মঞ্জুলিকা রায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
মঞ্জুলিকা রায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

স্বপ্নময়ী - মঞ্জুলিকা রায়

 

 স্বপ্নময়ী
মঞ্জুলিকা রায় 
 

       
 



ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরছিলেন অনিন্দ্যবাবু, অন্য দিনের থেকে আজ একটু আগেই বের হয়েছেন।  শরৎকাল চললেও দিল্লির আবহাওয়া এখনো বেশ  গরম।  সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে তবুও  আকাশে এখনো  সূর্যের শেষ রশ্মির ছটা। এতো তাড়াতাড়ি  বাড়ি ফিরে  কি   করবেন ভেবে বাড়ির কাছেই  একটা পার্কের সামনে গাড়িটা  রাখেন। পার্কে কিছু বয়স্ক মানুষ  ছোট ছোট গ্রুপ করে আড্ডা দিচ্ছে  আর কয়েকটি  বাচ্চা ছোটাছুটি করছে।  একটা ফাঁকা বেঞ্চি দেখে  অনিন্দ্য বসলেন, আশেপাশে মানুষের উপস্থিতি একধরনের উত্তাপ দেয় মনে,  নইলে বাড়ি গিয়ে তো সেই একা চুপচাপ সময় কাটানো! 

অন্যমনস্ক ভাবে বসে ছিলেন, হঠাৎ একটা নরম  রঙিন বল গায়ে এসে লাগায়  মুখ তুলে  দেখেন একটা দেড়  দুই বছরের   খুদে বাচ্চা  টলমল করতে করতে তাঁর দিকে  এগিয়ে আসছে। তিনি এগিয়ে গিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেন,  বলটা ওকে দিতে গিয়ে  দেখেন  বাচ্চাটার  আর  বলে  মন নেই, খুদেটা তাঁর  চশমা ধরে টানতে আরম্ভ করেছে । 
" এ মুন্না, বদমাশি মত করো।  ইধার আও " মেয়েলি গলার আওয়াজ কানে আসতেই অনিন্দ্যবাবু  তাকিয়ে দেখেন একটি বছর তেইশ চব্বিশের তরুণী তাঁদের দিকে  আসছে। বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামিয়ে দেন  । যখনই  কোনো বাচ্চাকে তিনি কোলে নেন তখনই বাচ্চার  গায়ের নরম ওম তাঁকে  মনে করিয়ে দেয়  চুষি কাঠি,  মায়ের কোল আর আদর, ফেলে আসা শৈশব ।  মনে মনে ভাবেন জীবনে  একটা বড় স্বপ্ন তাঁর  কখনো পূর্ণ হলো  না , কোনো শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরে ভাবা হলো  না যে এ আমারই সন্তান, এ আমারই সৃষ্টি! 

অনিন্দ্যর বাবা প্রণবেশ চৌধুরী  যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তাঁকে বিয়ে দেবার  কম চেষ্টা করেন নি কিন্তু বিয়ের নামেই তাঁর কেমন একটা অসম্ভব ভয় হয় , হাতপা ঠান্ডা হয়ে আসে। বিয়ে করেননি বলে আজও কোনো আফসোস নেই কিন্তু একটা সন্তানের বড় শখ ছিল তাঁর। 

আজ এই পড়ন্ত বেলায়  উত্তর ভারতীয় যুবতীটিকে দেখে মুহূর্তে চল্লিশ বছর পার করে নিজের ফেলে আসা শৈশবে পৌঁছে যান।  অনেকটা সেই তাঁর মতো মুখের আদল, সেই রকম দুধে আলতা গায়ের রঙ যা আম বাঙালিদের মধ্যে দুর্লভ।   
  
                                   *******

" বাবু,  বাবু ওঠ ওঠ,  আর ঘুমায় না,  ঝড় উঠেছে।  চল ছাদে যাই,  বৃষ্টি দেখবো,  চল চল। " মায়ের ডাকে দুপুরের ঘুম থেকে জেগে ওঠে বাচ্চা অনিন্দ্য ,  অবাক চোখে দেখে হাসি ঝলমলে মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মা।  মায়ের হাত ধরে ছাদে উঠে আসে,  বৃষ্টি দেখে খুশিতে আটখানা মা ছেলের হাত ধরে ভিজতে নেমে পড়েন। চোখ বুঁজলে আজও অনিন্দ্য  দেখতে পায়  বৃষ্টি ঝমঝম  ছাদে দুই হাত ছড়িয়ে গোল গোল পাক খেয়ে ঘুরছে  তার  মা, মায়ের  আজানুকেশ ভিজে  যাচ্ছে আকাশ ভাঙা জলে , শাড়ি উঁচু করে তোলা, ফর্সা পায়ে রূপোর নুপুর ঝকমক করছে। পাক খেতে খেতে ছেলেকেও মা কাছে টেনে নেন,  মুখে ছড়া কাটেন  ' আনি মানি জানি না,  এ কাদের ছেলে চিনি না। " শুনে ছেলে ঠোঁট ফুলায়,  ছেলের কপালে চুমু এঁকে মা বলেন " দূর পাগল, এটা তো খেলা। "  

অনিন্দ্যর আজকাল মনে হয় তার মা যেন এক জীবন্ত প্রহেলিকা ছিলেন বা হয়তো বা সেইভাবে বড়ই  হন নি কখনো  । তার বাচ্চা মা তাকে নিয়ে নানারকম ছেলেমানুষী খেলা খেলতেন  ,  কখনো আচার চুরি করে দুজনে মিলে ছাতের চিলেকোঠায় লুকিয়ে লুকিয়ে খেতেন  কিন্তু  লুকানোটা কার থেকে!   বাবা তো তখন ব্যবসাকে  বড় করার নেশায় পাগলের মতো ছুটছেন,  বাড়িতে থাকতেনই না।  বাড়িতে বাচ্চা অনিন্দ্য আর তার তরুণী মা ছাড়া ছিল কয়েকজন কাজের লোক। 

তারা  সবাই বাবাকে যমের মতো ভয় পেতো তাই মা ও ছেলের দুষ্টুমির কথা বাবাকে কেউ জানাবেই না কিন্তু মা এমন আচরণ করতেন যেন অদৃশ্য কেউ একজন তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে এবং  তার থেকে তাদেরকে লুকিয়ে বাঁচতে হবে। বাচ্চা অনিন্দ্যর কাছে এটা অবশ্য একটা খেলার মতো ছিল। 

মা তার থেকে মাত্র সতেরো বছরের বড় ছিলেন।  নামেও কমলিনী দেখতেও প্রস্ফুটিত পদ্মের মতো সুন্দর। একাত্তরের বাংলাদেশের  মুক্তিযুদ্ধের সময়ে খুলনা থেকে তার দাদু দিদিমা আর পনের বছরের কিশোরী মা এইদেশে পালিয়ে  এসেছিলেন। রূপসী মেয়েকে নিয়ে দাদু দিদিমার অসম্ভব চিন্তা ছিল তাই তারা আর ওইদেশে ফিরে যান নি।  খড়দায় একটা ছোটো বাড়ি বানিয়ে এখানেই থেকে যান কিন্তু  রূপসী মেয়েকে  নিয়ে এখানেও তাঁরা  নানারকম  বিপদের মুখে  পড়লেন। 

মা খুলনায় ক্লাস নাইনে পড়তেন কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ফলে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এদেশে আসার পরে মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে ভয় পাচ্ছিলেন ওনার বাবা মা, ফলে বাড়িতেই বসে থাকতে হচ্ছিল , প্রচুর বিয়ের সম্বন্ধ আসছিল কিন্তু সেসব দাদু দিদিমার মনমতো  হচ্ছিল না। অনিন্দ্যর বাবার পিসি ওনাদের প্রতিবেশী ছিলেন, তিনিই এই বিয়েতে ঘটকালি করেছিলেন। 

    প্রথমে অনিন্দ্যর বাবা রাজি ছিলেন না ।  চালচুলোহীন গরিব রিফিউজি পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করার  ইচ্ছে তাঁর ছিল না কিন্তু পরে  কমলিনীর ফটো দেখে  তিনি এতটা মুগ্ধ হয়ে যান যে কয়েক দিনের মধ্যেই  শুধু শাঁখা সিঁদুর দিয়ে গরীব রিফিউজি পরিবারের  মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসেন। 

তাঁদের  বিয়ের পরপরই অনিন্দ্যর একমাত্র পিসি একটি দুর্ঘটনায় মারা যায় আর  প্রণবেশের মাকে  মেয়ের  বাচ্চাদের  সামলানোর জন্য সেখানে   গিয়ে থাকতে হয়েছিল।  ফলে বিয়ের পর থেকে কমলিনী বাড়িতে প্রায় একাই থাকতেন  ।  জামাইয়ের বাড়িতে মাত্র দু বছরের মধ্যেই প্রণবেশের মায়েরও  মৃত্যু হয়। 

বিয়ের  পর প্রণবেশ  সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে কালচার্ড বানাতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন।   স্ত্রীকে সবরকম ভাবে গড়েপিটে নেবার উদগ্র বাসনায় তিনি খেয়ালও করেন নি ষোলো বছরের মেয়েটি  কি চায় ! বাংলাদেশের উন্মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে বড় হয়ে ওঠা মেয়েটি উত্তর ভারতের রুক্ষ, শুষ্ক আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে উঠতে পারছিল না। কোথায় বাংলার কোমল শ্যামলিমা আর কোথায় উত্তরের তীব্র দাবদাহ !  স্বজনহীন পরবাসে মেয়েটি রোজ মরছিল, বন্ধুবান্ধব নেই,  কথা বলার কেউ নেই, 
বাড়িতে অধিকাংশ  সময়ই কমলিনীকে   একা একাই থাকতে হতো। 


 প্রণবেশ মানুষটিও খানিক রুক্ষ   স্বভাবের,  তিনি  চোদ্দ বছরের ছোট স্ত্রীর বন্ধু কম অভিভাবক বেশি ছিল। একা একা দূরে প্রবাসে থাকা,  স্বামীর কড়া শাসন আর সময়ের আগেই মাতৃত্বের চাপেই বোধহয় কমলিনীর মানসিক অসুখের সূত্রপাত হয়েছিল। এমনিতে  ভালোই থাকতেন,  খুব আনন্দে আছেন,  ছেলের সঙ্গে গল্প করছেন, খেলছেন,  গান গাইছেন আবার কখনো কখনো গুম হয়ে পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকতেন, বাইরের কোনো কিছুই তখন তাকে স্পর্শ করতে পারতো না। ছোট্ট অনিন্দ্যর মনে আছে দুপুরের ঘুম ভেঙে পাশে মাকে না দেখতে পেয়ে সে সারা বাড়িতে মাকে খুঁজছে,  ডেকে ডেকে গলা ফাটিয়ে ফেলার উপক্রম কিন্তু  মায়ের কোন সাড়াশব্দ নেই।  খুঁজতে খুঁজতে কখনো সে মাকে খুঁজে পেত আলমারি আর দেওয়ালের মধ্যে ছোট একটা কোণার মধ্যে হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে আছে।  মাকে হাত দিয়ে স্পর্শ করলেও মা কোন সাড়াশব্দ করতেন না।  মায়ের হাঁটু ছোঁয়া চুল খোলা অবস্থায় মাটিতে লুটোচ্ছে,  তখন কেমন একটা ভয়ে অনিন্দ্যর বুকের মধ্যটা  সিরসির করে উঠতো।  মাকে হাত দিয়ে অল্প অল্প ঠেলা দিলেও মা সেইরকম পাথরের মূর্তির মতোই বসে থাকতেন,  শেষে যখন অনিন্দ্য ভয় পেয়ে কান্না জুড়তো তখন যেন মায়ের হুঁশ ফিরে আসতো।  ভয় পাওয়া ছেলেকে বুকে চেপে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করতেন যে এটা একটা খেলা,  তিনি স্টাচু স্টাচু খেলছিলেন।  অনিন্দ্য বাচ্চা হলেও কেমন করে যেন বুঝে যেত এটা খেলা নয়,  সিরিয়াস কিছু। মায়ের এই ঘোর লাগা অবস্থা বেশ কয়েকদিন ধরে চলতো, তারপরে আবার সেই পুরনো আনন্দময়ী রূপে ফিরে আসতেন । 


অনিন্দ্যর বাবাকে তখন ব্যবসার নেশায় পেয়েছে,   ব্যবসায়  যত শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছিল ততই তিনি কম সময় দিচ্ছিলেন তার পরিবারকে।   অনিন্দ্যর বাবা ছেলেকে সময় না দিলেও তার জন্য নামকরা গৃহশিক্ষক নিয়োগ করেছিলেন, তাদের তত্বাবধানে সে স্কুলে ভালোই রেজাল্ট করতো।   অবোধ বেলায়  কোনো দুঃখ বা মানসিক কষ্ট তাকে ছুঁতে পারে নি কারণ তখন তার জগতে তার মা ছিলেন। 

                                            ********

যখন  অনিন্দ্যর  বয়েস সাত বছর তখন একদিন দুপুরে হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে যায়। দুপুরে ভাত খাবার পরে সে  মায়ের সাথে  শুয়ে ঘুমিয়েছিল। ঘুম ভেঙে দেখে মা পাশে নেই। সে ভেবেছিল মা বোধহয় আবার তার সাথে সেই লুকোচুরি খেলাটা খেলছে।   মজা পেয়ে হাসতে হাসতে সে এঘর থেকে ও ঘরে মাকে খুঁজতে থাকে। একা একা ছাদ পর্যন্ত ঘুরে আসে। মাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে ভীষণ অভিমানের সাথে বলেছিল " কোথায় লুকিয়ে রয়েছো?  আমি খুব রেগে গেছি কিন্তু !  তোমার সাথে আমার  আড়ি আড়ি আড়ি!  আর কক্ষনও কথা বলবো না। "


এরপরেও যখন মা সাড়া দিলেন না তখন ভয় পেয়ে সে কাঁদতে আরম্ভ করে । কাঁদতে কাঁদতে সে দোতলা থেকে একতলায় নেমে এসেছিল। একতলাটায়  অনিন্দ্যর বাবার  অফিস, ঘরে থাকার সময়ে কোনো ক্লায়েন্ট আসলে বাবা নিচের তলার অফিস ঘরটা ব্যবহার করতেন। খুঁজতে খুঁজতে অনিন্দ্য একতলার অফিস ঘরে আসে। 

বাথরুমের দরজা খোলা দেখে সে সেদিকে যায় , তখনি  দেখতে পায় সাদা ধপধপে পোর্সিলিনের বাথটবের মধ্যে লাল রঙের জলের মধ্যে মায়ের মুখটিই শুধু ভাসছে যেন রক্তের সরোবরের মধ্যে একটা শ্বেত পদ্ম ফুটে আছে,  মায়ের মাথার খোলা চুল কিছুটা জলে আর কিছুটা  বাথটব পার করে বাথরুমের মেঝেতে লুটোচ্ছে।  কেমন একটা অবুঝ ভয়ে সে কেঁপে  ওঠে ,  চেঁচিয়ে কাঁদতে থাকে মা মা বলে, কাছে গিয়ে মায়ের চুল ধরে টানে তখনি দেখতে পায়  বাথটবের পাশে খানিকটা রক্ত আর একটা রক্তমাখা ছুড়ি পড়ে আছে। 


প্রচণ্ড ভয়ে তার ছোট্ট শরীরটা কেঁপে উঠেছিল, চোখ অন্ধকার হয়ে আসছিল,  সে বুঝতে পারছিল  সে প্যান্টে হিসু করে ফেলেছে,  পা গড়িয়ে সেই হিসু গিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা রক্তের সাথে মিশতে থাকে ,  অনিন্দ্যর চোখে আঁধার ঘনিয়ে আসে, সে কাঁপতে কাঁপতে বাথরুমের মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। 


এরপর তার আর কিছু মনে নেই,  বড় হবার পরে শুনেছিল তাদের কাজের মাসি তাদের দুজনকে একতলায় খুঁজে পেয়েছিল। সেই রাতেই অনিন্দ্যর  প্রচণ্ড কনভালশন আর হাই টেম্পারেচার ওঠে। সেরে উঠতে বহুদিন লেগেছিল,  প্রায়ই বেড ওয়েটিং হয়ে যেত। স্বপ্ন দেখতো  লাল সায়রের জলে মায়ের মুখখানা শ্বেত পদ্মের মতো ভাসছে।  বাবা তখন দিন রাত এক করে তার সেবা করেছিলেন, ব্যবসা ভুলে সারাক্ষণ তার পাশে থাকতেন। ধীরেধীরে সে ভালো হয়ে উঠেছিল, বড় হয়ে সে জানতে পেরেছিল যে তার মায়ের বাইপোলার ডিসঅর্ডার ছিল। 

মায়ের মৃত্যু সে কখনো ভুলতে পারে নি, বাবার সাথে থাকলেও সম্পর্কে প্রচুর দূরত্ব তৈরি ছিল। বাবা যা বলতেন বা যেটা চাইতেন তার বিরুদ্ধতা করা স্বভাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। একই বাড়িতে তাঁরা দুটো দ্বীপের মতো বাস করতেন। অনিন্দ্য কখনো সেইভাবে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে নি।
অনিন্দ্য ইউনিভার্সিটিতে পড়ান, বাবার মৃত্যুর পরে ব্যবসা বেচে দিয়েছেন, তাঁর ধন সম্পত্তি, বিদ্যা, সম্মান সব আছে কিন্তু তাঁর কোনো ঘর হয় নি। স্বপ্নে  আজও  একটি নূপুর পরা রূপসী তরুণী  তাঁর কাছে  আসে। আবছা স্বপ্নের মতো একটি অবয়ব তাঁকে ঘিরে আবর্তিত হয়, ফিসফিসিয়ে যেন বলে " আনি মানি জানি না, পরের ছেলে মানি না। "

                                                                 ******
 
 



প্রবাহমান - মঞ্জুলিকা রায়

 


প্রবাহমান 
মঞ্জুলিকা রায় 
 

 

ট্রেনটা আধ ঘন্টা লেট ছিল,  স্টেশনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় একটা বেজে গেল। ভোরের ফ্লাইটে দমদম তারপর সেখান থেকে শিয়ালদায় এসে ট্রেন ধরেছিল। টিকিট তো আজকাল অন লাইনেই কাটা হয় তাই অসুবিধা কিছু হয় নি তাছাড়া সাথে নীলেশও এসেছে, ওকে ট্রেনে বসিয়ে দিয়ে গেছে।  নীলেশের  মাসির বাড়ি যাদবপুরে সেখানেই  থাকবে ও,  ইন্দ্রাণী ফিরে এলে তখন দুজনে মিলে দিল্লি উড়ে যাবে   ।   নিজের ভারী ট্রলিটা টানতে টানতে স্টেশনের বাইরে এসে একটা রিক্সা নিয়েছে  ইন্দ্রাণী।   বহুদিন পরে সে এসেছে  নিজের শহরে,  যে শহরে সে  কাটিয়েছিল  জীবনের প্রথম একুশটা বছর।  রিকশা চলছে আর তাঁর চোখের সামনে  দৃশ্যমান হচ্ছে তাঁর চেনা রাস্তাঘাট।  মেন রোড থেকে বাঁদিকের রাস্তাটা গেছে তাঁর কলেজের দিকে,  স্কুল,  মেয়েবেলা,  বহু স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে এই শহরের  পথে ঘাটে, রাস্তার পাশের গাছপালায়,  পথের ধুলোবালিতে,  কতো সুখ দুঃখের স্মৃতি,  কতো লড়াই,  কতো অপমান ,  অভিমান   গল্প হয়ে মিশে আছে এখানে  ।  চোদ্দো বছর আগে এই শহরটাকে ছেড়ে সে পাকাপাকিভাবে রাজধানীতে  চলে 
গিয়েছিল কিন্তু  তাঁর বুকের মধ্যে সবসময়ই একটা দ্বীপের মতো ভেসে থাকতো এই মফস্বল শহরটা যেখানে থাকেন  তাঁর বাবা,  তাঁর ফেলে আসা জীবনের একমাত্র যোগসূত্র। 


বাবা নামক যোগসূত্রটাও ছিঁড়ে গেছে কয়েকদিন আগে,  চতুর্থীর কাজ ইন্দ্রাণী  করেছে তাঁর দিল্লির বাড়িতে  বসে,  আজ বাবার ঘাটকাজ,  সে যাচ্ছে বাড়ির লোকেদের জন্য কাপড়চোপড় আর যেসব সামগ্রী এইসময় দিতে হয় সেসব পৌঁছাতে।  ইন্দ্রাণীর শাশুড়ীমা খুব বুঝদার মহিলা,  তিনিই সব কেনাকাটা করেছেন,  ট্রলিতে  প্রত্যেকের  কাপড়চোপড়ে তিনিই নাম লিখে গুছিয়ে দিয়েছেন।  ইন্দ্রাণী জানে বাড়ির কাজের লোকেদের জন্যেও তিনি   ঠিক  কাপড় কিনেছেন।  এইসময় ইন্দ্রাণীকে  একটুও বিরক্ত করেন নি তিনি।  এমন নয় যে বাবার মৃত্যু খুব অপ্রত্যাশিত ছিল,  বাবার বেশ বয়েস হয়েছিল,  প্রেশার সুগার সবকিছুই ছিল তবু বাবা আছেন কোথাও, এই ভাবনাটা  ইন্দ্রাণীকে আশ্বস্ত করতো,  শান্তি দিতো,  তাঁর বিয়ের আগের জীবনে শুধু  দুটো লোকই তাঁর মনের মধ্যে আজ অবধি  বাস করেছে  বাবা আর তুলি।  তুলিকেও ইন্দ্রাণী ধীরেধীরে অনেকটা ভুলেছেন কিন্তু বাবা তো সবসময়ই বিরাজ করতেন মনের মধ্যে।  

বছরে এক দুইবার  কয়েক ঘন্টার জন্য ইন্দ্রাণী আসতো বাবাকে দেখতে কিন্তু কখনো রাত্রিবাস করে নি,  এছাড়া সপ্তাহে একবার অন্তত ভিডিও কলে সে বাবাকে দেখেতোই।  বাবার দেখাশোনা করে  বাচ্চু বলে যে ছেলেটি তাঁর মাইনে পত্তর, বাবার চিকিৎসার যাবতীয় খরচ চাকরি পাবার পর থেকে ইন্দ্রাণীই করে এসেছে। বাচ্চুকে সেই স্মার্ট ফোন কিনে দিয়ে, কিভাবে ভিডিও কল করা হয় সেটাও  শিখিয়েছিল  শুধু বাবাকে যাতে একবার চোখের দেখা দেখতে পারে, যাতে  দুটো  কথা বলতে পারে।  দাদারা   বিবাহিতা বোনের থেকে  বাবার খরচ নেবে না বলে  খুব আপত্তি জানিয়েছিল  কিন্তু ইন্দ্রাণী বলেছিল " কেন,  আমিও কি  বাবার সন্তান নই ,  বাবার জন্যেই  আজ আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি ,  সন্তান হিসাবে আমারও তো  কিছু  দায়িত্ব , কর্তব্য  আছে । 
 তখনও বাবাই তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে, দাদাদের বলেছিলেন " তুমরা বুইনরে বাঁধা দিও না,  ও তো তুমাগো  থিক্যা কহনো কিস্যু চায় নাই, আজ একইখ্যান আব্দার করতাসে, হেইডা তুমরা মাইন্যা লও। ", 

বাবার কথা ভাবতেই চোখ ভিজে এলো ইন্দ্রাণীর,  তাঁর জন্মাবধি বুড়ো, অসহায়,  কোলকুঁজো হয়ে থাকা,  নিড়বিড়ে স্বভাবের বাবাই তো  তাঁর শৈশব কৈশোরের একমাত্র আশ্রয় ছিলেন ,  বাবার যতটুকু ক্ষমতা ছিল তাই দিয়ে তিনি রক্ষা করতে চেয়েছিলেন তাঁর প্রায় বৃদ্ধ বয়েসে জন্মানো কন্যাটিকে।   সবসময় যে তিনি সফল হয়েছেন এমনটা নয় কিন্তু আজ যে ইন্দ্রাণী জীবনে  দাঁড়িয়েছে সেটির সমস্ত কৃতিত্ব তাঁর বাবার।  গ্রাজুয়েশনের পরে  বিয়ে দিয়ে  হাত ধুয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন   ইন্দ্রাণীর মা আর দাদারা।  ইন্দ্রাণীর কান্না দেখে বাবাই তখন জিদ ধরেছিলেন,  সহজ ছিল না সেই পথ,  বাবা খাওয়াদাওয়া ত্যাগ করায় শেষ পর্যন্ত  মা  বাধ্য হয়ে দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্স   থেকে  পোস্ট গ্রাজুয়েশন করার অনুমতি দিয়েছিলেন। রাজধানী  তাঁকে ফিরিয়ে দেয় নি,  পড়তে এসে সে এখানেই খুঁজে পেয়েছে  স্বনির্ভরতা, পেয়েছে সম্মান, ভালোবাসার ঘর  ,  জীবনসাথী নীলেশ   আর মায়ের মতো স্নেহশীলা শাশুড়ী মাকে । কলকাতায় আসার আগের জীবনটা ছিল বঞ্চনার, অপমানের, অসম্মানের,  বাবা ছাড়া তাকে কেউ আপনজন বলে ভাবেই নি,  আপনজনদের চূড়ান্ত খারাপ ব্যবহারে বারেবারে রক্তাক্ত হতো  ছোট্ট  ইন্দ্রাণীর হৃদয় ! 


----বাবা, ও বাবা তুমি আমারে  বুল্টির মতো কালা  ছিট ছিট দেওয়া সাদা ফ্রক কিইন্যা  দিবা ?  


------ তুমার মায়েরে কও সুনা,  মায় কিইন্যা দিবো নে। 


------ মা দিবে না,  মা কইছে সাদা জামায় আমারে  আরও কালা  লাগবো । তুমি দিবে  বাবা? 


পাঁচ বছরের মেয়ের চোখ মুছিয়ে তার বাবা বলেন ' নিশ্চয়ই দিমু মা,   তর মায়  একখান আবুদা,  আমার এমন সোন্দর মাইয়ারে কালী কয়! 


সাদার উপর পোলকা ডট ফ্রকের শখ বলাবাহুল্য মেটে নি মেয়েটার । বয়েস যখন বারো  তখন সরস্বতী পূজোয় মেয়েটার বন্ধুরা  সবাই শাড়ি পরবে বলে ঠিক করেছিল ,  মেয়েটা ভয়েভয়ে মাকে গিয়ে বলেছিল " তুমার  পুরানা  আলমারির নীচের তাহে   একখান লাল সিল্কের শাড়ি আসে  ,  ওই শাড়িটা আজ পরুম ? "


মায়ের ঠোঁটের বক্র হাসিটি কখনো ভুলতে পারবে না ইন্দ্রাণী,  " তয় আর তরে দ্যাখতে  হইবো না,   এক্কেরে টিকায়  আগুন লাগসের নাহান লাগবো। "


সেই পুজোয় আর ঠাকুর দেখতে বাইরে যাওয়া হয় নি ইন্দ্রাণীর, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বারো বছরের বাচ্চাটি শুধু  নিজেকেই দেখছিল,  নিজেকে তাঁর দেখতে খারাপ লাগে না কখনো ।  তার মা আর দুই দাদা ছাড়া আর তো কেউ তাকে এইসব বলেও  না!  ইন্দ্রাণীর পিসি থাকতেন পাশের পাড়ায়,  মায়ের সাথে পিসির ছিল আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক।  পিসি আর কারুর সামনে নিজের ক্ষোভ না উগরাতে পেরে তাকেই শোনাতো। " তর মায়ের ধলা  রঙ লইয়্যা বড়ই অহংকার  রে,  আমারে হে কইতো ভাগ্যিস ঠাহুরজামাই ধলা হইসেন তাই তুমার মাইয়াদের পার করতে  পারসো,  তুমার রঙ পাইলে আইবুড়া হইয়্যা ঘরেই পইচ্যা  মরতো। "


আরও  খানিকটা বড় হবার পরে পিসির থেকেই সে শুনেছিল " তুর মায়ের ধারণা আসিলো হ্যার কহনো মাইয়া হইবোই না,  আমারে কইতো  ঠাহুরঝি তুমার হইলো মাইয়া বিয়োইবার প্যাড আর আমার প্যাডে আমি চাইলেও  মাইয়া বিয়াইতে পারুম না।তর মায়ের সেই গুমোর ভাইঙ্গা গেলো যহন বুড়া কালে তুই জন্মাইলি,  হেই কারণে ও তুরে দ্যাখতে পারে না। "


ইন্দ্রাণী  যখন জন্মান তখন তার বাবার বয়েস পঞ্চাশ আর মায়ের বয়েস বিয়াল্লিশ,  মাসিক অনিয়মিত হওয়ায়   মা নাকি প্রথম দিকে বুঝতেই পারেন নি যে তিনি আবার অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন। যখন বুঝলেন তখন দেরি হয়ে গিয়েছিল,  মায়ের অ্যানিমিয়া ছিল,  ডাক্তার অ্যাবোর্ট করতে রাজি হন নি। বুড়ো বয়েসের মেয়ে তায় আবার গায়ের রঙ চাপা   মা নাকি তাকে  ছুঁয়েও দেখেন নি,  বাড়ির বুড়ি ঝি গোপালের মায়ের যত্নে ইন্দ্রাণী বেঁচে যায় । জ্ঞান হবার পর থেকেই ইন্দ্রাণী বুঝেছিল  আর পাঁচটা বাচ্চার মতো তার জীবন নয়।  তাঁর দুই দাদা যাদের একজনের বয়েস তাঁর জন্মের সময়েই ছিল   প্রায় বাইশ   আর একজনের আঠারো তাঁদের হাতেই ব্যবসা, রোজগারের চাবিকাঠি। বাবা বুড়ো মানুষ,    সংসারের কোনো কিছুর উপরেই বাবার কোনো জোর নেই। বড় হবার বুঝতে পেরেছিল  আসলে বাবা ততটা বুড়ো ছিলেন না কিন্তু  মেয়ে জন্মানোর  পরে  দুই সাবালক ছেলের রাগ ভাঙানোর জন্য ওদের হাতেই ব্যবসার রাশ ছেড়ে দিতে  বাবাকে বাধ্য করেছিলেন মা। মানুষটা বড়ই নিড়বিড়ে স্বভাবের ছিলেন বলে সেইভাবে  প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ কিছুই করতে পারেন নি । অসময়ে ঘরবসত করার ফলে বাবা তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে গিয়েছিলেন। 

ইন্দ্রাণীর মা তার বড় দুই ছেলেকেই সংসারের কর্তা বানিয়েছিলেন,  ছেলেদের ছোটো থেকেই  প্রশ্রয় আর আদর  দিয়ে তাদের মাথাটা এতটাই  খেয়েছিলেন যে তারা পড়াশোনাটা শেষ  করতে পারে  নি।  ছেলেদের বিয়েও তাড়াতাড়ি দেন,  ছেলে বউমাদের অসম্ভব মাথায় করে রাখতেন যাতে তিনি সংসারে গৃহিণীর  পদটা বজায় রাখতে পারেন। ক্রমাগত মেয়েকে বঞ্চিত করে গেছেন,  খাওয়া পরায়, এমনকি পড়াশোনার ব্যাপারেও। ইন্দ্রাণী সেই ছোটবেলার থেকে বুঝতে পেরেছিল যে তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে আর সেই দাঁড়ানোর জন্য  পড়াশোনাটা ভালো করে  করতেই হবে।


ইন্দ্রাণীর সাত বছর বয়েসে তুলি জন্মালো,  বড় দাদার প্রথম সন্তান,  পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মতো ধপধপে গায়ের রঙ। তুলির একটু  জ্ঞান হতেই তুলিকে ইন্দ্রাণীর বিছানায় চালান করে দিয়েছিলেন ইন্দ্রাণীর মা। দু বছরের তুলি রাতের বেলা মাকে খুঁজতো,  নিজের জন্য যে মেয়েটি কখনো কিছু চাইতো না সেই নয় বছরের মেয়েটি গিয়েছিল তুলির হয়ে দরবার করতে। 
--" রাতে তুলি কান্দে, মনে লয় ওর মায়েরে  খুঁজে।  ওরে আমার সাইথ্যে শুইতে দিসো ক্যান? "
---- " বলদা মাইয়া, তুলির তো ভাই হইবো আর কিসুদিনের মইধ্যে,  ওরে  এহোন আলাদা শোওনের অভ্যাস করাইতে হইবো। 
--- কান্দে যে,  রাতে আমি ঘুমাইতে পারি না। 
----- পেরথম পেরথম কয়েক দিন কান্দবো, কাইন্দলে পরে তুর বুড়া আঙুলখান ওর মুহে ঢুকাইয়া দিবি, খানিক চুইষ্যা ও চুপ হইয়া যাইবো, এমনেও তো ওর মায়ের বুকে এহোন আর দুধ নাই। 

অবোধ বাচ্চাকে চুপ করাতে গিয়ে আর একটা নয় বছরের শিশুর বুড়ো আঙুলের ছাল চমড়া উঠে গিয়েছিল। 
তুলির পরে বিল্টু এলো,  ইন্দ্রাণী অবাক হয়ে দেখেছিল তাঁর সাথে যা যা অন্যায় হতো সেটি ওই দুধের বাচ্চা তুলির সাথেও হচ্ছে । ইন্দ্রাণীর ধারণা ছিল তাঁর মাজা মাজা রঙই তাঁর দুর্ভাগ্যের কারণ কিন্তু  তুলি তো ধপধপে ফরসা,  এতোটুকু বাচ্চার সাথে এইরকম অমানবিক আচরণের কারণ বুঝতে পারতো না বলে ও অনেকবার তুলির হয়ে ঝগড়া করেছে,  ধীরেধীরে বুঝতে পারলো যে কালো ফরসা নয় তাঁরা মেয়ে বলেই তাঁদের সাথে এইরকম  বিমাতৃসুলভ আচরণ করা হয় কিন্তু  তুলি দুধের বাচ্চা,   অতো শত বোঝার মতো বয়েস তখনও ওর হয় নি তাই বিল্টুর মুখে চকলেট দেখে গগনবিহারী  চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে তাঁর কাছে ছুটে ছুটে চলে আসতো,  " ও পিপি রে, আমারে  দেয় নাই  রে!  বিল্টুরে দিছে "!  প্রথম প্রথম ঝগড়া করলেও পরে বাবার থেকে যে দুই চার পয়সা পেতো তাই দিয়ে তুলির জন্য চকলেট কিনে আনতো,  তখন আবার অন্য বিপত্তির সৃষ্টি হতো।  বিল্টু  নাকি কান্না জুড়ে নালিশ জানাতো,  এক দুই বার  ভাইপোকে না দিয়ে  ভাইঝিকে দেবার জন্য ইন্দ্রাণী চড়চাপড়ও খেয়েছে কিন্তু বাবা জানতে পেরে হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দিতেন। ক্ষেপে গিয়ে বলতেন " মাইয়া মানুষের গায়ে হাত তুইল্যা রাবণরাজা নির্বংশ হইসে,  মাইয়ার গায়ে হাত তুললে বংশলোপ পাইবো "।  তারপর থেকে ইন্দ্রাণীর মা আর ইন্দ্রাণীর গায়ে হাত তুলতেন না কিন্তু বড়বৌদির হাতে তুলি মার খেতো। 

অপমানিত, অবহেলিত ছোট্ট তুলির প্রায় মা হয়ে উঠেছিল ইন্দ্রাণী,  তুলিকে বোঝাতো  " তোর যা ইচ্ছা হইবো আমারে কইবি,  বাবারে কইয়া আমি আনাইয়া দিমু,  অগোরে কিসু কইস না। "  তুলি তবুও ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতো " হক্কলরে দেয়, শুধু তোরে আর আমারেই দেয় না।  কাল কাকীরে মাছের মুড়া দিসিলো,  আমি কইলাম আমারেও দাও তো ঠাকুমা কইলো মাইয়া মানুষের অতো নোলা ভালা  না।  ক্যান রে পিপি,  কাকী কি ব্যাটাছেলে,  মাইয়া মানুষ নয় ? "   ততোদিনে ছোটদারও বিয়ে হয়ে বউ এসেছে,  ছোটদার যমজ ছেলেও হয়েছে,  ইন্দ্রাণীও বড় হয়ে উঠেছে,  বুঝতে পারতো ছেলের বউদের খাইয়ে দাইয়ে  আদর প্রশ্রয়ে   না রাখতে পারলে  ছেলেদের উপর  মায়ের কর্তৃত্ব রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে। এতো স্বচ্ছল পরিবারে সমস্ত কিপটেমি কেন তাঁদের দুজনের উপরেই হতো সেটাও বুঝতে ওদের অনেক  সময় লেগেছিল। পরে বুঝেছিল আবহমানকাল থেকে চলে আসা মনোভাব যে  মেয়েসন্তানের জন্মই হয় পরের ঘরে চলে যাওয়ার জন্য,  যারা কোনো উপকারেই লাগবে না তাঁদেরকে খাইয়ে মাখিয়ে কি লাভ হবে? 
এছাড়া আরও একটা ধারণা ছিল যে মেয়েদের শ্বশুর বাড়ির থেকে  কিছু পাবার আশা করাটাই   দুরাশা তাই তাঁদেরকে ভালো ভালো জিনিসের  অভ্যাস করিয়ে দিলে ভবিষ্যতে  মেয়েদের প্রতি খারাপই করা হবে !  তাই শৈশব থেকেই তাঁদের প্রতি কঠোর আচরণ করে ভবিষ্যৎ যমালয় মতান্তরে শ্বশুর ঘর করতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করাতে  হবে। 

ইন্দ্রাণী সেই ছোট বয়েস থেকেই বুঝেছিল সম্মানের সাথে বাঁচতে হলে তাকে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে।  তুলিকেও সেই শিক্ষাই দিতো,  কারুর সহায়তা ছাড়া পড়াশোনা করাটা অনেক কঠিন ছিল, ইন্দ্রাণীকে  ভালো রেজাল্টের জন্য অন্যদের প্রায় ডাবল পরিশ্রম করতে হতো।  তুলিকেও জোর করে পড়তে বসাতো,  বাবা অবশ্য বলতেন " রাঙ্গা মুলা, ওর হইবো না।  তোর যা মনের জোর আছে তা ওর নাই। মনের জোর ছাড়া কিসুই হয় না। " তারপর  ইন্দ্রাণী মাস্টার্স করতে দিল্লি  চলে গেলো ,  সেখানে গিয়ে ইন্দ্রাণীর যেন মেটামরফোসিস হয়েছিল, বাঙাল কথা বলা ছেড়ে দিয়ে পুরো আধুনিক মনের  মানুষ হয়েছিল,  তারপর চাকরি, নীলেশের   সাথে প্রণয় আর বিয়ে, শাশুড়ী মায়ের মধ্যে স্নেহমহী মাকে খুঁজে  পাওয়া, বুবলাইয়ের জন্ম,  সম্মান, আদরে উছলানো জীবন কাটছে তাঁর কিন্তু সবটাই এতো সহজে হয় নি। ইন্দ্রাণীর শাশুড়ী মা ডিভোর্সি , কলেজে পড়ান তার উপর নীলেশরা  কায়স্থ সব মিলিয়ে বিয়ের সময়ে তাঁদের প্রাচীন পন্থী বাড়িতে যেন  ঝড় উঠেছিল। 

ইন্দ্রাণীর মা বলেছিলেন " বরকে ছাইড়া দিছে যে মাইয়ামানুষ হের সাথে বেশ্যার কোনো ফারাক নাই! ' অথবা " কায়স্থ আমাগো ভিতরবাড়ির চৌকাঠ পার হইতে পারবো না "।  বলা বাহুল্য এইসব বলে মা আর দাদারা তাঁর বিয়েটা মেনে নেয়নি এবং বিয়েতে একটা পয়সাও খরচ করে নি। তাতে অবশ্য ইন্দ্রাণীর কিছু যায় আসে নি,  বাবাকে প্রণাম করে সে ঘর ছেড়ে চলে এসেছিল। বাবার খুব ইচ্ছা ছিল ঠাকুমার গলার সাত লহরী হারটা তাঁকে দেওয়া হোক কিন্তু  মা আর বউদিরা তাতেও বাধা দিয়েছিল।  বাবার চোখে জল দেখে  সে হেসে বলেছিল " থাক না বাবা,  ওটা নাহয় তুলির বিয়েতে দিও।  বাড়ির কোনো মেয়ে পেলেই তো হলো। "   বিয়ের পরে নীলেশকে  নিয়ে বাবাকে প্রণাম করতে গিয়েছিল।  বাবা নীলেশের  হাত জড়িয়ে ধরে  কেঁদেছিলেন আর বলেছিলেন " আমার এই মাইয়াডারে দেইখ্যো বাবা,  তুমার হাতে অরে তুইল্যা দিতাসি,  বড্ডো অভিমানী মাইয়া আমার, কহনো মুখ ফুইট্যা কিস্যু চায় না তবে খুব বুঝদার,  এমন মাইয়া ভূভারতে কমই আসে। " নীলেশ  বাবাকে আশ্বস্ত করেছিল। 

দশ বছরের বিবাহিত জীবন যেন সুখস্বপ্নে মোড়া, পঁচিশ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস শাশুড়ী মায়ের ভালোবাসায় ধুয়েমুছে গেছিল কিন্তু একটা জিনিস তাঁর মনের মধ্যে খচখচ করতো, তাঁর বিয়ের এক বছরের  মধ্যে  উনিশ বছরের  তুলি বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে নিয়েছিল।  তুলি তো তাঁর ভাইঝি কম, মেয়ে বেশি,  তাই তুলি পড়াশোনা শেষ না করে বিয়ে করায়  বহুদিন  পর্যন্ত মন খারাপ করতো তাঁর । বাবা অবশ্য বলতেন " কইছিলাম না ও হইলো গিয়া রাঙ্গা মূলা, অর দ্বারা পড়াই লিখাই হইবো না। " তুলির শ্বশুর বাড়ির অবস্থা প্রথমে সাধারণ ছিল, পরে ওর বর রাজ্যের শাসক দলের একজন মাঝারি গোছের নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে,  স্বনামে বেনামে প্রচুর সম্পত্তি বানিয়েছে,   দাদাদের ব্যবসায়  নাকি তুলির বর এখন  অনেক সাহায্য করছে , ফলে জামাইয়ের এখন ওই বাড়িতে স্পেশাল খাতির। বাবার আবার তাই নিয়ে  অনেক ক্ষোভ ছিল,  তুলিরা জাতে কৈবর্ত হয়েও বাড়িতে খাতির পাচ্ছে আর নীলেশকে একগ্লাস জলও কেউ সাধে নি। ইন্দ্রাণীর অবশ্য এইসব ব্যাপারে হেলদোল ছিল না,  নীলেশ মুখে কখনো কিছু না বললেও শ্বশুরবাড়ির রক্ষণশীলতা নিয়ে খুশি ছিল না। 


প্রতিবার  ইন্দ্রাণী  যখনই  বাপের বাড়ি আসে তখন  একটা কথাই মনে আসে,  বাড়িটার কোনো পরিবর্তন হয় না কেন ! 
জগদ্দল পাথরের মতো অপরিবর্তনশীল, দিন দিন যেন আরও কুশ্রী হচ্ছে অথচ বাবার কাছ থেকে ইন্দ্রাণী জেনেছে পারিবারিক ব্যবসায় আরও উন্নতি হয়েছে। বাড়ির বাসিন্দারা যেমন সময়ের থেকে অনেক পিছিয়ে সেটা  বাড়ির চেহারাতেও প্রকাশ পাচ্ছে। সঙ্গে করে আনা জিনিসগুলো মোটামুটি প্রায় সবাইকে দিয়ে ইন্দ্রাণী  এসে বাবার ঘরে বসলো। এই বাড়ির লোকেদের  হাতে পয়সা থাকলেও খরচ বলতে বোঝে  ছেলেদের জন্য সম্পত্তি আর মেয়েদের জন্য সোনার গয়না কেনা  কিন্তু পোশাকের ব্যাপারে এরা সস্তা কাপড় খোঁজে তাই ইন্দ্রাণীর আনা রুচিসম্মত কাপড়চোপড় পেয়ে সবাই খুব খুশি হলো। মায়ের সাথে দেখা হয় না,  মা ঠাকুর ঘরে ব্যস্ত আর ঠাকুর ঘরে কায়স্থকে বিয়ে করার জন্য ইন্দ্রাণীর প্রবেশের অধিকার নেই। দাদাদের সাথে অবশ্য দেখা হলো,   দুই দাদাকে মুন্ডিত মস্তক দেখে ইন্দ্রাণীর অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল।  বড়দা ভদ্রতা করে বললেন  " ক'টা দিন থাকবি তো?"  উত্তরে ইন্দ্রাণী ফ্যাকাসে হাসি হাসে যার অর্থ হ্যাঁও হতে পারে আবার নাও হতে পারে।  বড়দা অবশ্য বলেই চলে গেছেন, ইন্দ্রাণীর উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন নি। 


 উঠোনে প্যান্ডেল বেঁধে কাজ হবে, সেখানে তখনও ডেকরেটারের লোক কাজ করছে।   সামনের ঘরে টেবিলের উপর  বাবার একটা পুরনো সাদাকালো ছবিতে মালা আর চন্দন পরিয়ে রাখা আছে।  ইন্দ্রাণী চুপচাপ বাবা যে ঘরে থাকতেন সেই ঘরে এসে বসেছিলো।  খাটের বিছানা ফেলে দেওয়া হয়েছে, খাটের ওপর একটা সুজনিই শুধু পাতা,  দেওয়ালে বাবার হাসি মুখ।  খাটের উপর চুপ করে বসে থেকে ইন্দ্রাণী যেন বাবাকে অনুভব করতে  পারছিল , সারা ঘরটায় যেন  বাবার গায়ের গন্ধ মাখা। ধীরেধীরে ইন্দ্রাণীর চোখ ভিজে  আসতে থাকে,  হঠাৎ পিছন থেকে কেউ এসে  ওকে জড়িয়ে ধরায় সামান্য একটু কেঁপে ওঠে ইন্দ্রাণী। 

" আমি ঠিক জানতাম তোকে এখানেই পাবো,  সবাই বললো তুই এসে গেছিস কিন্তু  তোকে কোথাও দেখতে পেলাম না। গতকাল থেকে এখানেই ছিলাম, সকালে যেই একটু বাড়ি গেছি, অমনি তুই এসে হাজির ! 
কী সুন্দর দেখতে হয়েছিস রে পিপি !  কে বলবে তুই আমার পিপি,  আমার চেয়ে তোকে ছোট লাগছে অনেক! "

ইন্দ্রাণী সামান্য অবাক হয়ে বলে " তুলি,  তুই! "

----- " কেন রে চিনতেই পারছিস না নাকি !  তুই কিকরে এখনো এতো ছিপছিপে রয়েছিস রে পিপি?  আমাকে দেখ !  একদম কুমড়োপটাশ  হয়ে গেছি। 

সত্যিই একে  তুলি বলে বুঝতে সময় লাগে !  তুলি মানে রোগা রোগা, কাজল ল্যাপটানো, ধপধপে ফরসা, লাল ঠোঁটের খুকির কথাই মনে পড়ে। যদিও যখন বাড়ি ছেড়েছিল ইন্দ্রাণী তখন তুলির বয়েস ছিল চোদ্দ বছর,  তারপর  মাধ্যমিকটা পাশ করেছিল কোনোমতে।  টুয়েলভে ফেল করে ঘরে বসেছিল, পরে  পালিয়ে বিয়ে করে নেয় ,  সেই  তুলি এখন এতটাই  মুটিয়েছে যে  কোমরে দুই তিন থাক চর্বির স্তর,  মুখটাও গোল ফোলা তাতে দু'টাকার সাইজের সিঁদুরের টিপ লেপ্টে আছে,  সারা গায়ে প্রচুর সোনার গয়না,  একটা ঢাকাই জামদানী পরনে,  শীতের প্রথম দিকেও তুলি দরদর করে ঘামছে। তুলি তাঁর পিপির বর, ছেলের খবর নিলো,  তাঁদের এখন পর্যন্ত চোখে না দেখার জন্য দুঃখ করলো,  তারপর শুরু করলো  নিজের স্বামীর ঐশ্বর্য আর ক্ষমতার গুণকীর্তন ,  ওর বর যে ওকে চোখে হারায়, এক মিনিটও ছেড়ে থাকতে পারে না বলে ওর সাথে এই বাড়িতে এসেও  রয়েছে সেটাও সগর্বে ঘোষণা করলো। 


ইন্দ্রাণী অবাক হয়ে ভাবছিল তুলি তো আজকের মেয়ে কিন্তু  কথাবার্তা শুনে  মনে হচ্ছে যেন সত্তর বছরের প্রবীণা  কথা বলছে । ভাবছিল এই কি সেই  মিষ্টি  মেয়ে তুলি !  এর মুখ থেকে তো   খালি রকমারি আজব শাড়ি গয়না বা স্বামীর সোহাগের গল্প !  ইন্দ্রাণীর কষ্ট হচ্ছিল,  তুলি সাত বছরের ছোট হলেও সেই কোন শৈশবেই ওকে সে সন্তানের মতো মানুষ  করেছিল।  আজ এই আঠাশ বছরের প্রবীণাটিকে তাঁর অচেনা বলে মনে হচ্ছিল।  তুলি বড় বড় গল্প শুনিয়ে   পিসিকে টেনে নিয়ে চললো বরের সাথে আলাপ করিয়ে দিতে।  এক তলায় দুই দাদার সাথে তুলির বর কথা বলছিল বলে আর  বরকে ডাকতে  পারলো না।  ইন্দ্রাণী  দেখলো তুলির বরও তুলির মতোই আড়াই মণ,  গায়ের রঙটা অবশ্য বেশ কালো,  তুলি আর তুলির বর দুজনেই  দুপুরের ভাত খাবার পরে পান চিবিয়েছ,  পানের রস শুকিয়ে ঠোঁট কালো হয়ে রয়েছে,  পরণে সিল্কের পাঞ্জাবি,  গলায় মোটা শিকলের মতো সোনার চেন,  হাতে রিস্টলেট, দশ আঙুলের প্রত্যেকটায় পাথর বসানো আঙটি।  বয়েসে নীলেশের চেয়ে এক দুই বছরের বড় বই ছোট হবে না।  এই মফস্বলি রাজনৈতিক গুণ্ডার মতো দেখতে লোকটাকে তুলির স্বামী হিসাবে মানতে মন চাইছিল না। 

তুলি এরপর নিজের  ছেলে মেয়েকে পিপিকে দেখাবে বলে তাঁদের খোঁজে গেল, ইন্দ্রাণী আবারও  এসে বাবার ঘরে বসেছিল। খানিক বাদে তুলিও এসে হাজির,  ছেলেমেয়েদের দেখা পায় নি,  এতবড় বাগান নিয়ে বাড়ির কোথায় কোন প্রান্তে আছে কে জানে!  তুলি ওর ছেলেমেয়ের গল্প করছিল,  বিয়ের এক বছরের মধ্যে পারমিতা  বা পরি জন্মায়  আর পরির জন্মের এক বছরের মধ্যে ছেলে  ডুগগু  জন্মেছে।  তুলি বলছিল " তুই তো বেঁচে গেছিস পিপি,  তোর প্রথমেই ছেলে হয়েছে বলে আর তোকে বাচ্চা  নিতে হয় নি।  আমার প্রথমে মেয়ে হওয়াতে শ্বশুর শাশুড়ী এমনকি আমার বরের কী রাগ !  তাঁদের ছেলে চাই,  যাক বাবা !  পরের বছর ডুগগু হয়ে আমায় বাঁচিয়েছে নইলে আবার ট্রাই মারতে হতো।  অবশ্য ওদেরই বা দোষ দিই কি করে!  একটা ছেলে ছাড়া ব্যবসার হাল কে ধরবে?  মেয়ে তো বিয়ে হয়ে পরের ঘরে চলে যাবে,  বংশ রক্ষার জন্য একটা ছেলে তো অন্তত চাই। "


ইন্দ্রাণী বলতে যাচ্ছিল যে  দেশে কতো  সফল বিজনেস ওম্যান আছে   আর বংশ রক্ষা আবার কি !  মেয়ে কি সন্তান নয় কিন্তু কিছু বলার আগে একটা  চিল চিৎকার আর গগনবিদারী কান্নার আওয়াজে দুজনেই চমকে ওঠে, তারপরেই তুলি চেঁচিয়ে ওঠে " কি হয়েছে বাবু?  কে তোমাকে কি বলেছে? " বলতে বলতে  ঘর ছেড়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল।  তুলির দেখাদেখি ইন্দ্রাণীও ঘর ছেড়ে বাইরে গিয়ে দেখে একটা বাচ্চা ছেলে একটা মেয়ের হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে আনছে।  ছেলে আর মেয়ে যে তুলির সেটা বুঝতে পারলো যখন তুলি ছেলেকে নিজের কাছে টেনে আঁচল দিয়ে মুখ পুঁছিয়ে জিজ্ঞেস করলো " কি হয়েছে বাবাই,  পরি  তোমায় মেরেছে? " উত্তরে ছেলেটা অ্যাঁ অ্যাঁ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে " পরি  আমায় না দিয়ে নিজেই আইসক্রিম খেয়ে নিয়েছে। " শুনেই তুলি একটা বিরাশি সিক্কার চড় বসিয়ে দেয় মেয়েকে,  " অ্যাতো বড় নোলা তোর, ভাইকে না দিয়ে নিজেই খেয়ে নিলি! " ইন্দ্রাণী অবাক হয়ে ভাবছিল ছেলেটা ছোট হয়েও দিদিকে  নাম ধরে বলছে, জোর করে টেনে নিয়ে আসছে !  বাবা মায়ের প্রশ্রয় ছাড়া এতটা অসভ্যতা করার সাহস বাচ্চাদের সাধারণত হয় না। 

মায়ের হাতে চড় খেয়ে মেয়েটা গোঁজ হয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে ছিল , কাঁদে নি কিন্তু ধীরেধীরে বললো  " গুডডু ওর আইসক্রিম খেয়ে আমারটা খেতে এসেছিল, আমার তখন আধা খাওয়া হয়ে গেছে তাই এঁটোটা দিই নি। " তুলি মেয়ের চুলের ঝুঁটি ধরে নেড়ে ভেঙিয়ে বলে " এঁটো হয়ে গেছে বলে দিই নি !  ভাই একটু চেয়েছে, দিলে কি ক্ষতি হতো!  ছোট ভাইকে কি কেউ হিংসে করে?  তুমি কেঁদো না বাবু,  বাবা তোমাকে অনেক আইসক্রিম কিনে দেবে, পরিকে একটাও দেবে না, এখন চুপ করো সোনা। " মার খেয়ে পরি  ধীরেধীরে  ওই জায়গা থেকে চলে গেলো। ইন্দ্রাণী এতক্ষণ তুলির সন্তান শাসন চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল,  পরিকে দেখে সে এতটা অবাক হয়েছিল যে মুখ থেকে একটা শব্দও বের হয় নি।  পরি  যেন সেই ছোটবেলার তুলি, সেই ধপধপে ফরসা রঙ, রোগা, ভাসাভাসা ডাগর চোখ আর ডুগগুকে দেখতে তুলির বরের মতো, ওইরকম কালো মোটা চেহারা। তুলির তখনও ছেলে নিয়ে আদিখ্যেতা যায় নি, ছেলেকে ট্যাঁকে করে ঘরে নিয়ে গিয়ে  আদর করছিল।  ইন্দ্রাণীর সব ব্যাপারটা এতো অসহ্য লাগছিল যে সে আর তুলির সাথে না গিয়ে ধীরেধীরে ওই জায়গা থেকে সরে পড়ে। 

এদিক সেদিক ঘুরে পিছনের বারান্দায় গিয়ে দেখে  পরি একা-একা বারান্দার রেলিং ধরে পিছনের পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছে। কাছে গিয়ে আদর করে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে যে সে কোন স্কুলে পড়ে, কোন ক্লাস। অপমানিত বাচ্চাটার গালে তুলির আঙুলের দাগ স্পষ্ট হয়ে বসেছে। মেয়েটার সাথে বেশ খানিকটা  কথা বলে ওকে আশ্বস্ত করে তারপর নিজের হ্যান্ডব্যাগের ভিতর থেকে একটা লাল গয়নার বাক্স বের করে তার থেকে একটা হার নিয়ে মেয়েটাকে পরিয়ে দিয়ে বলে " জানো তো আমি তোমার মায়ের পিসি,  এই হারটা আমি তোমাকে দিলাম।  চলো, তোমার মাকে গিয়ে দেখাই হার পরে তোমায় কতো সুন্দর লাগছে। " পরির হাত ধরে ইন্দ্রাণী আবার সেই ঘরে যায় যেখানে তুলি ওর ছেলে নিয়ে তখনও আদিখ্যেতা করছে,  পরিকে দেখিয়ে বলে " এই হারটা আমি পরিকে দিয়েছি, আমার তরফ থেকে তোর মেয়েকে উপহার "।

তুলি খুব অবাক হয়ে বলে " এটা তো সোনার,  বেশ বড়, ভরি তিনেক তো হবেই,  এটা তুই ওকে মুখ দেখানি হিসাবে দিলি? 
তোর কি কোনোদিন কাণ্ডজ্ঞান হবে না পিপি!  তুই মেয়েকে  সোনা দিয়ে মুখ দেখলি আর ছেলেকে কিছু না!  আমার শ্বশুর বাড়ি লোকেরা কী বলবে বলতো?  এতটা সোনা একজনকে না দিয়ে তুই এটা দিয়ে দুটো চেন বানাতেই পারতিস "।
ইন্দ্রাণী শুকনো হেসে বলে " পঁয়ত্রিশ বছরেও যখন আমার কাণ্ডজ্ঞান হয় নি তখন আর কখনোই হবে না,  গুড্ডুকে আমি টাকা দেব,  তুই ওর পছন্দমতো জিনিস কিনে দিস, আসলে আমার মনে হয়  গয়নায় আগে মেয়েদেরই  অধিকার , ছেলেদের পরলেও হয় না পরলেও কিছু না,  দেখ দেখি পরিকে কী সুন্দর লাগছে যেন একেবারে সেই ছোটবেলার তুই!  আমি আর থাকতে পারছি না রে , তুই মাকে বা দাদাদের কাউকে বলে দিস যে আমি চলে যাচ্ছি। বিকেলে একটা ট্রেন আছে, ওটাই ধরবো। " হারটা সে এনেছিল তুলির কথা ভেবে,  বিয়ের পরে তুলির সাথে প্রথমবার দেখা হবে তখন উপহার হিসাবে দেবে।  এই তুলিকে তাঁর অচেনা লাগছিল আর যার মধ্যে সে সেই ছোট্ট তুলির ছায়া দেখতে পেয়েছে তাঁকেই হারটা দিয়েছে। 

ফাঁকা ট্রলিটা নিয়ে অবাক তুলির সামনে দিয়ে বাইরে যাওয়ার রাস্তা ধরে ইন্দ্রাণী,  মনে মনে ভাবে " পঁয়ত্রিশ বছরেও  এই বাড়ির এতটুকু পরিবর্তন হলো না, সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে,  সেদিন যে ছিল নির্যাতিতা আজ সেই নির্যাতনকারী হিসেবে ফিরে এসেছে।  এই বাড়ির  হাওয়া বাতাসে মান্ধাতার আমলের নারী নির্যাতনের বিষ মিশে আছে,  এখানে  নিঃশ্বাস নিতেও দম বন্ধ হয়ে যায়।  এরা জানতেই পারলো না  পৃথিবীতে কতো দ্রুত পরিবর্তন আসছে,    বাবা তাঁকে বাইরে পড়তে  পাঠিয়েছিলেন বলেই সে এতো সুন্দর একটা জীবনের স্বাদ নিতে পারছে । এটাই তাঁর শেষ আসা এই শহরে,  এই বাড়ি তাঁকে কখনো আপন করে নি, আজ সেও চিরতরে এই বাড়িটিকে পরিত্যাগ করে যাচ্ছে। তাঁর যা কর্তব্যকর্ম সে দূর থেকেই করবে কিন্তু এই বাড়িতে আর নয় !  ফাঁকা একটা রিক্সা পেয়ে ইন্দ্রাণী তাতে চড়ে বসে,  এতক্ষণ পর্যন্ত যে চোখের জলকে সে ধরে রেখেছিল, এইবার  সেই জল তাঁর গাল ভাসিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরতে থাকে।   এখানে   একটি মৃত  মানুষেরই ঘাট শ্রাদ্ধ হয় নি, একটি জীবিত মানুষের স্মৃতিকেও  ইন্দ্রাণী  জলে ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছে।  সে আর  কখনো পিছন ফিরে  দেখবে না,  সুন্দর সোনালী ভবিষ্যৎ  তাঁর জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে ।
.........................

অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি