শিকার মহল
সোমা কাজী
রৌনক
যখন মুরারই স্টেশনে পা দিল তখন সবে ভোরের আলো ফুটছে। ওরা তিনজন, রৌনক, ওর
সাংবাদিক বন্ধু সায়ন আর ক্যামেরা ম্যান অংকুর। সুদূর কানাডা থেকে তিনমাসের
ছুটিতে ভারতে এসেছে রৌনক, ইতিহাসের তরুণ অধ্যাপক। অনেক ছোটবেলায় বাবার
সঙ্গে এখানে এসেছিল সে। মাস তিনেক ছিল। তখন থেকেই সায়নের সঙ্গে বন্ধুত্ব।
কানাডায় থাকলেও বন্ধুত্ব অটুট এখনো।
একটা টোটো নিয়ে
তিনজনে চলল বাঁশলৈ গ্রামের দিকে। একদিকে গাছপালা ঢাকা মোরামের রাস্তা আর
অন্যদিকে ঝিরিঝিরি সুরবতীকে পাশে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা পৌঁছে গেল
'শিকার-মহল'।
চারপাশে লোকালয় অথচ সামান্য দূরেই ঝোপঝাড়ে ঢাকা একটা খন্ডহর... চোখ দুটো জ্বালা করে উঠলো রৌনকের।
ক্যামেরাম্যান
একটা চাদর বিছিয়ে দিল সামনের ঘাসজমিতে। একসময় হয়তো সবুজ কার্পেটের মতো
ছিল, এখন বয়স্ক পুরুষের সপ্তাহ খানেক না কামানো দাড়ির মতো চারদিক বুনো
গাছের খোঁচায় জর্জরিত! ব্যাকপ্যাক নামিয়ে সায়ন শুকনো খাবার বের করল।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রৌনক আলুর পরোটার একটা টুকরো মুখে ফেলল। খুব খিদে পেয়ে
গেছিল সকলের।
হাতে ফোল্ডিং স্টিক নিয়ে সামনে দু'জন, পিছনে ক্যামেরাম্যান অংকুর। লাঠি ঠুকতে ঠুকতে রৌনক বলল,
-চারপাশ ভালো করে দেখতে দেখতে হাঁটো। সাপ তো বটেই বুনো জানোয়ারও যে দুটো একটা থাকবে না কে বলতে পারে?
আলিশান
প্রাসাদ না হলেও যথেষ্ট বড় বাড়ি। শ্যাওলা- ছোপ জরাজীর্ণ পাঁচিলে ঘেরা। এই
কারণেই দূর থেকে কেবল ভগ্নদশা গ্রস্ত দোতলাটাই নজরে পড়ে। চাতাল থেকে
আট-দশটা ধাপ উঠলে সার সার ঘর। দুপাশ দিয়ে ছাদে ওঠার সিঁড়ি। দরজার আর্চের
মাথায় ভারী সুন্দর লতাপাতার নকশা।
-দরজা নেই একটাও ঘরে! সায়নের কথায় রৌনক জবাব দিল
-চোর-ছ্যাঁচড়ের কাজ আর কি!
একমনে ছবি তুলছিল অংকুর। বলল
-এ বাড়ির গল্পটা তো জানা হ'ল না এখনো! -আগে তো চারদিক ঘুরে দেখি!
বলতে
বলতে মজে যাওয়া একটা ফুটিফাটা পুকুরের দিকে এগিয়ে চলল রৌনক। বেশ বড়সড় ছিল
একসময়। ভাঙা ঘাটের ফাটলে অজস্র রং- বাহারি ল্যান্টানা ক্যামেরা ফুলের ঝাড়।
দক্ষিণমুখী একটা জীর্ণ মন্দির।দেবী হংসেশ্বরী একসময় বিরাজ করতেন মন্দিরে।
শোনা যায় কোন তিনি নাকি রুষ্ট হয়ে অদৃশ্য হয়ে যান!
লেন্সে কভার পরাতে পরাতে অংকুর বলল,
- চা খাওয়া যাক, কি বলো?
