পাঠ প্রতিক্রিয়া
সুকন্যা দত্ত
উপন্যাস: সুপুরিবনের সারি
লেখক: শঙ্খ ঘোষ
প্রকাশনী: অরুণা
মূল্য: ৭০/-
'নীলুদের গ্রামটা না কি এখন অন্য একটা দেশ, ভারি আজব কথা'— এ আজব কথার সময়টা ভারত বিভাজনের, সময়টা নিজের দেশবিদেশ হয়ে যাওয়ার, সময়টা তোমাদের-আমাদের এই দুইভাগে ভাগ হয়ে পাঁচিল উঠে যাওয়ার।
"সুপুরিবনের সারি"— এ শুধুমাত্র 'কবি' শঙ্খ ঘোষের লেখা নয়, এটি একটি এমন মানুষের চোখ দিয়ে দেখা দেশভাগ, যে দেশকে নিজের আত্মার সাথে এক করেছে, সেই দেশ ছাড়তে যে শরীর থেকে আত্মাকে বিমুক্ত করার তুল্য বিজাতীয় যন্ত্রণায় আছাড়িপিছাড়ি খেয়েছে আর সেই যন্ত্রনায় কুঁকড়ে ওঠা মনেরই রূপরেখা এঁকেছেন শঙ্খ ঘোষ তাঁর 'নীলু'-র হাত দিয়ে। এক কিশোরের শেষবারের মত 'দেশে' যাওয়ার গল্প 'আর কোনোদিন দেশে না যাবার জন্য।'
একদিন দুপুরে কলেজের লাইব্রেরিতে বসে শঙ্খ ঘোষের কবিসত্ত্বাকে ছাপিয়ে আবিষ্কার করেছিলুম তাঁর দেশবোধকে, তাঁর কিশোরবেলার মামাবাড়ি যাওয়ার অসীম আনন্দকে, তাঁর দেশের প্রতিটি মানুষকে, তাঁর বন্ধু, তাঁর বাঙ্ময় দৃষ্টির তথাকথিত অর্থহীন শব্দ বলা 'পাগলী' ছোটমামীকে, তাঁর ওপারে ফেলে আসা দিগন্ত বিস্তৃত শ্যামলিমা, তাঁর সুবাসিত ফুলের বাগান, তাঁর স্বচ্ছতোয়া নদী, কাকচক্ষু পুকুর, তাঁর দ্বাদশীর বিকেলে ঝুপ করে নেমে আসা সন্ধ্যের মুখে প্রদীপ জ্বলা তুলসীতলা, আর সবচেয়ে বেশি করে সেই সুপুরিবনটাকে, যার 'ওইপর্যন্তই হলো আমাদের গ্রামের সীমা। ব্যস্, তারপর, শেষ—'
আবিষ্কার করেছিলুম দেশবিভাগের চুলচেরা রেখায় বিভক্ত হয়ে যাওয়া তাঁর ছোট্টবেলার বেলার বিষাদগ্রস্ত, এক ধাক্কায় হটাৎ বড় হয়ে যাওয়া বুঝদার, ভারী মনটাকে, কারণ গল্পের 'নীলু' যে তিনিই স্বয়ং তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। আবিষ্কার করেছিলুম আর কখনও সেদেশে ফিরে যেতে না পারার নিষ্ফল আক্রোশের তাঁর বয়ঃসন্ধিকালকে, তাঁর 'মুসলমান' বন্ধুদের ব্যাকুলতাকে— 'আসিস কিন্তু আবার, সামনেরবার। আসবি তো? কী রে, আসবি তো? আসিস আবার। আসবি?', আর এর উত্তর দিতে না পারা নীলুর অপরিসীম অসহায়তাকে।নৌকায় করে নিজের দেশে ফিরতে থাকা নীলু চাইলেও কাউকেকিছুতেই বোঝাতে পারে না তার মাস্টারমশাই নির্মলবাবুর বলা কথাগুলো, বাঙালি আর মুসলমান এরকম কোনো ভাগ হতে পারে না, 'দুটোয় গুলিয়ে ফেললেই মুশকিল। একটায় জাতের কথা, একটায় ধর্মেরকথা।'
'সুপুরিবনের সারি'- কে কিশোর উপন্যাস বলা হলেও এটি সবধরণের মানুষের মনে ঘরছাড়ার মনোবেদনা উদ্রেক করতেযথেষ্ট সক্ষম।কিশোর চোখের মধ্য দিয়ে নৈসর্গিক দৃশ্যের মাঝে জলপথে ভ্রমণের অপরূপ বর্ণনা দিয়ে শুরু হয়েছে উপন্যাসখানি। মাঝে ছুঁয়ে গেছে দেশমাতৃকার উদ্দেশ্যে জীবনের ঝুঁকি নেওয়া বিপ্লবীর কথা। রয়ে গেছে দুর্গাপুজোয় যৌথ পরিবারের পাত পেড়ে খাওয়ার আনন্দ। থেকে গেছে অনেক পরিজনের মাঝে একটি মানুষের আলাদা, নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়ার স্পর্শ। মিশে গেছে এক 'বাঙালি' কিশোর আর তার মুসলমান বন্ধুর মাঝে দেওয়াল ওঠার হাহাকার— "এইসব একদিন আমাগো হইয়া যাবে", আর এই সবকিছুর মাঝে গন্ডির মত মাথা তুলে রয়ে গেছে নীলুর দেশের সুপুরিবনের সারি।
লেখক শক্ত শব্দার্থ বর্জিত খুব ছোট ছোট সরল সাবলীল বাক্যবিন্যাসে মাত্র ৯০টি পাতার মধ্যে জড়ো করেছেন নিজের দেশ হটাৎ বিভুঁইহয়ে যাওয়ার যাতনাকে, তারসাথে যথোপযুক্ত সঙ্গত করেছে প্রবীর সেনের প্রচ্ছদ সবুজরঙের গন্ধ মাখা লম্বা গাছের সারি।
বসে ছিলুম পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখতে, লিখে ফেললুম আবেগমাখানো কিছু অনুভূতি। আসলে কষ্টের এ বিচ্ছেদ হয়তো আমরা মেয়েরা এমনি এমনিই কিছুটা বুঝতে পারি, আর তার জন্য হয়তো ওপারের মানুষ হতে লাগে না, এপারের মানুষ হয়েও নিজের বাড়িঘর আর তার লাগোয়া স্মৃতি মুছে চলে আসার রক্তক্ষরণ কখনও না কখনও আমাদের সব মেয়েদের অন্তরেই যে চুঁইয়ে পড়ে, তাই...
"কেবলই করে ভয়
এত যে লোক এত যে জন
আমার কি কেউ নয়।"
!! সমাপ্ত !!