বরুণ সরকারের শেষ লেখা - রণি বসু
নিরুদ্দিষ্ট যাত্রী - শেলী ভট্টাচার্য
সময়ের বিপদ আপদ - সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
ভাবনা কারা - আগমনী পাঠক
ভাবনা কারা
আগমনী পাঠক
“বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এই কল্পনাতীত বিশাল ক্ষেত্রের ক্ষুদ্রাতীত ক্ষুদ্র আমাদের এই বাসভূমি। পুনশ্চ, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তুলনায় মোদের অস্তিত্ব নগন্য। তবে জানিস, হিন্দু দর্শন মতে, যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাই আছে সবথেকে ক্ষুদ্র কণাতেও, আবার মনই নাকি এসবের আধার! উফ, কীসব বকছি তোদের কাছে। আসলে, ইদানিং আমার আবার বিজ্ঞানের তত্ত্বর সাথে নানান ধর্মীয় তত্ত্ব আলোচনা পর্যালোচনার ভূত মাথায় চেপে বসেছে। এই ভূত বলতেই আমার মাথায় বেশ ইন্টারেস্টিং ঘটনা মাথায় এসেছে”
মামাবাড়িতে গরমের ছুটিতে সবাই এসেছি। আমি, বাবাই, তুতাই, টুবলাই, মনি দিদি, আর ছোট্ট রিনিও এসেছে। আমি, তুতাই , টুবলাই তিনজনেই হাওড়া ঠাকুরানী উচ্চবিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেনীর ছাত্রছাত্রী। সম্পর্কে আমারা সবাই একেওপরের কাজিন্স। মনি দিদি আর টুবলাই অবশ্য সিব্লিংস। বাবাই দাদা আমার মামত দাদা। এই বাড়িটা আমাদের মামাবাড়ি ঠিক নয়, এটা মামার চাকরিসুত্রে পাওয়া কোয়াটার, কিন্তু বিএসএফ ইন্সপেক্টরের কোয়াটারকে স্বচ্ছন্দে ছোটোখাটো বাংলো বাড়ি বলা যায়। আসামের শিলচর শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে গ্রাম্য পরিবেশে এই বিশাল বি এস এফ ক্যাম্প! এর পাশেই আর্মি ক্যাম্প, সেটা আরও বড়ো, তবে আমরা যাইনি ওখানে, দূর থেকে দেখে আর মামীমার মুখে শুনে ঠাওর করেছি ওর আয়তন। বাবাইদাদা এখন ব্যাঙ্গালরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে আর মনি দিদি কলকাতায় বালিগঞ্জে এম এস সি করছে। আমি এটুকু গল্প শুরুর আগে বলা প্রয়োজন মনে করলাম নয়ত গল্পের মাঝে আমাদের পরিচয় পেতে পাঠকের হয়ত ভালো লাগবে না। যাইহোক, আমি আবার গল্পে ফিরি। এবার নিশ্চয় বুঝেছেন যে কথা শুরু করেছে সে আমাদের মনি দিদি। মামা যেখানেই থাকুক প্রতিবার গরমের সময়ে আমরা সবাই সেখানে যাই, খুব খুব মজা করে কাটে আমাদের ছুটি। সাথে মনিদির গল্প আমাদের উপরি পাওনা।
মনিদির কথায় বেশ বুঝতে পারলাম একটু উৎসাহ দেখালেই মনিদির গল্পের ঝাঁপি খুলে যাবে।
“ইন্টারেস্টিং? মানে কি সেই হাউ মাউ খাঁউ মানুষের গন্ধ পাঁউ? এই তাহলে আমি নেই, উঠলাম, ওসব গাঁজাখুড়ি গল্প আমার পোষায় না” বাবাই দা মনিদির কথা শেষ হতেই হাঁই হাঁই করে বলে উঠল!
মনিদি সোফার উপর বসে বেশ যোগীমাতার মত মুখের ভঙ্গি করে বলল, আমি কবে শুনিয়েছি সেসব ? না, শুনতে চাইলে আমি বলবো না, যা!
উফ, এই দাদা দিদি নামেই বড়ো হয়েছে, তবু বাচ্ছাদের মত রাগ করে, যাইহোক আমি বললাম,
“আরে না না, দিদি তুমি যা বলছিলে শুরু করো, আট টা বাজতে গেল, ঠিক ৯টা পনেরো তে মামিমা আবার ডাক দেবে, খেতে যেতে হবে, তার আগে প্লিজ”
“ঠিক আছে সবাই বলছে যখন আমিও বসি” বাবাই দাদার সম্মতিতে দিদি বেশ মুখে এক প্রসন্ন হাসি এনে, আবার বলতে শুরু করল। আর, বাকিরা তো, আগে থেকেই গল্পের নাম শুনে জাঁকিয়ে বসেছে।
এবার যা গল্প মনিদিদির কথাতেই লিখছি আমি,
“তবে শোন, এই গল্প আমার অভিজ্ঞতা নয়, এ আমার এক রুমমেটের কথা, গল্প তোদের মামদ, জামদ বা ভ্যাম্পায়ার নিয়ে না হলেও…,” বলতে বলতেই দুম করে কারেন্ট অফ হয়ে গেল, আর বাইরে যে এতক্ষণ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে তা এতক্ষন টেরই পাইনি, এখন তারই শব্দ কাঁচ ঘেরা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে, নিঝুম পরিবেশের ছমছমে ভাবটা আরও গভীর থেকে গভীরতর করে তুলল।
“এই ভয় বলতে বলতেই কারেন্টটা কেন যে হাওয়া হয়ে যায়, বুঝি না বাপু!” তুতাইয়ের কথা শেষ হতে না হতেই, মামি মা দুটো বড়ো বড়ো বাতি জ্বালিয়ে ঘরের দুই কোনে রেখে গেলেন। আমরা মনিদিদির আরও কাছে কাছে ঘেঁসে বসলাম।
“এই যে এখন অন্ধকার হয়ে গেল, এখন তোদের মনে হচ্ছে না, এটা যেন একটু আগেই হয়েছে বা এই একই সময় কাটিয়েছিস? বা জানিস সবটুকু কী ঘটতে পারে!”
“দিদি, প্লিজ, কীসব বলছিস! তুই গল্প বল” টুবলাই বলল।
“হুম্, আমার রুমমেট প্রিয়া, আছে এখান থেকে সামনেই শিলং শহরে। গতবছর মার্চে বিয়ের পর পরই ও ওর বরের সাথে এই শিলং শহরে চলে আসে, ও আমার রুমমেট কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে ছিল আমার থেকে ১ বছরের সিনিয়র। তাই পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে খুব আনন্দেই শিলঙে চলে আসে। আমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, ওখানের পরিবেশের অপরূপ দৃশ্যের ছবি পাঠাত আমাকে। ছুটিতে ওখানে যেতেও অনুরোধ করে, কিন্তু তোরা তো জানিস আমার ফাইনাল ইয়ার গেল এই বছরটা । সুতরাং ছুটি পেলেও প্রোজেক্ট , রিপোর্ট, করতে করতেই কেটে যেত।
প্রায়ই কথা হত। ওর ছবি বা ভিডিও থেকে আমারও ততদিনে ওদের বাড়ির আশে পাশের পরিবেশ সহ মানচিত্র বেশ মাথায় গেঁথে গেছে। একটা সবুজ উদ্যান ঘেরা একতলা বাড়ি ওদের। ওর বর ইউনিভার্সিটির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোফেসর আর ইউনিভার্সিটির খুব কাছেই ছিল ওদের এই বাড়ি। এমনিতে দেড় কিমির মতো হলেও, সামনের এক পার্ক এর রাস্তা নিলে ৫০০ মিটার কম হাঁটতে হতো। এখানে এসে তো, তোরা পাহাড়ের সৌন্দর্য বুঝতেই পারছিস তাই ওসব আর বলবো না। মোটকথা ওখানের দৃশ্য আমি দূর থেকে ডিজিটালি দেখেই অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। এইভাবে ওর ওখানে ৮ মাস কেটে গেল, শীতকাল জাঁকিয়ে বসেছিল শিলং শহরে, আর আমার জীবনে বসেছিল সেমিস্টারের চাপ! অনেকদিন কথা হয়নি আর প্রিয়ার সাথে। এরপর একদিন হোয়াটসঅ্যাপে দেখি প্রিয়ার খুব লম্বা একটা মেসেজ”
এতটুকু বলে মনিদিদি থামলো, ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রল করতে করতে মিনিট খানেক পর আমাদের সামনে মোবাইলটা এগিয়ে দিল। বাবাইদা সেটা প্রায় ছোঁ মেরে সবার আগে নিয়ে নিল। মনিদিদি বলল, “ওটা ও পাঠিয়েছিল, খুব একটা ব্যাক্তিগত কিছু নেই, তাই তোদের সরাসরি দেখতে দিলাম”। বাবাইদার পর সবার হাত ঘুরে আমার হাতে এসে পৌঁছাল সব শেষে, এস এম এস টা ছিল এইরকম।
“মনি, কতদিন তোকে ফোন করতে পারিনি, কিন্তু আজকালযে কি হয়েছে আমার! সময় যেন কেমন আমার সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে হারিয়ে যায়। গতকালেরই ঘটনা, সোমনাথ ওর রিসার্চ ল্যাবে একটু রাত অবধি কাজ করবে জানাল, আমাকে বলল ওর রাতের খাবারটা ওখানেই নিয়ে যেতে। সেইমতো আমি সব প্যাক করে নিয়ে বেরলাম, তখন সবে সাতটা বাজে কিন্তু এখন শীতের সময়, তাই বেশ অন্ধকার! নিলাম ওই পার্কের পথ, হাতে মোবাইল ছিল তবে টর্চ জ্বালানোর প্রয়োজন ছিল না, অনেক স্ট্রিট লাইট জ্বলছে। পার্কের সামনের ফাউন্টেনটা পেরিয়ে যেতেই এমন একটা রাস্তা পড়ে যার দুপাশে বড়ো বড়ো গাছ। ওই গাছের সবুজ ডাল পালাগুলো এমনভাবে রাস্তার সামনে এগিয়ে এসেছে যে সকালে নীল আকাশ উঁকি মারলেও রাতের অন্ধকারে তা দেখা যায় না। দিনে এই পথ বেশ রোম্যান্টিক লাগে কিন্তু রাতে যেন এক গুহা পথ। কাল দেখি, শুধু ওই পথেরই স্ট্রিট লাইট গুলো ঠিক করে জ্বলছে না, দুটো একেবারে বন্ধ আর দুটো জ্বলছে নিভছে। হাতের মোবাইলের টর্চটা জ্বালাতে হল না, তাড়াতাড়ি ওখান থেকে বেরতেই দেখি, একটা বেশ সাদা রঙের ছোটো কুকুর খুব লেজ নাড়াচ্ছে আর আমার সামনের দিকে এগিয়ে এসে আমার পায়ের কাছে যেন মাথা ঠেকিয়ে কিছু একটা জানাতে চাইছে, আমি বুঝলাম, ওর হয়ত খিদে পেয়েছে। আমার ব্যাগে রাতের খাবারের সাথে কিছু শুকনো খাবারও ছিল, সেটা আমি বের করে ওই কুকুরটাকে দিলাম। ও সানন্দে লেজ দুলিয়ে খাবারের দিকে মুখ ঝুঁকিয়ে খেতে শুরু করে দিল। তখন, আমার হঠাৎ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে খুব ইচ্ছা হল। মাথা নুইয়ে দিতে গিয়েই কেমন যেন একটু চোখের দৃষ্টি অন্ধকার হয়ে এলো।
এরপর দেখি, কোথায় সেই কুকুর, এমনকি আমি ওই পথের অন্য প্রান্তে মানে এখনও আমি ওই রাস্তাই পার হইনি। কিন্তু কীভাবে তা হয়? ভাবলাম, আমি হয়ত অনেক বেশি ক্লান্ত, আর বেশি বেশি চিন্তা করছি, তাই মনের ভয় ভয় ভাবটা কাটিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। আর তুই তো জানিস, আমি সবসময় একটু বেশি ভাবতে থাকি। এবার যা হল,কীভাবে যে বলি! ওই সবুজ গুহাপথের ন্যায় রাস্তা আবার পেরিয়ে গেলাম ওপর প্রান্তে, আমি আবার একইভাবে ওই কুকুরটার দেখা পেলাম, কেন জানি না, মনে হল ওকে খাবার দিই। কিন্তু সেই একই ঘটনা ঘটল, মানে খাবার দিয়ে ওকে খেতে দেখতে দেখতে যেই ওর মাথায় হাত দিয়ে একটু আদর করতে গেলাম,…
দেখি কিনা, আমি আবার অন্য প্রান্তে! এরকমভাবে প্রায় তিনবার ঘটল। আমি খুব ক্লান্ত, সবথেকে অবাক কী জানিস?
আমি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম, সাতটা বেজে ১০ মিনিট আর ওই ঘটনা তিনবার ঘটার পরও দেখলাম মোবাইলের ঘড়ি জানাচ্ছে তখন সবে মাত্র ৭ মিনিট পেরিয়েছে। তাহলে কি সবই মনের মাঝে!! বেশি ভাবার জন্য কি হচ্ছে?
আমি আবার গেলাম, তবে এবার আর ওই কুকুরটার মাথায় হাত বোলানোর জন্য ঝুঁকলাম না। দেখলাম আর আমি অন্যপ্রান্তে নিজেকে আবিষ্কার করলাম না। যতটা সম্ভব দ্রুত হেঁটে ওর ইউনিভার্সিটি পৌঁছে গেলাম। গিয়ে খুব হাঁপিয়ে পড়ি, তাই ঠিক করলাম, সোমনাথের সাথেই বাড়ি ফিরব, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ওদের রেস্টিং প্লেসে বসে রইলাম।
এরপরের ঘটনা, ঐদিনই ফেরার সময় হয়।
ফেরার সময় সোমনাথ সাথেই ছিল। হাঁটতে হাঁটতে ইউনিভার্সিটি এরিয়া শেষে পার্কের রাস্তা ধরলাম, তখন ও ওর ব্যাগ থেকে একটা চকলেট বের করে আমায় এগিয়ে দিয়ে বলল, “খেতে খেতে চল”। আমি নিতে গিয়ে দেখি, কোথায় পার্কের রাস্তা কোথায় চকলেট দিচ্ছে! সোমনাথ তো আমার পাশে দাঁড়িয়ে বোতল থেকে জল খাচ্ছে, আমরা পার্কের রাস্তা দিয়ে হাঁটতেই তো শুরু করিনি! ঠিক এই ঘটনা তো হাঁটতে শুরু করার আগের মুহূর্তেই ঘটল। আমি আবার দেখলাম, একই ঘটনা ঘটল, সময় এগোচ্ছে না যেন পেন্ডুলামের মত দুলছে।
এবার হাঁটতে লাগলাম, সেই একইভাবে সোমনাথ আমার দিকে চকলেট এগিয়ে দিল! এবার আমার মাথাটা ঝিম ঝিম করতে শুরু করেছে, চকলেট না নিয়ে আমি সোমনাথের হাতটা শক্ত করে ধরলাম। এসব শুধু আমিই অনুভব করছি, সোমনাথ নয়।
জানি না রে, কী হচ্ছে আমার সাথে, কেন হচ্ছে! আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি!”
এত্ত বড়ো এস এম এসটা পড়া শেষ করতেই মনিদিদি আবার বলতে শুরু করল, “আমি প্রিয়াকে ফোন করে আরও অনেক কথা জানতে পারি, ও বলে ও নাকি জানে আমি কী কী বলবো, একই ঘটনা নাকি বারে বারে হচ্ছে,… শুধু ওর জন্য! অথচ আমি ওকে ঐদিন একবারই ফোন করেছিলাম!”
“তোর বন্ধুর স্ক্রু ঢিলা হয়ে গেছে, এতে ভয়ের কিছু নেই” বাবাইদা বলল।
বাবাইদার কথায় মনিদিদি বলল, “এতটুকু শুনে আমিও তাই ভেবেছিলাম, তাই ওর হাসবেন্ড মানে সোমনাথকে ফোন করে আমার সাথে যা কথা হয়েছে সবই বললাম, শুনে উনিও বললেন, প্রিয়া নাকি এই কদিন খুবই অন্যমনস্ক থাকে, নানান রকম অদ্ভুত কথা বলে”।
“কেমন, কেমন” তুতাই বলল,
“ওরা একদিন শিলং শহরের এক চার্চে গিয়েছিল, প্রিয়া আর সোমনাথ একদম শেষের দিকে বসে ছিল। চার্চে প্রার্থনা চলছিল। হঠাৎ প্রিয়া সোমনাথের পাশ থেকে উঠে গিয়ে কোথা থেকে এক বালতি জল নিয়ে এলো, আর তখনই দেখে, এক বাচ্ছা মেয়ের ফ্রকে বাতির আগুন থেকে আগুন লেগেছে সে ভয়ে ছুটে আসছে, আর প্রিয়া তখনই ওই জল ছুঁড়ে নিভিয়ে দেয়। সবাই সেদিন প্রিয়াকে সাক্ষাত ঈশ্বরের দূত মেনে ভূয়সী প্রশংসা করেছে, বিশেষ করে ওই মেয়েটির বাবা মা। এবার, প্রশ্ন হলো যে, প্রিয়া জানল কি করে যে ওটা হবে?
আমি প্রিয়ার সাথে কথা বলতে, ও আমায় বলে, ঠিক আগেই ও ওই মুহূর্তটা কাটিয়েছে, ওটা ও , না করলে মেয়েটার ডান পা নাকি মারাত্বক দগ্ধ হয়ে যেত!
প্রিয়ার এটা বিশেষ কোনও ক্ষমতা নাকি সবটাই ওর মনের মাঝে হওয়া জটিল কোনও ভাবনার বহিঃপ্রকাশ! দাঁড়া, তোদের আরও একটা এস এম এস দেখাই,………”
মনিদিদি আবার থামল, বাইরে সমানে বৃষ্টি হচ্ছে। কাঁচের জানালায় বৃষ্টির ফোঁটা টপ টপ করে লাগছে। এরকম নিশ্চুপ বৃষ্টি আমাদের হাওড়াতে হয়না, যেন কেউ নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে। মনের মাঝে মনিদিদির গল্পটা অনেক দাপাদাপি করছে, কোনও ঘটনা ঘটার সময় অথবা ঘটে যাওয়ার পরে মনে হয়না যে ওটা যেন আগেও ঘটেছে, আগেই দেখেছি, হয়না কি আমাদের সাথে?? দিদির বন্ধু প্রিয়ার মতো আমাদের সাথে এগুলো হয়না?
এতক্ষনে বাতিগুলো থেকে মোম ঝরে বাতির গায়েই এক লম্বা স্তুপ সৃষ্টি করছে, অথচ একটু আগেই যেন কিছু ছিল না। আচ্ছা, এইমাত্র দেখলাম যেন বাতিটা নিভে আসছে আর ……
ভাবনার জালে জড়িয়ে যেতে মনিদিদির স্বর আবার বাস্তবে ফিরিয়ে আনল।
“এই এস এম এস টা দেখ, ঋতু” মনিদিদি আমাকে মোবাইলটা দিল। ওতে দেখলাম,
“জানিস, এখন এত বেশি হচ্ছে একই ঘটনার ফিরে ফিরে আসা, আমি আর পারছি না রে, মাঝে মাঝে মাথাটা যেন যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যায় এসব ভেবে ভেবে। মাথার চুল ঠিক করে নিয়ে, আয়নার সামনে থেকে সরে এসেও যেন আবার আমি আমাকে দেখতে পাই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কোনটা যে সত্যই হচ্ছে, কোনটা যে আমি আর কোনটা নয়, চার পাঁচ বার ঘটে যাওয়ার পরও দেখি সকলের জন্য সেটা মাত্র একবারই হচ্ছে। সময় যেন শুধু আমার সাথেই এই লুকোচুরি খেলছে, এই লুকোচুরিতে আমি ক্লান্ত।
আচ্ছা মনি, তোর কখনও এরকম হয়েছে যে , হয়ত তুই কারোর সাথে কথা বলছিস কিন্তু বুঝতে পারছিস যেন সে কি বলবে, যেন তুই আগেও শুনেছিস! অথবা, খাওয়ার শেষ করেও দেখছিস তোর খাওয়া হয়নি, টেবিল ভর্তি খাবার একইভাবে পড়ে আছে। কী রে হয়েছে?”
এই এস এম এস টা পড়ে দিদির মোবাইলটা ফিরিয়ে দিয়ে বাতিটার দিকে চেয়ে এবার সত্যই যেন মনে হল, এই লেখাগুলো আগেও পড়েছি।
বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে উঠল, বৃষ্টি থেমে এল, মামিমা আমাদের খেতে ডাকল, সবই যেন আগেও ঘটেছে, আবার ঘটল।
বেশি ভাবলে কি সময় পেন্ডুলামের মতো দোলে?
আপনাদের সাথেও কি এরকম হয়? আমার এই লেখা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে না? এটা আগেও পড়েছেন? কি হচ্ছে না?
সমাপ্ত
Agamoni Pathak
বছর কুড়ি পরে - এস সি মন্ডল
বছর কুড়ি পরে,
এস সি মন্ডল
| ১।
সন্ধ্যা আটটা, লেকের পাড় ধরে হাঁটছেন শওকত সাহেব। বিকেল থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে করে চোখের ভারি ফ্রেমের চশমার কাচ ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে বারবার। তাই মাঝে মধ্যে থেমে গেঞ্জির কোনা দিয়ে চশমার কাচটা মুছে নিয়ে আবার হাঁটছেন তিনি। বিগত কুড়ি বছর ধরে এটাই তার রুটিন। ঘড়ি ধরে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় রাতের খাবারটা খেয়ে নেন, তারপর একঘন্টা লেকের পাড় ধরে হেঁটে বাড়ি ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে ঠিক নয়টার সময় ঘুমিয়ে পড়েন।
বাড়িতে লোক বলতে তিনি একাই, স্ত্রী গত হয়েছেন প্রায় কুড়ি বছর আগে, বাচ্চা কাচ্চাও নেই। চাইলে অবশ্য আবার বিয়ে করতে পারতেন, কিন্তু কুড়ি বছর আগে এরকমই এক সন্ধ্যায় লেকের পাড়ে ঘটা ঘটনাটা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। সেই থেকে একটা দিনের জন্যেও হাঁটা বাদ দেননি।
লেকের চারপাশে এক চক্কর দিয়ে যখন টেনিস কোর্টের কাছাকাছি এসেছেন, তখন শওকত সাহেব দেখলেন ছাতা মাথায় কেউ একজন উল্টো দিক থেকে হেঁটে আসছে। কাছাকাছি আসতে লোকটা থেমে দাঁড়াল, তারপর চিকন মিহি কণ্ঠে বলল-
“আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।”
কণ্ঠ শুনে চিনতে পারলেন শওকত সাহেব, লোকটার নাম মজিদ। একসময় তারই কলেজের ছাত্র ছিল। ফচকে ধরনের ছাত্র, কলেজ আর পাশ করেনি, এখন একটা ফার্মেসির দোকান দিয়েছে লেকের দক্ষিনে ক্লিনিকের পাশে।
“ওয়ালাইকুম আসসালাম” - জবাব দিলেন শওকত সাহেব। তারপর জিজ্ঞেস করলেন-
“কেমন আছো মজিদ?”
“আলহামদুলিল্লাহ স্যার, আপনাদের দোয়ায় ভালোই আছি। খুব খুশি লাগতেছে স্যার, যে আপনি আমাকে চিনতে পারছেন।”
“চিনতে পারব না কেন? আগের সপ্তাহেও তো তোমার দোকানে গেলাম” - অবাক হয়ে বললেন শওকত সাহেব।
একটু মিনমিন করে মজিদ বলল-
“না মানে স্যার, আপনাকে নিয়ে চিন্তায় থাকি, আপনিই আমাদের আসল শওকত স্যার কিনা সেই চিন্তা।”
কথা শেষ হতে মজিদের মিহি খিকখিক হাসির শব্দ শোনা গেল। মেজাজটা বিগড়ে গেল শওকত সাহেবের, কিছু না বলে তিনি আবার সামনের দিকে হাঁটা ধরলেন। এমন বেয়াড়া প্রশ্ন অবশ্য তার জন্য নতুন কিছু নয়, বহু বছর ধরেই এই জ্বালাতন সহ্য করে আসছেন তিনি। কুড়ি বছর আগে সেই ঘটনাটা ঘটার পর কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক তারাপদ বাবুকে ঘটনাটা বলেছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন তারাপদ বাবু হয়ত ঘটনাটার একটা ব্যখা দিতে পারবেন, কিন্তু তারাপদ বাবু ব্যাখা তো দিতে পারলেনই না, উল্টো কলেজময় জানাজানি হয়ে গেল সব।
| ২।
শওকত সাহেব নিজে ছিলেন বাংলার ছাত্র, পড়াশোনার পাট চুকিয়ে সরাসরি মফস্বলের এই কলেজে বাংলার লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। তখন অবশ্য কলেজ এত বড় ছিল না, একটা মাত্র পাকা দোতালা বিল্ডিং আর দুটো টিনের ঘর ছিল। ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যাও ছিল হাতে গোনা। তারপর বছরখানেক কেটে যেতে পরিবারের পছন্দে বিয়ে করলেন মালাকে।
আহা, কি সুন্দর ছবির মত ছিল সেই দিনগুলি, সারাদিন কলেজে পড়িয়ে বাসায় ফিরতেন, তারপর সন্ধ্যায় মালাকে নিয়ে হাঁটতে বের হতেন এই লেকের পাড়ে। মালা ছিল তার স্ত্রীর ডাকনাম, তিনি অবশ্য ভালবেসে শঙ্খমালা বলে ডাকতেন। মালার পাশে হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মধ্যেই আনমনা হয়ে পড়তেন শওকত সাহেব, পুরো পৃথিবীটাকে কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হত। রাতের বেলায় বাড়ির ছাদে উঠে পাটি বিছিয়ে পাশাপাশি শুয়ে থাকতেন দুজন, মালার আঙ্গুলগুলো খেলা করে যেত তার মাথার চুলে। তখন মালাকে জীবনানন্দের কবিতা শোনাতেন তিনি
“যেদিন আমি পৃথিবীর থেকে চলে যাব, হে শঙ্খমালা-
অপরিসীম নক্ষত্র তুমি বিছিয়ে রেখো আকাশে...”
কিন্তু স্বপ্নের মত দিনগুলো বেশিদিন স্থায়ী হলনা, বিয়ের বছর দুয়েকের মাথায় এক জুন মাসে মাত্র পাঁচদিনের জ্বরে ভুগে মালা চলে গেল তাকে ছেড়ে। মালাকে হারিয়ে তিনি পড়ে গেলেন এক নিদারুন হতাশার মধ্যে। বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই মরে যেতে শুরু করেছিল একসময়ে। হয়তো মরেও যেতেন যদিনা কুড়ি বছর আগে লেকের ধারের সেই ঘটনাটা ঘটত।
| ৩।
মালার মৃত্যুর ছয়মাস পর ডাক্তারের পরামর্শেই সন্ধ্যায় লেকের পাড়ে আবার হাঁটা শুরু করেন তিনি। ডাক্তার বলেছিল এতে করে শারীরিক পরিশ্রম হবে কিছুটা, রাতে ভালো ঘুম হবে। সেই মত মাস দুয়েক হাঁটাহাঁটি করলেন, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হলনা। বরং লেকের পাড়ে হাঁটতে এলেই মালার কথা বেশি করে মনে পড়তে লাগল।
কুড়ি বছর আগের সেই সন্ধ্যায় লেকের ধারে হাঁটতে হাঁটতে মালার কথাই ভাবছিলেন। আকাশে ভরা পূর্নিমার চাঁদ, লেকের জল ছুয়ে বয়ে চলা মৃদু বাতাস সব কিছু যেন আরো প্রকট করে তুলেছিল মালার অভাবটাকে। বারবার শুধু মনে পড়ছিল জীবনানন্দের কবিতার কথা, সেই যে “আট বছর আগে” কবিতার লোকটা, সেও তো এমনি এক পূর্নিমার রাতে একগাছা দড়ি হাতে করে গিয়েছিল অশ্বত্থের কাছে। সেদিনই তিনি ঠিক করলেন কলেজের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবেন। নাহলে হয়তো মালার স্মৃতি ভোলা কোনদিনই সম্ভব হবে না তারপক্ষে।
তারপর এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে টেনিস কোর্টের কাছে আসতেই আচমকা যেন একটা গর্তের ভিতরে পা দিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন রাস্তার উপরে। চোখে খানিকটা অন্ধকার দেখলেন প্রথমটায়, এরপর সম্বিত ফিরে পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। রাস্তায় তাকিয়ে গর্তটা খোজার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তেমন কিছু চোখে পড়ল না। পড়ার সময় ধাক্কা সামলাতে গিয়ে বাম হাতের কনুইটা একটু ছড়ে গিয়েছিল। সেটা তেমন কিছু না হলেও ঝামেলা হল চোখ থেকে খুলে পড়ে চশমার কাঁচটা ভেঙে যাওয়াতে, তাই সেদিনের মত হাঁটা শেষ করে বাড়ির দিকে চললেন তিনি।
বাড়ির কাছাকাছি এসে অবাক হয়ে শওকত সাহেব দেখলেন ঘরের ভিতরে আলো জ্বলছে। তিনি একা মানুষ, বাড়ি থেকে বের হবার আগে সবকটা আলো নিভিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। তাহলে এখন আলো জ্বালালো কে? নিজেরই ভুল হয়েছে মনে করে দরজার সামনে এসে তালা খোলার জন্য চাবিটা হাতে নিতেই দারুন চমকে উথলেন তিনি। দরজায় তালা দেয়া নেই, কান পেতে শুনে মনে হল ঘরের ভিতরে হাঁটাচলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। যাহোক মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি নিয়ে দরজার কড়া নাড়লেন তিনি, আর তারপরই ঘটল তার জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা।
দরজাটা খুলে গেল। অবাক চোখে শওকত সাহেব দেখলেন হাসিমুখে মালা দাড়িয়ে আছে। তাকে দেখে মালাও অবাক, বলল-
“আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে?”
উত্তর দিতে পারলেন না তিনি, ঘরের ভিতরে ঢুকবেন কিনা সেটা নিয়েও দ্বিধায় পড়ে গেলেন। এমন সময় ঘরের ভিতর থেকে ছোট্ট একটা মেয়ে দৌড়ে এসে আধো আধো স্বরে ‘বাবা বাবা’ বলে হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। মালা এসে তাগাদা দিয়ে বলল -
“দাঁড়িয়ে রইলে কেন, হাতমুখ ধুয়ে এসো”
বলতে বলতেই মালার চোখ পড়ল শওকত সাহেবের ভাঙ্গা চশমা আর ছড়ে যাওয়া হাতের উপরে। ব্যস্ত হয়ে উঠল মালা, উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করল-
“কি হয়েছে তোমার ?”
এবারে উত্তর না দিয়ে পারলেন না তিনি, আমতা আমতা করে বললেন-
“টেনিস কোর্টের ধারে, পড়ে গিয়েছিলাম”
মালা নিজের হাতে শওকত সাহেবের হাতের ক্ষতটা পরীক্ষা করে দেখল একবার, তারপর বলল-
“তুমি চুপচাপ বোসো, আমি স্যাভলন নিয়ে আসি”
মালা চলে গেলে বসার ঘরে সোফার উপরে বসলেন শওকত সাহেব। বসার ঘরটাও কেমন বদলে গেছে, কাঠের টেবিল চেয়ারগুলো নেই, বদলে একটা সোফা আর কাচের টি-টেবিল দেখা যাচ্ছে। টিভিটা ঠিকই আছে, তবে টিভির উপরে সেলাই করা ফুলতোলা পর্দাটা যেন নতুন দেখছেন। ছোট্ট মেয়েটা তার পাশের সোফায় এসে বসেছিল, তার হাতে একটা আধখাওয়া আপেল, সে সেই আপেলটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল-
“বাবা খাও...খাও...”
শওকত সাহেবের বিস্ময় কাটছিল না। এসবই কি তার মনের ভুল? অথচ মালা বেঁচে থাকলে হয়তো এসব সত্যি হয়েই আসত তার জীবনে। তিনি হাত বাড়িয়ে আপেলটা নিলেন, তারপর মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলেন-
“মাগো, তোমার নাম কি?”
খিলখিল করে হেসে মেয়েটা বলল-
“ইরাবতী”
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন শওকত সাহেব, এমন সময় তার মাথাটা কেমন ঘুরে উঠল, চোখের সামনে যেন একটা কালো পর্দা নেমে এল।
| ৪।
চোখের সামনের অন্ধকারটা যখন কেটে গেল তখন শওকত সাহেব দেখলেন তিনি পড়ে আছেন সেই রাস্তার উপরে। প্রথমটায় ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারলেন না ঠিকমত। কোথায় গেল মালা, কোথায় গেল ইরাবতী? নাকি রাস্তায় পড়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন, তখনই কল্পনায় দেখেছেন এসব? কিন্তু তার চিন্তায় বাদ সাধল হাতের মুঠোয় ধরা আধখাওয়া সেই আপেলটা। সবই যদি কল্পনা হয়, তবে এই আধখাওয়া আপেলটা এল কোথা থেকে?
এই ঘটনার পর কেমন যেন হয়ে গেলেন শওকত সাহেব। সেই আধখাওয়া আপেলটা হাতে নিয়ে বসে থাকতেন সারাদিন। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পেতেন মালার মুখটা, সাথে করে ইরাবতীর মুখটাও। মেয়েটা দেখতে একদম তার মায়ের মত হয়েছে। খুব ইচ্ছে হত যদি আরেকবার দেখতে পেতেন মেয়েটাকে, একবার কোলে নিতে পারতেন। কাজকর্ম সব শিকেয় উঠল, কলেজের চাকরিটাও প্রায় যায় যায় অবস্থা হল। হয়তো চলেই যেত, যদিনা একদিন কলেজের লাইব্রেরিতে পত্রিকা পড়তে গিয়ে সেই লেখাটা চোখে না পড়ত।
লেখাটা পড়তে গিয়েই তিনি প্রথম জানলেন, এই মহাবিশ্বের মত হুবহু এমন আরো অসংখ্য মহাবিশ্ব থাকার নাকি একটা সম্ভাবনা আছে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা, যার নাম তারা দিয়েছেন “সমান্তরাল মহাবিশ্ব”। এইসব মহাবিশ্বের একটায় যেটা অবাস্তব, সমান্তরাল অন্য মহাবিশ্বে সেটাই নাকি হতে পারে বাস্তব। শওকত সাহেবের মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল যে, প্রকৃতির খেয়ালবশে হয়তো কিছু সময়ের জন্য এমনই এক সমান্তরাল বিশ্বে চলে গিয়েছিলেন তিনি। যে বিশ্বে বেঁচে আছে মালা, আছে কন্যা ইরাবতী। একটা আশা জন্মাল তার মনে, কে জানে- প্রকৃতি যদি আরেকবার ভুল করে! আরেকবার যদি তাকে নিয়ে যায় সেই মহাবিশ্বে। যদিও এই কুড়ি বছরে সেটা হয়নি।
একটা সাইকেলের শব্দ শুনে চিন্তার সুতা কেটে বাস্তবে ফিরে আসেন শওকত সাহেব। মজিদের সাথে কথা বলে মনটা খারাপ হয়েছে বেশ, সেই হতাশটা আবার যেন ফিরে আসছে মনের মধ্যে। আসলেই তো, কতগুলো বছর চলে গেছে। এত বছরেও যখন হলোনা, তবে আর কি হবে? বৃষ্টির ছাঁটে আবারো চশমাটা ঘোলা হয়ে গিয়েছিল, একটু থেমে চশমাটা মুছে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন তিনি।
কিন্তু শওকত সাহেবের ভাগ্যটাই মন্দ, বাড়ির গলিতে ঢুকতেই বিদ্যুৎ চলে গেল। ল্যাম্পপোস্টের আলো না থাকায় বেশ সমস্যায় পড়ে গেলেন তিনি। দুপুরের বৃষ্টিতে রাস্তার খানাখন্দে জল জমেছে, ওদিকে সাথে অন্যকোন আলোও নেই। যাহোক অন্ধকারটা চোখে সয়ে এলে সামনে পা বাড়ালেন তিনি, আর তাতেই ঘটল বিপত্তি, রাস্তার উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। জমে থাকা জলে জামাকাপড় ভিজে গেল, চোখ থেকে খুলে পড়ে হারিয়ে গেল চশমাটা।
কোনরকমে উঠে দাঁড়িয়ে পথ হাতড়ে বাড়ি ফিরে এলেন তিনি। কিন্তু ঝামেলাটা হল তালা খুলতে গিয়ে। দরজায় যে তালা নেই ! তবে কি?
নিশ্বাস চেপে রেখে দরজার কড়া নাড়লেন শওকত সাহেব। ঘরের ভিতরে একটা নারী কণ্ঠ শোনা গেল-
“ইরা, এই ইরা…দরজাটা খোল, দেখ তোর বাবা এসেছে কিনা?”
দরজা খুলতেই দেখা গেল মোমবাতি হাতে পরীর মত সুন্দর একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, শওকত সাহেবকে দেখে চমকে উঠে মেয়েটা বলল-
“বাবা, একি অবস্থা তোমার?”
ইরাবতীর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না শওকত সাহেব, তার দুচোখে ততক্ষনে অশ্রুর বাঁধ ভেঙ্গেছে।
(সমাপ্ত)
S C Mondal