গলা তুলতে লাই - ময়না মুখোপাধ্যায়

গলা তুলতে লাই

ময়না মুখোপাধ্যায়

 



- ধর্মাবতার এই যে খুনের অপরাধে অভিযুক্ত তরিনি সোরেন ওকে ওপর থেকে দেখতে যতই শান্ত সহজ লাগুক আসলে ও একটা নৃশংস মনের খুনী। ওর এই চুপ করে থাকা, কিছু বুঝতে না পারা সব একটা নাটক, একটা চিত্রনাট্য, যেটা ওরই উর্বর মস্তিষ্কের ফসল। এভাবে শাস্তি এড়াতে চাইছে ও ধর্মাবতার।

সরকারি উকিলের একটানা বলে যাওয়া কথাগুলো টুসুর কানে আর অর্থবহ হয়ে উঠছিল না। শব্দগুলো কেমন দলা পাকিয়ে একটা জড়ানো ঝিঁঝিঁর গুঞ্জনের মত তার কানের পাশে ঘোরাফেরা করছিল শুধু। টুসুর মাথাটা টলছিল, পা ভেঙে আসছিল তবু সে দাঁতে দাঁত লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে যেতে লাগল। কতক্ষণ ধরে কত কথা চলল, কেউ হাসল, কেউ টিটকিরি দিল কিন্তু তার একবর্ণও টুসুর কানে ঢুকল না। বোধ ফিরল তখন যখন একটা মেয়ে পুলিশ তার হাত ধরে টান দিয়ে কাঠগড়া থেকে তাকে নামাল। টুসু এলোমেলো দৃষ্টিতে চারিদিকে একবার তাকাল তারপর পা ঘষে ঘষে মেয়ে পুলিশটার সাথে ভ্যানে গিয়ে উঠল। এরকম কতদিন ধরে চলছে আরো কতদিন চলবে সেসব হিসেব টুসুর মনে থই পায় না। সে শুধু জানে তার একদিন শাস্তি হবে। প্রথমবার যেদিন তাকে কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে বিচারক জিজ্ঞাসা করেছিল,
- তরিনি সোরেন তোমার বিরুদ্ধে যে সুনীল মরান্ডিকে খুনের অভিযোগ আনা হয়েছে তা কি তুমি মেনে নিচ্ছ ? 
টুসু নির্বাক হয়ে চারিদিকে তরিনি সোরেনকে খুঁজে বেরাচ্ছিল। সে ভুলেই গেছিল তরিনি বলে তার একটা নাম ছিল যেটা পাঠশালায় ভর্তি হওয়ার সময় বড় দিদিমণি দিয়েছিল। দিদিমণি বলেছিল,
- টুসু তো ঘরের নাম। বাইরের একটা নাম লাগে। 
টুসুর বাপ হাঁ করে চেয়ে বলেছিল, 
-বাইরের নামটা আবার কি বট্যে। 
দিদিমণি হেসে বলেছিল, 
-ও তোমার বুঝতে হবে না আমি টুসুর নাম দিলাম তরিনি। 
টুসু বিচারকের কথার জবাব না দিয়ে ভাবতে থাকে একটা মানুষের কতগুলো মন, কতগুলো রূপ আর তার মাত্র দুটো নাম তাও সে ভুলে গেল। ভালো হত যদি নানা রূপের নানা নাম থাকত তবে বলা যেত এটা তরিনি করেনি গো, এটা টুসু করেছে। তরিনি তো পড়ালেখা জানা মেয়ে হত। তার কি এমন করতে হত। চিন্তার জাল ছিন্ন হয়ে যায় উকিলের গর্জন শুনে, 
- হুজুর কি বলছেন শুনতে পাচ্ছ না ? উত্তর দাও।
টুসু ভিড়ের মধ্যে হুজুরকে খুঁজতে খুঁজতে বলে,
- আমি কিছু জানিনে কো হুজুর।
উকিল তরবরিয়ে ওঠে,
- দেখেছেন হুজুর বলেছিলাম না এ মেয়ে ছেনাল আছে। 
বিচারক বলে,
- ভাষায় সংযম রাখুন।
টুসুর মনে পড়ে কে যেন বলেছিল, শালী সংযম দিখাচ্ছে। টুসু কি জানে সংযম কি, কিভাবে দেখাতে হয়। অত কি লেখাপড়া করেছে সে। দু কেলাস পড়েই তো তার ছুটি হয়ে গেল। মায়ের আবার বেটা হল। তাকে মানুষ করবে কে। সরকারি দিদি আসলে তাকে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করেছিল,
- সংযম কি লা দিদি ? 
ভেবেছিল খারাপ কথা হবে। সরকারি দিদি বলল, 
- ওই কেউ খারাপ কথা বললে তাকে খারাপ কথা না বলা। 
টুসু জেনে খুশি হয়েছিল। বলেছিল,
- ও তাই বল। ই তো আমরা সব্বসময় দিখাই।  আমার মা বলেছিল যে, টুসু ম্যেইয়াদের গলা তুলতে লাই, জিগাস করতে লাই, নিতি মরদের হাতে দু ঘা খ্যেইয়ে লিতে হয়। তবে লা ঘরকে শান্তিটো থাইক্যে। 
তা টুসু মারঝাপটা কতোই না খেয়েছে সংযম দেখিয়ে। তা শান্তিটা তার জীবনে থাকল কই। 

কদিন না কমাস যেন থানা আদালত ঘুরপাক খেয়ে শাস্তিটা হয়েই গেল টুসুর। সরকারি উকিল শেষটা যেদিন বলছিল সেদিন টুসু একটুও উদাস হয়নি, টালমাটালও করেনি, সব শক্তি দিয়ে কান মাথা খুলে সব শুনেছিল। উকিল বলেছিল,

- হুজুর এই তরিনি যখন পাঁচ বছর আগে বিধবা হয়ে ঘরে ফিরেছিল তখন তার বাপ মরেছে, মা মরোমরো। দুবছর পরে মা মরলে ভাইরা তাকে আর ঘরে রাখতে চায়নি। ওর দিদি সুবু মরান্ডির বর সুনীল মরান্ডি তখন ওকে আশ্রয় দেয়। দুই বছর সে সেখানে আদর যত্নেই ছিল। নইলে কখনো কি কারোকে তরিনি খারাপ থাকার কথা জানাতো না। তরিনির দিদি সুবু বিছানায় শয্যাশায়ী ছিল বহুদিন আর সেই সুবাদে তরিনি সংসারের কর্ত্রী হয়ে ওঠে। বছর খানেক আগে সুবু মারা গেলে সুনীলের বাড়িতে অশান্তি শুরু হয়। সুনীল মারা যাবার আগে বয়ান দিয়ে গেছে তরিনি দুশ্চরিত্রা ছিল, নানা ছেলেকে ঘরে ঢোকাতো। ঘটনার দিন সুনীল ঘরের থেকে অন্য ছেলেকে বেরোতে দেখে তরিনিকে মারতে গেলে তরিনি খড় কাটার বটি দিয়ে নৃশংস ভাবে সুনীলের পুরুষাঙ্গ কেটে দেয়। সুনীলের চিৎকারে সবাই ছুটে যায়, পুলিশ ডাকে। পুলিশ আসলে সুনীল এই বয়ান দিয়ে মারা যায়। আর দেখুন হুজুর এই মেয়ে যদি নিরপরাধ হত তবে কি একবারও বলত না ও খুন করেনি। একটুও কি কান্নাকাটি করত না, আপনার দয়া ভিক্ষা করত না। আমার ওকালতির জীবনে এমন শক্ত মেয়ে আমি কখনো দেখিনি। এ পাক্কা খুনি হুজুর। একে কঠোর শাস্তি দিন।

তরিনি অলস চোখে কাঠগড়ার কাঠ দেখতে দেখতে মনকে বলে সংযম টুসু, সংযম, গলা তুলতে লাই। বিচারক রায় দেন।
- যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। 
রায় শেষে মেয়ে পুলিশ যখন তাকে ভ্যানে তুলছে তখন চারিদিকে থইথই ভিড়। আওয়াজ উঠছে খুনি, ছেনাল মেয়েছেলে। এমন শক্ত খুনি মেয়ে আবার কবে দেখা যাবে কে জানে তাই ভিড় উপচে পড়ছে। 

টুসু আজ খুব নিশ্চিন্ত। তার যা হওয়ার হয়ে গেছে তা নিয়ে সে ভাবিত নয়। কিন্তু মার কথা সে রেখেছে সে কথা বলেনি। তবে তার যা করার ছিল তা সে করে দিয়েছে। এ কটা রাত সে ঘুমাতে পারেনি। আজ ঘুমাবে। কত কথা ভিড় করে আসে টুসুর মনে। যেদিন তার বরটা মদ খেয়ে লিভার পচে মরে গেল তখন সে মাত্র সাতমাসের নতুন বৌ। শ্বশুর ঘরে ঠাঁই হল না ভাতারখাকি মেয়েমানুষের। বাপের ঘরে মা'টা ছিল তাই উঠতে পেরেছিল। যে ভাইদুটোকে হাতে করে বড় করেছিল তারাই বলল যে কদিন মা সে কদিন তুই। দুবছর যেতে না যেতে মা'টাও মরে গেল। তখন অকূল পাথারে পড়েছিল টুসু। আঠেরো বছরের ডবকা ছুড়িকে কে ঘরে নেবে।ওই সুনীল মরান্ডি তাকে সেধে নিয়ে গেল দিদি সুবুর ঘরে। সুবুর তখন একটা দশ বছরের মেয়ে আর একটা সাত বছরের ছেলে। সুবুর কি অসুখ কেউ জানে না কিন্তু বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতা তার ছিল না। টুসু গিয়ে হাল ধরল সংসারের। দিদির ছেলে শিবু আর মেয়ে পাকুকে নিজের সন্তানের মত পালত সে। দিদি বিছানায়, তার শরীর কথা বলে না তাই শরীরের ক্ষিদে মেটাতে একদিন সুনীলের চোখ পড়ল টুসুর ওপরে। টুসু ভেবেছিল পালিয়ে যাবে। সুবু হাতযোড় করল তার সামনে। জলভরা চোখে বলেছিল,
-  আমি বাঁচব লাই টুসু। তবে মরার আগে তোর সাথে উয়ার বিয়্যাটা দিয়া যাব। 
টুসু বুঝেছিল গলা তুলতে লাই। মনকে বুঝিয়ে ছিল ঘর পাব, মরদ পাব, সন্তান পাব আর কি চাই। সুনীল যখন তার শরীরের ওপর চাপতো তার গা ঘিনঘিন করত বমি আসতো তবু সে গলা তোলেনি। একদিন সুবু মরে গেল। পাকু আর শিবুকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে ছিল টুসু। ওরা মানুষ হোক। বছর খানেক কাটল। টুসুর যত্নে বার বছরের পাকুকে তখন চোদ্দ পনের বছরের ডবকা লাগে। ছেলে মেয়ের সামনে টুসুর লজ্জা লাগে শরীর দিতে। একদিন সুনীলকে সেকথা বলায় সে টুসুকে সপাটে চড় মেরে বলে ওঠে,
- মাগী সংযম দিখাচ্ছে আমায়।
সেও সহ্য হয়েছিল কিন্তু যেদিন নেশা করে সুনীল পাকুর ওপর চড়াও হল সেদিন আর টুসুর সহ্য হয়নি। সেদিনও সে গলা তোলেনি তবে হাত তুলেছিল। খড় কাটার বটিটা সোজা বসিয়ে দিয়েছিল উদোম লোকটার অহংকারে। ভেবেছিল যদি মরে যায় ভালো আর বেঁচে গেলে যেন কেন্নোর মত গুটিয়ে থাকে সারাজীবন। সে আদালতে প্রাণ ভিক্ষা চায়নি। শুধু চেয়েছিল পাকুর নাম যেন একবারের তরেও না ওঠে। সত্যি ঘটনাটা জানলে হয়তো হুজুর তাকে মাপ করে দিত কিন্তু পাকু, তার গায়ে যে দাগ লেগে যেত। পাকুকে দিব্যি দিয়ে এসেছিল যাতে সে মুখ না খোলে। শুধু সরকারি দিদিকে বলে এসেছিল পাকু আর শিবুকে যেন একটা অনাথ আশ্রমে রাখার ব্যবস্থা করে দেয়। 
 
টুসু আজ জেলে যাবে। সরকারি দিদি এসেছে পাকু আর শিবুকে নিয়ে। একবার দেখা করতে।  ওরা এখান থেকে অনাথ আশ্রমে চলে যাবে। দিদি সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। যতদিন টুসু ছাড়া না পাবে ততদিন ওরা সেখানেই থাকবে। টুসু পাকুর মাথায় হাত বুলিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
- গলা তুলতে হয় পাকু, দরকার হলে গলা তুলবি।
                            

................................

অলঙ্করণ :-  পায়েল খান

 



 

Comments

Loading... Logging you in...
  • Logged in as
There are no comments posted yet. Be the first one!

Post a new comment

Comments by