ঐতিহাসিক গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
ঐতিহাসিক গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

মালবকৌশিক - মলয় চ্যাটার্জী

 

মালবকৌশিক

 

মলয় চ্যাটার্জী 

 

    সকালের দিকে আচমকাই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর এখন আকাশ বেশ ঝকঝকে হয়ে উঠেছে । দূরে পূবদিকে যদিও কিছুটা মেঘের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে , কিন্তু তাতে যে এইমুহূর্তে বৃষ্টির কোনো আশঙ্কা নেই সেটা বলে দেওয়াই যায় । সময়টা চৈত্রের মাঝামাঝি হওয়ার কারণে দামোদরকে এখন সত্যিই মনে হচ্ছে যেন বিধবার সিঁথির মতো। সে নদের একেবারে মাঝবরাবর না চলে এই সুবৃহৎ গহনার নৌকাটি চলেছে কিছুটা দক্ষিণ দিকের পার ঘেঁষে । সূর্যদেবের মাথার ঠিক ওপরভাগে অবস্থান করতে এখনো প্রায় তিন দণ্ড দেরি আছে । এইসময়েই ছইয়ের ভিতর থেকে নৌকার সম্মুখভাগের পাটাতনে এসে দন্ডায়মান হলেন ত্রিলোক গোস্বামী । এদিকের পাটাতনে আর কারও আসার হুকুম নেই । এদিকটা  সম্পূর্ণভাবেই তার জন্য ছেড়ে রাখা হয়েছে । প্রথমেই গুন টানতে থাকা মাল্লার দিকে তাকিয়ে তারপর তিনি দৃষ্টিপাত করলেন ধীরলয়ে চলা দামোদরের দিকে। তারপর ছইয়ের ওপর দিয়ে তাকালেন নৌকার পিছনে হাল ধরে থাকা মাঝির দিকে । এ নৌকার সাথেই শক্ত করে বাঁধা তুলনায় অনেক ছোট এক বাছারি নৌকাও চলেছে ঢেউ ভেঙ্গে । সেদিকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলতে গিয়েও প্রথমে জিজ্ঞাসা করলেন ....

 

-- কি মনে হচ্ছে গো ? আজ সন্ধ্যার আগে পৌঁছাতে পারবো তো মশাগ্রামে ? 

মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে উত্তর দিলো মাঝি...

-- তা পৌঁছাবো ঠাকুর, আকাশ দেখে তো মনে হচ্ছে অসুবিধার কোনো কিছুই নেই।

 

পিছনের বাছারির গলুইতে বসা বছর তিরিশের লোকটির দিকে তাকিয়ে বললেন ত্রিলোক...

-- ওর যাতে অসুবিধা না হয় সেটাও দেখো তুমি। 

এই একটি গহনার নৌকাতেই আসা যেত সবাই মিলে; কিন্তু ও লোকটি যে.....

 

    এই তো ঠিক দুই দিন আগের ঘটনা। নিজগৃহে সংগীতশিক্ষা দিচ্ছিলেন ত্রিলোক। প্রৌঢ়ত্বে পা দেওয়া ত্রিলোকের নিবাস এক সময় বিষ্ণুপুরে থাকলেও বর্তমানে উনি নিজের আশ্রয়স্থল গড়ে নিয়েছেন দামোদরের এপারে গোপীনাথপুরে। বাসস্থান এখানে উঠিয়ে নিয়ে আসলেও শিষ্যের কোনো অভাব নেই ত্রিলোকের। এক সময় সমগ্র বিষ্ণুপুরেই সংগীতগুরু হিসাবে ওনার খ্যাতি ছিল গগনচুম্বী। এমনিতেও মল্ল রাজাদের গড় এই বিষ্ণুপুর চিরকালই সংগীতের কদর করে এসেছে। সে কদর অবশ্য আজও বর্তমান,কিন্তু প্রথমে ১৭৬৫ সনের দেওয়ানি লাভের পর বিষ্ণুপুর চলে যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। তারপর মারাঠা বর্গির আক্রমণ ও ১৭৭০ সালের বিভীষিকাময় মন্বন্তরের কারণে নিজগৌরব হারায় বিষ্ণুপুর। আর এই তো কয়েকবছর আগেই বাঁকুরাকে সদর এবং বিষ্ণুপুরকে পৃথক করে গঠিত হয়েছে পশ্চিম বর্ধমান জেলা। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণেই বিষ্ণুপুরের সংগীতজগৎ এখন টলোমলো। তাছাড়া যে কারণে বিষ্ণুপুরের সংগীতের এত খ্যাতি,সেই ধ্রুপদীসংগীতশৈলীতেও বর্তমান প্রজন্ম আর সেইভাবে যেন আকৃষ্ট হচ্ছে না। তারা এখন সংগীতে মনোরঞ্জনের দিকেই বেশি উৎসাহী। এর কারণ যদিও বুঝতে পারেন না ত্রিলোক গোস্বামী, কিন্তু তিনি এটা বোঝেন যে কালের সাথে সাথে , যুগের তালে ওনার নিজেকেও তাল মিলিয়ে চলতেই হবে। অতএব মূর্তির গায়ে অলঙ্করণ করার মত ওনাকেও শ্রোতার মনোরঞ্জনকারী সংগীত শিক্ষা দিতে হয় নিজের শিষ্যদের। 

এমনিতে মিঞা তানসেনের প্রত্যক্ষ বংশধর বাহাদুর খাঁয়ের সাথেই ধ্রুপদ এসেছিল বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের দরবারে। তবে ত্রিলোক গোস্বামীর নিজবংশমর্যাদাও কিছু কম নয়।১৬শতকের গোড়ায় বৃন্দাবনের গোস্বামীরা, শ্রীনিবাস, নরোত্তমদাস এবং শ্যামানন্দ নামে যে তিনজন বৈষ্ণব নেতাকে বিভিন্ন গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের জন্য একটিই সাধারণ ঈশ্বরতত্বের কাঠামো তৈরী আর প্রচারের উদ্দেশ্যে খেতুড়ির মহাসম্মেলনে পাঠিয়েছিলেন, তাদের মাঝে শ্যামানন্দ ছিলেন সহজাত গায়ক। তিনি এই সম্মেলনে বাংলার বৈষ্ণবসমাজে ধ্রুপদ গায়কীতে এক নতুন ধরনের ভক্তি সংগীতের সূচনা করেন। আর আজকের ত্রিলোক গোস্বামী সেই হলেন সেই শ্যামানন্দেরই বংশধর। 

 

    সংগীতগুরু হিসাবে ওনার খ্যাতি এখন ছড়িয়েছে বিষ্ণুপুর বাঁকুড়া ছাড়াও অন্যান্য জেলাগুলোতে। লোকে বলে "গান গেয়ে কিভাবে শ্রোতার মন জয় করা যায় সেটা শিখতে যদি চাও তো তিলোক গোঁসাইয়ের কাছে যাও।" 

 

    সেদিনও এক শিষ্যকে উনি শেখাচ্ছিলেন যে কিভাবে কোমল নি-র জায়গায় শুদ্ধ নি ব্যবহার করলে রাগ মালকোষ পরিণত হয় রাগ চন্দ্রকোষে। এই সময়েই সর্বক্ষণের সঙ্গী তরণী এসে দাঁড়ায় ওনার সম্মুখে। দ্বারের দিকে দেখিয়ে বলে ওঠে..

-- আজ্ঞে গোঁসাইঠাকুর, একজন আপনার দর্শন পাওয়ার জন্য এসেছেন। 

-- কে আবার এলো এই সময়ে। তুমি যাও তরণী,ওনাকে এই ঘরেই নিয়ে এসো।

বলা সত্ত্বেও তরণী তবুও ইতস্ততঃ করছে দেখে পুনরায় উনি জিজ্ঞাসা করলেন .....

-- কি হলো তরণী ? যাও...

-- আজ্ঞে ঠাকুর , লোকটি বিধর্মী। 

-- বিধর্মী ? সে কি ? কি নাম ? কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সে ? 

-- আজ্ঞে নাম বলেছে মুস্তাক আলি। আর এ গৃহের বাইরের রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে আছে। আর বলছে যে আপনার সাথে তার বড় দরকার। 

-- চলো তো দেখি। 

তাড়াতাড়ি গৃহের দ্বারে এসে দেখলেন ত্রিলোক যে একেবারেই মলিন বস্ত্র পরিহিত এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে দ্বারপ্রান্তে। ত্রিলোক গোস্বামীকে দেখে কপালে হাত ঠেকায় সে। মুখে বলে....

-- গোঁসাই ঠাকুর , এবার যে না গেলেই নয়। 

বড় আশ্চর্য্য হন ত্রিলোক। এই যুবক তাকে চিনলো কিভাবে ? আর কোথায় যাওয়ারই বা কথা বলছে এ। বলেন...

-- তুমি আমাকে চিনলে কিভাবে ? 

-- আজ্ঞে দামোদরের দুই কূলেই যে আপনার খ্যাতি বিরাজ করেছে। আপনাকে না চেনা তো অপরাধ ঠাকুর। 

-- তা ঠিক, কিন্তু কোথায় যাওয়ার কথা বলছো তুমি? 

-- আমাকে যে পাঠানো হয়েছেই ঠাকুর আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যিনি পাঠিয়েছেন, তিনি বলেও দিয়েছেন যে আপনি আসবেনই ওনার শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করতে। 

-- কার কথা বলছো তুমি ? আর যাবোটাই বা কোথায় ?

-- আজ্ঞে এখন আসছি সোমরাগিরি থেকে। তবে যিনি পাঠিয়েছেন তিনি বলেছেন যে গুপ্তিপাড়ার দরবেশ বললেই আপনি ঠিক চিনতে পারবেন। 

 

    সহসা কোনো অন্ধকার ঘরের দ্বার খুললে যেমন সে ঘরের অন্ধকারের ওপর বাইরের আবছা আলো এসে পড়ে, গুপ্তিপাড়ার নাম শুনে ত্রিলোকের অবস্থা হলো ঠিক সেইরকম। মনের কোণ থেকে যেন উঠে এলো শৈশবকাল। মনে পড়লো যে এই গুপ্তিপাড়াতেই জন্ম হয়েছিল ওনার। জন্মের পরের আট বছরও ওনার কেটেছিল এই গুপ্তিপাড়াতেই। সংগীতের প্রতি অমোঘ আকর্ষণে ওই শিশুকালেই সেইসময় তিনি শুনতে যেতেন স্থানীয় মন্দিরের ভজন গান। এইসময়েই গুপ্তিপাড়ায় এসে উপস্থিত হন এক সুফি সাধক। নাম মহম্মদ গোলাম দরবেশ। শুধুই সংগীতের মাধ্যমে তিনি ডাকতেন তার উপাস্যকে। রাগ মালকোষে যখন আকুল হয়ে গাইতেন "তেরে সামনে সব কো আনা পড়েগা মেরে মালিক " তখন যেন মনে হতো যে নিজের সবটুকু দিয়েই উনি ওনার মালিককে ডাকছেন। শিশু ত্রিলোক যেন ছায়াসঙ্গী হয়ে গিয়েছিল সেই দরবেশের। এমনকি ভাগ্যান্বেষণের জন্য ত্রিলোকের পিতা যখন যাত্রা করেন বিষ্ণুপুরের উদ্দেশ্যে , সেদিন ছোট্ট ত্রিলোক কেঁদে ভাসিয়েছিল তার দুচোখ। দরবেশকে কিছুতেই ছেড়ে যেতে চায়নি সে। শেষে ছোট্ট ত্রিলোকের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে আস্বস্ত করেন সেই দরবেশ,আর বলেন... 

-- শোচো মত বেটা, আভি তুম যাও। পর ইয়াদ রাখনা, ওয়াক্ত আনে সে তুমে ম্যায় বুলা লুঙ্গা। 

 

    বিষ্ণুপুরে এসেই ত্রিলোক শুরু করেন সংগীতের তালিম নিতে। এ ঘটনা আস্তে আস্তে মুছেও যায় তার মন থেকে। এরপর সংগীতগুরু হিসাবে খ্যাতির সাথে সাথে অতীতও যেন বিস্মৃতপ্রায় হয়ে যায় ধীরে ধীরে।

আজ এতদিন পরে সেই গুপ্তিপাড়া আর দরবেশের কথা শুনে হঠাৎই যেন ঝাঁকি খেলেন ত্রিলোক গোস্বামী। দরবেশ বলেছিলেন বটে যে সময় হলেই ডেকে নেবেন। কিন্তু কিসের সময় সেটা আর জানা হয়নি ওনার। কৌতূহলভরে এবার তাই প্রশ্ন করলেন উনি...

-- আর কিছু বলেননি উনি ? মানে এতদিন পর আমায় ঠিক কি প্রয়োজনে স্মরণ করছেন উনি? 

-- না গোঁসাইঠাকুর, উনি শুধু বলেছেন যে আপনাকে এইটুকুই বলতে। আর আপনাকে নাকি যেতে হবেই। 

 

    কেমন জানি বিহ্বল হয়ে পড়েন ত্রিলোক। হঠাৎই খেয়াল হয় যে বিধর্মী হলেও এই মুহূর্তে মুস্তাক আলি ওনার গৃহে অতিথি। তাড়াতাড়ি তরণীকে নির্দেশ দেন যে মুস্তাকের জন্য জল এবং আহার্য্যের ব্যবস্থা করতে। গৃহের অদূরেই এক কুটিরে থাকার ব্যবস্থাও করতে বলেন উনি। তারপর সেদিন এবং গতকাল প্রায় সারাদিনই চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন ত্রিলোক। খালি ভেবেছেন যে দরবেশের বলা ওই সময় কিসের ইঙ্গিত করছে। অবশেষে গতকাল বৈকালে মনস্থির করেই ফেলেন তিনি। তরণীকে বলেন যে ওনার যাত্রার উপযুক্ত নৌকার ব্যবস্থা করতে। বর্তমানে যেস্থলে আছেন দরবেশ , সেই সোমরাগরির দূরত্বও এই গোপীনাথপুর থেকে বড় কম নয়। পদব্রজে বা গরুর গাড়িতে এই দূরত্ব পার করা যায় ঠিকই , কিন্তু তা যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। এবং ত্রিলোক গোস্বামীর বর্তমান সামাজিক সম্মানের পরিপন্থীও বটে। সেই কারণেই স্থির হয়েছে যে নৌকাযাত্রায় মশাগ্রাম পর্যন্ত যাওয়ার পর সেখান থেকে গরুর গাড়িতে মেমারি,সেনের ডাঙ্গা হয়ে যাওয়া হবে সোমরাগরি। সেইমতই দামোদর বেয়ে এই সামনের গহনার নৌকায় চলেছেন ত্রিলোক, আর পিছনের বাছারিতে চলেছে মুস্তাক আলি। 

 

    সোমরাগিরির ভাঙাচোরা মসজিদে যখন পৌঁছলেন ত্রিলোক, তখন সন্ধ্যা হয় হয়। মসজিদের বাইরেই দেখলেন ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছেন এক বৃদ্ধ। পরনে শুধু মলিন পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি। দুধসাদা অবিন্যস্ত পক্ককেশ আর বুক পর্যন্ত ঢাকা দাড়ি হাওয়ায় উড়ছে। বলিরেখাময় মুখমন্ডলে যেন খেলা করে বেড়াচ্ছে স্বর্গীয় হাসি। শরীরে বয়স থাবা বসিয়েছে, যদিও শৈশবের দেখা গোলাম দরবেশকে চিনতে খুব একটা অসুবিধা হলো না ত্রিলোকের। কিন্তু এখন উনি আর সেই ছোটটি নেই, এখন সংগীতমহলে ওনার খ্যাতি অত্যন্ত বিশাল। তাই উচ্ছাস গোপন করে শান্তস্বরেই শুধোলেন....

-- শুধুমাত্র আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্যই এসেছি আমি। বলুন , কি আপনার শেষ ইচ্ছা ? 

বহুদিন বঙ্গদেশে থাকতে থাকতে বাংলা বলতে এখন আর কোনো অসুবিধা হয়না দরবেশের, তবে সামান্য উর্দুর টান যে রয়ে গেছে সেটা বোঝাই যায়। সেভাবেই বললেন তিনি...

-- হোবে বেটা, ওহ সোব হোবে। পর পহলে তুম আরাম করো। তুমহারি রহনে কে লিয়ে অলগসা জাগা কা ইন্তেজাম কিয়া হ্যায় বেটা। অউর খানে কা সব বন্দোবস্ত ভি ওহি পর হ্যায় বেটা। পর বেটা, খানা তুমাকেই পাকাতে হোবে। 

-- কিন্তু.....

-- নেহি বেটা, আজ আরাম করো। কাল বাত হোবে। 

 

    আবার ঘুরে মসজিদে ঢোকার আগে ত্রিলোকের সাথে আসা মুস্তাককে এবার ইঙ্গিত করেন তিনি ওনার থাকা খাওয়ার জায়গাটা দেখিয়ে দিতে। তাড়াতাড়ি মুস্তাক এবার এগিয়ে আসে সেই কাজ করতে। হতভম্ব ত্রিলোককে নিয়ে সে পৌঁছায় মসজিদের অনতিদূরেই এক জীর্ণ কুটিরের সামনে। মুখে শুধু বলে...

-- আসুন গোঁসাই, এখানেই আপনার থাকার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। 

--কিন্তু মুস্তাক.....

-- জানি গোঁসাই, সে চিন্তা করবেন না। এ ছিল এক ব্রাহ্মণেরই ঘর। বেশ কিছুদিন হলো তারা এখানকার ভিটে ছেড়ে নদী পেরিয়ে চলে গেছে নবদ্বীপে। আর আপনার আহারের জন্য যা যা আনা হয়েছে, তাতেও আমরা কেউ হাত লাগাইনি। সবই এখানকার এক হিন্দু ভাই নিয়ে এসে রেখেছেন। 

-- সে না হয় হলো, কিন্তু উনি কি বলার জন্য শুধু আমাকেই স্মরণ করেছেন সেটার বিষয়ে কি কিছু জানো তুমি ?

-- ক্ষমা করবেন গোঁসাইঠাকুর। ও ব্যাপারে যা বলার সেসব ওই ফকিরবাবাই বলবেন। এবার আমায় আজ্ঞা করুন। আমায় গিয়ে ওনার জন্য রাতের খাবার বানাতে হবে। 

চলে যায় মুস্তাক, আর ক্লান্ত অবসন্ন শরীর নিয়ে সেই কুটিরের ভিতর প্রবেশ করেন ত্রিলোক। রাতের খাবার বানাতে হবে এখন। তারপরেই আজকের মতো শরীরকে বিশ্রাম দেওয়ার পালা। 

 

    পরদিন প্রত্যুষেই নিদ্রা ভাঙে ত্রিলোকের। মসজিদ আর এই কুটিরের মাঝে ব্যবধান প্রায় সিকি মাইলের। চারপাশে কেমন জানি ঝুপসি হয়ে আছে বড় বড় গাছগুলো। তার মাঝেই আছে যদিও কয়েক জরাজীর্ণ গৃহ, তবে সেখানে যে কেউ বাস করেনা এখন সেটা বোঝাই যায়। মনে হয় এখানকার বাসিন্দারা সবাই ঘর ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি দিয়েছে পেটের তাগিদে। তবে অনতিদূরে দুএকঘর হিন্দুর বাসও যেন চোখে পড়লো ওনার। মনে মনে ভাবলেন যে তাদের মধ্যেই কেউ মনে হয় ওনার জন্য আহারের সামগ্রী রেখে গেছে এই কুটিরে। 

নিতান্ত অলসতা আর কৌতূহলের মাঝে সারাদিন কাটিয়ে যখন সন্ধ্যার পর সে কুটিরের দাওয়ায় বসে নিজের মনেই গুনগুন করে পুরবীর কলি গাইতে শুরু করেছেন ত্রিলোক, তখনই মুস্তাকের কাঁধে ভর দিয়ে সে কুটিরের সামনে এসে দাঁড়ালেন দরবেশ। ত্রিলোক কিছু বলার আগে নিজের থেকেই বলে উঠলেন..

-- আমি জানি বেটা, আমার ঘরে যেতে তোমার অসুবিধা আছে। কিন্তু তোমার ঘরে আসতে আমার তো কোনো অসুবিধা নেই। আমি কি এই দাওয়ায় বসবো বেটা ? 

 

    লজ্জায় ভারী সঙ্কুচিত হয়ে পড়েন এবার ত্রিলোক। বিধর্মীর ছোঁয়া খাবার উনি খান না একথা সঠিক। কিন্তু চার কুড়ি বয়স পার করা এক বৃদ্ধকে উনি ঘরের দাওয়ায় বসার অনুমতি দেবেন না, এ চিন্তাও যে বাতুলতা। বিশেষ করে এই গৃহে থাকার আয়োজনও যখন তিনিই করে দিয়েছেন। তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন...

-- সে কি কথা ! বসবেন না কেন ? আর তাছাড়া আমি তো আপনার কাছ থেকে ওই ইচ্ছা আর সময়ের কথা শোনার জন্যেই অপেক্ষা করছি। 

কোনোরকমে সেই দাওয়ায় বসলেন দরবেশ। তারপর প্রথমে মুস্তাককে বললেন যে ঘন্টাখানেক পর আবার ঘুরে আসতে। এবার ধীরস্বরে বলেন ত্রিলোককে...

-- হাঁ বেটা , অব শুনাও। 

-- কি শুনতে চাইছেন আপনি ? বলবেন তো আপনিই, শোনার জন্য তো আমিই বসে আছি। 

-- সে তো বলবোই বেটা। লেকিন পহলে তুম শুনাও। আজ ম্যায় তুমহারি গানা শুননে কে লিয়ে হি আয়ে হ্যায়।

-- বেশ বলুন কি গাইবো ? 

-- ওহি, ইঁহা আনেসে পহলে যো তুম গা রহে থে, ওহ মালকোষ শুননে কা মন কর রহে হ্যায় বেটা। 

চমকে ওঠেন ত্রিলোক। এখানে আসার ঠিক আগে যে উনি ওই রাগ মালকোষ গাইছিলেন সেটা এতদূরে বসে দরবেশ জানলেন কিভাবে ? তাকিয়ে দেখলেন দরবেশের মুখে যেন স্নিগ্ধ হাসির ছটা লেগে আছে। শুনতে পেলেন উনি বলছেন ....

-- কি ভাবছো বেটা ? আমি কিভাবে জানলাম তাই তো ? ও কুছ নেহি হ্যায়। ওহ সব বাদমে বাতায়েঙ্গে। পহলে তুম গানা শুনাও আপনা। 

গান শুরু করার আগে শুধু জিজ্ঞাসা করেন ত্রিলোক যে ওনার গান তো সবই হরি বা কৃষ্ণের গুনগান নিয়ে। সেটা শুনতে দরবেশের কোনো অসুবিধা হবে কিনা। স্মিত হেসে দরবেশ বলেন..

-- বেটা , চাহে আল্লাহ চাহে ভগবান , পর সুর তো একহি হ্যায় না। 

আর দেরি করেন না ত্রিলোক। আলাপ ধরেন রাগ মালকোষের। 

সা... নিসা...গাসা...গামা... গাসা... গামা....ধাসা..

চোখ বন্ধ করে শুনতে থাকেন দরবেশ। কিছু পরে যখন পকড় ধরে সবে ত্রিলোক শুরু করেছেন.....

ধানি... সামা...মাগা... মাগাসা....

হঠাৎই চোখ খুলে বলে ওঠেন দরবেশ....

-- বেটা তুম কিসকো শুনা রহে হো ? 

-- মানে ? সামনে তো শুধু আপনিই বসে আছেন। আর আপনিই তো এই রাগ মালকোষ শুনতে চাইলেন। আপনাকেই শোনাচ্ছি। 

-- পর বেটা, আমি তো তোমাকে কিছু দিতে পারবো না।

-- মানে ? এখানে দেওয়াদেয়ির কথা আসছে কেন ?আর আপনি দিলে আমি নেবই বা কেন ?

-- না বেটা, সে কথা নয়। তোমার গান শুনে মনে হচ্ছে কি তুম কুছ পানে কে লিয়েহি গা রহে হো। মতলব ইয়া তো রূপেয়া, ইয়া সাবাশি। অ্যায়সে নেহি বেটা,সির্ফ আপনে আপ কো লিয়ে তুম গাও বেটা। ম্যায় ওহি শুননা চাহতা হুঁ।

-- নিজের জন্য মানে ? আমি তো নিজেই গাইছি।

-- হাঁ বেটা, তুমি নিজে গাইছো। পর নিজের জন্য গাইছো কি ? তোমার গান শুনে মনে হচ্ছে কি যে ইয়ে গানা খতম হোনে কি বাদ ইয়া তো তুমহে কুছ নজরানা মিলেগা, ইয়া তো কিসিসে সাবাশি, ওহ নেহি বেটা , সির্ফ আপনে দিল কো খুশ করনে কে লিয়ে গাও তুম।

-- আপনি ভুলে যাচ্ছেন যে আমি কিন্তু এই সঙ্গীতের শিক্ষাদানই করে থাকি।

-- ওহ সব ম্যায় নেহি জানতা হুঁ বেটা। পর শুনে লাগছে কি যে তুমি গানে কে সাথ রাগ মালকোষকো ঠিক সে নেহি বুলা রহে হো। 

-- মানে....

-- না বেটা, আজ তুমি শোচো। অউর সির্ফ শোচো বেটা। ম্যায় কাল ফির আউঙ্গা। 

 

    সেরাতে দরবেশ চলে যাওয়ার পর ভেবে ভেবেও কিছু কূলকিনারা পান না ত্রিলোক। খালি মনে হয় যেন অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই এখানে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা বোধহয় হঠকারীতাই হয়েছে। পরদিন দুপুরেও শুধুমাত্র সামান্য ফলাহার করেই অপেক্ষায় থাকেন ত্রিলোক। সে কুটিরের দাওয়ায় বসে দুচোখে তন্দ্রা আসে তার। হঠাৎই দেখেন যে এক সৌম্যকান্তি পুরুষ অপূর্ব জ্যোতি অঙ্গে মেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে। কিছু বলার আগেই তিনি বলে ওঠেন "আমি আসবো ত্রিলোক , শুধু তোমায় আকুল হয়ে ডাকতে হবে আমায়।" হতচকিত নয়নে প্রশ্ন করেন ত্রিলোক, "কিন্তু কে আপনি ?" আবার উত্তর আসে সেই দিব্যকান্তি পুরুষের থেকে, "আমি স্বয়ং রাগ মালকোষ ত্রিলোক। ডাকো আমায়, সর্বস্ব দিয়ে ডাকো তুমি, তবেই তো তুমি জানবে আমায়। তবেই তো ছুঁতে পারবে আমায়।"  

যেন বহুদিনের নিদ্রায় বিজড়িত কোনো রাজকুমারকে ছোঁয়ানো হয়েছে সোনার কাঠি ,রুপোর কাঠি। ধড়মড় করে নিদ্রাভঙ্গ হয়ে সটান উঠে বসেন ত্রিলোক। স্বপ্নে দেখা দিব্যকান্তি পুরুষ যেন ঘোর লাগিয়ে দিয়েছে ওনার অন্তরে। মনে মনে ভাবতে থাকেন যে ধ্রুপদের অর্থ হলো ধ্রুব পদ। ধ্রুপদে স্থায়ী অন্তরা সঞ্চারী আভোগ নামে চারটি কলি আছে। ধ্রুপদের বিশেষত্বই হচ্ছে যে রাগের বিশুদ্ধতা বজায় রাখা। আর সেই ধ্রুপদ অঙ্গে রাগ মালকোষ , সে তো পরম যত্নের ধন। 

মাল এবং কৌশিক , এই দুটি শব্দের সংযোগে সৃষ্টি হয়েছে মালবকোষ বা মালকোষ শব্দটি। যিনি কণ্ঠে সর্পের মতো মালা পরিধান করেন , অর্থাৎ ভগবান শিব। কথিত আছে সতীর দেহত্যাগ দেখে শিব যখন রুদ্রমূর্তি ধারণ করে তাণ্ডবলীলা শুরু করেন , তখন তাকে শান্ত করার জন্য এই রাগের সৃষ্টি করেন স্বয়ং দেবী পার্বতী। 

আর সেই রাগ মালকোষের সাথেই কিনা তিনি এতদিন করেছেন অবিচার। তুচ্ছ বাহবা আর উপঢৌকনের মোহে সেই রাগকে তিনি উপস্থিত করেছেন নিজের মর্জিমতো।

 

    সন্ধ্যা পার করে আজ আবার আসেন দরবেশ। ত্রিলোক কিছু বলার আগেই বলে ওঠেন তিনি...

-- কেয়া বেটা , মুলাকাত হুয়া কেয়া উনকে সাথ।

-- কার কথা বলছেন আপনি ? 

-- ওহি , যিনহনে আয়ে থে তুমহারি স্বপ্নে মে। 

আবার চমকে ওঠেন ত্রিলোক। তাকিয়ে দেখেন যে দরবেশ হাসছেন মিটিমিটি। ওইভাবে হাসতে হাসতেই তিনি এবার বলে ওঠেন....

-- কেয়া শোচ রহে হো বেটা ? মুঝে ক্যায়সে পতা চলা? ওহ সব ছোড়ো বেটা। অব শুনো , ইসিলিয়ে তো তুমে লে আয়া হুঁ মেরে পাস। আজ সে তুম সির্ফ উনকো পুকারেঙ্গে বেটা। ভুল যাও সবকুছ। অগলে পাঁচদিন তক এহি তুমহারা কাম হ্যায়। 

-- পাঁচদিন ! কিন্তু পাঁচদিনই বা বলছেন কেন আপনি? আর তাছাড়া আপনাকে তো কিছুই দিতে পারবোনা আমি। 

এবার ত্রিলোকের মাথায় হাত রাখেন দরবেশ। মুখে শুধু বলেন...

-- কিউ কি যো ওয়াক্ত কা তালাশ হ্যায়, ওহ পাঁচদিন বাদ হি আয়েগা বেটা। অউর ফিকর মত করো তুম,ম্যায় খুদ আপনি নজরানা মাঙ্গ লুঙ্গা তুমসে। ইসিলিয়ে তো তুম আয়ে হো ইধার। 

-- মানে ? আমি আপনার ওই নজরানা দেওয়ার জন্য এসেছি এখানে ? 

-- হাঁ বেটা। তুমাকে আসতেই হতো ইখানে। পর ইয়ে সব ছোড়ো তুম। তুম ইয়ে পাঁচদিন সির্ফ উনকো পুকারো। 

সেদিন আর কথা না বাড়িয়ে চলে যান দরবেশ। আর ত্রিলোক ভাবতে থাকেন , তাহলে কি ওনার শিক্ষা সম্পূর্ণ নয়। যেভাবে মালকোষ রাগকে উনি পেশ করেন শ্রোতাদের সামনে তাতে কি সত্যিই কোনো খামতি আছে ? কিন্তু ওনার পরিবেশনায় যদি কোনো খামতিই না থাকবে তাহলে ওই স্বপ্নই বা দেখলেন কেন উনি। 

 

    পরের পাঁচদিন বলতে গেলে ত্রিলোক শুধু আকুল ভাবে ডেকেই চললেন রাগ মালকোষকে। কোন রকম মুরকি নয় , কোনো গমক নয়, কোনো খটকা নয়, শুধু মনের আকুলতা দিয়ে গেয়ে চলেছেন "হরি আওবো আজ মন মন্দিরে।" শুধুই আরহ অবরোহ খেলা করছে তখন ওনার কণ্ঠে 

"নি সা গা মা ধা নি সা

 সা নি ধা মা গা মা গা সা" 

মন্দ্রসপ্তকে শুধু শোনা যাচ্ছে তখন ...

"সানিসা নিসানিধামা মাধানিসা

 সানিধামাসামা গামাগাসা সাগামাধামা...."

 

    এই পাঁচদিন ওনার জন্য আহার্য্য বস্তু এসেছিলো ওই কয়েকঘর হিন্দুর থেকে পালা করে। ত্রিলোক কোনোদিন প্রস্তুত করেছেন আহার, সে আহার গলধঃকরণ করেছেন কোনোরকমে। আবার কোনোদিন সব ভুলে শুধু ডেকেই গেছেন রাগ মালকোষকে। 

পঞ্চমদিন সন্ধ্যার পর ওনার কুটিরের সামনে এসে দাঁড়ায় মুস্তাক। মুখে শুধু বলে ...

