জ্যাঠামশাই - শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
বেহেস্ত - শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
আমার পিছনে গুলাম মহম্মদ নামে এক বৃদ্ধ গাইড। এখানে ঢোকার কিছু আগেই সে আমার সঙ্গ নিয়েছে। আদ্যন্ত সাদা উলের চাদরে ঢাকা চাপ দাড়িওয়ালা ছয় ফুট লম্বা হিলহিলে চেহারার মানুষটা তরতর করে হেঁটে গেল শ্বেত পাথরের সোপান বেয়ে মিনারের কাছে।
মাথার ওপরে থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ। এক অদ্ভুত আলো আঁধারী পরিবেশ চারিদিকে। শীতের হিমেল হাওয়া। মার্বেলের শিলায় পা রাখা মাত্র জ্যোৎস্না রাতের রোমাঞ্চ যেন তার সবটুকু সৌন্দর্য নিয়ে গ্রাস করলো আমার মনকে। কিন্তু আজ এমন এক মূহুর্তে জায়গাটা এরকম জনপ্রাণী হীন কেন? নিজের মনকেই বললাম,' লোকজনের মাঝে বোধহয় এই সৌন্দর্যকে এত অন্তরঙ্গভাবে উপভোগ করা যেত না। এই মার্বেল শিলায় পা দিয়ে একাকি নিজেকে কেন যে এত ভাগ্যবান মনে হচ্ছে বারবার...এই অপার্থিবতার মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেবার জন্যই যেন জন্মজন্মান্তর ধরে অপেক্ষা করে ছিলাম আমি...যার টানে পুজোর ছুটি কাটাতে একা একাই ছুটে এসেছি কলকাতা থেকে সুদূর এই আগ্রায়।
বাদামী পাথরের সোপান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কুহকিনী সৌধের দিকে তাকিয়ে কথাটা যেন অজান্তেই বেরিয়ে এলো আমার মুখ থেকে, 'লাভ পোয়েম ইন এ মার্বেল...। স্টেইনলেস...!'
অনতিদূরে মথুরা অয়েল রিফাইনারি থেকে নিঃসৃত বাতাসে ভাসমান দূষিত গ্যাসীয় আবরণী পাথরের গায়ে যতটুকুই সংশ্লেষ ঘটাক না কেন, এই সুউচ্চ স্থাপত্যের বিস্ময় বা মুগ্ধতা আজও যে অকৃত্রিম!এতটাই কলংক মুক্ত সে। তবে এই দূষণ সৃষ্টিকারী পৃথিবী ভবিষ্যতের জন্য আশংকার বার্তা রেখে যায় বৈকি।
মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গুলাম মহম্মদ একটু হেসে বিশুদ্ধ হিন্দিতে আমায় বললো,' আসুন জাঁহাপনা। দেখে নিন চারিদিক। প্রেম আর হাহাকার কিভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে পাথরের প্রতিটি খাঁজে খাঁজে...কোণায় কোণায়। এমন মুহূর্ত আর পাবেন না জীবনে, এই নীরবতা, নির্জনতার মধ্যে দিয়েই তো তারা আসে। রোজ রাতে আসে। কারা যেন কথা বলে ফিসফিস করে...এসব কাহিনী বংশপরম্পরায় শুনে আসছি...আগ্রা শহরের প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়....এসেই যখন পড়েছেন একবার তার আস্বাদ নেবেন না? '
আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে গুলাম।
বলতে পারতাম,' সেই অদৃশ্য লোকের মানুষ গুলোর সঙ্গে তুমি বুঝি মোলাকাত করেছো? '
যুক্তি তর্কে গেলাম না। যাওয়ার মতো মানসিকতাও তখন আমার নেই। কারণ সেই মুহূর্তে আমার অন্তঃকরণ জুড়ে শুধুই বিচরণ করছে তাজ। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে চেয়ে দেখছি আর মন প্রাণ ঢেলে উপভোগ করছি চাঁদনি রাতে মার্বেল গাত্রে আঁকা চিরন্তন প্রেমের স্বর্গীয় রূপকে।
আমার সহযোগী বলে চলে,'সম্রাট প্রিয়তমাকে ধরে রাখতে পারেন নি বেশিদিন,চতুর্দশ সন্তানের জননী হতে গিয়ে নিজেকে বিসর্জন দেয় সে অপ্সরা রাজেন্দ্রাণী... বিরাট বিরহী বুকে আঁকড়ে থাকা সেই স্মৃতি আজও অমর; চিরন্তন কালের জন্য। যে স্মৃতি কথা বলে ওঠে কালের স্রোত বেয়ে...কিন্তু এর বাইরে আর কি কেউ কথা বলে ওঠে না? তাজমহল তো সেই হাহাকারেরই আরোএক রূপ..! নৈঃশব্দের আড়ালে কিছু শুনতে পাচ্ছেন জাঁহাপনা? '
অদ্ভুত ভাবে হেসে উঠলো গুলাম মহম্মদ। আমার থেকে হাতকয়েক দূরে উদ্যানমুখী মিনারের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। কোটরগত চোখদুটো তাকিয়ে আছে আমার উত্তরের অপেক্ষায়। মণিগুলো আশ্চর্য রকম নীল। নীচের চারবাগ উদ্যানের সুরম্য পুষ্করীণীর জলে প্রতিবিম্বিত তাজমহলের ভেসে চলা আবছায়া রূপের মতোই রহস্যময় সে দৃষ্টি।
আস্তে আস্তে এবার আমার কাছে এগিয়ে আসে গুলাম। ফিস ফিস করে বলে,' আমি যা বলবো তা শুধু অনুভব করুন। ঠিক শুনতে পাবেন। সমাধিস্থলের মূল প্রবেশ পথের দিকে তাকান একবার। গম্বুজের দেওয়াল গাত্রে আঁকা জারি, ছেদ যুক্ত সূক্ষ্ণ সূচীকর্মের অদ্ভুত নির্মাণ শৈলী, খোদিত কোরাণের বাণী,বৃহদাংশ জুড়ে মমতাজ মহলের অকুন্ঠ প্রশস্তি সমন্বিত অলংকার সমৃদ্ধ এমন সুনিপুণ হস্তাক্ষরশিল্প ...মুঘল ক্যালিগ্রাফির এই আশ্চর্য নিদর্শন যার মস্তিষ্ক প্রসূত...ফটকের গায়ে ঐ দেখুন ফার্সিতে খোদাই করা সে নাম...জ্বলজ্বল করছে আজও...পারস্যের নামজাদা চারুলিপিকার আমানত খাঁ....ঐ যে ঐ দেখুন, ছত্রে ছত্রে জ্বলজ্বল করছে মূল স্থপতিকার আহমেদ লাহোরি নামটুকু...জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে ১৬৩২ থেকে ১৬৫৩ বাইশ বছর ধরে হুমায়ুনের মাজার, ইমাদউদ্দৌল্লার মাজার, তিমুরের গুর ই আমির, দিল্লির জামি মসজিদের গঠন শৈলীকে সামনে রেখে, ইন্দো-ইরাণীয় তুরস্কের স্থাপত্য রীতির আশ্চর্য সংমিশ্রণেএকটু একটু করে গড়ে তুলেছিলেন যে স্বপ্নের তাজ...সে সব রক্তের দাগ অনাদিকাল ধরে চাপা পড়ে আছে এই পাথর স্তূপের নীচেই....জাঁহাপনা আসুন....
পাথরের গায়ে এই যে দেখছেন ভুবন ভোলানো খাঁজকাটা শিল্পকর্ম... মোজাইক শিল্পের এমন অদ্ভুত নমুনা দিল্লির প্রখ্যাত পাথর খোদাই কারক চিরঞ্জিলাল ছাড়া আর কে ই বা পারতো সৃষ্টি করতে। ...ঐ অত্যাশ্চর্য মোচাকৃতি গম্বুজ,স্বর্ণখোচিত চূড়া...যা সৃষ্টি করবার জন্য সুদূর অটোমান সাম্রাজ্য থেকে ভাড়া করে নিয়ে আসা হয়েছিল ওস্তাদ ইসমাইল খাঁ কে...গম্বুজের পদ্মফুলের চূড়ায় শোভিত এককালের ঐ চাঁদ, শিংযুক্ত স্বর্ণদন্ড...ওর যিনি সৃষ্টিকর্তা...লাহোরের সেই ওস্তাদ কাজিম খাঁ...মানুষের মাঝে আজ কোথায় তাঁর অস্তিত্ব বলতে পারেন...? আর ঐ ষাঁড়, বলদে টানা শয়ে শয়ে গাড়িগুলো... বেলুচিস্তান, পারস্য, মাকরাণ,রাজস্থান থেকে আনা দুষ্প্রাপ্য পাথর বোঝাই করে পশুগুলোর পিঠে চাপিয়ে কিরকম নিষ্ঠুরভাবে তাদের নিয়ে আসা হয়েছিল দূর দূরান্ত দিয়ে সম্রাটের প্রেমের সৌধ গড়ে তুলতে...যে হাজার হাজার লোকগুলোকে কোমড়ে দড়ি বেঁধে ব্যবহার করা হয়েছিল সেদিন কপিকল ঠেলে ঠেলে পাহাড় প্রমান পাথরগুলোকে গাঁথার কাজে...সাধারণ মানুষের চোখে আজও তারা অবহেলিত, সম্রাট নামক রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা নিষ্পেষিত...জনতা আসে, অখন্ড সৌধের অনুপম রূপ দেখে চলে যায়...সৌন্দর্যের রসটুকু ছেঁকে নেয়...কজন শুনতে পায় প্রেমের ফলকে হাহাকারের কাহিনী.... কেই বা শুনতে চায়। বাইশ বছর ধরে বাইশ হাজার মানুষের শ্রমের ফসল...একদা মহারাজা জয়সিংহের কাছ থেকে প্রাপ্ত এই সুবিশাল জমিকে মাটির পাহাড় দিয়ে ভরাট করলো যারা...একের পর এক বৃহদাকৃতির পাতকুয়ার উপরিভাগে সুউচ্চ বেদি নির্মাণ করে গড়ে তুললো সমাধি সৌধের বজ্রকঠিন ভিত..তারওপরে পাথর কেটে কেটে সাজিয়ে তোলা হলো সম্রাটের এক আকাশ স্বপ্নকে....সেই পাথর কাটার শব্দ,কপিকলের আওয়াজ...মিনার চত্ত্বরের অলিন্দে অলিন্দে, দীঘি,ঝরনা,কাজুবাগান,সুরম্য উদ্যানবাটির চারিপাশে আজও যে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়...। তারপর একসময় সূর্য যেমন করে ঢলে পরে ক্লান্ত অবসন্ন পথিকের মতো পৃথিবীর এক কোলে, সে শব্দও ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসে...মিলিয়ে যায় না একেবারে। এক অদ্ভুত করুণ সুরের রাগিণী হয়ে বাজে। বেঁচে থাকে শ্রমিকের বাঁধা পড়া জীবনের অবিচল প্রাণের কেন্দ্রে। সকাল,বিকেল,সন্ধ্যা..যে পাথরের রঙ বদলায় ক্ষনে ক্ষনে...মাতাল করে রাখে পর্যটককে...তার প্রতিটি টুকরো যে আসলে ঐ মানুষগুলোর শরীরের একএকটি পাঁজর...! এতটাই অবিচ্ছেদ্য ওরা...এতটাই জীবন্ত এ স্মৃতিসৌধ! বাদশাহ,বেগমের সাথে সাথে আরো কত প্রাণ হেঁটে চলে বেড়ায় এ চত্ত্বরে... ভাবুন একবার! সৌন্দর্য পিপাসু মানুষের চোখে সে অন্ধকারের বাসিন্দাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। তবু দৈবাৎ কেউ যদি একাএকা এসে পড়ে এ পথে,কারা যেন প্রাণপণে টেনে রেখে দেয়। ছাড়তে চায় না কিছুতেই। এই চাঁদনি রাতে এমন একাকী মুহূর্তেই মানুষকে শোনাতে চায় ওরা, ভগ্নস্তূপের স্তরে স্তরে চাপা পড়ে থাকা নিজেদের কাহিনি...শুনতে পাচ্ছেন নাকি সেই করুণ সুরের রাগিণী? কান পেতে থাকুন,দেখবেন ঠিক...। '
চমকে উঠে দেখলাম অদ্ভুত দৃষ্টিসম্পন্ন লোকটা কখন এসে ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে আমার। সাদা চুলগুলো উড়ছে এলোমেলো হাওয়ায়।
' কী দেখছেন জাঁহাপনা? চাঁদনি রাতে পুষ্করিণীর জলে তাজের প্রতিবিম্বিত ছায়া? এককালের গাছপালার অতিপ্রাচুর্য, সুদৃশ্য ঝরনার নীচে নীচে শোভিত বিশালাকৃতির স্বর্ণপাত্র, যমুনার জলধারা সিঞ্চিত সে সব জলাধার, হস্তচালিত গম্বুজাকৃতির কপিকল, পাথরের গায়ে গায়ে পারস্য মধ্য এশিয়ার দূষ্প্রাপ্য টার্কোয়াজ, ল্যাপিস লাজুলি, আফগানিস্তানের বৈদূর্যমণি সমন্বিত পিয়েত্রো দুরার সে অপরূপ কারুকার্য.... ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যের অবশেষটুকুর মতোই সেসবই এখন ইতিহাসের গর্ভে..প্রধান সমাধিস্থল সৃষ্টির পাঁচ বছর পর তৈরি সম্রাটের হাতে গড়া ঐ সাজানো বাগান, সেও তো কবেই হারিয়ে গিয়েছে। এখন যে উদ্যান চোখের সামনে ভাসছে, এ নেহাৎই সেদিনের। ইংরেজের দল নিজেদের খেয়াল খুশি মতো ভেঙে চুরে বিলিতি গার্ডেনের আনুষ্ঠানিক ছাঁচে একে গড়ে তুলেছে। কিন্তু পুষ্করিণীর জলের ঐ ছায়া...সে তো আর মিথ্যে হতে পারে না। ছায়া আজও ঘুরে ফিরে বেড়ায়..এ সৌধের কোণায় কোণায়, অলিন্দে অলিন্দে... প্রেম, অমরত্বের স্মৃতি, হাহাকার ফিরে ফিরে আসে রাতের নির্জনতার পথ ধরে....সে কথা তো আগেই বলেছি আপনাকে। বৃদ্ধ হয়েছি তো, তাই বারবার ফিরে আসে আবেগ। অনেকে বলবে গল্পকথা, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যমুনার অবশিষ্ট জল আজও রক্তাক্ত হয়ে রয়েছে হাজারো স্থপতির কেটে দেওয়া বৃদ্ধাঙ্গুলের চুঁইয়ে পড়া রক্তে...।'
মার্বেলের গায়ে হাত রেখে বোধহয় অমরত্ত্ব আর হাহাকার সমন্বিত ইতিহাসের সেই নির্যাসটুকুই অনুভব করতে চেষ্টা করছিলাম গুলাম মহম্মদের চোখ দিয়ে।
একটু কৌতুহলী হয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম,' তুমি কোথায় থাকো?'
'কেন এখানেই থাকি।'
' এখানেই থাকি বলতে?'
' এটাই তো আমার পৃথিবী। লোককে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলা...এ আমার পূর্বপুরুষের জীবিকা। নিশুত রাতের রহস্যে মাখা গা ছমছমে এই পরিবেশ, এই শান্ত সমাহিত অপার্থিব সৌন্দর্যে ঢাকা চারিধার...এ ছেড়ে আমি যাবো কোথায়? ঐ যে দূরে, তাজমহলের দেওয়াল বেষ্টনীর বাইরে বেলে পাথরের সমাধিগুলো... ওর একটা শাহজাহান পত্নী মমতাজের পরিচারিকাদের সমাধি সৌধ আর বাকীগুলো সম্রাটের অন্য পত্নীদের স্মৃতিবিজড়িত সৌধ। মমতাজকে হারাবার পর ওদেরকে নিকা করেছিলেন সম্রাট। সে প্রেম কি তাহলে ছিল আসলে দ্বিচারিতা? তা আমি জানি না। পূর্বদিকের ঐ লালপাথরের বিশালাকৃতির ইমারত যা এককালে জাওয়াব মানে মেহমানদের থাকার ঘর বা অতিথিশালা বলে পরিচিত ছিল, তার পার্শ্ববর্তী কালো পাথরের মেঝের ছককাটা ঐ মসজিদ....
তাজমহলের এই মীনার চত্তর...এখানে রোজ নমাজ পাঠ হয়, আজান হয়। আমি আজান দিই। কাক ডাকা ভোরে শ্বেতপাথর ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করি নিজের হাতে..এই মর্মর পাথরের গায়ে কোনো কলুষতার কালো দাগ আমি লাগতে দেবো না। যে সৌধ কুহকিনীর রূপে যুগ যুগান্ত ধরে মায়ায় বেঁধে রাখে মানুষকে সে নিজে থেকে কোনোদিনই কলুষিত হতে পারে না। সে তো চায় ধরা দিতে....তার ব্যাথা বেদনা বিষাদ অমলিনতা সবটুকু নিয়ে.... আমরাই শুধু বাইরে থেকে সে অমলিনতার মাঝে প্রেমকে খুঁজে খুঁজে বেড়াই...আপনার মতো কজনই বা পারে এরকম নিঝুম একাকী পরিবেশে ইতিহাসের নিগড়ে এসে পৌঁছাতে...তো এসেই যখন পড়েছেন, অত সহজে কি আর ফিরে যাওয়া যায়?'
'মানে?'
খিলখিল করে হেসে ওঠে গুলাম মহম্মদ।
' মানে আপনি ইতিহাসকে জড়িয়ে ধরলে সেও কি পারে আপনাকে না জড়িয়ে থাকতে? '
দূরে আঙুল দিয়ে দেখায় লোকটি...' ঐ দেখুন আগ্রা দূর্গ। পরিখার আড়াল থেকে তাকিয়ে রয়েছে। সামনে যমুনা। একসময় ছিল ভরা জল প্রবাহিত নদী। মুঘল ইতিহাসে যে নদী ছিল বেহেস্ত বা স্বর্গের নদী। জীবনের শেষ আটটা বছর দূর্গের মুসাম্মন বার্জে বন্দীদশাপ্রাপ্ত একাকী সম্রাট নিভৃতে ঠিক এমনি করেই আকুল নয়নে অবলোকন করতেন প্রিয়তমার স্মৃতি সৌধের প্রতিবিম্বিত ছায়া। আজ সে যমুনা মরা খালে পরিণত প্রায়। দূষণ সৃষ্টিকারী বদ্ধভূমি। তবু তারা আসে। পালটে যাওয়া পৃথিবীর মধ্য দিয়েই ঠিক পথ চিনে চলে আসে। টান যে এমনই...। রাত আর একটু নিশুতি হলে আস্তে আস্তে ভেসে আসবে ঘোড়ার পায়ের ক্ষুরের রাজকীয় সে শব্দ, থেকে থেকে হ্রেষাধ্বনি. ..ঐ আগ্রা দূর্গের পথ ধরে...থেমে যাবে তাজমহলের ঠিক দোরগোড়ায় এসে...কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধ হবে চারিধার। আচমকা ঝুমুর পড়া পায়ের কিঙ্কিণীর আওয়াজ ঘুরে বেড়াতে শুরু করবে তাজ চত্ত্বরের আনাচে-কানাচে দিয়ে সারা অলিন্দ ময়...বাগানের চারিধার...অব্যক্ত প্রেমের অমরত্বের স্মৃতি বুকে নিয়ে....রাত আর একটু গাঢ় হলেই...!'
ইতিহাসের নির্যাস আহরণ করতে করতে হঠাৎই মনে হলো, ভয় দেখাচ্ছে নাতো লোকটা? কি জানি...।
'আসুন জাঁহাপনা, প্রধান ফটকের ভেতর মূল সমাধি স্থলে প্রবেশ করি আমরা..যে সমাধিস্থল সবচেয়ে প্রাচীন। ১৬৪৩ এর মধ্যে শেষ হয় যার নির্মাণ কাজ। আসুন। '
বললেন গুলাম মহম্মদ।
গোম্বুজের নীচেকার ধনুকাকৃতির দরজা দিয়ে ভেতরকক্ষে প্রবেশ করে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে আছি। দেওয়াল ময় অপরূপ সব কারুকার্য। পিয়েত্রো দুরা শিল্পের সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন যে শিল্পীর হাতে গড়া, পৃথিবীতে স্বর্গের অমরত্বকে প্রতিষ্ঠা করতেই যেন তার জন্ম। আমি প্রাণভরে উপভোগ করছি সে ভাস্কর্য, চিত্র শৈলীর আশ্চর্যময়তা। মাথার উপরিভাগে গম্বুজাকৃতি চূড়া থেকে নেমে এসেছে এক প্রকান্ড ঝাড়বাতি। জ্যোৎস্নার আলো আঁধারীর মাঝে নির্জন নিভৃত কক্ষে যেন এক অপার্থিবতা, অন্য কার অস্তিত্ব ক্রমশ গ্রাস করতে শুরু করেছে আমায় যা এতক্ষণ টের পেলেও নিজের মধ্যে হয়তো অনুভব করিনি এতটা...!
আমার পেছনে দাঁড়িয়ে গুলাম মহম্মদ বললো,' যেগুলো লতাপাতার খোদাইকার্য ওগুলো চিরঞ্জিলালের মস্তিষ্ক প্রসূত। ওঁরই হাতে গড়া। আর বাকিগুলো অলংকার সমৃদ্ধ ফার্সি ক্যালিগ্রাফি। আমানত খাঁয়ের নিজস্ব সৃষ্টি। কিছু মহম্মদের বাণী, কিছু আল্লাহের কোলে চিরনিদ্রায় শায়িত মমতাজ প্রশস্তি। যে নিদর্শন গম্বুজের বাইরেও দেখে এলেন। পাথরের খাঁজে খাঁজে কত যে মণি মানিক্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠতো সেদিনের এই কক্ষ...সেসব দুষ্প্রাপ্য রত্ন আজ আর অবশিষ্ট নেই কিছুই। আসল ঝাড়বাতি... ১৮৫৭ এর মহাবিদ্রোহের সময় সব খুলে নেওয়া হয়েছে। যেটা দেখছেন, এ বাতি কায়রো জাদুঘর থেকে আনানো। লর্ড কার্জনের আনুকুল্যে। এমনকি এই প্রাচীণ গোম্বুজের উপরিতলে চূড়ার একেবারে মাথায় যে স্বর্ণদন্ডটি একদা স্বর্গের অনুপম আলো হয়ে লোকচক্ষে দৃশ্যমাণ হতো, আঠারো শতকের পর আর কেউ সে দন্ডের অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি। বর্তমানে যেটি রয়েছে সেটি কাঁসা অথবা তাম্র নির্মিত কিছু একটা হবে।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ' কক্ষে আলো জ্বলছে না কেন?'
হা হা করে এবার হেসে উঠলো গুলাম।
' কে জ্বালাবে? লোক কোথায়?'
' মানে? কেয়ারটেকার থাকে না?'
' এখন এই মুহূর্তে আমি ছাড়া আর কেউ এখানে থাকে না। আবার সবাই আসবে ভোর হলে। কবরের তলায় ঘুমিয়ে আছে যে ইতিহাস, তাকে জাগানোর সাধ্য বা সাহস কোনোটাই ওদের নেই। বুঝলেন কিছু?'
মনে হলো যেন স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে গুলাম। মুখটা কেমন যেন অন্ধকারে ঢেকে আছে ওর। আলো কম বলেই কি?হবে হয়তো। ততক্ষণে আমাকে প্রবলভাবে টানতে শুরু করেছে ঐ ওপাশে সুরঙ্গের মতো নেমে যাওয়া একটা গহ্বর।
আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই গুলাম আমায় স্মরণ করিয়ে দিল, 'তাজের একটা নিজস্ব আলো আছে জানেন তো? সেই আলো কখনো কখনো কাউকে একাএকাই টেনে নিয়ে আসে...ঠিক আপনারই মতোন। নিজে থেকে যখন এতদূর চলে এলেন, আশা করি বাকি পথটুকুও....। চলুন জাঁহাপনা, এবার ঐ গহ্বর ধরে মূল সমাধি কক্ষে প্রবেশ করি। সেখানে প্রবেশের আগে অবশ্য আরো কয়েকটি কক্ষ পড়বে। প্রধান কক্ষে দুটি অমর স্মৃতি ফলক রয়েছে। সম্রাট, সম্রাগ্যির নামাঙ্কিত। তার এক স্তর নীচে অপরূপ নকশায় সুসজ্জিত পাশাপাশি দুটো শ্বেতশুভ্র সমাধি বেদি আজও একই রকম অমলিন। সেখানে অনন্ত শয্যায় শায়িত সম্রাট শাহজাহান আর তাঁর পরম প্রিয়তমা পত্নী আন্জুমান্দ বেগম। খুব অন্ধকার কিন্তু। অনেকটা গভীর সুড়ঙ্গ। পারবেন তো নামতে?'
' হ্যাঁ হ্যাঁ পারবো। চলো।'
' আমি জানি আপনি পারবেন।'
মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে গেলাম আমি সুড়ঙ্গ পথের দিকে।
ঘন অন্ধকার গহ্বর। আন্দাজে বুঝতে পারছি ছোট ছোট সিঁড়ি নেমে গেছে একেবারে সমাধি কক্ষ পর্যন্ত।
' আসুন। দেখে আসুন।' বলে আমার সামনে দিয়ে গুলাম নেমে গেল এক পা এক পা করে সিঁড়ি বেয়ে।
একটু একটু করে সিঁড়ি ভাঙছি আমিও।
'গুলাম। গুলাম। একটু আস্তে চলো। আমি দেখতে পাচ্ছি না কিছু। গুলাম...!'
কোনো সাড়া পেলাম না কারো। কোথায় হারিয়ে গেল লোকটা? প্রথম থেকেই ওর চলন বলন হঠাৎ হঠাৎ কিরকম যেন সন্দেহের উদ্রেক করছিল মনে। এবার সেই সন্দেহটা যেন বেড়ে গেল বহুগুণ। এই নিকশ কালো অন্ধকারে, মাত্র কিছুসময়ের মধ্যে কোথায়ই বা হারিয়ে যেতে পারে বৃদ্ধ লোকটা! যতই এপথ ওর নখদর্পণে থাকুক। এই পরিস্থিতিতে, এত কম সময়ে, এত তাড়াতাড়ি পথ চলা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব?
' গুলাম..!'
জোড় গলায় চেচিঁয়ে উঠলাম। চিৎকারের শব্দটা ভেতরের কোন্ গভীর অতল থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এলো মাত্র।
আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কোথায় দাঁড়িয়ে পড়েছি জানি না। ঘন কালো ছাড়া আর কোথাও কোনো রং নেই চারিপাশে। তবে বেশ বুঝতে পারছি এই সুড়ঙ্গ পথ আরো গভীর সুড়ঙ্গের দিকে নেমে গেছে। কতটা গভীর তা আমি জানি না।
......' টগবগ টগবগ টগবগ টগবগ.....চিঁহি চিঁহি চিঁহি..!'
অনেকদূর থেকে আসা একটা ঘোড়ার পায়ের শব্দ। সেই সঙ্গে থেকে থেকে হ্রেষাধ্বনি...!
আমি কাঠের মতো স্তব্ধ হয়ে একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকি। কান খাড়া করে শুনছি শব্দটা।
স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে হতে একসময় তাজমহলের প্রধান ফটকের একেবারে সামনে এসে থেমে যায় শব্দটা।
মিনিট কয়েক সব চুপচাপ। হঠাৎই আমার কানে পরিষ্কার ভেসে এলো ঝুমুর পড়া একটা মেয়েলি পায়ের আওয়াজ। সুড়ঙ্গপথ ধরে গভীর অন্ধকারের ভেতর থেকে এক পা একপা করে এগিয়ে আসছে সে শব্দ... আমারই দিকে। সেই সঙ্গে বিনিয়ে বিনিয়ে একটা হালকা নারীকণ্ঠের কান্নার আওয়াজ।
কে যেন উঠে আসছে সিঁড়ি বেয়ে, বুক চাপা কান্না সাথে নিয়ে ...ধাপে ধাপে....একপা... একপা...একপা...!
ঐ হ্রেষাধ্বনি, ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ, নারীকণ্ঠের বুকচাপা কান্না,ঝুমুরের শব্দ...যেন কোন্ অদৃশ্যলোকের পথ ধরে নিকশ অন্ধকারের মাঝে ঘিরে ধরতে শুরু করেছে আমার চারিপার্স্বস্থ পৃথিবীকে। বিদ্যুৎপৃষ্ঠের মতো সর্বাঙ্গে এক অদ্ভুত শিহরন খেলে যাচ্ছে আমার। আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করে চলেছি সেই ভয়াল, ভীষণ অন্ধকারকে বিদীর্ণ করতে....দিশেহারার মতো এধার ওধার তাকাচ্ছি শুধু একটু আলো যদি কোথাও পাই....একফোঁটা আলোর রেখা...!
' গুলাম..!'
ডাকটা আবার বেরিয়ে এলো কন্ঠনালী চিরে যেন।
....' হা হা হা হা...'
হঠাৎ....হঠাৎই নীচেকার গভীর সুড়ঙ্গ থেকে উঠে আসা পুরুষ কন্ঠের এক প্রবল অট্টহাস্যে যেন ফেটে পড়লো চতুর্দিক। কি নিষ্ঠুর,কি নির্মম, কি ভয়ানক সে হাসির সুর...!
আমি প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছি ওপরে উঠতে।
আচমকা নীচ থেকে উঠে আসা একটা কার হাত এসে চেপে ধরলো আমার পায়ের কাছটা। যে হাত কোনো রক্তমাংসের হাত নয়। শুধু কয়েকটা হাড়ের সমষ্টিমাত্র।
ঘুমটা ভেঙে গেল ঠিক সেই সময়। চোখ মেলতেই দেখি জানলা দিয়ে ভোরের আলো এসে পড়েছে। কাজের লোক রতন চা নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার আগ্রা ভ্রমণের তরতাজা স্মৃতি যে এইভাবে ফিরে আসবে স্বপ্নের পথ ধরে...বুঝতেই পারিনি!
কাগজ - শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
কাগজ
শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
নিজের লাইব্রেরি রুমে চিন্তান্বিত ভঙ্গিতে বসেছিলেন মল্লার বাবু। ডান হাতে ফাউন্টেন পেন আর এক হাতে ধরা একটা ওয়াইন গ্লাসে আধখাওয়া হুইস্কি এখনো পড়ে রয়েছে। তাঁর সাধের ইজরায়েলি স্কচ লিখতে লিখতে অনেক ক্রূশিয়াল মোমেন্টে তাঁকে বুস্ট আপ করতে সাহায্য করেছে..এ অভিগ্যতা মল্লার বাবুর জীবনে কম হয় নি। কিন্তু এবারকার এক্সপেরিয়েন্স যেন একেবারেই ভিন্ন। চিন্তার জটে পড়ে এমন হাবুডুবু মল্লার বাবু আগে কখনো খেয়েছেন কিনা, সত্যিই তাঁর মনে পড়ে না।
সামনে লেখার কাগজগুলো বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে। একটা কালির দাগও তাতে এখনো পড়ে নি। এখনো অবধি দু -দুটো উপন্যাস আর তিন তিনটে ছোটো গল্পের পর এবারের মতো শারদীয়া সংখ্যার জন্য এটাই তাঁর শেষ লেখা।তারপর আপাতত কয়েক মাসের ছুটি। আবার নতুন করে শুরু...।
কিন্তু শেষকালে এসে এই একটা লেখাই যেন মল্লার বাবুর রাতের সমস্ত ঘুম কেড়ে নিয়েছে। দিন কয়েক ধরে হাজার ভেবেও একটা ছোটো গল্পের প্লটও মাথায় এলো না এখনো। 'ভারত ' পত্রিকার সম্পাদক অঘোর বাবু গতকাল আরো একবার এসে ঘুরে গেছেন। কড়জোড়ে তাগাদা দিয়ে গেছেন... ' স্যার, মানে বলছিলাম, প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি...। আসলে সময় কম। বিস্তর কাজ। জানি আপনাদের মাথার ওপরেও সারা বছরের চাপ... এইমাত্র কবি সারদা মল্লিক এর বাড়ি হয়ে এলাম। তিনিও আরো দিন দুই সময় চেয়েছেন... এই টাগ অব ওয়ারের মাঝে পড়ে কি যে নাজেহাল অবস্থা...!'
' আজ সোমবার। বুধবার দিন ডেফিনিটলি আপনার গল্প পেয়ে যাবেন। ' স্তোকবাক্য দিয়ে এ যাত্রার মতো সম্পাদক মশাইকে ঠেকানো গেলেও সময়কে কি আর বাগে আনা যায়..। দেখতে দেখতে রাত পেরিয়ে পরের দিন সকালও গড়িয়ে গেল। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত একটা জুতসই কাহিনিও মাথায় এলো না মল্লার বাবুর। এ ঘটনা তাঁর পঁয়ত্রিশ বছরের লেখক জীবনে অভূতপূর্ব। গতরাত্রে আচমকাই একটা ছোটো গল্পের প্লট মাথায় এসে গিয়েছিল।গল্পের নামকরণও করে ফেলেছিলেন..'অন্ধকার।' কিন্তু লেখা শেষ করার পর কেন জানি না তাঁর মনে হলো, সত্যিই এটা ঠিক কী হলো? এমন কাঁচা,দূর্বল, জঘন্য মাণের গল্প তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, আশা করা যায় কখনো? এ যেন নেহাৎই লেখার জন্য লেখা। এর বেশি কিছু নয়। এমন লেখা আর যাই হোক, আলোর মুখ দেখতে পারে না। গল্পটা রিজেক্ট করতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হলো না মল্লার বাবুকে। বাতিল করে দেওয়া কাগজ গুলো এখনো পড়ে রয়েছে তাঁর সামনে টেবিলের এক কোণে। একজন লেখক কি এইভাবেই ক্রমশ ফুরিয়ে যায়...?এখনই..এত তাড়াতাড়ি! না না তা কি করে হয়!………..চেয়ার ছেড়ে উঠে অস্থির চিত্তে পায়চারি করতে থাকেন মল্লার বাবু। হঠাৎই তাঁর মনে পড়ে যায় বহু বছর আগে জীবনের একেবারে প্রথম দিকে একটা নামকরা বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে তিনি একটা শর্ট স্টোরি লিখেছিলেন। যে কোনো কারণেই হোক লেখাটা আর পত্রিকায় পাঠানো হয়নি। রিডিং রুমের শেল্ফগুলো খুঁজলে এখনো সেটা পাওয়া যেতে পারে। আচ্ছা,যদি ঐ লেখাটাই অঘোর মাইতির হাতে তুলে দেওয়া হয় তাহলে কেমন হয়?তাতে আর যাই হোক মান সম্মান টা বাঁচবে । চেয়ার ছেড়ে উঠে রিডিং রুমের দিকে যেতে গিয়েও কি মনে করে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন মল্লার বাবু। সত্যিসত্যিই কি বাঁচবে মান সম্মান? এ লেখা পত্রিকায় ছাপা হলে পাঠক সমাজের কাছে হয়তো জোড়ালো সমালোচনার মুখোমুখি হতে হবে তাকে। শুনতে হবে, এটা সাহিত্যিক মল্লার চৌধুরীর নিজের লেখা নয়। বিদেশি গল্পের স্পষ্ট অনুকরণ...। এককথায় নকল। হোক না সমালোচনা। একজন লেখককে ঘিরে ক্রিটিসিজ্ম থাকবে না, এ তো হয় না। তাছাড়া তিনি তো অভূতপূর্ব কিছু করছেন না। বিশ্ব সাহিত্যে যুগে যুগে স্থান পেয়েছে এমন বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে রচিত লেখার সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। মল্লার বাবু চাইলে হাতে গুণে নামও বলে দিতে পারবেন। লোকে একদিন সমালোচনা করবে, দুদিন করবে... তারপর আস্তে আস্তে ভুলে যাবে; বছরকে বছর পুরনো হয়ে যাওয়া শারদীয়া পত্রিকার বিস্মৃতপ্রায় মলাটের মতো। এটাই জীবনের নিয়ম। কিন্তু আজ বাদে কাল যদি অঘোর বাবু এসে দেখেন গোটা গল্প দাঁড় করানো দূরের কথা মল্লার বাবু এখনো একটা লাইন পর্যন্ত লিখে উঠতে পারেননি... কী ধারণা জন্মাবে ওঁর মনে? অঘোর মাইতির সামনে কতখানি ফেস লস হবে তাঁর!সীদ্ধান্ত একপ্রকার নিয়েই ফেললেন মল্লার বাবু। ঐ পান্ডুলিপিখানাই তাঁকে উদ্ধার করতে পারে এই সংকটের হাত থেকে। এছাড়া আর কোনো রাস্তা অন্তত এই মূহুর্তে তাঁর মাথায় কাজ করছে না। 'স্যার...।' মল্লার বাবুর সেক্রেটারি অজিত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। 'কিছু বলবে? ' 'এক ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করবে বলে অনেকক্ষন থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন?' 'কে?কী নাম'? ' নাম বললো অরূপ সেনগুপ্ত।' ' সে আবার কে?' 'গত শনিবার কৃষ্ননগর থেকে ফেরার পথে আপনার সঙ্গে নাকি ট্রেনে আলাপ পরিচয় হয়েছিল তার।' মনে করতে খুব বেশি সময় লাগলো না মল্লার বাবুর। সেদিন কৃষ্ণনগরে একটা সাহিত্য সভার আসর সেরে ফিরছিলেন তিনি। গাড়িটা খারাপ হয়ে যাওয়ায় অত রাত্রে ট্রেনেই ফিরতে হয়েছিল তাঁকে।প্রায় নিরালা কম্পার্টমেন্টে একটি ছেলের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তাঁর। অনেকটা সময় ধরে ওর সঙ্গে কথা হয়েছিল বলে ঘটনাটা পরিষ্কার মনে আছে মল্লার বাবুর।ট্রেনে একা একা বসে একঘেয়েমি ধরানোর চাইতে তিনি বেশ উপভোগ করছিলেন ছেলেটির সঙ্গ। বেকার ছেলে।চাকরি বাকরির চেষ্টা করছে বটে,কিম্তু ওসবের থেকেও সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ তার মধ্যে অনেক বেশি তীব্র।বাবার কাছ থেকে পাওয়া পকেট খরচা জমিয়ে মাসে দুটো একটা করে সাহিত্য পত্রিকা তার কেনা চাইই চাই। বই পড়ার মতোই গল্প লেখাটাও তার নাকি আর একটা ভালোবাসা।কিন্তু ছেলেটির পরিবারে বা তার পরিচিত মহলে এমন কেউ নেই যারা তাকে এ ব্যাপারে কোনোরকম উৎসাহ জোগাতে পারে। বরং নিরুৎসাহিত করার লোকের সংখ্যাই যেন বেশি। ছেলেটির বাবার একটা মুূদিখানার দোকান রয়েছে। ভদ্রলোকের অতীব ইচ্ছে, ছেলে এখন থেকে ব্যাবসা পত্তর শিখুক। হাত পাকাক। একদিন তো ধরতেই হবে দোকানের হাল। নয়তো কে দেখবে। সাধারণভাবে গ্র্যাজুয়েশন পাশ করে আজকের দিনে চাকরির দরজা পেরোনো যে কতটা কঠিন তা ভদ্রলোক নিজে যেমন বোঝেন, হয়তো তার ছেলেরও বিষয়টা অজানা নয়। তবু মুদির দোকানের ঐ বদ্ধ খাঁচার মধ্যে ভ্যান ভ্যান করতে থাকা মাছি, ভেলি গুড়,রেড়ির তেলের গন্ধ, দর কষাকষির খেলা আর অসাড় খেড়ো খাতায় মুখ ডুবিয়ে,নিদাঘ মধ্যাহ্নে সিন্দুকের সামনে গদি আঁটা টুলে বসে পাখার বাতাস খেতে খেতে নিজের ভালোলাগার ক্ষেত্রটিকে জলান্জলি দিতে কিছুতেই রাজী নয় ছেলেটি।তার নিজের কথায়, মল্লার বাবুর মতো মানুষের সঙ্গে এইভাবে যে ওর কোনোদিন আলাপ হতে পারে এ যেন তার কাছে স্বপ্নের মতো। প্যারাডক্স। মনে হচ্ছে জীবনের সবথেকে বড় পাওয়াটা ভগবান বুঝি তাকে পাইয়ে দিয়েছেন। ট্রেনে যতটা সময় ছেলেটি ছিল ততক্ষনই যেন মল্লার বাবুকে ঘিরে এক অদ্ভুত বিস্ময় আর সম্ভ্রম তার চোখে মুখে খেলা করছিল। রানাঘাট ষ্টেশনে নেমে যায় ছেলেটি। যাবার আগে একটা অনুরোধ রেখেছিল সে। তার নিজের লেখা অনেকগুলো ছোটো গল্পের মধ্যে যেটা তার চোখে বেস্ট চয়েস হিসেবে চিহ্নিত, সেই লেখাটা নিয়ে একদিন যদি সে মল্লার বাবুর বাড়িতে গিয়ে দেখা করে তাতে কোনো অসুবিধে আছে কিনা। লেখা সম্পর্কে লেখক মশাইয়ের মূল্যবাণ মতামত তার জীবনের পাথেয় হয়ে থাকবে। ছেলেটির কথাবার্তা শুনে কোথায় যেন তার প্রতি একটা তাৎখণিক ভালোলাগাবোধ জেগে উঠেছিল মল্লার বাবুর মনে।সৌজন্যের খাতিরে তার সে অনুরোধে না করতে পারেন নি তিনি। কিন্তু সেদিন ছিল এক পরিস্থিতি। আজ এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে কারো সাথে দেখা করা বা কথা বলার মতো সময় কিংবা মন কোনোটাই তাঁর নেই।সেক্রেটারিকে তিনি বললেন, 'গিয়ে বলো আমি একটা বিশেষ জরুরি কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছি। পরে দেখা করতে... আর হ্যাঁ, এই কাগজগুলো একটু বাইরে ওয়েস্ট পেপার বাক্সে ফেলে দাও তো.. এ আর কোনো কাজে লাগবে না।' ফেলে দেওয়া গল্পের সেই স্ক্রিপ্ট গুলো অজিত এর হাতে তুলে দিলেন মল্লার বাবু। কিছুক্ষণ পর অজিত ফিরে এলো। 'ভদ্রলোক এই কাগজটা আপনাকে দিতে বলেছেন। ' কয়েকলাইনে লেখা একটা চিঠি। খানিকটা কৌতুহলী হয়ে মল্লার বাবু চিঠিখানা পড়তে শুরু করলেন।... 'স্যার, গত কদিন ধরে আপনাকে অনেকবার ফোনে ধরতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত যোগাযোগ হয় নি। আমার নিজের ডায়েরির পাতা থেকে বাছাই করা একটা ছোটোগল্প আপনাকে দেখাবো বলে নিয়ে এসেছিলাম। সেটা হলো না বলে প্রথমটায় বেশ খারাপই লাগছিল। কিন্তু তার বদলে আজ যে জিনিসটা পেলাম তাতে আমার খারাপ লাগা সবটুকু অনূভুতি নিমেষেই মুছে গেছে। তখন সেক্রেটারি স্যার ওয়েস্ট পেপার বাক্সে কিছু কাগজ ফেলে রেখে গিয়েছিলেন। পাশে দাঁড়ানো সিকিউরিটি গার্ড ভদ্রলোকের কি একটা কথার উত্তরে শুনছিলাম উনি বলছিলেন "একটা গল্প নিয়ে কদিন ধরে স্যারের খুব মেন্টাল প্রেসার পড়ে গেছে। লেখার পরেও পছন্দ হলো না বলে শেষে এই কাগজগুলো বাতিল করে দিলেন"। ওনারা চলে গেলে কাগজকটা তুলে নিয়ে দেখি ওগুলো 'অন্ধকার 'নামে কোনো একটা গল্পের পান্ডুলিপি। ম্যানাসক্রিপ্টটা আমি সাথে করে নিয়ে গেলাম স্যার। আপনাকে না জানিয়ে কাজটা করে ফেলার জন্য বিশেষ ভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। ভালো থাকবেন। পুজোয় আপনার নতুন গল্পের অপেক্ষায় রইলাম। ইতি- আপনার গুণমুগ্ধ পাঠক অরুপ সেনগুপ্ত।'.......।
ফাউন্টেন পেন এ লেখা গোটা গোটা হরফ। হতভম্বের মতো কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে চিঠিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন মল্লার বাবু।হঠাৎ তাঁর মনে পড়লো, ছেলেটা সেদিন একটা চিরকুটে নিজের মোবাইল নম্বর লিখে দিয়েছিল। এখনই ওকে ফোন করা দরকার। লাইনটা পাওয়া ভীষণ জরুরি। ব্যস্ততার সঙ্গে ওয়ালেট থেকে চিরকুটটা বের করে রিং করলেন মল্লার বাবু।... 'হ্যালো। আমি মল্লার চৌধুরী বলছি। তুমি অরূপ তো?' 'স্যার আপনি! বলুন...।' এমন একটা দামী ফোন যে আসতে পারে, ওপাশের ব্যক্তিটি যেন কল্পনাই করতে পারে নি। কিন্তু এবারে যে প্রশ্নটা ধেয়ে এলো সেটা যেন তার কাছে আরো বেশি আনএক্সপেক্টেড।...' শোনো তুমি যেটা করেছো একেবারেই ঠিক করো নি। কাউকে কিছু না জানিয়ে এমন একটা কাজ করলে কি করে...?' আচমকা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় ছেলেটি। ' স্যার, ইয়ে, মানে আমি খুব অন্যায় করে ফেলেছি.. আসলে ডাস্টবিনে কাগজগুলো পড়েছিল, তাই ভাবলাম...। ' ' তাই সটান ওগুলো নিয়ে চলে গেলে...। ঐ ফেলে দেওয়া লেখাটা তোমার কোন্ কাজে লাগবে শুনি..?'' স্যার, আসলে আমি অনেক আশা করে...।' 'আশা.. কিসের আশা...।' মল্লার বাবুর ক্ষোভের পারদটা যেন আরো এক কাঠি বেড়ে গেল। 'ঐ রিজেক্টেড লেখা তুমি কাকে দেখাবে ?যার হাতে এ লেখা পড়বে, সে কি খুব বাহবা দেবে ভেবেছো, অ্যাঁ? যেখানে আমি নিজেই নিজেরটা বাতিল করে দিয়েছি সেখানে কেন তুমি এই কাজটা করতে গেলে...? শোনো তুমি এখন কোথায়? কত দূরে?'মল্লার বাবুর ধমকের সুরে নার্ভাস হয়ে তোতলাতে থাকে ছেলেটি।' স্যা..স্যার...আমি মানে আ..আমি তো এখন বাসে.. ল্যান্সডাউন ছাড়িয়ে... '। 'তুমি যেখানেই থাকো এসে ঐ কাগজগুলো ফেরৎ দিয়ে যাও... ।' এবার যেন ভেঙে পড়ে ছেলেটি। 'স্যার আমার কথাটা, মানে একবারটি শুনুন... কাউকে দেখানোর জন্য এ কাজ আমি করিনি স্যার...'। 'তাহলে কিসের জন্য করেছো?' আমতা আমতা স্বরে উত্তর আসে 'ভেবেছিলাম স্যার,পাণ্ডুলিপি খানা নিজস্ব সংগ্রহে রেখে দেবো।আমার একটা বড় যত্নের ফাইল আছে তার মধ্যে... লেখাটা শুধু আমার মন জুড়েই থেকে যাবে... '।অবাক হয়ে গেলেন মল্লার বাবু।কিছুটা নরম সুরে বললেন,'কিন্তু সব লেখা তো আর গল্প হয় না..।' বিনয়ী কন্ঠে ভেসে আসে,' আপনার মতো মানুষের কলমের আঁচড়টুকু তো থেকে যাবে। জীবনে এও কি কিছু কম পাওয়া স্যার..'। এরপর আর যুক্তি চলে না।একটুক্ষন থেমে মল্লার বাবু বললেন, ' বেশ তোমার যখন এতই আগ্রহ তখন আর ও জিনিস ফেরৎ দিতে হবে না। তবে এটাও বলি, আজ থেকে এ লেখাটার ওপর কোনো দায় কিন্তু আমার আর রইল না..'। হঠাৎই উৎফুল্ল কন্ঠে আওয়াজ শোনা যায়,' আপনার মুখের কথাটুকুই অনেক। বিশ্বাস করুন স্যার আর আমার কোনো অপরাধবোধ রইলো না..'।
ফোনটা রেখে চোখ বন্ধ করে বেশ খানিক্ষণ চেয়ারে বসে রইলেন মল্লার বাবু। ফেলে দেওয়া কয়েকটা কাগজের পাতা হঠাৎ করে এতটা মহার্ঘ হয়ে উঠতে পারে তা যে তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি। মল্লার বাবুর মনে হলো জীবনে এতদূর প্রত্যাশা কি তিনি সত্যিই কোনো পাঠকের কাছ থেকে করেছিলেন? ভাবতে গিয়ে হঠাৎই ভারত পত্রিকার জন্য একটা ঝকঝকে টাটকা ছোটো গল্পের প্লট যেন বিদ্যুৎের মতো ঝলক দিয়ে উঠলো তাঁর মস্তিষ্কে...যে গল্পের মূল কেন্দ্রীয় চরিত্র দুজন। একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক। আরএকজন তাঁরই গুণমুগ্ধ এক পাঠক। যার সঙ্গে ঘটনাচক্রে ট্রেনের কামরায় লেখক এর পরিচয় এবং তারই সূত্র ধরে কাহিনির অগ্রগতি ;পরিশেষে আজকের অভিজ্ঞতা। শুধু চরিত্রের নামগুলো অদলবদল করে দিতে হবে এই যা...। এক বেলার মধ্যে গল্পটা শেষ করার টার্গেট মাথায় রেখে কলম ধরলেন মল্লার বাবু। তার আগে প্রিয় পাঠকটিকে একবার বড়সড় ধন্যবাদ না জানিয়ে পারলেন না তিনি।
পরের দিন ঠিক বেলা বারোটা নাগাদ অঘোর বাবু এলেন আশা নিরাশার মাঝে একরাশ দোলাচল নিয়ে। মল্লার বাবু তাঁর আধ ঘন্টা আগে শেষ করা গল্পের ম্যানস্ক্রিপ্টটা এগিয়ে দেবার সাথে সাথেই ভদ্রলোকের নাদুসনুদুস গাল জোড়ায় একরাশ হাসি ফুটে উঠলো...'কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ...।'
'একবার গল্পটা পড়ে নিন..আমার দিক থেকে ভুল ত্রুটি যদি কিছু...। ' বললেন মল্লার বাবু।
'ভুল ত্রুটি...কার? আপনার?'
মুখের হাসিটাকে আগের মতোই ধরে রেখে ব্যাগে রাখা একটা রুপোলী কৌটো থেকে পান বের করে মুখে পুরে ভদ্রলোক বললেন, 'দু মিনিট সময় দেন তো একটা ছোট্ট লাইফ হিস্ট্রি তুলে ধরি?'
'দিলাম। বলুন।'
'বছর কুড়ি কি তারও বেশি আগের আগের কথা। এ প্রত্রিকা, সে পত্রিকার অফিসে ম্যানাসক্রিপ্ট বগলদাবা করে ছুটে বেড়াচ্ছি তখন।এভাবেই একদিন এডিটার'স অফিসে আপনার সঙ্গে পরিচয়..কি তাই তো? আপনি তখন মোটামুটি নাম করেছেন লেখালেখির জগতে। আর আমিও ঠিক আপনারই মতো চোখে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি...লেখক হবার স্বপ্ন..।'
অঘোর বাবুর সঙ্গে মল্লার বাবুর চেনা পরিচয় আজকের নয়। লেখক হয়ে ওঠার বাসনা নিয়ে জীবন শুরু করলেও,প্রারম্ভিক স্তরে কিছু কিছু গল্প ছোটোখাটো পত্র পত্রিকায় মোটামুটি জনপ্রিয়তা কুড়োলেও ঐ জায়গা থেকে উঠে তেমন কোনো সাফল্যের সিঁড়ি পেরোনো অঘোর বাবুর পক্ষে আর সম্ভব হয়ে ওঠে নি। সে যাই হোক, লেখালেখির সূত্রেই মল্লার বাবুর সঙ্গে ওঁর পরিচয় আর তারই সুবাদে ভদ্রলোক মাঝেমাঝে আসা যাওয়া করতেন বাড়িতে।
একদিন মল্লার বাবুর কাছে এসে ভদ্রলোক নিজেই বললেন,' না মশাই, অনেক তো চেষ্টা চরিত্র করলাম.. জুতোর শুকতলা খয়ে গেল.. দেখলাম কলমের শুধু একগাদা কালিই খরচা করে গেছি এতদিন...কাজের কাজ ঢুঁঢুঁ...গ্যাটেঁর পয়সা খরচ করে বই ছাপিয়ে লোককে বিলি করা ছাড়া আর তো কোনো রাস্তা দেখছি না.. এ লাইন সবার জন্য নয়...একটা নতুন প্ল্যান মাথায় এসেছে...বাড়ির নীচের তলায় যে পৈতৃক ছাপাখানাটা রয়েছে, বাবা মারা যাবার পর মেশিন পত্তর গুলোতে আর সেভাবে হাত পরেনি কারো। এক ব্যাটা কর্মচারী ছিল, সে অন্য জায়গায় কাজ পেয়ে তারপর থেকে আর আসে না। জিনিস পড়ে আছে। অথচ কাজ জানা লোকের অভাব। ভাবছি নীচের ঘরটাকে নতুন রং টং লাগিয়ে, রিপেয়ারিং করে যদি একটা এডিটিং অফিস খুলতে পারি...লেখা আসবে..,বই হয়ে, ম্যাগাজিন হয়ে ছেপে বেরোবে...কমদিন তো আর এ লাইনে চষে বেড়ালাম না...এডিটিং, শর্টিং,প্রূফ রিডিং... কাজগুলো সব চোখের সামনে, কাছ থেকে দেখেছি... সেই অভিজ্ঞতাকেই কাজে লাগিয়ে যদি একটা অফিস খুলে ফেলা যায়...এবার সত্যিই নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় এসেছে মশাই...কাল রাত্তিরে নীচের তলার ঘরখানা কি মনে করে ঘুরে দেখতে গিয়ে মেশিন পত্তরগুলোর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আইডিয়াটা মাথায় এলো। করতে পারলে কেমন হয় বলুন তো? 'আপনার যখন অভিজ্ঞতা আছে, দেখুনই না। কে বলতে পারে...।'
' বলছেন?'
চোখে মুখে একরাশ উৎসাহ নিয়ে বলেছিলেন অঘোর বাবু।
' অবশ্যই আপনি শুরু করুন।'
' দরকার শুধু দুটো জিনিস দাদা। লোকবল। আর আপনাদের মতো গুণী মাণী মানুষের একটু সাপোর্ট। পাশে থাকবেন তো দাদা? অন্য কিচ্ছু নয়। খালি একটু লেখার মাধ্যমে পাশে থাকা... এই আর কি..।'
তদ্দিনে 'লেখক মল্লার চৌধুরী ' নামটা তড়তড় করে খ্যাতির সিঁড়ি বেয়ে শারদীয়া সংখ্যায় বেস্ট সেলার গল্প, উপন্যাসের তালিকায় মোটামুটি পাকা জায়গা করে নিয়েছে বলাই যায়।
পূর্ব পরিচয় আর সৌযন্যের খাতিরে লেখক জীবনের হাজারো ব্যাস্ততার মাঝেও অসময়ে মানুষটার পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধে না করতে পারেন নি মল্লার বাবু।
সম্পাদক অঘোর মিত্তিরের নতুন পেশাগত জীবনের সেই শুরু। তাঁর সম্পাদিত 'ভারত পত্রিকা' তাঁরই নিজের ছাপাখানা থেকে প্রথম প্রকাশিত হলো... সে প্রায় বহু বছর আগের কথা। সেদিনের সেই ছোটোখাটো কলম পত্রিকা আজ এত বছর পেরিয়ে এসে আকারে,পরিসরে বেড়েছে তো বটেই; পর পর বছর কয়েক হলো বেস্ট সেলার ছোটো পত্রিকার তকমাটাকেও বজায় রাখার ক্ষেত্রে বলা যায় দারুণ ভাবে সফল।
পান চিবোতে চিবোতে অঘোর বাবু বলতে লাগলেন আগের কথার রেশ ধরে.. ' লেখালেখির জগতকে একপ্রকার বিদায় জানিয়ে তখন সবে নতুন প্রফেশান শুরু করেছি। একদিন কি একটা কাজে অন্বেষা পত্রিকার দুঁদে সম্পাদক প্রভাকর সরকারের বেনিয়াটোলা লেনএরঅফিসে গিয়ে ঢুঁ মারলাম। প্রভাকর বাবু এককালে বাবার পুরনো বন্ধু ছিলেন। আগে আমাদের বাড়িতে যাতায়াতও করেছেন কয়েকবার। বাবার অবর্তমানে, সময়ের গতিকে তারপর অবিশ্যি আর...। আমাকে এডিটিং পেশা সম্পর্কে অনেক উৎসাহ ব্যাঞ্জক কথাই বললেন তিনি। শিক্ষানবিশের মতো শুনে গেলাম। অনেক কথার মধ্যে একটা খুব দামী কথা বলেছিলেন সরকার মশাই..."বুঝলে অঘোর, ওয়েষ্ট পেপার বাক্সে ফেলে দেওয়া হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজের গায়ে লেখা অক্ষরও সোনা হয়ে উঠতে পারে, যদি সেটা লেখার মতো লেখা হয়। শুধু দেখবার মতো একটা চোখ দরকার এই যা..।" চোদ্দ বছর হয়ে গেল আমার এ পত্রিকা অফিসের বয়স। সরকার মশাই আজ আর নেই। কিন্তু ওঁর সেদিনের কথা মনে গেঁথে আছে আজও.."দেখবার মতো একটা চোখ "। সাধে কি আর আপনাদের মতো মানুষের অপেক্ষায় হাপিত্যেশ করে বসে থাকি দাদা...ডাস্টবিন থেকে রত্ন খুঁজে নেওয়াই যে আমাদের কাজ..। আপনাদের পাশে না পেলে আজ এ পত্রিকা কটা লোকের কাছে পৌঁছোতো বলুন দেখি? '
ফেলে দেওয়া কাগজ, ডাস্টবিন, রত্ন...প্রতিটা শব্দ যেন অদ্ভুতভাবে কানে এসে বাজছিল মল্লার বাবুর।ভদ্রলোককে আর একটু বাজিয়ে দেখার জন্য হেঁয়ালির সুরে তিনি জিগ্যেস করলেন, 'সবসময় ডাস্টবিন খুঁজলেই বুঝি রত্ন মেলে?'
'তা হয়তো মেলে না। কিন্তু ভাবুন দেখি একবার হলুদ হয়ে যাওয়া ছেঁড়াখোড়া কোনো পাতার গায়ে আপনার কলমের দু দুটো আঁচড় সে পাতার গ্র্যাভিটিকে কোথায় নিয়ে এসে পৌঁছে দেবে..?সোনার আংটির আবার হলমার্ক...। হ্যাঁ, ছাপতে গিয়ে প্রিন্ট মিস্টেক হলে দ্যান্ আই উইল পে ফর দ্যাট...এই নিন স্যার আপনার চেক। আজ তাহলে উঠি।'
কথার সাথে মুখের কষ বেয়ে পানের পিক গড়িয়ে পড়ার উপক্রম হচ্ছিল আর একটু হলেই।রুমাল দিয়ে কোনোক্রমে নিজেকে সামলে নিলেন ভদ্রলোক। মূহুর্তের দৃশ্যটা একটু আগে হলে হয়তো স্বাভাবিক কারণে হাসির উদ্রেক ঘটাতে পারতো মল্লার বাবুর মনে। কিন্তু মূহুর্ত কয়েকের ব্যবধান মানুষের অবস্থানকে বোধহয় সরিয়ে নিয়ে আসতে পারে কয়েক যোজন...।
বিয়ারার চেকটা মল্লার বাবুর হাতে তুলে দিয়ে সম্পাদক মশাই হাসি মুখে বিদায় নিলেন।
ডাস্টবিনে আজ আর পরে নেই কোনো ফেলে দেওয়া গল্পের পান্ডুলিপি। কেউ আসেনি সেই পান্ডুলিপির সন্ধানে। রত্নের খোঁজে। ড্রয়িং রুমে বসে থাকতে থাকতে এক আশ্চর্য অনুভূতি যেন ক্রমেই ঘিরে ধরছিল মল্লার বাবুর চারিপাশের পৃথিবীটাকে। এ বছরের জন্য শারদীয়া পত্রিকায় শেষ ছোটো গল্প.. কলমের শেষ আঁচড়টুকু যে আত্মতৃপ্তির স্বাদ এনে দিয়েছিল মল্লার বাবুর মনে, ঠিক ততোটাই যেন গভীর.. ততোটাই যেন গাঢ় এই মূহুর্তের এই অচেনা অনুভূতি..! গল্পটা পড়ে শেষ করে ওঠার পর একই রকম অনুভূতি হয়তো অঘোর বাবুর মনকেও গ্রাস করবে। করতে বাধ্য....। কি অদ্ভুত! কি আশ্চর্য! এমনটাও হয়...!
সেক্রেটারি অজিত ঘরে এলো।
'স্যার, এই চিঠিটা কেউ ড্রপ বক্সে রেখে গিয়েছিল। সম্ভবত আজই।'
অন্যমনস্ক মনে চিঠিখানা অজিতের হাত থেকে নিয়ে পড়তে যাওয়া মাত্রই চোখদুটো আটকে গেল মল্লার বাবুর। একটা ছোটো কাগজে ফাউন্টেন পেন এ লেখা খুব চেনা গোটা গোটা হরফে কয়েকটা লাইন..."স্যার, মনের মাঝে জমে থাকা কথাগুলো বলবো বলেই আজ এতো সকালে না এসে আর থাকতে পারলাম না। কাউকে না পেয়ে চিঠিখানা ড্রপ বক্সে রেখে গেলাম। কাল আপনার ওখান থেকে বাড়ি ফিরে আসার পর একটা অনুভূতি ক্রমাগত তারিয়ে নিয়ে বেরিয়েছে আমাকে।এ নিয়ে নিজের সঙ্গে কম লড়াই করি নি। বারবার প্রশ্ন করেছি নিজেকে। রাত্রে ভালো করে ঘুমোতে পারি নি। অবশেষে অনেক চিন্তা করে দেখলাম, যে লেখার ওপর আপনার কোনো দায় নেই পাঠক হয়ে সে লেখার ওপর আমারও কোনো দাবি থাকতে পারে না। থাকাটা উচিতও নয়। এ লেখা বরং মুছেই যাক.. শুধু আপনার মন থেকে নয়, আমারো মন থেকে। জানি লেখাটাকে ঘিরে আপনার অনেক টেনশন গেছে। আর চিন্তা করবেন না। কাগজগুলো যেখানে ছিল আবার সেখানেই রেখে গেলাম। ভালো থাকবেন। ইতি - আপনার গুণমুগ্ধ পাঠক...।
.....সমাপ্ত.....
subhanjan Chatterjee