ঘাটের একদম উপরের ধাপে বসল তিনজন । ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে এগিয়ে দিয়ে রৌনক শুরু করলো
- দিল্লিতে ফিরোজ শাহ তুঘলক শাসন করছেন। আমাদের পুরনো বাংলা তখনও স্বাধীন। যদিও জীবন যাপনে সুলতানি প্রভাব কিছুটা হলেও ছিল।
সায়ন বলল,
-তাই ইসলামিক আর্কিটেকচারের টাচ?
- একদম ঠিক। মাঝে কতগুলো বছর পেরিয়ে গেল...রৌনক বিড়বিড় করছিল।
চায়ের কাপে আয়েশ করে একটা চুমুক দিয়ে অংকুর বলল
-তুমি এতকিছু জানলে কি করে?
- জানতে হয় হে চিত্রগ্রাহক! ব'লে কথায় ফিরল রৌনক,
-বাঁশলৈ
থেকে একশো কিলোমিটারের মধ্যে পাকুড়। সেখানকার রাজাদের একটা অংশ চ'লে আসে
মহেশপুর ব'লে একটা জায়গায়। এখান থেকে কুড়ি কিলোমিটার প্রায়। খুব সম্ভব
শরিকি বিবাদ। ওখানেই তারা বসবাস করতে থাকে। আশপাশে সব সরল আদিবাসী। তাদের
কাছ থেকে এরা জলের দরে জমি কিনে নিজেদের এলাকা বাড়াতে থাকে। এখন মহেশপুরের
রাজবাড়িও প্রায় ভেঙে পড়েছে।
দীর্ঘশ্বাস চেপে আবার শুরু করলো রৌনক,
-এই
রাজবাড়িতে থাকতেন রাজা দীপ্রকর, রাজমহিষী ও তাঁর পরিবার। তখন চারদিকে ঘন
জঙ্গল। জঙ্গলে অজস্র পশুপাখি। রাজার ছিল শিকারের শখ। একবার শিকারের জন্য
তিনি এই বাঁশলৈয়ের কাছাকাছি জায়গায় এসে পথ হারিয়ে ফেলেন।এই যে পোড়ো বাড়ি,
এরই কাছাকাছি কোন জায়গায় একটা ছোট্ট মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তাঁর।
-দারুণ ইন্টারেস্টিং তো! সায়ন সাগ্রহে তাকাল রৌনকের দিকে।
চায়ের খালি কাপটা ঝোপের ভেতর ছুঁড়ে দিয়ে রৌনক বলল,
-শুনেছি
মেয়েটির বাবা নাকি রাজাকে সেই রাতে আশ্রয় দিয়েছিল তাদের বাড়িতে। আতিথেয়তায়
খুশি হয়ে রাজা গলার হার উপহার দেন মেয়েটিকে। আর এখানে বানিয়ে ফেলেন এই
'শিকার-মহল', মাঝে মাঝে শিকারে আসবেন বলে।
- বলো কি?
অংকুর ক্যামেরা ব্যাগে চালান করে দিয়ে চোখ বড়ো বড়ো করল দেখে রৌনক বলল,
- বোঝোই তো, রাজারাজড়াদের কারবার...
-আরে থেমে গেলে কেন? সায়নের কথায় হঠাৎ যেন জেগে উঠলো রৌনক।
-
রাজার পরের সব প্রজন্মের কারো বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না এই বাড়ি নিয়ে। কারণ
শিকার করার সখ টখ তাদের ছিলনা বললেই চলে! আস্তে আস্তে এক এক করে মহলের গা
থেকে দরজা জানালা খুলে নিতে নিতে একেবারে নিঃস্ব করে দিল চোরের দল। শেষে
ঝোপঝাড়ে মুখ ঢেকে প'ড়ে রইল বেচারা দুয়োরাণী হয়ে!
মুঘলদের
সরিয়ে বৃটিশ শাসন চালু হ'ল ভারতে। মহেশপুরের শেষ রাজা ছিলেন চরম লম্পট।এক
মালো মহিলাকে বিয়ের কথা দিয়ে তিনি সহবাস করেন। সে গর্ভবতী হয়ে পড়ে বিয়ের
কথা বললে তাকে রাজা পুরোপুরি অস্বীকার করেন। সেই তখন থেকে মালো জাতের
সঙ্গে রাজাদের চরম শত্রুতা। -মালো মানে জাতির নিরিখে নীচু...
