সংঘমিত্রা রায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
সংঘমিত্রা রায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

দিগম্বরীর দুঃখ - সংঘমিত্রা রায়

 

দিগম্বরীর দুঃখ
সংঘমিত্রা রায় 
 

 


    " তোমাদের অমরপুরের  বাড়িটা অনেক বড় শান্  কলকাতায় এতো বড় বাড়ী দেখাই যায় না  !"
    " একসময় কত লোক থাকত এই বাড়ীতে এখন ছোট কাকুর পরিবার ছাড়া আর কেউ থাকে না নেহাত উনি এখানকার স্কুলের প্রধান শিক্ষক  তাই ।"
   " আর এখন আমরা এলাম । আমার খুব একটা খারাপ লাগছে না  । কত গাছপালা তোমাদের  বাড়ীতে একটু প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নিতে পারব । "
   " হু তা পারবে !  এখানকার লোকজনও খুব মিশুকে মিলেমিশে থাকলে তোমার ভালোই লাগবে । তাছাড়া কাকীমা, বুলা , বিট্টু তারা তো   রয়েছে ।"

    বিয়ের ছয়মাস  পর চাকরির খাতিরে শ্বশুর বাড়ীর পুরানো ভিটেতে যেতে হল  মীম আর শানকে। ওদের ভালো নাম শান্তনু আর মধুমিতা কুন্ডু । দুজনে ভালোবেসে বিয়ে করেছে উওর কলকাতায় পাশাপাশি পাড়াতে তাদের বাড়ী । শান্তনুরা দুই ভাই বড় ভাই অতনু  কলকাতার একটা কলেজের প্রফেসার তার  স্ত্রী সুচেতাও একই কলেজে পড়ায়। শান্তনুর বাবা সুশান্ত কুন্ডু পৌর সভার অফিসে উঁচু পদে চাকরি করতেন । তার মা শোভা দেবী  গৃহবধূ সুশান্তবাবু  চাকরি পাওয়ার পর কলকাতায় বাড়ী করেন আর বিয়ে করে কলকাতায়  থেকে যান । তখন  গ্রামের বাড়ীতে তার বাবা, মা ভাইয়েরা থাকতেন তিনি মাঝে মাঝে বাড়ী যেতেন । আরও তার কাকা , কাকাতো ভাইয়েরা তখন থাকতেন । তাদের বাড়ীটা অনেক বড় আর বেশ কয়েকটা অংশ ছিল । কিন্তু আস্তে আস্তে বয়স্করা সবাই চলে গেলেন আর মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেল, ছেলেরা কর্ম সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে । শুধু শানের ছোট কাকা এই বাড়ীতে থাকেন  তার নিজের অংশে। শান আগে প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরি করত এখন সরকারী পরীক্ষা দিয়ে পঞ্চায়েত  বিভাগে চাকরি পেয়েছে অমরপুরে। যেখানে তাদের বাড়ী ছিল নিজেদের বাড়ী থাকতে অন্য জায়গায় থাকবে কেন তাই এখানে এসেছে । তার ছোটকাকা  প্রশান্তবাবু লোক লাগিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করে রেখেছেন ।
     মীম বরাবরই চটপটে স্বভাবের মেয়ে । বাংলায় এম, এ পাশ চাকরি পায়নি  খুব সুন্দর গান গায় । দেখতে সুন্দরী আসার পরই মিশে যায় প্রশান্ত বাবুর স্ত্রী পারমিতা দেবী, বুলা, বিট্টু তাদের সঙ্গে । অমরপুর  বেশ উন্নত গ্রাম । বুলা , বিট্টু দুজনে কলেজে পড়ে ।  মীমকে ঘরের কাজে সাহায্য করার জন্য একজন মহিলা রেখে দিয়েছে  শান সে রান্না ছাড়া সবই কাজ করে ।

     মীম  , শান  যেদিকে থাকে ওদিকে ওদের পূর্ব পুরুষদের  বেশ কয়েকটা ছবি টাঙানো শুধু পুরুষ নয় কয়েকজন মহিলাও আছেন । ঘরগুলো কিছুটা জমিদার বাড়ীর আদলে তৈরি । শান মীমকে ছবির  সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে । মীমের  সবচেয়ে বেশী ভালো লাগে পিসি ঠাকুমা দিগম্বরীর ছবি । তখন ফটো তোলার চল ছিল না তাদের বাড়ীতে একজন চিত্রশিল্পী এসে সব ছবি একে দিতেন । এটা  দিগম্বরীর মৃত্যুর কিছুদিন আগের ছবি প্রায়  সত্তর বছর হবে তবুও  দেখতে বেশ সুন্দরী  লাগছে । 
   মীম দুপুরে একাই থাকে রান্না শেষ হয়ে গেলে আর বিশেষ কোন কাজ থাকে না বসে বসে ফোন টিপে আর টিভি দেখে । কখনও শাশুড়ি বা মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলে।সুচেতা দেবী সুশান্তবাবুর শরীর বিশেষ ভালো নেই তাই তারা আসেননি বলেছেন কিছুদিন যাক্ তারপর তারা আসবেন ।
   মীম মাঝে মাঝে  দিগম্বরীর ছবির দিকে তাকিয়ে দেখে  কি সুন্দর ছিলেন তিনি  পুরো শরীর দেখা যাচ্ছে ছবিটা বেশ বড় তিনি চেয়ারে  বসে আছেন সাদা  শাড়ি মাথায় ঘোমটা  । মীমের মনে হয় তার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছেন । তাকে কিছু বলতে চাইছেন !
    মীম, শান দুজনেই মাছ ছাড়া খেতে পারে না । মীম মাছের আইটেম গুলো বেশ ভালো রান্না করতে পারে । শান সকালে ইলিশ মাছ এনে দিয়ে গেছে । মীম ভাবল ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচুশাক আর ইলিশ মাছ সিদ্ধ রান্না করবে । কাকুর ঘরেও একটু দেবে ওরা ভালো কিছু রান্না হলে তাদের দেয়। ওরা যে ঘরে ঘুমোয় সেটাই  শানের পিসিঠাকুমা দিগম্বরীর ঘর । মীম রান্না শেষ করে ওর ঘরে যেতেই কে যেন বলে উঠল, " কি ভালো ইলিশ মাছের গন্ধ বেরুচ্ছে নাতবৌ যদি একটু খেতে দিতি !"
    মীম চারপাশে তাকাতে থাকে কে বলল কথাটা কিন্তু না কেউ নেই । দিগম্বরীর ছবির দিকে তাকিয়ে মনে হল তার মুখটা কালো হয়ে আছে ।  
     এরকম দুদিন হল মীম পরদিন লাউ দিয়ে কুচো চিংড়ি রান্না করছিল তার মনে হল কে যেন বলছে," একা একা খাচ্ছিস নাতবৌ আমার কুচো চিংড়ি খুব প্রিয় ছিল ।"

   পরদিন পাবদা মাছ রান্নার সময় মীমের মনে হল কেউ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মীম পাবদা মাছের  চড়চড়ি নামাতেই কে যেন বলে উঠল,"  আমাকে একটু দে নাতবৌ দেখি খেয়ে কেমন হয়েছে !"
   মীম ঘুরে  তাকায় বুঝল একটা দমকা হাওয়া তার পাশ থেকে সরে গেছে । কদিন ধরে যার কথা সে শুনছে তা মনে হচ্ছে একজনের বেশ মিষ্টি গলার স্বর !  কিন্তু কে বুঝতে পারছে না আবার কাউকে বলতে পারছে না কোন প্রমাণ নেই তার কাছে । শানকে বললে বিশ্বাস করবে না হয়তো বলবে এখানে  যখন তোমার সঙ্গে এসব হচ্ছে তাহলে বাড়ি চলে যাও । কিন্তু মীম শানকে ছেড়ে থাকতে পারবে না । ভাবতে ভাবতে মীম দিগম্বরীর ছবিটার দিকে তাকাল । তার প্রায়ই মনে দিগম্বরীর মুখের ভঙ্গি একেক সময় একেক রকম থাকে !  
     দুপুরে মীম একাই থাকে যে ঘরের অন্য  কাজ  করে সে তখন কাকীমার ঘরে কাজ করতে চলে যায় । মীম একটু তাকিয়ে ফিরতেই আবার সেই গলা ," নাতবৌ শুধু  আমাকে দেখলেই হবে একটু মাছ দিয়ে খেতে দে না বড় ক্ষিদে পেয়েছে ।"
    মীম ঘুরে তাকায় দেখল ছবির পিসি ঠাকুমা তার দিকে তাকিয়ে হাসছেন । বেশ মিষ্টি হাসি মীম মনে মনে একটু ভয় পেল বাপরে ছবির লোকেরা কি কথা বলতে পারে ! ছোটবেলায় অনেক ভূতের গল্প শুনেছে কিন্তু ভূত কখনও চোখে দেখেনি । এখন কি পিসিঠাকুমার ভূত তার সঙ্গে কথা বলছে ! 
   " কি হল নাতবৌ ভয় পেয়ে গেলি । ভয় পাস না আমি তোকে কিছু করব না । শুধু একটু মাছ দিয়ে খেতে দে  কতকাল খাইনি। "
   মাগো এতো সত্যি পিসিঠাকুমার ছবি কথা বলছে !  মীম কোন কালেই ভিতু মেয়ে নয় তার সাহস আছে আর তার মনে হল যে পিসিঠাকুমা এতো মিষ্টি করে 'নাতবৌ নাতবৌ' করেন তিনি তার  কখনও ক্ষতি করবেন না ।বলল," পিসিঠাকুমা তুমি তো শুনেছি অনেক আগে মরে  ভূত হয়ে গেছ কিন্তু এখন দেখছি ছবি থেকেই কথা বলছ কেন !"
    " ওমা তুই আমার এতো আদরের নাতবৌ তোরা  এই বাড়ীতে প্রথমবার এলি তোর সঙ্গে কথা বলব না । আমার নাতির পছন্দ আছে তুই কি সুন্দর দেখতে !  আচ্ছা পরে তোর সঙ্গে কথা বলব । আগে একটু মাছ দিয়ে খেতে দে তো !"
   " সেকি পিসিঠাকুমা তুমি তো শুনেছি মাছ খেতে না , এমনকি মাছের গন্ধ পেলে তোমার নাকি বমি পেত সেই তুমি এখন মাছ দিয়ে খেতে চাইছ । ভূত হয়ে গিয়ে কি সব নিয়ম ভুলে গেছ নাকি ভূতের জগতের নিয়ম আলাদা !"
   " আহা নাতবৌ তুই একটা শিক্ষিত মেয়ে হয়ে এমন কথা বলছিস কেন । এই নিয়মনীতির  চক্করে  জীবিত অবস্থায় অন্তরকে কত কষ্ট দিয়েছি । আমার দুঃখের কথা কাউকে বলতে পারিনি বেচে থাকতে কিন্তু  আজ  তোকে  বলব  । "
    মীমের আর ভয় লাগছে না দুপুরবেলা  চারপাশে এতো আলো তাতে ভয় পাবার কিছু নেই । তাছাড়া একজন ভূতের সঙ্গে সে কথা বলছে বেশ একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা হচ্ছে তার । বলল, " ঠিক আছে পিসিঠাকুমা বল তোমার দুঃখের কথা !" মীম পিসিঠাকুমার ছবির দিকে তাকিয়ে তার বিছানার উপর গিয়ে বসল ।
     দিগম্বরী বলতে থাকেন ,"  পনেরো বছর বয়সে বিধবা হয়ে বাপের বাড়ি চলে এলাম । বাড়ি ভর্তি লোকজন  বড় রান্না ঘর কত  ধরনের মাছ আসছে রান্না হচ্ছে আর আমার ঠাঁই হল ঠাকুমার নিরামিষ হেঁসেলে। একসময় মাছ ছাড়া ভাত মুখে তুলতাম না সেই আমাকে সারাজীবন নিরামিষ খেতে হবে ভাবতেই চোখের জল এসে যেত । যখন ওদিকে মাছ রান্না হত লুকিয়ে লুকিয়ে মাছের গন্ধ নিতাম। খুব কষ্ট করে নিরামিষ খেতাম । তারপর একে একে মা , জেঠিমা, কাকীমা, বড়বৌদি  এদের ঠাঁই হল নিরামিষ ঘরে । আমি বুঝতাম সবারই খেতে একটু কষ্ট হত সবচেয়ে কষ্ট হত আমার। কিন্তু সবাইকে বলতাম আমি নাকি মাছের গন্ধ সহ্য করতে পারি না । এভাবেই থাকতে থাকতে একসময় মরে ছবিতে ঠাঁই পেলাম । এ বাড়ীর লোকজন একে একে চলে গেল এদিকটা  বন্ধই থাকে । এখন এতোদিন পর তোরা এলি ঘরে মাছ রান্না হচ্ছে আমার খুব ইচ্ছে করছে মাছ খেতে ! "
     মীমের  বেশ কষ্ট লাগল পিসিঠাকুমার কথা শুনে । সত্যি কে যে এসব নিয়ম বানিয়েছে বিধবাদের নিরামিষ খেতে হবে । বউ মরলে কি তাদের স্বামীরা নিরামিষ খায় যত নিয়ম  মেয়েদের বেলায় । একটা পনেরো বছরের মেয়ে সারাজীবন কি করে নিরামিষ খাবে । তবে সময় বদলে গেছে মীমের ঠাম্মী এখন মাছ খান । বলল," পিসিঠাকুমা তুমি তো ভূত হয়ে গেছ । শুনেছি ভূতেরা যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারে তাহলে তুমি এতো বছর হল মারা গেছ তাহলে মাছ খাওনি কেন? "
    " আসলে ভদ্র বাড়ির বাধ্য মেয়ে মরেও এ বাড়ীর বাইরে গিয়ে মাছ খাওয়ার কথা ভাবতে পারিনি । অন্য ভূত ,পেত্নি , শাক চুন্নিরা আমাকে  ওদের  বাড়ীতে  যাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করত কিন্তু আমি এই বাড়ী থেকে যাওয়ার কথা ভাবতে পারিনি । তাই এতো বছর ধরে ছবির মধ্যেই  বন্দি হয়ে আছি । চারপাশে চেয়ে দেখ আমার বাপ , ঠাকুরদা, ঠাম্মী কেমন কড়া শাসনে রেখেছে আমাকে মরে গিয়েও আমার দিকে নজর রাখছেন তারা । আমি এদের সামনে তো আর অবাধ্যতা করতে পারি না । তাই যখন ছবিতে থাকতে থাকতে আর ভালো লাগে না তখন এ বাড়ীর  আশপাশে একটু ঘুরে  বেড়াই । কিন্তু তুই আসার পর যখন মাছ রান্না করছিস , মাছের গন্ধ বেরুচ্ছে নিজেকে সামলাতে পারিনি।"
     " ঠিক আছে পিসিঠাকুমা তোমার মাছ খেতে ইচ্ছে করছে বল কী দিয়ে খাবে । ফ্রিজে দুরকমের মাছ আছে । "
   " আমাকে দুই রকমের মাছ দে পেট ভরে খাই আত্মাকে একটু শান্তি দিই !"
   " ভূতদের আবার আত্মা হয় নাকি । আত্মা বেরিয়ে গেলেই তবেই তো ভূত হয়। আচ্ছা বল কোথায় বসে খাবে এবার ছবি থেকে বেরিয়ে আস ।"
   " না না তুই ছবির সামনে এসে রেখে দে আমি চট করে খেয়ে নেব। "
   মীম ভাত দুরকমের মাছ দিয়ে সাজিয়ে থালা এনে দিগম্বরীর  ছবির  সামনে এনে রাখল  দিগম্বরী ছবি থেকেই হাত বাড়িয়ে চটপট খেয়ে নিলেন । বললেন ," বড় শান্তি দিদিভাই । রোজ আমাকে একটু মাছ খেতে দিবি তো !"
   " হু অবশ্যই দেব । কিন্তু তুমি তো ভূত নিজে  নিয়েও খেতে পারতে !"
   " ঔ যে বললাম মরে গিয়ে ও ভদ্রতা ছাড়তে পারিনি । চুরি করে খেতে পারব না ।"
   এরপর দিগম্বরী আর মীম দুজনে   বান্ধবী  হয়ে যায় মানে ভূত মানুষের বন্ধুত্ব । নির্জন দুপুরে দুজনে বসে গল্প করেন  কুন্ডু বাড়ীর পুরানো  দিনের কথা । আর দিগম্বরী ছবির  ভিতর থেকে হাত বাড়িয়ে মাছ ভাত খান ! কেউ জানে না তাদের   বন্ধুত্বের  কথা ! শেষপর্যন্ত  দিগম্বরীর  দুঃখ  ঘুচিয়ে  দিয়েছে মীম !

  সমাপ্ত