সুনেত্রা সাধু লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
সুনেত্রা সাধু লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

তার ছেঁড়া যন্ত্র - সুনেত্রা সাধু

 

তার ছেঁড়া যন্ত্র

সুনেত্রা সাধু

 



রবিবার সকালে মাছ বাজারটা ভিড়ে থিক্ থিক্ করে। পা রাখা দায়, তার উপর আবার সেদিন সব মাছের দরই আগুন। শনিবারেও যে চিঙড়ি পাঁচশো টাকা কিলো ছিল রবিবার এলেই তা এক লাফে হয়ে যাবে সাড়ে সাতশো। তাও পড়ে থাকে নাকি! বাজারে নামতে যা দেরী, চোখের নিমেষে  সব হাওয়া।  মাছের জন্য এত ঠেলাঠেলি দরাদরি একেবারেই পোষায় না, তাই অপরেশ সোমবার মাছ বাজারে আসে; একটু সকাল সকাল। অফিসের তাড়া থাকে ঠিকই তবে বাজার ফাঁকা থাকার জন্য বিশেষ দেরী হয় না। এই তো দু বছর পরেই তার রিটায়ারমেন্ট, তখন আর অফিসের তাড়া থাকবে না। আর কিনবে তো রুই না হয় কাতলা, এ মাছ রোজই মেলে ; কাজেই দেরী হবার প্রশ্নই নেই । এদিক ওদিক ঢুঁ মেরে নষ্ট করার মতো সময় অপরেশের নেই, সোজা গোবিন্দর দোকান থেকে  মাছ কিনে বেরিয়ে পড়ে। সেদিনও মর্নিং ওয়াক ফেরত সকাল সকালই বাজারে ঢুকেছিল অপরেশ। গোবিন্দ বৈরাগী তার নির্দিষ্ট জায়গায় রুই কাতলা চিতল, ভেটকির পসরা সাজিয়ে বসে আছে। অপরেশ গিয়ে দাঁড়ালো, ভেজা মাছ গুলোতেও ছপ ছপ করে জলের ছিটে মারছিল গোবিন্দ। অপরেশকে একবার দেখেই মুখ নামিয়ে নিল, ব্যবহারে বিশেষ তাপ উত্তাপ নেই। গোবিন্দ জানে পাঁচশো গ্রাম কাটা পোনার বেশি এই লোক কিছুই কিনবে না, তাই বাড়তি খাতির না করলেও চলে। জল ছেটানো শেষ হলে বটির ফলাটা কাঠের বাঁটে মোটা বাটখারা দিয়ে ঠুকে নিচ্ছিল সে। সবে দোকান খুলেছে, পিছনের দেয়ালে টানানো অন্নপূর্ণার ছবির সামনে ধূপ দুটো এখনো জ্বলছে। এই বার বিক্রিবাটা শুরু করবে। সামনে পড়ে থাকা দুটো কাটা মাছ অপরেশকে দেখিয়ে বলল ‘কোনটা দেব? ওইটা না এইটা?’ দুটোই মরা, স্বাদেও বিশেষ পার্থক্য হবে বলে মনে হয়না। অপরেশ অপেক্ষাকৃত লাল কানকো ওয়ালা মাছটার দিকে নির্দেশ করে বলতে যাবে ওইটা, ঠিক তার আগের মুহূর্তে সে মৃত্যুকে দেখতে পেল। ঘন নীল শার্ট আর কালো প্যান্ট পরে ঠিক ক হাত দূরেই গোবিন্দর পিছনে  দাঁড়িয়ে আছে। অপরেশকে দেখেই মুচকি হাসল মৃত্যু, অপরেশও হাসি ফিরিয়ে দিল। বাবু কাকে দেখে হাসছে দেখতে গিয়ে মাথা ঘুরিয়েও গোবিন্দ কাউকে দেখতে পেল না। 


‘তোর কাছে কোনো জ্যান্ত মাছ নেই?  আড়াই তিন কিলোর? কাতলা?’ 