তাই না? অংকুরের প্রশ্নে মাথা নেড়ে সহমত জানাল রৌনক।
মাথার
উপর সূর্য প্রায় উঠে পড়েছে। বেশ গরম লাগছে দেখে ওরা ঘাট ছেড়ে মূল বাড়িটার
দিকে রওনা দিল। ডানপাশের যে সিঁড়িটা ছাদে উঠে গেছে, তার গোড়ায় মস্ত একটা
জারুল গাছ। এত অনাদরেও বেগুনি ফুলে ছেয়ে আছে। হয়তো এখনো এ বাড়ির প্রতি
মমতায় ভরে আছে তার শরীর! ছায়ায় বসে লাঞ্চ সারলো ওরা। ভেতরে ভেতরে অস্থির
হয়ে উঠছিল রৌনক কিন্তু বাকিদের অনুরোধ ঠেলতে না পেরে ফের পোড়ো বাড়ির
গল্পকথা শুরু করল,
- অন্যান্য অনেক রাজাদের
মতো বৃটিশরা মহেশপুরের রাজাদের সম্পত্তিও দখল ক'রে একটা মাসোহারার ব্যবস্থা
করে দেয়। তাতেই তাদের চলতে থাকে। এদিকে সেই মালো মেয়েটি একটি ছেলের জন্ম
দেয়। কপাল দ্যাখো, রাজার ঘরে যার থাকার কথা সে থাকে দরমার ঘরে। শৈশব কৈশোর
ছাড়িয়ে সে যুবক হয়ে উঠলো ক্রমে ক্রমে। শরীর আর মনে তার অসম শক্তি। হঠাৎ
ঘটলো ঘটনাটা। একরাত্রে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে তখন সেই মালো যুবক
সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে আচমকা রাজবাড়ি আক্রমণ ক'রে রাজা, তাঁর দুই ছেলে
তাদের দুই স্ত্রীকে মেরে ফেলে। তার এবং মায়ের প্রতি অবহেলা সে সইতে পারেনি
মনে হয়। রানী ছেলেটার পায়ে প'ড়ে দুই নাতির প্রাণ ভিক্ষা চায়। যুবকটির দয়া
হয়। কিন্তু তাঁদের ঠাঁই হয় জংগলের আড়ালে থাকা 'শিকার মহলে'। সঙ্গে আসে
দরকারি জিনিস পত্র আর কয়েকজন চাকর-বাকর।
- এ যে ইতিহাসের পাতা ওলটাচ্ছি! সায়নের গলায় রীতিমতো মুগ্ধতা। রৌনক বলল,
-
বেলা পড়ার আগেই বেরোতে হবে কিন্তু! এখন চটপট শেষ করি। তা, রাজবাড়ির
পাহারাদার কিছু কুকুরও এলো রানীর সঙ্গে। বড়ো নাতি তখন বছর দশেক। বাইরে থেকে
খাবার দাবারের যোগাড় করে দেয় চাকরেরা। পরে একজন বাদে বাকি সকলে কেটে পড়ে।
দুটো ছাড়া বাকি কুকুরগুলোও অযত্নে মারা যায় একে একে। কুকুরের ভয়ে কোনো
বাইরের লোক ঘেঁষত না। বাড়িটার কথা বাইরের লোকে ভুলেই গেল প্রায়।
বড়
নাতিটি পরে পালিয়ে গিয়ে হাজির হয় মামাবাড়িতে। কারণ এখানে তার দম বন্ধ হয়ে
আসত নাকি! পিতৃমাতৃহীন ছেলেটাকে মামা উপযুক্ত করে মানুষ করেছিলেন।পরে সে
সেখান থেকে পড়াশোনা ক'রে বিদেশে পাড়ি জমায়। একটু দম নিল রৌনক।
-আমাদের
দেশে বৃটিশ শাসন শেষ হ'ল কিন্তু রানী অনেক চেষ্টা করেও মহেশপুরের
রাজবাড়ির দখল ফিরে পেলেন না। বড়ো অভিমানে তিনি আংটির হীরে খেয়ে আত্মহত্যা
করলেন। বড় নাতি এতদিন বিদেশ থেকে টাকা পাঠাতো, তাতেই চলতো রানী আর ছোট
নাতির। রানীর মৃত্যুর পর দেশে ফিরে শেষকাজ সেরে আবার ফিরে যায় বড়ো নাতি।
ছোট ভাই তার থেকে যায় এখানেই। পাসপোর্ট ভিসার ব্যবস্থা করা হলেও ঠাকুমা
কিংবা ভাই যেতে চায়নি তার কাছে। ২০১৫ সালে ছোট ভাইও মারা যায় বলে শুনেছি।
রৌনক উঠে দাঁড়ালো,
-চলো এবার ভেতরে ঢোকা যাক।
রৌনক
সামনে, পিছনে দু'জন। ঘরে বিরাট একটা টেবিলে চিনেমাটির ডাইনিং -সেট। একটা
কাপ গড়াগড়ি খাচ্ছে টেবিলে। বহু দিনের হলেও লেগে থাকা চায়ের চিহ্ন বোঝা
যাচ্ছে। এককোণে মেঝেয় তেলচিটে একরাশ চাদর বালিশ... ধুলোর পুরু স্তর
সবকিছুতে। কানেকশান কাটা ফ্রীজ, ঝাড়বাতি। মেঝের এককোণে মরচে পড়া স্টোভ আর
কিছু হাঁড়িকুড়ি। সুখী জীবনে অভ্যস্ত রানী শেষজীবনে হয়তো নিজেই কোনমতে দুটো
পেটের জন্য রান্না করতেন! এছাড়া আসবাব বলতে তেমন কিছুই নেই। বাইরের লোক
ভাবতেই পারবেনা এমন দীনহীন ভাবে রাজ পরিবারের মানুষ কাটাতে পারে! কোনমতে
বেরিয়ে আসা চোখের জল গিলে ফেলল রৌনক। সাংবাদিক সায়নের নির্দেশ মতো অংকুর
ছবি তুলতে ব্যস্ত। উল্টো দিকে বালিশের নীচে গোঁজা বিবর্ণ হলদে হয়ে যাওয়া
কিছু কাগজপত্র নজরে পড়ল রৌনকের। হাতে নিয়ে দেখল কয়েকটা খাম। খামের গায়ে
বিদেশি স্ট্যাম্প। ভেতরে চিঠি রয়েছে বোঝা যাচ্ছে। খামের ওপর ঠিকানা লেখা
হস্তাক্ষর রৌনকের খুব পরিচিত! আর রয়েছে পোকায় কাটা পুরনো পাসপোর্ট - ভিসা।
দুজনের নজর এড়িয়ে চটপট ব্যাগে সেসব ঢুকিয়ে নিল রৌনক।
বাড়িটা সরকারি অধিগ্রহণ হবে বলে শুনেছে রৌনক। তবে এ
ব্যাপারে কোনোভাবেই কোন সাংবাদিকের মুখোমুখি হতে চায়না সে। এখানেই মুছে যাক
সব পরিচয়। অবশিষ্ট চিহ্নগুলোও কি ভাসিয়ে দেবে সুরবতীর জলে! ভাবপ্রবণ হয়ে
যাচ্ছে কেন সে! ইতিহাস গরিমাময় হয়না সবসময়। অন্ধকারের ইতিহাস খুঁড়লে কেবল
ধূলোয় ধূসরিত হবে তার হাত! একটা মানুষের লালসার আগুনে ছারখার হয়ে গেছে
কতগুলো মানুষ! তাও বিনা দোষে। রৌনক বা তার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি কখনও নিজের
প্রকৃত পরিচয় দিতে পারবে দেশের মানুষের কাছে! সুদূর কোন্ অবিমৃষ্যকারী
পূর্ব পুরুষের কৃতকর্মের লজ্জা আজ এতকাল পরেও বুকটা বড় ভারী করে দিচ্ছে
তার!
সমস্ত বাড়ি ঘুরে যখন সবাই বেরলো,
বিকেল শেষ হব হব করছে। একদৃষ্টে রৌনক কিছুক্ষণ বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকল।
তারপর দূর থেকে মন্দিরের দিকে ফিরে প্রণাম জানিয়ে মনে মনে বলল,
-আমাদের কাছে তোমার অধিষ্ঠাত্রী যত্নেই আছেন। তাঁর অমর্যাদা হবে না আমি বেঁচে থাকতে!
.........................
অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি