কল্পবিজ্ঞান লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
কল্পবিজ্ঞান লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

বরুণ সরকারের শেষ লেখা - রণি বসু

 

বরুণ সরকারের শেষ লেখা
রণি বসু
 

 


  রাতে ছাদে শুয়ে ঘুমোনো আমার বরাবরের অভ্যেস। এটা কেবল গ্রীষ্মের গরমের জন্যই নয়, এর একটা অমোঘ আকর্ষণ আছে আমার কাছে। সেটা হল আকাশের আকর্ষণ। দিনের আকাশ নয়, রাতের আকাশ। যে আকাশ নির্মেঘ, তারাভরা। তাই বৃষ্টির দিন এমনিতেও আমি ঘরেই ঘুমোই, কারণ সেদিনগুলোয় তারাদের দেখা যায় না।

  কীভাবে এই টান তৈরি হল তা আমি নিজেই বুঝতে পারি না। তবে রাতের খোলা আকাশের নীচে শুয়ে শরীরে-মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করি। চোখ খুলে বা চোখ বুজে। এই শান্তি আমি আর কোথাও কিছুর মধ্যেই খুঁজে পাইনি।

  আমার জীবনের একাকিত্বও ঘুচে যায় তারাভরা আকাশের সান্নিধ্যে। ঘুমের মধ্যে মনে হয় অসংখ্য কণ্ঠস্বর আমাকে একটানা কিছু বলে চলেছে। সেসব আমি বুঝতে পারি না। ওদের ভাষাটা আমার পরিচিত নয়, কিন্তু তাও আমার অল্প চেনা চেনা লাগে। তবে কথার অস্পষ্টতার জন্যই বোধগম্য হয় না তা। যেন মনে হয় শতকোটি আলোকবর্ষ দূরের কেউ ডাক দিচ্ছে আমাকে, আমাকে বলতে চাইছে কিছু। তারপরেই মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে ঘুমমাখা আবছা দৃষ্টিতে দেখতে পাই আকাশের সেই তারাগুলো, শুধু তারা। আর কেউ কোথাও নেই।

  আমি আপ্রাণ চেষ্টা করি ওদের কথাগুলো উপলব্ধি করার। কারণ ওরা আমায় ডাকছে বহুদিন, বহুবছর ধরে, যবে থেকে আমি ছাদে ঘুমোনো শুরু করেছি। কিন্তু আমি সে ডাকে সাড়া দিতে পারছি না, কারণ সাড়া দিতে গেলেই ঘুম ভেঙে যায়। তাই আজকাল আমার মনটা ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছে। কোনো কাজেই মন বসাতে পারি না। ওই দুর্বোধ্য ডাক সারা দিনরাত আমার মাথার ভিতরে প্রতিধ্বনিত হয় যেন। পাগল পাগল লাগে।

  তবে এই অস্থিরতাই যেন শাপে বর হল। আমি ভাবতে পারিনি যে মাথার ভিতর এই চঞ্চল ঢেউগুলোই অবশেষে একদিন এক প্রবল ধাক্কায় খুলে দেবে আমার মনের দরজা। হ্যাঁ, অবশেষে আমি শুনতে পেলাম সেই দূরাগত বার্তা। শুধু শোনা নয়, কীভাবে যেন অনুধাবন করতেও পারলাম। ওরা আমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, যদিও এখনও আমি ওদের দেখতে পাচ্ছি না। এ এক অশরীরী আহ্বান। তবে এই আহ্বানে এক অদ্ভূত মায়ার টান আছে। ওরা যেন আমার সাত জন্মের আত্মীয়। আমি চাইলেও উপেক্ষা করতে পারছিলাম না ওই ডাকের আকর্ষণ।

  ওরা বলল, 'অনেকদিন অপেক্ষা করিয়েছ। আজ তুমি প্রস্তুত?'

  আমি ঘোর লাগা মস্তিষ্কে মাথা নাড়াই। হ্যাঁ, আমি প্রস্তুত। আমি আর আমার মধ্যে নেই। ঘুমের মধ্যেও এ যেন এক অন্যরকম ঘুমের নেশায় আমি আচ্ছন্ন।

  তবে একসাথে দু'টো ঘুম বোধহয় ঘুমোনো যায় না। কারণ এরপরেই আমার পার্থিব ঘুম ভেঙে গেল আচমকাই। কিন্তু থেকে গেল সেই অপার্থিব মহাজাগতিক ঘোর। প্রথমে ঠাহর করতে পারলাম না কী হচ্ছে। সোজা হয়ে শুয়েছিলাম, চোখ খুলতেই দেখলাম সেই রহস্যময় কালো রাক্ষুসে আকাশ, কিন্তু সেই রাক্ষসের ভয় ম্লান করে দিয়েছে ছোটোবড়ো সাদা আলোকবিন্দুগুলো। আমার হাত-পা যেন অবশ। হতাশ মনে ভাবলাম, আজকেও ঘুমটা ভেঙে গেল মোক্ষম সময়ে, পৌঁছাতে পারলাম না ওদের কাছে। আজও ওরা অধরাই থেকে গেল।

  কিন্তু না। আমি পিঠের নীচে কোনো কঠিন মেঝে টের পেলাম না। নরম হাওয়ার বিছানা। আর আমার চারিদিকে নেই ছাদের চার দেওয়ালের চৌহদ্দি। আমি উঠছি, আরও উপর দিকে উঠছি। ছাদ থেকে শূন্য, শূন্য থেকে মহাশূন্যে। কালো আকাশ একইরকম আছে, কেবল উজ্জ্বল আলোকবিন্দুগুলো বড় হতে হতে আলোকপিন্ডের রূপ ধারণ করছে ক্রমশ। তবে কি আজই আমার এই দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার অবসান? আজই কি আমি জানতে পারব এই আকাশ, এই তারার দেশ আমাকে টানে কেন? কী সম্পর্ক আমার ওদের সাথে?

  জলতেষ্টা পাচ্ছিল খুব। কিন্তু আমল দিলাম না। মন বলছিল এক চিরশান্তির দেশে আমি পাড়ি দিয়েছি। সেখানে একবার পৌঁছে যেতে পারলে এরকম ছোটোখাটো অস্বাচ্ছন্দ্য বা অস্বস্তির আর কোনো জায়গা থাকবে না। আমি আবার চোখ বুজলাম। মনের ভিতর একটা অদ্ভুত পরিতৃপ্তি কাজ করছিল। আজ আমার মুক্তি। কে বলে মৃত্যুর আগে মুক্তি নেই? আমি তো না মরেই উপভোগ করছি সেই মুক্তির আনন্দ। আর নেই রোজকার অফিস যাওয়া, বসের অকারণ ঝাড়, প্রতিবেশীর 'পাগলা' বলে ব্যঙ্গবিদ্রুপ শোনা কিংবা হাত পুড়িয়ে রান্না করে খাওয়া। আঃ, এই শান্তি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়!

  আরও কতক্ষণ এভাবে ভেসে ছিলাম জানি না, কারণ সময়ের হিসাব করিনি আর কেউই হাতঘড়ি পরে শোয় না। অনেকক্ষণ পরে চোখ খুললাম আবার, গায়ে গরম হলকা লাগায়। তারাগুলোর খুব কাছে এসে পড়েছি। সত্যি বলতে কী, ওদের হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূর থেকে যতটা নিরীহ মনে হত, এখন কিন্তু আর ততটা মনে হচ্ছে না। বরং ওই কালো আকাশ দানবের অসংখ্য জ্বলন্ত চোখের মতো লাগছে। আমার অল্প ভয় ভয় করছে যেন এবার। আমি কি আকাশের মায়াজালে জড়িয়ে নিজেকে বিপদে ফেললাম? সেই অদৃশ্য কণ্ঠস্বরগুলোই বা কানে আসছে না কেন আর?

  দেখলাম, আমি এগিয়ে যাচ্ছি একটা জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডের দিকে। নিজেকে থামাবার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম, পারলাম না। আমি যেন এক মহাজাগতিক গতি প্রাপ্ত হয়েছি। আমি আর আমার মধ্যে নেই! ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অবর্ণনীয় ভয়ে চোখ বুজে ফেলি আমি।

  আর ঠিক তখনই আবার শুনতে পাই ওদের কণ্ঠস্বর। আশ্চর্য, এবার অনেক কাছে! গমগম করছে যেন। ওরা সমস্বরে বলে উঠল, 'এসেই যখন পড়েছ, তখন এত ভয় কীসের? তুমি তো জানো - আমরাই তোমার বন্ধু, তোমার আপনজন। ভয় পেও না। চোখ খুলে ওই দেখো, তোমার মা, তোমার বাবা। তোমার সামনেই। তুমি দেখতে চাও না ওদের?'

  আমার ছোটোবেলাটা কেটেছে চাইল্ড কেয়ার হোমে। পরে জেনেছিলাম, ওঁরা আমাকে যেদিন কুড়িয়ে পেয়েছিলেন তার আগের দিনই কাছাকাছি একটা জলাশয়ে উল্কাপাত হয়েছিল। সেই জলাশয়ের ধার থেকেই আমাকে পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু মা-বাবা? তাঁদের সন্ধান আমি কোনোদিন পাইনি!

  আজ সেই মা-বাবা আমার সামনে? আস্তে আস্তে চোখ মেলে চাইলাম। কিন্তু একী! এ তো দু'টো বিশাল তারা! একদম কাছে। ওগুলোর গরম হলকায় আমি পুড়ে যাচ্ছিলাম। ওহ্, অসহ্য!

  আমি আবার শোয়া অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলাম, ব্যর্থ হলাম। আমার শরীরটা যেন ক্রমশ কাঠকাঠ, জড় পদার্থের মতো হয়ে যাচ্ছে। ঘাড়টা কোনোমতে ঘুরিয়ে নীচের দিকে তাকালাম, মাথা ঘুরে গেল। চোখ বন্ধ করে ফেললাম আবার। এবার যা হবে সবই আমার নিয়তি।

  আর তখনই অনুভব করলাম, উত্তপ্ত অগ্নিপিণ্ডগুলো স্পর্শ করে ফেলেছে আমার শরীর। আআআআআ, অসহ্য উত্তাপে আমি পুড়ে যাচ্ছি, আর পারছি না! শুনতে পাচ্ছি চারদিকে প্রবল অট্টহাসি। সেই কণ্ঠস্বরগুলোর! যেন ওদের খুব আনন্দ! কিন্তু ওরা আসলে কারা? তারারা কি কথা বলে, হাসে? চামড়া পোড়ার যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকি আমি। মুক্তি পাওয়া সত্যিই সোজা নয়।

  তারপর একসময় মরে আসতে লাগল আমার শরীরের সমস্ত কষ্ট, অস্বস্তি। নিজেকে অনেক হালকা মনে হচ্ছে। ওদের হাসিও থেমে গেছে। এখন আবার সমস্বরে বলে উঠল ওরা, 'আর ভয় নেই। তুমি এখন আমাদেরই একজন। আমরাই তোমার হারানো পরিবার, আপন করে নাও আমাদের…..'

  আমার অগ্নিগোলকের ন্যায় দেহটায় এখন কোনো প্রাণের স্পন্দন টের পাওয়া যাবে না আর। কিন্তু আমি 'হ্যাঁ' বললাম, যেটা কেবল আমার স্বজাতি, আকাশের ওই লক্ষ লক্ষ তারারাই বুঝতে সক্ষম হবে।

       *        *        *        *        *        *        *       

  এ ডায়েরি আমার বন্ধু বরুণের। ও টুকটাক লেখালিখি করত আমার মান্থলি সায়েন্স-ফ্যান্টাসি ম্যাগাজিন 'সাইফাই'-তে। লিখত দারুণ, এমনিতে মানুষও ভালো। তবে এটা আমারও মনে হত যে ও সত্যিই কিছুটা 'পাগলা' ছিল।

  ক'সপ্তাহ আগে 'সাইফাই'-এর স্পেশাল ইস্যুর জন্য ওকে একটা লেখা দিতে বলেছিলাম। সে লেখা আর হাতে পাইনি, কারণ তার আগেই ও বাড়ি থেকে বেমালুম উধাও হয়ে গেছিল।

  কিন্তু আজ সকালে অফিসে এসে আমার টেবিলে দেখতে পেলাম কালো ডায়রিটা। কোথা থেকে এল, কে রাখল, কেউই কিছু বলতে পারল না। খুলে দেখলাম, ডায়েরির প্রথম পাতায় নাম লেখা বরুণ সরকার।

  একেবারে নতুন ডায়েরি। শুধু শুরুর তিনটে পাতায় আঁকাবাঁকা প্রায় পাঠের অযোগ্য হরফে এইটুকু লেখা। যদিও বরুণের হাতের লেখা অনেক সুন্দর ছিল।

  যদি বরুণের নিখোঁজ হওয়ার পিছনে এই 'গল্প'-ই সত্যি হয়, তাহলে সেসব কথা পরে এই ডায়েরিতে লিখল কে? অনেক ভেবেও কূলকিনারা করতে পারলাম না। একসময় ভাবা বন্ধ করে দিলাম, কারণ কিছু ঘটনার ব্যাখ্যা হয় না।

  তবে ঠিক করলাম স্পেশাল ইস্যুতে বরুণের গল্পের জায়গায় ওর নাম দিয়ে ডায়রির এই তিনটে পৃষ্ঠাই ছেপে দেবো। আশা করি পাঠক ভালোই খাবে। গল্পের একটা নামও ঠিক করে ফেলেছি - 'তারা'ই আমার আত্মীয়। মন্দ নয় - তাই না?

[সমাপ্ত]
 অলঙ্করণ :-  প্রিয়াঙ্কা সরকার

 

নিরুদ্দিষ্ট যাত্রী - শেলী ভট্টাচার্য



নিরুদ্দিষ্ট যাত্রী 
শেলী ভট্টাচার্য 
 

 

ফোনের শব্দে আচমকা ঘুম ভেঙ্গে গেল নির্বাণের। ভুরু কুঁচকে চোখ মেলে দেখল, বেডরুমের বাঁদিকের জানলা দিয়ে হাল্কা নরম আলোর রেখা উঁকি দিচ্ছে। এত ভোরে কার তাড়া পড়ল যে ফোন করতে হল। ভাবনার মাঝেই ফোনের রিং বন্ধ হয়ে গেল। ছেড়ে যাওয়া ঘুমটা আবার জড়াজড়ি করার উপক্রম করতেই, চোখ মেলে তাকাল নির্বাণ। ফোনটা আবার বাজছে। বিছানা ছেড়ে টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ও দেখল ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠছে 'ডক্টর দীপঙ্কর ডেলহি কলিং ...।'

একভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মনে করার চেষ্টা করল নির্বাণ। হঠাৎ করেই ওর মনে পড়ল তখন, গত বছর দিল্লিতে একটা সেমিনারে গিয়ে আলাপ হয়েছিল ভদ্রলোকের সঙ্গে। ধীরে ধীরে মানস চোখে ভেসে উঠল ভদ্রলোকের চেহারাটা। অ্যাভারেজ হাইট, সৌম্য মুখাবয়ব, উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি আর চিবুকে ঘন খাঁজ। টাইম ট্রাভেলের ফিউচার ভিশনের উপরে একটা সেমিনার হয়েছিল গতবছর দিল্লিতে। কল্পনা চাওলার স্মৃতির উদ্দেশে যে দুটো স্পেস রিসার্চ স্টেশন কুরুক্ষেত্রের আশপাশে গড়ে উঠেছিল, তার একটাতে রিসার্চের কাজ করে নির্বাণ। সেখানকার প্রতিনিধি হিসাবে তাই ও গিয়েছিল সেমিনারটাতে। ওখানেই বাঙালী প্রবাসী ডাক্তার দীপঙ্কর মাইতির সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিল। ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলে ও বুঝেছিল, বেশ অন্যরকমের মানুষ ওঁ। 

নির্বাণের 'হ্যালো' বলার আগেই ওদিক থেকে কাঁপতে থাকা কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
"সরি, সরি মিস্টার বোস। আমি বড্ড অসময়ে আপনাকে কল করে ফেলেছি। কিন্তু না করেও থাকতে পারলাম না।"
হুড়মুড়িয়ে কথাগুলো বললেন ভদ্রলোক।

ভদ্রলোকের গলার স্বর শুনে রীতিমতো ঘাবড়ে গেল নির্বাণ। উৎকণ্ঠায় প্রশ্ন করল ও 
"আপনি ঠিক আছেন তো? কোনও বিপদ টিপদ হয়নি তো?"

"বিপদ একটা হতে চলেছে! তবে আমার নয়, অন্য কারও। মানে, আমি বলতে চাইছি একজনের নয়, বেশ কয়েক জনের। ওরা ভ্যানিশ হয়ে যেতে পারে ভবিষ্যতে!"

'ভ্যানিশ' শব্দটা শুনে থমকে গেল নির্বাণ। মনে মনে ভাবল, সেদিন ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলে ওঁর মাথায় গোলমাল আছে বলে তো মনে হয়নি। আবার ওঁ ম্যাজিসিয়ানও নন। সাধারণ একজন ডাক্তার। দীপঙ্কর মাইতির মুখ থেকেই শুনেছিলেন, বাবার একমাত্র ছেলে তিনি। দেশ বাড়ির সব সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে দিল্লির অশোকনগরে চলে এসেছিলেন। সেখানে একটু ব্যাকওয়ার্ড জায়গায় নিজের একটা ছোটখাটো চ্যারিটেবল হাসপাতাল তৈরি করেছেন। বিয়ে থা করেননি। প্রকৃত অর্থেই সমাজের বন্ধু হয়ে অকাতরে সমাজ সেবা করে যাচ্ছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে ভদ্রলোক যে সমস্ত কথা বলছেন, তার খেই ধরতে পারছে না নির্বাণ। গলা কাঁচিয়ে প্রশ্ন করল ও
"কাদের বিপদ? আসলে আমি আপনার কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারছি না।"

"আমিই হয়তো আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারছি না।"
ভদ্রলোকের গলায় অসহায়তা।
নির্বাণ ফোনটা কান থেকে একটু নামিয়ে দেখল সাড়ে পাঁচটা বাজে। ভোরের এই সুমধুর ঘুমকাতুরে সময়ে ভদ্রলোক ওকে বোঝাতে বসলে সমস্যা হবে, মনে মনে ভাবছিল ও। 

"আপনার মনে আছে, আমি আপনাকে আমার ছোটবেলার একটা ঘটনা বলেছিলাম। সেই পুকুর থেকে মূর্তি পাওয়ার ব্যাপারটা।"

ঠিক মনে করতে পারল না নির্বাণ। পাছে কথা বেড়ে যায় তাই সংক্ষেপে 'হ্যাঁ হ্যাঁ' বলে দিল। হাই উঠছিল ওর।

হাই তোলার শব্দটা পেতেই ভদ্রলোক আরও বিনয়ী গলায় বললেন
"এই অসময়ে আমি বড্ড বিরক্ত করছি আপনাকে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি এই মুহূর্তে এমন একটা ঘটনার সাক্ষী হয়েছি যে, উত্তেজনায় আমার সারা শরীর কাঁপছে। বিষয়টা টাইম ট্রাভেলের সঙ্গে জড়িত বলেই আপনাকে কল করলাম।"

"টাইম ট্রাভেল!"
নির্বাণের গলায় আছড়ে পড়ল তুমুল বিস্ময়।

"হ্যাঁ, তবে এই মুহূর্তে আমার কাছে কোনও প্রমাণ নেই। আসলে বুঝতেই পারিনি ওই এগারো জন যে হঠাৎ করে উধাও হয়ে যাবে।"

ভদ্রলোকের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিল না নির্বাণ। ও কোনওরকমে নরম গলায় বলল
"বলছি কী, আমি আপনাকে আর দু-তিন ঘন্টা পরে কল করছি। আমি আসলে অনেকটা রাত করে ঘুমিয়েছিলাম তো ...!"

ভদ্রলোক প্রচণ্ড লজ্জায় বললেন
"আবার বলছি সরি, সরি। আপনি রেস্ট নিয়ে নিন। পরে কথা বলছি। আর দেরি হলেও বা কী!"

ওঁর কথার অর্থ বোঝার চেষ্টা না করে 'রাখছি' বলে ফোন কাটল নির্বাণ।

স্বভাবতই ঘুম ভাঙতে বেশ দেরি হয়ে গেল ওর। হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙ্গতেই দেখল প্রায় আটটা বাজে। ন'টায় সেন্টারে ঢুকতে হবে। তাড়াতাড়ি উঠে নিজের রুটিন মতো কাজ সারতে লাগল ও।  

রিসার্চ সেন্টারে পৌঁছে কিছুটা কাজ সামলানোর পরেই নির্বাণের মনে হল, দীপঙ্কর মাইতিকে একবার কল করা উচিত। ভদ্রলোক কী যে বলতে চাইছিলেন, ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। তখনই স্মৃতিতে একটু চাপ দিল নির্বাণ। কিছুক্ষণ একনাগাড়ে ভাবতেই ওর মনে পড়ে গেল, দীপঙ্কর মাইতি গল্প করে বলেছিলেন, ওঁর মামাবাড়ির কথা। সেখানে শান বাঁধানো পুকুর ঘাট ছিল। কিশোরবেলায় গরমের ছুটিতে সেখানে বেড়াতে যেতেন ওঁ। সেসময় নাকি একটা আজব ঘটনা ঘটেছিল। স্নান করতে নেমে ওঁর পায়ে ঠেকেছিল একটি ধাতব মূর্তি। ও দুহাতে উপরে তুলে দেখে প্রায় দু ফুট উচ্চতার গোবিন্ত মূর্তি চকচক করছে। দুধের সরের মতো তার সোনালী ছায়া ছড়িয়ে পড়ছে পুকুরের জলের উপরিভাগে। ঠিক তখনই কে যেন ওকে ডাকতে আসতেই, ওর হাত ফসকে মূর্তিটা ঝপ করে জলে পড়ে গিয়েছিল। তারপর হাজার খুঁজেও আর ওটার হদিস পায়নি কেউ তখন। দিদিমাকে জানাতে, জেলে ডেকে এনে জাল ফেলাও হয়েছিল পুকুরে। কিন্তু কিছুই পাওয়া যায়নি।
এর প্রায় আট নয় বছর পরে, সেই মূর্তির হদিস পাওয়া গিয়েছিল। দীপঙ্কর তখন কলকাতার এক হাসপাতালে ইন্টার্ণশিপ করছিল, ওঁর বড় মামা ফোন করে জানিয়েছিল ঘটনাটা। মামাবাড়ির পাড়ার কৃষ্ণ মন্দিরের অষ্টধাতুর চকচকে গোবিন্দ মূর্তি নাকি গয়না সহ উধাও হয়ে গিয়েছিল। তার কয়েক মাস পরে মামাবাড়ির পুকুরে জাল ফেলতেই সেই মূর্তি উঠে এসেছিল। গয়নাগুলো অবশ্য পাওয়া যায়নি। বড় মামার কাছে কথাগুলো শুনে বিশ্বাস হচ্ছিল না দীপঙ্করের। সেসময় ওঁর দিদিমাও বেঁচে ছিলেন না। তাই ওঁর আগের অভিজ্ঞতার সাক্ষী ছিল না কেউ। দিদিমা সেসময় জাল ফেলার ব্যবস্থা করলেও, ছোট নাতির এই অভিজ্ঞতার কথা কাউকে জানাননি। 

এই ঘটনাটা নির্বাণকে বলার পর দীপঙ্কর মাইতি সেদিন প্রশ্ন করেছিল, 
'আচ্ছা, বলুন তো সেই কিশোরবেলায় আমি টাইম ট্রাভেল করে আট নয় বছর এগিয়ে গিয়েছিলাম, নাকি মূর্তি সমেত ঘটনাটা সময়ের সিঁড়িতে পিছলে গিয়ে আমার কাছে এসে পৌঁছেছিল?'

নির্বাণ অনেকক্ষণ ভেবেচিন্তে বলেছিল,
'এক্ষেত্রে যেহেতু আপনার অস্তিত্বের প্রমাণ ক্রমপর্যায়ে বজায় রয়েছে, তাই ধরে নিতে হবে মূর্তিটাই কিছুক্ষণের জন্য সময়ের কূপে পড়ে গিয়েছিল।'

'এরকম অভিজ্ঞতা কি অনেকেরই হয়?'
প্রশ্ন করেছিলেন ডাক্তার দীপঙ্কর মাইতি। 

'আমি তো আগে কখনও কারও মুখে সেরকম শুনিনি। আচ্ছা, আর কী কী উপলব্ধি হয় আপনার?'
নির্বাণের ভদ্রলোককে বেশ আকর্ষণীয় লাগছিল।

উদাস চোখে চেয়ে ভদ্রলোক বলেছিলেন,
'মাঝেমধ্যেই নিজের ঘরের দেওয়ালের উপর অন্যরকম কিছু দেখি। যেমন ধরুন, দেওয়ালের কিছুটা অংশে তরঙ্গের মতো ঢেউ খেলে যাচ্ছে। কুয়াশার পাতলা পর্দার মতো সরে যাচ্ছে দেওয়ালের অংশটা। তার ওপারে উঁকি দিচ্ছে একটা অন্য জগৎ। ঝকঝকে সোনা ঝরা রোদ্দুরের মতো আলোর কণা ভেসে বেড়াচ্ছে সেখানে।'

'এসব আপনি আর কাউকে বলেছিলেন?'

নির্বাণের প্রশ্নের উত্তরে ভদ্রলোক বলেছিলেন 
'না। আমায় কেউ পাগল ভাবুক, তা চাইনি। আপনাকে এই জন্য বলছি, কারণ আপনি টাইম ট্রাভেলের বিষয়টা জানেন, বোঝেন।'

ফোনের রিংয়ের শব্দে চমক ভাঙ্গল নির্বাণের। দীপঙ্কর মাইতির ফোন। 

"আমি আপনাকে ক'টা ছবি পাঠিয়েছি। দেখুন তো, এই মডেলের গাড়ি চিনতে পারেন কিনা?"
নির্বাণ ভাবছিল, সরি বলে কথোপকথন শুরু করবে। কিন্তু ওর কিছু বলার আগেই ভদ্রলোক ছবি, গাড়ি ইত্যাদি নিয়ে কথা বললেন। নির্বাণের বোধ হল, কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছেন ভদ্রলোক।

দীপঙ্কর বাবুর কথায় তড়িঘড়ি ছবিগুলো খুলে নির্বাণ দেখল, রকেটের মতো ছুঁচলো বেশ লম্বা একটা গাড়ি। তিন জোড়া চাকা আছে তাতে। গাড়িটার উপরিভাগ উত্তল। নিচের কিছু অংশ ছাড়া প্রায় পুরো গাড়িটাই স্বচ্ছ। গাড়িটার নম্বর প্লেট ভেঙ্গে দুমরে মুচড়ে রয়েছে বলে, কোন জায়গার গাড়ি বোঝা যাচ্ছে না।

"কি, পারলেন?"
দীপঙ্কর মাইতি আবার প্রশ্ন করলেন।

"এরকম মডেল কোথাও দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না। তবে আমার এক কাসিন ব্রাদারের কাছে শুনেছিলাম এরকম গড়নের গাড়ি তৈরির পরিকল্পনা হচ্ছে মেট্রো সিটিতে।"

"এবার মন দিয়ে শুনুন। ওরা এগারো জন ছিল। আধুনিক পোষাক পরা, ক্লিন সেভড পুরুষ। বেশ কয়েকজনের দেহে বিভিন্ন আঘাতের চিহ্ন ছিল। তবে প্রায় সবারই মাথার সমস্যা হচ্ছিল। কারণ, কেউ নিজেদের নাম বলতে পারছিল না। আমি কাল রাতে ডিনার সেরে শুতে যাব, বুধুয়া নিজের কোয়াটারে চলে গিয়েছিল, ঠিক তখনই হাসপাতালের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল গাড়িটা। আমি শব্দ পেয়ে গেটের কাছে আসতেই ওরা হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়েছিল। আমায় দেখে ট্রিটমেন্ট করার অনুরোধ করেছিল পরিষ্কার ইংলিশে। এখন লকডাউনের প্রভাবে হাসপাতালে রোগীর তেমন ভিড় নেই। কয়েকজন মাত্র জেনেরাল ওয়ার্ডে ভর্তি আছে। তাই আমি ছাড়া বাকি দুজন ডাক্তার আর পাঁচ জন নার্স বিকেলেই বেরিয়ে যায় রোজ। আমার অল্প সামর্থ, তাই লোকবলও কম। সেই সময় ওদের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গিয়ে একাই সামলানোর চেষ্টা করছিলাম ওদের। বুধুয়াকে ডেকে নেওয়ার জন্য কল করলে দেখি ওর সুইচড অফ। 
ওদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিকরে এসব হল?
ওরা বলল একটা আন্ডার গ্রাউন্ড ট্যানেল নাকি ভূমিকম্পে ধ্বসে পড়েছিল। তাতে আরও অনেক গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকেই মারা গেছে। তবে ওরা প্রাণে বেঁচে গেছে। 
আমি ওদের প্রাইমারি চিকিৎসা করে শুতে গিয়েছিলাম। ভোর পাঁচটায় উঠে ওই ঘরে যেতেই শুনি, ওদের মধ্যে একজন বেশ রহস্যময় গলায় বলছে, আমাদের ফিরে যেতে হবে। ক্যালেন্ডার দেখিয়ে বলছিল সে, তেইশ বছর পিছিয়ে গেছি আমরা।
আমি চোখ বড় বড় করে শুনছিলাম সবটা। সারাটা শরীর থরথর করে কাঁপছিল আমার। একটু ধাতস্থ হতেই ভাবলাম, মোবাইল বের করে ওদের ছবি তুলি। পকেট হাতড়াতে গিয়ে সবে নজর সরিয়েছিলাম, অমনি সব ভ্যানিশ।"

নির্বাণ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বলল
"তাহলে এই গাড়ির ছবিটা ..."

"রাস্তার মোড়ের সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়েছে।"
ভদ্রলোক উত্তর দিলেন।

"আচ্ছা, আপনার কী মনে হয়, ওরাও মূর্তিটার মতো সময়ের স্রোতে পিছলে নিচে নেমে এসেছিল? এও কি সম্ভব?"
দীপঙ্কর মাইতির কাঁপা গলায় দ্বন্দ্ব।

"শুনেছিলাম, ইতালিতে ১৯১১ সালে জনেটি কোম্পানির একটি নতুন ট্রেন একশো চার জন যাত্রীসহ একটা ট্যানেলের মধ্য থেকে উবে গিয়েছিল। মানে ট্রেনটা ট্যানেলে ঢুকেছিল, কিন্তু আরেক দিক দিয়ে আর বের হয়নি। এই যাত্রীদের একজন আত্মীয় নাকি পরবর্তীতে ১৮৪০ সালের এক বিস্ময়কর রেকর্ড আবিষ্কার করেছিলেন। একটা হাসপাতালে হঠাৎই নাকি ১০৪ জন একসঙ্গে চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন। পরিচয় দিয়েছিলেন ইতালীয় এক ট্রেনের যাত্রী হিসাবে। তাদের মানসিক অবস্থাও স্থিতিশীল ছিল না।"

ঘটনাটা শোনার পরে দীপঙ্কর কিছুক্ষণ চুপ করেছিলেন। নির্বাণই বলেছিল
"আপনি এই নিয়ে আর বেশি ভাববেন না। সময় ব্যাপারটা ভীষণ গোলমেলে হিসাবে জট পাকিয়ে থাকে। সেই জটের মধ্যে চিন্তার ক্ষেত্রকে পেতে বসলে, সমস্যায় পড়বেন।"

ঠিক তখনই দীপঙ্করের সামনের মনিটরে একটা ওয়েব মেসেজ ঢুকল। সেখানে যা লেখা আছে তার বাংলায় অর্থ হল, গতকাল রাতে এক অভিনব সিগনাল ধরা পড়েছে। যা সময়ের কোনও এক লুপ থেকে অন্য লুপে যাওয়ার ইশারা বহন করছে।

(সমাপ্ত)
 অলঙ্করণ :-   রিচা দাস
 

 

সময়ের বিপদ আপদ - সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী


 

সময়ের বিপদ আপদ
সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
 


- “তুমি এখনও ঐ আ -পদ বলে বিচ্ছিরি জিনিসটা ইউজ করছ মা?”
আমার কিশোরী মেয়ে মুনিয়ার মুখে এই কথা শুনে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম।
আমরা সবাই যেসব জিনিসগুলো একেবারে স্বাভাবিক ভাবে দৈনন্দিন ব্যবহারের
তালিকায় রাখি, ওর সেগুলো ঠিক পছন্দ হয় না, এটা জানতাম। ও যত বড় হচ্ছে তত এইসব পছন্দ অপছন্দগুলো প্রকাশ করছে, স্বাভাবিক। এই স্বভাবটা ওর বাবার থেকেই পেয়েছে, বিপ্লব, আমার প্রাক্তন স্বামী। দুনিয়ার এই যন্ত্রসভ্যতায়
ক্রমাগত বদলে যাওয়াকে ঠিক মেনে নিতে পারত না। মুনিয়া যেটা বলছে, সেই আ-পদ অর্থাৎ আণবিক পদার্থ রূপান্তরক যন্ত্রটা এখন ঘরে ঘরে। একটা ভীষণ
কার্যকরী পোর্টেবল কোয়ান্টাম ম্যাটার ট্রান্সমিশন ডিভাইস। আমি সেই কথাই
বলে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করি, “দেখ মুনিয়া এগুলো তো এখন সবাই ব্যবহার করে।
এত সস্তা আর উপযোগী। আ-পদ ছাড়া চলে নাকি?”
- “কিন্তু মা, তুমি বুড়ি হয়ে যাচ্ছ! বুঝতে পার না? সব ঐটার জন্য।”
- “কী বলছিস এসব আবোলতাবোল?”
- “ঠিকই বলছি মা। আসলে তুমি তো অনেকদিন আয়না দেখো না, তাই হয়ত...”
- “আয়নার কী দরকার বল তো? ভি আই পি (ভার্চুয়াল ইমেজ প্রোভাইডার)
থাকতে ওসব অবসোলেট জিনিস কেউ রাখে এখন বাড়িতে? তুই যে কী করে এত
সেকেলে হলি!”
- “দরকার আছে মা। তোমার ঐ ছাতার মাথা ভি আই পি’তে সব মনগড়া
প্রতিবিম্ব দেখায়, চকচকে, ঝকঝকে, তুমি ঠিক যেমনটি দেখতে চাও, তাই
দেখায়। দাগ, ছোপ, কুঞ্চনের লেশ মুছে দিয়ে একশ’ শতাংশ নিখুঁত ছবি! বাস্তব
দেখলে যদি দুশ্চিন্তা করো, তাই।”
- “মুনিয়া! তোকে কে এসব জ্ঞান শেখায় বল তো? তুই কি ভালো হতে চাস না?
এসব উল্টোপাল্টা আচরণ করতে থাকলে তোকে কী করে আবার আমার কাছে
নিয়ে যাব বল তো? জানিসই তো ওয়েব লর্ডের নিয়ম কত কড়া!”
- “হুহ! রাখো তোমাদের ওয়েব লর্ড! একটা না মানুষ না যন্ত্র কিনা গোটা
দেশটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে আর তোমরা বুঝেও বুঝতে পারছ না কী সর্বনাশটা
ঘটছে তোমাদের অগোচরে!”

- “চুপ চুপ! মুনিয়া! প্লিজ এসব আর বলিস না। এই ডিটেনশন চেম্বার থেকেও
তাহলে হয়ত তোকে অন্য জায়গায় ট্রান্সফার করে দেবে। তোর বাবার জেদের
পরিণতি কী হয়েছিল মনে নেই?” আঁতকে উঠি মেয়ের কথা শুনে।
- “দিক গে। কেয়ার করি না। বাবা সাহসী ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, মানুষ ছিল। আই অ্যাম প্রাউড অফ হিম। তা বল, তোমার নতুন বয়ফ্রেন্ড কেমন আছে?” ওর
গলায় প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গের সুর।
- “অর্চি, সে ভালোই আছে, খুব ভালো ছেলে।” মেয়ের কাছে এর বেশি কিছু বলতে
সঙ্কোচ বোধ হয়। অর্চি সত্যিই খুব ভালো। কেয়ারিং, ডমিন্যান্ট নয়, সব
সময় আমাকে খুশি রাখার চেষ্টা করে, শরীরে, মনে। অ্যান্ড্রয়েড মানব বলেই
হয়ত, প্রখর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সম্পন্ন। বিপ্লবের মত অমন
ঝগড়া করে না কক্ষনও। তবে মুনিয়া কোনদিনই ওকে পছন্দ করে না।
- “বেশ বেশ। তুমি ভালো থাকলেই আমিও হ্যাপি। কিন্তু প্লিজ মা, ঐ আ-পদ
টাকে বেশি ব্যবহার কোর না। গাড়ি আছে, স্কাইস্কুটি আছে, নিদেনপক্ষে
হাঁটাচলা করেও তো টুকটাক যাতায়াতগুলো সারতে পার মাঝেমাঝে!”
- “হাঁটা! তোর মাথাটা সত্যিই খারাপ হয়ে যাচ্ছে রে মা। সময়ের কত দাম জানিস
এখন? এই আ-পদে যেভাবে নিমেষের মধ্যে যে কোনও বস্তু এক স্থান থেকে
অন্যত্র স্থানান্তর করা যায়, সেটা হাঁটাচলা করে সম্ভব? আর গাড়ি,
স্কাইস্কুটি সবেতেই তো অনেক বেশি সময় লাগে।”
- “দেখো মা, তুমি হয় ব্যপারটা বুঝতে পারছ না, বা বুঝতে চাইছ না। সময় ওভাবে
বাঁচানো যায় না। ডাইমেনশনের সঙ্গে ছেলেখেলা করলে প্রকৃতি সেটা সহ্য
করে না। তুমি যে সময়টা বাঁচাচ্ছ বলে ভাবছ, সময় ঠিক সেটা তোমার জীবন
থেকে নিয়ে নিচ্ছে। প্রত্যেক নিমেষেই।”
- “উফ! কী সব...”
- “বলতে দাও মা। এটা রিলেটিভিটির সেই বিখ্যাত টুইন প্যারাডক্সের মত
খানিকটা। সেই যে দুই যমজ ভাই, যাদের একজন পৃথিবীতে রইল আর
আরেকজন প্রায় আলোর বেগে রকেটে চেপে মহাশূন্য ভ্রমণে গেল। এবার
যেহেতু আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বে তীব্রবেগে চলমান
রেফারেন্স ফ্রেমে মানে রকেটে সময় একটু ধীরে বইবে, তাই কয়েক বছর পর
পৃথিবীতে ফেরার পর নিশ্চয়ই দেখা যাবে ওখানে থাকা যমজ ভাইটি একটু বেশি
বুড়ো হয়েছে আর রকেটে ঘোরা ভাই একটু বেশি জোয়ান। কিন্তু বাস্তবে
এমনটা হবে না, কারণ এখানেই একটা মজার প্যারাডক্স বা হেঁয়ালি রয়েছে।
কারণ আপেক্ষিকতা অনুসারেই চলমান রকেটের সাপেক্ষে পৃথিবীতে থাকা

ভাইটিও তীব্র বেগে গতিশীল। ফলে সময়কে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। বয়স
দু’জনেরই সমান বাড়বে!”
- “তার সঙ্গে আ-পদের কী সম্পর্ক? এত ভালো একটা যন্ত্র।“
- “সম্পর্ক তো আছেই। প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ। তোমাদের ঐ যন্ত্রে
বস্তুগুলোকে প্রথমে অতিক্ষুদ্র কণিকাতে, তারপর শক্তিতে রূপান্তরিত
করে ফোটন মানে আলোর কণার বেগে এক জায়গা থেকে অভীষ্ট স্থানে পৌঁছে
দেয়, তারপর আবার শক্তি থেকে ভরে বা বস্তু অবস্থায় ফিরিয়ে আনে। কিন্তু
শক্তি আর সময়ের অনিশ্চয়তার সূত্রটা মনে করো। যে কোনও একটা যত
সুনির্দিষ্ট হবে, আরেকটা তত এলোমেলো, অনির্দিষ্ট হবে। এখন এই যে
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সময়ে তোমরা স্থানান্তর করছ, এতে তোমাদের কিছু না কিছু
শক্তিক্ষয় হচ্ছেই, তোমরা তিলে তিলে অকাল বার্ধক্যের দিকে যাচ্ছ মা!”
বলতে নেই, এমন ‘অবান্তর’ কথা শুনেও কেমন যেন শিউরে উঠলাম ভিতরে। সত্যি এমনটা হচ্ছে না তো? যদি একটা আয়না পাওয়া যেত কোথাও... বোধহয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম। মুনিয়ার ডাকে চমকে সম্বিৎ ফিরল।
- “কিছু খুঁজছ মা? এটা চলবে?”
মেয়ের হাতে একটা ছোট্ট হাত আয়না উঠে এসেছে। হাসিমুখে আমার দিকেই
এগিয়ে ধরেছে সেটা। কাঁপা কাঁপা হাতে সেটা ধরতে গিয়ে অস্ফুটে বলতে যাই – “তুই আবার এসব জিনিস এখানে...”
পুরোটা বলতে পারি না। আয়নাটা হাতের মুঠো থেকে খসে পড়ে। ভাগ্যিস মুনিয়ার বিছানাতেই পড়ল, না হলে ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যেত। এ আমি কী দেখলাম! চোখের নিচে কালি, দু’পাশে চামড়া কুঁচকে গেছে। কপালে বলিরেখা! গালের তলায় ত্বক ঝুলে যাচ্ছে! এটা আমি? তাহলে, তাহলে এতদিন যে...
হঠাৎ চেম্বারের ভিতর লাল আলো জ্বলে উঠল। আর সেইসঙ্গে একটা বিচ্ছিরি
কানে তালা ধরানো কর্কশ আওয়াজ। অ্যালার্ম বাজছে। আমি দরজার দিকে
এগোনোর চেষ্টা করার আগেই সেটা খুলে গেল। ভিতরে ঢুকে এল দু’জন সশস্ত্র
যন্ত্রদারোগা, আর, আর... তাদের পিছনে, একী, এ যে অর্চি! ও কী করছে
এখানে? আমি বলার আগেই যেন টেলিপ্যাথিতে প্রশ্নটা বুঝে জবাব দিল ও -

- “তোমায় নিয়ে যেতে এসেছি সোনা। এখানে আবহাওয়া ভালো না। তোমার শরীর খারাপ করবে।” ওর ঠোঁটে সেই পরিচিত হাসিটাই। কিন্তু এখন যেন সেটা বড় ক্রূর লাগছে।
- “কিন্তু, কিন্তু তুমি জানলে কীভাবে যে আমি...”
- “হা হা! কেন, জানতে পারি না?” অর্চির ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টি ঘুরে যায় আমার
মাথার হেলমেট আর হাতে লাগানো ছোট্ট ধাতব যন্ত্রাংশের দিকে। আ-পদ!
তাহলে এটা নজরদারিরও কাজে লাগে? মুনিয়ার কথা যদি আরেকটু আগে
শুনতাম। ইশ! দেরি হয়ে গেছে। আমাকে দু’পাশ থেকে জাপটে ধরে টেনেহিঁচড়ে
নিয়ে যাচ্ছে যন্ত্রদৈত্যেরা। হয়ত আমার বিগত কিছু সময়ের স্মৃতি মুছে দিয়ে
আবার ‘স্বাভাবিক’ করে দেবে... কিন্তু মুনিয়া? ওর কী হবে? ওকে কি আর
দেখতে পাব?
পিছনে দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একটানা কর্কশ অ্যালার্মের আওয়াজটা চাপা
পড়ে যাচ্ছে তার পিছনে। লাল আলোটা আরও তীব্রতর হয়ে আমার চেতনাকে
আচ্ছন্ন করে ফেলার আগে কি তাও বহুদূর থেকে কোনও ‘মা’ বলে ডাক কানে এল আমার?
....................
Saptarshi Chatterjee
 
অলঙ্করণ :-  সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
 
 

 

ভাবনা কারা - আগমনী পাঠক

 ভাবনা কারা
আগমনী পাঠক


    “বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এই কল্পনাতীত বিশাল ক্ষেত্রের ক্ষুদ্রাতীত ক্ষুদ্র আমাদের এই বাসভূমি। পুনশ্চ, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তুলনায় মোদের অস্তিত্ব নগন্য। তবে জানিস, হিন্দু দর্শন মতে, যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাই আছে সবথেকে ক্ষুদ্র কণাতেও, আবার মনই নাকি এসবের আধার! উফ, কীসব বকছি তোদের কাছে। আসলে, ইদানিং আমার আবার বিজ্ঞানের তত্ত্বর সাথে নানান ধর্মীয় তত্ত্ব আলোচনা পর্যালোচনার ভূত মাথায় চেপে বসেছে। এই ভূত বলতেই আমার মাথায় বেশ ইন্টারেস্টিং ঘটনা মাথায় এসেছে”
 

    মামাবাড়িতে গরমের ছুটিতে সবাই এসেছি। আমি, বাবাই, তুতাই, টুবলাই, মনি দিদি, আর ছোট্ট রিনিও এসেছে। আমি, তুতাই , টুবলাই তিনজনেই হাওড়া ঠাকুরানী উচ্চবিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেনীর ছাত্রছাত্রী। সম্পর্কে আমারা সবাই একেওপরের কাজিন্স। মনি দিদি আর টুবলাই অবশ্য সিব্লিংস। বাবাই দাদা আমার মামত দাদা। এই বাড়িটা আমাদের মামাবাড়ি ঠিক নয়, এটা মামার চাকরিসুত্রে পাওয়া কোয়াটার, কিন্তু বিএসএফ ইন্সপেক্টরের কোয়াটারকে স্বচ্ছন্দে ছোটোখাটো বাংলো বাড়ি বলা যায়।  আসামের শিলচর শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে গ্রাম্য পরিবেশে এই বিশাল বি এস এফ ক্যাম্প! এর পাশেই আর্মি ক্যাম্প, সেটা আরও বড়ো, তবে আমরা যাইনি ওখানে, দূর থেকে দেখে আর মামীমার মুখে শুনে ঠাওর করেছি ওর আয়তন। বাবাইদাদা এখন ব্যাঙ্গালরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে আর মনি দিদি কলকাতায় বালিগঞ্জে এম এস সি করছে। আমি এটুকু গল্প শুরুর আগে বলা প্রয়োজন মনে করলাম নয়ত গল্পের মাঝে আমাদের পরিচয় পেতে পাঠকের হয়ত ভালো লাগবে না। যাইহোক, আমি আবার গল্পে ফিরি। এবার নিশ্চয় বুঝেছেন যে কথা শুরু করেছে সে আমাদের মনি দিদি। মামা যেখানেই থাকুক প্রতিবার গরমের সময়ে আমরা সবাই সেখানে যাই, খুব খুব মজা করে কাটে আমাদের ছুটি। সাথে মনিদির গল্প আমাদের উপরি পাওনা।
মনিদির কথায় বেশ বুঝতে পারলাম একটু উৎসাহ দেখালেই মনিদির গল্পের ঝাঁপি খুলে যাবে।
“ইন্টারেস্টিং? মানে কি সেই হাউ মাউ খাঁউ মানুষের গন্ধ পাঁউ? এই তাহলে আমি নেই, উঠলাম, ওসব গাঁজাখুড়ি গল্প আমার পোষায় না” বাবাই দা মনিদির কথা শেষ হতেই হাঁই হাঁই করে বলে উঠল!
মনিদি সোফার উপর বসে বেশ যোগীমাতার মত মুখের ভঙ্গি করে বলল, আমি কবে শুনিয়েছি সেসব ? না, শুনতে চাইলে আমি বলবো না, যা!
উফ, এই দাদা দিদি নামেই বড়ো হয়েছে, তবু বাচ্ছাদের মত রাগ করে, যাইহোক আমি বললাম,
“আরে না না, দিদি তুমি যা বলছিলে শুরু করো, আট টা বাজতে গেল, ঠিক ৯টা পনেরো তে মামিমা আবার ডাক দেবে, খেতে যেতে হবে, তার আগে প্লিজ”
“ঠিক আছে সবাই বলছে যখন আমিও বসি” বাবাই দাদার সম্মতিতে দিদি বেশ মুখে এক প্রসন্ন হাসি এনে, আবার বলতে শুরু করল। আর, বাকিরা তো, আগে থেকেই গল্পের নাম শুনে জাঁকিয়ে বসেছে।
 

    এবার যা গল্প মনিদিদির কথাতেই লিখছি আমি,
“তবে শোন, এই গল্প আমার অভিজ্ঞতা নয়, এ আমার এক রুমমেটের কথা, গল্প তোদের মামদ, জামদ বা ভ্যাম্পায়ার নিয়ে না হলেও…,” বলতে বলতেই দুম করে কারেন্ট অফ হয়ে গেল, আর বাইরে যে এতক্ষণ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে তা এতক্ষন টেরই পাইনি, এখন তারই শব্দ কাঁচ ঘেরা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে, নিঝুম পরিবেশের ছমছমে ভাবটা আরও গভীর থেকে গভীরতর করে তুলল।  
“এই ভয় বলতে বলতেই কারেন্টটা কেন যে হাওয়া হয়ে যায়, বুঝি না বাপু!” তুতাইয়ের কথা শেষ হতে না হতেই, মামি মা দুটো বড়ো বড়ো বাতি জ্বালিয়ে ঘরের দুই কোনে রেখে গেলেন। আমরা মনিদিদির আরও কাছে কাছে ঘেঁসে বসলাম।
“এই যে এখন অন্ধকার হয়ে গেল, এখন তোদের মনে হচ্ছে না, এটা যেন একটু আগেই হয়েছে বা এই একই সময় কাটিয়েছিস? বা জানিস সবটুকু কী ঘটতে পারে!”  
“দিদি, প্লিজ, কীসব বলছিস! তুই গল্প বল” টুবলাই বলল।
“হুম্, আমার রুমমেট প্রিয়া, আছে এখান থেকে সামনেই শিলং শহরে। গতবছর মার্চে বিয়ের পর পরই ও ওর বরের সাথে এই শিলং শহরে চলে আসে, ও আমার রুমমেট কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে ছিল আমার থেকে ১ বছরের সিনিয়র। তাই পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে খুব আনন্দেই শিলঙে চলে আসে। আমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, ওখানের পরিবেশের অপরূপ দৃশ্যের ছবি পাঠাত আমাকে। ছুটিতে ওখানে যেতেও অনুরোধ করে, কিন্তু তোরা তো জানিস আমার ফাইনাল ইয়ার গেল এই বছরটা । সুতরাং ছুটি পেলেও প্রোজেক্ট , রিপোর্ট, করতে করতেই কেটে যেত।
 

    প্রায়ই কথা হত। ওর ছবি বা ভিডিও থেকে আমারও ততদিনে ওদের বাড়ির  আশে পাশের পরিবেশ সহ মানচিত্র বেশ মাথায় গেঁথে গেছে। একটা সবুজ উদ্যান ঘেরা একতলা বাড়ি ওদের। ওর বর ইউনিভার্সিটির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোফেসর আর ইউনিভার্সিটির খুব কাছেই ছিল ওদের এই বাড়ি। এমনিতে দেড় কিমির মতো হলেও, সামনের এক পার্ক এর রাস্তা নিলে ৫০০ মিটার কম হাঁটতে হতো। এখানে এসে তো, তোরা পাহাড়ের সৌন্দর্য বুঝতেই পারছিস তাই ওসব আর বলবো না। মোটকথা ওখানের দৃশ্য আমি দূর থেকে ডিজিটালি দেখেই অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। এইভাবে ওর ওখানে ৮ মাস কেটে গেল, শীতকাল জাঁকিয়ে বসেছিল শিলং শহরে, আর আমার জীবনে বসেছিল সেমিস্টারের চাপ! অনেকদিন কথা হয়নি আর প্রিয়ার সাথে। এরপর একদিন হোয়াটসঅ্যাপে দেখি প্রিয়ার খুব লম্বা একটা মেসেজ”
 

    এতটুকু বলে মনিদিদি থামলো, ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রল করতে করতে মিনিট খানেক পর আমাদের সামনে মোবাইলটা এগিয়ে দিল। বাবাইদা সেটা প্রায় ছোঁ মেরে সবার আগে নিয়ে নিল। মনিদিদি বলল, “ওটা ও পাঠিয়েছিল, খুব একটা ব্যাক্তিগত কিছু নেই, তাই তোদের সরাসরি দেখতে দিলাম”। বাবাইদার পর সবার হাত ঘুরে আমার হাতে এসে পৌঁছাল সব শেষে, এস এম এস টা ছিল এইরকম।
“মনি, কতদিন তোকে ফোন করতে পারিনি, কিন্তু আজকালযে কি হয়েছে আমার! সময় যেন কেমন আমার সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে হারিয়ে যায়। গতকালেরই ঘটনা, সোমনাথ ওর রিসার্চ ল্যাবে একটু রাত অবধি কাজ করবে জানাল, আমাকে বলল ওর রাতের খাবারটা ওখানেই নিয়ে যেতে। সেইমতো আমি সব প্যাক করে নিয়ে বেরলাম, তখন সবে সাতটা বাজে কিন্তু এখন শীতের সময়, তাই বেশ অন্ধকার! নিলাম ওই পার্কের পথ, হাতে মোবাইল ছিল তবে টর্চ জ্বালানোর প্রয়োজন ছিল না, অনেক স্ট্রিট লাইট জ্বলছে। পার্কের সামনের ফাউন্টেনটা পেরিয়ে যেতেই এমন একটা রাস্তা পড়ে যার দুপাশে বড়ো বড়ো গাছ। ওই গাছের সবুজ ডাল পালাগুলো এমনভাবে রাস্তার সামনে এগিয়ে এসেছে যে সকালে নীল আকাশ উঁকি মারলেও রাতের অন্ধকারে তা দেখা যায় না। দিনে এই পথ বেশ রোম্যান্টিক লাগে কিন্তু রাতে যেন এক গুহা পথ। কাল দেখি, শুধু ওই পথেরই স্ট্রিট লাইট গুলো ঠিক করে জ্বলছে না, দুটো একেবারে বন্ধ আর দুটো জ্বলছে নিভছে। হাতের মোবাইলের টর্চটা জ্বালাতে হল না, তাড়াতাড়ি ওখান থেকে বেরতেই দেখি, একটা বেশ সাদা রঙের ছোটো কুকুর খুব লেজ নাড়াচ্ছে আর আমার সামনের দিকে এগিয়ে এসে আমার পায়ের কাছে যেন মাথা ঠেকিয়ে কিছু একটা জানাতে চাইছে, আমি বুঝলাম, ওর হয়ত খিদে পেয়েছে। আমার ব্যাগে রাতের খাবারের সাথে কিছু শুকনো খাবারও ছিল, সেটা আমি বের করে ওই কুকুরটাকে দিলাম। ও সানন্দে লেজ দুলিয়ে খাবারের দিকে মুখ ঝুঁকিয়ে খেতে শুরু করে দিল। তখন, আমার হঠাৎ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে খুব ইচ্ছা হল। মাথা নুইয়ে দিতে গিয়েই কেমন যেন একটু চোখের দৃষ্টি অন্ধকার হয়ে এলো।
 

    এরপর দেখি, কোথায় সেই কুকুর, এমনকি আমি ওই পথের অন্য প্রান্তে মানে এখনও আমি ওই রাস্তাই পার হইনি। কিন্তু কীভাবে তা হয়? ভাবলাম, আমি হয়ত অনেক বেশি ক্লান্ত, আর বেশি বেশি চিন্তা করছি, তাই মনের ভয় ভয় ভাবটা কাটিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। আর তুই তো জানিস, আমি সবসময় একটু বেশি ভাবতে থাকি। এবার যা হল,কীভাবে যে বলি! ওই সবুজ গুহাপথের ন্যায় রাস্তা আবার পেরিয়ে গেলাম ওপর প্রান্তে, আমি আবার একইভাবে ওই কুকুরটার দেখা পেলাম, কেন জানি না, মনে হল ওকে খাবার দিই। কিন্তু সেই একই ঘটনা ঘটল, মানে খাবার দিয়ে ওকে খেতে দেখতে দেখতে যেই ওর মাথায় হাত দিয়ে একটু আদর করতে গেলাম,…
দেখি কিনা, আমি আবার অন্য প্রান্তে! এরকমভাবে প্রায় তিনবার ঘটল। আমি খুব ক্লান্ত, সবথেকে অবাক কী জানিস?
আমি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম, সাতটা বেজে ১০ মিনিট আর ওই ঘটনা তিনবার ঘটার পরও দেখলাম মোবাইলের ঘড়ি জানাচ্ছে তখন সবে মাত্র ৭ মিনিট পেরিয়েছে। তাহলে কি সবই মনের মাঝে!! বেশি ভাবার জন্য কি হচ্ছে?
আমি আবার গেলাম, তবে এবার আর ওই কুকুরটার মাথায় হাত বোলানোর জন্য ঝুঁকলাম না। দেখলাম আর আমি অন্যপ্রান্তে নিজেকে আবিষ্কার করলাম না। যতটা সম্ভব দ্রুত হেঁটে ওর ইউনিভার্সিটি পৌঁছে গেলাম। গিয়ে খুব হাঁপিয়ে পড়ি, তাই ঠিক করলাম, সোমনাথের সাথেই বাড়ি ফিরব, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ওদের রেস্টিং প্লেসে বসে রইলাম।
এরপরের ঘটনা, ঐদিনই ফেরার সময় হয়।
 

    ফেরার সময় সোমনাথ সাথেই ছিল। হাঁটতে হাঁটতে ইউনিভার্সিটি এরিয়া শেষে পার্কের রাস্তা ধরলাম, তখন ও ওর ব্যাগ থেকে একটা চকলেট বের করে আমায় এগিয়ে দিয়ে বলল, “খেতে খেতে চল”। আমি নিতে গিয়ে দেখি, কোথায় পার্কের রাস্তা কোথায় চকলেট দিচ্ছে! সোমনাথ তো আমার পাশে দাঁড়িয়ে বোতল থেকে জল খাচ্ছে, আমরা পার্কের রাস্তা দিয়ে হাঁটতেই তো শুরু করিনি! ঠিক এই ঘটনা তো হাঁটতে শুরু করার আগের মুহূর্তেই ঘটল। আমি আবার দেখলাম, একই ঘটনা ঘটল, সময় এগোচ্ছে না যেন পেন্ডুলামের মত দুলছে।  
এবার হাঁটতে লাগলাম, সেই একইভাবে সোমনাথ আমার দিকে চকলেট এগিয়ে দিল! এবার আমার মাথাটা ঝিম ঝিম করতে শুরু করেছে, চকলেট না নিয়ে আমি সোমনাথের হাতটা শক্ত করে ধরলাম। এসব শুধু আমিই অনুভব করছি, সোমনাথ নয়।
জানি না রে, কী হচ্ছে আমার সাথে, কেন হচ্ছে! আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি!”
এত্ত বড়ো এস এম এসটা পড়া শেষ করতেই মনিদিদি আবার বলতে শুরু করল, “আমি প্রিয়াকে ফোন করে আরও অনেক কথা জানতে পারি, ও বলে ও নাকি জানে আমি কী কী বলবো, একই ঘটনা নাকি বারে বারে হচ্ছে,… শুধু ওর জন্য! অথচ আমি ওকে ঐদিন একবারই ফোন করেছিলাম!”
“তোর বন্ধুর স্ক্রু ঢিলা হয়ে গেছে, এতে ভয়ের কিছু নেই” বাবাইদা বলল।
বাবাইদার কথায় মনিদিদি বলল, “এতটুকু শুনে আমিও তাই ভেবেছিলাম, তাই ওর হাসবেন্ড মানে সোমনাথকে ফোন করে আমার সাথে যা কথা হয়েছে সবই বললাম, শুনে উনিও বললেন, প্রিয়া নাকি এই কদিন খুবই অন্যমনস্ক থাকে, নানান রকম অদ্ভুত কথা বলে”।
“কেমন, কেমন” তুতাই বলল,
“ওরা একদিন শিলং শহরের এক চার্চে গিয়েছিল, প্রিয়া আর সোমনাথ একদম শেষের দিকে বসে ছিল। চার্চে প্রার্থনা চলছিল। হঠাৎ প্রিয়া সোমনাথের পাশ থেকে উঠে গিয়ে কোথা থেকে এক বালতি জল নিয়ে এলো, আর তখনই দেখে, এক বাচ্ছা মেয়ের ফ্রকে বাতির আগুন থেকে আগুন লেগেছে সে ভয়ে ছুটে আসছে, আর প্রিয়া তখনই ওই জল ছুঁড়ে নিভিয়ে দেয়। সবাই সেদিন প্রিয়াকে সাক্ষাত ঈশ্বরের দূত মেনে ভূয়সী প্রশংসা করেছে, বিশেষ করে ওই মেয়েটির বাবা মা। এবার, প্রশ্ন হলো যে, প্রিয়া জানল কি করে যে ওটা হবে?
 

    আমি প্রিয়ার সাথে কথা বলতে,  ও আমায় বলে, ঠিক আগেই ও ওই মুহূর্তটা কাটিয়েছে, ওটা ও , না করলে মেয়েটার ডান পা নাকি মারাত্বক দগ্ধ হয়ে যেত!
প্রিয়ার এটা বিশেষ কোনও ক্ষমতা নাকি সবটাই ওর মনের মাঝে হওয়া জটিল কোনও ভাবনার বহিঃপ্রকাশ! দাঁড়া,  তোদের আরও একটা এস এম এস দেখাই,………”
মনিদিদি আবার থামল, বাইরে সমানে বৃষ্টি হচ্ছে। কাঁচের জানালায় বৃষ্টির ফোঁটা টপ টপ করে লাগছে। এরকম নিশ্চুপ বৃষ্টি আমাদের হাওড়াতে হয়না, যেন কেউ নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে। মনের মাঝে মনিদিদির গল্পটা অনেক দাপাদাপি করছে, কোনও ঘটনা ঘটার সময় অথবা ঘটে যাওয়ার পরে মনে হয়না যে ওটা যেন আগেও ঘটেছে, আগেই দেখেছি, হয়না কি আমাদের সাথে?? দিদির বন্ধু প্রিয়ার মতো আমাদের সাথে এগুলো হয়না?
এতক্ষনে বাতিগুলো থেকে মোম ঝরে বাতির গায়েই এক লম্বা স্তুপ সৃষ্টি করছে, অথচ একটু আগেই যেন কিছু ছিল না। আচ্ছা, এইমাত্র দেখলাম যেন বাতিটা নিভে আসছে আর ……
ভাবনার জালে জড়িয়ে যেতে মনিদিদির স্বর আবার বাস্তবে ফিরিয়ে আনল।
“এই এস এম এস টা দেখ, ঋতু” মনিদিদি আমাকে মোবাইলটা দিল। ওতে দেখলাম,
“জানিস, এখন এত বেশি হচ্ছে একই ঘটনার ফিরে ফিরে আসা, আমি আর পারছি না রে, মাঝে মাঝে মাথাটা যেন যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যায় এসব ভেবে ভেবে। মাথার চুল ঠিক করে নিয়ে, আয়নার সামনে থেকে সরে এসেও যেন আবার আমি আমাকে দেখতে পাই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কোনটা যে সত্যই হচ্ছে, কোনটা যে আমি আর কোনটা নয়, চার পাঁচ বার ঘটে যাওয়ার পরও দেখি সকলের জন্য সেটা মাত্র একবারই হচ্ছে। সময় যেন শুধু আমার সাথেই এই লুকোচুরি খেলছে, এই লুকোচুরিতে আমি ক্লান্ত।
আচ্ছা মনি, তোর কখনও এরকম হয়েছে যে , হয়ত তুই কারোর সাথে কথা বলছিস কিন্তু বুঝতে পারছিস যেন সে কি বলবে, যেন তুই আগেও শুনেছিস! অথবা, খাওয়ার শেষ করেও দেখছিস তোর খাওয়া হয়নি, টেবিল ভর্তি খাবার একইভাবে পড়ে আছে। কী রে হয়েছে?”
এই এস এম এস টা পড়ে দিদির মোবাইলটা ফিরিয়ে দিয়ে বাতিটার দিকে চেয়ে এবার সত্যই যেন মনে হল, এই লেখাগুলো আগেও পড়েছি।
বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে উঠল, বৃষ্টি থেমে এল, মামিমা আমাদের খেতে ডাকল, সবই যেন আগেও ঘটেছে, আবার ঘটল।
বেশি ভাবলে কি সময় পেন্ডুলামের মতো দোলে?
আপনাদের সাথেও কি এরকম হয়? আমার এই লেখা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে না? এটা আগেও পড়েছেন? কি হচ্ছে না?
 

সমাপ্ত 

 

Agamoni Pathak

 


 


বছর কুড়ি পরে - এস সি মন্ডল

 

বছর কুড়ি পরে,

এস সি মন্ডল


| ১।

 

সন্ধ্যা আটটা, লেকের পাড় ধরে হাঁটছেন শওকত সাহেব। বিকেল থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে করে চোখের ভারি ফ্রেমের চশমার কাচ ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে বারবার। তাই মাঝে মধ্যে থেমে গেঞ্জির কোনা দিয়ে চশমার কাচটা মুছে নিয়ে আবার হাঁটছেন তিনি। বিগত কুড়ি বছর ধরে এটাই তার রুটিন। ঘড়ি ধরে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় রাতের খাবারটা খেয়ে নেন, তারপর একঘন্টা লেকের পাড় ধরে হেঁটে বাড়ি ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে ঠিক নয়টার সময় ঘুমিয়ে পড়েন। 


বাড়িতে লোক বলতে তিনি একাই, স্ত্রী গত হয়েছেন প্রায় কুড়ি বছর আগে, বাচ্চা কাচ্চাও নেই। চাইলে অবশ্য আবার বিয়ে করতে পারতেন, কিন্তু কুড়ি বছর আগে এরকমই এক সন্ধ্যায় লেকের পাড়ে ঘটা ঘটনাটা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। সেই থেকে একটা দিনের জন্যেও হাঁটা বাদ দেননি।


লেকের চারপাশে এক চক্কর দিয়ে যখন টেনিস কোর্টের কাছাকাছি এসেছেন, তখন শওকত সাহেব দেখলেন ছাতা মাথায় কেউ একজন উল্টো দিক থেকে হেঁটে আসছে। কাছাকাছি আসতে লোকটা থেমে দাঁড়াল, তারপর চিকন মিহি কণ্ঠে বলল-


“আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।”


কণ্ঠ শুনে চিনতে পারলেন শওকত সাহেব, লোকটার নাম মজিদ। একসময় তারই কলেজের ছাত্র ছিল। ফচকে ধরনের ছাত্র, কলেজ আর পাশ করেনি, এখন একটা ফার্মেসির দোকান দিয়েছে লেকের দক্ষিনে ক্লিনিকের পাশে। 


“ওয়ালাইকুম আসসালাম” - জবাব দিলেন শওকত সাহেব। তারপর জিজ্ঞেস করলেন-


“কেমন আছো মজিদ?” 

“আলহামদুলিল্লাহ স্যার, আপনাদের দোয়ায় ভালোই আছি। খুব খুশি লাগতেছে স্যার, যে আপনি আমাকে চিনতে পারছেন।” 


“চিনতে পারব না কেন? আগের সপ্তাহেও তো তোমার দোকানে গেলাম” - অবাক হয়ে বললেন শওকত সাহেব।


একটু মিনমিন করে মজিদ বলল-


“না মানে স্যার, আপনাকে নিয়ে চিন্তায় থাকি, আপনিই আমাদের আসল শওকত স্যার কিনা সেই চিন্তা।”


কথা শেষ হতে মজিদের মিহি খিকখিক হাসির শব্দ শোনা গেল। মেজাজটা বিগড়ে গেল শওকত সাহেবের, কিছু না বলে তিনি আবার সামনের দিকে  হাঁটা ধরলেন। এমন বেয়াড়া প্রশ্ন অবশ্য তার জন্য নতুন কিছু নয়, বহু বছর ধরেই এই জ্বালাতন সহ্য করে আসছেন তিনি। কুড়ি বছর আগে সেই ঘটনাটা ঘটার পর কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক তারাপদ বাবুকে ঘটনাটা বলেছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন তারাপদ বাবু হয়ত ঘটনাটার একটা ব্যখা দিতে পারবেন, কিন্তু তারাপদ বাবু ব্যাখা তো দিতে পারলেনই না, উল্টো কলেজময় জানাজানি হয়ে গেল সব। 


| ২।

 

শওকত সাহেব নিজে ছিলেন বাংলার ছাত্র, পড়াশোনার পাট চুকিয়ে সরাসরি মফস্বলের এই কলেজে বাংলার লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। তখন অবশ্য কলেজ এত বড় ছিল না, একটা মাত্র পাকা দোতালা বিল্ডিং আর দুটো টিনের ঘর ছিল। ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যাও ছিল হাতে গোনা। তারপর বছরখানেক কেটে যেতে পরিবারের পছন্দে বিয়ে করলেন মালাকে। 


আহা, কি সুন্দর ছবির মত ছিল সেই দিনগুলি, সারাদিন কলেজে পড়িয়ে বাসায় ফিরতেন, তারপর সন্ধ্যায় মালাকে নিয়ে হাঁটতে বের হতেন এই লেকের পাড়ে। মালা ছিল তার স্ত্রীর ডাকনাম, তিনি অবশ্য ভালবেসে শঙ্খমালা বলে ডাকতেন। মালার পাশে হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মধ্যেই আনমনা হয়ে পড়তেন শওকত সাহেব, পুরো পৃথিবীটাকে কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হত। রাতের বেলায় বাড়ির ছাদে উঠে পাটি বিছিয়ে পাশাপাশি শুয়ে থাকতেন দুজন, মালার আঙ্গুলগুলো খেলা করে যেত তার মাথার চুলে। তখন মালাকে জীবনানন্দের কবিতা শোনাতেন তিনি


“যেদিন আমি পৃথিবীর থেকে চলে যাব, হে শঙ্খমালা-

অপরিসীম নক্ষত্র তুমি বিছিয়ে রেখো আকাশে...”


কিন্তু স্বপ্নের মত দিনগুলো বেশিদিন স্থায়ী হলনা, বিয়ের বছর দুয়েকের মাথায় এক জুন মাসে মাত্র পাঁচদিনের জ্বরে ভুগে মালা চলে গেল তাকে ছেড়ে। মালাকে হারিয়ে তিনি পড়ে গেলেন এক নিদারুন হতাশার মধ্যে। বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই মরে যেতে শুরু করেছিল একসময়ে। হয়তো মরেও যেতেন যদিনা কুড়ি বছর আগে লেকের ধারের সেই ঘটনাটা ঘটত।


| ৩।

 

মালার মৃত্যুর ছয়মাস পর ডাক্তারের পরামর্শেই সন্ধ্যায় লেকের পাড়ে আবার হাঁটা শুরু করেন তিনি। ডাক্তার বলেছিল এতে করে শারীরিক পরিশ্রম হবে কিছুটা, রাতে ভালো ঘুম হবে। সেই মত মাস দুয়েক হাঁটাহাঁটি করলেন, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হলনা। বরং লেকের পাড়ে হাঁটতে এলেই মালার কথা বেশি করে মনে পড়তে লাগল। 


কুড়ি বছর আগের সেই সন্ধ্যায় লেকের ধারে হাঁটতে হাঁটতে মালার কথাই ভাবছিলেন। আকাশে ভরা পূর্নিমার চাঁদ, লেকের জল ছুয়ে বয়ে চলা মৃদু বাতাস সব কিছু যেন আরো প্রকট করে তুলেছিল মালার অভাবটাকে। বারবার শুধু মনে পড়ছিল জীবনানন্দের কবিতার কথা, সেই যে “আট বছর আগে” কবিতার লোকটা, সেও তো এমনি এক পূর্নিমার রাতে একগাছা দড়ি হাতে করে গিয়েছিল অশ্বত্থের কাছে। সেদিনই তিনি ঠিক করলেন কলেজের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবেন। নাহলে হয়তো মালার স্মৃতি ভোলা কোনদিনই সম্ভব হবে না তারপক্ষে। 


তারপর এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে টেনিস কোর্টের কাছে আসতেই আচমকা যেন একটা গর্তের ভিতরে পা দিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন রাস্তার উপরে। চোখে খানিকটা অন্ধকার দেখলেন প্রথমটায়, এরপর সম্বিত ফিরে পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। রাস্তায় তাকিয়ে গর্তটা খোজার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তেমন কিছু চোখে পড়ল না। পড়ার সময় ধাক্কা সামলাতে গিয়ে বাম হাতের কনুইটা একটু ছড়ে গিয়েছিল। সেটা তেমন কিছু না হলেও ঝামেলা হল চোখ থেকে খুলে পড়ে চশমার কাঁচটা ভেঙে যাওয়াতে, তাই সেদিনের মত হাঁটা শেষ করে বাড়ির দিকে চললেন তিনি।


বাড়ির কাছাকাছি এসে অবাক হয়ে শওকত সাহেব দেখলেন ঘরের ভিতরে আলো জ্বলছে। তিনি একা মানুষ, বাড়ি থেকে বের হবার আগে সবকটা আলো নিভিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। তাহলে এখন আলো জ্বালালো কে? নিজেরই ভুল হয়েছে মনে করে দরজার সামনে এসে তালা খোলার জন্য চাবিটা হাতে নিতেই দারুন চমকে উথলেন তিনি। দরজায় তালা দেয়া নেই, কান পেতে শুনে মনে হল ঘরের ভিতরে হাঁটাচলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। যাহোক মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি নিয়ে দরজার কড়া নাড়লেন তিনি, আর তারপরই ঘটল তার জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা। 


দরজাটা খুলে গেল। অবাক চোখে শওকত সাহেব দেখলেন হাসিমুখে মালা দাড়িয়ে আছে। তাকে দেখে মালাও অবাক, বলল-


“আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে?”


উত্তর দিতে পারলেন না তিনি, ঘরের ভিতরে ঢুকবেন কিনা সেটা নিয়েও দ্বিধায় পড়ে গেলেন। এমন সময় ঘরের ভিতর থেকে ছোট্ট একটা মেয়ে দৌড়ে এসে আধো আধো স্বরে ‘বাবা বাবা’ বলে হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। মালা এসে তাগাদা দিয়ে বলল -


“দাঁড়িয়ে রইলে কেন, হাতমুখ ধুয়ে এসো” 


বলতে বলতেই মালার চোখ পড়ল শওকত সাহেবের ভাঙ্গা চশমা আর ছড়ে যাওয়া হাতের উপরে। ব্যস্ত হয়ে উঠল মালা, উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করল-


“কি হয়েছে তোমার ?”


এবারে উত্তর না দিয়ে পারলেন না তিনি, আমতা আমতা করে বললেন-


“টেনিস কোর্টের ধারে, পড়ে গিয়েছিলাম” 


মালা নিজের হাতে শওকত সাহেবের হাতের ক্ষতটা পরীক্ষা করে দেখল একবার, তারপর বলল-


“তুমি চুপচাপ বোসো, আমি স্যাভলন নিয়ে আসি”


মালা চলে গেলে বসার ঘরে সোফার উপরে বসলেন শওকত সাহেব। বসার ঘরটাও কেমন বদলে গেছে, কাঠের টেবিল চেয়ারগুলো নেই, বদলে একটা সোফা আর কাচের টি-টেবিল দেখা যাচ্ছে। টিভিটা ঠিকই আছে, তবে টিভির উপরে সেলাই করা ফুলতোলা পর্দাটা যেন নতুন দেখছেন। ছোট্ট মেয়েটা তার পাশের সোফায় এসে বসেছিল, তার হাতে একটা আধখাওয়া আপেল, সে সেই আপেলটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল-


“বাবা খাও...খাও...”


শওকত সাহেবের বিস্ময় কাটছিল না। এসবই কি তার মনের ভুল? অথচ মালা বেঁচে থাকলে হয়তো এসব সত্যি হয়েই আসত তার জীবনে। তিনি হাত বাড়িয়ে আপেলটা নিলেন, তারপর মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলেন-


“মাগো, তোমার নাম কি?”


খিলখিল করে হেসে মেয়েটা বলল-

“ইরাবতী”


কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন শওকত সাহেব, এমন সময় তার মাথাটা কেমন ঘুরে উঠল, চোখের সামনে যেন একটা কালো পর্দা নেমে এল।


| ৪।

 

চোখের সামনের অন্ধকারটা যখন কেটে গেল তখন শওকত সাহেব দেখলেন তিনি পড়ে আছেন সেই রাস্তার উপরে। প্রথমটায় ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারলেন না ঠিকমত। কোথায় গেল মালা, কোথায় গেল ইরাবতী? নাকি রাস্তায় পড়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন, তখনই কল্পনায় দেখেছেন এসব? কিন্তু তার চিন্তায় বাদ সাধল হাতের মুঠোয় ধরা আধখাওয়া সেই আপেলটা। সবই যদি কল্পনা হয়, তবে এই আধখাওয়া আপেলটা এল কোথা থেকে?


এই ঘটনার পর কেমন যেন হয়ে গেলেন শওকত সাহেব। সেই আধখাওয়া আপেলটা হাতে নিয়ে বসে থাকতেন সারাদিন। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পেতেন মালার মুখটা, সাথে করে ইরাবতীর মুখটাও। মেয়েটা দেখতে একদম তার মায়ের মত হয়েছে। খুব ইচ্ছে হত যদি আরেকবার দেখতে পেতেন মেয়েটাকে, একবার কোলে নিতে পারতেন। কাজকর্ম সব শিকেয় উঠল, কলেজের চাকরিটাও প্রায় যায় যায় অবস্থা হল। হয়তো চলেই যেত, যদিনা একদিন কলেজের লাইব্রেরিতে পত্রিকা পড়তে গিয়ে সেই লেখাটা চোখে না পড়ত। 


লেখাটা পড়তে গিয়েই তিনি প্রথম জানলেন, এই মহাবিশ্বের মত হুবহু এমন আরো অসংখ্য মহাবিশ্ব থাকার নাকি একটা সম্ভাবনা আছে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা, যার নাম তারা দিয়েছেন “সমান্তরাল মহাবিশ্ব”। এইসব মহাবিশ্বের একটায় যেটা অবাস্তব, সমান্তরাল অন্য মহাবিশ্বে সেটাই নাকি হতে পারে বাস্তব। শওকত সাহেবের মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল যে, প্রকৃতির খেয়ালবশে হয়তো কিছু সময়ের জন্য এমনই এক সমান্তরাল বিশ্বে চলে গিয়েছিলেন তিনি। যে বিশ্বে বেঁচে আছে মালা, আছে কন্যা ইরাবতী। একটা আশা জন্মাল তার মনে, কে জানে- প্রকৃতি যদি আরেকবার ভুল করে! আরেকবার যদি তাকে নিয়ে যায় সেই মহাবিশ্বে। যদিও এই কুড়ি বছরে সেটা হয়নি।


একটা সাইকেলের শব্দ শুনে চিন্তার সুতা কেটে বাস্তবে ফিরে আসেন শওকত সাহেব। মজিদের সাথে কথা বলে মনটা খারাপ হয়েছে বেশ, সেই হতাশটা আবার যেন ফিরে আসছে মনের মধ্যে। আসলেই তো, কতগুলো বছর চলে গেছে। এত বছরেও যখন হলোনা, তবে আর কি হবে? বৃষ্টির ছাঁটে আবারো চশমাটা ঘোলা হয়ে গিয়েছিল, একটু থেমে চশমাটা মুছে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন তিনি। 


কিন্তু শওকত সাহেবের ভাগ্যটাই মন্দ, বাড়ির গলিতে ঢুকতেই বিদ্যুৎ চলে গেল। ল্যাম্পপোস্টের আলো না থাকায় বেশ সমস্যায় পড়ে গেলেন তিনি। দুপুরের বৃষ্টিতে রাস্তার খানাখন্দে জল জমেছে, ওদিকে সাথে অন্যকোন আলোও নেই। যাহোক অন্ধকারটা চোখে সয়ে এলে সামনে পা বাড়ালেন তিনি, আর তাতেই ঘটল বিপত্তি, রাস্তার উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। জমে থাকা জলে জামাকাপড় ভিজে গেল, চোখ থেকে খুলে পড়ে হারিয়ে গেল চশমাটা। 


কোনরকমে উঠে দাঁড়িয়ে পথ হাতড়ে বাড়ি ফিরে এলেন তিনি। কিন্তু ঝামেলাটা হল তালা খুলতে গিয়ে। দরজায় যে তালা নেই ! তবে কি? 


নিশ্বাস চেপে রেখে দরজার কড়া নাড়লেন শওকত সাহেব। ঘরের ভিতরে একটা নারী কণ্ঠ শোনা গেল-


“ইরা, এই ইরা…দরজাটা খোল, দেখ তোর বাবা এসেছে কিনা?”


দরজা খুলতেই দেখা গেল মোমবাতি হাতে পরীর মত সুন্দর একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, শওকত সাহেবকে দেখে চমকে উঠে মেয়েটা বলল-


“বাবা, একি অবস্থা তোমার?”


ইরাবতীর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না শওকত সাহেব, তার দুচোখে ততক্ষনে অশ্রুর বাঁধ ভেঙ্গেছে।


(সমাপ্ত)

 

S C Mondal