গোবিন্দ উৎসাহী হয়ে উঠেছে,  ‘হ্যাঁ বাবু আছে তো। দাঁড়ান’, বলে পিছনের চৌবাচ্চা হাতড়ে একটা প্রায় তিন কিলোর কাতলা খুঁজে বের করে অপরেশের সামনে ফেলেছে। এক্কেবারে জ্যান্ত, খাবি খাচ্ছে। 

‘নিয়ে যান বাবু এক নম্বর মাল, চৌধুরীদের মিঠা পুকুরে জাল ফেলেছিল, এই টাকটা নিয়ে এলাম। লোকাল মাছ।’ 


‘দে, কেটে কুটে দে। বাড়িতে বড় বটি নেই। আর তোর বৌদি আবার এসব পারে না।’ 


‘আজ কি বাড়িতে লোকজন আসবে নাকি?অনুষ্ঠান আছে কিছু?’গোবিন্দর কথা শুনে অপরেশ আর মৃত্যু চোখাচোখি করে হাসে। 


ব্যাগটা বেশ ভারি হয়েছে,তিন কিলো ওজন! মাছের মাথাটাও বেশ বড়। অপরেশ পুঁই শাক নিল, মাছের মাথা দিয়ে ছ্যাঁচড়াটা বিথী ভালোই রাঁধে। কিছুটা মাথা মুগ ডালেও দিতে বলবে। মৃত্যু পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপরেশের বাজার করা দেখছে। হঠাৎ অলোক সাঁপুই এর সাথে দেখা হয়ে গেল অপরেশের। 


‘কি অপরেশদা এখন নটা ছত্রিশ ধরছেন না? বহুদিন ট্রেনে দেখা হয় না। শরীর ভাল তো?’ 


‘আগের ট্রেনটা ধরি আজকাল। নতুন বস খুব পাংচুয়াল, তাই… 

এমনি আমার শরীর ভালোই, তবে.. 

একদিন  বাড়িতে আসুন না, কথা হবে।’ বলেই মনে মনে জিভ কাটল অপরেশ, সে আজ আছে কাল নেই শুধু শুধু নেমন্তন্ন করল। মৃত্যুর চোখে রাগ দেখল সে। কি মনে হতে একটা দু হাজার টাকার নোট বার করে অলোক সাঁপুই এর হাতে দিয়ে অপরেশ বলল‘ এটা বিমলকে একটু দিয়ে দেবেন? ওর ভাইটার রক্তের কি যেন অসুখ হয়েছে, বলছিল টাকার দরকার।’ 


‘আপনি আজ অফিস যাবেন না?’ 


‘না, আজ ছুটি নিয়েছি। বাড়িতে একজন এসেছেন।’


‘বেশ আমি দিয়ে দেব। বিমলকে বলব আপনাকে ফোন করে নিতে৷’ অলোক চলে গেল। অপরেশ বাজার থেকে বেরিয়ে মৃত্যুঞ্জয় সুইটস এ ঢুকল। দোকানের নাম শুনে পেটের ভিতর হাসি বুজকুড়ি কাটছে। মৃত্যুর মুখেও খিল্লির হাসি। কচুরি আলুরদম, ঘিয়ের পান্তুয়া আর রসমালাই কিনল অপরেশ। এদের রসগোল্লাটাও বিখ্যাত, কি স্বাদ!! তাও কিনল খান কতক। ক্ষীর ক্ষীর ঘন মিষ্টি দই নিল পাঁচশো। তারপর  মা তারা ভ্যারাইটি স্টোর্স এ ঢুকে কটা হজমোলা কিনল। টক টক ঝাল ঝাল কি ভালো যে লাগে। বিথী দেখলেই বকে। কটা হজমোলা মুখে ফেলে শিশিটা পাঞ্জাবির পকেটে চালান করল অপরেশ। 


 গলা তুলে জিজ্ঞেস করল ‘তাপস আমার কত টাকা বাকী আছে রে?’ 


 তাপস অন্য একজন খদ্দেরকে চিঁড়ে ওজন করে দিচ্ছিল।বলল, ‘এখনো তো মাস শেষ হয়নি কাকু, একেবারে দেবেন।’


‘আরে না না, বল ;  মিটিয়ে দিই।’ খুব বেশি বাকী ছিল না, শ পাঁচেক মতো৷ টাকাটা দিয়ে দিতেই পকেট খালি হয়ে গেল। নির্ভার লাগছে। একটা রিক্সা ডাকলো অপরেশ, অন্যদিন হেঁটেই  ফেরে। আজ ব্যাগটা বেশ ভারি। মৃত্যুও উঠে বসল রিক্সায়। দুজনে যাচ্ছে, কারো মুখে কোনো কথা নেই। মাঠের ধারের শিমুল গাছটা লালে লাল। পলাশ গাছটাতেও যেন আগুন লেগেছে। কদিন আগেই দোল গিয়েছে, এখনো রাস্তায় বসন্তের দাগ। আবিরের প্যাকেট,ছেঁড়া  রঙিন জামা পড়ে আছে ইতিউতি। পরের বসন্তটা আর দেখা হবে না, আলগা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন অপরেশ। মৃত্যু তাকালো, তার চোখে স্বান্তনা। 


‘তোমার কি মাথা খারাপ! এতো মাছ কেউ আনে? দুটো মানুষ ক জন্ম ধরে খাব? আর এত মিষ্টি এক সাথে এনেছ কেন! কে খাবে? তোমার সুগার সে খেয়াল আছে? আবার কচুরি! একদিনে এত খেলে শরীর খারাপ হবে না? শুধু শুধু এত গুলো টাকার শ্রাদ্ধ।’বিথী বাজার দেখে বেজায় চটেছে। 


‘একদিনই তো, রোজ রোজ কি আনি? আজ ছুটি নিয়েছি,  আয়েস করে খাব।’


‘ছুটি? কই সকালে বললে না তো! সাত তাড়াতাড়ি রান্না বসালাম।’ 


‘ভালোই তো রান্না সেরে নাও,  কতদিন বসে দুটো কথা হয় না।’ 


‘তোমার কি হয়েছে বলো তো! অন্যদিন হলে কোনো না কোনো কারণে এতক্ষণ বার দুয়েক ঝগড়া হয়েই যায়।’


অপরেশ হাসে, একটু দূরে সোফায় বসে আছে মৃত্যু। বসে ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে। অপরেশের রকমসকম দেখে ঈষৎ বিরক্ত বুঝি বা। 


ডালটা বিথী অপূর্ব রেঁধেছে, মাছ ভাজা আর ডাল দিয়ে বেশ খানিকটা ভাত খেয়ে ফেলল অপরেশ। ছ্যাঁচড়াটা বিথী এমনিই ভাল রাঁধে, সাথে দই মাছটা পুরো বিয়ে বাড়ির মতো খেতে হয়েছিল। আজ খুব তৃপ্তি করে ভাত খেল অপরেশ। জলখাবারে রসগোল্লা পান্তুয়া খেয়েছিল,  ভাতের পাতে চাপ দই আর রসমালাই নিল। বিথী কোনোকালেই বেশি খেতে পারে না। সে সবই খেলো একটু একটু করে। 


‘একটা পান হলে দিব্যি হত,  কি বলো? আচ্ছা বিথী, ব্যাঙ্কের লকারের চাবি কোথায় থাকে জানো তো? আলমারি খুলে বাঁদিকে যে কাঠের বাক্সটা আছে ওখানে। ওই তাকেই সব দরকারী কাগজ আছে, মানে এল আই সি, ফিক্সড ডিপোজিট, আধার, প্যান ব্যাঙ্কের বই,  সব।’


‘আছে তো আছে,  আমি জেনে কি করব! আশ্চর্য! অত দায়িত্ব আমি নিতে পারব না, ওসব তুমিই দেখো। এই দ্যাখো আমাদের নাতি বাবু আজ ইস্কুলে ভর্তি হয়েছে, টুকুন ছবি পাঠিয়েছে। ’অপরেশ ও বিথীর একমাত্র মেয়ে টুকুন দিল্লিতে থাকে। বিয়ে হয়েছে তা বছর পাঁচেক হবে। জামাই ভালো মানুষ অপরেশ নিশ্চিন্ত থাকে। ফোনে নাতির ছবি দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল, আর দেখতে পাবেন না কখনো। মৃত্যু সোফা ছেড়ে শিয়রে এসে বসেছে। তর্জনী দিয়ে ঘড়ি দেখাচ্ছে অপরেশকে। হয়তো বলছে অনেক তো হল, এবার পাততাড়ি গুটিয়ে  চলো। পাশে বিথী ঘুমিয়ে পড়েছে। হালকা নাক ডাকার আওয়াজ হচ্ছে। অপরেশের বুকের বাঁ দিকের চিনচিনে ব্যাথাটা তীব্র আকার নিচ্ছে, প্রবল কষ্ট হচ্ছে। শরীর ছেড়ে প্রাণ বেরোনো তো চাট্টিখানি কথা নয়। হাঁকপাঁক করতে করতে বিছানা ভিজিয়ে ফেলেছে, বোধহয় মুখ দিয়ে গোঙানির মতো আওয়াজ হচ্ছিল। বিথী জেগে গিয়েছে। জল খাওয়ালো, ফ্যান ফুল স্পিডে  দিয়ে ছোটাছুটি করছে ঘরময়, কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। কাকে কাকে যেন ফোন করছে। মিনিট দুই পর যন্ত্রণাটা একেবারেই কমে গেল। শরীরটা বেশ হালকা লাগছে। অপরেশ নিজের মৃতদেহটা খাটে শুয়ে থাকতে দেখল। বিথীর কান্না শুনে পাড়া প্রতিবেশী জড়ো হয়েছে। শোবার ঘরটা লোকে লোকারণ্য। ভিড়ের মধ্যে তাপসও আছে, কাছেই বাড়ি। 

‘কাকীমা একি হয়ে গেল! এই তো আজ সকালে বাজার ফেরত আমার দোকানে এসেছিল কাকু। হজমোলা কিনল, বলল কত বাকী আছে বল দিয়ে দিই। বললাম মাস ফুরোলে দেবেন, শুনলো না,  জোর করে দিয়ে গেল।’

শুনে বিথী অবাক হল, মাস না পড়তেই ধার মেটালো?  তার মনে এল লকারের চাবি আর দরকারি কাগজ পত্র সংক্রান্ত কথোপকথন। চলে যাবে একথাই কি বলতে চেয়েছিল অপরেশ? ইস বিথী আগে বুঝল না! হাউ হাউ করে  কাঁদতে লাগলো সে। অপরেশ শেষ বারের মতো ঘরটা ঘুরে ফিরে দেখে নিচ্ছে। পরের জন্মে কোথায় ঠাঁই হবে কে জানে! সে বেশ যত্ন করে দাঁড়িয়ে থেকে বানিয়েছিল বাড়িটা, মিস্তিরির হাতে ছেড়ে দেয় নি। রড,  সিমেন্ট সব এক নম্বর। দেওয়ালে হাত বোলালো খানিক। শুনতে পেল টুকুনরা দিল্লি থেকে রওনা দিয়েছে। পৌঁছতে তাও আরো ঘন্টা পাঁচেক। ততক্ষণ কি থাকতে দেবে মৃত্যু? কে জানে! বিথী কার সঙ্গে যেন কেঁদে কেঁদে কথা বলছে ফোনে। অলোক সাঁপুই?  দুহাজার টাকা দিয়েছে শুনে বিথীর কান্না দ্বিগুণ হল। মানুষটা তবে বুঝতে পেরেছিল সে মারা যাবে, বিথী বুঝল না! এসব দেখতে আর ভালো লাগছিল না অপরেশের।

‘ এত খাবার দাবার একসাথে কেউ খেতে দেয়! নিষেধ করতে পারলি না! বয়স তো হয়েছে।' অপরেশের দিদি চোখ মুছছেন আর বিথীকে দুষছেন। অপরেশ দিদিকে কিছু বলতে পারে না, সে ক্ষমতা তার আর নেই। পায়ে পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সে। মৃত্যু তার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে। বাড়ির বাইরেও লোক গিজ গিজ করছে, এতো মানুষ অপরেশকে ভালোবাসতো তা সে বেঁচে থাকতে টের পেল না! সবাই অপরেশের গুণগান করছে। তারই মাঝে লড়ঝড়ে সাইকেল চালিয়ে হন্তদন্ত করে  গোবিন্দ এসে দাঁড়ালো। সকালে কি কি হয়েছিল তা ব্যাখান করে বলছে, আর হায় হায় করছে। গোবিন্দকে দেখেই ঝপ করে একটা প্রশ্ন মাথায় এলো, সকালে মৃত্যু কিন্তু গোবিন্দর পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। তবে কি অপরেশ নিজে যেচে মৃত্যুকে ডেকে আনল ? নাকি তাকে নিতেই মৃত্যু এসেছিল? অপরেশের মনে পাক খেতে থাকা প্রশ্নটা  মৃত্যু টের পেয়েছে, তার মুখে অদ্ভুত রহস্যময় একটা হাসি। তার অর্থ হ্যাঁ অথবা না দুটোই হতে পারে…


অপরেশ মৃত্যুর ঠান্ডা হাত ধরে মাঠের পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। বিকেলের হলুদ আলোয় ভিজছে শহর। শন্ শন্ শব্দে বসন্ত বাতাস বইছে, ঝরা পাতার ঘূর্ণি উঠছে। পালাশ গাছের নীচে বিছিয়ে আছে আছে কমলা রঙা বসন্ত। একটা গানের লাইন বার বার মনে পড়ছে অপরেশের। 

❝তার ছেঁড়া যন্ত্রের মাঝখানে শুয়ে আছি

আমলকি বনে শোনো

বসন্ত এসে গেছে❞…..

..................................

অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি