প্রবন্ধ - সীমান্তে কালো মেঘ - সিদ্ধার্থ পাল

 

 সীমান্তে কালো মেঘ
সিদ্ধার্থ পাল
 
        নিজেদের স্মৃতি থেকে ২০২০ সালকে মুছে ফেলতে এতদিনে হয়তো অনেকেই চেয়েছেন। করোনার সর্বগ্রাসী আতঙ্ক, মৃত্যুর কালো ছায়ায় ঢেকেছে গোটা পৃথিবীকে। জীবন আগে না জীবিকা, সেটা বাছাই করতে গিয়ে ধরাশায়ী হচ্ছে একের পর এক দেশের অর্থব্যবস্থা। লক-ডাউনে গৃহবন্দী মানুষ স্বাভাবিক দিনযাপনের সংজ্ঞা পর্যন্ত ভুলে গেছে। আমাদের দেশেও সেই একই দুরবস্থার ছবি সর্বত্র। তবে ভারতের পরিস্থিতি আরও সঙ্কটাপন্ন। লড়াই এখানে শুধুমাত্র অদৃশ্য ভাইরাসের সাথেই নয়। প্রতিবেশী শত্রুদেশরা পরিস্থিতির সুযোগে হানা দিচ্ছে সীমান্তে। এই নিয়ে টিভি, খবরের কাগজ বা স্যোশাল মিডিয়া, সর্বত্রই মন খারাপ করে দেওয়া সংবাদে তিক্ততর হয়ে উঠছে প্রতিটা দিন। দমবন্ধ করা নিরাশাজনক পরিস্থিতিতে ভরসা হারিয়ে যাচ্ছে সব কিছুর ওপর থেকেই। ও’দিকে, তথাকথিত বিশেষজ্ঞরা উদ্বাহু আস্ফালনে প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিচ্ছে ৬২’র যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানির কথা। আবার হয়তো সেই কালো দিনগুলোর পুনরাবৃত্তি হবে। করোনা এবং বৈদেশিক শক্তির যূথবদ্ধ আক্রমণে দেশের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হবে। চতুর্দিক যখন এতটাই অন্ধকার তখন ভাবলাম একবার খুঁজে দেখতে দোষ কি, সত্যি কতটা কালো ছিল ১৯৬২’র অভিজ্ঞতা। শুধুই কি গ্লানিতে আচ্ছন্ন সেই স্মৃতিগুলো নাকি সেখান থেকেও কুড়িয়ে আনা যায় এমন কিছু ঘটনা যা আমাদের আশার আলো দেখাবে? ইতিহাস থেকে শিখবো ভেবে শুরু করলাম বই ঘাঁটা। লকডাউনের সুযোগ নিয়ে পড়ে ফেললাম ব্রিগেডিয়ার ডালভি’র ‘Himalayan Blunder’, মেজর জেনারেল পালিতের ‘War In The High Himalayas’ এবং লিউটেন্যান্‌ট জেনারেল কাউলের ‘The Untold Story’। দেখলাম, প্রতিটা বইয়ের প্রত্যেক অধ্যায়ে ফুটে উঠেছে সমসাময়িক রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতৃত্বের সামগ্রিক বিপর্যয়ের কাহিনী। সাংবাদিক নেভিল ম্যাক্সওয়েলের লেখা ‘India’s China War’ বইতেও সেই অভিন্ন উপাখ্যান অনুরণিত হয়েছে। ভদ্রলোক চীনের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হলেও মূল বক্তব্য সেই একই। কিন্তু কোনো বইতেই মাটির কাছাকাছি থাকা জওয়ানদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সংগ্রামের আখ্যান সে’ভাবে খুঁজে পেলাম না। তাঁরা কি এতো সহজেই জমি ছেড়ে দিয়েছিলেন হানাদারদের? এটা তো ভারতীয় সেনার চরিত্র বিরোধী! মানতে পারছিলাম না। অবশেষে হাতে পেলাম শিব কুনাল ভার্মা’র ‘1962 The War That Wasn’t’ বইটি। বুঝলাম, প্রবল ব্যক্তিত্বশালী রাজনৈতিক নেতা বা বুকে অসংখ্য মেডেলধারী সেনাপতি নন, মাটির মানুষ, সাধারণ সেনানীদের নাছোড় লড়াইয়ের ক্ষমতার ওপরে ভরসা করেই আমরা নিশিন্তে ঘুমোতে যেতে পারি। ভাবলাম, তাঁদেরই একটা গল্প আপনাদের সাথে ভাগ করি। অনেকেই হয়তো এই বিষয়ে জানেন, আবার অনেকের কাছেই এটা নতুন তথ্যের ওপরে আলোকপাত করবে। তাই রিপিট করার ঝুঁকি নিয়েও আলোচনা করা যেতেই পারে। চলুন, একবার যাওয়া যাক ৬২’র ঘটনাবহুল দিনগুলোতে।
বর্ষার পরেই অনিবার্য যুদ্ধের কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছিল উত্তর সীমান্তে। দু’দেশের বর্ডারে মুখোমুখি জমায়েত হয়েছে অগুনতি সেনা। খবরের কাগজ বা অন্যান্য মিডিয়াতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আস্ফালক মন্তব্য করতে পিছপা না হলেও ভারতের সাধারণ জওয়ান এবং আর্মি লিডারশীপ বুঝতে পেরেছিল সাফল্যের সম্ভাবনা কতটা সীমিত। শীতবস্ত্র, খাবার থেকে আরম্ভ করে প্ল্যানিং, গোলাগুলির সরবরাহ, সর্বত্রই ছিল অভূতপূর্ব দৈন্যদশা। প্রথম গুলি চলার আগেই অবশ্যম্ভাবী পরাজয়ের বিষাদ গ্রাস করেছিল সেনাপতিদের চিন্তাভাবনাকে। অন্যদিকে, কিউবা মিসাইল ক্রাইসিসে বিশ্বের তাবড় শক্তিধর দেশগুলো তখন নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। ভারত-চীনের বর্ডার সংঘাত নিয়ে তাদের মাথা ঘামানোর সময় কোথায়। বাইরে থেকে সাহায্য আসার সম্ভাবনাও তাই ছিলো না। এই সুবর্ণ সন্ধিক্ষণ হাতছাড়া করেনি চীন। অবশেষে দীপাবলির সাতদিন আগে, ২১শে অক্টোবর ভোর রাতে, ম্যাক্‌মোহন লাইনের নৈঃশব্দ চুরমার হয়ে যায় ‘নামকা চু’ নালার পাশে ‘ঢোলা’ পোস্টের ওপরে তাদের সৈন্যদের হামলায়। ‘থাগ্‌ লা’র শৈলশিরা ডিঙ্গিয়ে, একের পর এক, ঢেউয়ের মতন আছড়ে পড়তে থাকে শত্রুর আক্রমণ। নিচে নালার পাশে, ট্রেঞ্চে প্রতিরোধকারী হতভাগ্য ভারতীয় সেনাদের কোনো সুযোগই ছিল না এই অসম লড়াইয়ের ফল কিছুমাত্র পরিবর্তন করার। আর্মি জেনারেলদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অকল্পনীয় স্থবিরতার এবং অমার্জনীয় শ্লথতার ফলস্বরূপ একরাতের লড়াইতেই ছত্রখান হয়ে যায় একটা গোটা ব্রিগেড। অপ্রতিরোধ্য চীনা আক্রমণের সামনে অসহায়ের মতন পতন হতে থাকে একের পর এক ডিফেন্সিভ লাইনের। তৈরি হয় একরকম ‘ডুম্‌স্‌ ডে’ পরিস্থিতির। পরেরদিন, অর্থাৎ ২২শে অক্টোবর মধ্যরাতে, ভারত, বর্মা এবং তিব্বতের ট্রাই জাংশন পয়েন্টের কাছে ‘ওয়ালঙ’ এর সীমানাতেও অনুপ্রবেশ আরম্ভ করে চীনা বাহিনী। ১৯৫০ এর ভয়ানক ভুমিকম্পে এই দুর্গম এলাকার নামমাত্র রাস্তাঘাটও সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে গেছিল। তাই আত্মরক্ষাকারীর পক্ষে সময়ের মধ্যে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছিল চূড়ান্ত কষ্টসাধ্য। ভারতীয় সেনারা অন্তিম বুলেট পর্যন্ত লড়াই করা সত্ত্বেও ‘কিবিথু’ ছেড়ে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়। শেষ পর্যন্ত ওয়ালঙকে ঘিরে তৈরি হয় পরবর্তী ডিফেন্সিভ লাইন। নিকটবর্তী ‘অশি’ হিলের কাছে চীনে সেনার গতি বিলম্বিত করার দায়িত্ব পড়ে ৬ কুঁমাওনের ‘ডি’ কোম্পানির ওপরে। এর নেতৃত্বে ছিলেন লিউটেন্যান্‌ট বিক্রম সিং রাঠোড়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান বা জার্মানির সাথে লড়াই করে পদক পাওয়া সেনানায়করা যেখানে সদলবলে খাবি খাচ্ছেন চাইনিজ হানাদারির সামনে, সেখানে এই সদ্য কুড়ি ডিঙ্গানো তরুণের কাছ থেকে বিশেষ কোনো আশা হয়তো কারোরই ছিল না। ‘নামতি’ নালার ওপরে থাকা কাঠের পাটাতন আর দড়ির ব্রিজ ভেঙ্গে দিলেই হয়তো চীনের অগ্রগতি একদিনের মত পিছিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু লিউটেন্যান্‌ট বিক্রম সিংয়ের পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। দুরন্ত বুদ্ধি এবং সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে তিনি প্রথমবার লড়াইকে প্রতিপক্ষের কাছে নিয়ে গেলেন। ব্রিজ একেবারে ধ্বংস না করে, বরং শেষদিকের বেশ কয়েকটা তক্তা সরিয়ে রাখা হল। তারপরে নালার একপাশে, উপযুক্ত যায়গায়, ‘ডি’ কোম্পানির একশ জন সৈন্যের সাথে ত্তৎ পেতে থাকলেন শত্রুর জন্য। তিনি নিজে, প্রত্যেক জওয়ানের পজিশন এবং রাইফেলের নিশানার পাল্লা পরখ করে নিশ্চিত করলেন, সীমিত বুলেট যেন সঠিক ভাবে কার্যকরী হয়। অতএব, প্রায় একশটা আগ্নেয়াস্ত্র এবং কিছু সংখ্যক মর্টার তাক করা রইলো ব্রিজের অপর প্রান্তের ‘চোক’ পয়েন্টের দিকে। বিক্রম সিং, সবাইকে বারবার মনে করিয়ে দিলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি আকাশে ‘ভেরি লাইট’ বা ইলুমিনেটিং রাউন্‌ড না ছুঁড়ছেন, ততক্ষণ যেন কেউ ভুলেও ট্রিগার না টেপে। এইভাবে তৈরি হল ভারতের প্রথম প্রতি-আক্রমণের পটভূমি।
 
         ২৫শে অক্টোবর ভোর ৩টের সময় চাইনিজ অ্যাডভান্সড্‌ কলাম এসে হাজির হল নালার ও’পাশে। প্রচণ্ড কুয়াশায় সে’রাতে দৃষ্টিগোচরতা ছিল সামান্য কয়েক গজ। এক চাইনিজ স্কাউট ঝুলন্ত ব্রিজের দড়ি ধরে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে থাকলো এই পাড়ের দিকে। ভারতীয় সেনাদের উপস্থিতি নজরে পড়লেই চেঁচিয়ে সবাইকে সাবধান করে দেবে। ব্রিজের এ’প্রান্তে এসে, ভালো করে ঠাহর করতে গিয়ে অন্ধকারে সে খেয়াল করলো না যে সামনের পাটাতন সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পা ফস্‌কে, প্রচণ্ড আর্তনাদ সহকারে ও হারিয়ে গেলো নিচের খরস্রোতা নালার জলে। সেই চিৎকার কানে যেতেই চাইনিজ’রা সার্চ লাইট জ্বালিয়ে খোঁজ আরম্ভ করলো হতভাগ্য স্কাউটের। কিন্তু এই ঘটনায় তাঁদের অবস্থান উদ্ঘাটিত হয়ে গেলো অ্যাম্‌বুশে অপেক্ষারত শিকারিদের কাছে। নিখুঁত সময়ে বিক্রম সিংয়ের ছোঁড়া ‘ভেরি’ লাইট দিনের আলোর মতন ঝলমলে করে দিলো ‘নামতি’ নালার ‘চোক পয়েন্ট’। মুহূর্তের মধ্যেই রাইফেলের গুলি ঝাঁক বেঁধে ছুটে গেলো সেই দিকে। মর্টারের গোলা আছড়ে পড়তে থাকলো পাথরের আড়ালে লুকোতে চাওয়া শত্রুর ওপরে। আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে ফেললো জমায়েত হওয়া ট্রাক বা অন্যান্য ট্রুপ্‌ ক্যারিয়ারগুলোকে। দূরপাল্লার ‘.৩০৩ এনফিল্ড’ রাইফেলের অভ্রান্ত লক্ষ্যভেদে একে একে লুটিয়ে পড়লো হানাদারদের প্রাণহীন দেহ। ধ্বংসাবশেষে ভরে উঠলো নামতির পাথুরে চরা। আগ্রাসনে অভ্যস্ত চীনা বাহিনী প্রথমবার উপলব্ধি করলো শিকার হওয়ার যন্ত্রণা। যুদ্ধটা তারা একতরফা হবে ভেবেছিলো। বাস্তবে তেমন হল কোথায়।
 
        এক ঘণ্টার ক্রমাগত গুলিবর্ষণের পরে লিউটেন্যান্‌ট বিক্রম সিং রাঠোড়ের অ্যাম্‌বুশ পার্টি অকুস্থল ছেড়ে পিছিয়ে আসে। ততক্ষণে, তাঁদের উদ্দেশ্য চূড়ান্ত ভাবে সফল। নালার অপর প্রান্তে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির প্রমাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অন্ততপক্ষে দুইশত হতাহতর ধাক্কায় ভোঁতা হয়ে যাওয়া চাইনিজ আক্রমণ আর এ’পথে আগে আসার সাহস পায়নি। তার চেয়েও বড় ব্যাপার, এই তুখোড় প্রতি-আক্রমণ এক লহমায় ওয়ালঙ সেক্টরের ভারতীয় সেনা এবং কমান্ডিং অফিসারদের মনোবল বাড়িয়ে দিল অনেকগুন। সঠিক প্ল্যানিং থাকলে চাইনিজ ব্লিৎস্‌ক্রিগকেও থামানো সম্ভব। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর বীর জওয়ানরা দ্বিগুন জোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে একপ্রকার রুখে দিল চীনের অনধিকার প্রবেশ। বুলেট শেষ হয়ে গেলে বেয়নেট নিয়ে হাতাহাতি যুদ্ধে পর্যুদস্ত করতে লাগলো প্রতিপক্ষের প্রোবিং পার্টিদের। সম্মান নিয়ে টানাটানি দেখে দেখে চীনের মিলিটারি হাইকম্যান্ড, Chengduআর্মি রিজার্ভের যাবতীয় অস্ত্র, কামান, গোলা বারুদ এবং পদাতিক সেনাকে নিক্ষেপ করলো শুধু মাত্র ওয়ালঙ দখলের জন্য। এ’দিকে জয়ের স্বাদ পেয়ে ভারতীয় কম্যান্ডাররাও দেখলেন অসম্ভবকে সম্ভব করার স্বপ্ন। নাঃ, শুধু ডিফেন্সিভ লড়াই আর নয়। লিউটেন্যান্‌ট বিক্রম সিংয়ের শুরু করার পাল্টা মার’কে বৃহত্তর রূপ দিতে ব্রিগেড লেভেলের কাউন্‌টার অ্যাটাকের পরিকল্পনা করা হল। লোহিত নদীর পাড়ে যদি চাইনিজ আর্মিকে নাস্তানাবুদ করা যায় তাহলে NEFA (North East Frontier Area)’র প্রতিশোধ শুধু সম্পূর্ণই হবে না, দখল বাহিনীকে উৎখাত করাও সম্ভবপর হবে। কিন্তু বিধি ছিল বাম।
অক্টোবর এবং নভেম্বর অভিযানের মাঝের কয়েক সপ্তাহে চীন যখন রিজার্ভ থেকে সৈন্য ঢেলে নিজেদের অবস্থান পাকা করছিল, ভারতের আর্মি হেড কোয়ার্টার ব্যস্ত ছিল ওয়ালঙ সেক্টরের ‘Order Of Battle (ORBAT)’ পরিবর্তন করতে। মাঝের দুই সপ্তাহে ঘনঘন চেঞ্জ করা হয় কমান্ডিং অফিসারদের। বারম্বার অদলবদল করা হয় কোম্পানি আর ব্যাটেলিয়নের অর্গানাইজেশন স্ট্রাকচার। ফলস্বরূপ, অবধারিত ঘাটতি রয়ে যায় প্রস্তুতিতে বা তথ্য সংগ্রহে। শত্রুপক্ষের ব্যাপক আয়োজনের খবরও এসে পৌছায় না কম্যান্ডারদের কানে। ভারতের স্পর্ধা ভাঙ্গতে চীন তার অফুরন্ত ভাঁড়ার নিয়ে দ্বিতীয়বার আক্রমণে উদ্যত হয় ১৪ই নভেম্বরে। তাদের প্ল্যান বানচাল করতে তড়িঘড়ি ওদের পূর্ব পার্শ্বে স্পয়েলিং কাউন্টার অ্যাটাক করে ইন্ডিয়ান আর্মি। উদ্দেশ্য ছিল ইয়েলো এবং গ্রিন পিম্পল নামক দুটি পাহাড় চূড়া থেকে চাইনিজ দখল উচ্ছেদ করা। সফল হলে, পুরো ওয়ালঙ উপত্যকাতেই চীনা অনুপ্রবেশকারী বাহিনীর অবস্থান দুর্বল হয়ে যেত। কিন্তু মোক্ষম সময়ে আবার প্রকট হয়ে পড়লো গোলা-বারুদ, শীতবস্ত্র আর অন্যান্য সামগ্রীর অভাব। সকল বিঘ্ন ডিঙ্গিয়ে, অনেক ক্ষয়ক্ষতির পরে হাতে এলো গ্রিন পিম্পল। তাতেও শেষরক্ষা হল না। ইয়েলো পিম্পলের পাহাড় চূড়া থেকে মাত্র কুড়ি ফুট দূরে নিঃশেষ হয়ে গেলো আমাদের দুর্ধর্ষ অভিযানের সামর্থ্য। যুদ্ধের রসদ শেষ হয়ে যাওয়ায় চীনের প্রতি-সংহারের হাত থেকে বাঁচার কোনো উপায় থাকলো না। একে একে নির্মূল হয়ে যেতে থাকলো প্রতিরোধের অবশিষ্ট অংশগুলোও। শত্রুর সাঁড়াশি আক্রমণে ওয়ালঙে ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার নিশ্চিত ধ্বংসের সম্মুখীন হয়ে দাঁড়ালো। এমতাবস্থায় ওয়ালঙের পশ্চিম পার্শ্ব টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব গিয়ে পড়লো বিক্রম সিংয়ের বিশ্বস্ত চওড়া কাঁধে। ব্রিগেডিয়ার সাহেবের আদেশ এলো, ১৬ই নভেম্বর সকাল ১১টা পর্যন্ত যে করে হোক আটকে রাখতে হবে চীনের আগ্রাসন। ব্রিগেডের বাকি সৈন্যরা এই সুযোগে অর্গানাইজড, ফাইটিং উইথড্রয়াল করতে পারবে। বিক্রম সিং এবারেও অক্ষরে অক্ষরে নির্দেশ পালন করলেন। ‘ডি’ কোম্পানির সৈন্যদের পাশে নিয়ে সারাদিন তুমুল লড়াইতে আটকে রাখলেন হাজারেরও বেশি হামলাকারীদের। লড়াই ছেড়ে পিছিয়ে আসার অনুমতি তিনি যতক্ষণে পেলেন ততক্ষণে অধিকাংশ সাথীই শহীদ হয়ে গেছেন। বিক্রম সিংয়ের মরিয়া প্রতিরোধে, শত্রুর ঘেরাবন্দি ভেঙ্গে পশ্চাদপসরণ করার সুযোগ পায় গুরুতর আহত অবশিষ্ট সতেরো জন। দিনাবসানে ক্লান্ত চীনা বাহিনী তাঁকে ঘিরে ফেলে। তীব্র কিন্তু নিস্ফল ক্ষোভে, বুলেট দিয়ে ঝাঁঝরা করে দেয় তাঁর বাইশ বছরের চির তরুণ দেহ। ৬ কুঁমাওনের প্রতিরোধ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই চীনের কাছে ওয়ালঙের পতন হয়।
 
         ইতিহাসের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে মুষ্টিমেয়র বীরত্বের অবদান কতটা? যেখানে যুগোপযোগী অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সম্ভার সেখানে ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যের কিই বা ভূমিকা থাকতে পারে। তাঁদের নামে বীরগাঁথা রচিত হয় হয়তো, কিন্তু প্রকৃত ফলাফলে কোনো সুদূরপ্রসারী প্রভাব থাকে কি? আপাতদৃষ্টিতে অর্বাচীন মনে হলেও এমন উদাহরণ কিন্তু বিরল নয় যেখানে একটি স্বল্পবর্ণীত চরিত্র বা তাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠা ঘটনা আমূল বদলে দিয়েছে জাতি বা দেশের ভবিষ্যতকে। কয়েক সহস্র বছর আগে, ঝিলম নদীর তীরে, পুরুর সাথে মরণপণ যুদ্ধের শেষে আলেকজান্ডার কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি হয়েছিলেন। বোধকরি তেমনই, লিউটেন্যান্‌ট বিক্রম সিং রাঠোড়ের রণহুংকারে নিজেদের আসু দুর্ভাগ্যের ছায়া দেখতে পেয়েছিল ৬২’র আগ্রাসীরা। মাউন্টেন ওয়ারফেয়ারের সব রকম রসদ থেকে বঞ্চিত ভারতীয়দের সরিয়ে ওয়ালঙ দখল করা খুবই ব্যয়বহুল অভিযানে পরিণত হয় চীনের কাছে। তদের হাজারেরও বেশি সেনা প্রাণ হারায়। আহত হয় আরও অনেক। Pyrrhic victory বোধকরি একেই বলে। আসামের সমতল থেকে এমন বহু বিক্রম সিংরা বদলা নিতে ছুটে আসছে জেনে একতরফা যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে তারা। ফেলে চলে যায় সমস্ত বিজিত জমি। সেই থেকে চীনের অরুনাচল দখলের হুংকারে বাহ্যিক আস্ফালন ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় নি। কে বলতে পারে, বছর বাইশের সেই তরুণ হয়তো একা হাতেই বদলে দিয়েছিলেন তৎকালীন NEFA তথা অধুনা অরুনাচল্প্রদেশের ভাগ্য।
ফিরে আসা যাক বর্তমানে। বসন্তের শুরু থেকেই অতিমারির ভয়াবহতায় প্রশাসন থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনীও যথেষ্ট বিক্ষিপ্তচিত্ত রয়েছে। তার ওপরে, পশ্চিমে পাকিস্তানের সাথে নিত্যদিনের দ্বৈরথে ব্যস্ত থাকার দরুন অবহেলিত হয়েছে চীনকে সামলানোর কৌশল। পুনরায় সুযোগের সদ্ব্যবহার করলো তারা। সামরিক মহড়ার অছিলায় তিব্বতে হাজির হওয়া চীনের হাজার হাজার সৈন্য, বিনা প্ররোচনায় অতি দ্রুততার সাথে মোতায়েন হল লাদাখে। এর সাথেই তারা আবর্জনায় ছুঁড়ে ফেলল লাইন অফ অ্যাক্‌চুয়াল কন্ট্রোলের স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে, কয়েক দশক ধরে, দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোকে। সেই থেকে, প্রতিনিয়ত যুদ্ধের হুমকি দিয়ে অবদমিত করে রাখতে চাইছে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের আত্মমর্যাদাকে। হাইব্রিড ওয়ারফেয়ারের সূত্রানুসারে মীরজাফরের দলও নড়েচড়ে বসেছে। সংবাদপত্রের পাতাজোড়া বিজ্ঞাপনে চীনের গুণকীর্তন চলছে। যেকোনো যুদ্ধে ভারতবর্ষের অস্তিত্ব যে অনায়াসে বিপন্ন হবে সেটা প্রমাণ করতে গিয়ে তারা বারবার তুলে আনছে ১৯৬২’র উদাহরণ। কিন্তু সেই একই উদাহরণ বিস্তারিত ভাবে জানলে দেখা যাবে চীন সেদিনও কোনো ওয়াকওভার পায়নি। এখনও পাবে না। অনেক পরিবর্তন এসেছে বরং ওদের ক্ষয়ক্ষতি সহ্য করার ক্ষমতার। আজ অনেক বেশি ইনসিক্যুরিটি তে ভুগছে চাইনিজ কম্যুনিস্ট পার্টি। সামান্যতম বিপর্যয়ের খবর যাতে জনগণের কাছে না পৌছায় তার জন্যে চতুর্দিকে বিপুল সেন্সরশিপের আয়োজন। এতো কিছু করেও আটকাতে পারছে না হংকংয়ের গণ-আন্দোলনকে। এই পরিস্থিতিতে গালওয়ানের খণ্ডযুদ্ধ যেমন চাইনিজ জুজু মুছে দিয়ে এ’দেশের প্রশাসনকে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করেছে, তেমনই চীনের মনেও সেই পুরনো ভয় নতুন করে ঢুকিয়ে দিয়েছে। বিক্রম সিং রাঠোড়রা এখনও অতন্দ্র প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে সীমানা জুড়ে। শুধু যদি যুদ্ধের রসদের জোগান ঠিক থাকে তাহলে যেকোনো অসাধ্য সাধন সম্ভব তাঁদের পক্ষে। ইন্ডিয়ান আর্মির বিভিন্ন ভিডিওতে তাই ঘুরেফিরে দেখা যাচ্ছে লজিস্টিক্সকে কতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে এবারে। তারসাথে, অভাবনীয় দ্রুত গতিতে পাহাড় কেটে তৈরি হচ্ছে টানেল এবং রাস্তা। নদীর ওপরে বসছে নতুন ব্রিজ। অস্ত্রশস্ত্র নয়, ১৯৬২ আর ২০২০র মধ্যে এগুলোই সবচেয়ে বড় তফাৎ।
 
         আগামী তিন মাস (নভেম্বর থেকে জানুয়ারি) খুবই গুরুত্বপূর্ণ আমাদের কাছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সাথে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ডামাডোলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যস্ত থাকবে নিজেকে নিয়েই। এ’দিকে, ভারতের প্রস্তুতিতে কণামাত্র ঢিলেমি দেখলেই আঘাত হানবে শত্রুরা। এ’বারের আক্রমণ হবে তিন দিক থেকে সমন্বিত ভাবে। পশ্চিমে পাকিস্তান, উত্তরে চীন এবং দেশের ভিতর থেকে অন্তর্ঘাতীরা। সীমানা রক্ষার দায়িত্বে রয়েছেন বিক্রম সিংদের উত্তরসূরিরা। চোখ বন্ধ করে ওঁদের ওপরে ভরসা করা যাবে। আপামর দেশবাসীকে বরং সতর্ক থাকতে হবে যাতে জাতি বা ধর্মীয় দাঙ্গায় উৎসাহ প্রদানকারীরা সুযোগ না পায়। ধর্ম, বর্ণ, জাতপাত নির্বিশেষে সবাই একে অন্যের হাত ধরে থাকলে ভারতের অমঙ্গল চাইবে এমন সাধ্য কার?
..................................