শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

জ্যাঠামশাই - শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

 

জ্যাঠামশাই
শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
 

 
 

এ যখনকার কথা আজকের শহর কাঁচরাপাড়ার ছবিটা তখন এরকম ছিল না। রেলকারখানা এবং তাকে কেন্দ্র করে জীবিকা সূত্রে মানুষের আসা যাওয়া তখন একটু একটু করে বাড়ছে বটে কিন্তু আজকের মতো গা ঘেঁষা জনবসতি সেদিন ছিল না। অল্প মানুষ, ছাড়া ছাড়া  বাড়ি ঘর, কিছু কিছু দোকান পাট, এক দুজন ব্যাবসায়ী শ্রেণির মৌরুসিপাট্টা, সমাজে স্থানীয় গুণীজনের বিশেষ সমাদর...এই নিয়েই ছিল আমাদের সেদিনকার চোখে দেখা অঞ্চল কাঁচরাপাড়া, যার বেশিরভাগটাই মাঠ ঘাট বন বনানী জলাশয়ে ঘেরা। পূর্বপুরুষের মুখে শোনা পুরোনো গ্রাম কাঁচরাপাড়ার সেই রাঙামাটির ছবি তখন ততটাই অতীত, যতটা বর্তমান পূর্বেকার গ্রামজীবন ছাড়িয়ে নতুন নতুন পথ ধরে আসা যাওয়া মানুষের চলমানতা..আর তারই সাথে একটু একটু করে মফস্বল অঞ্চলের শ্রীবৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া আমার সে শৈশবের বেড়ে ওঠা জন্মভূমি। 
আমাদের বাড়ির দরজা খুললেই সামনে দিয়ে বয়ে যেত এক প্রকান্ড পুকুর। যেমন গভীর। তেমনই তার টলটলে জল৷ মাছরাঙা খেলা করতো। ভরা বর্ষায় নৌকা থেকে জাল ফেলা হত সে পুকুরে। ঐ জলেই আমাদের ছোটোবেলায় সাঁতার শেখা। পৌরসভার তৈরি ঐ পুকুরের সিঁড়ি  বাঁধানো দুটো ঘাট ইংরেজ আমলে ব্র্যাডলে সিম্পসন নামে রেল কারখানার এক ওয়ার্কস ম্যানেজারের হাতে উদ্বোধন করা হয়েছিল বলে ঘাটের পাশে তারই নামাঙ্কিত সিমেন্টের একটি ফলক স্বযত্নে সেখানে স্থাপন করা হয়। সেই থেকে আম জনতার কাছে পুকুরটি  ব্র্যাডলে ট্যাঙ্কের পুকুর নামে পরিচিত। পুকুরের ধার ঘেঁষে  নতুন পিচ ঢালা রাস্তা পৌরপ্রধানের নিজের উদ্যোগে তৈরি একতলা স্কুল বাড়ি, পৌরভবন, এ অঞ্চলের ভূমিপুত্র বিপ্লবী বিপিন বিহারি গাঙ্গুলির স্মৃতিতে তৈরি বিপিন স্মৃতি পাঠাগার, জনবসতিকে ডান হাতে রেখে সোজাপথ ধরে চলে গেছে বহুদূর। পুকুরের ওধারে সুবিস্তৃত রেল লাইন...বড় বড় কয়লার ইঞ্জিন গুলো যখন যায়, ঝনঝন করে ওঠে আমাদের বাড়িটা যেন। বাইরের বৈঠক খানা ঘরের খোলা দরজা দিয়ে আমি তখন তাকিয়ে থাকি। মিলিয়ে যায় হুইসিলের শব্দ, আকাশের পথে ভাসমান কালো কালো ধোঁয়াগুলো আরো কিছু সময় ভেসে চলে আমার মনোরাজ্যে...একলা দুপুর বেলা 'শিল কাটাও 'বলতে বলতে হেঁকে চলে যায় ফেরীআলা...এক রাস্তা ছাড়িয়ে আর এক রাস্তায় মিলিয়ে যায় সে মানুষ...মন উদাস করা ডাকটুকু রয়ে যায় তারপরেও কোথায় যেন....চৈত্রের নিঃসঙ্গ হাওয়া শনশন শব্দে বয়ে যায় পেয়ারা, নিম, সরকার বাড়ির আম গাছের পাতায়...পাঁচ পয়সার আইসক্রিমআলা ঘন্টি বাজাতে বাজতে এগিয়ে আসে পুকুর পাড়ের রাস্তা ধরে ক্রমশ এদিকে....কুলুঙ্গির ভেতর মায়ের রেখে দেওয়া মরচে ধরা টিনের বাক্স থেকে নয়া পয়সা সরিয়ে নিঃশব্দে  খিড়কি দোর খুলে ছুটে যাই গাড়ির পেছনে.... বেলা ডুবে আসে সূর্যের কোলে...বিচুলি বোঝাই গরুর গাড়ি হেলতে দুলতে অবসন্ন চিত্তে এগিয়ে যায় আমার বাড়ির খিড়কি দরজার সামনে দিয়ে...পুকুরের জলে শেষ বিকেলের আলো আঁক কাটে জলছবি হয়ে....বেলা শেষে বাড়ি ফেরে হাঁসের দল....সন্ধ্যা নামে...বাবা ফিরে আসেন ওকালতির কাজ সেরে...মা তুলসী মঞ্চে শাঁখ বাজিয়ে রান্নাঘরে যান চা বসাতে...আমরা গোল হয়ে বসে ভাই বোনেরা মিলে পড়াশোনা করি...রাত বাড়ে...ঝিঁ ঝিঁ পোকার সুর তত স্পষ্ট হয়...আমাদের বাড়ির পাঁচিল ঘেঁষা দেহাতি বসতির একচালা ঘরে রোজকার মতো রামগানের ভোজপুরী সুর ভেসে আসে...' রঘুপতি রাঘব রাজা রাম...পতিত পাবন...'
এসবকিছুই আমার শৈশবের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়ানো স্মৃতি। সময়ের সাথে ধীরে ধীরে পালটে যায় কত ছবি , কিছু বা ফিকে হয়ে আসে, নতুন রঙের প্রলেপ পড়ে....ফ্যাকাশে অ্যালবাম আলো হয়ে রয়ে যায় কালের বুকে। 
জনবসতি বাড়ে ব্যবসা, রেল কারখানার হাত ধরে। কাজের সুবাদে ভিন রাজ্য থেকে আসা মানুষ, ওপার বাংলার মানুষের আনাগোনায় রেল সংলগ্ন বৃটিশ আমলের বাড়ি, জায়গাগুলো নামের আড়ালে এক এক করে সাধারণের কলোনীতে পরিনত হয়... আর এক ধারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় পুরোনো কাঁচরাপাড়ার এদেশি, ব্যাবসায়ী বনেদিআনা। আমার বাড়ির পাঁচিলের গায়ে সেই দেহাতি খোট্টা লোকটি এখন আর সন্ধ্যাকালে রামগানের আওয়াজ তোলে না। পঙ্গু স্বামীর পাশে বসে বসে ওর স্ত্রী আকাশের দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে সুর তোলে...' রঘুপতি রাঘব...'
রাস্তার ধারের ব্র্যাডলে ট্যাঙ্কের পুকুর আমাদের খিড়কি দোর ছাড়িয়ে একটু একটু করে দূরে সরে আসে....পলিমাটির চরাটুকু বড় হতে হতে কবে যেন স্টেশনে যাওয়া আসার নতুন পথ, ছেলেপিলেদের খেলার মাঠে পরিণত হয়...আমার এককালের পড়ে আসা দরমার বেড়া আর টালির ছাউনি দেওয়া স্কুল বাড়ির ঘরগুলো পাকা কংক্রিটের ওপর ভর দিয়ে একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখে....পৌরসভা, দমকল,শিবানী হাসপাতাল, বিপিন পাঠাগার হয়ে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে কত নতুন নতুন মানুষ, হামেশাই কত যানবাহন আজকাল চলাচল করে.. দেখি তাই বসে বসে। 
ছেদ পড়ে না গরুর গাড়ির আসা যাওয়ায়...শুধু টা টা করে চলে গিয়েছে বিচুলির গাড়ির পেছন পেছন ধাওয়া করে বেড়ানোর সেই মুহূর্তগুলো....ফিকে হয় না স্নান ঘাটের পাশে সিমেন্ট ফলকের গায়ে কালো রঙে খোদাই করা ব্র্যাডলে সাহেবের নামটুকু,আমাদের ' কমলাবাস' বাড়িটাকে ঘিরে ভাই বোনেদের আনন্দ...ভর দুপুরে আইসক্রিম গাড়ির ঘন্টির আওয়াজ...হারিয়ে গিয়েছে কেবল পাঁচ পয়সার জন্য মায়ের ঘুমোবার অপেক্ষায় চুপটি করে বসে থাকা সেইসব ঘুঘু ডাকা অলস মধ্যাহ্ন....ছিঁচকে চোরের মতো সদর দরজার ছিটকানি খুলে ঘন্টি কাকুর পিছু নেওয়া সেই সব অমূল্য সময়....বাড়ির উল্টোদিকে রাস্তার ধারে হেলে পড়া  সরকারদের আমগাছটায় বোল ফোটে এখনো....নিদাঘ মধ্যাহ্নে বন্ধুরা মিলে তরতাজা আম চুরি করে খাবার সে বয়স অন্তর্হিত হয়েছে কতকাল..! দিনের শেষে শুধু স্বাদটুকুই মুখে লেগে থাকে আজও...। 
এখন আমি প্রি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। বৈঠক খানা ঘরের দরজার সামনে চৌকিতে বসে ইউনিভার্সিটির স্যারের লিখিয়ে দেওয়া নোট চেকোশ্লোভাকিয়ান ক্রাইসিস মুখস্থ করছিলাম। খিড়কি দোর সংলগ্ন ছোট রোয়াকে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছিল আমার থেকে দু বছরের ছোট বোন মিনু। 
' দাদা..দাদা...!'
মিনু ডাকে।
' আঃ! পড়তে দে। একটা শক্ত বিষয় দেখছি। এখন ডিসটার্ব করিস না।'
' দ্যাখ দাদা কিরকম মেঘ করেছে! ঐ ওখানটা কালো হয়ে যেন দৈত্যের মতো এগিয়ে আসছে..!'
 'পরে দেখবো। এখন কথা বলিস না।'
চুল বাঁধা থামিয়ে আকাশের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে মিনু। ' 
খাতার পৃষ্ঠা থেকে ঝলকে মুখটা একটু তুলতে এবার বুঝতে পারলাম। 
' হ্যাঁরে তাইতো! '
রেল লাইনের ওপারে ঈশান কোনে তাল,নারকেল গাছের সারির মাথার ওপর ঘন কালো পাহাড় প্রমান মেঘরাশি আকাশ ময় ক্রমশ যেন তার জাল বিস্তার করতে শুরু করেছে।  শেষ বিকেলের কুসুমরঙা আলোর আভা দক্ষিণ পশ্চিম কোণে কিছুটা হলেও স্পর্শ টুকু ছু্ঁয়ে রেখেছে এখনো। কখন যে সেটুকুও ডুবে যায়...।  এদিক ওদিক তাকালাম। চারিদিক অদ্ভুত রকম থমথমে হয়ে এসেছে। অদূরে ভুটিয়াদের বিচুলির দোকান...সেও খোলেনি এখনো। রাস্তাঘাটে জনপ্রাণী নেই বললেই চলে। সাইকেল চড়ে দুটো লোক আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে সাঁ সাঁ করে বেরিয়ে গেল। তিন চারটে সারস পাখি অকাল আঁধারের আশংকায় হুশ করে উড়ে চলে গেল রেললাইন ছাড়িয়ে বহু দূরে গাছ গাছালীর আড়ালে যেখানে মাঠ, জলাশয়ের প্রান্তসীমা টুকু চোখে ভাসে। 
' দাদা কিরকম কালো হয়ে ঢেকে যাচ্ছে দ্যাখ চারিদিকের আকাশটা! বড় একটা ঝড় উঠবে মনে হচ্ছে!'
 পড়াশোনা বন্ধ করে রোয়াকে এসে দাঁড়িয়ে দেখছি দৃশ্যটা। মিনুর ভাষায় 'দৈত্যাকৃতি'র জটাজুটো ধারী কালবৈশাখির মেঘ প্রায় গোটা আকাশটাকে গ্রাস করে নিয়েছে। রাস্তায় লোক নেই, দোকান পাটগুলোও খোলে নি...বাইরের ঘরের রোয়াকে দাঁড়িয়ে আছি শুধু আমরা দুজন। পুকুর পাড়ের চড়ায় দুতিনটে বাচ্চা ছেলে এতক্ষণ খেলা করছিল। দূর থেকে ওদের চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। অন্ধকার হয়ে আসছে দেখে এইমাত্র ধূলো ওড়াতে ওড়াতে পালিয়ে গেল ছেলেগুলো। ওদের চলে যাওয়ার সাথে সাথে কি জানি হঠাৎই মনে হলো আমার...এখন সবে সাড়ে পাঁচটা বাজে...এরই মাঝে দূর্যোগের আশংকায় পাড়াটা যেন অদ্ভুত রকম নিশুতি হয়ে এসেছে...! 
' ঝড়টা হলে ভালোই হয় দাদা। কয়েক দিন ধরে বড্ড গুমোট হয়ে আছে!'
' হ্যাঁ তা অবশ্য...।'
হঠাৎই হাওয়া শুরু হলো। গুমোট থেকে ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়া। গাছ গাছালী লতাপাতাগুলো এ ওর গায়ে এসে পড়তে শুরু করেছে। বাতাসে সোঁ সোঁ শব্দ। শুকনো ধূলো, রাস্তায় পড়ে থাকা খড়কুটো সব যেন ঘূর্ণির মতো পাক খেয়ে খেয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে চোখের সামনে। সামনের দু একটা  বাড়ির জানলার শার্সির ফাঁক ফোঁকর দিয়ে মুখ বাড়িয়ে প্রকৃতির রূপ দেখছিল হয়তো কেউ। দমকা হাওয়ার ধাক্কায় সেই যে পাল্লা বন্ধ হয়ে গেল আর খুললো না।
ততক্ষনে ঝড়ের তীব্র হিল্লোলে রেল লাইনের ওপারের তাল, নারকেল গাছের মাথাগুলো এমন ভাবে হেলে দুলে উঠছে, যেন এই বুঝি মটমট করে ভেঙে পড়ে। সামনে সরকার বাড়ির আমগাছ থেকে টপাটপ হলুদ রঙা হিমসাগর পড়তে শুরু করেছে রাস্তার এদিক ওদিক... থেঁতলে যাচ্ছে শক্ত মাটির আঘাতে। ভাবলাম  দৌড়ে যাই আমি আর মিনু মিলে। পা এগোলো না৷ মেঘ আর ধূলোয় অন্ধকার হয়ে উঠেছে চতুর্দিক। দুটো বলদকে দড়ি বেঁধে কোনোমতে খাটালের দিকে  নিয়ে চলেছে  রাধেশ্যাম গোয়ালা। 
' দাদা, এই দাদা...আমগুলো কিরকম রাস্তায় পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দ্যাখ...কয়েকটা আঁচলে ভরে তুলে আনবো? এখন তো কেউ কোত্থাও নেই। সবাই যেন ঘুমিয়ে পড়েছে....! '
' নারে, সরকার বুড়িকে চিনিস না। বাড়ির ভেতর থেকে উঁকি মেরে সব দ্যাখে...এখন এই ঝড়ে বাইরে বেরোলে নির্ঘাত কারো চোখে পড়ে যাবি। বুড়ি চিৎকার করে পাড়া মাথায় করবে। বাবা অফিস থেকে ফিরে এসে যদি জানতে পারে....সে বয়স কি আর আছে রে?' 
কথাগুলো মুখ থেকে বেরিয়ে এলো বটে, কিন্তু চারপাশের প্রকৃতিটাকে অবলোকন করতে করতে হঠাৎ করে হারানো ছেলেবেলাটা যেন টুকটুক করে কড়া নাড়তে শুরু করলো আমার মনেরই কোথাও লুকিয়ে থাকা কোনো এক গহন পথে৷ ভাবলাম দৌড়ে যাই। এরকম আম পড়া ঝোড়ো বেলা কতদিন পর যে এতটা কাছ থেকে, নিজেকে ছোটোবেলার সঙ্গে অদ্ভুত ভাবে মিশিয়ে নিয়ে উপভোগ করছি সত্যিই জানি না। হাওয়ার গর্জন, তার প্রতিটি অভিব্যক্তি, লতা পাতার সোঁ সোঁ শব্দ, কালো মেঘের লুটোপুটি, বাইরের আঁধার ঘেরা নিস্তব্ধতা...এই দৃশ্য ফেলে কিছুতেই যেন মন চাইছে না ঘরে ঢুকে দরজা জানলা বন্ধ করে বসে থাকতে....মন চাইছে আরো কিছু.... বাইরের রোয়াক থেকে সোজা রাস্তায় বেরিয়ে প্রাণ ভরে প্রকৃতির স্বাদ আহরণ করতে। এতদিনের গুমোট করা চারিপাশটা যখন ঠান্ডা হতে শুরু করেছে, তার একবার স্বাদ নেবো না! 
' মিনু চল, আম কুড়োই...তুই শুধু একটু লক্ষ্য রাখিস, এদিক ওদিক থেকে কেউ আবার দেখে ফেলে কিনা...বিশেষ করে ঐ সরকার বুড়ি....।'
' সত্যি যাবি দাদা!'
মিনুর মুখখানা কিরকম যেন অ্যাডভেঞ্চারিস্টের মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। 
এক পা বাড়িয়েও আচমকা থমকে যেতে হল আমাদের। 
অনেক দূরে রেললাইনের ওপারে বাঁশগাছের আড়াল থেকে একটা লম্বা আলোর রেখা সাপের গতিতে এঁকেবেঁকে তাল,নারকেল, অশ্বত্থ গাছের মাথার ওপর দিয়ে ব্র্যাডলে ট্যাঙ্কের পুকুরের জলে প্রতিবিম্বিত হয়ে যেন আকাশের বুক চিরে ঠিকরে বেরিয়ে এলো একরাশ জ্বলন্ত আগুনের ফুলকি দিয়ে তৈরি ধনুকের ছিলায় জড়ানো তীরের শানিত ফলার মতো....সে বিদ্যুতের ঝলকের সাথে সাথেই প্রচন্ড জোড়ে একটা বাজ পড়লো...এতটাই জোড়ে যেন মনে হলো রেলব্রিজের ঠিক পেছনটাতে বাঁশ বাগানের জলার ভেতর গিয়ে পড়লো সে অগ্নিকুণ্ড! সাথে সাথে আরো একটা বজ্রপাত। 
সাহস হলো না এই খোলা রাস্তায় গিয়ে আম কুড়োবার। 
মিনু শঙ্কার দৃষ্টিতে আকাশটাকে দেখতে দেখতে বললো,' বাবার আসতে এখনো কত দেরী! ট্রেন যদি বন্ধ হয়ে যায়... কি করে আসবে বল তো?'
কি জানি আমারো এবার বেশ চিন্তা হচ্ছিল বাবার জন্য। ঝড় যে ক্রমশ বাড়ছে! বাড়ছে হাওয়ার ঝাপটা আর তার সঙ্গে এক অদ্ভুত সোঁ সোঁ কালবৈশাখির আওয়াজ...! 
এই দূর্যোগ আরো চলতে থাকলে কত কি হতে পারে। ওভারহেড তার ছিঁড়ে যেতে পারে।  ভাবতে ভাবতেই দেখি একটা প্রকান্ড মালগাড়ী আমাদের বাড়িটাকে থরথর করে কাঁপিয়ে দিয়ে ঘটাং ঘটাং শব্দ তুলে হুস করে বেরিয়ে চলে গেলো ডাউন লাইন দিয়ে। 
তাকিয়ে দেখি বৈঠক খানা ঘরের ভেতরটা অন্ধকার হয়ে উঠেছে। চারিপাশে লোডশেডিং হয়ে গেছে কখন যেন। বাবার আসার সময় এখনো ঢের দেরি। ততক্ষণে  কি আর ঝড় কমবে না?  নিশ্চই কমে যাবে। মিনুকে অযথা চিন্তা করতে নিষেধ করে ভাবলাম মাকে বলে ভেতর ঘর থেকে একটা লম্ফ নিয়ে আসি...নোটটা মুখস্থ করতে শুরু করি আবার....ঠিক সেই সময় বাড়ির ভেতরের কোনো একটা দরজা কিংবা জানলার পাল্লা সজোরে হাওয়ার বারি খেয়ে এতটাই জোরে দরাম করে উঠলো যেন মনে হলো পাল্লাটাই বুঝি খুলে পড়ে গেল...! 
আমি দৌড়ে গিয়ে দেখতে যাবো বাড়ির ভেতরে কি হলো, এমন সময় হঠাৎই বেশ জোরে বলে ওঠে মিনু,' দাদা, দাদা...জ্যাঠামশাই আসছে...ঐ দ্যাখ!'
' এই দূর্যোগে জ্যাঠামশাই? '
' ঐ তো দ্যাখ না পুকুরের পাশ দিয়ে আসছেন...একটা ছায়ামূর্তি... দেখতে পাচ্ছিস? অবিকল জ্যাঠামশাইয়ের মতো চলনভঙ্গি...কতকালের মানুষটা...না চিনে কখনো থাকতে পারি? কিন্তু এই ঝড় বাদলের দিনে উনি এতদূর কি করে আসবেন বল তো দাদা..!'
সত্যিই তো! দূর থেকে দেখি আধো অন্ধকারের মাঝে সেই পুরনো আদ্যিকালের কাঠের হাতলওয়ালা ছাতাটা নিয়ে দূর্যোগ মাথায় করে ফরসা নধরকান্তি চেহারার টাক পড়া এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের ছায়াশরীর  হেলতে দুলতে পুকুর পাড়ের চড়ার ওপর দিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। সেই হাফহাতা ফতুয়া, চিরাচরিত খেঁটো ধুতি, দমকা হাওয়ায় এলোমেলো করে দিচ্ছে পরনের ধুতি, ফতুয়া খানা, ছাতা হেলে পড়ছে...শত বাধা বিঘ্ন পেরিয়ে এগিয়ে আসছে...এগিয়ে আসছে সেই ছায়ামূর্তি...। আমি আর মিনু অধীর আগ্রহে চেয়ে রয়েছি। যাকে ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি, ছায়ামূর্তির বেশেও তাঁকে চিনতে আমার এতটুকু ভুল হবার কথা নয়। আমি হাত নেড়ে চিৎকার করে উঠলাম,' ও জ্যাঠামশাই... জ্যাঠামশাই..!'
মিনুও আমার দেখাদেখি হাত নাড়ছে। 
বেঁটেখাটো ছায়াশরীরটা আস্তে আস্তে মানব শরীরের অবয়ব হয়ে এগিয়ে আসছে...পুকুর পাড়ের রাস্তা ছাড়িয়ে আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় এসে পড়লেন মানুষটা। তাকিয়ে আছেন আমার আর মিনুর দিকে। এই আবছায়া অন্ধকারে, তীব্র ঝোড়ো হাওয়ার মাঝেও মুখের হাসিটুকু কি অদ্ভুত ভাবে মিশে রয়েছে তাঁর দু চোখে..! 
' ও জ্যাঠামশাই, বাড়িতে আসবেন না?'
দূর থেকে হাত তুললেন জ্যাঠামশাই।
' আসবো ফেরার পথে। এখন একটু ওদিকে যাচ্ছি। '
' কোথায়? '
' পলাশি।'
' এই দূর্যোগের মধ্যে আপনি অতদূরে পলাশিতে....!'
আবার সেই আলগা হাসি। ঘাড়টা কিছুটা হেলিয়ে একবার আড়চোখে কি যেন দেখলেন আমার দিকে তাকিয়ে... যা আমি আবছায়া আলোতেও বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। 
' তোর বাবা কেমন আছে রে?'
কিছু বলতে পারলাম না। মুখ দিয়ে কথা সরলো না। জ্যাঠামশাই আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে ডানদিকের রাস্তা ধরে জোর পায়ে হেঁটে যেতে শুরু করলেন। 
ঠিক সেই সময় কড়াৎ করে আরো একটা বিভৎস জোরে বাজ পড়লো। সেই সঙ্গে নামলো বৃষ্টি। 
আমি আর মিনু রোয়াকে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে মুখ বাড়িয়ে তাকিয়ে রয়েছি জ্যাঠামশাইয়ের চলে যাওয়ার দিকে। মুখে বৃষ্টির ঝাপটা এসে লাগছে। হাওয়ার তোড়ে পাশের বস্তি বাড়ির একটা খড়ের চাল সজোরে উড়ে গিয়ে পুকুর পাড়ে কোথায় গিয়ে যে পড়লো কে জানে।  কিন্তু তখন এসব ভ্রূক্ষেপ করার মতো মন বা মানসিকতা আমার নেই৷ 
একটু একটু করে দেখতে পাচ্ছি, ছাতার আড়ালে একটা কোলকুঁজো কালো ছায়ামূর্তি ছপছপ করে নাগড়াই জুতোর পায়ের আওয়াজ ফেলতে ফেলতে ক্রমশ দূর থেকে আরো দূরে ঝড়, মেঘ, বৃষ্টি  আর হাওয়ার মাঝে মিলিয়ে যাচ্ছে এক রাস্তা থেকে আর এক রাস্তায়...একসময় স্কুল বাড়ির পাশ দিয়ে ঝুপসি অন্ধকারে দৃষ্টি পথের বাইরে অদৃশ্য হয়ে  যায় সেই অবয়ব। 
দরজাটা বন্ধ করে ভেতরে চলে এলাম। মনটা ভারি অন্যমনস্ক হয়ে আছে। 
' কিরে দাদা...জ্যাঠামশাই আমাদের বাড়ি না এসে এই দূর্যোগের মধ্যে পলাশিতে....পায়ে হেঁটে সে কি কমখানিক দূর..! ব্যাপারটা কিরকম যেন লাগছে আমার! এরকমটা তো কোনোদিন হয়নি! কোনোকারণে রাগ টাগ করলেন না তো? '
মিনুও যেন আমার মনের কথাটাই তুলে ধরলো। 
বললাম, ' না না রাগ করবেন কেন। সেরকম তো কিছু হয়নি। ফেরার পথে আসবেন, এটাও তো বললেন। তবু ঠিকই বলেছিস,  যে মানুষ কাঁচরাপাড়ায় এলে সবার আগে আমাদের বাড়ি না এসে কোথাও যান না...সেই মানুষটাই এত কাছ থেকে হাত নাড়িয়ে চলে যেতে পারে..! '

সন্ধ্যা বেলায় বাবা যখন কোর্ট থেকে ফিরলেন, তখন ঝড় বৃষ্টি অনেকটাই থেমে গেছে। প্রকৃতিকে ঠান্ডা করে দিয়ে কয়েক পশলা ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি তখনো হচ্ছিল, সে নেহাৎই ছিটেফোঁটা। নরম, শীতল প্রকৃতির কোলে মাঝে মাঝে হালকা বিদ্যুৎও চমকাচ্ছিল। 
দেখতে ভারি ভালো লাগছিল এই কোমল রূপ। 
 ছাতাটা ঘরের বাইরে একপাশে মেলে রেখে বাবা বললেন, ' ভেবেছিলাম হয়তো ফিরতে আরো অনেক দেরী হবে৷ কোথাও ট্রেন লাইন জলমগ্ন, কোথাও আবার ওভারহেড তার ছিঁড়ে গেছে ঝড়ে, ওদিকে বট গাছের ডাল ভেঙে চিড়িয়া মোড়ের কাছে সেকি যানজট! জায়গায় জায়গায় কত যে গাছ পড়েছে আজ...!  কপালগুণে একটা ভীড় ট্রেন পেয়ে গেলাম তাই। উঠে পড়তে পেরেছি এই ভাগ্যি! তার পরপরই শুনলাম, ডাউন লাইন জলের তলায় বসে গিয়েছে। আপে ও আপাতত আর কোনো গাড়ি চলবে না। ভাগ্যিস কৃষ্ণ নগরটা ধরতে পেরেছি...! কালই খবরের কাগজে জানতে পারবো কোথায় কি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সরকারদের আমগাছটা কি ভেঙে পড়েছে নাকি রে? দেখলাম একটা বিরাট বড় মোটা ডাল রাস্তার ধারে লতাপাতা সমেত  একেবারে নুইয়ে পড়েছে! '
' তা হতে পারে। যেরকম ঝড়টা গেল..! আমরা তো চিন্তা করছিলাম তোমার জন্য..!'

মা রান্নাঘরে ছিলেন। বাবার জন্য চা জলখাবার রেডি করছিলেন। মিনুর সামনে মাধ্যমিকের অঙ্কের বইটা খোলা। তবুও পড়ায় মন দিতে পারছে না ও। হয়তো আমারই মতো ওরও এখনো মাথায় ঘুরছে ছবিটা। 
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন,' খোকা আজ আর কলেজে যাস নি তো?'
' না সামনে পরীক্ষা...তাই স্টার্ডি লিভ চলছে।'
' ভালো করে পড়াশোনা করছিস তো? '
' হ্যাঁ। জানো বাবা একটা ঘটনা ঘটেছে আজ। কেমন যেন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। এরকমটা তো আজ অবধি কখনো হয়নি...তাই বোধহয়...!'
মিনু আর আমি চোখ চাওয়া চাওয়ি করি। কথাটা মাকেও জানানো হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। 
লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি টা পরে সবে চৌকিতে বসতে গিয়েছিলেন বাবা, আমার কথায় ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন।
' কী ঘটনা? '
' তখন পৌনে ছটা বাজে। বাইরে তখন খুব ঝড়। বৃষ্টিও নেমেছে। একটু আগেই লোডশেডিং হয়ে গেছে। হঠাৎ দেখি পুকুর পাড়ের রাস্তাটা দিয়ে জ্যাঠামশাই আসছেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন। বললেন, " পলাশি যাচ্ছি। ফেরার পথে আসবো.."
তোমার কথা একবার জিজ্ঞেস করে সোজা হাঁটা দিলেন ঐ দিকে। ঐরকম দুর্যোগ মাথায় নিয়ে বৃদ্ধ মানুষটা একা একা পলাশি যাচ্ছেন...আমাকে তো কিছু বলারও সময় দিলেন না...মুখে সেই আগের মতো হাসি....ঐরকম ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে..মেঘের গর্জন...অথচ সদাহাস্যময় চোখে কিরকম আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে সোজা চলে গেলেন জ্যাঠামশাই...!'
আমার আর মিনুর মুখে ঘটনাটা শুনে বাবাও ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন। বাড়ির সকলের তখন একটাই মনের ভাব....' এমনটা তো কখনো হয়নি..'

পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে জ্যাঠামশাইয়ের প্রতি বাবার যে আত্নীক টান জড়িয়ে ছিল,  তা আমি জীবনের বিভিন্ন সময়ে রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করেছি। 
শুনেছিলাম আমাদের বংশের চারপুরুষ আগেকার জনৈক ব্যক্তি  গৌড়হরি চট্টোপাধ্যায় মুর্শিদাবাদ থেকে ভাগ্যান্বেষণে সেকালের কাঞ্চনপল্লীর পলাশি গ্রামে চলে আসেন এবং সেখানেই কয়েক একর জমিতে   বসতভিটা তৈরি করে, আমের বাগান, দেশ বিদেশ থেকে গোলাপের চারা আমদানি করে  চাষআবাদ শুরু করেন। এই ভাবে পলাশি মাঝিপাড়া মৌজার প্রায় অর্ধেকেরও বেশি জমি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জনৈক উদ্যোগপতি গৌড়হরির হস্তগত হয়। চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পূর্বপুরুষের বিত্তবৈভবের শুরু হয়তো সেখান থেকেই। 
গৌড়হরির পরবর্তী বংশধর রত্নেশ্বর চট্টোপাধ্যায় ছিলেন নীলকুঠির এক কুখ্যাত দেওয়ান। তাঁর হাতে নাকি ছিল একশোরও বেশি লেঠেল বাহিনী। কত অসহায় মানুষকে চোখের জলে ভাসিয়ে তাদের জমিজমা সম্পত্তি বলপূর্বক হস্তগত করেছিলেন তিনি, তার বুঝি ইয়ত্তা নেই। পুরনো কাঁচরাপাড়ার রেল কারখানার অদূরে যাতায়াতের পথে যে ডাকাতে কালিমন্দির আজও চোখে পড়ে, সেই মন্দির এবং গর্ভগৃহ সংলগ্ন বহুদূরগামী অন্ধকার সূড়ঙ্গপথ রত্নেশ্বরেরই হাতে তৈরি। কপালে এই বড় সিঁদুর দিয়ে রাঙা চেলী পরে ঐ মন্দিরে ডাকাতে কালীর আরাধনা করতেন তিনি।  শোনা যায় সেই সুড়ঙ্গপথ ছিল একেবারে পলাশির বসতভিটা পর্যন্ত বিস্তৃত। শত্রুপক্ষের আসার খবর পেলে ঐ গহন পথই ছিল ভরসা। যার হদিস রত্নেশ্বর এবং তাঁর কয়েকজন পোষা ডাকাত দলের সর্দার ছাড়া আর কেউই জানতো না। গৌরহরি যে বসতভিটার গোড়াপত্তন করে গিয়েছিলেন, রত্নেশ্বরের হাত ধরে তার শ্রীবৃদ্ধি হয় বহুলাংশে। পলাশির সেই বৃহদাকার পরিখা বিশিষ্ট দো মহলা বাড়ি, বাড়ির অন্দরমহলে ঢোকার মুখে প্রকান্ড সিংহদুয়ার, বিশালাকৃতির খিলান,নাটমন্দির, গর্ভগৃহ, আম আর গোলাপের বাগানে মেঘাচ্ছন্ন হয়ে থাকা মাইলের পর মাইল সুবিশাল জমি...রত্নেশ্বরের কল্যানে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের নাম, যশ, খ্যাতি, বিত্ত গরিমা মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সেই সুউচ্চ দো মহলা বাড়ির মতোই মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াতো। শোনা যায় চট্টোপাধ্যায় বংশের এক দুঃসম্পর্কিত আত্নীয় মুর্শিদাবাদ থেকে ঘোড়ায় চড়ে পলাশি গ্রামে আসতে গিয়ে কালী মন্দিরের চারিপাশে ঘন বনাঞ্চলের মধ্যে ডাকাত দলের হাতে গিয়ে পড়েন।  শেষমেশ রত্নেশ্বরের বংশধর হিসেবে নিজের পরিচয় দেওয়ায় সে যাত্রায় প্রাণে রক্ষা পান ঐ ব্যক্তি। ডাকাতের এক সর্দার তাকে নিজে পৌঁছে দেয় পলাশির বাড়িতে। 
পরবর্তী বংশধর যোগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন তখনকার দিনের এল.এম.এফ ডাক্তার। ঘোড়ায় চড়ে প্র্যাকটিস করতে যেতেন। সেকালের কাঁচরাপাড়ার বেশিরভাগটা জুড়েই  ছিল ঘন বনাঞ্চল..জলাভূমি...কুলকুল করে বয়ে যেত যমুনা নদী...আজ যে নদী পলিমাটি আর চড়া পড়ে মথুরা বিলে পরিণত হয়েছে। ছিল রেললাইন, রেলকারখানা, পূর্বপুরুষের তৈরি ডাকাতে কালী মন্দির আর তার সংলগ্ন কাটাপুকুর...যে জলে কত মানুষের গলা কেটে ফেলে রেখে দিত ডাকাতেরা...সেই শ্বাপদ সংকুল অরন্যাবৃত পথ ধরে ঘোড়ার গাড়ি করে চিকিৎসা করতে যেতেন আমার পিতামহ যোগেন্দ্রনাথ। এতক্ষন ধরে যেসব কাহিনি বলে গেলাম এসবই আমার জ্যাঠামশাইয়ের মুখে শোনা। কিছু কিছু বাবার মুখেও শুনেছি। বাবাও শুনেছিলেন জ্যাঠামশাইয়ের থেকেই। 
বাবার যখন তিন বছর বয়স তখন তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়। সেই সময় থেকে সেজো জ্যাঠামশাই বাবার অভিভাবকের দায়িত্ব নেন। যোগেন্দ্রনাথের ছিল পাঁচ সন্তান। দুই  সন্তান আগেই মারা যায়। বাকি তিন সন্তানের মধ্যে সেজো জ্যাঠামশাই খুব ছোট অবস্থায় বাবাকে বিহারের দাড়ভাঙায় নিয়ে যান। 
পলাশির বাড়ির আগের সে জৌলুস তখন আর নেই। ন জ্যাঠামশাই ধার দেনায় বিকিয়ে যাওয়া, মদ্যপান,জুয়াখেলা,  বাঈজী নাচ, ভোগ বিলাসী চরম উচ্ছৃঙ্খল জীবনের পাঁকে পরে শেষ সম্বল হিসেবে পলাশির বাড়ির একটা একটা নবাবি আমলের পুরনো দুষ্প্রাপ্য ইঁট তখন বেচে দিতে শুরু করেছেন। আকাশ ঝাপসা হয়ে থাকা জমি কে জমি সেসব আম,গোলাপের বাগান ন জ্যাঠামশাইয়ের কল্যানে হাত বদল হতে হতে প্রায় শূণ্য হতে বসেছে। 
ঠিক সেইরকম এক পরিস্থিতিতে ক্ষয়ে যাওয়া, নুয়ে পড়া, ভাঙা চোরা, জৌলুসহীন, শ্রী হীন হয়ে পড়া পলাশির সেই ভগ্নপ্রায় বাড়ি থেকে সেজো জ্যাঠামশাই বাবাকে হাত ধরে  নিয়ে চলে গেলেন বিহারে। সেখানে জ্যাঠামশাইয়ের নিজস্ব ব্যবসা ছিল।  জীবনের একটা বিরাট সময় বিহারেই জ্যাঠামশাইয়ের কাছে কেটেছে বাবার। জ্যাঠামশাই লেখাপড়া জানতেন না। লেখাপড়া তেমন একটা ভালোও বাসতেন না। কিন্তু তাঁর জন্মগত কারিগরি মেধা ছিল অসাধারণ। মাথা থেকে নতুন নতুন উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে কত ব্যবসা ছেড়েছেন আবার কত ব্যবসা নতুন করে গড়েছেন সেসব কাহিনি শুনলে আজকের যুগে জ্যাঠামশাইকে একজন বড় ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না। সে অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যবসাই হোক, কিংবা নিজের উদ্যোগে সামান্য পুঁজি নিয়ে দেশলাই কারখানা খোলাই হোক, কিংবা কালোয়াতি ব্যবসাই হোক অথবা দাড় ভাঙার ব্যাবসায়ীদের সঙ্গে একসাথে মিলে মেশিনারি টুলস তৈরির নতুন এক ব্যাবসায়িক উদ্যোগ নেওয়া....সবেতেই যেন জড়িয়ে ছিল জ্যাঠামশাইয়ের সেই অদ্ভুত উদ্ভাবনী প্রতিভা...যা একেবারেই তাঁর সহজাত। হয়তো এই কারণেই নির্দিষ্ট কোনো একটা কাজ কিংবা ব্যাবসায় খুব বেশিদিন টিকে থাকার মানুষ জ্যাঠামশাই ছিলেন না। তাঁর মস্তিষ্ক যেন অবিরত কোনো নতুন কিছুর সন্ধান করে বেড়াতো। 
বিহারের বিভিন্ন জায়গায় কাজের সূত্রে ঘুরে বেড়াতে হত জ্যাঠামশাইকে। বাবাকেও নিয়ে যেতেন সেসব জায়গায় । সেই থেকে বাবা হয়ে গেলেন জ্যাঠামশাইয়ের সর্বক্ষণের সঙ্গী, সহকারী। 
একটু একটু করে জ্যাঠামশাইয়ের সান্নিধ্যে, সাহচর্যে বড় হয়ে উঠলেন বাবা। নিজের ইচ্ছেতে লেখাপড়া করলেন...তারপর স্কুল, কলেজ....চৌত্রিশ সালের বিহারের বিধ্বংসী  ভূমিকম্পের পর বাবা পাকাপাকি ভাবে দাড় ভাঙা ছেড়ে চলে এলেন....তবে পলাশিতে নিজের দেশের বাড়ি নয়...পূর্ব পরিচিত কাঁচরাপাড়ায়। 
পলাশির বাড়ি তখন ভঙ্গুর, প্রায় পরিত্যক্ত এক আবাসস্থল যেন। ন জ্যাঠামশাই তাঁর পরিবার নিয়ে দুটো ছোটো ছোটো ঘরে বসবাস করছেন। বাড়ি সংলগ্ন স্থানে বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত কিছু জমি তখনো পড়ে আছে। সেখানে কিছু কিছু করে সবজির চাষ হয়। সবকিছু খুইয়ে ঐ সম্বলটুকু নিয়েই দিন কাটাচ্ছেন ন জ্যাঠামশাই। 
দেশের বাড়ি বাবা আর কখনো ফিরে যান নি। মোক্তারী পাশ করে বারাকপুর কোর্টে চাকরি নিয়ে কাঁচরাপাড়াতেই একদিন পরিবারবর্গ নিয়ে যৎসামান্য উপার্জনের পয়সা জমিয়ে জমি কিনে বাড়ি করে সেটল হলেন বাবা।
 একদিন বি.এল.আর.ও অফিস থেকে একটা চিঠি এলো আমাদের বাড়িতে। পলাশি মাঝিপাড়া মৌজা এলাকায় বাগের খাল সংলগ্ন, শ্রী হরেন চট্টোপাধ্যায় ( ন জ্যাঠামশাইয়ের ভালো নাম) কর্তৃক বেআইনী ভাবে হাত বদল হওয়া বেশ কিছু আবাদি জমি এখনো অবশিষ্ট রয়ে গেছে, যার মূল মালিকানা চট্টোপাধ্যায় পরিবারের চতুর্থ প্রজন্মের কনিষ্ঠতম বংশধর  অতুল কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়( আমার বাবা) উপযুক্ত প্রমান সহ ওয়ারিশান হিসেবে দাবি করতে পারেন। জরীপ বিভাগের সীদ্ধান্ত অনুযায়ী হস্তান্তরিত হওয়া উক্ত জমি জায়গার ওপর হরেন চট্টোপাধ্যায়ের কোনোরকম অধিকার আজ থেকে অস্বীকৃত বলে গন্য করা হল। 
দ্বিরুক্তি না করে সে চিঠি বাবা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বাবার কথায়..' কত অসহায়, আর্ত, সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া মানুষের হাহাকার জড়িয়ে আছে ঐ জমি জায়গার সাথে....পূর্বপুরুষের ঐ পাপের সম্পত্তি ভোগ দখল করে আমি বেঁচে থাকতে পারবো না....নিজের চেষ্টায় যেটুকু করে উঠতে পেরেছি তাই আমার কাছে অনেক শান্তির...ঠিক যতটুকু শান্তির তিলতিল করে গড়ে তোলা আমার এই ছোট্ট বাড়িখানা...'
সেই থেকে আমরা হয়ে গেলাম রেল স্টেশন সংলগ্ন কাঞ্চনপল্লীর বাসিন্দা। অন্যদিকে সেজো জ্যাঠামশাই নিজের ব্যবসার সূত্রে পাকাপাকি ভাবে দাড়ভাঙাতেই রয়ে গেলেন পরিবার নিয়ে। যদিও পলাশির বাড়ির প্রতি তাঁর টান ছিল অবিচ্ছেদ্য। যেরকম অবিচ্ছেদ্য টান ছিল বাবার প্রতি। মাঝে মধ্যে কাঁচরাপাড়ায় এলেই আমাদের বাড়িতে দু এক দিনের জন্য থেকে যেতেন তিনি। পুকুর পাড়ে বসে অনেক রাত অবধি নিজের মনে কালোয়াতি সুরে গান গাইতেন। গলা খারাপ ছিল না তাঁর। বাড়ির পাশের দেহাতি বস্তির অনেকেই জ্যাঠামশাইয়ের ভক্ত হয়ে গিয়েছিল। ভুটিয়ার বিচুলির দোকানের বেঞ্চে মাঝে মাঝেই গিয়ে বসতেন জ্যাঠামশাই। তারাও বড্ড ভালোবাসতো সাদাসিধে মানুষটিকে। দোকানে বসলে চা না খাইয়ে ছাড়তো না। 
কাজে কর্মে এদিকে এলে বাবার সঙ্গে দেখা করে তবেই পলাশির বাড়ি পাড়ি দিতেন জ্যাঠামশাই। ন জ্যাঠামশাই মারা যাবার পর দেশের বাড়িতে তাঁর নিজস্ব ছোট্ট ঘরখানায় একা একা  দিন কয়েক কাটিয়ে ফেরার পথে আবার একবার বাবার সঙ্গে দেখা করে তবে দাড়ভাঙার ট্রেন ধরতেন। জ্যাঠামশাই বলতেন বাবাকে,' হাড়কঙ্কাল বেরোনো  প্লাস্টারখসা দেওয়ালগুলো, খসে পড়া নবাবি যুগের ছোটো ছোটো চৌকোনা লাল ইঁট, শিশুকালের চোরকুঠুরি, তোর যেখানটাতে জন্ম হয়েছিল..সেই ভাঙা পরিত্যক্ত স্যাঁতসেঁতে ঘরখানা... আপন মনে খেলা করার ঐ নড়বড়ে রেলিং ধ্বসে পড়া অবশিষ্ট ছাদটুকু, কারুকার্যময় ভাঙাচোরা জাফরির অবশেষ, গায়ে গায়ে দূরবীনের মতো ছোট ছোট ঘুলঘুলি, ছাদের ভগ্নাবশেষ হয়ে পড়ে  থাকা দুশো বছরের  সেইসব বিখ্যাত সাবেকি চোরা রন্ধ্রপথ....এ মাটিতে পা দিলেই যেন আঁকড়ে ধরে রাখে...ঠিক তোদের মতো...।'
সেই মানুষ ঝড় বাদলের দিনে আমাদের বাড়ি একটিবার না এসে সামনে দিয়ে চলে যাবেন.... মেনে নিতে পারিনি সেদিন কিছুতেই।

 কপালে দুশ্চিন্তা আর অজানা আশংকার ভাঁজ নিয়ে পরের দিন দুপুর বেলা পলাশির বাড়ি থেকে ঘুরে এসে বাবা খবর দিলেন, জ্যাঠামশাই সেখানে যান নি...। 
' তবে কি হাওয়ায় উবে গেল মানুষটা..!'
 বলতে গিয়ে বাবার কন্ঠ রূদ্ধ হয়ে আসে।
ভেতরকার উদ্বিগ্নতা যেন ঘন কালো ধোঁয়ার মতো গ্রাস করতে শুরু করেছে মনকে। ঝড়ের বিকেলে  যাঁকে যেতে দেখলাম তাঁর সঙ্গে আজকের ঘটনার কোথাও কি সম্পর্ক লুকিয়ে থাকতে পারে? ভেবেও তল পেলাম না! 
সামনের রোয়াকে, বৈঠক খানার খিড়কি দরজা দিয়ে একরাশ রৌদ্রজ্বল আলো এসে খেলা করছে। মেঘমুক্ত আকাশের কোল ঘেঁষে কি পাখি উড়ে চলেছে....চিলেকোঠার কার্ণিশ ভাঙা ছাদের ফাটলে কোথায় ঘুঘুর ডাক....
বাবার চোখের উদাস দৃষ্টি ঘুরে বেড়ায় আকাশের প্রান্তসীমায় যেন। অস্ফুট স্বরে বলেন,' শেষ যেবার দাদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল বৌদি তার কয়েকমাস আগে গত হয়েছেন। ঐ রোয়াকে বসে শেষ বিকেলের আলোয় তামাক খেতে খেতে ভারি অদ্ভুত কয়েকটা কথা বলেছিলেন দাদা, যা এর আগে কোনোদিনও বলেন নি..." ভারত বর্ষের অনেক জায়গাতেই তো ঘুরে বেড়ালাম কাজের তাগিদে, পয়সা রোজগারের তাগিদে....যত দিন যাচ্ছে কিরকম একটা অদ্ভুত নিরাসক্ততা চলে আসছে বুঝলি....এই ঘর বাড়ি, বিষয় আশয়...কী হবে এসব দিয়ে...গায়ত্রী         (জ্যাঠামশাইয়ের স্ত্রী) তো আমাকে একা করে দিয়ে নিজেই চলে গেল....মেয়ে দুটোর বিয়ে দিয়ে দিয়েছি...ওরা সব সুখে ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার করছে...ভালো আছে, এটুকুই তো চাওয়ার...এছাড়া আর তো নতুন কিছু পাওয়ার নেই জীবনে...এবার বানপ্রস্থ খোঁজার পালা...একটা বয়সে মানুষকে খুঁজে নিতে হয়....নইলে কষ্ট বাড়ে, বুঝলি না..."
বলতে বলতে আপন মনে চোখ বন্ধ করে মীরার ভজন গেয়ে ওঠেন দাদা। প্রেম, বিরহ, দুঃখ সব যেন ঝরে পড়ছিল সেদিন....গানের মধ্যে নাকি দাদার অন্তস্থল থেকে তা আমি বলতে পারবো না। তামাকের সেই কুন্ডলীপাকানো ধোঁয়াগুলো যেন আজও উড়ে বেড়াচ্ছে আমার চোখের সামনে...এলোমেলো, বিক্ষিপ্ত অবয়ব হয়ে নিরুদ্দেশের পথে....একটা মানুষ কোথায় যে চলে গেল...!'
উত্তর মেলেনি আর।
............................................. 
অলঙ্করণ :-  প্রিয়াঙ্কা সরকার


বেহেস্ত - শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

 

বেহেস্ত
শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
 

 


 সন্ধ্যা নেমে এসেছে বেশ খানিকক্ষণ আগে। পূর্ণিমার তারাগুলো যেন ঝলমল করছে মর্মর সৌধের বুকে। প্রধান ফটকের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেলাম। কাজুবাগানকে বাঁহাতে রেখে চারিধারে  গোলাপ,ড্যাফোডিল,আশ্চর্য রকম সুন্দর ফুলরাজিতে সুসজ্জিত চাহার বাগ উদ্যানের ভিতরকার যমুনা নদী নিসৃত ঝর্ণার জলধারায় সৃষ্ট রাতের আলোমাখা পুষ্করিণীর পাশ দিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে গেলাম সেই অপার্থিব সৌন্দর্যের দিকে।
আমার পিছনে গুলাম মহম্মদ নামে এক বৃদ্ধ গাইড। এখানে ঢোকার কিছু আগেই সে আমার সঙ্গ নিয়েছে। আদ্যন্ত সাদা উলের চাদরে ঢাকা চাপ দাড়িওয়ালা ছয় ফুট লম্বা হিলহিলে চেহারার মানুষটা তরতর করে হেঁটে  গেল শ্বেত পাথরের সোপান বেয়ে মিনারের কাছে।
মাথার ওপরে থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ। এক অদ্ভুত আলো আঁধারী পরিবেশ চারিদিকে। শীতের হিমেল হাওয়া। মার্বেলের শিলায় পা রাখা মাত্র জ্যোৎস্না রাতের রোমাঞ্চ যেন তার সবটুকু সৌন্দর্য নিয়ে গ্রাস করলো আমার মনকে। কিন্তু আজ এমন এক মূহুর্তে জায়গাটা এরকম জনপ্রাণী হীন কেন? নিজের মনকেই বললাম,' লোকজনের মাঝে বোধহয় এই সৌন্দর্যকে এত অন্তরঙ্গভাবে উপভোগ করা যেত না। এই মার্বেল শিলায় পা দিয়ে একাকি নিজেকে কেন যে এত ভাগ্যবান মনে হচ্ছে বারবার...এই অপার্থিবতার মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেবার জন্যই যেন জন্মজন্মান্তর ধরে অপেক্ষা করে ছিলাম আমি...যার টানে পুজোর ছুটি কাটাতে একা একাই ছুটে এসেছি কলকাতা থেকে সুদূর এই আগ্রায়।
বাদামী পাথরের সোপান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কুহকিনী সৌধের দিকে তাকিয়ে কথাটা যেন অজান্তেই বেরিয়ে এলো আমার মুখ থেকে, 'লাভ পোয়েম ইন এ মার্বেল...। স্টেইনলেস...!'
অনতিদূরে মথুরা অয়েল রিফাইনারি থেকে নিঃসৃত  বাতাসে ভাসমান দূষিত গ্যাসীয় আবরণী পাথরের গায়ে যতটুকুই সংশ্লেষ ঘটাক না কেন, এই সুউচ্চ স্থাপত্যের বিস্ময় বা মুগ্ধতা আজও যে অকৃত্রিম!এতটাই কলংক মুক্ত সে। তবে এই দূষণ সৃষ্টিকারী পৃথিবী ভবিষ্যতের জন্য আশংকার বার্তা রেখে যায় বৈকি।
মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গুলাম মহম্মদ একটু হেসে বিশুদ্ধ হিন্দিতে আমায় বললো,' আসুন জাঁহাপনা। দেখে নিন চারিদিক। প্রেম আর হাহাকার কিভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে পাথরের প্রতিটি খাঁজে খাঁজে...কোণায় কোণায়। এমন মুহূর্ত আর পাবেন না জীবনে, এই নীরবতা, নির্জনতার মধ্যে দিয়েই তো তারা আসে। রোজ রাতে আসে। কারা যেন কথা বলে ফিসফিস করে...এসব কাহিনী বংশপরম্পরায় শুনে আসছি...আগ্রা শহরের প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়....এসেই যখন পড়েছেন একবার তার আস্বাদ নেবেন না? '
আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে গুলাম।
বলতে পারতাম,' সেই অদৃশ্য লোকের মানুষ গুলোর সঙ্গে তুমি বুঝি মোলাকাত করেছো? '
যুক্তি তর্কে গেলাম না। যাওয়ার মতো মানসিকতাও তখন আমার নেই। কারণ সেই মুহূর্তে আমার অন্তঃকরণ জুড়ে শুধুই বিচরণ করছে তাজ। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে চেয়ে দেখছি আর মন প্রাণ ঢেলে উপভোগ করছি চাঁদনি রাতে মার্বেল গাত্রে আঁকা চিরন্তন প্রেমের স্বর্গীয় রূপকে।
আমার সহযোগী বলে চলে,'সম্রাট প্রিয়তমাকে ধরে রাখতে পারেন নি বেশিদিন,চতুর্দশ সন্তানের জননী হতে গিয়ে নিজেকে বিসর্জন দেয় সে অপ্সরা রাজেন্দ্রাণী... বিরাট বিরহী বুকে আঁকড়ে থাকা সেই স্মৃতি আজও অমর; চিরন্তন কালের জন্য। যে স্মৃতি কথা বলে ওঠে কালের স্রোত বেয়ে...কিন্তু এর বাইরে আর কি কেউ কথা বলে ওঠে না? তাজমহল তো সেই হাহাকারেরই আরোএক রূপ..! নৈঃশব্দের আড়ালে কিছু শুনতে পাচ্ছেন জাঁহাপনা? '
অদ্ভুত ভাবে হেসে উঠলো গুলাম মহম্মদ। আমার থেকে হাতকয়েক দূরে উদ্যানমুখী মিনারের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। কোটরগত চোখদুটো তাকিয়ে আছে আমার উত্তরের অপেক্ষায়। মণিগুলো আশ্চর্য রকম নীল। নীচের চারবাগ উদ্যানের সুরম্য পুষ্করীণীর জলে প্রতিবিম্বিত তাজমহলের ভেসে চলা আবছায়া রূপের মতোই রহস্যময় সে দৃষ্টি।
আস্তে আস্তে এবার আমার কাছে এগিয়ে আসে গুলাম। ফিস ফিস করে বলে,' আমি যা বলবো তা শুধু অনুভব করুন। ঠিক শুনতে পাবেন। সমাধিস্থলের মূল প্রবেশ পথের দিকে তাকান একবার। গম্বুজের দেওয়াল গাত্রে আঁকা জারি, ছেদ যুক্ত সূক্ষ্ণ সূচীকর্মের অদ্ভুত নির্মাণ শৈলী, খোদিত কোরাণের বাণী,বৃহদাংশ জুড়ে মমতাজ মহলের অকুন্ঠ প্রশস্তি সমন্বিত অলংকার সমৃদ্ধ এমন সুনিপুণ হস্তাক্ষরশিল্প ...মুঘল ক্যালিগ্রাফির এই আশ্চর্য নিদর্শন যার মস্তিষ্ক প্রসূত...ফটকের গায়ে ঐ দেখুন ফার্সিতে খোদাই করা সে নাম...জ্বলজ্বল করছে আজও...পারস্যের নামজাদা চারুলিপিকার আমানত খাঁ....ঐ যে ঐ দেখুন, ছত্রে ছত্রে জ্বলজ্বল করছে মূল স্থপতিকার আহমেদ লাহোরি নামটুকু...জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে ১৬৩২ থেকে ১৬৫৩  বাইশ বছর ধরে হুমায়ুনের মাজার, ইমাদউদ্দৌল্লার মাজার, তিমুরের গুর ই আমির, দিল্লির জামি মসজিদের গঠন  শৈলীকে সামনে রেখে, ইন্দো-ইরাণীয় তুরস্কের স্থাপত্য রীতির আশ্চর্য সংমিশ্রণেএকটু একটু করে গড়ে তুলেছিলেন যে স্বপ্নের তাজ...সে সব রক্তের দাগ অনাদিকাল ধরে চাপা পড়ে আছে এই পাথর স্তূপের নীচেই....জাঁহাপনা আসুন....
পাথরের গায়ে এই যে দেখছেন ভুবন ভোলানো খাঁজকাটা শিল্পকর্ম... মোজাইক শিল্পের এমন অদ্ভুত নমুনা দিল্লির প্রখ্যাত পাথর খোদাই কারক চিরঞ্জিলাল ছাড়া আর কে ই বা পারতো সৃষ্টি করতে। ...ঐ অত্যাশ্চর্য মোচাকৃতি গম্বুজ,স্বর্ণখোচিত চূড়া...যা সৃষ্টি করবার জন্য সুদূর অটোমান সাম্রাজ্য থেকে ভাড়া করে নিয়ে আসা হয়েছিল ওস্তাদ ইসমাইল খাঁ কে...গম্বুজের পদ্মফুলের চূড়ায় শোভিত এককালের ঐ চাঁদ, শিংযুক্ত স্বর্ণদন্ড...ওর যিনি সৃষ্টিকর্তা...লাহোরের সেই ওস্তাদ কাজিম খাঁ...মানুষের মাঝে আজ কোথায় তাঁর অস্তিত্ব বলতে পারেন...? আর ঐ ষাঁড়, বলদে টানা শয়ে শয়ে  গাড়িগুলো... বেলুচিস্তান, পারস্য, মাকরাণ,রাজস্থান থেকে আনা দুষ্প্রাপ্য পাথর বোঝাই করে পশুগুলোর পিঠে চাপিয়ে কিরকম নিষ্ঠুরভাবে তাদের নিয়ে আসা হয়েছিল দূর দূরান্ত দিয়ে সম্রাটের প্রেমের সৌধ গড়ে তুলতে...যে হাজার হাজার লোকগুলোকে কোমড়ে দড়ি বেঁধে ব্যবহার করা হয়েছিল সেদিন কপিকল ঠেলে ঠেলে পাহাড় প্রমান পাথরগুলোকে গাঁথার কাজে...সাধারণ মানুষের চোখে আজও তারা অবহেলিত, সম্রাট নামক রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা নিষ্পেষিত...জনতা আসে, অখন্ড সৌধের অনুপম রূপ দেখে চলে যায়...সৌন্দর্যের রসটুকু ছেঁকে নেয়...কজন শুনতে পায় প্রেমের ফলকে হাহাকারের কাহিনী.... কেই বা শুনতে চায়। বাইশ বছর ধরে বাইশ হাজার মানুষের শ্রমের ফসল...একদা মহারাজা জয়সিংহের কাছ থেকে প্রাপ্ত এই সুবিশাল জমিকে মাটির পাহাড় দিয়ে ভরাট করলো যারা...একের পর এক বৃহদাকৃতির পাতকুয়ার উপরিভাগে সুউচ্চ বেদি নির্মাণ করে গড়ে তুললো সমাধি সৌধের বজ্রকঠিন ভিত..তারওপরে পাথর কেটে কেটে সাজিয়ে তোলা হলো সম্রাটের এক আকাশ স্বপ্নকে....সেই পাথর কাটার শব্দ,কপিকলের আওয়াজ...মিনার চত্ত্বরের অলিন্দে অলিন্দে, দীঘি,ঝরনা,কাজুবাগান,সুরম্য উদ্যানবাটির চারিপাশে আজও যে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়...। তারপর একসময় সূর্য যেমন করে ঢলে পরে ক্লান্ত অবসন্ন পথিকের মতো পৃথিবীর এক কোলে, সে শব্দও ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসে...মিলিয়ে যায় না একেবারে। এক অদ্ভুত করুণ সুরের রাগিণী হয়ে বাজে। বেঁচে থাকে শ্রমিকের বাঁধা পড়া জীবনের অবিচল প্রাণের কেন্দ্রে। সকাল,বিকেল,সন্ধ্যা..যে পাথরের রঙ বদলায় ক্ষনে ক্ষনে...মাতাল করে রাখে পর্যটককে...তার প্রতিটি টুকরো যে আসলে ঐ মানুষগুলোর শরীরের একএকটি পাঁজর...! এতটাই অবিচ্ছেদ্য ওরা...এতটাই জীবন্ত এ স্মৃতিসৌধ! বাদশাহ,বেগমের সাথে সাথে আরো কত প্রাণ হেঁটে চলে বেড়ায় এ চত্ত্বরে... ভাবুন একবার! সৌন্দর্য পিপাসু মানুষের চোখে সে অন্ধকারের বাসিন্দাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। তবু দৈবাৎ কেউ যদি একাএকা এসে পড়ে এ পথে,কারা যেন প্রাণপণে টেনে রেখে দেয়। ছাড়তে চায় না কিছুতেই। এই চাঁদনি রাতে এমন একাকী মুহূর্তেই মানুষকে শোনাতে চায় ওরা, ভগ্নস্তূপের স্তরে স্তরে চাপা পড়ে থাকা নিজেদের কাহিনি...শুনতে পাচ্ছেন নাকি সেই করুণ সুরের রাগিণী? কান পেতে থাকুন,দেখবেন ঠিক...। '
চমকে উঠে দেখলাম অদ্ভুত দৃষ্টিসম্পন্ন লোকটা কখন এসে ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে আমার। সাদা চুলগুলো উড়ছে এলোমেলো হাওয়ায়।
 ' কী দেখছেন জাঁহাপনা? চাঁদনি রাতে পুষ্করিণীর জলে তাজের প্রতিবিম্বিত ছায়া? এককালের গাছপালার অতিপ্রাচুর্য, সুদৃশ্য ঝরনার নীচে নীচে শোভিত বিশালাকৃতির স্বর্ণপাত্র, যমুনার জলধারা সিঞ্চিত সে সব জলাধার, হস্তচালিত গম্বুজাকৃতির কপিকল, পাথরের গায়ে গায়ে পারস্য মধ্য এশিয়ার দূষ্প্রাপ্য টার্কোয়াজ, ল্যাপিস লাজুলি, আফগানিস্তানের বৈদূর্যমণি সমন্বিত পিয়েত্রো দুরার সে অপরূপ কারুকার্য.... ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যের অবশেষটুকুর মতোই সেসবই এখন ইতিহাসের গর্ভে..প্রধান সমাধিস্থল সৃষ্টির পাঁচ বছর পর তৈরি সম্রাটের হাতে গড়া ঐ সাজানো বাগান, সেও তো কবেই হারিয়ে গিয়েছে। এখন যে উদ্যান চোখের সামনে ভাসছে, এ নেহাৎই সেদিনের। ইংরেজের দল নিজেদের খেয়াল খুশি মতো ভেঙে চুরে বিলিতি গার্ডেনের আনুষ্ঠানিক ছাঁচে একে গড়ে তুলেছে। কিন্তু পুষ্করিণীর জলের ঐ ছায়া...সে তো আর মিথ্যে হতে পারে না। ছায়া আজও ঘুরে ফিরে বেড়ায়..এ সৌধের কোণায় কোণায়, অলিন্দে অলিন্দে... প্রেম, অমরত্বের স্মৃতি, হাহাকার ফিরে ফিরে আসে  রাতের নির্জনতার পথ ধরে....সে কথা তো আগেই বলেছি আপনাকে। বৃদ্ধ হয়েছি তো, তাই বারবার ফিরে আসে আবেগ। অনেকে বলবে গল্পকথা, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যমুনার অবশিষ্ট জল আজও রক্তাক্ত হয়ে রয়েছে হাজারো স্থপতির কেটে দেওয়া বৃদ্ধাঙ্গুলের চুঁইয়ে পড়া রক্তে...।'
মার্বেলের গায়ে হাত রেখে  বোধহয় অমরত্ত্ব আর হাহাকার সমন্বিত  ইতিহাসের সেই নির্যাসটুকুই অনুভব করতে চেষ্টা করছিলাম গুলাম মহম্মদের চোখ দিয়ে।
একটু কৌতুহলী হয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম,' তুমি কোথায় থাকো?'
'কেন এখানেই থাকি।'
' এখানেই থাকি বলতে?'
' এটাই তো আমার পৃথিবী। লোককে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলা...এ আমার পূর্বপুরুষের জীবিকা। নিশুত রাতের রহস্যে মাখা গা ছমছমে এই পরিবেশ, এই শান্ত সমাহিত অপার্থিব সৌন্দর্যে ঢাকা চারিধার...এ ছেড়ে আমি যাবো কোথায়? ঐ যে দূরে, তাজমহলের দেওয়াল বেষ্টনীর বাইরে বেলে পাথরের সমাধিগুলো... ওর একটা শাহজাহান পত্নী মমতাজের পরিচারিকাদের সমাধি সৌধ আর বাকীগুলো  সম্রাটের অন্য পত্নীদের স্মৃতিবিজড়িত সৌধ। মমতাজকে হারাবার পর ওদেরকে নিকা করেছিলেন সম্রাট। সে প্রেম কি তাহলে ছিল আসলে দ্বিচারিতা? তা আমি জানি না। পূর্বদিকের ঐ লালপাথরের বিশালাকৃতির ইমারত যা এককালে জাওয়াব মানে মেহমানদের থাকার ঘর বা অতিথিশালা বলে পরিচিত ছিল, তার পার্শ্ববর্তী কালো পাথরের মেঝের ছককাটা ঐ মসজিদ....
তাজমহলের এই মীনার চত্তর...এখানে রোজ নমাজ পাঠ হয়, আজান হয়। আমি আজান দিই। কাক ডাকা ভোরে শ্বেতপাথর ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করি নিজের হাতে..এই মর্মর পাথরের গায়ে কোনো কলুষতার কালো দাগ আমি লাগতে দেবো না। যে সৌধ কুহকিনীর রূপে যুগ যুগান্ত ধরে মায়ায় বেঁধে রাখে মানুষকে সে নিজে থেকে কোনোদিনই কলুষিত হতে পারে না। সে তো চায় ধরা দিতে....তার ব্যাথা বেদনা বিষাদ অমলিনতা সবটুকু নিয়ে.... আমরাই শুধু বাইরে থেকে সে অমলিনতার মাঝে প্রেমকে খুঁজে খুঁজে বেড়াই...আপনার মতো কজনই বা পারে এরকম নিঝুম একাকী পরিবেশে ইতিহাসের নিগড়ে এসে পৌঁছাতে...তো এসেই যখন পড়েছেন, অত সহজে কি আর ফিরে যাওয়া যায়?'
'মানে?'
খিলখিল করে হেসে ওঠে গুলাম মহম্মদ।
' মানে আপনি ইতিহাসকে জড়িয়ে ধরলে সেও কি পারে আপনাকে না জড়িয়ে থাকতে? '
দূরে আঙুল দিয়ে দেখায় লোকটি...' ঐ দেখুন আগ্রা দূর্গ। পরিখার আড়াল থেকে তাকিয়ে রয়েছে। সামনে যমুনা। একসময় ছিল ভরা জল প্রবাহিত নদী। মুঘল ইতিহাসে যে নদী ছিল বেহেস্ত বা স্বর্গের নদী। জীবনের  শেষ  আটটা বছর দূর্গের মুসাম্মন বার্জে বন্দীদশাপ্রাপ্ত একাকী সম্রাট নিভৃতে ঠিক এমনি করেই আকুল নয়নে অবলোকন করতেন প্রিয়তমার স্মৃতি সৌধের প্রতিবিম্বিত ছায়া। আজ সে যমুনা মরা খালে পরিণত প্রায়। দূষণ সৃষ্টিকারী বদ্ধভূমি। তবু তারা আসে। পালটে যাওয়া পৃথিবীর মধ্য দিয়েই ঠিক পথ চিনে চলে আসে। টান যে এমনই...। রাত আর একটু নিশুতি হলে আস্তে আস্তে ভেসে আসবে ঘোড়ার পায়ের ক্ষুরের রাজকীয় সে শব্দ, থেকে থেকে হ্রেষাধ্বনি. ..ঐ আগ্রা দূর্গের পথ ধরে...থেমে যাবে তাজমহলের ঠিক দোরগোড়ায় এসে...কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধ হবে চারিধার। আচমকা ঝুমুর পড়া পায়ের কিঙ্কিণীর আওয়াজ ঘুরে বেড়াতে শুরু করবে তাজ চত্ত্বরের আনাচে-কানাচে দিয়ে সারা অলিন্দ ময়...বাগানের চারিধার...অব্যক্ত প্রেমের অমরত্বের স্মৃতি বুকে নিয়ে....রাত আর একটু গাঢ় হলেই...!'
ইতিহাসের নির্যাস আহরণ করতে করতে হঠাৎই মনে হলো, ভয় দেখাচ্ছে নাতো লোকটা? কি জানি...।
'আসুন জাঁহাপনা, প্রধান ফটকের ভেতর মূল সমাধি স্থলে প্রবেশ করি আমরা..যে সমাধিস্থল সবচেয়ে প্রাচীন। ১৬৪৩ এর মধ্যে শেষ হয় যার নির্মাণ কাজ। আসুন। '
বললেন গুলাম মহম্মদ।
গোম্বুজের নীচেকার ধনুকাকৃতির দরজা দিয়ে ভেতরকক্ষে প্রবেশ করে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে আছি। দেওয়াল ময় অপরূপ সব কারুকার্য। পিয়েত্রো দুরা শিল্পের সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন যে শিল্পীর হাতে গড়া, পৃথিবীতে স্বর্গের অমরত্বকে প্রতিষ্ঠা করতেই যেন তার জন্ম। আমি প্রাণভরে উপভোগ করছি সে ভাস্কর্য, চিত্র শৈলীর আশ্চর্যময়তা। মাথার উপরিভাগে গম্বুজাকৃতি চূড়া থেকে নেমে এসেছে এক প্রকান্ড ঝাড়বাতি। জ্যোৎস্নার আলো আঁধারীর মাঝে নির্জন নিভৃত কক্ষে যেন এক অপার্থিবতা, অন্য কার অস্তিত্ব ক্রমশ গ্রাস করতে শুরু করেছে আমায় যা এতক্ষণ টের পেলেও নিজের মধ্যে হয়তো অনুভব করিনি এতটা...!
আমার পেছনে দাঁড়িয়ে গুলাম মহম্মদ বললো,' যেগুলো লতাপাতার খোদাইকার্য ওগুলো চিরঞ্জিলালের মস্তিষ্ক প্রসূত। ওঁরই হাতে গড়া। আর বাকিগুলো অলংকার সমৃদ্ধ ফার্সি ক্যালিগ্রাফি। আমানত খাঁয়ের নিজস্ব সৃষ্টি। কিছু  মহম্মদের বাণী, কিছু আল্লাহের কোলে চিরনিদ্রায় শায়িত মমতাজ প্রশস্তি। যে নিদর্শন গম্বুজের বাইরেও দেখে এলেন। পাথরের খাঁজে খাঁজে কত যে মণি মানিক্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠতো সেদিনের এই কক্ষ...সেসব দুষ্প্রাপ্য রত্ন আজ আর অবশিষ্ট নেই কিছুই। আসল ঝাড়বাতি... ১৮৫৭ এর মহাবিদ্রোহের সময় সব খুলে নেওয়া হয়েছে। যেটা দেখছেন, এ বাতি কায়রো জাদুঘর থেকে আনানো। লর্ড কার্জনের আনুকুল্যে। এমনকি এই প্রাচীণ গোম্বুজের উপরিতলে চূড়ার একেবারে মাথায় যে স্বর্ণদন্ডটি একদা স্বর্গের অনুপম আলো হয়ে লোকচক্ষে দৃশ্যমাণ হতো, আঠারো শতকের পর আর কেউ সে দন্ডের অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি। বর্তমানে যেটি রয়েছে সেটি কাঁসা অথবা তাম্র নির্মিত কিছু একটা হবে।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ' কক্ষে আলো জ্বলছে না কেন?'
হা হা করে এবার হেসে উঠলো গুলাম।
' কে জ্বালাবে?  লোক কোথায়?'
' মানে? কেয়ারটেকার থাকে না?'
' এখন এই মুহূর্তে আমি ছাড়া আর কেউ এখানে থাকে না। আবার সবাই আসবে ভোর হলে।  কবরের তলায় ঘুমিয়ে আছে যে ইতিহাস, তাকে জাগানোর সাধ্য বা সাহস কোনোটাই ওদের নেই। বুঝলেন কিছু?'
মনে হলো যেন স্থির চোখে  আমার দিকে তাকিয়ে আছে গুলাম। মুখটা কেমন যেন অন্ধকারে ঢেকে আছে ওর। আলো কম বলেই কি?হবে হয়তো। ততক্ষণে আমাকে প্রবলভাবে টানতে শুরু করেছে ঐ ওপাশে সুরঙ্গের মতো নেমে যাওয়া একটা গহ্বর।
আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই গুলাম আমায় স্মরণ করিয়ে দিল, 'তাজের একটা নিজস্ব আলো আছে জানেন তো? সেই আলো কখনো কখনো কাউকে একাএকাই টেনে নিয়ে আসে...ঠিক আপনারই মতোন। নিজে থেকে যখন এতদূর চলে এলেন, আশা করি বাকি পথটুকুও....। চলুন জাঁহাপনা, এবার ঐ গহ্বর ধরে মূল সমাধি কক্ষে প্রবেশ করি। সেখানে প্রবেশের আগে অবশ্য আরো কয়েকটি কক্ষ পড়বে। প্রধান কক্ষে দুটি অমর স্মৃতি ফলক রয়েছে। সম্রাট, সম্রাগ্যির নামাঙ্কিত। তার এক স্তর নীচে  অপরূপ নকশায় সুসজ্জিত পাশাপাশি  দুটো শ্বেতশুভ্র সমাধি বেদি আজও একই রকম অমলিন। সেখানে  অনন্ত শয্যায় শায়িত সম্রাট শাহজাহান আর তাঁর পরম প্রিয়তমা পত্নী আন্জুমান্দ বেগম। খুব অন্ধকার কিন্তু। অনেকটা গভীর সুড়ঙ্গ। পারবেন তো নামতে?'
' হ্যাঁ হ্যাঁ পারবো। চলো।'
' আমি জানি আপনি পারবেন।'
মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে গেলাম আমি সুড়ঙ্গ পথের দিকে।
ঘন অন্ধকার গহ্বর। আন্দাজে বুঝতে পারছি ছোট ছোট সিঁড়ি নেমে গেছে একেবারে সমাধি কক্ষ পর্যন্ত।
' আসুন। দেখে আসুন।' বলে আমার সামনে দিয়ে গুলাম নেমে গেল এক পা এক পা করে সিঁড়ি বেয়ে।
একটু একটু করে সিঁড়ি ভাঙছি আমিও।
'গুলাম। গুলাম। একটু আস্তে চলো। আমি দেখতে পাচ্ছি না কিছু। গুলাম...!'
কোনো সাড়া পেলাম না কারো। কোথায় হারিয়ে গেল লোকটা? প্রথম থেকেই ওর চলন বলন হঠাৎ হঠাৎ কিরকম যেন সন্দেহের উদ্রেক করছিল মনে। এবার সেই সন্দেহটা যেন বেড়ে গেল বহুগুণ। এই নিকশ কালো অন্ধকারে, মাত্র কিছুসময়ের মধ্যে কোথায়ই বা হারিয়ে যেতে পারে বৃদ্ধ লোকটা! যতই এপথ ওর নখদর্পণে থাকুক। এই পরিস্থিতিতে, এত কম সময়ে, এত তাড়াতাড়ি পথ চলা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব?
' গুলাম..!'
জোড় গলায় চেচিঁয়ে উঠলাম। চিৎকারের শব্দটা ভেতরের কোন্ গভীর অতল থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এলো মাত্র।
আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কোথায় দাঁড়িয়ে পড়েছি জানি না। ঘন কালো ছাড়া আর কোথাও কোনো রং নেই চারিপাশে। তবে বেশ বুঝতে পারছি এই সুড়ঙ্গ পথ আরো গভীর সুড়ঙ্গের দিকে নেমে গেছে। কতটা গভীর তা আমি জানি না।
......' টগবগ টগবগ টগবগ  টগবগ.....চিঁহি চিঁহি চিঁহি..!'
অনেকদূর থেকে আসা একটা ঘোড়ার পায়ের শব্দ। সেই সঙ্গে থেকে থেকে হ্রেষাধ্বনি...!
আমি কাঠের মতো স্তব্ধ হয়ে একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকি। কান খাড়া করে শুনছি শব্দটা।
স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে হতে একসময় তাজমহলের প্রধান ফটকের একেবারে সামনে এসে থেমে যায় শব্দটা।
মিনিট কয়েক সব চুপচাপ। হঠাৎই আমার কানে  পরিষ্কার ভেসে এলো ঝুমুর পড়া একটা মেয়েলি পায়ের আওয়াজ। সুড়ঙ্গপথ ধরে গভীর অন্ধকারের ভেতর থেকে এক পা একপা করে এগিয়ে আসছে সে শব্দ... আমারই দিকে। সেই সঙ্গে বিনিয়ে বিনিয়ে একটা হালকা নারীকণ্ঠের কান্নার আওয়াজ।
কে যেন উঠে আসছে সিঁড়ি বেয়ে, বুক চাপা কান্না সাথে নিয়ে ...ধাপে ধাপে....একপা... একপা...একপা...!
ঐ হ্রেষাধ্বনি, ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ, নারীকণ্ঠের বুকচাপা কান্না,ঝুমুরের শব্দ...যেন কোন্ অদৃশ্যলোকের পথ ধরে নিকশ অন্ধকারের মাঝে ঘিরে ধরতে শুরু করেছে আমার চারিপার্স্বস্থ পৃথিবীকে। বিদ্যুৎপৃষ্ঠের মতো সর্বাঙ্গে এক অদ্ভুত শিহরন খেলে যাচ্ছে আমার। আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে  চেষ্টা করে চলেছি সেই ভয়াল, ভীষণ অন্ধকারকে বিদীর্ণ করতে....দিশেহারার মতো এধার ওধার তাকাচ্ছি শুধু একটু আলো যদি কোথাও পাই....একফোঁটা আলোর রেখা...!
' গুলাম..!'
ডাকটা আবার বেরিয়ে এলো কন্ঠনালী চিরে যেন।
....' হা হা হা হা...'
হঠাৎ....হঠাৎই নীচেকার গভীর সুড়ঙ্গ থেকে উঠে আসা পুরুষ কন্ঠের এক প্রবল অট্টহাস্যে যেন ফেটে পড়লো চতুর্দিক। কি নিষ্ঠুর,কি নির্মম, কি ভয়ানক সে হাসির সুর...!
আমি প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছি ওপরে উঠতে।
আচমকা নীচ থেকে উঠে আসা একটা কার হাত এসে চেপে ধরলো আমার পায়ের কাছটা। যে হাত কোনো রক্তমাংসের হাত নয়। শুধু কয়েকটা হাড়ের সমষ্টিমাত্র।

ঘুমটা ভেঙে গেল ঠিক সেই সময়। চোখ মেলতেই দেখি জানলা দিয়ে ভোরের আলো এসে পড়েছে। কাজের লোক রতন চা নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার আগ্রা ভ্রমণের তরতাজা স্মৃতি যে এইভাবে ফিরে আসবে স্বপ্নের পথ ধরে...বুঝতেই পারিনি!

.....................................................
অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি


কাগজ - শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

 

কাগজ

শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়


 

     নিজের লাইব্রেরি রুমে চিন্তান্বিত ভঙ্গিতে বসেছিলেন মল্লার বাবু। ডান হাতে ফাউন্টেন পেন আর এক হাতে ধরা একটা ওয়াইন গ্লাসে আধখাওয়া হুইস্কি এখনো পড়ে রয়েছে। তাঁর সাধের ইজরায়েলি স্কচ লিখতে লিখতে অনেক ক্রূশিয়াল মোমেন্টে তাঁকে বুস্ট আপ করতে সাহায্য করেছে..এ অভিগ্যতা মল্লার বাবুর জীবনে কম হয় নি। কিন্তু এবারকার এক্সপেরিয়েন্স যেন একেবারেই ভিন্ন।  চিন্তার জটে পড়ে এমন হাবুডুবু মল্লার বাবু আগে কখনো খেয়েছেন কিনা, সত্যিই তাঁর মনে পড়ে না। 

    সামনে লেখার কাগজগুলো বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে। একটা কালির দাগও তাতে এখনো পড়ে নি। এখনো অবধি দু -দুটো উপন্যাস আর তিন তিনটে ছোটো গল্পের পর এবারের মতো শারদীয়া সংখ্যার জন্য এটাই তাঁর শেষ লেখা।তারপর আপাতত কয়েক মাসের ছুটি। আবার নতুন করে শুরু...। 

    কিন্তু শেষকালে এসে এই একটা লেখাই যেন মল্লার বাবুর রাতের সমস্ত ঘুম কেড়ে নিয়েছে। দিন কয়েক ধরে হাজার ভেবেও একটা ছোটো গল্পের প্লটও মাথায় এলো না এখনো। 'ভারত ' পত্রিকার সম্পাদক অঘোর বাবু গতকাল আরো একবার এসে ঘুরে গেছেন। কড়জোড়ে তাগাদা দিয়ে গেছেন... ' স্যার, মানে বলছিলাম, প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি...। আসলে সময় কম। বিস্তর কাজ। জানি আপনাদের মাথার ওপরেও সারা বছরের চাপ... এইমাত্র কবি সারদা মল্লিক এর বাড়ি হয়ে এলাম। তিনিও আরো দিন দুই সময় চেয়েছেন... এই টাগ অব ওয়ারের মাঝে পড়ে কি যে নাজেহাল অবস্থা...!'

 ' আজ সোমবার। বুধবার দিন ডেফিনিটলি আপনার গল্প পেয়ে যাবেন। ' স্তোকবাক্য দিয়ে এ যাত্রার মতো সম্পাদক মশাইকে ঠেকানো গেলেও সময়কে কি আর বাগে আনা যায়..। দেখতে দেখতে রাত পেরিয়ে পরের দিন সকালও গড়িয়ে গেল। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত একটা জুতসই কাহিনিও মাথায় এলো না মল্লার বাবুর। এ  ঘটনা তাঁর পঁয়ত্রিশ বছরের লেখক জীবনে অভূতপূর্ব।   গতরাত্রে আচমকাই একটা ছোটো গল্পের প্লট মাথায় এসে গিয়েছিল।গল্পের নামকরণও করে ফেলেছিলেন..'অন্ধকার।' কিন্তু লেখা শেষ করার পর কেন জানি না তাঁর মনে হলো, সত্যিই এটা ঠিক কী হলো? এমন কাঁচা,দূর্বল, জঘন্য মাণের গল্প তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, আশা করা যায় কখনো? এ যেন নেহাৎই লেখার জন্য লেখা। এর বেশি কিছু নয়। এমন লেখা আর যাই হোক, আলোর মুখ দেখতে পারে না।  গল্পটা রিজেক্ট করতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হলো না মল্লার বাবুকে। বাতিল করে দেওয়া কাগজ গুলো এখনো পড়ে রয়েছে তাঁর সামনে টেবিলের এক কোণে। একজন লেখক কি এইভাবেই ক্রমশ ফুরিয়ে যায়...?এখনই..এত তাড়াতাড়ি! না না তা কি করে হয়!………..চেয়ার ছেড়ে উঠে অস্থির চিত্তে পায়চারি করতে  থাকেন মল্লার বাবু। হঠাৎই তাঁর    মনে পড়ে যায় বহু বছর আগে জীবনের  একেবারে প্রথম দিকে একটা নামকরা বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে তিনি একটা শর্ট  স্টোরি লিখেছিলেন। যে কোনো কারণেই হোক লেখাটা আর পত্রিকায় পাঠানো হয়নি।   রিডিং রুমের শেল্ফগুলো খুঁজলে এখনো সেটা পাওয়া যেতে পারে। আচ্ছা,যদি ঐ লেখাটাই অঘোর মাইতির হাতে তুলে দেওয়া হয়  তাহলে কেমন হয়?তাতে আর যাই হোক মান সম্মান টা বাঁচবে । চেয়ার ছেড়ে উঠে  রিডিং রুমের দিকে যেতে গিয়েও কি মনে করে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন মল্লার বাবু। সত্যিসত্যিই কি বাঁচবে মান সম্মানএ লেখা পত্রিকায় ছাপা হলে পাঠক সমাজের কাছে হয়তো জোড়ালো সমালোচনার মুখোমুখি হতে হবে তাকে। শুনতে হবে, এটা সাহিত্যিক মল্লার চৌধুরীর নিজের লেখা নয়। বিদেশি গল্পের স্পষ্ট অনুকরণ...। এককথায় নকল। হোক না সমালোচনা। একজন লেখককে  ঘিরে  ক্রিটিসিজ্ম থাকবে না, এ তো হয় না। তাছাড়া তিনি তো অভূতপূর্ব কিছু করছেন না। বিশ্ব সাহিত্যে যুগে যুগে  স্থান পেয়েছে এমন বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে রচিত লেখার সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। মল্লার বাবু চাইলে হাতে গুণে নামও বলে দিতে পারবেন। লোকে একদিন সমালোচনা করবে, দুদিন করবে... তারপর আস্তে আস্তে ভুলে যাবে; বছরকে বছর পুরনো হয়ে যাওয়া শারদীয়া পত্রিকার বিস্মৃতপ্রায় মলাটের মতো। এটাই জীবনের নিয়ম।  কিন্তু আজ বাদে কাল যদি অঘোর বাবু এসে দেখেন গোটা গল্প দাঁড় করানো দূরের কথা  মল্লার বাবু এখনো একটা লাইন পর্যন্ত লিখে উঠতে পারেননি... কী ধারণা জন্মাবে ওঁর মনে? অঘোর মাইতির সামনে কতখানি ফেস লস হবে তাঁর!সীদ্ধান্ত একপ্রকার নিয়েই ফেললেন মল্লার বাবু। ঐ পান্ডুলিপিখানাই তাঁকে উদ্ধার করতে পারে এই সংকটের হাত থেকে। এছাড়া আর কোনো রাস্তা  অন্তত এই মূহুর্তে তাঁর মাথায় কাজ করছে না। 'স্যার...।' মল্লার বাবুর সেক্রেটারি অজিত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। 'কিছু বলবে? ' 'এক ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করবে বলে অনেকক্ষন থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন?' 'কে?কী নাম'? ' নাম  বললো অরূপ সেনগুপ্ত।' ' সে আবার কে?' 'গত শনিবার কৃষ্ননগর থেকে ফেরার পথে আপনার সঙ্গে নাকি ট্রেনে আলাপ পরিচয় হয়েছিল তার।' মনে করতে খুব বেশি সময় লাগলো না মল্লার বাবুর। সেদিন কৃষ্ণনগরে একটা সাহিত্য সভার আসর সেরে ফিরছিলেন তিনি। গাড়িটা খারাপ হয়ে যাওয়ায় অত রাত্রে ট্রেনেই ফিরতে হয়েছিল তাঁকে।প্রায় নিরালা কম্পার্টমেন্টে একটি ছেলের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তাঁর। অনেকটা সময় ধরে  ওর সঙ্গে কথা হয়েছিল বলে ঘটনাটা পরিষ্কার মনে আছে মল্লার বাবুর।ট্রেনে একা একা বসে একঘেয়েমি ধরানোর চাইতে  তিনি বেশ উপভোগ করছিলেন ছেলেটির সঙ্গ। বেকার ছেলে।চাকরি বাকরির চেষ্টা করছে বটে,কিম্তু ওসবের থেকেও সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ তার মধ্যে অনেক বেশি তীব্র।বাবার কাছ থেকে পাওয়া পকেট খরচা জমিয়ে মাসে দুটো একটা করে সাহিত্য পত্রিকা তার কেনা চাইই চাই।  বই পড়ার মতোই গল্প লেখাটাও তার নাকি আর একটা ভালোবাসা।কিন্তু ছেলেটির পরিবারে বা তার পরিচিত মহলে এমন কেউ নেই যারা তাকে এ ব্যাপারে কোনোরকম উৎসাহ জোগাতে পারে। বরং নিরুৎসাহিত করার লোকের সংখ্যাই যেন বেশি। ছেলেটির বাবার একটা মুূদিখানার দোকান রয়েছে। ভদ্রলোকের অতীব ইচ্ছে, ছেলে এখন থেকে ব্যাবসা পত্তর শিখুক। হাত পাকাক। একদিন তো ধরতেই হবে দোকানের হাল। নয়তো কে দেখবে। সাধারণভাবে গ্র্যাজুয়েশন পাশ করে আজকের দিনে চাকরির দরজা পেরোনো যে কতটা কঠিন তা ভদ্রলোক নিজে যেমন বোঝেন, হয়তো তার ছেলেরও বিষয়টা অজানা নয়। তবু মুদির দোকানের ঐ বদ্ধ খাঁচার মধ্যে ভ্যান ভ্যান করতে থাকা মাছি, ভেলি গুড়,রেড়ির তেলের গন্ধ, দর কষাকষির খেলা আর অসাড় খেড়ো খাতায় মুখ ডুবিয়ে,নিদাঘ মধ্যাহ্নে সিন্দুকের সামনে গদি আঁটা টুলে বসে পাখার বাতাস খেতে খেতে  নিজের ভালোলাগার ক্ষেত্রটিকে জলান্জলি দিতে কিছুতেই রাজী নয় ছেলেটি।তার নিজের কথায়, মল্লার বাবুর মতো মানুষের সঙ্গে এইভাবে যে ওর  কোনোদিন আলাপ হতে পারে  এ যেন তার কাছে স্বপ্নের মতো। প্যারাডক্স। মনে হচ্ছে জীবনের সবথেকে বড় পাওয়াটা ভগবান  বুঝি তাকে পাইয়ে দিয়েছেন। ট্রেনে যতটা সময় ছেলেটি ছিল ততক্ষনই যেন মল্লার বাবুকে ঘিরে এক অদ্ভুত বিস্ময় আর সম্ভ্রম  তার চোখে মুখে খেলা করছিল। রানাঘাট ষ্টেশনে নেমে যায় ছেলেটি। যাবার আগে একটা অনুরোধ রেখেছিল সে। তার নিজের লেখা অনেকগুলো ছোটো গল্পের মধ্যে যেটা তার চোখে বেস্ট চয়েস হিসেবে চিহ্নিত, সেই লেখাটা  নিয়ে একদিন যদি সে মল্লার বাবুর বাড়িতে গিয়ে দেখা করে তাতে কোনো অসুবিধে আছে কিনা। লেখা সম্পর্কে লেখক মশাইয়ের মূল্যবাণ মতামত তার জীবনের পাথেয় হয়ে থাকবে। ছেলেটির কথাবার্তা শুনে কোথায় যেন তার প্রতি একটা তাৎখণিক ভালোলাগাবোধ জেগে উঠেছিল মল্লার বাবুর মনে।সৌজন্যের খাতিরে তার সে  অনুরোধে  না করতে পারেন নি তিনি। কিন্তু সেদিন ছিল এক পরিস্থিতি। আজ  এই মুহূর্তে  দাঁড়িয়ে কারো সাথে দেখা করা বা কথা বলার মতো সময় কিংবা মন কোনোটাই তাঁর নেই।সেক্রেটারিকে তিনি বললেন, 'গিয়ে বলো আমি একটা বিশেষ জরুরি কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছি। পরে দেখা করতে... আর হ্যাঁ, এই কাগজগুলো একটু বাইরে ওয়েস্ট পেপার বাক্সে ফেলে দাও তো.. এ আর কোনো কাজে লাগবে না।ফেলে দেওয়া গল্পের সেই স্ক্রিপ্ট গুলো অজিত এর হাতে তুলে দিলেন মল্লার বাবু। কিছুক্ষণ পর অজিত ফিরে এলো। 'ভদ্রলোক এই কাগজটা আপনাকে দিতে বলেছেন। '   কয়েকলাইনে লেখা একটা চিঠি। খানিকটা কৌতুহলী হয়ে  মল্লার বাবু চিঠিখানা পড়তে শুরু করলেন।... 'স্যার, গত কদিন ধরে আপনাকে অনেকবার ফোনে ধরতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত যোগাযোগ হয় নি।  আমার নিজের ডায়েরির পাতা থেকে  বাছাই করা  একটা  ছোটোগল্প আপনাকে দেখাবো বলে নিয়ে এসেছিলাম। সেটা হলো না বলে প্রথমটায় বেশ খারাপই লাগছিল। কিন্তু তার বদলে আজ যে জিনিসটা পেলাম তাতে আমার খারাপ লাগা সবটুকু অনূভুতি নিমেষেই মুছে গেছে। তখন সেক্রেটারি স্যার ওয়েস্ট পেপার বাক্সে কিছু কাগজ ফেলে রেখে গিয়েছিলেন।  পাশে দাঁড়ানো সিকিউরিটি গার্ড ভদ্রলোকের কি একটা কথার উত্তরে শুনছিলাম উনি  বলছিলেন  "একটা গল্প নিয়ে কদিন ধরে স্যারের খুব মেন্টাল প্রেসার পড়ে গেছে। লেখার পরেও পছন্দ হলো না বলে শেষে এই কাগজগুলো বাতিল করে দিলেন"। ওনারা চলে গেলে কাগজকটা  তুলে নিয়ে দেখি ওগুলো 'অন্ধকার 'নামে কোনো একটা গল্পের পান্ডুলিপি। ম্যানাসক্রিপ্টটা  আমি সাথে করে নিয়ে গেলাম স্যার। আপনাকে না জানিয়ে কাজটা করে ফেলার জন্য বিশেষ ভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। ভালো থাকবেন। পুজোয় আপনার নতুন গল্পের অপেক্ষায় রইলাম। ইতি- আপনার গুণমুগ্ধ পাঠক অরুপ সেনগুপ্ত।'.......। 

    ফাউন্টেন পেন এ লেখা গোটা গোটা হরফ। হতভম্বের মতো কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে চিঠিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন মল্লার বাবু।হঠাৎ তাঁর মনে পড়লো, ছেলেটা সেদিন একটা চিরকুটে নিজের মোবাইল নম্বর লিখে দিয়েছিল। এখনই ওকে ফোন করা দরকার। লাইনটা পাওয়া ভীষণ জরুরি। ব্যস্ততার সঙ্গে  ওয়ালেট থেকে চিরকুটটা বের করে রিং করলেন মল্লার বাবু।... 'হ্যালো। আমি মল্লার চৌধুরী বলছি। তুমি অরূপ তো?' 'স্যার আপনি! বলুন...।' এমন একটা দামী ফোন যে আসতে পারে, ওপাশের ব্যক্তিটি যেন কল্পনাই করতে পারে নি। কিন্তু এবারে যে প্রশ্নটা ধেয়ে এলো সেটা যেন তার কাছে আরো বেশি আনএক্সপেক্টেড।...' শোনো তুমি যেটা করেছো একেবারেই ঠিক করো নি। কাউকে কিছু না জানিয়ে এমন একটা কাজ করলে কি করে...?' আচমকা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় ছেলেটি। ' স্যার, ইয়ে, মানে আমি খুব অন্যায় করে ফেলেছি.. আসলে ডাস্টবিনে কাগজগুলো পড়েছিল, তাই ভাবলাম...। ' ' তাই সটান ওগুলো নিয়ে চলে গেলে...। ঐ ফেলে দেওয়া লেখাটা তোমার কোন্ কাজে লাগবে শুনি..?'' স্যার, আসলে আমি অনেক আশা করে...।' 'আশা.. কিসের আশা...।' মল্লার বাবুর ক্ষোভের পারদটা যেন আরো এক কাঠি বেড়ে গেল। 'ঐ রিজেক্টেড লেখা তুমি কাকে দেখাবে ?যার হাতে এ লেখা পড়বে, সে কি খুব বাহবা দেবে ভেবেছো, অ্যাঁ? যেখানে আমি নিজেই নিজেরটা বাতিল করে দিয়েছি সেখানে কেন তুমি এই কাজটা করতে গেলে...? শোনো তুমি এখন কোথায়? কত দূরে?'মল্লার বাবুর ধমকের সুরে নার্ভাস হয়ে তোতলাতে থাকে ছেলেটি।' স্যা..স্যার...আমি মানে আ..আমি তো এখন বাসে.. ল্যান্সডাউন ছাড়িয়ে... ' 'তুমি যেখানেই থাকো এসে ঐ কাগজগুলো ফেরৎ দিয়ে যাও... ।' এবার যেন ভেঙে পড়ে ছেলেটি। 'স্যার আমার কথাটা, মানে একবারটি শুনুন... কাউকে দেখানোর জন্য এ কাজ আমি করিনি স্যার...''তাহলে কিসের জন্য করেছো?' আমতা আমতা স্বরে উত্তর আসে 'ভেবেছিলাম স্যার,পাণ্ডুলিপি খানা নিজস্ব  সংগ্রহে রেখে দেবো।আমার একটা বড় যত্নের ফাইল আছে তার মধ্যে... লেখাটা শুধু আমার মন জুড়েই থেকে যাবে...  '।অবাক  হয়ে গেলেন মল্লার বাবু।কিছুটা নরম সুরে বললেন,'কিন্তু সব লেখা তো আর গল্প হয় না..।' বিনয়ী কন্ঠে ভেসে আসে,' আপনার মতো  মানুষের কলমের আঁচড়টুকু তো থেকে যাবে। জীবনে এও কি কিছু কম পাওয়া স্যার..'। এরপর আর যুক্তি চলে না।একটুক্ষন থেমে  মল্লার বাবু বললেন, ' বেশ তোমার যখন এতই আগ্রহ তখন আর ও জিনিস ফেরৎ দিতে হবে না। তবে এটাও বলি, আজ থেকে এ লেখাটার ওপর কোনো দায় কিন্তু  আমার আর রইল না..'। হঠাৎই উৎফুল্ল কন্ঠে আওয়াজ শোনা যায়,' আপনার মুখের কথাটুকুই অনেক। বিশ্বাস করুন স্যার আর আমার কোনো অপরাধবোধ রইলো না..'

 

     ফোনটা রেখে চোখ বন্ধ করে বেশ খানিক্ষণ চেয়ারে বসে রইলেন মল্লার বাবু।  ফেলে দেওয়া কয়েকটা কাগজের পাতা হঠাৎ করে  এতটা মহার্ঘ হয়ে উঠতে পারে তা যে তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি। মল্লার বাবুর মনে হলো জীবনে এতদূর প্রত্যাশা কি তিনি সত্যিই কোনো পাঠকের কাছ থেকে করেছিলেন? ভাবতে গিয়ে হঠাৎই ভারত পত্রিকার জন্য একটা  ঝকঝকে টাটকা  ছোটো গল্পের প্লট যেন  বিদ্যুৎের মতো ঝলক দিয়ে উঠলো তাঁর মস্তিষ্কে...যে গল্পের মূল কেন্দ্রীয় চরিত্র দুজন।  একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক। আরএকজন তাঁরই গুণমুগ্ধ এক পাঠক। যার সঙ্গে ঘটনাচক্রে ট্রেনের কামরায় লেখক এর পরিচয় এবং তারই সূত্র ধরে কাহিনির অগ্রগতি ;পরিশেষে আজকের অভিজ্ঞতা। শুধু চরিত্রের নামগুলো অদলবদল করে দিতে হবে এই যা...। এক বেলার মধ্যে গল্পটা শেষ করার টার্গেট মাথায় রেখে কলম ধরলেন মল্লার বাবু। তার আগে প্রিয় পাঠকটিকে একবার বড়সড় ধন্যবাদ না জানিয়ে পারলেন না তিনি। 

 

    পরের দিন ঠিক বেলা বারোটা নাগাদ অঘোর বাবু এলেন আশা নিরাশার মাঝে একরাশ দোলাচল নিয়ে। মল্লার বাবু তাঁর আধ ঘন্টা আগে শেষ করা গল্পের ম্যানস্ক্রিপ্টটা এগিয়ে দেবার সাথে সাথেই ভদ্রলোকের নাদুসনুদুস গাল জোড়ায় একরাশ হাসি ফুটে উঠলো...'কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ...।'

'একবার গল্পটা পড়ে নিন..আমার দিক থেকে ভুল ত্রুটি যদি কিছু...। ' বললেন মল্লার বাবু। 

'ভুল ত্রুটি...কার? আপনার?'

মুখের হাসিটাকে আগের মতোই ধরে রেখে ব্যাগে  রাখা একটা রুপোলী কৌটো থেকে পান বের করে মুখে পুরে ভদ্রলোক বললেন, 'দু মিনিট সময় দেন তো একটা ছোট্ট লাইফ হিস্ট্রি তুলে ধরি?'

'দিলাম। বলুন।'

'বছর কুড়ি কি তারও বেশি আগের আগের কথা। এ প্রত্রিকা, সে পত্রিকার অফিসে ম্যানাসক্রিপ্ট বগলদাবা করে ছুটে বেড়াচ্ছি তখন।এভাবেই একদিন এডিটার'স অফিসে আপনার সঙ্গে পরিচয়..কি তাই তো? আপনি তখন মোটামুটি নাম করেছেন লেখালেখির জগতে। আর আমিও ঠিক আপনারই মতো চোখে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি...লেখক হবার স্বপ্ন..।'

    অঘোর বাবুর সঙ্গে মল্লার বাবুর চেনা পরিচয় আজকের নয়। লেখক হয়ে ওঠার বাসনা নিয়ে জীবন শুরু করলেও,প্রারম্ভিক স্তরে কিছু কিছু গল্প    ছোটোখাটো পত্র পত্রিকায় মোটামুটি জনপ্রিয়তা কুড়োলেও ঐ জায়গা থেকে উঠে তেমন কোনো সাফল্যের সিঁড়ি পেরোনো অঘোর বাবুর পক্ষে আর সম্ভব হয়ে ওঠে নি। সে যাই হোক, লেখালেখির সূত্রেই মল্লার বাবুর সঙ্গে ওঁর পরিচয় আর তারই সুবাদে ভদ্রলোক মাঝেমাঝে আসা যাওয়া করতেন বাড়িতে।

 

    একদিন মল্লার বাবুর কাছে এসে ভদ্রলোক নিজেই বললেন,' না মশাই, অনেক তো চেষ্টা চরিত্র করলাম.. জুতোর শুকতলা খয়ে গেল.. দেখলাম কলমের শুধু একগাদা কালিই খরচা করে গেছি এতদিন...কাজের কাজ ঢুঁঢুঁ...গ্যাটেঁর পয়সা খরচ করে বই ছাপিয়ে লোককে বিলি করা ছাড়া আর তো কোনো রাস্তা দেখছি না.. এ লাইন সবার জন্য নয়...একটা নতুন প্ল্যান মাথায় এসেছে...বাড়ির নীচের তলায় যে পৈতৃক ছাপাখানাটা রয়েছে, বাবা মারা যাবার পর মেশিন পত্তর গুলোতে আর সেভাবে হাত পরেনি কারো। এক ব্যাটা কর্মচারী ছিল, সে অন্য জায়গায় কাজ পেয়ে তারপর থেকে আর আসে না। জিনিস পড়ে আছে। অথচ কাজ জানা লোকের অভাব। ভাবছি নীচের ঘরটাকে নতুন রং টং লাগিয়ে, রিপেয়ারিং করে যদি একটা এডিটিং অফিস খুলতে পারি...লেখা আসবে..,বই হয়ে, ম্যাগাজিন হয়ে ছেপে বেরোবে...কমদিন তো আর এ লাইনে চষে বেড়ালাম না...এডিটিং, শর্টিং,প্রূফ রিডিং... কাজগুলো সব চোখের সামনে, কাছ থেকে দেখেছি... সেই অভিজ্ঞতাকেই কাজে লাগিয়ে যদি একটা অফিস খুলে ফেলা যায়...এবার সত্যিই নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় এসেছে মশাই...কাল রাত্তিরে নীচের তলার ঘরখানা কি মনে করে ঘুরে দেখতে গিয়ে মেশিন পত্তরগুলোর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আইডিয়াটা মাথায় এলো। করতে পারলে কেমন হয় বলুন তো? 'আপনার যখন অভিজ্ঞতা আছে, দেখুনই না। কে বলতে পারে...।'

' বলছেন?'

চোখে মুখে একরাশ উৎসাহ নিয়ে বলেছিলেন অঘোর বাবু। 

' অবশ্যই আপনি শুরু করুন।'

' দরকার শুধু দুটো জিনিস দাদা। লোকবল। আর আপনাদের মতো গুণী মাণী মানুষের একটু সাপোর্ট। পাশে থাকবেন তো দাদা? অন্য কিচ্ছু নয়। খালি একটু লেখার মাধ্যমে পাশে থাকা... এই আর কি..।'

    তদ্দিনে 'লেখক মল্লার চৌধুরী ' নামটা তড়তড় করে খ্যাতির সিঁড়ি বেয়ে শারদীয়া সংখ্যায় বেস্ট সেলার গল্প, উপন্যাসের তালিকায় মোটামুটি পাকা জায়গা করে নিয়েছে বলাই যায়। 

পূর্ব পরিচয় আর সৌযন্যের খাতিরে লেখক জীবনের হাজারো ব্যাস্ততার মাঝেও অসময়ে মানুষটার পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধে না করতে পারেন নি মল্লার বাবু। 

    সম্পাদক অঘোর মিত্তিরের নতুন পেশাগত জীবনের সেই শুরু। তাঁর সম্পাদিত 'ভারত পত্রিকা' তাঁরই নিজের ছাপাখানা থেকে প্রথম প্রকাশিত হলো... সে প্রায় বহু বছর আগের কথা। সেদিনের সেই ছোটোখাটো কলম পত্রিকা আজ এত বছর পেরিয়ে  এসে আকারে,পরিসরে বেড়েছে তো বটেই; পর পর বছর কয়েক হলো বেস্ট সেলার ছোটো পত্রিকার তকমাটাকেও বজায় রাখার ক্ষেত্রে বলা যায় দারুণ ভাবে সফল। 

     পান চিবোতে চিবোতে অঘোর বাবু বলতে লাগলেন আগের কথার রেশ ধরে.. ' লেখালেখির জগতকে একপ্রকার বিদায় জানিয়ে তখন সবে নতুন প্রফেশান শুরু করেছি। একদিন কি একটা কাজে অন্বেষা পত্রিকার দুঁদে সম্পাদক প্রভাকর সরকারের বেনিয়াটোলা লেনএরঅফিসে গিয়ে ঢুঁ মারলাম। প্রভাকর বাবু এককালে বাবার পুরনো বন্ধু ছিলেন। আগে আমাদের বাড়িতে যাতায়াতও করেছেন কয়েকবার। বাবার অবর্তমানে, সময়ের গতিকে তারপর অবিশ্যি আর...। আমাকে এডিটিং  পেশা সম্পর্কে অনেক উৎসাহ ব্যাঞ্জক কথাই  বললেন তিনি। শিক্ষানবিশের মতো শুনে গেলাম। অনেক কথার মধ্যে একটা খুব দামী কথা বলেছিলেন সরকার মশাই..."বুঝলে অঘোর, ওয়েষ্ট পেপার বাক্সে ফেলে দেওয়া হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজের গায়ে লেখা অক্ষরও সোনা হয়ে উঠতে পারে, যদি সেটা লেখার মতো লেখা হয়। শুধু দেখবার মতো একটা চোখ দরকার এই যা..।" চোদ্দ  বছর হয়ে গেল আমার এ পত্রিকা অফিসের বয়স। সরকার মশাই আজ আর নেই। কিন্তু ওঁর সেদিনের কথা মনে গেঁথে আছে আজও.."দেখবার মতো একটা চোখ "। সাধে কি আর আপনাদের মতো মানুষের অপেক্ষায়  হাপিত্যেশ করে বসে থাকি দাদা...ডাস্টবিন থেকে রত্ন খুঁজে নেওয়াই যে আমাদের কাজ..। আপনাদের পাশে না পেলে আজ এ পত্রিকা কটা লোকের কাছে পৌঁছোতো বলুন দেখি? '

    ফেলে দেওয়া কাগজ, ডাস্টবিন, রত্ন...প্রতিটা শব্দ যেন অদ্ভুতভাবে কানে এসে বাজছিল মল্লার বাবুর।ভদ্রলোককে আর একটু বাজিয়ে দেখার জন্য হেঁয়ালির সুরে তিনি জিগ্যেস করলেন, 'সবসময় ডাস্টবিন খুঁজলেই বুঝি রত্ন মেলে?'

'তা হয়তো মেলে না। কিন্তু ভাবুন দেখি একবার হলুদ হয়ে যাওয়া ছেঁড়াখোড়া কোনো পাতার গায়ে আপনার কলমের দু দুটো আঁচড় সে পাতার গ্র্যাভিটিকে কোথায় নিয়ে এসে পৌঁছে দেবে..?সোনার আংটির আবার হলমার্ক...। হ্যাঁ, ছাপতে গিয়ে প্রিন্ট মিস্টেক হলে দ্যান্ আই উইল পে ফর দ্যাট...এই নিন স্যার আপনার চেক। আজ তাহলে উঠি।'

    কথার সাথে মুখের কষ বেয়ে পানের পিক গড়িয়ে পড়ার উপক্রম হচ্ছিল আর একটু হলেই।রুমাল দিয়ে  কোনোক্রমে নিজেকে সামলে নিলেন ভদ্রলোক। মূহুর্তের দৃশ্যটা একটু আগে হলে হয়তো স্বাভাবিক কারণে  হাসির উদ্রেক ঘটাতে পারতো মল্লার বাবুর মনে। কিন্তু মূহুর্ত কয়েকের ব্যবধান মানুষের অবস্থানকে বোধহয় সরিয়ে নিয়ে আসতে পারে কয়েক যোজন...। 

 

    বিয়ারার চেকটা মল্লার বাবুর হাতে তুলে দিয়ে সম্পাদক মশাই হাসি মুখে বিদায় নিলেন।

 

    ডাস্টবিনে আজ আর পরে নেই কোনো ফেলে দেওয়া গল্পের পান্ডুলিপি। কেউ আসেনি সেই পান্ডুলিপির সন্ধানে। রত্নের খোঁজে। ড্রয়িং রুমে বসে থাকতে থাকতে এক আশ্চর্য অনুভূতি যেন ক্রমেই ঘিরে ধরছিল মল্লার বাবুর চারিপাশের পৃথিবীটাকে। এ বছরের জন্য শারদীয়া পত্রিকায় শেষ ছোটো গল্প.. কলমের শেষ আঁচড়টুকু যে আত্মতৃপ্তির স্বাদ এনে দিয়েছিল মল্লার বাবুর মনে, ঠিক ততোটাই যেন গভীর..  ততোটাই যেন গাঢ় এই মূহুর্তের এই অচেনা অনুভূতি..! গল্পটা পড়ে শেষ করে ওঠার পর  একই রকম অনুভূতি হয়তো অঘোর বাবুর মনকেও গ্রাস করবে। করতে বাধ্য....। কি অদ্ভুত! কি আশ্চর্য! এমনটাও হয়...!

সেক্রেটারি অজিত ঘরে এলো। 

'স্যার, এই চিঠিটা কেউ ড্রপ বক্সে রেখে গিয়েছিল। সম্ভবত আজই।'

    অন্যমনস্ক মনে চিঠিখানা অজিতের হাত থেকে নিয়ে পড়তে যাওয়া মাত্রই চোখদুটো আটকে গেল মল্লার বাবুর। একটা ছোটো কাগজে ফাউন্টেন পেন এ লেখা খুব চেনা গোটা গোটা হরফে কয়েকটা লাইন..."স্যার, মনের মাঝে জমে থাকা কথাগুলো বলবো বলেই আজ এতো সকালে না এসে আর থাকতে পারলাম না। কাউকে না পেয়ে চিঠিখানা ড্রপ বক্সে রেখে গেলাম। কাল আপনার ওখান থেকে বাড়ি ফিরে আসার পর একটা অনুভূতি ক্রমাগত তারিয়ে নিয়ে বেরিয়েছে আমাকে।এ নিয়ে  নিজের সঙ্গে কম লড়াই করি নি। বারবার প্রশ্ন করেছি নিজেকে। রাত্রে ভালো করে ঘুমোতে পারি নি। অবশেষে অনেক চিন্তা করে দেখলাম, যে লেখার ওপর আপনার কোনো দায় নেই  পাঠক হয়ে সে লেখার ওপর আমারও কোনো দাবি থাকতে পারে না। থাকাটা উচিতও নয়। এ লেখা বরং মুছেই যাক.. শুধু আপনার মন থেকে নয়, আমারো মন থেকে। জানি লেখাটাকে ঘিরে আপনার অনেক টেনশন গেছে। আর চিন্তা করবেন না। কাগজগুলো যেখানে ছিল আবার সেখানেই রেখে গেলাম। ভালো থাকবেন।  ইতি - আপনার গুণমুগ্ধ পাঠক...। 

 

 

.....সমাপ্ত.....

 

 subhanjan Chatterjee