ছোটলোকের অমলেট
মৌমিতা তারণ
শান্তিভবন বৃদ্ধাবাসে আজ উৎসবের মেজাজ। কয়েকমাস আগে বোর্ডারদের সঙ্গে
মিটিংয়ের সময় জানতে চাওয়া হয়েছিল এখানে তারা কোনকিছু মিস করছেন কি না। না,
তেমনভাবে কোনও অভাবের কথা কেউ জানান নি। কিন্তু শান্তিভবন বৃদ্ধাবাসের
মালিক মিসেস নবনীতা মুখার্জির মনে হয়েছে এখানকার মানুষগুলো সংসারকে খুব মিস
করছেন। সংসার বলতে সাংসারিক কাজকর্ম। শান্তিভবনে কোনও বোর্ডারকেই কোনও কাজ
করতে হয় না। সুচারুভাবে এখানকার কর্মীরা তাদের সব কাজ করে দেয়। ঘড়ি ধরে
সবকিছু মেইনটেইন করা হয়। অত্যন্ত যত্নে আছেন বোর্ডাররা এখানে। কিন্তু
জীবনের অনেকটা সময় সাংসারিক দায়দায়িত্ব পালন করার পর হঠাৎ এই রুটিন জীবন
তাদের ভাল নাও লাগতে পারে। এমনটাই মনে করেন নবনীতা মুখার্জি। নিজের
অভিজ্ঞতায় বিষয়টি আরও ভালভাবে বুঝতে পারেন নবনীতাদেবী।
দমদম মলরোডের এক শান্ত পরিবেশে বড় হয়েছেন নবনীতাদেবী। বাবা ছিলেন এলাকার
একজন মাঝারিমানের ব্যবসায়ী। ব্যবসার পাশাপাশি বাবার শখ ছিল নিজের জমিতে
ফুল ফোটানো। জানা অজানা অজস্র ফুলে সারাবছর ওদের বাগান সেজে থাকত। এই
বাগানের নেশা দুই ছেলেমেয়ের মধ্যেও বাবা জাগিয়ে তুলেছিল। পড়াশোনার ফাঁকে
দাদা বাবার সঙ্গে হাত লাগাত বাগান পরিচর্যায়৷ নবনীতার দায়িত্ব ছিল নিয়ম করে
গাছে জল দেওয়া, শুকনো পাতা ফেলে দিয়ে গাছকে সুন্দর রাখা। কত মানুষ আসত
ওদের বাগান দেখতে। এমনকি খবরের কাগজেও ওদের বাগান নিয়ে লেখা হয়েছিল একবার।
তবে এসব থেকে শতহাত দূরে ছিল মা। বাগান নিয়ে মায়ের কোনও উৎসাহ ছিল না। মা
ভালবাসত নিপুনভাবে সংসার করতে। শুধু যে নিজের স্বামী, পুত্র, কন্যার দেখভাল
করত তা নয়। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সকলের প্রতিই ছিল মায়ের সমান যত্ন।
নবনীতা দেখেছে ভরদুপুরে হঠাৎ তাদের বাড়িতে কেউ এসে পড়লে মা তাকে ভাত না
খাইয়ে ছাড়ত না। ঘরে যা আছে সেসব দিয়ে চমৎকার খাবার বানিয়ে ফেলত মা। তারপর
রোজকার রান্নার সঙ্গে পরম ভালবাসায় তা পরিবেশন করত অতিথির পাতে ৷ একইসঙ্গে
দুই ছেলেমেয়েকে মনের মতো করে গড়ে তোলাতেও সজাগ দৃষ্টি ছিল মায়ের।
নবনীতা ও দাদা দু'জনেই তখন পড়াশোনার কারণে বিদেশে। ওদের বিদেশে থাকার সময়ই
বাবা মারা যায়। বাবার মৃত্যুর পর দুই ভাইবোন বাধ্য হয়েছিল মা'কে ওল্ড এজ
হোমে রাখতে। কারণ একা বাড়িতে থাকা মায়ের পক্ষে নিরাপদ ছিল না। বিপদে আপদে
পাশে থাকার মতো কেউ ছিল না সেসময়। তার উপর একা বাড়িতে বয়স্ক মানুষের খুন
হয়ে যাওয়ার খবরে বিদেশে বসে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যেত ওদের দুই ভাইবোনের।
বৃদ্ধাবাসে মা'কে রাখা অনেক স্বস্তির মনে হয়েছিল ওদের। কিন্তু মা একদম
পারছিল না বৃদ্ধাবাসে থাকতে। সুবন্দোবস্ত থাকা সত্ত্বেও মা মিস করত সংসারের
কাজকর্ম। প্রায় প্রতিদিন ফোনে জানাত সেকথা। নবনীতার খুব মন খারাপ হতো
মায়ের জন্য। কিন্তু তখন দেশে ফেরার উপায় ছিল না। দাদা পরবর্তীতে বিদেশেই
সেটল করে। তবে নবনীতা পরে দেশে ফিরে এসেছিল। কিন্তু তার আগেই মা'কে
হারিয়েছিল। শেষজীবনে মা'কে সাংসারিক আনন্দ দিতে না পারায় আক্ষেপ রয়ে গেছে
নবনীতার।
এসব কারণেই শান্তিভবনের মালিক মিসেস নবনীতা মুখার্জি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে
মাসে একদিন করে ফেলে আসা সাংসারিক জীবনের স্বাদ দেওয়া হবে বোর্ডারদের।
সেদিন অ্যানেক্স বিল্ডিংয়ের চারটে প্রাইভেট কিচেন দেওয়া হবে চার বোর্ডারকে।
তারা নিজেদের পরিবারের লোকদের ডেকে তাদের পছন্দমতো খাবার নিজে হাতে রেঁধে
খাওয়াবেন। হ্যাঁ নিজেদের খরচেই। তবে শান্তিভবনের কিচেন স্টাফরা তাদের পাশে
হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে থাকবে। পালা করে সকল বোর্ডারকেই এই সুযোগ দেওয়া
হবে।
আজ সেই দিন। শান্তিভবন বৃদ্ধাবাসে সকাল থেকে শুরু হয়েছে তোড়জোড়। গেটের
সিক্যুরিটি থেকে শুরু করে কাচরা নিয়ে যাওয়া ভৃগু অবধি আজ খুশিতে ডগমগ৷
শান্তিভবন যে আর দশটা বৃদ্ধাবাস থেকে আলাদা সেটা আবার প্রমাণ করে দিলেন
তাদের মণিমা। নবনীতা মুখার্জি এই শান্তিভবন বৃদ্ধাবাসের মালিক কাম ডিরেক্টর
হলেও এখানে তিনি সকলের মণিমা। স্বামীর মৃত্যুর পর নিজের মায়ের নামে
বারুইপুরের বাগানবাড়িতে এই শান্তিভবন বৃদ্ধাবাস গড়ে তুলেছেন তিনি।
১ নম্বর ও ২ নম্বর ঘরের চার বোর্ডারকে দিয়ে আজ শুরু হল শান্তিভবনের এই
অভিনব কর্মসূচী। সকাল থেকে চার বোর্ডার রান্নাবান্নায় ব্যস্ত। তাদের চোখমুখ
খুশিতে উজ্জ্বল। একমাস আগেই সবাই নিজের পরিবারের লোকদের আজ এখানে এসে
খাওয়াদাওয়া করতে বলেছেন। মনোরমা মাসীমার নাতি এবার মাধ্যমিকে ফার্স্ট
হয়েছে৷ মা, বাবার সঙ্গে নাতিও আসবে আজ তার ঠাকুমার হাতের রান্না খেতে৷ গত
কয়েকদিন ধরে সারা বৃদ্ধাবাস জেনে গেছে মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করা ছেলেটি আজ
বৃদ্ধাবাসে আসবে। নাতির অহংকারে মনোরমা মাসীমার পা পড়ছে না মাটিতে। নাতির
জন্য দইমুর্গি রাঁধবেন আজ তিনি৷ ওদিকে একসময় ছেলে তার হাতের মাগুর মাছের
ঝোল ছাড়া ভাত খেত না। মনোরমা মাসীমা ছেলের জন্য মাগুরের ঝোল রেঁধেছেন।
বউমার জন্য রেঁধেছেন চিংড়ির মালাইকারী।
পিছিয়ে নেই অন্য তিন মাসীমাও। শুক্লা মাসীমার দুই মেয়ে আসবে। ওরা এখন
ছুটিতে কলকাতায় এসেছে। মায়ের কোনও অভাব রাখেনি দুই মেয়ে। শুধু ব্যস্ততার
কারণে মা'কে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারে না। ওদের সঙ্গে জামাইরাও আসবে বলেছে।
শুক্লা মাসীমা বিরিয়ানি রাঁধবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু এখন আর বিরিয়ানির গন্ধটা
ঠিক সহ্য হয় না। তাই কষা মাংস আর ফ্রায়েড রাইস রেঁধেছেন। সঙ্গে ডিমের
ডেভিল আর ভেটকি পাতুরি৷ ছোট মেয়ে ডিম খেতে বড় ভালবাসে।
সকলের থেকে বয়সে ছোট হলেন মৃদুলা মাসীমা। নিঃসন্তান মৃদুলাদেবী ভাইদের
মানুষ করেই জীবন কাটিয়েছেন৷ স্বামীর রেখে যাওয়া উইডো পেনশনে তার ভালই চলে
যায়৷ কিন্তু ভাইদের না দেখে থাকতে পারেন না তিনি। মাঝে মাঝে তাই তিনি বাপের
বাড়ি যান। পৈত্রিক বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাটবাড়ি হয়েছে সেখানে। একই বিল্ডিংয়ে
তিনটে আলাদা ফ্ল্যাটে তিন ভাই থাকে৷ ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ভাইরা কেউ
বৃদ্ধাবাসে আসতে পারে না। তাই মৃদুলাদেবী নিজেই চলে যান ওদের সঙ্গে দেখা
করতে। ফিরে এসে মনোরমাদিদের গল্প শোনান ভাই, ভাইয়ের বউরা কত আদর করেছে
সেসবের। মৃদুলাদেবী এখন ব্যস্ত তিন ভাই বউ আর দুই ভাইপোর জন্য তাদের
পছন্দের রান্না রাঁধতে। সারা সপ্তাহ ব্যবসার ঝক্কি সামলে রবিবারে আর ভাইরা
বাড়ির বাইরে বেরোতে চায় না। তাই তারা আসবে না বলেছে৷ মৃদুলাদি বেশি করেই
রান্না করছেন৷ ভাই বউদের হাতে ভাইদের জন্য খাবার পাঠিয়ে দেবেন ঠিক করেছেন।
ওদিকে বীনা মাসীমার রান্নাও প্রায় শেষের মুখে। খুব সকালে তিনি ঘুম থেকে
উঠতে পারেন না। তাই রান্না শুরু করতে একটু দেরী হয়েছে৷ তেতোর ডালে বীনা
মাসীমা আদা - সর্ষে ফোড়ন দিতেই সারা বৃদ্ধাবাস সেই মোহময়ী গন্ধে ম ম করতে
লাগল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হেল্পিং হ্যান্ড মানদা মুগ্ধ সে গন্ধে। আর যখন
লম্বাডাঁটির বেগুন ভাজছেন বীনা মাসীমা মানদা তো রীতিমতো অবাক। বেগুনভাজারও
যে অমন সুগন্ধ হয় জানা ছিল না।
ঘড়িতে এখন দুপুর দু'টো। এক ঘন্টা হয়ে গেল মনোরমা মাসীমা, শুক্লা মাসীমা,
মৃদুলা মাসীমা খাবার গুছিয়ে বসে আছে। পাঁচমিনিট আগে মনোরমা মাসীমার ছেলে
এসে মায়ের সঙ্গে দেখা করে গেছে। আজ এখানে খেতে পারবে না জানিয়েছে। বাইরে
গাড়িতে নাতি আর বউমা বসে আছে। নাতির কোচিং সেন্টার আজ নাতিকে সংবর্ধনা
দেবে। কাজেই সেখানে যেতে হবে এখন। হাতে একদম সময় নেই। শুক্লা মাসীমা
গেটের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। এই বুঝি মেয়েরা এল। মৃদুলা মাসীমাও ভাই বউদের
অপেক্ষায়। খিদে পেয়েছে খুব। কিন্তু ওদের ফেলে খায় কী করে।
ডাইনিং হলের এক কোনায় বসে নীরবে খাচ্ছেন বীনা মাসীমা। তেতোর ডাল,
লম্বাডাঁটির বেগুনভাজা, পাটপাতার বড়া, লাউশাকের তরকারি রান্না করেছেন তিনি।
প্রতিটি পদ বীনা মাসীমার নিজের পছন্দের। আর বানিয়েছেন কাঁচালংকা, আদা,
পেঁয়াজকুচি দিয়ে একটা ডবল ডিমের অমলেট।
বীনা মাসীমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন অন্য তিন মাসীমা। অবাক মনোরমা মাসীরমার প্রশ্ন, " সেকি বীনা কেউ আসার আগেই তুমি খেয়ে নিলে ?"
"কেউ আসবে না তো। আমি তো কাউকে আসতে বলি নি।" মুচকি হেসে বীনা মাসীমা জবাব দেন।
" ওমা, আসতে বলনি কেন ?" মৃদুলা মাসীমার সরাসরি প্রশ্ন।
মৃদুলা মাসীমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বীনা মাসীমা বলে ওঠেন, "আর অপেক্ষা না করে তোমরাও এবার খেয়ে নাও। তোমাদেরও কেউ আসবে না।"
কথাগুলো শেষ করেই বীনামাসীমা এক টুকরো অমলেট মুখে দিলেন। আহ, প্রাণ জুড়িয়ে
গেল। কতবছর বাদে এমন অমলেট খেলেন। মনে পড়ল বউমা এমন অমলেটকে বলত ছোটলোকের
অমলেট। ছেলের বাড়ির অমলেটে টমেটো আর ক্যাপসিকাম কুচি থাকত। বড়লোকের অমলেট।
ক্যাপসিকামের গন্ধ বীনা মাসীমার সহ্য হত না।
............................................
অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি