অলৌকিক একটা গল্প - শুক্তি রায়

অলৌকিক একটা গল্প 

শুক্তি রায় 

 


 



                                  

লোকে বলে মর্নিং শোজ দ্য ডে ! এই কথাটা যে কতটা ফালতু সেটা আজ বার বার মনে হচ্ছে স্বর্ণাভর। রুক্মিণীকে ছ মাসের জন্য বাপের বাড়িতে রেখে ও যখন রওনা হল সকাল বেলা, আকাশ তখন খিলখিলিয়ে হাসছে। কিউল থেকে কলকাতা এমন একটা কিছু দূরত্ব নয় আর ওই রাস্তাও একদম মুখস্থ স্বর্ণাভর। শ্বশুরবাড়িতে ঠেসে ব্রেকফাস্ট করে যখন গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসল স্বর্ণাভ, তখন ও নিশ্চিত ছিল যে সন্ধ্যার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাবে। লাঞ্চ করারও দরকার হবে না। মাঝে মাঝে কোথাও দাঁড়িয়ে একটু চা কফি খেয়ে নিলেই হবে।

একটু দূর সবে এগিয়েছে, পঙ্কজের ফোন। ফোনের স্ক্রিনটা দেখেই মাথার মধ্যে বিপদঘণ্টি বাজতে লাগল স্বর্ণাভর। পঙ্কজ রুক্মিণীর দূর সম্পর্কের দাদা। পয়সা কড়ি এবং ক্ষমতা তার অপর্যাপ্ত তাই রুক্মিণীদের বাড়িতে ওর খুব আদর কদর। মেজাজি লোক পঙ্কজ, একটা বছর কলকাতার কলেজে বি কম পড়েছিল স্বর্ণাভর সঙ্গে সেই সূত্রেই ওদের আলাপ বন্ধুত্ব আর তারপর রুক্মিণীর সঙ্গে বিয়েটা। রুক্মিণী অসামান্য সুন্দরী আর একই সঙ্গে বুদ্ধিমতী এবং ঘরোয়া মেয়ে। ভালো ভাবেই বি এ পাশ করেছে কিন্তু চাকরি করার বেয়াড়া ইচ্ছে ডানা মেলেনি ওর মধ্যে। স্বর্ণাভদের মতো ওরাও ব্রাহ্মণ। স্বর্ণাভর বাড়িতে একটু আপত্তি উঠেছিল বিহারী মেয়েকে বিয়ে করা নিয়ে কিন্তু মেয়ের বাড়ির ঠাটবাট আর ঘরে যেচে আসা অজস্র দান সামগ্রীর সঙ্গে পঞ্চাশ লাখ এবং পঞ্চাশ ভরি পাওয়ার পর সবার মুখ একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবু আজকাল মাঝে মাঝেই স্বর্ণাভর মনে হয় বিয়েটা কি আসলে একটা টোপ ছিল স্বর্ণাভর কাছে যা গিলে ওর গলায় আটকে গেছে পঙ্কজের পাপের বঁড়শি ?  

মাত্র একটা বছর কলকাতায় ছিল পঙ্কজ। তারপর আর মা সরস্বতীর পায়ে তেল মারার ধৈর্য ছিল না। ভাঁড় মে জায়ে ডেবিট-ক্রেডিট ! পড়াশোনা ডিগ্রি... কী হবে এ সব দিয়ে ? পঙ্কজ আর ওর বাপ দাদার কী নেই ? জমিজমা, চাল গমের আড়ত আর সুদের ব্যবসায় প্রচুর টাকা। আইন যাই বলুক ওই এলাকাতে ওদের পরিবারের কথাই শেষ কথা। গ্রামের পঞ্চায়েতের মুখিয়াও ওরাই। কোন মাঈ কা লাল আছে, যে ওদের সঙ্গে টক্কর নেবে ? বাড়িতে অগুন্তি গরু মোষ, চারটে বাঘা কুকুর আর পঙ্কজের দু দুটো সুন্দরী বৌ। চমকাবার কিছু নেই ! একটা সাচ্চা মরদের মাত্র একটাই বৌ থাকবে নাকি ? পুলিশ থেকে পঞ্চায়েত সবই ওর পকেটে কাজেই... এ হেন পঙ্কজের ইচ্ছা হয়েছে তার বহনোই অর্থাৎ ভগ্নিপতির সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করার। স্বর্ণাভ দু একবার টাল বাহানা করে কাটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল কিন্তু পেরে ওঠেনি। হেথবাটিয়া থেকে সোজা রাস্তা ছেড়ে গাড়ি ঘোরাল সে মধুপুর হয়ে কর্মাটাঁড়ের দিকে। কর্মাটাঁড় পেরিয়ে পাঁচ কিলোমিটার মতো গিয়ে সুখিয়াগঞ্জ, পঙ্কজ ঠাকুরের নিজস্ব এলাকা।

দুপুরে খাওয়া দাওয়া যা হল, তা বলার কথা নয়। আর হল কিছু কাজের কথা। সেই জন্যই তো স্বর্ণাভর ডাক পড়েছিল। স্বর্ণাভর গাড়ির ডিকিতে তুলে দেওয়া হল একটা বড় সড় বস্তা। স্বর্ণাভকে বলে দেওয়া হল সুখিয়াগঞ্জ থেকে মহুলপুর হয়ে, জেঠার মোড় থেকে বাঁ দিকে ঘুরে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ওকে যেতে হবে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার। ওই জঙ্গলের মধ্যে অনেকগুলো সরু সরু মেটে রাস্তা চলে গেছে দূর দূরের গ্রামে। ওই রকম একটা রাস্তার মুখে হাতে তৈরি ট্যারাব্যাঁকা অক্ষরে লেখা একটা সাইনবোর্ড আছে ‘কংকালী মা মন্দির’ বলে। স্বর্ণাভকে ওই সাইনবোর্ডটা খেয়াল রাখতে হবে তারপর ওই কাঁচা রাস্তাটা ধরে একটু দূর গেলেই একটা ভাঙা চোরা মন্দির। ওখানে গাঁ-বস্তি নেই। এক্কেবারে সুনসান। মন্দিরের পাশে একটা বড় দীঘি। সেই দীঘিটার মধ্যে বস্তাটা ফেলে দিয়ে ও গাড়ি ঘুরিয়ে যে রাস্তা দিয়ে গিয়েছিল, সে রাস্তা দিয়ে ফিরবে। বস্তাটা যথেষ্ট ভারি তাই টুপ করে ডুবে যাবে। ও নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। জেঠার মোড় থেকে একটু গেলেই চিত্তরঞ্জন যাওয়ার রাস্তা তারপর আসানসোল হয়ে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়ে। হ্যাঁ, স্বর্ণাভর বাড়ি পৌঁছোতে রাত হবে কিছুটা। তাতে কী ? ও তো আর ষোল বছরের মেয়ে নয় !

স্বর্ণাভ সরাসরি জানে না কিন্তু অনুমান করে যে ওই বস্তাটার মধ্যে রয়েছে একটা লাশ। ওর কাজ ওই লাশটা গুম করা। পঙ্কজের পাল্লায় পড়ে এর আগে অনেক বেআইনি কাজই করেছে স্বর্ণাভ কিন্তু এই রকম কোনো কাজ ও আগে কখনো করেনি। স্বর্ণাভ বুঝতে পারছে যে ও এক গভীর চোরাবালির মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে। আজ ও লাশ পাচার করছে, কাল হয়তো ওকে খুন করতে হবে। রাতের পর রাত বিলাসবহুল এসি ঘরে দামি বিছানায় এ পাশ ও পাশ করে কেটে যায় ওর। দারুণ ফ্ল্যাট, সুন্দরী বৌ আর প্রচুর টাকা পয়সা থাকা সত্বেও ওর অস্থিরতা যায় না। কিন্তু ওই চোরাবালি থেকে বেরোবার কোনো পথও ওর জানা নেই।

বস্তাটা টেনে নিয়ে দীঘিটার মধ্যে ফেলে জঙ্গল থেকে বেরোবার সময় স্বর্ণাভ হঠাৎ আবিষ্কার করল যে ওর ফোনের স্ক্রিনটা কালো হয়ে গেছে। পঙ্কজ ওকে বলে দিয়েছিল আর ও নিজেও জানে যে ফোন দিয়ে লোকেশন ট্র্যাক করা যায়। তাই ও মনে মনে স্থির করে রেখেছিল যদি কখনো কোনো কারণে প্রশ্ন ওঠে যে ও কেন গিয়েছিল ওই জঙ্গলে তাহলে ও বলবে যে ওই জাগ্রত কঙ্কালী মায়ের কাছে ও ওর গর্ভবতী স্ত্রী আর অনাগত সন্তানের জন্য মঙ্গল কামনা করতে গিয়েছিল। সবাই বলে যে ওই দেবী খুবই জাগ্রত। ফোন অফ করা ছিল এতক্ষণএখন বার বার চেষ্টা করেও অন হচ্ছে না ফোনটা। রুক্মিণী নিশ্চয়ই এতক্ষণে পঞ্চাশ বার ফোন করে ফেলেছে ওকে।

জেঠার মোড় থেকে ডান দিকে গাড়ি ঘোরাল স্বর্ণাভ। ছোট একটা গঞ্জ পেরিয়ে গাড়িটা তীর বেগে ছুটে চলল পিচ রাস্তা দিয়ে হঠাৎ একটা ঝটকা মেরে গাড়িটা থেমে গেল ! স্বর্ণাভ গাড়ি থেকে নেমে বনেট খোলে। গ্লাভ বক্স থেকে টর্চ বের করে দেখার চেষ্টা করে বনেটের ভিতরে। কোনো সমস্যা তো চোখে পড়ছে না। আবার গাড়িতে উঠে চাবি ঘোরায়। আহ্‌ কী জ্বালা ! কিছুতেই স্টার্ট নিচ্ছে না গাড়িটা ! শীতের বিকেল দ্রুত ছুটছে অন্ধকারের দিকে। কোথাও জনবসতির চিহ্ন নেই। আদিগন্ত ঢেউ খেলানো ছোট ছোট টিলা আর তার মাঝখান দিয়ে চলেছে ঝকঝকে পিচের রাস্তা। নাহ্‌, গাড়িটা বিগড়েই গেছে ওর।

রাস্তায় নেমে দাঁড়ায় স্বর্ণাভ। গাড়িটা মাঝ রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে থাকে। এ কেমন রাস্তা যে একটাও গাড়ি বাস বা লরি যাচ্ছে না ! চারদিকে নিকষ অন্ধকার। তার মধ্যে জ্বলছে নিভছে ওর গাড়িটার ইন্ডিকেটর ল্যাম্প। অন্ধকারে ঘড়ি দেখা যাচ্ছে না। মোবাইলটা এমনিতেও অন্ধকার। কেমন একটা হিম হিম ভয় বয়ে যায় স্বর্ণাভর গোটা শরীর বেয়ে। পা দুটো অবশ হয়ে ও বসে পড়ে রাস্তার ধারে। ওর মনে হয় যেন আজীবন এই অন্ধকার জনমানবহীন রাস্তায় পড়ে  থাকবে ও। কেউ আসবে না ওকে বাঁচাতে।

দূরে আকাশের শরীর চিরে ঝলসে উঠল বিদ্যুতের রেখা, এদিক থেকে ওদিক। ওদিক থেকে সেদিক। গুমগুম গুমগুম শব্দ যেন প্রতিধ্বনি তুলল গোটা প্রান্তর জুড়ে। ডাকাতের মতো ঝোড়ো হাওয়া ছুটে এল হা রে রে রে করে। ধুলোর ঝড়ে যেন অন্ধ হয়ে গেল চতুর্দিক। কোথায় যেন তীব্র শব্দ করে বাজ পড়ল। বুকের কাছে দু হাত জড়ো করে একটা বাচ্চা ছেলের মতো ভয়ে চিৎকার করে উঠল স্বর্ণাভ আর সঙ্গে সঙ্গে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। গাড়ির দরজাটা খুলে ছিটকে ঢুকে গেল গাড়িটার মধ্যে। পর মুহূর্তেই কী এক অজানা আতংকে গাড়ির দরজা খুলে আবার নেমে এল রাস্তায়।

বৃষ্টির শব্দের মধ্যে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে একটা অদ্ভুত শব্দ দূর থেকে কাছে এগিয়ে আসছে না ? এক ঝলক বিদ্যুৎ চমকাল আর স্বর্ণাভ দেখতে পেল একটা গরুর গাড়ি এগিয়ে আসছে রাস্তা ধরে। ‘এই ! এই ! রোকো, রোকো !’ স্বর্ণাভ চেঁচিয়ে ওঠে। ব্লিঙ্কারের ক্ষীণ আলোতে ও দেখতে পায় গরুর গাড়িটা থেমেছে ঠিক ওর গাড়ির পিছনেই। একটাই লোক আছে গাড়িতে, সেই চালাচ্ছে গাড়িটা। ‘গাড়ি খরাব হো গঈ হ্যায় মেরী’, স্বর্ণাভ বলে, ‘মেকানিক মিলেগা কহীঁ পে ?’ ‘ব্যায়েঠ জাইয়ে বাবু গাড়ি মেঁ’, খসখসে গলায় উত্তর দেয় লোকটা। তখন আর ভাবার অবস্থা নেই স্বর্ণাভর। ও উঠে পড়ে গরুর গাড়িতে। অন্ধকার পথ ধরে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে চলতে থাকে গাড়িটা ক্যাঁচর ক্যাঁচর করে।

কতক্ষণ ধরে চলছে গাড়িটা কে জানে ? অন্ধকার যেন আরো ঘন হয়ে এল, আরো বাড়ল বৃষ্টির তোড়। অবশেষে অনেক দূর থেকে দেখা গেল একটা আলোর রেখা। বুকে যেন একটু বল এল স্বর্ণাভর। ‘ক্যা হ্যায় ওহাঁ ?’ গাড়োয়ানের কাছে জানতে চায় ও। ‘মন্দির হ্যায় বাবু। কঙ্কালী মাতা কা মন্দির’, লোকটা উত্তর দেয়। ‘কেন এনেছ আমাকে এখানে ?’ ভয়ে চিৎকার করে ওঠে স্বর্ণাভ। ‘আপনিই তো আমাকে ইখানে রেখে গেলেন বাবু’, নিরীহ গলায় বলে লোকটা। ‘আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে চলো। আমার ভয় করছে। যত টাকা লাগবে দেব আমি। আমায় ফিরিয়ে নিয়ে চলো’, কাতর হয়ে চিৎকার করে ওঠে স্বর্ণাভ। ‘কুতায় ফিরবেন বাবু ?’ অন্ধকারে ভেসে আসে খসখসে গলা, ‘আপনার দোস্তের পুরো বসেরা তো আজ খাক হো গয়া বিজলি গিরকে ! জিন্দা নহীঁ হ্যায় কোঈ ভি।  আর টাকা তো আজ আর আমার কুনো কাজে লাগবে না, বাবু ! কাম কা বন্দা থা। কাম খতম তো জান খতম !  বহুত অকেলা লাগেগা আজ কে বাদ। বস, দোনো সাথ ব্যায়ঠেঙ্গে পোখর কে গহরাই মেঁ !’ একটা হালকা হাসি ছড়িয়ে পড়ে ভিজে হাওয়ায়।

উফ ! এই সময়েই ফোন আসতে হয় ? নীলা কী বোর্ড থেকে আঙুল সরিয়ে ফোনটা ধরে, ‘হ্যাঁ, শ্রীনিবাস বাবু আপনার পত্রিকার ‘অশরীরী’ সংখ্যার লেখা প্রায় শেষ। আর পনের মিনিটের মধ্যেই মেইল করছি।’          

 

সমাপ্ত