সিদ্ধার্থ পাল লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
সিদ্ধার্থ পাল লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

প্রবন্ধ - সীমান্তে কালো মেঘ - সিদ্ধার্থ পাল

 

 সীমান্তে কালো মেঘ
সিদ্ধার্থ পাল
 
        নিজেদের স্মৃতি থেকে ২০২০ সালকে মুছে ফেলতে এতদিনে হয়তো অনেকেই চেয়েছেন। করোনার সর্বগ্রাসী আতঙ্ক, মৃত্যুর কালো ছায়ায় ঢেকেছে গোটা পৃথিবীকে। জীবন আগে না জীবিকা, সেটা বাছাই করতে গিয়ে ধরাশায়ী হচ্ছে একের পর এক দেশের অর্থব্যবস্থা। লক-ডাউনে গৃহবন্দী মানুষ স্বাভাবিক দিনযাপনের সংজ্ঞা পর্যন্ত ভুলে গেছে। আমাদের দেশেও সেই একই দুরবস্থার ছবি সর্বত্র। তবে ভারতের পরিস্থিতি আরও সঙ্কটাপন্ন। লড়াই এখানে শুধুমাত্র অদৃশ্য ভাইরাসের সাথেই নয়। প্রতিবেশী শত্রুদেশরা পরিস্থিতির সুযোগে হানা দিচ্ছে সীমান্তে। এই নিয়ে টিভি, খবরের কাগজ বা স্যোশাল মিডিয়া, সর্বত্রই মন খারাপ করে দেওয়া সংবাদে তিক্ততর হয়ে উঠছে প্রতিটা দিন। দমবন্ধ করা নিরাশাজনক পরিস্থিতিতে ভরসা হারিয়ে যাচ্ছে সব কিছুর ওপর থেকেই। ও’দিকে, তথাকথিত বিশেষজ্ঞরা উদ্বাহু আস্ফালনে প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিচ্ছে ৬২’র যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানির কথা। আবার হয়তো সেই কালো দিনগুলোর পুনরাবৃত্তি হবে। করোনা এবং বৈদেশিক শক্তির যূথবদ্ধ আক্রমণে দেশের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হবে। চতুর্দিক যখন এতটাই অন্ধকার তখন ভাবলাম একবার খুঁজে দেখতে দোষ কি, সত্যি কতটা কালো ছিল ১৯৬২’র অভিজ্ঞতা। শুধুই কি গ্লানিতে আচ্ছন্ন সেই স্মৃতিগুলো নাকি সেখান থেকেও কুড়িয়ে আনা যায় এমন কিছু ঘটনা যা আমাদের আশার আলো দেখাবে? ইতিহাস থেকে শিখবো ভেবে শুরু করলাম বই ঘাঁটা। লকডাউনের সুযোগ নিয়ে পড়ে ফেললাম ব্রিগেডিয়ার ডালভি’র ‘Himalayan Blunder’, মেজর জেনারেল পালিতের ‘War In The High Himalayas’ এবং লিউটেন্যান্‌ট জেনারেল কাউলের ‘The Untold Story’। দেখলাম, প্রতিটা বইয়ের প্রত্যেক অধ্যায়ে ফুটে উঠেছে সমসাময়িক রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতৃত্বের সামগ্রিক বিপর্যয়ের কাহিনী। সাংবাদিক নেভিল ম্যাক্সওয়েলের লেখা ‘India’s China War’ বইতেও সেই অভিন্ন উপাখ্যান অনুরণিত হয়েছে। ভদ্রলোক চীনের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হলেও মূল বক্তব্য সেই একই। কিন্তু কোনো বইতেই মাটির কাছাকাছি থাকা জওয়ানদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সংগ্রামের আখ্যান সে’ভাবে খুঁজে পেলাম না। তাঁরা কি এতো সহজেই জমি ছেড়ে দিয়েছিলেন হানাদারদের? এটা তো ভারতীয় সেনার চরিত্র বিরোধী! মানতে পারছিলাম না। অবশেষে হাতে পেলাম শিব কুনাল ভার্মা’র ‘1962 The War That Wasn’t’ বইটি। বুঝলাম, প্রবল ব্যক্তিত্বশালী রাজনৈতিক নেতা বা বুকে অসংখ্য মেডেলধারী সেনাপতি নন, মাটির মানুষ, সাধারণ সেনানীদের নাছোড় লড়াইয়ের ক্ষমতার ওপরে ভরসা করেই আমরা নিশিন্তে ঘুমোতে যেতে পারি। ভাবলাম, তাঁদেরই একটা গল্প আপনাদের সাথে ভাগ করি। অনেকেই হয়তো এই বিষয়ে জানেন, আবার অনেকের কাছেই এটা নতুন তথ্যের ওপরে আলোকপাত করবে। তাই রিপিট করার ঝুঁকি নিয়েও আলোচনা করা যেতেই পারে। চলুন, একবার যাওয়া যাক ৬২’র ঘটনাবহুল দিনগুলোতে।
বর্ষার পরেই অনিবার্য যুদ্ধের কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছিল উত্তর সীমান্তে। দু’দেশের বর্ডারে মুখোমুখি জমায়েত হয়েছে অগুনতি সেনা। খবরের কাগজ বা অন্যান্য মিডিয়াতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আস্ফালক মন্তব্য করতে পিছপা না হলেও ভারতের সাধারণ জওয়ান এবং আর্মি লিডারশীপ বুঝতে পেরেছিল সাফল্যের সম্ভাবনা কতটা সীমিত। শীতবস্ত্র, খাবার থেকে আরম্ভ করে প্ল্যানিং, গোলাগুলির সরবরাহ, সর্বত্রই ছিল অভূতপূর্ব দৈন্যদশা। প্রথম গুলি চলার আগেই অবশ্যম্ভাবী পরাজয়ের বিষাদ গ্রাস করেছিল সেনাপতিদের চিন্তাভাবনাকে। অন্যদিকে, কিউবা মিসাইল ক্রাইসিসে বিশ্বের তাবড় শক্তিধর দেশগুলো তখন নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। ভারত-চীনের বর্ডার সংঘাত নিয়ে তাদের মাথা ঘামানোর সময় কোথায়। বাইরে থেকে সাহায্য আসার সম্ভাবনাও তাই ছিলো না। এই সুবর্ণ সন্ধিক্ষণ হাতছাড়া করেনি চীন। অবশেষে দীপাবলির সাতদিন আগে, ২১শে অক্টোবর ভোর রাতে, ম্যাক্‌মোহন লাইনের নৈঃশব্দ চুরমার হয়ে যায় ‘নামকা চু’ নালার পাশে ‘ঢোলা’ পোস্টের ওপরে তাদের সৈন্যদের হামলায়। ‘থাগ্‌ লা’র শৈলশিরা ডিঙ্গিয়ে, একের পর এক, ঢেউয়ের মতন আছড়ে পড়তে থাকে শত্রুর আক্রমণ। নিচে নালার পাশে, ট্রেঞ্চে প্রতিরোধকারী হতভাগ্য ভারতীয় সেনাদের কোনো সুযোগই ছিল না এই অসম লড়াইয়ের ফল কিছুমাত্র পরিবর্তন করার। আর্মি জেনারেলদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অকল্পনীয় স্থবিরতার এবং অমার্জনীয় শ্লথতার ফলস্বরূপ একরাতের লড়াইতেই ছত্রখান হয়ে যায় একটা গোটা ব্রিগেড। অপ্রতিরোধ্য চীনা আক্রমণের সামনে অসহায়ের মতন পতন হতে থাকে একের পর এক ডিফেন্সিভ লাইনের। তৈরি হয় একরকম ‘ডুম্‌স্‌ ডে’ পরিস্থিতির। পরেরদিন, অর্থাৎ ২২শে অক্টোবর মধ্যরাতে, ভারত, বর্মা এবং তিব্বতের ট্রাই জাংশন পয়েন্টের কাছে ‘ওয়ালঙ’ এর সীমানাতেও অনুপ্রবেশ আরম্ভ করে চীনা বাহিনী। ১৯৫০ এর ভয়ানক ভুমিকম্পে এই দুর্গম এলাকার নামমাত্র রাস্তাঘাটও সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে গেছিল। তাই আত্মরক্ষাকারীর পক্ষে সময়ের মধ্যে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছিল চূড়ান্ত কষ্টসাধ্য। ভারতীয় সেনারা অন্তিম বুলেট পর্যন্ত লড়াই করা সত্ত্বেও ‘কিবিথু’ ছেড়ে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়। শেষ পর্যন্ত ওয়ালঙকে ঘিরে তৈরি হয় পরবর্তী ডিফেন্সিভ লাইন। নিকটবর্তী ‘অশি’ হিলের কাছে চীনে সেনার গতি বিলম্বিত করার দায়িত্ব পড়ে ৬ কুঁমাওনের ‘ডি’ কোম্পানির ওপরে। এর নেতৃত্বে ছিলেন লিউটেন্যান্‌ট বিক্রম সিং রাঠোড়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান বা জার্মানির সাথে লড়াই করে পদক পাওয়া সেনানায়করা যেখানে সদলবলে খাবি খাচ্ছেন চাইনিজ হানাদারির সামনে, সেখানে এই সদ্য কুড়ি ডিঙ্গানো তরুণের কাছ থেকে বিশেষ কোনো আশা হয়তো কারোরই ছিল না। ‘নামতি’ নালার ওপরে থাকা কাঠের পাটাতন আর দড়ির ব্রিজ ভেঙ্গে দিলেই হয়তো চীনের অগ্রগতি একদিনের মত পিছিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু লিউটেন্যান্‌ট বিক্রম সিংয়ের পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। দুরন্ত বুদ্ধি এবং সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে তিনি প্রথমবার লড়াইকে প্রতিপক্ষের কাছে নিয়ে গেলেন। ব্রিজ একেবারে ধ্বংস না করে, বরং শেষদিকের বেশ কয়েকটা তক্তা সরিয়ে রাখা হল। তারপরে নালার একপাশে, উপযুক্ত যায়গায়, ‘ডি’ কোম্পানির একশ জন সৈন্যের সাথে ত্তৎ পেতে থাকলেন শত্রুর জন্য। তিনি নিজে, প্রত্যেক জওয়ানের পজিশন এবং রাইফেলের নিশানার পাল্লা পরখ করে নিশ্চিত করলেন, সীমিত বুলেট যেন সঠিক ভাবে কার্যকরী হয়। অতএব, প্রায় একশটা আগ্নেয়াস্ত্র এবং কিছু সংখ্যক মর্টার তাক করা রইলো ব্রিজের অপর প্রান্তের ‘চোক’ পয়েন্টের দিকে। বিক্রম সিং, সবাইকে বারবার মনে করিয়ে দিলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি আকাশে ‘ভেরি লাইট’ বা ইলুমিনেটিং রাউন্‌ড না ছুঁড়ছেন, ততক্ষণ যেন কেউ ভুলেও ট্রিগার না টেপে। এইভাবে তৈরি হল ভারতের প্রথম প্রতি-আক্রমণের পটভূমি।
 
         ২৫শে অক্টোবর ভোর ৩টের সময় চাইনিজ অ্যাডভান্সড্‌ কলাম এসে হাজির হল নালার ও’পাশে। প্রচণ্ড কুয়াশায় সে’রাতে দৃষ্টিগোচরতা ছিল সামান্য কয়েক গজ। এক চাইনিজ স্কাউট ঝুলন্ত ব্রিজের দড়ি ধরে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে থাকলো এই পাড়ের দিকে। ভারতীয় সেনাদের উপস্থিতি নজরে পড়লেই চেঁচিয়ে সবাইকে সাবধান করে দেবে। ব্রিজের এ’প্রান্তে এসে, ভালো করে ঠাহর করতে গিয়ে অন্ধকারে সে খেয়াল করলো না যে সামনের পাটাতন সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পা ফস্‌কে, প্রচণ্ড আর্তনাদ সহকারে ও হারিয়ে গেলো নিচের খরস্রোতা নালার জলে। সেই চিৎকার কানে যেতেই চাইনিজ’রা সার্চ লাইট জ্বালিয়ে খোঁজ আরম্ভ করলো হতভাগ্য স্কাউটের। কিন্তু এই ঘটনায় তাঁদের অবস্থান উদ্ঘাটিত হয়ে গেলো অ্যাম্‌বুশে অপেক্ষারত শিকারিদের কাছে। নিখুঁত সময়ে বিক্রম সিংয়ের ছোঁড়া ‘ভেরি’ লাইট দিনের আলোর মতন ঝলমলে করে দিলো ‘নামতি’ নালার ‘চোক পয়েন্ট’। মুহূর্তের মধ্যেই রাইফেলের গুলি ঝাঁক বেঁধে ছুটে গেলো সেই দিকে। মর্টারের গোলা আছড়ে পড়তে থাকলো পাথরের আড়ালে লুকোতে চাওয়া শত্রুর ওপরে। আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে ফেললো জমায়েত হওয়া ট্রাক বা অন্যান্য ট্রুপ্‌ ক্যারিয়ারগুলোকে। দূরপাল্লার ‘.৩০৩ এনফিল্ড’ রাইফেলের অভ্রান্ত লক্ষ্যভেদে একে একে লুটিয়ে পড়লো হানাদারদের প্রাণহীন দেহ। ধ্বংসাবশেষে ভরে উঠলো নামতির পাথুরে চরা। আগ্রাসনে অভ্যস্ত চীনা বাহিনী প্রথমবার উপলব্ধি করলো শিকার হওয়ার যন্ত্রণা। যুদ্ধটা তারা একতরফা হবে ভেবেছিলো। বাস্তবে তেমন হল কোথায়।
 
        এক ঘণ্টার ক্রমাগত গুলিবর্ষণের পরে লিউটেন্যান্‌ট বিক্রম সিং রাঠোড়ের অ্যাম্‌বুশ পার্টি অকুস্থল ছেড়ে পিছিয়ে আসে। ততক্ষণে, তাঁদের উদ্দেশ্য চূড়ান্ত ভাবে সফল। নালার অপর প্রান্তে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির প্রমাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অন্ততপক্ষে দুইশত হতাহতর ধাক্কায় ভোঁতা হয়ে যাওয়া চাইনিজ আক্রমণ আর এ’পথে আগে আসার সাহস পায়নি। তার চেয়েও বড় ব্যাপার, এই তুখোড় প্রতি-আক্রমণ এক লহমায় ওয়ালঙ সেক্টরের ভারতীয় সেনা এবং কমান্ডিং অফিসারদের মনোবল বাড়িয়ে দিল অনেকগুন। সঠিক প্ল্যানিং থাকলে চাইনিজ ব্লিৎস্‌ক্রিগকেও থামানো সম্ভব। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর বীর জওয়ানরা দ্বিগুন জোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে একপ্রকার রুখে দিল চীনের অনধিকার প্রবেশ। বুলেট শেষ হয়ে গেলে বেয়নেট নিয়ে হাতাহাতি যুদ্ধে পর্যুদস্ত করতে লাগলো প্রতিপক্ষের প্রোবিং পার্টিদের। সম্মান নিয়ে টানাটানি দেখে দেখে চীনের মিলিটারি হাইকম্যান্ড, Chengduআর্মি রিজার্ভের যাবতীয় অস্ত্র, কামান, গোলা বারুদ এবং পদাতিক সেনাকে নিক্ষেপ করলো শুধু মাত্র ওয়ালঙ দখলের জন্য। এ’দিকে জয়ের স্বাদ পেয়ে ভারতীয় কম্যান্ডাররাও দেখলেন অসম্ভবকে সম্ভব করার স্বপ্ন। নাঃ, শুধু ডিফেন্সিভ লড়াই আর নয়। লিউটেন্যান্‌ট বিক্রম সিংয়ের শুরু করার পাল্টা মার’কে বৃহত্তর রূপ দিতে ব্রিগেড লেভেলের কাউন্‌টার অ্যাটাকের পরিকল্পনা করা হল। লোহিত নদীর পাড়ে যদি চাইনিজ আর্মিকে নাস্তানাবুদ করা যায় তাহলে NEFA (North East Frontier Area)’র প্রতিশোধ শুধু সম্পূর্ণই হবে না, দখল বাহিনীকে উৎখাত করাও সম্ভবপর হবে। কিন্তু বিধি ছিল বাম।
অক্টোবর এবং নভেম্বর অভিযানের মাঝের কয়েক সপ্তাহে চীন যখন রিজার্ভ থেকে সৈন্য ঢেলে নিজেদের অবস্থান পাকা করছিল, ভারতের আর্মি হেড কোয়ার্টার ব্যস্ত ছিল ওয়ালঙ সেক্টরের ‘Order Of Battle (ORBAT)’ পরিবর্তন করতে। মাঝের দুই সপ্তাহে ঘনঘন চেঞ্জ করা হয় কমান্ডিং অফিসারদের। বারম্বার অদলবদল করা হয় কোম্পানি আর ব্যাটেলিয়নের অর্গানাইজেশন স্ট্রাকচার। ফলস্বরূপ, অবধারিত ঘাটতি রয়ে যায় প্রস্তুতিতে বা তথ্য সংগ্রহে। শত্রুপক্ষের ব্যাপক আয়োজনের খবরও এসে পৌছায় না কম্যান্ডারদের কানে। ভারতের স্পর্ধা ভাঙ্গতে চীন তার অফুরন্ত ভাঁড়ার নিয়ে দ্বিতীয়বার আক্রমণে উদ্যত হয় ১৪ই নভেম্বরে। তাদের প্ল্যান বানচাল করতে তড়িঘড়ি ওদের পূর্ব পার্শ্বে স্পয়েলিং কাউন্টার অ্যাটাক করে ইন্ডিয়ান আর্মি। উদ্দেশ্য ছিল ইয়েলো এবং গ্রিন পিম্পল নামক দুটি পাহাড় চূড়া থেকে চাইনিজ দখল উচ্ছেদ করা। সফল হলে, পুরো ওয়ালঙ উপত্যকাতেই চীনা অনুপ্রবেশকারী বাহিনীর অবস্থান দুর্বল হয়ে যেত। কিন্তু মোক্ষম সময়ে আবার প্রকট হয়ে পড়লো গোলা-বারুদ, শীতবস্ত্র আর অন্যান্য সামগ্রীর অভাব। সকল বিঘ্ন ডিঙ্গিয়ে, অনেক ক্ষয়ক্ষতির পরে হাতে এলো গ্রিন পিম্পল। তাতেও শেষরক্ষা হল না। ইয়েলো পিম্পলের পাহাড় চূড়া থেকে মাত্র কুড়ি ফুট দূরে নিঃশেষ হয়ে গেলো আমাদের দুর্ধর্ষ অভিযানের সামর্থ্য। যুদ্ধের রসদ শেষ হয়ে যাওয়ায় চীনের প্রতি-সংহারের হাত থেকে বাঁচার কোনো উপায় থাকলো না। একে একে নির্মূল হয়ে যেতে থাকলো প্রতিরোধের অবশিষ্ট অংশগুলোও। শত্রুর সাঁড়াশি আক্রমণে ওয়ালঙে ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার নিশ্চিত ধ্বংসের সম্মুখীন হয়ে দাঁড়ালো। এমতাবস্থায় ওয়ালঙের পশ্চিম পার্শ্ব টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব গিয়ে পড়লো বিক্রম সিংয়ের বিশ্বস্ত চওড়া কাঁধে। ব্রিগেডিয়ার সাহেবের আদেশ এলো, ১৬ই নভেম্বর সকাল ১১টা পর্যন্ত যে করে হোক আটকে রাখতে হবে চীনের আগ্রাসন। ব্রিগেডের বাকি সৈন্যরা এই সুযোগে অর্গানাইজড, ফাইটিং উইথড্রয়াল করতে পারবে। বিক্রম সিং এবারেও অক্ষরে অক্ষরে নির্দেশ পালন করলেন। ‘ডি’ কোম্পানির সৈন্যদের পাশে নিয়ে সারাদিন তুমুল লড়াইতে আটকে রাখলেন হাজারেরও বেশি হামলাকারীদের। লড়াই ছেড়ে পিছিয়ে আসার অনুমতি তিনি যতক্ষণে পেলেন ততক্ষণে অধিকাংশ সাথীই শহীদ হয়ে গেছেন। বিক্রম সিংয়ের মরিয়া প্রতিরোধে, শত্রুর ঘেরাবন্দি ভেঙ্গে পশ্চাদপসরণ করার সুযোগ পায় গুরুতর আহত অবশিষ্ট সতেরো জন। দিনাবসানে ক্লান্ত চীনা বাহিনী তাঁকে ঘিরে ফেলে। তীব্র কিন্তু নিস্ফল ক্ষোভে, বুলেট দিয়ে ঝাঁঝরা করে দেয় তাঁর বাইশ বছরের চির তরুণ দেহ। ৬ কুঁমাওনের প্রতিরোধ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই চীনের কাছে ওয়ালঙের পতন হয়।
 
         ইতিহাসের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে মুষ্টিমেয়র বীরত্বের অবদান কতটা? যেখানে যুগোপযোগী অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সম্ভার সেখানে ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যের কিই বা ভূমিকা থাকতে পারে। তাঁদের নামে বীরগাঁথা রচিত হয় হয়তো, কিন্তু প্রকৃত ফলাফলে কোনো সুদূরপ্রসারী প্রভাব থাকে কি? আপাতদৃষ্টিতে অর্বাচীন মনে হলেও এমন উদাহরণ কিন্তু বিরল নয় যেখানে একটি স্বল্পবর্ণীত চরিত্র বা তাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠা ঘটনা আমূল বদলে দিয়েছে জাতি বা দেশের ভবিষ্যতকে। কয়েক সহস্র বছর আগে, ঝিলম নদীর তীরে, পুরুর সাথে মরণপণ যুদ্ধের শেষে আলেকজান্ডার কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি হয়েছিলেন। বোধকরি তেমনই, লিউটেন্যান্‌ট বিক্রম সিং রাঠোড়ের রণহুংকারে নিজেদের আসু দুর্ভাগ্যের ছায়া দেখতে পেয়েছিল ৬২’র আগ্রাসীরা। মাউন্টেন ওয়ারফেয়ারের সব রকম রসদ থেকে বঞ্চিত ভারতীয়দের সরিয়ে ওয়ালঙ দখল করা খুবই ব্যয়বহুল অভিযানে পরিণত হয় চীনের কাছে। তদের হাজারেরও বেশি সেনা প্রাণ হারায়। আহত হয় আরও অনেক। Pyrrhic victory বোধকরি একেই বলে। আসামের সমতল থেকে এমন বহু বিক্রম সিংরা বদলা নিতে ছুটে আসছে জেনে একতরফা যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে তারা। ফেলে চলে যায় সমস্ত বিজিত জমি। সেই থেকে চীনের অরুনাচল দখলের হুংকারে বাহ্যিক আস্ফালন ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় নি। কে বলতে পারে, বছর বাইশের সেই তরুণ হয়তো একা হাতেই বদলে দিয়েছিলেন তৎকালীন NEFA তথা অধুনা অরুনাচল্প্রদেশের ভাগ্য।
ফিরে আসা যাক বর্তমানে। বসন্তের শুরু থেকেই অতিমারির ভয়াবহতায় প্রশাসন থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনীও যথেষ্ট বিক্ষিপ্তচিত্ত রয়েছে। তার ওপরে, পশ্চিমে পাকিস্তানের সাথে নিত্যদিনের দ্বৈরথে ব্যস্ত থাকার দরুন অবহেলিত হয়েছে চীনকে সামলানোর কৌশল। পুনরায় সুযোগের সদ্ব্যবহার করলো তারা। সামরিক মহড়ার অছিলায় তিব্বতে হাজির হওয়া চীনের হাজার হাজার সৈন্য, বিনা প্ররোচনায় অতি দ্রুততার সাথে মোতায়েন হল লাদাখে। এর সাথেই তারা আবর্জনায় ছুঁড়ে ফেলল লাইন অফ অ্যাক্‌চুয়াল কন্ট্রোলের স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে, কয়েক দশক ধরে, দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোকে। সেই থেকে, প্রতিনিয়ত যুদ্ধের হুমকি দিয়ে অবদমিত করে রাখতে চাইছে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের আত্মমর্যাদাকে। হাইব্রিড ওয়ারফেয়ারের সূত্রানুসারে মীরজাফরের দলও নড়েচড়ে বসেছে। সংবাদপত্রের পাতাজোড়া বিজ্ঞাপনে চীনের গুণকীর্তন চলছে। যেকোনো যুদ্ধে ভারতবর্ষের অস্তিত্ব যে অনায়াসে বিপন্ন হবে সেটা প্রমাণ করতে গিয়ে তারা বারবার তুলে আনছে ১৯৬২’র উদাহরণ। কিন্তু সেই একই উদাহরণ বিস্তারিত ভাবে জানলে দেখা যাবে চীন সেদিনও কোনো ওয়াকওভার পায়নি। এখনও পাবে না। অনেক পরিবর্তন এসেছে বরং ওদের ক্ষয়ক্ষতি সহ্য করার ক্ষমতার। আজ অনেক বেশি ইনসিক্যুরিটি তে ভুগছে চাইনিজ কম্যুনিস্ট পার্টি। সামান্যতম বিপর্যয়ের খবর যাতে জনগণের কাছে না পৌছায় তার জন্যে চতুর্দিকে বিপুল সেন্সরশিপের আয়োজন। এতো কিছু করেও আটকাতে পারছে না হংকংয়ের গণ-আন্দোলনকে। এই পরিস্থিতিতে গালওয়ানের খণ্ডযুদ্ধ যেমন চাইনিজ জুজু মুছে দিয়ে এ’দেশের প্রশাসনকে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করেছে, তেমনই চীনের মনেও সেই পুরনো ভয় নতুন করে ঢুকিয়ে দিয়েছে। বিক্রম সিং রাঠোড়রা এখনও অতন্দ্র প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে সীমানা জুড়ে। শুধু যদি যুদ্ধের রসদের জোগান ঠিক থাকে তাহলে যেকোনো অসাধ্য সাধন সম্ভব তাঁদের পক্ষে। ইন্ডিয়ান আর্মির বিভিন্ন ভিডিওতে তাই ঘুরেফিরে দেখা যাচ্ছে লজিস্টিক্সকে কতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে এবারে। তারসাথে, অভাবনীয় দ্রুত গতিতে পাহাড় কেটে তৈরি হচ্ছে টানেল এবং রাস্তা। নদীর ওপরে বসছে নতুন ব্রিজ। অস্ত্রশস্ত্র নয়, ১৯৬২ আর ২০২০র মধ্যে এগুলোই সবচেয়ে বড় তফাৎ।
 
         আগামী তিন মাস (নভেম্বর থেকে জানুয়ারি) খুবই গুরুত্বপূর্ণ আমাদের কাছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সাথে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ডামাডোলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যস্ত থাকবে নিজেকে নিয়েই। এ’দিকে, ভারতের প্রস্তুতিতে কণামাত্র ঢিলেমি দেখলেই আঘাত হানবে শত্রুরা। এ’বারের আক্রমণ হবে তিন দিক থেকে সমন্বিত ভাবে। পশ্চিমে পাকিস্তান, উত্তরে চীন এবং দেশের ভিতর থেকে অন্তর্ঘাতীরা। সীমানা রক্ষার দায়িত্বে রয়েছেন বিক্রম সিংদের উত্তরসূরিরা। চোখ বন্ধ করে ওঁদের ওপরে ভরসা করা যাবে। আপামর দেশবাসীকে বরং সতর্ক থাকতে হবে যাতে জাতি বা ধর্মীয় দাঙ্গায় উৎসাহ প্রদানকারীরা সুযোগ না পায়। ধর্ম, বর্ণ, জাতপাত নির্বিশেষে সবাই একে অন্যের হাত ধরে থাকলে ভারতের অমঙ্গল চাইবে এমন সাধ্য কার?
..................................
 
 

 

নীল রঙে মিশে গেছে লাল - সিদ্ধার্থ পাল

 

 নীল রঙে মিশে গেছে লাল  

 

সিদ্ধার্থ পাল



    ফটফটে চাদের আলোয় রুপালি কুয়াশার কাঁথায় ঢাকা পড়ে আছে জয়ন্তীর বিস্তীর্ণ শুষ্ক চরা। পাহাড়ের চুড়ায় শিব মন্দিরের টিমটিমে আলো এত দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে। অনেকটা সমুদ্রের মাঝখানে লাইট হাউসের মতন। দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে ওঠা নাম না জানা পাখিদের কর্কশ আর্তনাদ, চারিদিকের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে, পাথরের গায়ে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করছে থেকে-থেকে। শোনা যাচ্ছে ফেউয়ের ডাকও। উত্তরের পাহাড়গুলো পেরিয়ে আরও কিছুদূর গেলেই বক্সা রিজার্ভ ফরেস্ট। এমন নিশ্চল রাতে কখনও সখনও সেখানকার বাঘের গর্জন উপত্যকার বাতাসে তরঙ্গ তুলে কানে এসে পৌছায়। বালিতে সর্সর্শব্দ বুঝিয়ে দেয় নিশাচরদের উপস্থিতি। বোধহয় তেমনই কিছু উপলব্ধি করার জন্যে কানের কাছে হাত নিয়ে স্থির হয়ে ছিলেন আদিত্য। নাহ্, বাঘ বা নেকড়ের উপস্থিতি টের পাওয়ার জন্যে নয়। তিনি ঠাহর করতে চাইছেন তাদের থেকেও ভয়ংকর কিছুকে। আলো-আঁধারির অন্তরালে লুকিয়ে থাকা সেই ছায়াময় অবয়ব, যার সুরেলা গলার গুনগুন গান বৃত্তাকারে ঘুরে চলেছে তাঁকে। জ্যোৎস্না ভেজা রাতে তরাইয়ের ঘন জঙ্গলে, শিমূল আর গামারের ভিড়ে কিভাবে এলেন আদিত্য? অজ্ঞান ছিলেন, হঠাৎ জ্ঞান ফিরল এমন কোনো ব্যাপার নয়। খুব স্বভাবিক ভাবে, চোরকাঁটার আঁচড় বাঁচিয়ে, শিশিরসিক্ত ফার্ন পাতাগুলোকে লাল হাতে সিঁদুর লেপে দিচ্ছিলেন তিনি। আচমকা সব ভালো লাগার অনুভূতি মুছে গিয়ে জমাট অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার ভয় চেপে ধরল তাঁকে। খেয়াল হল, তিনি ভীষণ একা। না না, ঠিক একা নন। ওই আকর্ষণীয় স্বরের গুঞ্জন ঘিরে রেখেছে তাঁকে। মনে আসছেঅবকাশগেস্ট হাউসের কড়ি-কাঠ। জানালার কাছে তার মায়াময় হাতছানি, যাকে উপেক্ষা করা যায়না। ব্যস, তারপরে এই

    পায়ে-পায়ে লতা, গুল্ম এড়িয়ে চরার বালিতে এসে দাঁড়ালেন আদিত্য। বরফ শীতল কুয়াশার ছোঁয়ায় রোমকূপ কেঁপে উঠল। গায়ের লাল চাদর ভালো করে জড়িয়ে নিলেন। লাল রঙ তাঁর পছন্দ নয়। চোখ ভরা বিস্ময় আর বিতৃষ্ণা নিয়ে চিনতে চাইলেন ঘরে ফেরার পথ। অনেক দূরে পাহাড়ের কোলে লেপচা বস্তির কাঁপা আলো নজরে এল। সেটাকে ডান হাতে রেখে, নদীখাতের বালির ওপর দিয়ে সোজা উত্তরে হাঁটতে থাকলে নিশ্চয়ই জয়ন্তী ব্রিজ আসবে। ব্যস, ওখানে একবার পৌছতে পারলেই নিশ্চিন্ত। বাকি পথটুকু ওঁর খুব ভালো করে চেনা হয়ে গেছে এই দিনে। হিমাংশুর সাথে দেখা হয়ে গেলে অনেক কৈফিয়ত দিতে হবে। কিন্তু আদিত্যকে সে চেনে। বন্ধুকে অবশ্যই বিশ্বাস করবে। ছোটবেলায় এমন হয়েছে আদিত্যর সাথে দু-একবার। গভীর রাতে নিজেকে আচমকা খুঁজে পেত কোলকাতার বাড়ির ছাদে শ্যাওলা ধরা জলের ট্যাঙ্কের পাশে। আবার কখনও পেয়ারা তলার দোলনায় দুলতে-দুলতে দুরন্ত উল্লাসে খান-খান করে দিত মধ্যরাতের নৈঃশব্দ্য। ডাক্তার বলেছিল নক্টাম্বুলিজম্বা স্লিপ ওয়াকিং। ঠাকুমা বলত নিশির ডাক। মা রাত জেগে আদিত্যর দুহাত আঁকড়ে বসে থাকত রাত্রির গ্রাস থেকে ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে। সেসব এখন অতীত। অন্তুতপক্ষে বছর দেড়েক আগে পর্যন্ত তাই ছিল। সর্বশেষ বইয়ের ওপরে কাজ করতে বসেই সব এলোমেলো হয়ে গেল

    চাপা গুনগুন গান আবার ফিরে এল। এবারে অনেক কাছের থেকে। একা সে ছাড়তে চায় না আদিত্যকে। কখনও পরম মমতায় জড়িয়ে থাকে আবার মুহূর্তেই তাঁর অস্তিত্বকে প্রবল ঘৃণায় গুঁড়িয়ে ফেলতে উদ্দাম হয়ে ওঠে। এই সংসর্গ আদিত্যের অকাঙ্খিত। কাতর প্রার্থনায় নিস্তার চেয়েছেন। কোনো ফল হয়নি। হামিং শব্দটাই এখন তাঁর ঘুমপাড়ানি গান

    প্রবল অস্বস্তিতে দুচোখ বুজে এল আদিত্যর। এই অশরীরী উপস্থিতির কথাই কি গেস্ট হাউসে স্থানীয় ভুটিয়া লোকগুলো আলোচনা করছিল? ছোট এলাকায় খুব সামান্য ঘটনাই বড়সড় ঢেউ তোলে। সেখানে এক মাসের মধ্যে তিনটে অপঘাতে মৃত্যু সবার সাহসের ভিত নড়িয়ে দিয়েছে। গরীব-গুর্বো মানুষগুলোর সহজ ব্যাখ্যা হল, পাহাড়ি যক্ষীইদ্যাগ, কোনো অজানা পাপের সাজা হিসেবে হতভাগ্য লোকেদের প্রাণবায়ু শুষে খিদে মেটাচ্ছে শহুরে লোকেরা সেসব মানে না। তারা পুলিশি বিশ্লেষণের ভরসায় বসে থাকে। সেদিন কুমারগ্রাম থানার অফিসার ইনচার্জের সাথে দেখা হয়েছিল। আদিত্যকে বারবার রাতে কোথাও বেরোতে বারণ করেন তিনি। গল্প শোনালেন এক ভয়ানক সিরিয়াল কিলারের যে তার শিকারকে শুধু হত্যাই করে না, ছিন্নভিন্ন করে দেয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। ওসি সাহেব কিভাবে আর জানবেন, অসময়ে বাইরে যাওয়া-না যাওয়া আদিত্যর নিজের হাতে নেই

‘♫ ♫ রাজকুমারের একলা থাকা, ঘুমের ঘোরে বদ্যি ডাকা ♫ ♫’

    কানের কাছে সুর করে বলা শব্দগুলো বুকের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানিকে ছাপিয়ে গেল। খুব চেনা লাইন আর খুব পরিচিত সেই গলা। চোখের পাতা জোরে বন্ধ রেখে নিজেকে দুনিয়া থেকে আলাদা করে দিতে চাইলেন আদিত্য। বোঝা আর তিনি বইতে পারছেন না। এখনতো আর মা নেই, যে দরজা আগলে তাঁকে ঘরে আটকে রাখবে

আদি টুকি! চোখ খুলবে না? আমার ওপরে এত রাগ

মনে পড়ল ছোটবেলায় মা আদর করে বলত, ‘আদি, খেতে আয় সোহাগ মাখা রমণীয় এই ডাক উপেক্ষা করার শক্তি আদিত্যর নেই। শাসন শিথিল করে চোখ মেললেন তিনি

রূপসা! তুমি আবার…’

    তীক্ষ্ণ খিলখিল অট্টহাসি ভরিয়ে তুলল চরাচর। গাছের পাখিগুলো আতঙ্কে ঝাপটে উঠল ডানা। হাসির দমকে রূপসার সর্বাঙ্গ কাঁপছে। কাঁপছে আদিত্যর মেরুদণ্ডও। হামাগুড়ি দিয়ে বসে পড়তে ইচ্ছে করছে। গায়ে চিমটি কেটে জাগতে চাইছে এই ভয়ানক দুঃস্বপ্ন থেকে। চাঁদের আলোয় কি বীভৎসই না লাগছে রূপসার কৌতুক। হাতের চেটো আর কষ লাল টুকটুকে, যেন আঁজলা ভরে রক্তপান করেছে। আর নিতে পারলেন না আদিত্য। উদ্ভ্রান্তের মতন ছুটতে লাগলেন বালি পাথরের ওপর দিয়ে। কিছুদূর এগোতে পারলেই দেখতে পাবেন ব্রিজটা। সারারাত সেখানে গাড়ি চলে। মানুষ দেখা যায়। গেস্ট হাউসে পৌঁছে হিমাংশুকে খবর দিতে হবে। ছেলেবেলার বন্ধুটিকে তাঁর একান্ত প্রয়োজন। ওঁর সাথে গল্প কথায় মেতে থাকলে মন ভালো থাকে আদিত্যর

    হঠাৎ হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লেন তিনি। কাঁধের ঝোলা ছিটকে পড়েছে বালিতে। তিনি ঝোলা নিয়ে নিশি ভ্রমনে বেরিয়েছিলেন? নিজের পরনের কাপড় দেখে আবার হতবাক হয়ে গেলেন। গায়ে জড়ান লাল শাড়ি, রূপসার মতন। মেয়েটার দুরভিসন্ধি দিনের পর দিন ছত্রখান করে ফেলছে আদিত্যর অস্তিত্বকে। ওর ওপরে প্রবল রাগে, পাগলের মতন অস্ত্র খুঁজে বেড়ালেন হামাগুড়ি দিয়ে। তেমন কিছু কুড়িয়ে না পেয়ে ফেরত এলেন ঝোলার কাছে। হাতড়ে পেলেন টর্চ। আর পেলেন, একটা রক্তস্নাত ভোজালি। কোথা থেকে এল এটা এখানে? নিজের ভাবনাকে চাপা দিয়ে তৈরি হলেন আত্মরক্ষার জন্যে। হাতের মুঠোয় অস্ত্র বাগিয়ে ধরে পিছনে ফিরলেন। ওঁনার জীবন যে দুর্বিষহ করে রেখেছে, তাকে আজকেই নিকেশ করতে পিছপা হবেন না। কিন্তু কোথায় রূপসা? টর্চের আলোয় শুধু কুয়াশার মেঘ চোখে পড়ছে। আর কারো চিহ্নমাত্র নেই। অথচ ওর গলা এখনও মাথার ভিতরে অনুরণিত হচ্ছে। মেয়েটা থেকেও নেই আবার না থেকেও সর্বক্ষণ জানান দিচ্ছে উপস্থিতি

    টর্চ মাটিতে ফেলেই দুপা পিছিয়ে গেলেন আদিত্য। দেহটাতে এখনও প্রাণ আছে। আলোর দিকে হাত বাড়িয়ে সাহায্য চাইছে নিঃশব্দে। প্রতিটা প্রচেষ্টায় দলা-দলা রক্ত উঠে আসছে ওর মুখ দিয়ে। কাছে গিয়ে চিনতে পারলেন তাকে আদিত্য। জিমসান দোরজে।অবকাশগেস্ট হাউসে হিমাংশুর সর্বক্ষণের সহায়ক। রান্নার হাত দারুণ। ওর হাতে দো-পেঁয়াজা খেয়ে প্রাণভরে প্রশংসা করেছেন কতবার। তারও এমন নির্মম পরিণতি হল?

কে মেরেছে তোমায় জিমসান? বল আমাকে। রূপসা? লাল শাড়ি পড়া কোনো মেয়ে?’

    আদিত্যর প্রশ্নে অবসন্ন জিমসানের চোখে বিহ্বলতা ফুটে উঠল। অবিরাম রক্তক্ষরণে বাকশক্তি হারিয়েছে তার। একটু যদি জল দেওয়া যেত ওকে। বালি খুঁড়লে, তলায় লুকনো জয়ন্তীর ধারা পাওয়া যাবে হয়তো। কিন্তু একি! জিমসানের ঘোলাটে দৃষ্টিতে চূড়ান্ত হিংস্রতা জেগে উঠেছে। রক্তাক্ত আঙ্গুলগুলো দিয়ে টিপে ধরতে চাইছে আদিত্যর গলা। মৃতপ্রায় মানুষটা সর্বশক্তি দিয়ে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে ওঁর টুঁটি। নিরুপায় আদিত্য মাটি থেকে ভোজালি তুলে নিয়ে কোপ বসাতে লাগলেন জিমসানের হাতে, গায়ে। মাংসের মধ্যে ধারালো ধাতু প্রবেশের চপ্চপ্শব্দ আর জিমসানের গোঙানি ছাড়া জয়ন্তী তখন শান্ত। ধীরে-ধীরে জিমসান নিঃসাড় হয়ে গেল। তার প্রাণহীন দেহ পিছনে ফেলে রেখে আবার ছুটতে শুরু করলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা লেখক আদিত্য বসু

    বছর খানেক আগে, সাহিত্য অ্যাকাডেমির পুরষ্কার নেওয়ার সময় কোনো এক হাল্কা মুহূর্তে জ্যোতির্ময়কে কথাটা বলে ফেলেছিলেন। চিরকাল হাস্যরস এবং সামাজিক বিষয়ে লিখে প্রবল জনপ্রিয়তা পেয়ে তিনি এবারে নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে চান। নিজের স্বচ্ছন্দ্য পরিসরের বাইরে বেরিয়ে অন্য কোনো জ্যঁরের সাথে এক্সপেরিমেন্ট করবেন। জ্যোতির্ময় লুফে নিয়েছিল প্রস্তাব। সেই থেকে এঁটুলি পোকার মতন পিছনে লেগে ছিল প্রকাশক বন্ধুটি। তাঁর তাড়নাতেইমনস্ত্বাত্তিক রোমাঞ্চনিয়ে রিসার্চের গভীরে ডুবে যান আদিত্য। পড়ে ফেলেন গাদা-গাদা বই। বিশ্বের তাবড়-তাবড় বৈজ্ঞানিক, গবেষকদের লেখা পড়ে বুঝতে পারেন, মনের রহস্যের গোলকধাঁধা মহাকাশের নক্ষত্রপুঞ্জের থেকেও সীমাহীন। ফোটন কণার থেকেও দ্রুতগামী এই শক্তি কোয়ান্টাম মেকানিক্স ত্বত্তের সংজ্ঞা অনুসারে একই সাথে সর্বত্র বিরাজ করতে পারে। ওয়ার্মহোলের সাহায্য ছাড়াই সমান্তরাল মহাবিশ্বে তার অবাধ বিচরণ। অবলীলায় খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলে সত্তাকে। আবার জুড়ে ফেলে প্রয়োজন মত। কত অদ্ভুত ঘটনার বিবরণ পড়ে ধাপে-ধাপে লেখার পটভূমি তৈরি করেছিলেন আদিত্য। তারপরে বাস্তবতার ছোঁয়া পেতে উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মধ্যে সমাহিত করে ফেলেন নিজেকে। লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গিয়ে দিন-রাত এক করে লিখতে থাকেন একের পর এক অধ্যায়। মনঃসংযোগ বজায় রাখার জন্যে এক জ্যোতির্ময় ছাড়া বাইরের কারোর সাথে দেখা পর্যন্ত করতেন না। দিনের পর দিন এমন কঠোর অধ্যবসায়ে পাণ্ডুলিপি শেষ হলেও অবসাদে আচ্ছন্ন হয়ে যায় তাঁর চেতনা। গল্পের গবেষণার কাজে জানতে পেরেছিলেন কিছু উদ্ভিদের সাইকেডেলিক ক্ষমতার কথা। সেই থেকে মানসিক দুরবস্থার ওষুধ হয়ে দাঁড়ায় নেশা। আদিত্যর সামাজিক সংযোগের দ্রুত অবনতি ঘটায় চূড়ান্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে জ্যোতির্ময়। জানা পরিচয়ের মধ্যে কোনো আত্মীয়স্বজন নেই তাঁর। অ্যাডাল্ লাইফ একলাই কাটিয়ে আসা লোকটার সাহায্যে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে আসে ছেলেবেলার বন্ধু হিমাংশু। ওর আমন্ত্রনে এবং জ্যোতির্ময়ের পরামর্শে জয়ন্তীর পাড়ে গেস্ট হাউসে মাস দেড়েক কাটিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন আদিত্য। হিমাংশু থাকলে রূপসা আসতে পারে না কাছে। দূর থেকে চাপা রাগে ফুঁসতে থাকে। আদিত্যর বন্ধুরা রূপসার চোখের বালি

    গেস্ট হাউসের কাছাকাছি পৌঁছে আবার পিছনে ফিরে দেখলেন আদিত্য। নাহ্কেউ নেই। দূরে কোথাও বালির ওপরে এখনও পড়ে আছে দোরজের নিষ্প্রাণ দেহ। আদিত্য কি আজকে নরহত্যা করলেন? না না ছেলেটা এমনিতেই বাঁচত না। রূপসা ওঁর ফুস্ফুস ফুটো করে দিয়েছিল যে। কত কষ্ট পাচ্ছিল। আদিত্য বরং সেই যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়েছেন। এক প্রকার মার্সি কিলিং। দোরজেকে বেশ ভালোবাসতেন আদিত্য। সুন্দর ভাব জমে উঠেছিল। দুদিন আগে আড়াল থেকে কিছ কথা শুনে ফেললেন তিনি। কোলকাতার লেখকের অদ্ভুত স্বভাব নিয়ে দারোয়ান গুরুঙ্গের সাথে নিষ্পাপ মস্করায় মেতেছিল দোরজে। রাতে দোতলায় কাজে গিয়ে লুকিয়ে পুরুষ মানুষের লিপস্টিক পড়া দেখেছে। দমফাটা হাসিতে ফেটে পড়ছিল ওরা। উল্লাসের প্রতিটা দমকে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল আদিত্যর অন্তরাত্মা। জীবনে প্রতিষ্ঠিত সে। সাহিত্য চর্চার পুরস্কারে ওঁর বালিগঞ্জের ফ্ল্যাট সাজানো। পাহাড়ি তরুণের ঠাট্টা তাঁর অবজ্ঞা করাই উচিত। তারপরে আদিত্য ভয়ও পেলেন খুব। মুখ লুকিয়ে পালিয়ে আসলে রূপসা রেগে যায়। হিমাংশু এসেছিল আদিত্যর মনখারাপ দূর করতে। কিন্তু গ্লাসের টুংটাং আর প্রাণ খোলা খুশির খেয়ালে লক্ষ্য করেনি ঘরে এসেছে রূপসাও

    ধূলিধূসরিত আদিত্য গেটের কাছে এসে শিউরে উঠলেন। চেয়ারে ঘুমন্ত গুরুং এর পাশে এলোকেশী হয়ে মিটিমিটি হাসছে মেয়েটা। আবার সেই অস্ফুট হামিং। মন্ত্রমুগ্ধের মতন এগিয়ে গেলেন আদিত্য। অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে

 

♫♫♫♫♫♫♫♫♫♫♫♫♫♫♫♫♫♫

 

    গেস্ট হাউসের সামনে জ্যোতির্ময় যখন গাড়ি থেকে নামল, তখন ঘড়ির কাঁটা রাত দুটো ছুঁই-ছুঁই। ভাড়া মিটিয়ে দিতেই ড্রাইভার দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল। ড্রাইভারের বাড়ি এখান থেকে কুড়ি কিলোমিটারের মধ্যে। মোটরগাড়িতে এই দূরত্ব তাড়াহুড়ো করার মতন নয় একেবারেই। তবে পথে আসার সময় জ্যোতির্ময় শুনেছিল এক খুনি যক্ষীর কাহিনী। সবাই তার ভয়ে কাঁটা। নৃশংস হত্যালীলার বিবরণে কপালের দুশ্চিন্তার ভাঁজ আরও গভীর হয়েছে জ্যোতির্ময়ের। এখন টিমটিমে বাল্বের আলোতে, সাইনবোর্ডেঅবকাশগেস্ট হাউসের নাম পড়তে গিয়ে ওর একবার মনে হল, হয়তো রাতটা আলিপুরদুয়ার সদরে কাটিয়ে এলেই ভালো হতো

    দারোয়ানের খালি ঘরে ছোট টিউবের আলোয় একলা টেবিল ফ্যান আপন খেয়ালে এদিক-ওদিক হাওয়া দিয়ে যাচ্ছে। জ্যোতির্ময় গলা খাঁকারি দিয়েও কারো সাড়া শব্দ পেল না। রিসেপ্শনেও একই অবস্থা। হিমাংশুর সাথে আগে দেখা হওয়া ভীষণ জরুরী। গতকাল ডক্টর কনক চৌধুরী শিয়ালদহ স্টেশনে বিদায় জানাতে এসেছিলেন। জ্যোতির্ময়কে বুঝিয়েছিলেন তিনি, আদিত্যর বর্তমান মানসিক অবস্থায় চমক অনিশ্চিত প্রতিক্রিয়া উদ্রেক করতে পারে। তাই আগে-ভাগে বলে কয়ে যাওয়াই উচিত। সেরকমই করবে ভেবেছিল জ্যোতির্ময়। আদিত্য সেল ফোন ব্যবহার করে না। হিমাংশুর সাথেও কিছুতেই যোগাযোগ করা যায়নি মোবাইলে। কোনো কর্মচারী ল্যান্ড লাইনটা তুলেছিল একদিন। ভাঙ্গা বাংলা আর হিন্দি মিশিয়ে বলেছিলবাবু পতাহ্নাই অমঙ্গলের কালো ছায়া দেখেছিল জ্যোতির্ময়

    আদিত্যর পরিস্থিতির জন্যে জ্যোতির্ময় নিজেকেই দায়ী করে কিছুটা। সর্বকালের সেরা ক্ল্যাসিক সৃষ্টির উল্লাস, নেশার মাদকতা ছড়িয়েছিল। আদিত্যকে লেখার সাহায্যার্থে বই-পত্তর, ম্যাগাজিন সব ওই জোগাড় করে এনে দিত। সময় সুযোগ পেলেই ছুটে যেত বন্ধুর ফ্ল্যাটে। মন দিয়ে শুনত প্লট। দিত নানা রকম সাজেশন্স। তবুও চোখের সামনে আদিত্যকে ডুবে যেতে দেখে হাত বাড়িয়ে দেয়নি। ভেবেছিল, স্রষ্টারা একটু পাগলাটে তো হয়ই। সাইকেডেলিকের প্রভাবে মোহাচ্ছন্ন আদিত্যর হাত থেকে পাণ্ডুলিপি নেওয়ার সময় জ্যোতির্ময় বুঝেছিল ওঁর অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে বেরিয়ে গেছে

    অ্যাকিউট কেস অফ ডিসোসিয়েটিভ পারসোনালিটি ডিজ-অর্ডার, ডক্টর চৌধুরী আদিত্যর মনস্তাত্বিক মূল্যায়ন করে বলেছিলেন। নিজের ব্যক্তিসত্তাকে অন্য কোনো ইমাজিনারি পারসোনালিটির কাছে হারিয়ে ফেলছেন ওঁ ক্রমশ। খুব সম্ভবত ছেলেবেলায় বেশ কিছু এপিসোড্ হয়েছিল। মা মরা ছেলের ঠিক মতন চিকিৎসা হয়নি। বয়স বাড়লে আদিত্য আপাত সুস্থ জীবনে ফিরে আসলেও উপসর্গগুলো অন্তঃসলিলা নদীর মতন লুকিয়ে ছিল। স্বভাব তেমন পুরুষালী না হওয়ায় আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা অচেনা আগন্তুকের কাছ থেকে বক্রোক্তি শুনলেও প্রতিবাদ করতে পারতেন না। মনের কষ্ট চেপে রেখে একের পর এক মজার সামাজিক গল্প লিখে সবাইকে হাসানোর চেষ্টা করে গেছেন। ভুলতে চেয়েছেন কাপুরুষ দুর্বল আদিত্যকে। অবশেষে নিজের সৃষ্টিতে, দৃঢ়চেতা নায়ক বা নায়িকার চরিত্র চিত্রণের প্রয়াসে, তাদেরই কারোর মধ্যে মিশে গেছেন। হ্যালুসিনেট করছেন তিনি দিন রাত। গুলিয়ে ফেলছেন বাস্তব আর অপার্থিব জগতের মধ্যে ভেদাভেদ। ওঁর অবিলম্বে চিকিৎসা আরম্ভ হওয়া দরকার। প্রতি দিন, প্রতি মুহূর্তের অপচয়ে ভয়ংকর ক্ষতি হতে পারে

    হিমাংশুর সাথে শেষবারের কথায় বিপদের ইঙ্গিত পেয়েছিল জ্যোতির্ময়। ডক্টর চৌধুরীর রিপোর্ট পেয়ে তাই নিজেই চলে আসার প্ল্যান করে। আদিত্যকে বাড়ি ফেরার জন্যে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করাতেই হবে। ঘটনা আরও জটিল হয়ে গেছে গত পরশু থেকে। ভবানীভবন থেকে সিআইডি অফিসার কৌশিক, জ্যোতির্ময়কে ফোন করে আদিত্যর খবরাখবর নিয়েছেন। গোয়েন্দাটি আদিত্যর সাথে কথা বলতে চান। তাঁর বইতে বর্ণিত কিছু ঘটনার সাথে ইদানিংকালে ঘটে যাওয়া দুয়েকটি চাঞ্চল্যকর অপরাধের গুরুত্বপূর্ণ মিল পাওয়া গেছে। আদিত্যর হদিস সে জানে না বলে ফোন রেখে দিলেও জ্যোতির্ময় বুঝতে পেরেছে, তাঁর পিছনে ফেউ লেগেছে। অনেক ঘুরপথে, পুলিশের চরকে কাটিয়ে এখানে পৌছতে তাই দেরি হয়ে গেল

    হিমাংশুর খোঁজ না পেয়ে আদিত্যর ঘরের দিকে পা বাড়াল জ্যোতির্ময়। রুম নম্বর আগেই জানত। হাতে ভারি বইয়ের ব্যাগ নিয়ে, কাঠের সিঁড়িতে মচ্মচ্শব্দ তুলে দোতলায় আদিত্যের ঘরে নক করল সে। দরজার তলা দিয়ে আলো আসছে। সম্ভবত জেগেই আছে

    এলে তাহলে?’, দরজা খুলেই বলল আদিত্য। ওঁর মুখের অভিব্যক্তিতে কোনো বিস্ময় লক্ষ্য করল না জ্যোতির্ময়। আদিত্য যেন জানতো যে জ্যোতির্ময় আসবে। আজকেই আসবে। কোনো-কোনো সময় ওঁর মানসিক ক্ষমতা বেড়ে যায় ভয়ানক ভাবে। তাকে সিক্সথ সেন্স, টেলিপ্যাথি না ইএসপি কি বলে জ্যোতির্ময় জানে না। নিজের বুকের ধুকপুকানি লুকিয়ে সহাস্যে ঘরে ঢুকল সে। পাহাড়ি রহস্যঘেরা জয়ন্তীর কোলে, নিজের এতদিনের সুহৃদকে দেখে খুব ভয় হল তার

    হ্যাঁ, সারপ্রাইজ দিতে মাঝ রাতেই চলে এলাম। তুমি তো একেবারেই অবাক হওনি দেখছি, জ্যোতির্ময় নিজেকে সাহস দেওয়ার জন্যেই যেন হইচই করে উঠল। গেস্ট হাউসে কি আর কোনো অতিথি নেই? তাঁদের কেউও যদি শব্দে বিরক্ত হয়ে কমপ্লেন করতে আসত তাহলে বুকে বল পাওয়া যেত

    শশ্শ্শ্‌…’, আঙ্গুল দিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে জ্যোতির্ময়কে চুপ করতে বললেন আদিত্য, ‘আওয়াজ কোরো না। রূপসা আছে

    জ্যোতির্ময়ের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। আদিত্যর এপিসোড চলছে। কথাবার্তা অসংলগ্ন হলেও চোখের দৃষ্টি অস্বাভাবিক রকম উজ্জ্বল। তীক্ষ্ণ নজরে এফোঁড় -ওফোঁড় করে ফেলছে জ্যোতির্ময়ের মগজ। শুরু থেকেই অদ্ভুত লেগেছে ওঁকে। চোখে সরু করে কাজল লাগানো। গালে রঙিন প্রসাধন

    রূপসা তো থাকবেই। তাকে সঙ্গে করেই নিয়ে এলাম আমি। এই তোমার পাঁচ কপি, আদিত্যর চোখ থেকে বাঁচতে জ্যোতির্ময় শশব্যস্ত হয়ে ব্যাগ থেকে বের করলেন তাঁর এযাবৎ শ্রেষ্ঠ লেখা। রূপসা নামের এক নারী সিরিয়াল কিলারের অভাবনীয় মনস্তাত্ত্বিক উপাখ্যাননীল রঙে মিশে গেছে লাল রূপসা যেমন সাহসী তেমনই হিংস্র। ঠিক যেমনটি আদিত্য হতে চেয়েছিল মনের গোপন স্তরে। বইটির আকাশছোঁয়া চাহিদা ইতিমধ্যেই ছাপিয়ে গেছে প্রিন্টেড কপির সংখ্যা

    আলাপ করবে ওর সাথে? দাঁড়াও ডেকে আনি, দৃশ্যতই উচ্ছ্বসিত আদিত্য বই হাতে শোয়ার ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, ‘কোথাও যেওনা যেন। এক্ষুনি আসছি।

    কাকে নিয়ে আসবে ঘর থেকে? মনের অলীক কল্পনাকে কি আর মাটিতে নামানো যায়। আদিত্যর কাজকর্মে দুশ্চিন্তার মধ্যেও হাসি পেল জ্যোতির্ময়ের। মনের ভুলে একটা মেয়ের গলাও শুনতে পেল যেন। কে জানে কেন আদিত্যের এত দেরি হচ্ছে। অস্থিরতা কমাতে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল ঘরের খুঁটিনাটি। ভিতরে একটা বাসি, থমথমে গন্ধ আছে না? এঁটোকাঁটা জমিয়ে রাখার অভ্যেস আছে ওঁর। বালিগঞ্জের বাড়িতেও একই জিনিস হত। জ্যোতির্ময় গিয়ে সপ্তাহান্তে সব পরিস্কার করে আসত, নইলে দুর্গন্ধে টেকা যেত না। এদিক সেদিক ভালো করে দেখে জ্যোতির্ময় অনুমান করল কাপবোর্ডের আড়ালেই জমে আছে কিছু

    কাপবোর্ডের পাল্লা খুলে নিশ্চল হয়ে গেল সে। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা, দলা পাকানো, খুবলানো শরীরটা কদিন আগেও ভিডিও কলে জ্যোতির্ময়কে বলেছিলসব ভালো নেই। আপনি শিগগির আসুন মনে পড়ল লেখাতে আদিত্যকে এমন কিছু নারকীয়তা যোগ করার পরামর্শ জ্যোতির্ময়ই দিয়েছিল। বইয়ের কাটতি বেশি হওয়ার আশায়

স্থূল হাতে পাল্লা বন্ধ করতেই নারী কণ্ঠের গুনগুন কানে আরও স্পষ্ট হল,

‘♫ একলা ঘরে এক, ফন্দি করে দেখ,

পিঠে এল দুই, মাদুর পেতে শুই,

নিশির ডাকে তিন, বাঁচার আশা ক্ষীণ ♫’

    চুড়ির আওয়াজ রিনরিন করছে জ্যোতির্ময়ের পিছনে। উগ্র আতরের সুবাস বিবস করছে ওর চেতনা। নিঃসীম আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে চোখ বুজল সে

    খিলখিল করে হেসে উঠে রূপসা। আজ থেকে সম্পূর্ণ মালিকানা পেয়ে যাবে আদিত্যর শরীরের। শুধু একটা কাজ বাকি

টুকি জ্যোতির্ময়। আমার দিকে তাকাও

 

 ...........


Siddhartha Pal