-- এবার যে যেতে হবে গোঁসাই।

-- কোথায় মুস্তাক ? আবার কোথায় নিয়ে যেতে চাও আমায় ? 

-- সামনেই গোঁসাই। ফকিরবাবার ঘরে। 

চমকে উঠলেন ত্রিলোক। এই প্রথমবার শুনলেন যে মুস্তাক ওনাকে নিয়ে যেতে চাইছে দরবেশের ঘরে। তবে মনের অদম্য কৌতূহল পূরণ করার উদ্দেশ্যে চললেন এবার দরবেশের আস্তানার দিকে। 

 

    ওই সোমরাগরি মসজিদের পিছনেই ছোট্ট এক ভাঙাচোরা কুটিরে বাস দরবেশের। সে কুটিরের একপাশে খোলা নাবাল জমি, আর পিছনেই এক বিশাল বড় দীঘি। দরবেশের কুটির আর ওই দীঘির মাঝেই এক লম্বা তালগাছ। সে তালগাছের ভৌতিক ছায়া পড়েছে ওই দীঘিতে। মনে হচ্ছে যেন দীঘিতে প্রকৃতি এক তালগাছের ছিপ ফেলে চুপটি করে বসে আছে। 

কুটিরের বাইরে মাদুরের ওপর বসেছিলেন দরবেশ। ত্রিলোককে দেখে হেসে বললেন...

-- আ বেটা। তেরা রাহা দেখতে দেখতে ইতনা সাল হো গ্যায়া। অব ওহ ওয়াক্ত আ গয়ে , তু বৈঠ মেরে সামনে। 

 

    আজ যেন চমকের পর চমক আসছে ত্রিলোকের কাছে। সাক্ষাতের পর এই প্রথম দরবেশ ওনাকে তুই বলে সম্বোধন করলেন। সবে কিছু বলতে যাবেন উনি,তার আগেই দরবেশ বলে উঠলেন মুস্তাককে দিকে তাকিয়ে....

--যা বাচ্চা , ইয়াদ হ্যায় না তুঝে ম্যায় কেয়া করনে কে লিয়ে বোলা থা। তু সির্ফ ওহি কর, উসিসে জিন্দেগী বিত জায়গা তেরা। 

এবার মুখ খোলেন ত্রিলোক...

-- কিন্তু কিসের সময় ? কোন সময়ের কথা বলছেন আপনি ? আর আজই বা কেন ? 

ওই হাসিমুখেই বলেন দরবেশ....

-- তোকে বলেছিলাম না বাচ্চা কে মেরা নজরানা ম্যায় খুদ মাঙ্গ লুঙ্গা। আজ ওহ দিন আ গ্যায়া।  আজ তুঝে সবকুছ দেনে কে বাদ ম্যায় আজাদ হো যাউঙ্গা। 

-- কিন্তু আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না এখনও। 

-- নেহি সমঝে বেটা। আজ শবে-এ-মিরাজ হ্যায় রে বাচ্চা। তু রুখ জরা, আজ ম্যায় আপনি হাতসে তুঝে খিলাউঙ্গা। তেরে লিয়ে খানা ভি ম্যায় খুদ বানায়া। 

-- সেকি ? কেন ? 

-- আজ যে তোর আঁখ ফোটাতে হবে রে বাচ্চা। আজ যো ম্যায় চাহুঙ্গা , তুঝে ওহি করনা পড়েগা। 

 

    আরও কিছুক্ষণ কথা বলে , বলতে গেলে ত্রিলোককে আরও হতচকিত করে দরবেশ ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে কুটির থেকে নিয়ে আসলেন খাবার। পদ্মপাতায় ঢেলে দিলেন সামান্য গরম ভাত , দুধ আর মধু। হেসে বললেন....

-- খা বেটা, মেরা খানে কা সামান তো ইঁহা কে ওহ লোগ রোজ দেতে হ্যায় যো তেরে ঘর কে সামনেহি রহতা হ্যায়। পর আজ ম্যায় তেরে লিয়ে সব কুছ রাখখে থে। তোর জন্যই আজ আমি চাওল পাকিয়েছি বেটা। তু মেরে সামনে বৈঠ কর খা। 

    কোনো কথাই আর উনি বলতে দেন না ত্রিলোককে। পরম যত্নে বসিয়ে খাওয়ান ত্রিলোককে। সে আহার শেষে খানিক বিশ্রামের পর এবার বলেন দরবেশ....

-- লে বাচ্চা, অব ম্যায় শো রহা হুঁ। তু মেরে পাস বৈঠ কর পুকার উনকো। অব সব কুছ তেরে হাত মে হ্যায় রে বাচ্চা। সির্ফ একহি বাত ইয়াদ রাখনা বাচ্চা। আজ কি রাত সুর মত ছোড়না বেটা। 

-- মানে.....

-- না বেটা, কিচ্ছু ভাবতে হবে না। ব্যস সুর মত ছোড়না। 

বয়সের ভারে জীর্ণ ডানহাতখানি তুলে এবার ত্রিলোকের মাথায় রাখেন দরবেশ। তারপর গালে কপালে সে হাত দিয়ে ধীরে ধীরে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেওয়ার পর সেই মাদুরের ওপর সোজা টানটান হয়ে শুয়ে পড়েন দরবেশ। 

 

    যেন একটা ঘোরের মাঝেই এবার রাগ মালকোষে সুর লাগান ত্রিলোক। আকুল কণ্ঠে ডাক দেন "হরি আওবো আজ মন মন্দিরে।" 

আস্তে আস্তে যেন সুরের মাঝে ডুবতে থাকেন ত্রিলোক। মন্দ্রসপ্তকে যখন কণ্ঠ ভাসিয়ে দিচ্ছেন উনি, তখন কণ্ঠে কোমল নি-র ব্যবহার শুনে মনে হচ্ছে যেন বিশ্ব চরাচর জুড়ে ধীর লয়ে বেজেই চলেছে ডিরিডিরি ডিরিডিরি আওয়াজ। একমনে একাগ্রচিত্তে দুচোখ বন্ধ করে সুরের মাঝে সম্পূর্ণ ডুবে গেছেন যখন ত্রিলোক , তখন হঠাৎই যেন অনুভব করে উঠলেন যে ওনার শরীর গরম হয়ে উঠছে। মাথা যেন ভার হয়ে উঠেছে। যেন কোনো সুরসমুদ্রের ওপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছেন উনি। গান থামিয়ে চমকে চোখ মেললেন ত্রিলোক। দেখলেন উজ্জ্বল কিন্তু চোখ ধাঁধানো নয়, বরং আশ্চর্য এক মায়াবী আলোয় ভেসে গেছে চারদিক। অদ্ভুত সুগন্ধে ম ম করছে চারিপাশ। ওনার গান থেমে গেছে, কিন্তু মাঠ প্রান্তর জুড়ে যেন হয়েই চলেছে একটা আওয়াজ। ডিরিডিরি -- ডিরিডিরি -- ডিরিডিরি। দরবেশ বসে আছেন ওনার সামনে। কিন্তু একি ? যেন মনে হচ্ছে শুন্যে ভাসমান হয়ে বসেছেন দরবেশ। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন ত্রিলোকের দিকে। আর যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে দরবেশের কণ্ঠস্বর "সুর মত ছোড়না বেটা, সুর মত ছোড়না।" 

     

    আর সহ্য করতে পারলেন না ত্রিলোক। ভয়ে বিস্ময়ে চোখ বন্ধ করে ফেললেন আবার। তারপর দরবেশের বলা কথামতো কণ্ঠে সুর ধরলেন আবার .......

"নিসাধানিসামা সাগামাগাসা গামাধানিধাসা 

গামাধানিসাগা গামাগাসানিসা 

ধানিসামা গামাধানিসাগাসা সামা ..........."

 

    আস্তে আস্তে, যেন খুব আলতো করে চোখের ওপর মায়ার পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে কেউ, এইভাবে ভোরের আলো ফুটতে থাকে। আবার পাখিদের গানে ভরতে থাকে ভুবন। গান থামিয়ে চোখ মেলেন ত্রিলোক। 

সামনে শুয়ে আছেন দরবেশ। এক নজর দেখলেই বোঝা যায় যে সে দেহ প্রাণহীন। যেন রাগ মালকোষ স্বয়ং এসে সুরলোকে নিয়ে গেছেন দরবেশ মহম্মদ গোলামকে । 

আসন ছাড়েন ত্রিলোক। ঘুরে মসজিদের সামনে এসে দেখেন যে মসজিদের ভাঙ্গা সিঁড়িতে বসে আছে মুস্তাক। শুধু তাই নয়, এই কাকভোরেও আশপাশ থেকে এসে হাজির হয়েছেন বেশ কিছু মানুষ। মুখ তোলে মুস্তাক, চোখে টলটল করছে জল। একরাতেই যেন সব দ্বন্দ্ব ঘুচে গেছে ত্রিলোকের। মুস্তাকের কাঁধে হাত রাখেন তিনি..

-- মুস্তাকভাই , তুমি প্রথম থেকেই সব জানতে; তাই না? 

-- না গোঁসাই, ফকিরবাবা শুধু বলেছিলেন যে গতকাল উনি ওনার মালিকের সাথে মিলবেন। তবে গতকাল রাতে ওনাকে ঠিক ওই জায়গায় মাদুরের ওপর বসতে দেখেই আমি আন্দাজ করেছিলাম। 

-- কেন মুস্তাকভাই। ওই জায়গার কি কোনো বিশেষত্ব আছে নাকি ? 

চোখে জল নিয়েও ম্লান হাসে মুস্তাক। বলে...

-- গোঁসাই , উনি বলেইছিলেন আগে যে ঠিক ওই জায়গায় যেন ওনাকে কবর দেওয়া হয়। কিন্তু আপনি এখন কি করবেন গোঁসাই। আপনার ফেরার ব্যবস্থা করতে যে দেরি হবে আজ। 

এবার মুস্তাকের হাত দুটোই চেপে ধরলেন ত্রিলোক। এতক্ষনে ওনার চোখও জলে ভরে গিয়েছে। সেই অবস্থাতেই বললেন.....

-- না মুস্তাকভাই, এখন নয়। ফিরতে তো আমায় হবেই। তবে তার আগে যিনি আমার চোখ ফুটিয়েছেন তার কবরে মাটি দেওয়ার কাজটাও যে আমায় করতে হবে আগে। তারপর তো আমারখোঁজার পালা।

-- খুঁজবেন ? কি খুঁজবেন গোঁসাই আপনি ? 

-- বুঝলেনা , আমার গুরু তার নৌকাটা ঠেলে দেওয়ার জন্যেই তো আমায় বেছে নিয়েছিলেন। আমাকেও যে এবার একজনকে খুঁজতে হবে মুস্তাকভাই যে আমার শেষ সময়ে আমার নৌকাটাকে ঠেলে দেবে। 

 

    আকাশ ইতিমধ্যেই পরিষ্কার হতে শুরু হয়েছে। সবাই সবার কাজে লেগে পড়বে এখন। এই দিনও শেষ হয়ে রাত নামবে একসময়। হয়তো কালের নিয়মে পাল্টে যাবে এই মসজিদের কাঠামো। হয়তো আবার অগুন্তি মানুষের ভীড়ে ভরে উঠবে এই জনপদ। 

তাকালেন ত্রিলোক গোস্বামী সামনের দিকে। কাঁচা রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে ওনার পায়ের সামনে থেকেই। এবার রাস্তায় নামার পালা ওনার। 

 

চরৈবতি......চরৈবতি.......... 

....................................................

 (গল্পে বর্ণিত চরিত্রগুলি সবই লেখকের কল্পনাপ্রসূত। এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল পাওয়া গেলে তা নেহাতই কাকতালীয় হিসাবেই গণ্য হবে। )

Malay Chatterjee

 

 


 

অনুসন্ধান পর্ব - শ্যামাপ্রসাদ সরকার


অনুসন্ধান পর্ব

শ্যামাপ্রসাদ সরকার 


    কুমার শিলাদিত্য যখন দুইজন অমাত্য  লইয়া অরণ্যভূমির প্রান্তে আসিয়া পৌছাইলেন তখন সূর্য অস্তগামী প্রায়। এই অঞ্চলটি  স্থানেশ্বর হইতে প্রায়  সহস‍্র ক্রোশ দক্ষিণে এবং শ্বাপদসঙ্কুল বলিয়া দুর্নাম  আছে। যদিও সঙ্গের অমাত্য  দুইজন অতি বিশ্বস্ত, তবুও এই অসময়ে,  নিবিড়় অরণ্যপ্রান্তে কিছু দুশ্চিন্তার অবকাশ থাকিয়াই যায়। সামনে কুলুকুলু শব্দে বহিয়া চলেছে রঙ্গিলা নামের একটি স্থানীয় পূর্ববাহিনী নদী। এটি শেষ পর্যন্ত শোণ নদীতে গিয়া মিশিয়াছে। । ক্রমাগত দুইশত ক্রোশ পথ অশ্বচালনার পর  অধিক পথশ্রমে ও ক্ষুধায় তাঁরা কাতর হইয়া  সূর্যাস্তের পর থামিয়াছেন।

    বহুকাল পূর্বে সম্রাট অশোক একটি সুবিশাল রাজপথ রচনা করিয়াছিলেন। তাহার অধিকাংশই  আর্যাবর্তের বিভিন্ন নগরীর মধ‍‍্যে দিয়া প্রবাহিত হইলেও দীর্ঘদিন  এই অংশে লোকচলাচলের অভাব হেতু  তাহা অরণ‍্যের গ্রাসে পড়িয়া  লুক্কায়িত হইয়া গেছে। অরণ‍্যটির মাটীকে বর্তমানে সূর্যালোক  স্পর্শ করে না। 

    এই অরণ‍্যভূমিটি  বিপদসংকুল বলিয়া রাত্রিযাপনের জন‍্য তাঁহারা একটি নিরাপদ আশ্রয় খুঁজিতেছিলেন। সহসা শুষ্ক পত্রের উপর দিয়া একটি প্রাণীর ধীর পদচারণার শব্দ শ্রুত হইল। কুমার তরবারিটি কোষমুক্ত করিলেন। তাঁহার অঙ্গরক্ষকদ্বয়  বসুদত্ত ও  শান্তশীল  একটি করে বাণ ধনুকে যোজনা করিয়া এদিকওদিক ঘুরিয়া দেখিতে লাগিল।  ঘনসন্নিবিষ্ট বনচ্ছায়াটিতে  কোনও হিংস্র প্রাণীর গমনাগমনের শব্দ বলিয়াই বোধ হইতেছে।

    কিছুক্ষণ পর শব্দের উৎসটি ক্রমে নিকটে আসিল। আশ্চর্যের বিষয় এই যে জনহীন বনাঞ্চলে বন‍্যপশুর পরিবর্তে  চীরবস্ত্র পরিহিত এক বৌদ্ধ শ্রমণ ক্রমে গোচর হইলেন। শিলাদিত‍্য তাহা দেখিয়া তরবারি কোষবদ্ধ করিয়া ধীর পায়ে আগন্তুকের  দিকে করজোড়ে অগ্রসর হইলেন। বৃদ্ধ এই  শ্রমণের নাম ভদন্ত কারুণিক। সম্প্রতি বিক্রমশীলা মহাবিহার হইতে পূর্বদেশে আসিয়াছেন। গৌড়দেশে এখন ভয়ানক মাৎস‍্যন‍্যায় চলিতেছে। গৌড়েশ্বর  শশাঙ্ক ভয়ানক বৌদ্ধ বিরোধী হইয়া উঠিয়াছেন। তাই একের পর এক সঙ্ঘারামকে ধ্বংস করিয়া ধূলায় পরিণত করিতেছেন। ভদন্ত ও তাঁহার সঙ্গে আগত কিছু ভিক্ষু শিষ‍্য মিলিতভাবে  অতি গোপনে বৌদ্ধশাস্ত্রগুলির মধ‍্যে প্রধান  বোধিসত্ত্বাবদান ও মূলকল্পাবদানের দুটি প্রাচীন পুস্তিকাকে কোনওমতে রক্ষা করিতে সক্ষম হইয়াছেন। এই  অরণ‍্যে পূর্বের সঙ্ঘাধ‍্যক্ষ দেবভূতির একটি ভগ্নপ্রায় বিহার এখনো টিকিয়া আছে। তাঁহারা গোপনে সেই বিহারেই অবস্থান করিতেছেন।
কুমারের পরিচয় পাইয়া ভদন্ত সঙ্ঘারামেই  তাঁহাদের রাত্রিযাপনের জন‍্য  অনুরোধ করিলেন। বলিলেন - " ভগবন্ বুদ্ধ  যেস্থানে অবস্থান করিতেছেন সেই স্থানে ব‍্যাঘ্রাদি পশুও সাধারণতঃ  মিত্রবৎ অহিংস আচরণই করিয়া থাকে!"


    শিলাদিত‍্য মনে মনে উৎফুল্ল হইয়া ভাবিলেন ভগ্নপ্রায় হইলেও বিহারটিতে এখনো যখন মনুষ‍্য বসবাস  করিয়া থাকে তখন সেই স্থলে সঙ্গীসহ রাত্রিযাপনের অপেক্ষা উৎকৃষ্ট ব‍্যবস্থা আর কিই বা হইতে পারে। অঙ্গরক্ষকদ্বয়কে তাঁহাদের  ঘোড়াগুলিকে লইয়া কুমার  তখন শ্রমণের অনুবর্তী হইলেন।

    বর্তমানে মালবরাজ দেবগুপ্ত ও গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক রাজনৈতিক মিত্রতায় আবদ্ধ। একদিকে গৌড়ের রাজধানী  কর্ণসূবর্ণ হইতে শশাঙ্ক যুদ্ধ জয়ের  নিশান উড্ডীন করিয়া উত্তরপথস্বামী হইবার উদ্দেশ‍্যে বাহির হইয়াছেন। অপরদিকে হুণ জাতীয় বর্বর দস‍্যুর দল দেশের পশ্চিম সীমান্ত হইতে পুনরায় আক্রমণ করিয়া দেশের শান্তি ভঙ্গ করিয়া এক ভয়ংকর অরাজকতার জন্ম দিয়াছে। স্থানেশ্বরের নরপতি মহামহিম রাজ‍্যবর্ধন বেশ কয়েকবার তাহাদের প্রতিহত করিলেও সম্প্রতি এক অন‍্যায় যুদ্ধে নিহত হইয়াছেন। কুমার শিলাদিত‍্য তাঁহারই কনিষ্ঠ ভ্রাতা। তাঁহার অপর নাম হর্ষবর্ধন। তাহাদের একটি ভগিনীও আছে। সে তাহার ভ্রাতাদের বড় প্রিয়। হর্ষ তাহাকে রাজ‍্যশ্রী বলিয়া ডাকিয়া থাকে। বৎসরকাল পূর্বে মৌখরীরাজ গ্রহবর্মার সহিত সাড়ম্বরে রাজ‍্যশ্রীর বিবাহ হইয়াছিল। কিন্তু হুণদের সহিত যুদ্ধে রাজ‍্যবর্ধনের সহিত সেও নিহত হইয়াছে। শোনা যায়  মালবরাজ রাজ‍্যশ্রীকে বন্দি করিয়া বলপূর্বক কারাগারে নিক্ষেপ করিবার সময় এক চতুর পরিকারিণীর সাহায‍্যে সে একাকী পলায়ন করিয়াছে। 
তাহার পর হইতে রাজ‍্যশ্রীর কোনও সংবাদ পাওয়া যায় নাই।

    হর্ষ ছদ্মবেশে ভগিনীর সন্ধানে বহু স্থান ঘুরিয়া শেষে বিন্ধ‍্যাচলের এই অরণ‍্যে আসিয়া উপনীত হইয়াছেন।  পথিমধ‍্যে তাহাদের সহিত এক নিষাদের  সাক্ষাৎ হইয়াছিল। সপ্তাহপূর্বে এক ভদ্রবেশী সুন্দরী  রাজকন‍্যাকে সে এই পথে ভীতা ও উদভ্রান্তের ন‍্যায় ছুটিয়া যাইতে দেখিয়াছিল। তাহা শুনিয়া  হর্ষের অনুমান হইয়াছে যে  ওই পলায়নকারিণীই আসলে রাজ‍্যশ্রী।

    ভদন্ত কারুণিক ও তাঁহার সঙ্গীগণ এই ঘন বনাঞ্চলেও গোধূম চূর্ণ ও ঘৃত ব‍্যবহার করিয়া একপ্রকার গোলাকৃতি খাদ‍্যবস্তু কুমার ও তাঁহার সঙ্গীদের জন‍্য পরিবেশন করিলেন আর  পানীয় হিসাবে তাহার  সহিত একটু ঘন ছাগদুগ্ধ। শশাঙ্কের অত‍্যাচারে মাসাধিককাল তাঁহারা অতি স্বল্পাহারে তাঁহাদের  রসদটি বাঁচাইয়া রাখিয়াছেন। এর অধিক সঙ্ঘারামটিতে  রাত্রিকালে অপর  কোনও খাদ‍্যবস্তুর আয়োজন করা বর্তমানে সম্ভবপর নহে। 

    কুমার শিলাদিত‍্য তাঁহাদের আতিথেয়তায়  কৃতজ্ঞতা জানাইয়া অবশেষে  রাজ‍্যশ্রীর প্রসঙ্গটি উত্থাপন করিলেন। ভদন্ত শ্রমণ বৃদ্ধ হইয়াছেন  ও সদাই তদ্ভাবে থাকেন। এরূপ কোনও রমণীকে তিনি এ অরণ‍্যে প্রবিষ্ট হতে অথবা নিষ্ক্রান্ত হইতে দেখেন নি। কিন্তু একজন ভিক্ষু, তাহার  নাম সম্বুদ্ধ সে কহিল যে এক সুন্দরী রমণীকে গতকল‍্যই সে অরণ‍্যের ভিতর কাষ্ঠ আহরণের সময় দেখিয়াছিল বটে। বনের পথে এইরূপ সুকন‍্যাটিকে দেখিবামাত্র সে আশ্চর্য হইয়াছিল। ভিক্ষু অভয়বাক‍্যের সহিত  তাহাকে ডাকিলেও রমণীটি তাহার কোনও উত্তর না দিয়াই ছুটিয়া অন‍্যত্র চলিয়া যায়। 

    কুমার তাহা শুনিয়া আশাহত হইয়া  বিমর্ষ চিত্তে আহার করিতে লাগিলেন। বসুদত্ত তাঁহাকে নিশ্চিন্ত করিবার জন‍্য বলিল কাল প্রাতেই অরণ‍্যের প্রতিটি কোণ তাহারা সকলে মিলিয়া খুঁজিয়া দেখিবে। রাজ‍্যশ্রীকে উদ্ধার না করিয়া তাহারা স্বভূমিতে ফিরিবে না। 

***********
    ভগ্নপ্রায় সঙ্ঘারামটির তোরণদ্বারে ভগবন্ বোধিসত্ত্বের একটি বিশালাকার একটি শায়িত মূর্তি রক্ষিত আছে। কুমার সেই মূর্তিটিকে দীপ হস্তে তিনবার প্রদক্ষিণ করিয়া তাঁহার  প্রার্থনা জানাইলেন। কনিষ্ঠা ভগিনীর কোনও অনিষ্ট হইলে তিনি নিজেকেও ক্ষমা করিতে পারিবেন না। কুমার  নিজেও একজন বৌদ্ধধর্মানুরাগী। স্থানেশ্বরের প্রাসাদে বৌদ্ধ শাস্ত্র মঞ্জুশ্রীমূলকল্পের একটি হস্ত লিখিত প্রাচীন পুস্তিকা তাঁহার সংগ্রহে আছে। সম্প্রতি মহাচীন থেকে এক পরিব্রাজক বুদ্ধের জন্মভূমি দেখিতে আসিয়াছেন। তাহার নাম ' য়ুয়াং ছাং'। কুমারের অতিথিশালায় তিনি কয়েকমাস অতিবাহিত করিয়া বুদ্ধভূমির বিবরণ লিখিতেছেন। তিনি ভাবিলেন রাজ‍্যশ্রীর সন্ধান পাইবার পর  ভদন্ত কারুণিক ও তাঁহার সঙ্গীসাথীদের স্বভূমিতে লইয়া যাইবেন। ভগবন্ তথাগতের প্রেম ও মৈত্রীর পরম বাণীর প্রচারক হইয়া  ও তাঁহার  রক্ষকদের পৃষ্ঠপোষকতা করিতে পারিলে তিনি নিজেও ধন‍্য বোধ করিবেন।

    পরদিন সূর্যোদয়ের পর বেশ বেলা করিয়া কুমারের নিদ্রাভঙ্গ হইল। পক্ষকালের পথশ্রম ও মানসিক অবসন্নতা তাঁকে ক্লান্ত করিয়া দিয়াছে। এমন সময় ভিক্ষু সম্বুদ্ধ আসিয়া সংবাদ দিল যে অরণ‍্যের পূর্বদিকে এক রমণী চিতা সাজাইয়া অগ্নি প্রস্তুতি করিতেছে। সকলের শীঘ্রই সেইস্থলে এই মুহূর্তে গমন করিবার  প্রয়োজন।  আর দ্বিরুক্তি না করিয়া কুমার  শিলাদিত্য বসুদত্ত ও শান্তশীলের সহিত ভিক্ষু সম্বুদ্ধকে সঙ্গে করিয়া অশ্বপৃষ্ঠে দ্রুত অরণ‍্যভূমির পূর্বপ্রান্তের উদ্দেশ‍্যে  নিষ্ক্রান্ত হইলেন।

    স্বামীর মৃত‍্যুর পর রাজ‍্যশ্রী অত‍্যন্ত অসহায় বোধ করিতেছিল। জ‍্যেষ্ঠভ্রাতা ও পতির যুগপৎ নিধন তাহাকে জীবনের প্রতি বীতরাগ করিয়া তুলিয়াছে। সে স্থির করিয়াছে প্রায়োপবেশনের পথে প্রাণ ত‍্যাগ করিবে। রাজ‍্যশ্রী যৌবনবতী। মালবের কারাগারে তাহার কোনও অনিষ্ট না হইলেও অরণ‍্যে দস‍্যু আর তস্করের অভাব নাই। তাহাদের হাতে ভ্রষ্টা হইবার চেয়ে মৃত‍্যুই শ্রেয়। তাই সে  অরণ‍্য হইতে  কাষ্ঠ ও শুষ্ক পত্রাদি সংগ্রহ করিয়া চকমকি প্রস্তরখন্ড দিয়া সবেমাত্র অগ্নি জ্বালাইতে যাইবে এমন সময় সে অশ্বক্ষুরধ্বনির সাথে কুমারের কন্ঠস্বর শুনিয়া সহসা চমকিয়া উঠিল। তাহার হস্তধৃত প্রস্তরখন্ডদুটি মাটিতে পড়িয়া গেল। কুমার অশ্বপৃষ্ঠ হইতে নামিয়া দ্রুতবেগে ভগিনীর নিকট ছুটিয়া যাইলেন। কিছুক্ষণ অপলকে দুইজনে একে অপরকে দেখিতে লাগিলেন। তাঁহাদের দুইচক্ষু দিয়া অশ্রুর বন‍্যা বহিতে লাগিল। রাজ‍্যশ্রী হর্ষকে দেখিয়া আশ্চর্য হইল। সানন্দে ভ্রাতা ও ভগিনীর এই  মিলনদৃশ‍্য দেখিয়া বসুমিত্র ও শান্তশীল নেপ‍থ‍্যে জয়স্তুতি দিয়া উঠিল।

    স্থানেশ্বরের প্রজারা দীর্ঘদিন অভিবাবকহীন হইয়া থাকায় তাহারা কুমার শিলাদিত‍্যকে সিংহাসনে আসীন হইতে দেখিতে চাইল। কিন্তু হর্ষ এখনো ভ্রাতৃশোক ভুলিতে পারেন নাই। রাজ‍্যশ্রীকে যদিবা ফিরিয়া পাইলেন তবুও সে কৃচ্ছসাধনে জীবন অতিবাহিত করিতেছে। সে গৈরিক চীরবস্ত্র পরিধান করে ভিক্ষুণীর ন‍্যায় তথাগতের স্মরণাগতা। বর্তমানে সে স্বহস্তে ছাগচর্মের উপর  শতসহস্রিকাপ্রজ্ঞাপারমিতার একটি অতিপ্রাচীন ও প্রায়বিলুপ্ত পুস্তিকার  নকল করিতেছে ও তাহার টীকাভাষ‍্য লিখিতেছে। ভদন্ত কারুণিক ও ভিক্ষু সম্বুদ্ধ  কুমার হর্ষের নিকটে আজকাল সুরক্ষিত হইয়া  স্থানেশ্বরেই অবস্থান করিতেছেন।
 গৌড়েশ শশাঙ্ক গুপ্তঘাতকের হাতে সদ‍্য নিহত হইয়াছেন। এই মুহূর্তে দেশের বাতাবরণ কিঞ্চিৎ স্বাভাবিক হইয়া উঠিতেছে। রাজ‍্যশ্রীও  প্রত‍্যহ চৈনিক পরিব্রাজক ' য়ুয়াং ছাং' এর সহিত তাঁহাদের বৌদ্ধশাস্ত্রালোচনায় অংশ গ্রহণ করিতেছেন। ভদন্ত কারুণিকের সহায়তায় 
'য়ুয়াং ছাং' চীনাভাষায় একটি বুদ্ধভূমির  বিবরণী লিখিতেছেন।  তিনি অঙ্গীকার করিয়াছেন যে সেই বিবরণীতে তাঁহার দৃষ্ট সকল অভিজ্ঞতার ঘটনাই বিবৃত থাকিবে। 
একদা 'য়ুয়াং ছাং' রাজগৃহে একদল দস‍্যূর হস্তে ধৃত হইয়াছিলেন। তাহারা তাঁকে নরবলি দিবার জন‍্য যূপকাষ্ঠেও আরোহণ করিয়াছিল। হঠাৎ একজন দস‍্যু দেখিতে পায় যে  তাঁহার বাম  হস্তের কনিষ্ঠা অঙ্গুলিটির উপরিভাগটি খন্ডিত। উৎসর্গীকৃত বলিটির খুঁত থাকিলে তাহা দেবকার্যে গৃহীত হয়না। তাহারা তখন পরিব্রাজকের পেটিকা হইতে স্বর্ণ ও রৌপ‍্যমুদ্রাগুলি কাড়িয়া লইয়া তাঁহাকে শেষঅবধি নিষ্কৃতি প্রদান করে। 
আজ সন্ধ‍্যায় তাহাই বিস্ফারিত মুখে উপবিষ্ট শ্রোতৃমন্ডলকে তিনি সেই কাহিনী শুনাইতেছিলেন। 
হর্ষ শুনিয়া গম্ভীর স্বরে বলিলেন -  
" এই অরাজকতার হেতু আসলে দারিদ্র। গৌড় ও মগধের ইন্দ্রিয়প্রবণ রাজন‍্যগণ প্রজাদিগকে বিবিধ করভারে জর্জরিত করিয়া রাখিয়াছে। তাই অন্ত‍্যজ শ্রেণীর মানুষগুলির কেহ দস‍্যূতা বা অন‍্য কুপ্রবৃত্তির বলে জীবনধারণ করিতে বাধ‍্য হয়। ইহার আশু প্রতিকার  করিতে হলে সমগ্র আর্যাবর্তকে পুনরায় একটি চন্দ্রাতপের নীচে আনিয়া  সুশাসনের প্রচলন ভিন্ন আর উপায় নাই।" 

    দীর্ঘসময় অতিক্রান্ত হইবার পর আজ মহামহিম রাজাধিরাজ শ্রী হর্ষবর্ধন শিলাদিত‍্য সমগ্র আর্যাবর্ত অধিকার করিয়া মাতৃভূমিতে প্রত‍্যাবর্তন করিয়াছেন। অমাত‍্য নাগানন্দ তাঁহাকে 'সকলোত্তপথনাথ' বলিয়া সর্বসমক্ষে ঘোষণা করিয়া জনমানসে তাঁহার  বীরগাথা প্রচার করিতে উদ‍্যত। হর্ষ স্বয়ং আজ বড় প্রসন্ন। বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর অবশেষে ভ্রাতৃহত‍্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করিয়া তিনি সিংহাসনে আরোহণের পরই বৌদ্ধধর্মের পুনর্জাগরণ করিবেন বলিয়া মনস্থির করিয়াছেন। সম্প্রতি নালন্দা মহাবিহারের উন্নতিকল্পে তিনি একলক্ষ স্বর্ণমুদ্রা সহ ভদন্ত কারুণিককে সেখানে প্রেরণ করিয়াছেন। এইবার  নালন্দাকে জ্ঞান ও সাধনার সর্বশ্রেষ্ঠ কেন্দ্র হিসাবে তিনি গড়িয়া তুলিবেন। তাঁহার ভগিনী রাজ‍্যশ্রীও এই কর্মযজ্ঞে যোগদান করিতে ইচ্ছুক। তাহার অবশিষ্ট জীবন সে তথাগতের চরণে সমর্পণ করিয়াছে। 

    হর্ষ প্রয়াগের ত্রিবেণী সঙ্গমে এক মহাদানেসম্মেলনের  আয়োজন করিলেন। এই স্থলটি অতি প্রাচীন ও মাহাত্ম‍্যপূর্ণ। অবলোকিতেশ্বরের প্রকান্ড মূর্তিটির সামনে আজ তিনি নতজানু হইয়া বসিয়াছেন। তাঁহার কোনরূপ ভেদবুদ্ধি নাই। চতুবর্ণের কেহই অপাঙক্তেয় নন এমনকি বহু জৈন ও নাথযোগী সন্ন‍্যাসীগণও তাঁর নিকট হইতে স্বর্ণ, বস্ত্র ও তন্ডুল লাভ করিতেছে। প্রসন্ন বদনে হর্ষ ও রাজ‍্যশ্রী দানসামগ্রী লইয়া প্রতীক্ষারত। প্রাগজ‍্যোতিষরাজ ভাস্করবর্মার সহিত হর্ষবর্ধন  মিত্রতা স্থাপনের পর তাঁহাদের  সৈন‍্যজোট বৃদ্ধি পাইয়াছে।  বন্ধুত্বের প্রীতি স্বরূপ একশত রণনিপুণ রাজহস্তী ও স্বর্ণাদি তিনি মিত্রবরকেও উপহার হিসাবে  প‍্রেরণ করিয়াছেন। পক্ষকালের অনুষ্ঠান এখন সমাপ্তির পথে। দানকর্ম সমাধা হলে এইবার রাজাধিরাজ শ্রী হর্ষবর্ধন শিলাদিত‍্য একটি বৌদ্ধ ধর্মমহাসম্মেলন আয়োজন করিবেন।ভাস্করবর্মাকে তখন নিমন্ত্রণ করিতে হইবে। আগামী দিনে ভগবন্ বুদ্ধের ঐশী মাহাত্ম‍্যকে প্রচার করিতে হর্ষ আগ্রহী। এক্ষেত্রে পূর্বজ সম্রাট প্রিয়দর্শী তাঁহার আদর্শস্বরূপ। 

    দানমঞ্চ হইতে দান সমাপন করিয়া নামিয়া আসিবার সময় হঠাৎ  এক গলিতদেহ কুষ্ঠরোগী তাঁর সম্মুখে আসিয়া ভিক্ষা যাচনা করিল। এক্ষণে সকল সামগ্রী অপ্রতুল হইয়া যাওয়ায় তিনি স্বয়ং লজ্জিত হইয়া পড়িলেন। পরক্ষণে কি ভাবিয়া  ভগিনীর নিকট হইতে একটি চীবর চাহিয়া লইয়া পরিধান করিয়া তাঁহার বহুমূল‍্যবান রত্নখচিত রাজপোষাকটি তাকে দান করিয়া দিলেন। তাহা দেখিয়া সমবেত জনতা ধন‍্য ধন‍্য করিয়া উঠিল। 

    প্রত‍্যাবর্তনের সময় হর্ষ রথে আরোহণ করিতে যাইবেন  সময়  দূর হইতে একজন পরিচিত মানুষ দৃষ্ট হইল। ইনি হর্ষের অন‍্যতম মিত্র বাণভট্ট। হর্ষ বাণকে  দেখিতে পাইয়া অত‍্যন্ত প্রীত হইলেন। বাণভট্ট কহিল সে  হর্ষবর্ধনের সকল কীর্তির কথা অবগত।একটি বিশেষ কার্যে কয়দিন ব‍্যস্ত থাকায় দানসম্মেলনে সে আসিতে পারে নাই।  দুই মিত্র পরস্পরকে আলিঙ্গন করিলেন। হর্ষবর্ধনের জন‍্য সে একটি উপহার আনিয়াছিল। বহুযত্নে মলমলের বস্ত্রে আচ্ছাদিত করিয়া তাহা বুকে করিয়া সে এতকাল রক্ষা করিয়াছে। আজ বিজয়ী ও দানবীর বন্ধুবরকে স্বহস্তে তাহা উপহার প্রদান করিয়া  সে যুগপৎ আনন্দিত ও উত্তেজিত। পেটিকাটি খুলিয়া রাজাধিরাজ শ্রী হর্ষবর্ধন শিলাদিত‍্য সেই পরম উপহারটি দেখিয়া অত‍্যন্ত আশ্চর্য হইলেন।  বাণভট্ট 'হর্ষচরিত' নামে একখানি সংস্কৃতে কাব‍্যরচনা করিয়া আনিয়াছে। আজ উপযুক্ত দিবসে তাহা হস্তান্তর করিয়া সে তাহাদের মিত্রতাকে সম্মানীত করিল।

    রপর প্রয়াগের তটরেখা ধরিয়া হর্ষবর্ধনের রথের ঘর্ঘর শব্দ ক্রমশ দূর হতে দূরে মিলিয়া যাইতে যাইতে একসময়  মহাকালের চরণধ্বনির সাথে লয় হইয়া গেল। 

    রক্তমাংসের মানুষ তাহার নশ্বর দেহ ত‍্যাগ করিয়া একদা চলিয়া যায় ঠিকই কিন্তু কীর্তিমানের কীর্তি কালের মন্দিরায় সর্বদাই অনন্তকাল ধরিয়া বাজিতেই থাকে ।

সমাপ্ত


SHYAMAPRASAD SARKAR 



দাস্তান-এ-গুল - দীপান্বিতা দে রায়




দাস্তান-এ-গুল

দীপান্বিতা দে রায়

 

    আরাকান রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম বরাবর ঘন জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ের কোলে ছোট একটা দুর্গ। দুর্গের শেষ প্রান্তের একটি মাত্র ঘরে মাটির প্রদীপ জ্বলছে টিমটিম করে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে অন্ধকার নেমে এসেছে। এই ঘরটি রাণীমার জন্য বরাদ্দ। দুর্গের বাকি ঘরগুলোতে কোনো আলোর সংকেত নেই। সেগুলিতে আত্মগোপন করে আছেন কয়েকজন, একমাত্র রাজা ছাড়া তাদের পরিচয় কারো কাছেই নেই। সেই দুর্গেরই এক ঘরে অস্থির ভাবে পায়চারি করছেন এক শাহ়্জাদা। একে একে প্রিয় মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে যার।

    এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করলো এক নারী মূর্তি। মাথায় তার রেশমি কাপড় ঢাকা। 

..."তুমি এসেছো গুলরোখ? সব শেষ হয়ে যাচ্ছে, আর কোনো উপায় নেই, আমার এই হাতে একমাত্র পুত্রের রক্তের দাগ দেখতে পাচ্ছো গুল। তাকে হারিয়েছি আমি, সে আজ মৃত, আমার নিয়তি আসছে আমাদের মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে, নিস্তার নেই গুল..."

...."মৃত্যুর মুখে একদিন আমিও ছিলাম শাহ়্জাদা, আপনি আমাকে মুক্তি দিয়েছিলেন সেই জাহান্নাম থেকে, আমার রূহ আপনার গোলাম। আপনাকে ছুঁতে পারবে না ওই কাফের মগ রাজা। আপনি অনুমতি দিন।" 

    শাহজাদার ঘরে কিছুক্ষন থেকে বেরিয়ে এলেন গুলরোখ।

    সময়টা ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি। মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আগ্রাসী থাবা বিস্তারিত হয়েছে ভারতবর্ষের সর্বত্র। শাহ সুজা ব্যতিরেকে সব ভাইকে হত্যা করে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাইদের নিকট থেকে আওরঙ্গজেব সিংহাসন প্রায় নিষ্কণ্টক। কিন্তু নিষ্কৃতি নাই শাহজাদা সুজাকে না সরানো পর্যন্ত। আওরঙ্গজেবের নিকট হতে প্রাণ রক্ষা করতে উপায় একটাই, ভারতবর্ষ ত্যাগ। আগে ভারতবর্ষ ত্যাগ, তাঁর পর সমুদ্র পথে পশ্চিমে মক্কা হয়ে পারস্য বা তুরষ্কে। স্ত্রী, তিন কন্যা এবং এক পুত্র সহ নিরুপায় সুজা আশ্রয় ও সহায়তার জন্য যোগাযোগ করেন আরাকান রাজের সাথে। 

    খাজোয়ার যুদ্ধে আওরঙ্গজেবের বাহিনীর কাছে পরাজিত সুবেদার শাহ সুজা ১ এপ্রিল ১৬৫৯ সালে রাজমহল ত্যাগ করে তাণ্ডায় আশ্রয় নেন। ৬ এপ্রিল ১৬৬০-এ তিনি প্রথমে জাহাঙ্গীরনগর (ঢাকা) এবং পরে সেখান থেকে আরাকান যাত্রা করেন। 

    আরকান রাজ আশ্বস্ত করেন সহায়তার। আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীরজুমলা পিছু ধাওয়া করলে শাহ সুজা তার অনুগত কিছু সেনাপতি এবং তাদের অধীনে বিপুল সংখ্যক মোঘলযোদ্ধাদের নিয়ে চট্টগ্রাম হয়ে নাফ নদীর তীরে পৌঁছান। কিন্তু আরকান রাজার শর্ত অনুযায়ী সকল যোদ্ধাদের সেখানেই বিদায় জানিয়ে মাত্র কিছু দেহরক্ষী নিয়ে নাফ নদী পার করে আরাকানের রাজধানী ম্রোহং-এ উপস্থিত হন শাহ সুজা। 

    উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় আরকানের রাজসৈন্যরা। রাজা ‘চন্দ্রসুধর্ম্ম’ প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন শাহ সুজার মক্কা গমনে সহায়তায়। 

    সন্মুখে আরাকান বাহিনী এবং পেছনে মীর জুমলার বাহিনীর ভয় থাকায় মোগল সেনারা অপেক্ষাকৃত দুর্গম অঞ্চলে গিয়ে তাদের প্রথম দুর্গ প্রতিষ্ঠা করেন ‘আলীকদম’। কিন্তু সেখানে নিরাপদ রূপে থাকা দীর্ঘদিন সম্ভব নয় জানতেন শাহাজাদা।

    এদিকে নানা ছুতোয় ক্রমে পিছিয়ে যাচ্ছিলো মক্কা যাত্রার জাহাজের বন্দোবস্ত। ধৈর্য্য চ্যুতি ঘটছিল শাহাজাদার, যেন নিজ দুর্গেই বন্দী শাহাজাদা নিরুপায় হয়ে দিন গুনছিলেন নিজের মৃত্যুর। ইতিমধ্যে আরাকান রাজের চক্রান্তে হারিয়েছেন নিজের জ্যেষ্ঠপুত্রকেও।

    পিয়ারী বানো বেগম ছিলেন শাহ সুজার দ্বিতীয় স্ত্রী। শাহজাহানের আমলে বাংলার দ্বিতীয় সুবেদার আজম খানের কন্যা ছিলেন পিয়ারী বানো। তিনি ছিলেন সার্থকনামা। পরমা সুন্দরী ও বিদুষী এই মহিলা তাঁর বুদ্ধির দীপ্তিতে তৎকালীন বঙ্গীয় উচ্চকোটির সামাজিক মহলে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। শেষ সময়ে উনি ছিলেন শাহজাদার পাশে। 

    কিন্তু এই গল্প নেহাতই ইতিহাসের বিবরণ নয়, এই গল্প এক নারীর। এই গল্প এক সাধারণের রাজ পরিবারের প্রতি আনুগত্যের। ইতিহাস এই গল্পে পথ হারালে তার সম্পূর্ণ দায় তার গল্পকারের, দাস্তান-এ-গুল এক অসম্পূর্ণ প্রেমের গল্প, এক কুহেলিকার গল্প।

--------------------------------------------------------------- 

    শীত এখনো আসেনি, তবে কুয়াশা ঢাকা – শিশির ভেজা  রাতে শীতের পদধ্বনি শোনা যায়।

    শেষ রাতে যখন পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে তন্দ্রা, ঠিক তখনই উন্মুক্ত হলো দুর্গের অন্তঃপুরের দরজা। এক নারী মূর্তি একলা পথে পেরিয়ে এলেন দুর্গের। অজানা কারণে দ্বাররক্ষক কেউ নেই পাহারায়। দুর্গের গায়ে টিমটিম করে জ্বলা আগুন মশালগুলোও নিভে আসছে। এ কোন ঘোর অন্ধকারের ইঙ্গিত? নারী মুর্তিটি এক মুহুর্তের জন্য থামলেন। তারপর আবার অগ্রসর হলেন সামনের দিকে, পেছনে পরে রইলো পাহাড়ের আড়ালে থাকা আলীকদম দূর্গ।

    তমাশাচ্ছন্ন রাতের কালো মেঘে ঢাকা পরেছিল এক ইতিহাস, আজ সেই গল্পই শোনাবো আপনাদের। এক বিশ্বাসঘাতকের গল্প, আর একজন নিজের শেষটুকু দিয়ে সেই বিশ্বাসের মর্যাদা দেওয়ার এক গল্প।

    পর্বতের উত্তর দিকে আছে একটা জঙ্গল, সেখানে মানুষের আনাগোনা প্রায় নেই বললেই চলে, কিছু আদিবাসী আসে শিকারের লোভে, তবে হিংস্র পশুদের আস্তানা এই জঙ্গল। নারী মুর্তিটি জঙ্গলের প্রবেশপথের সামনে এসে দাঁড়ালেন, একা। কিছুটা সময় পরে সেই জঙ্গলের পথে এলেন এক সুপুরুষ যুবক। ঠিক যেন পাথর কেটে এই কিন্নরের জন্ম হয়েছে। চওড়া কাঁধ, পিঠের পেশি শক্ত হয়ে নেমে এসেছে কোমরের উপত্যকায়। আবলুশ কাঠের মতো গায়ের রঙ তার, একমাথা ঝাঁকড়া চুলের গোছা, মাথায় চুড়ো করে বেঁধে রাখে। হাত জোর করে দাঁড়িয়ে আছে পুরুষটি, হয়তো অন্য কারো অধীনস্থ তার স্বত্তা। তাই মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে আছে। নারী মুর্তি তাকে অনুসরণ করলো, প্রবেশ করলো জঙ্গলে, সেখানে একটা শিবিরের মাঝে একটাই মশালের আলো জ্বলছে। খুব কম তার আলো। তবু সেই আলোতেও বোঝা যায় সেই শিবিরে কেউ প্রতিক্ষায় প্রহর গুনছে। নারী মুর্তি প্রবেশ করলেন শিবিরে। পুরুষটি বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। অটল প্রহরী হয়ে। 

    নারী মুর্তি খুলে ফেললেন তার মাথায় দেওয়া রেশমি কাপড়। নিস্তেজ হয়ে আসা আলোতেও নারী মুর্তিকে চিনতে অসুবিধা হলো না। এই সেই গুলরোখ। কিন্তু রূপের ছটায় হার মানে হুর পরীরাও। শাহাজাদার সাথে এই বাঁদী কে প্রথম যেদিন দেখেছিলেন আরকান রাজ চন্দ্রসুধর্ম, সেদিনই মত্ত হয়েছিলেন এর প্রেমে। পেতে চেয়েছিলেন নিজের করে। কিন্তু মগ রাজার প্রস্তাবে ক্রুদ্ধ হন শাহ়্জাদা। মনের মধ্যে প্রেমের আগুনটা জ্বালিয়েছিল যে নারী আজ সে নিজেই দাবী করে সাক্ষাতের। উপেক্ষা কর‍তে পারেনি রাজা, তাই গোপনে জঙ্গলে এই মিলনের ব্যবস্থা করেন উনি। 

    হটাৎ কালো আকাশ ভেঙে বাজ পরলো কান ফাটানো শব্দে।
    মুহুর্তের জন্য অসাবধান হলেন গুলরোখ। তার গায়ের পাতলা দুধ সাদাটে রঙের ওড়না ভেদ করে উপত্যকার গভীরে হারিয়ে গেলো রাজা চন্দ্রসুধর্মের চোখ। 

     চারিদিক অন্ধকারের মাঝে এক শুভ্র আলো আচ্ছন্ন করেছে শিবিরকে। ধীর পায়ে কাছে এগিয়ে এলেন রাজা। পুরুষালি গন্ধ অনুভব করলো গুলরোখ। দুচোখ বন্ধ হয়ে এলো আবেশে। আসতে আসতে বন্দী হলো গুলরোখের শরীর, রাজা চন্দ্রসুধর্ম্মের বাহুপাশে।

    এদিকে বাইরে উত্তাল হচ্ছে ধরণি, আজই যেন শেষদিন তার। বহু অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে প্রেমিকের উত্তাল ভালোবাসায় চমকে চমকে উঠছে। শুষ্ক রুক্ষ ধরণি সিক্ত হচ্ছে।

"দহনশয়নে তপ্ত ধরণী পড়েছিল পিপাসার্তা,
পাঠালে তাহারে ইন্দ্রলোকের অমৃতবারির বার্তা।
মাটির কঠিন বাধা হল ক্ষীণ,
দিকে দিকে হল দীর্ণ–"

    তিরতির করে কাঁপছিলো গুলরোখ। রাজা আশ্রয় দিলো তাকে। এই নারী ছিল রাজার কল্পনারও অতীত। আজ বহ্নি পতঙ্গের ন্যায় ধরা দিয়েছে সে নিজেই। গুলরোখের গোলাপি ঠোঁটের উৎসে এসে রাজা থমকে গেলেন। চন্দন সুরভীত দেহ পল্লব তার। গোলাপের মতো কোমল তার ত্বক। গুলরোখের পেলব পীঠ বেয়ে নেমে এলো রাজার হাত, আরো গভীরে। নাভিমূলের গ্রন্থিতে এসে আটকে গেলো সে। ততক্ষণে গুলরোখের কেশ সজ্জা বিন্যস্ত করেছে রাজা চন্দ্রসুধর্ম। এক এক করে শরীরের সব আবরণ উন্মুক্ত করেছে তার। সম্পুর্ণ নিরস্ত্র, নির্বস্ত্র গুলরোখ। যদিও শিবিরের পাশেই লুকিয়ে আছে রাজার সেনা, প্রহরায় তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত দাস, তবুও সাবধান হতে চান রাজা। গুলরোখের মেঘের মতো চুলের রাশি নেশা সৃষ্টি করছে। আচ্ছন্ন করছে রাজাকে। প্রেমের নেশার এক অদ্ভুত গন্ধ আছে, সেই গন্ধই মেতে উঠেছে রাজা। আজকের রাতের জন্য গুলরোখ তার, তারপর খুব শীঘ্রই আসবেন বাদশা আওরঙ্গজেব। একবার শাহজাদা সুজাকে পেলেই মিলবে প্রচুর উপঢৌকন। মিলবে বাদশার নিরাপত্তা। 

    কিন্তু ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন হচ্ছিলেন রাজা, গুলরোখের শরীরের গন্ধে নেশা সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন করেছে রাজাকে। নিঃশব্দে এক সময় লুটিয়ে পরলেন রাজা। পাশেই লুটিয়ে পরলেন গুলরোখ। প্রাণহীন নিথর দুটো দেহ মৃত্যু যন্ত্রনায় নীল হতে শুরু করেছে। শিবিরের বাইরে প্রতিক্ষায় দ্বাররক্ষক কিন্তু ভেতরে প্রবেশের অনুমতি নেই, রাজা নিজে না ডাকলে।

    বিশ্বাসঘাতকের শিবিরে সে নিজেই এসেছিল আজ অস্ত্র হয়ে। সারা শরীরে ছিল বিষের আধার। গুলরোখ জানতো শিবির থেকে সে ফিরে আসতে পারবেনা। শাহজাদার ভীষণ বিপদ, মগরাজ নিজের কথা রাখেননি, তাই মৃত্যুকে সঙ্গী করেই সে এসেছিল।

    সেদিন রাতের অন্ধকারে দুর্গের পশ্চিমের দ্বার খুলেছিল ঠিক সেই সময় যখন গুলরোখ উত্তরের দ্বারে। রাজা চন্দ্রসুধর্ম্ম ছিলেন গুলরোখের অপেক্ষায়। তাই কারো নজরে আসেনি শাহাজাদা অন্যপথে পাড়ি দেয় তার স্ত্রী আর তিন সন্তানকে নিয়ে। কুয়াশার মায়াজালে আচ্ছন্ন রইলো ইতিহাসের একটা অধ্যায়। তারপর কী হয়েছিল তা ইতিহাস নিরুত্তর, কোথাও বর্ণিত আছে আওরঙ্গজেব পুত্র মোহম্মদই শাহজাদা সুজাকে সাহায্য করেছিলেন সেদিন। গুলরোখের প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত ছিলেন মোহাম্মদ। কিন্তু সেই ইতিহাস হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে।

-সমাপ্ত

 Dipanwita DeyRay