত সঙ্গত করেছে প্রবীর সেনে প্রচ্ছদ সবুজরঙের গন্ধ মাখা ম্বা গাছের সারি। 


বসে ছিলুম পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখতেলিখে ফেললুম আবেগমাখানো কিছু অনুভূতি। আসলে কষ্টের  বিচ্ছেদ হয়তো আমরা মেয়েরা এমনি এমনিই কিছুটা বুঝতে পারিআর তার জন্য হয়তো ওপারের মানুষ হতে লাগে না, এপারের মানুষ হয়েও নিজের বাড়িঘর আর তার লাগোয়া স্মৃতি মুছে লে আসার রক্তক্ষরণ কখনও না কখনও আমাদের সব মেয়েদের অন্তরেই যে চুঁইয়ে পড়ে, তাই...

                        "কেবলই করে ভয় 

                   এত যে লোক এত যে জন 

                      আমার কি কেউ নয়।"

                     
                             !! সমাপ্ত !!
 

 

পাঠপ্রতিক্রিয়া - সেফটিপিন - শুভদীপ কোলে

 

পাঠপ্রতিক্রিয়া

শুভদীপ কোলে

 

 

উপন্যাসসেফটিপিন

লেখকস্মরনজিৎ চক্রবর্তী

প্রকাশকআনন্দ

মূল্য২৫০ টাকা

 

 


 

 দিনের পরে রাত কেটে যায়... রাতের পরে দিন...

কার কাছে আজ লুকিয়ে রাখো তোমার সেফটিপিন!”

     ছোটবেলা থেকে দেখেছি মা সেফটিপিন দিয়ে আঁচল গেঁথে রাখে কিন্তু একটা সেফটিপিন কি সময় গাঁথতে পারে? মনে করুন ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দী হয়ে এই একবিংশ শতাব্দীকে গেঁথে রাখল একটা সোনার সেফটিপিন ব্রোচ স্মরনজিৎ বাবু কি মন দিয়ে প্রেম লেখেন যখনই তাঁর প্রেম পড়ি, আমি আবার প্রেমে পড়ি আবার প্রেমে পড়লামপড়লাম সেফটিপিনএর

 

     উপন্যাসটি শুরু হচ্ছে ঊনবিংশ শতাব্দীর আলমার যুদ্ধক্ষেত্রে ওয়াল্টার নামের এক সদ্য যুবা যুদ্ধের ময়দানে জেনারেলের থেকে উপহার হিসেবে একটা সেফটিপিন ব্রোচ পায়, সে ভাবে সেটা তার প্রেম ভার্জিনিয়া কে দেবে তারপর কি হয়? গল্প এসে পড়ে ২০১৮ তে আমাদের কলকাতাতে সিয়োনা আর বিরাজ এর গল্প হয়ে। তারপর গল্প চলে যায় উত্তাল সাতের দশকে যেখানে নকশাল কর্মী সাহিমার সাথে দেখা হয় রেয়াংশ এর। কি হয় তাদের গল্প? কেন গল্প রসিক লাল আর তার মেম বান্ধবী মেরীর সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কলকাতায় চলে গেল? সেও এক উত্তাল সময়। জাপানীরা বোমা ফেলেছে। গল্প ক্রমেই সময়ের গোলোক ধাঁধাঁয় এদিক ওদিক চলে যায়, কখন কোন সময় পড়তে পড়তে ভুলে যাচ্ছিলাম। সময় ঘুরতে থাকে সাথে সেফটিপিন ও। গল্প যত এগোয় বা বলা যায় কখনো কখনো পিছিয়ে যায় নিজের ছন্দে, তত বোঝা যায় যে প্রেমে পড়া সহজ, প্রেম পাওয়া না। বলতে না পারা সব প্রেম গুলো, না পাওয়া সব প্রেম গুলো সময়ের সাথে সাথে গাঁথা পড়ে সেফটিপিনে আর লুকানো কিছু খাতার পাতায়। সেই সেফটিপিন যা লক্কা পুটুর খাঁচায় চলে গেছিল। কি করে? তার খোঁজে বিরাজ সিমোয়া সত্যি কাছে আসে। তখন আদরের দাগের মত আকাশ আসে কলকাতায়। এই গল্প হল প্রেমের গল্প, প্রেম না পাওয়ার গল্প, প্রেম পেয়েও হারাবার গল্প আবার তাকে ফিরে পাবার গল্প। কে পেল আর কে হারাল জানতে গেলে পড়তেই হবে সেফটিপিন। কে কার সম্পর্কে কি তাও জানতে পড়তেই হবে সেফটিপিন। তবে বলতে পারি ভালোবাসা আশপাশেই থাকে তাকে খুঁজে নিতে হয়। 

......................



 Suvadip Koley