মায়াপুরী
ঐষিক মজুমদার
টিলার
ওপরে প্রথম উঠেছিলাম আমি। উঠে সামনের দিকে তাকাতেই, পাথরের মূর্তির মত
দাঁড়িয়ে পড়তে হল। মুখ থেকে অস্ফূটে বেরিয়ে এল, "আশ্চর্য!"
শুভেন্দু ছিল আমার ঠিক পেছনেই। আমাকে ওভাবে দাঁড়াতে দেখে সে জিজ্ঞেস করল, " কি রে, কি হল?"
তারপরেই দৃশ্যটা চোখে পড়ল ওরও। চাপা আর্তনাদের মত ও বলল, " এ কি! এ কি করে হয়?"
প্রদীপ
ছিল সবার শেষে। আমাদের কথা সে শুনতে পায় নি। কিন্তু উঠে এসেই হতভম্বের মত
থমকে গেল সেও। ঘর্মাক্ত মুখে চশমা পিছলে নেমে গেছিল, সেটা ঠেলে উঠিয়ে চেয়ে
রইল একদৃষ্টে। তারপর বলল একটাই কথা, "স্ট্রেঞ্জ!"
অথচ
সামনের দৃশ্য খুব সুন্দর হলেও, একেবারে চোখ-ধাঁধানো কিছু নয়। টিলার ঠিক
নীচ থেকেই ঢালু হয়ে নেমে গেছে পাহাড়ী নদীর খাত। কিছুদূর নামলেই ক্ষীণাঙ্গী
নদী, উচ্ছ্বল তন্বী কিশোরীর মতই পাথরে-পাথরে পা ফেলে নাচতে-নাচতে এগিয়ে
চলেছে সে। শেষ বিকেলের পড়ন্ত আলোয় আরো মায়াবী সাজে সেজেছে প্রকৃতি।
ইতস্ততঃ
ছড়িয়ে থাকা বোল্ডারের ওপর দিয়ে আমরা সন্তর্পণে নদীর ধারে নেমে এলাম। কারুর
মুখে কোনো কথা নেই, সবার দৃষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছে চতুর্দিকে।
অবশেষে আমিই নীরবতা ভঙ্গ করলাম।
"কি ব্যাপার বুঝতে পারছি না, কিন্তু আমি আগেও এখানে এসেছি!"
শুভেন্দু আমার দিকে চোখ ফিরিয়ে সংক্ষেপে বলল, "আমিও!"
প্রদীপ তাকিয়ে ছিল দূরে কোথাও। এদিকে না ফিরেই সে মাথা ওপর-নীচ করল। অর্থাৎ আগে এখানে এসেছে সে-ও।
এরপর আমরা তিনজন পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। কারণ আমরা জানি, আমরা কেউই কখনো এখানে আসি নি। আসা সম্ভব নয়।
আমাদের
তিনজনের বন্ধুত্ব সেই স্কুল-জীবন থেকেই। মাঝে অনেকটা সময় কেটে গেছে,
কিন্তু বাঁধন আলগা হয় নি। তবে পরিবার ছাড়া তিনজনের একত্রে ভ্রমণ - এ জিনিস
হল এবারেই। উদ্যোক্তা শুভেন্দু।
আসলে
গেল বছর ফুসফুসের ক্যান্সারে স্ত্রীর হঠাৎ মৃত্যুর পর প্রদীপ খুব মুষড়ে
পড়েছিল। ওদের কোনো ছেলে-মেয়েও নেই। মূলতঃ ওকে একটু চাঙ্গা করতেই শুভেন্দুর
এই পরিকল্পনা।
শুভেন্দুর
একটি পরিচিত ছেলে ট্র্যাভেল এজেন্ট। তার নির্দেশনায় নৈনিতাল-আলমোড়া-করবেটের
প্ল্যান যখন তৈরী, তখন একটা ফ্যাকড়া তুলেছিলাম আমিই।
"লাখ-লাখ
ট্যুরিস্ট প্রতিবছর গিয়ে এসব জায়গাকে তো দীঘা-পুরীই বানিয়ে ফেলেছে ইদানীং!
অন্তত একটা রাত এমন জায়গায় কাটানো হোক, যেখানে কেউ যায় না। মানে নির্জন
প্রকৃতির মাঝখানে আর কি!"
এজেন্ট ছেলেটি সত্যি ওয়াকিবহাল এবং করিৎকর্মা। চটপট সে ব্যবস্থা করে ফেলল। ফিরে আসার আগের দিনটা এরকম একটা জায়গায় থাকব আমরা।
জায়গাটার
নাম...না, উহ্যই থাক বরং। নৈনীতাল থেকে প্রায় চারঘন্টার পথ। নদীর ধারে
ছোট্ট একটা গ্রাম। ওরকম ছোট জায়গায় কুমায়ুন বিকাশ নিগমের কোনো রিসর্ট নেই,
আছে কেবল উত্তরাখণ্ড বন-দপ্তরের একটা বাংলো। সেখানেই আমাদের থাকার
বন্দোবস্ত।
সেই বন্দোবস্ত
অনুযায়ী বেড়ানোর একেবারে অন্তিম লগ্নে আজ বেলা দুটোর সময় এখানে এসে পৌঁছেছি
আমরা। আমাদের গোটা ট্যুরের ড্রাইভার মধ্যবয়সী এবং সদালাপী শর্মাজি বেশ
অবাক। এই অজ গাঁয়ে ট্যুরিস্টরা কি দেখতে আসবে? যাই হোক, আমাদেরকে বাংলোর
চৌকিদারের জিম্মায় রেখে সে চলে গেল নৈনীতাল। বলে গেল, কাল বেলা এগারোটায়
ফিরে এসে আমাদের কাঠগুদাম স্টেশনে পৌঁছে দেবে।
বৃদ্ধ
চৌকিদার কোঁয়ার সিং বিপত্নীক, বাংলোরই একপাশের একটা ঘরে তার আস্তানা। সে
একাধারে এই বাংলোর কেয়ারটেকার এবং রাঁধুনী। তার রান্না দেশী মুরগীর ঝোল আর
ভাত একেবারে অমৃত না হলেও মোটামুটি চলনসই।
হাত-মুখ ধুয়ে খেয়ে উঠতে-উঠতে প্রায় চারটে বেজে গেল। খাওয়া শেষ হতেই আমরা তিনজন নদীর ধারে যাওয়ার জন্য তৈরী।
বাংলোটা
নদী থেকে কিছুটা দূরে। চৌকিদারের কাছ থেকে পথনির্দেশ জানতে গিয়েই বাধল
বিপত্তি! বুড়োর এতক্ষণের হাস্যোজ্জ্বল মুখে হঠাৎ যেন মেঘের ছায়া।
পথ
তো সোজাই। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পায়ে-চলা রাস্তা ধরে এক কিলোমিটার গেলে পাওয়া
যাবে একটা টিলা। সেই টিলা পেরোলেই নদী। কিন্তু সন্ধ্যা নেমে আসছে। এইসময়
পরদেশী মেহমানরা যাবেন কেন সেখানে? দুপুর গড়িয়ে গেলে গাঁয়ের লোকেরাই ওদিকে
যায় না। জায়গাটা ঠিক নয় কিনা!
ঠিক
নয় মানে? একটা রহস্যের গন্ধ পেয়ে আমরা তখন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি। আমাদের
মধ্যে শুভেন্দু সবচেয়ে আমোদপ্রিয়। আমাদের দিকে একবার চোখ টিপে সে মুখ খুলল।
"হ্যাঁ,
আমাদেরও কানে এসেছে সেই কাহিনী। সেই যে, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে - দুজনে
দুজনকে ভালোবাসত - বাড়ি থেকে আপত্তি করায় ওই নদীতে আত্মহত্যা করে বসল
দুজনে! সেই থেকেই দুজনের ভূত ওখানে ঘুরে বেড়ায়! তাই তো?"
সরল-সাদাসিধে বৃদ্ধ কিন্তু বিদ্রূপটা ঠিক ধরতে পারল না। আত্মা? না না, ওখানে কোনো আত্মা নেই - একটু অবাক হয়েই সে বলল।
তাহলে? কোনো হিংস্র জন্তুর আস্তানা? কিংবা কোনো অপদেবতার অধিষ্ঠান?
না, তাও নয়। জানোয়ার বা দেও থাকে না সেখানে। খালি, জায়গাটার একটা টান আছে!
সে কি, তার মানে? অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম আমরা।
হিন্দি
আর গাড়োয়ালির খিচুড়িতে চৌকিদার অত্যন্ত অগোছালো ভাবে যা বলল, তার সারমর্ম
এই - নদীর ধারের একটা মায়া আছে। দিনের বেলা গেলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু
সন্ধ্যার পরে যারাই গেছে, তারাই পড়েছে সেই আকর্ষণে।
পাগল?
না, পাগল হয় নি কেউই। ফিরে এসেছে বহাল তবিয়তে, সংসারও করেছে পুরোদমে।
কিন্তু তারা আর কোনোদিন পুরোপুরি স্বাভাবিক হয় নি। তাদের মন পড়ে আছে ওই
নদীর ধারে।
কিন্তু এতদূর
এসে এই গল্পকথা শুনে নষ্ট করার মত সময় আমাদের নেই, তাই একটু জোর করেই
বেরিয়ে পড়লাম আমরা। অবশ্য বেরোবার আগে বুড়ো আমাদের দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে
নিল - তিনজন সবসময় একসাথে থাকব, আলাদা হব না কোনোমতেই! এবং অন্ধকার নামার
আগে ফিরে আসব।
জঙ্গলের
মধ্য দিয়ে হেঁটে আসার সময় বুড়োর কিসসা নিয়ে আমরা ঠাট্টা-তামাশা করেছি
বিস্তর। কিন্তু এখানে যে আমাদের জন্য এতবড় বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে, তা কে
জানত!
ইতিমধ্যে আমাদের
জায়গাটা মোটামুটি ঘুরে দেখা হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে শুভেন্দু আর প্রদীপ বসে
পড়েছে দুটো বোল্ডারের ওপর। কাছেই একটা প্রকাণ্ড পাথরের চাঁই, তাতে হেলান
দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি। সবাই চুপ, দৃষ্টি নিবদ্ধ মাটির দিকে।
প্রথম কথা বললাম আমিই।
"জানি না এ কি করে সম্ভব, কিন্তু এই জায়গাটা আমি দেখেছিলাম পহেলগাঁও-এ!"
"পহেলগাঁও...মানে কাশ্মীর?" - শুভেন্দুর প্রশ্ন, "ঠিক এরকম জায়গা?"
"এরকম নয়। এটাই!" - আমি বললাম কেটে-কেটে। আর কিছু না বলে দুজনে চেয়ে রইল আমার মুখের দিকে।
"তোরা
তো জানিস, আমি খুব সাধারণ পরিবারের ছেলে।" - আমি অনেকটা স্বগতোক্তির মতই
বলে চললাম, "বাবা সামান্য কেরানীর চাকরি করতেন। ছোটবেলায় বেড়ানোটা ছিল
আমাদের কাছে বিলাসিতা।
তবুও
একবার হঠাৎ করে কাশ্মীর যাওয়া হয়ে গেল, বাবার অফিসের কয়েকজন সহকর্মী আর
তাঁদের পরিবারের সাথে। তখন কাশ্মীরে এরকম ঝামেলা ছিল না। সেই আমার প্রথমবার
দূরে ঘুরতে যাওয়া। সে কি উত্তেজনা!
তখন আমার বয়স কত? এই দশ কি এগারো হবে। শ্রীনগর-গুলমার্গ যাওয়া হয়েছিল হয়তো, ভালো মনে নেই। কিন্তু মন ভরে গেছিল পহেলগাঁও এসে!
এখনও
মনে আছে, আমাদের লজ-টার নাম ছিল হোটেল শাজাহান। একটু হেঁটে এলেই লিডার
নদীর ধারে এই স্পট। আমাদের দলে আমার বয়সী আরো কয়েকজন ছেলেমেয়ে ছিল। সবাই
মিলে সারাদিন হৈ-হুল্লোড় করতাম এখানে!"
"এখানে নয়, পহেলগাঁও-এ।" - নীচু স্বরে সংশোধন করল শুভেন্দু।
"না, এখানেই!" - আমার যেন রোখ চেপে গেছে, "ওদিকে দ্যাখ্! ওই ব্রিজটা দেখতে পাচ্ছিস?"
ওরা তাকাল। কিছুটা দূরেই একটা কাঠের সেতু নদীর দুপারের সংযোগরক্ষা করেছে।
"ওই ব্রিজটা ছিল আমাদের দারুণ প্রিয়। সুযোগ পেলেই ওর ওপরে উঠে..."
"কিন্তু" - বাধা দিল শুভেন্দু, "ওরকম কাঠের ব্রিজ তো যে কোনো পাহাড়ী নদীর ওপরেই থাকতে পারে!"
"পারে।
কিন্তু এটাই সেই ব্রিজ!" - ক্লান্ত গলায় বললাম আমি, "কাছে গিয়ে দ্যাখ্, ওর
মাঝামাঝি জায়গায় রেলিং-এ একটা ফাঁক আছে। আমরা ওতে উঠলে বড়রা খুব ভয় পেত,
চেঁচামেচিও করত। দেখতে পাচ্ছিস?"
কাছে যেতেও হল না। এখান থেকেই চোখে পড়ছে রেলিং-এর ফাঁকটা।
আবার সবাই চুপচাপ। শুধু শোনা যাচ্ছে নদীর জলের শব্দ। তীক্ষ্ণ চিৎকার করে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল একটা ঘরমুখী পাখি।
এবার
বলার পালা শুভেন্দুর। ব্রিজের দিকে তাকিয়েই অন্যমনস্ক-ভাবে ও শুরু করল,
"ব্রিজ তো ছিলই সেখানে, তবে ঠিক এইরকম কি না মনে পড়ছে না। কিন্তু আর একটা
জিনিস স্পষ্ট মনে আছে!
তোরা তো জানিস, ডাক্তারি পাশের পরেই আমি সরকারী চাকরিতে ঢুকে যাই। প্রথম পোস্টিং হল ঋষিখোলা। জায়গাটা ভারত--ভূটান বর্ডারে।
নির্জন
জায়গা, রোগীর চাপ বিশেষ নেই। হেলথ সেন্টার থেকে মিনিট দশেক হেঁটে এলেই এই
জায়গা। একা-একা হাঁফিয়ে উঠেছিলাম, প্রতিদিন বিকেলে এখানে এসে বসে থাকতাম
নদীর ধারে।
স্টাফ নার্স
রাণু আমার সাথেই জয়েন করেছিল, তারও এটা ফার্স্ট পোস্টিং। একাকিত্বের চাপে
দুজনের মনের মিল হতে দেরী হল না। অচিরেই সেও হল আমার সান্ধ্য-ভ্রমণের
সঙ্গী। তারপর তো বিয়ে এবং সংসার।"
প্রদীপ এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার সে ধীরে-ধীরে বলল, "কিন্তু তুই কি করে নিশ্চিত হচ্ছিস এটাই সেই জায়গা?"
তার
কথার উত্তর না দিয়ে শুভেন্দু আমার দিকে তাকাল। তারপর বলল প্রায় ফিসফিস
করে, "অনীশ যে বড় পাথরটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সেই পাথরটা ছিল ওখানেই!
একদিন
আমরা ওই পাথরে নিজেদের নামের আদ্যাক্ষর খোদাই করেছিলাম। নিতান্ত
ছেলেমানুষী! কিন্তু সেই সময় ব্যাপারটা আমাদের কাছে ছিল দারুণ রোমান্টিক।
সেই লেখাটা....
অনীশ, একটু পিছন ফিরে দেখবি ভাই?"
আমি ঘুরে তাকালাম। কোনো সন্দেহ নেই। কালের লেহনে কিছুটা অস্পষ্ট, তবুও পড়া যাচ্ছে।
পাথরের মসৃণ গায়ে বাটালি-জাতীয় কিছু দিয়ে খোদাই করে লেখা হয়েছে দুটি অক্ষর - এস এবং আর। মাঝখানে একটি হৃদয়ের প্রতীক।
"কিন্তু
এটা তো অন্য কোনো প্রেমিক-প্রেমিকার নামও হতে পারে!" - আমার নিজের গলা
নিজের কানেই দুর্বল শোনালো। শুভেন্দু আমার দিকে খর-দৃষ্টিতে একবার চাইল
কেবল।
দূরের পাহাড়গুলোর
মাথায় এখনও আলোর আভাস। উপত্যকায় সন্ধ্যা নেমে আসছে। ল্যাণ্ডস্কেপের ওপর
ধীরে-ধীরে যেন একটা কালো চাদর টেনে আনছে কেউ।
আমি আর শুভেন্দু এখন তাকিয়ে আছি প্রদীপের দিকে। নদীর জলে আঙ্গুল ডুবিয়ে-ডুবিয়ে নিজের মনেই পাথরের ওপর আঁকিবুকি কাটছে সে।
কোনোরকম ভণিতা ছাড়াই হঠাৎ সে শুরু করল তার কাহিনী।
" আমার দেখা জায়গাটা কিন্তু এদেশে নয়। আমার বাবা বড় ব্যবসায়ী। আমি বিয়ে করার পর উনি আমাদের হনিমুনে পাঠিয়ে দিলেন সুইজারল্যাণ্ড।
আল্পস
পাহাড়ের নীচে বাসেল বলে একটা শহর আছে, নাম শুনেছিস হয়তো। তার থেকে একটু
দূরে একটা ছোট্ট নদী, নাম ভুলে গেছি। রাইন-এরই কোনো ছোট শাখা হবে।"
একটু
দম নিয়ে প্রদীপ আবার বলে চলল, "সেই নদীর ধারেই এই জায়গা। এখানে একটা লগ
কেবিনে রোমি আর আমি চারটে দিন কাটিয়েছিলাম। এই বোল্ডারগুলোর ওপর দিয়ে আমরা
হেঁটে বেড়াতাম। যদিও ওই ব্রিজ বা পাথরের ব্যাপারটা এতদিন পরে ঠিক মনে পড়ছে
না।
রোমিকে তোরা দেখেছিস, ওরকম হাসিখুশী মেয়ে আর হয় না। ওই চারটে দিন ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়!"
প্রদীপ আবার থামল। এই ম্লান আলোতেও দেখতে পেলাম - তার দুচোখে জল চিকচিক করছে।
কিন্তু এই অবসরে শুভেন্দু একটা প্রশ্ন করে বসল।
"এখানে তোর সেই লগ কেবিন দেখতে পাচ্ছিস কি?"
কোনো কথা না বলে প্রদীপ ডানহাতটা তুলল। তার উদ্যত তর্জনী অনুসরণ করে আমরাও তাকালাম দূরে।
প্রায়
দু-তিনশো মিটার তফাতে নদীর ধারে কিছুটা জায়গা সমতল। সেখানে সত্যিই রয়েছে
একটা লগ কেবিন বা গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরী বাড়ি! গোধূলির আবছায়াতে তার অবয়ব
এই মুহূর্তে অস্পষ্ট। তবু একটা বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
এই লগ কেবিনের গঠনশৈলী এ দেশীয় নয়।
আমরা বজ্রাহতের মত তাকিয়ে আছি, এমন সময় প্রদীপ হঠাৎ উঠে দাঁড়াল।
"এক কাজ কর, তোরা বরং বাংলোয় ফিরে যা! আমি একবার যাব ওই বাড়িটায়। ওখানে রোমির দেখা পেতে পারি, আমার মন বলছে!"
তড়িৎগতিতে
শুভেন্দু গিয়ে ধরে ফেলেছে তার ডান হাত! আমার দিকে একটা চোখের ইঙ্গিত করে
সে নরম গলায় বুঝিয়ে বলল, "এখন নয়! সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, অচেনা জায়গা। এখন
আমরা সকলেই ফিরে যাব। কাল সকালে আবার আসব এখানে, তখন ভালো করে ঘুরে দেখব
সবকিছু!"
ততক্ষণে আমিও গিয়ে দাঁড়িয়েছি প্রদীপের বাঁ-পাশে। কয়েকবার গাঁই-গুঁই করে অবশেষে নিরস্ত হল সে।
সেই অদ্ভুত প্রহেলিকাকে পেছনে ফেলে রেখে আমরা তিন অবিশ্বাসী শহুরে মানুষ টলতে-টলতে ফিরে চললাম পরিচিত, নিরাপদ জগতের দিকে।
যখন
বাংলোয় ফিরলাম, তখন পুরোপুরি অন্ধকার। এই অঞ্চলে অধিকাংশ সময় বিদ্যুৎ থাকে
না। বাংলোয় দেখলাম হ্যাজাক জ্বলছে। চৌকিদার উদ্বিগ্ন হয়ে রাস্তায়
দাঁড়িয়েছিল, আমাদের ফিরতে দেখে আশ্বস্ত হল। কিন্তু আমাদের গম্ভীর, চিন্তিত
মুখ দেখে সে আর কোনো প্রশ্ন করল না।
আটটার
আগেই ডিনার লাগিয়ে কোঁয়ার সিং তার ঘরে চলে গেল। খিদে বা রুচি কারুরই তেমন
ছিল না। নমো-নমো করে খাওয়া সেরে একটা হ্যাজাক নিয়ে আমরা চলে এলাম বাংলোর
বারান্দায়।
আমি একটা
সিগারেট ধরিয়েছি। প্রদীপ মাথার পেছনে হাত রেখে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে
আছে। শুভেন্দু পায়চারী করছে বারান্দায়। তার মুখে ভ্রূকুটি।
হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গলা-খাঁকারি দিল সে।
"একটা
কথা ভেবে দ্যাখ্। আমাদের একটা উদ্ভট অভিজ্ঞতা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু
ব্যাপারটা যে একেবারেই যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, এমন নয়!
আসল
কথা, এইসব ছোটখাটো পাহাড়ী নদীগুলো সবই মোটামুটি একরকম দেখতে। মানে, সেই
নদী, নদীর দুপাশে ছড়িয়ে থাকা পাথর, আরেকটু দূরে জঙ্গল - এই আর কি!
বাকি মিলগুলো নেহাত কাকতালীয়! যেমন, এখানে যে ব্রিজটা আছে, মোটামুটি সেরকমই একটা ব্রিজ অনীশ দেখেছিল পহেলগাঁও-এ!"
"আর তোদের নাম লেখা ওই পাথরটা?" - সরাসরি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম আমি।
"অন্য
কারুর কীর্তি, যেমনটা তুই তখন বলেছিলি!" - এবারে একটু তুৎলিয়ে গেল
শুভেন্দু, "দৈবাৎ একই অক্ষর বলে আমার মনে হয়েছে আমার হাতের লেখা!"
বারান্দার রেলিং-এ রাখা হ্যাজাকটা সামান্য দপদপ করছে। তার আলোর বৃত্তটুকুর বাইরে গাঢ় অন্ধকার।
সেই অন্ধকারে চোখ রেখে প্রদীপ বলল, "দুর্বল যুক্তি, তাও তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম। কিন্তু ওই কেবিন?"
"আরে
সেটাই তো এখুনি ভেবে বার করলাম!" - শুভেন্দু সোৎসাহে বলল, "এটা তো জানিস,
এইসব অঞ্চলে অনেক বিদেশীর বাস, সেই জিম করবেটের আমল থেকেই। হয়তো তাদেরই
কারুর খামখেয়ালে তৈরী ওই কেবিন!"
প্রদীপ গলার মধ্যে একটা অস্পষ্ট শব্দ করল। সেটা সম্মতির কি বিরক্তির, ঠিক বোঝা গেল না।
"আর
আমরা তো ওখানে ফিরে যাচ্ছি কাল সকালেই!" - শুভেন্দু তাড়াতাড়ি যোগ করল,
"সবকিছু খুঁটিয়ে দেখলেই রহস্যভেদ হবে। কাছে কোনো গ্রাম থাকলে সেখানকার
লোকের সাথেও কথা বলা যাবে!"
আমরা দুজনেই তার কথায় সায় দিলাম। তখনও জানি না, পরের দিন কি চমক অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য!
সে রাতে কারুরই বিশেষ ঘুম হয় নি। সকাল সাতটা বাজতেই কোঁয়ার সিং চা নিয়ে হাজির। সঙ্গে তার নিজের হাতে তৈরী নমকিন।
একটা
কথা মনে হলে এতদিন পরেও খারাপ লাগে। বিদেশী অতিথিদের মুখে নিজের
রন্ধন-পটুতার একটু প্রশংসা নিশ্চয়ই আশা করেছিল বৃদ্ধ! কিন্তু তখনকার মানসিক
অবস্থায় আমাদের কারুরই সেটা খেয়াল হয় নি।
চা-পর্ব
শেষ হতেই রওনা হলাম তিনমূর্তি। এই সকালেই ঝকঝকে রোদ। কাল বিকেলের গা-ছমছমে
ভাবটা পুরোপুরি উধাও। জোর কদমে হেঁটে কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়লাম টিলার
নীচে।
আর টিলার ওপরে উঠতেই লাগল মারাত্মক ধাক্কাটা!
এই দৃশ্যপট আমাদের সম্পূর্ণ অপরিচিত। আমরা কেউ কস্মিনকালেও এখানে আসি নি।
নদী আছে। আছে তার পাশে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত বোল্ডারও। কিন্তু সকালের উজ্জ্বল আলোয় পুরোটাই অন্যরকম।
প্রাথমিক অসাড়-ভাবটা কাটিয়ে ধীরে-ধীরে নীচে নামলাম তিনজনে। চারদিক একটু খুঁটিয়ে দেখতেই ধরা পড়ল আরো নানান অসঙ্গতি। অনেক কিছুই নেই।
যেমন, কালকের সেই ব্রিজটা নেই। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে দেখলাম। নেই।
আড়চোখে দেখলাম, শুভেন্দু খুঁজছে ওদের নাম লেখা সেই বিরাট পাথরটা। বলা বাহুল্য, উধাও সেটাও।
প্রদীপ
দাঁড়িয়ে আছে হতভম্বের মত। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ কিছুটা দূরে। সেখানে সেই লগ
কেবিনটা নেই। কোনোকালে যে ছিল, এমন কোনো চিহ্নও দেখা যাচ্ছে না।
"সব মায়া!" - বিড়বিড় করে বললাম আমি।
বেশ
কিছুক্ষণ নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। আর এখানে
সময় নষ্ট করে কোনো লাভ নেই। ওদিকে ড্রাইভার শর্মাজিও এসে পড়বে গাড়ি নিয়ে।
সবার মন অবশ, পা চলছে যন্ত্রের মত। তবু তার মধ্যেই আমি প্রশ্ন করলাম, "ব্যাপারটা ঠিক কি হল বল্ তো?"
"আমার মনে হয় বুঝতে পেরেছি আমি। কিছুটা হলেও।" - ধীরে-ধীরে বলল শুভেন্দু, "এখন যেমন দেখলি, এ জায়গার আসল চেহারা সেরকমই!
কিন্তু
আধো-অন্ধকারে এই জায়গার দিকে তাকালেই যে কারুর এমন একটা চেনা জায়গার কথা
মনে পড়ে যাবে, যার সঙ্গে তার কোনো একটা সুখের স্মৃতি জড়িত। ওটাই এখানকার
জাদু!
কাল টিলার ওপর থেকে
প্রথমবার এদিকে তাকাতেই আমরা তিনজন দেখতে পেয়েছিলাম তিনটে আলাদা-আলাদা
জায়গা। যেগুলো কোনো না কোনোভাবে আমাদের কাছে খুব প্রিয়। যেগুলোর কথা
কোনোদিন ভোলা যায় না। আমরা প্রত্যেকে কিন্তু নিজের-নিজের ভালো-লাগা
জায়গাটাই দেখেছিলাম। অথবা আমাদের দেখানো হয়েছিল!"
"কিন্তু ওই ডিটেল-গুলো? ওই ব্রিজ, ওই পাথর, ওই কেবিন?" - আমার জিজ্ঞাসা।
"ওগুলো
প্রথমে ছিল না!" - করুণ হেসে বলল শুভেন্দু, "আমরা যেই প্রিয় জায়গাটার কথা
ভাবতে শুরু করি, আমাদের একটু-একটু করে মনে পড়তে থাকে সেখানকার নানান
খুঁটিনাটি। ছোট-ছোট প্রিয় জিনিস।
আর আমাদের মনে পড়ার সাথে-সাথেই, সেই জিনিসগুলো একে-একে ফুটে ওঠে এখানকার দৃশ্যপটে!"
"কিন্তু তাহলে এখন সেগুলো নেই কেন?" - প্রদীপ যেন কৈফিয়ত তলব করছে।
"এটাও বুঝলি না?" - এবার আমি হেসে উঠলাম শব্দ করে, "দিনের বেলা যে! এত আলোয় মায়াপুরীর মায়া খাটে না!"
আবার কিছুক্ষণ সব চুপচাপ।
তারপর প্রদীপ বলল, অনুচ্চ কিন্তু দৃঢ় স্বরে, "সে যা-ই হোক! আমি আবার ফিরে আসব এখানে। ভালো করে দেখব সবকিছু।"
"আমরাও!" - সমস্বরে বললাম শুভেন্দু আর আমি।
সেই
ফেরা কিন্তু আজও হয় নি। এই অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছিল প্রায় পাঁচ বছর আগে।
এতগুলো বছরে আমরা তিনজন বহুবার চেষ্টা করেছি আবার সেখানে যাওয়ার। কিন্তু
অনেকদূর আয়োজন করার পর একেবারে শেষ মুহূর্তে এসেছে কোনো না কোনো বিঘ্ন।
তবে, হাল ছাড়ি নি আমরা। একদিন ফিরে যাবই সেখানে। আমরা জানি!
আপনারা
যারা ছুটিতে পাহাড়ে বেড়াতে যাবেন ভাবছেন, তাঁদের জন্য একটা সামান্য উপদেশ।
যেতে চাইলে যান কোনো সুপরিচিত ট্যুরিস্ট স্পটেই। আরো দশজনের সাথে মিলে
হৈ-হল্লা, আমোদ-প্রমোদে কাটিয়ে আসুন কয়েকটা দিন। পাহাড়ে কোথায় কি থাকে বলা
মুশকিল। তাই ঝোঁকের মাথায় ফট করে কোনো অজানা, নিরিবিলি জায়গায় চলে যাবেন
না।
অথবা, যাবেন! অবশ্যই যাবেন! কিন্তু তার আগে জানাতে ভুলবেন না, কেমন লাগল আমার এই গপ্পো!
...............................
Oeeshik Majumder