জলপাই রঙের শাড়ি
সুদীপ ভট্টাচার্য
বল্টুদা
প্রকৃত অর্থে গোবেচারা। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান মাঝে মধ্যেই। যেমন ধরুন,
জিনিস হারিয়ে ফেলার সময় কেমন জানি অদ্ভুতুরে স্বভাবের হয়ে যান তিনি।
আশ্চর্যের যেটা সেটা হলো তিনি যে সত্যি সত্যিই তা হারিয়েছেন প্রাথমিক ভাবে
বুঝতেই পারেন না। ফলে না বোঝার ভান করে থাকেন। এতে বৌদির রাগ বাড়ে। বৌদির
ধারনা জন্মায় যে বল্টুদা জেনে শুনে এই না বোঝার ভান করে থাকেন। আদতে সেরকম
কিন্তু একেবারেই নন বল্টুদা এটা বোঝাবে কার সাধ্যি।
জলপাই
রঙের একটা বুটিকের শাড়ি খুঁজে পাচ্ছেন না বৌদি। লডাউনের কিছুদিন পরের
ঘটনা। সবে মাত্র চারিপাশ হাঁসফাঁসের থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়েছে। বাতাস বইছে
টলমল করে। মানুষের মনে প্রবল টেনশানের সঙ্গে সঙ্গে অল্প করে মুক্তির স্বাদ
ফিরে এসেছে। প্রচুর নিয়ম মেনে চলতে হচ্ছে এখন। দোকানপাট খুলছে এক এক করে।
কলেজস্ট্রিটের বইয়ের দোকান যেমন খুলছে, শাড়ির বুটিকের দোকানও খুলছে। আর
শুধু সেটাই নয় প্রায় চার পাঁচ মাস ঘরবন্দী, স্টাইল বন্দী বাঙালি মহিলাদের
কাছে স্যানিটাইজার বা সাবানের থেকেও শাড়ি বেশী আকর্ষণীয়।
জলপাই
রঙের শাড়ি পাচ্ছেন না বৌদি। তন্ন তন্ন করে ঘরের চারপাশ খুঁজলেন। আলমারির
প্রত্যেককটা তাক খুঁজলেন। বাড়িতে চারটে আলমারি। পৌনে চারটে আলমারি জুড়ে
বৌদির অবস্থান, একটি ছোটো, পাতলা, হাল্কা, প্লাস্টিকের আলমারির অর্ধেকের
অর্ধেক খানা বল্টুদার কপালে জুটেছে। তাতেই কোনমতে বল্টুদার সংসার। এ নিয়ে
সামান্য মুখ খুলেছো তো নারী আন্দোলন আর নারীর প্রতি অবিচারের ভয় দেখান
বৌদি। সেন্টিমেন্টাল ইস্যু। তাই অর্ধেকের অর্ধেক আলমারি থাক, সর্ব সাকুল্যে
দুটি তাকই থাক, ভিতর আর বাহিরের আভূষনের গন্ধ মাখা মেশামেশিই থাক, ঘামে
চপচপ মুখ দেখা দেখি থাক, কিন্তু তাক আর বেশী চাইবেন না বল্টুদা সেটা মনে
মনে ঠিকই করে নিয়েছেন। নিজের এহেন আলমারির কথা মনে এলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন
বল্টুদা, তারপরেই গলা ছেড়ে গান ধরেন "যা গেছে তা যাক, যাক।" আজও গলা ছেড়ে
সেটাই গাইতে শুরু করে দিলেন বল্টুদা। আর গাইবি তো গা একেবারে বৌদির কানের
ডগায়।
আর যাবে কোথায়। চেঁচিয়ে উঠলেন বৌদি, "বল্টে,
আমার জলপাই রঙের শাড়ি যে তুমিই ইচ্ছে করে সরিয়ে রেখেছো সেটা নিয়ে আর
বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই আমার। তার উপর আবার আনন্দে গান করা হচ্ছে, যা গেছে
তা যাক? যাবে না কিছুতেই বল্টে। শাড়ি না পেলে তোমার আনন্দের দিন কিছুতেই
যাবে না। এই আমি বলে রাখলুম। "
এটা
অভিশাপ না ভয় দেখানো সেটা এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেননি বল্টুদা। এমনটা
প্রায়ই ঘটে। এইতো গেলবারের শীতে ঝাল ঝাল লঙ্কা, কাসুন্দি, সরষের তেল, বিট
নুন, ধনে পাতা দিয়ে জম্পেশ একটা কদবেলের আচার করে ছাদে নিয়ে গিয়েছিলো বৌদি।
বরিবারের দুপুর, বল্টুদার অফিস ছিলো না, নীচের ঘরে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিলেন
তিনি। বৌদি ছাদে গিয়ে একটা চেয়ার নিয়ে বসলেন আরাম করে বই পড়বেন, আর কদবেলের
আচারের স্বাদ নেবেন বলে। হঠাৎ বল্টুদার চিৎকার। দরকারে কিছুক্ষনের জন্যে
নীচে নেমে আসতে হোলো বৌদিকে। বই আর কদবেলের আচার ছাদে রেখেই চলে আসেন তিনি।
তারপরই লেগে যায় দক্ষযজ্ঞ। ছাদে ফিরে বৌদি আর কদবেলের আচার খুঁজে পান না।
ফাঁকা বাটি। কি সাংঘাতিক কান্ড। দিনে দুপুরে ডাকাতি। অনেক খুঁজেও পাওয়া
গেলোনা আচার। ওদিকে বৌদির সমস্ত রাগ গিয়ে পরল বল্টুদার উপরে। প্রায় দুশো
ডেসিবেল শব্দ তান্ডবে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বৌদি, ম্রিয়মাণ বল্টুদা। এমন চলতেই
থাকলো বল্টুদার প্রতি। বল্টুদা বুঝেই উঠতে পারিছিলেন না দোষটা ঠিক কি
করলেন। বুঝে ওঠার আগেই যত দোষ নন্দ ঘোষের মত বল্টুদার উপরে বর্ষিত হল।
অবশেষে সব ঝামেলার শেষে বৌদি হঠাৎ করে উপলব্ধি করলেন বই পড়তে পড়তে পুরো
আচারটাই তিনি খেয়ে ফেলেছেন। আর পুরোটাই যখন খেয়ে নিয়েছেন, বাটিতে আচার
থাকবে কি করে? সে যাত্রায় বৌদির স্মৃতি ফিরে আসায় রক্ষে পেয়েছিলেন বল্টুদা।
সব ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। জল আরো ঘোলা হয়। নাটক চলতেই থাকে। বল্টুদার
বর্ষা কাটেনা কিছুতেই। কিন্তু ওই, কেমন নির্বাক হয়ে যান বল্টুদা। মনেই
পরেনা আসলে করেছেনটা কি।
এহেন
বল্টুদা আবার চাপে পরলেন জলপাই রংয়ের শাড়ি নিয়ে। বৌদির খুব পছন্দের শাড়ি।
লকডাউনের মনখারাপ থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে আজকাল বৌদি এসব কিনে আনছেন।
কয়েকদিন আগে বল্টুদাকে বলে রেখেছেন যেভাবে জিনিস বাড়ছে তাতে চতুর্থ
আলমারির আরো একটা তাক তার চাই। একজন পুরুষ মানুষের জামাকাপড়ের জন্যে আর
কতটুকুই বা জায়গা লাগে, একটা তাকই যথেষ্ট। বল্টুদা সামান্য উত্তেজনায়
কিঞ্চিৎ প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলেন সেদিন, বৌদির রক্তচক্ষু দেখে আর এগোলেন না
সে পথে, বরং রাগটাকে নিমেষে মৃদু মুখ চাপা হাসিতে পরিনত করে দাঁত খিটমিট
করে বলে উঠলেন "নিশ্চই নিশ্চই, বাড়ির সব কটা আলমারি তোমার বাবার, ইয়ে মানে
আমার শ্বশুরমশাইয়ের নিজের হাতে বানানো, তার মেয়ে ইচ্ছেমতন ব্যবহার করবে
নাতো কে করবে?"
বল্টুদার
কথাটা বলার সময় হুঁশ ছিলো না। করোনা হয়েছিলো কিছুদিন আগে। করোনা নাকি
মস্তিস্কেও ছাপ ফেলে যাচ্ছে। সেরকমই কিছু একটা। নাহলে এমন ভয়ঙ্কর কথা বলবার
বেহিসেবী সাহস বল্টুদা পান কি করে? অতঃপর বৌদি গম্ভীর হলেন। পরপর সাতদিন
রান্না করেন নি বৌদি। গুম মেরে বসেছিলেন। বল্টুদা প্রতিদিন গুনে গুনে ডজন
খানেক বার ক্ষমা চেয়েছেন, কিন্তু রাগ ভাঙেনি বৌদির। অবশেষে আজকাল হোম
ডেলিভারি চলছে। তবে হ্যাঁ, মেনু কিন্তু পছন্দ করে দিচ্ছেন বৌদি। আজ দুপুরে
ভেটকি মাছ হলে রাতে চিকেন, দুপুরে পমপ্লেট হলে রাতে মাটন, দুপুরে কাতলা হলে
রাতে বিরিয়ানি। এর চাইতে হাজার খানেক গালাগাল আর কয়েকশো ধমক দিলেও বোধয়
ভালো ছিলো। হজম হয়ে যেত। কিন্তু এমন হোম ডেলিভারির খাবারের বিল কিছুতেই হজম
হচ্ছে না বল্টুদার। বল্টুদা নিজেকেই নিজের মারতে ইচ্ছে হলো। সামান্য রাগেন
না বল্টুদা, কি যে হলো, একটু হাসি মুখে রাগ দেখিয়েছেন কি, পকেট ফাঁকা।
জলপাই
রঙের শাড়ি পাচ্ছেন না বৌদি। কয়েকদিন আগের কেনা। সব রাগ গিয়ে জমা হল
বল্টুদার কপালে। বেধড়ক ঝাড়, মুখে। বল্টুদার ঝাড় খেয়ে অভ্যেস হয়ে গেছে।
বৌদির চোদ্দপুরুষের স্বভাব, সে তো আর এমনিতে যাবে না। বৌদির মা ঝাড়তেন তার বর
কে, মায়ের মা ঝাড়তেন তার বর কে, তার মায়ের মা। পুরো চোদ্দপুরুষের ব্যাপারস্যাপার, নারী ঝাড়েন, পুরুষেরা কান বন্ধ করে শোনেন। তাও না হয় আজকাল
বল্টুদা ঝাড়বার টাইমে হেডফোন কানে লাগিয়ে জম্পেশ হিন্দি গান চালিয়ে দেন। আর
দিদি নাম্বার ওয়ানের মত ওই হেডফোন কানে দিয়ে বৌদির লিপ রিডিং করে রিএক্ট
করেন। যখন বুঝতে পারেন বৌদি মোটামুটি শান্ত, তখন বল্টুদা কান থেকে হেডফোন
নামিয়ে নেন। পাকাপাকি বন্দোবস্ত আর কি।
যাই
হোক এদিনও তাই করলেন বল্টুদা। বৌদির জলপাই রঙের বুটিকের শাড়ি পাওয়া যাচ্ছে
না। সব রাগ গিয়ে পরলো বল্টুদার উপর। এমনকি বল্টুদা তার অন্য কোনো
বান্ধবীকে শাড়িটা দিয়েছেন বলেও বৌদি দোষারোপ শুরু করে দিলেন। হেডফোনে তখন
বাজছিলো একটা মজার গান। বল্টুদা চোখ বুজে সামান্য হেসে উঠলেন। বৌদি ভাবলেন
বৌদির কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছেন বল্টুদা। যেন হাসি দিয়ে বুঝিয়ে
দিতে চাইছেন, কে হে তুমি, আমার যাকে ইচ্ছে দেবো, তোমার কি?
প্রচন্ড
রাগ জমা হচ্ছে বৌদির মনের গভীরে। যা বারুদ ভরা আছে, বিরাট কিছু বিস্ফোরণ
যে কোন মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে। বৌদি একটা হাতা হাতে নিলেন, একেবারে
রনচন্ডী। কোমড়ের আঁচল নিলেন গুটিয়ে। এগিয়ে আসছেন বল্টুদার দিকে। মুখে
অসম্ভব রাগ, যেন এই পৃথিবীটাকেই ধ্বংস করে দেবেন তিনি। প্রায় কাছে চলে এলেন
বল্টুদার। বল্টুদা আরামে বসে কানে হেডফোন গুঁজে শুনছিলেন নাটক। নাটকের নাম
অবাক জলপান। বৌদি প্রায় কাছে চলে এসেছেন বল্টুদার। হাতের হাতাটা শক্ত করে
ধরা। সবে মাত্র হাতা হাতে হাত মাথার উপরে তুলেছেন বৌদি, এমন সময়...
বল্টুদা
কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছিলেন। বৌদি প্রচন্ড উত্তেজিত। বল্টুদা তখন
কেমন নির্বাক হয়ে নাটক শুনছেন, অবাক জলপান। নাটকের মধ্যে লেখা আছে একটু জল
পাই কোথায় বলতে পারেন? বল্টুদা তখন সেই জায়গাটাই পড়ছেন। খুবই আকর্ষণীয়
অংশটা। বৌদি তখন হাতা হাতে বল্টুদার সামনে। বল্টুদা খুব স্বাভাবিক ভাবে
প্রায় অজান্তেই বৌদির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন " জল পাই কোথায়?"
সামান্য
এটুকু কথা। নড়ে গেলো যেন চারিপাশ। বৌদি কেন জানি নিজের শাড়ির দিকে তাকালেন
একবার। আশ্চর্য, তার পরনেই তো সেই জলপাই রঙের শাড়িটা। যেটা নিয়ে এত
তোলপাড়।
বল্টুদা কঠিন পরিস্থিতিতেও শান্ত থাকেন। এই ঘটনাতেও চুপচাপ ছিলেন।
.........................................
অলঙ্করণ :- দেবাদৃতা দাস