সামাজিক গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
সামাজিক গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

না-মানুষী ভাষা - হৈমন্তী ভট্টাচার্য

 না-মানুষী ভাষা
হৈমন্তী ভট্টাচার্য


 


বৈশাখের খর গরমের দুপুরে তেঁতুল দিয়ে মাজা বাসনের মত চকচকে রোদ থাকলে কী হবে, দমকা হাওয়ায় সুপুরি গাছগুলো এ ওর গায়ে গিয়ে পড়ছে। চোখ বন্ধ করে পাতার আওয়াজ শুনলে মনে হয় ঝিরঝির করে জল পড়ছে। বুধানী বাগচী বাড়ির বাঁধানো কলপাড়ে চৌবাচ্চার কলে ঝপাঝপ বাসন ধুয়ে তুলল। তারপর ন্যাতাটা কেচে পাঁচিলের ওপর ফেলতেই বাড়ির পেছনের দিকের সানসেটের দিকে নজর পড়ল। একটা ছোট্ট কালো মতন দড়ি নড়ছে যেন। সাপ নাকি! চোখের চারপাশের কোঁচকানো চামড়া আরো কুঁচকে ঠাহর করে দেখল, না, সাপ নয়, তবে কিসের একটা লেজ, লোমহীন সরুপানা। পায়ের পাতার ওপর উঁচু হয়ে বুধানী গলাটা যদ্দুর সম্ভব ঘুরিয়ে দেখবার চেষ্টা করল। সাপ নয়, তবে কি বেঁজি?

     বুধানী মুখ তুলে দেখল দোতলার সামনের দিকের বারান্দাটা ফাঁকা। একটু আগে অবধি বুলবুলি দিদি বসে ছিল। ইদানিং বড্ড চুপচাপ হয়ে গেছে মেয়েটা। বিয়ের একবছর পর বিয়োতে গিয়ে আঁতুড়েই চার দিনের ছেলে মরে গেল। তারপর নয় নয় করে পাঁচ বছর কেটে গেছে। কীরকম মনমরা হয়ে থাকে আজকাল। বাপের বাড়ি এসেছে সংক্রান্তি কাটাতে।

  বেঁজিই হবে, উবু হয়ে বাসনগুলো হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে একবার তাকাতেই বড় বড় গোল গোল পুঁতির মত দুটো চোখের সাথে চোখাচুখি । একটা ছোট্ট লোমশ কালচে মাথা একবার উঁকি দিয়েই দেওয়ালের আড়ালে চলে গেল ঝট করে।
-"ও হরি এ তো হুনুমানের ছানা।"

-"হুনুমানের পাল এসেছে, সব বড়ি আচার তুলে নাও গো ছাদ থেকে।" বুধানীর সাবধানবাণী শুনে আশপাশের বাড়ির ছাদে জানালায় কয়েকটা মুখ দেখা গেল, "কই গো?"

নদে জেলার হাঁসখালিতে অবশ্য হনুমান আসা কোনো নতুন খবর নয়। এ তো কলকাতা নয়, যে হনুমান দেখতে হলে চিড়িয়াখানায় টিকিট কাটতে হবে। এখানে দিব্যি হনুমান দলবল নিয়ে পাড়া টহল দিতে বের হয়। পালের গোদা মস্ত বড় হনু তার লেজটা পিঠের উপর বাঁকিয়ে ইংরেজি আলফাবেট সি এর মত করে লাফ দিয়ে এ বাড়ি থেকে ওবাড়ির ছাদে তাণ্ডব করে। মাদি হনু পেটে ছানাকে আঁকড়ে ধরে খোসা ছাড়িয়ে কলা খায় আর পথ চলতি মানুষকে মুখ ভ্যাংচায়। ছাদ বাগানের লেবু বেগুন, বাড়ি আচার খেয়ে কলাগাছ আমগাছ ধ্বংস করে দল বিদায় নিয়ে যায় অন্যপাড়ায়।

বুধানীর সাবধান বাণীতে বাড়ির বউ ঝিরা গলা বাড়িয়ে কোনো হনুমান দেখতেই পেল না। পাশের বাড়ির ক্লাস ফাইভের পিকলু দোতলার জানলা থেকে বুধানীকে বলল, "তুমি হুনুমান বলছ কেন? ইস্কুলে শিখিয়েছে হনুমান। হনু মানে হল চোয়াল।"

-"থাম দিকি।" বুধানী ফোকলা মুখের ঠিক সামনে পাটিতে মুড়ির মত লেগে থাকা দাঁতটা ঠোঁটে দুবার ঘষে চারপাশ ভালো করে দেখে নিল। নাহ চারপাশের গাছ গাছালিতে বড় মেজো সেজো গোদা কোনো হনুমান দেখা যাচ্ছে না তো। তবে সানসেটের ওপর ওই ছানাটা এল কোথা থেকে?

এ বাড়ির ভেতর থেকে বাগচীবৌদি বলে উঠল, "কী হয়েছে রে বুধানী?"

-"হুনুমানের ছানা গো, তোমাদের জানলার ওপরে।"
বাগচী গিন্নী গ্রিলের দরজা খুলে লাল রোয়াকের ওপর দিয়ে এগিয়ে বুধানীর পাশে এসে দাঁড়ালেন,"কই রে?"

-"ছোট্ট ছানা গো", পাশের বাড়ির ছাদ থেকে  পিকলু বলে উঠল, "মনে হয় কাল যে হনুর দলটা এসেছিল, তাদের কারোর বাচ্চা। হয়ত লাফ দিতে গিয়ে পড়ে গেছে।"

-"তুই দেখতে পাচ্ছিস? আশে পাশে ওর মা আছে?"

পাশের দুটো বাড়ির ছাদ থেকে পিকলু আর বিন্তি চারপাশ ভালো করে দেখে বলল, "না গো।"

ক্রমশ চারপাশের বাড়ির ছাদে,আর পাঁচিলের বাইরে পাড়ার ছেলে পিলে ভিড় জমালো।
-"দেখো কত টুকুনি বাচ্চা। আহা গো।"
চার বছরের ভণ্ডুলকে ওর মা আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, "ওই দেখ , আরেকটু বড় হলে তোর মত হবে।"

দুবাড়ির ছাদ থেকে পিকলু আর বিন্তি তর্ক জুড়েছে।
পিকলু বেশ জোর গলায় বলল, "শোন হনুমান সীতা দেবীকে খুঁজতে গিয়ে ল্যাজ জ্বালিয়ে লঙ্কায় আগুন লাগিয়েছিল । তারপর সেই লেজটা মুখে পুরে ওর মুখটা পুড়ে কালো হয়ে গেছে। তাই হনুর মুখ কালো।"

বিন্তি চশমার আড়াল থেকে টেরা চোখে তাকিয়ে বলল, "তোর মুণ্ডু, হনুমান সূর্যের কাছে পড়তে গিয়েছিল। সূর্যের তো অনেক কাজ। তখন হনু বলল, আপনি রথ চালান, আমি আপনার দিকে মুখ করে পেছন দিকে ছুটব, আর আপনি যা বলবেন শিখব।সূর্যের রথের দিকে তাকিয়ে পেছন দিকে দৌড়ে দৌড়ে শিক্ষা নিয়েছিল বলে রোদে পুড়ে মুখ কালো হয়ে গেছে।"

পিকলু মানবে না, "তুই ভুল জানিস। এটা আমার দাদু বলেছে।"

-"না রে হনুমান, তুই ভুল জানিস। আমায় মা এই গল্পটা বলেছে।"

ওদিকে হনুমানের ছানা তো এত মানুষ জন দেখে ভয়ে আরো সিঁটিয়ে গেছে। কি করা যায় ছানাটাকে বাঁচানোর জন্য সেই বিষয়ে জল্পনা শুরু হল।
-"কী হবে বল তো? গোটা একদিন পড়ে আছে আটকে। এভাবে থাকলে তো না খেয়েই মরে যাবে।"

-"বাহাদুর পুর বিট অফিসে ফোন করা যাক।" ঝটপট ফোন হল বনদফতরে। কিন্তু লোক কম। তাই দেরি হবে আসতে।

বুলবুলি ইতিমধ্যে পায়ে পায়ে মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। খুব খুঁটিয়ে দেখে মনে হল ছানাটা পেছনের পা বা কোমরটা নাড়তে পারছে না। এতক্ষণ , প্রায় একদিন ওই সানসেটে আটকে আছে। আরো কত দেরি হবে কে জানে! বুলবুলি ভিড়ে দাঁড়ানো যুবকদের উদ্যেশ্যে বলল, "ওকে নামানোর ব্যবস্থা কর দিকি তোরা।"

-"মানুষ গায়ে হাত দিলে যদি ওর মা না নেয়!"
বাগচী গিন্নী আমতা আমতা করে বললেন।

-"মা যদি নিতই, তাহলে কি রেখে চলে যেত? যেত নি। এ হল জানোয়ারের মর্জি। আগেও দেকিচি, কোনো কোনো ছানাকে মা কাচেও নেয় না, দুদও দেয় না। মেরে ফেলে ।আবার অনেক সময়ে মায়ের দূর ছাইতে এমনিই না খেয়ে ছানা মরে যায়।" বুধানী বেশ বিজ্ঞের মত বলে উঠল।

-"একটু ওকে নামিয়ে দে সন্তু", বুলবুলির গলায় মিনতি।
জোয়ান ছেলে সন্তু পাঁচিলের খাঁজে পা রেখে তরতর করে উঠে গিয়ে হাত বাড়াতেই ছানাটা ভয়ে "চি চি" করে ডেকে উঠল।
-"সাবধানে। ওর পিঠে ব্যথা আছে মনে হয়", বুলবুলি নীচ থেকে ডেকে বলল।

বেশ কসরত করে ছানাকে নামানো হল। বুধানী বলে উঠল,"জয় বজরংবলী"। গোল গোল চোখদুটো কাঁচের গুলির মত ঝকঝকে। বুলবুলি স্থির চোখে চেয়ে রইল।  ঠিকই আন্দাজ করেছিল। পেছনের পায়ের নিচের দিকে আর পেটে বেশ খানিকটা জায়গা লোম উঠে ভেতরকার লালচে মাংস বেরিয়ে আছে। রস জমে আটকে আছে লোমের সাথে। হয়ত  পড়ে গিয়ে জখম হয়েছে। পুরো শরীরটা ব্যথায় নাড়াতে পারছে না ।অল্প ঘাড় নেড়ে প্রাণীটা ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকাচ্ছে।

-"বিট অফিসের লোকজন কখন আসবে কে জানে!"
জল খাওয়ানোর চেষ্টা হল মগে করে। সরু ধারায় মুখের কাছে ফেললেও গালে পৌঁছল না, গড়িয়ে গেল। এক্কেবারে নেতিয়ে গেছে। ঘাড় তুলে হাঁ করেও জল খেতে পারছে না। বুধানী ঠোঁট ছড়িয়ে বলল, "এ বাঁচবে নি গো।"

বুলবুলি আর দাঁড়ালো না। প্রায় দৌড়ে বাড়ি থেকে তুলোর প্যাকেট আর জলের বোতল নিয়ে ফিরে এল। পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে চৌবাচ্চার বাঁধানো পাড়ে বসে পড়ে বলল, "আমার কোলে একটু আস্তে করে তুলে দাও দিকি।"

বুলবুলির কোলে এসে ছানাটা গোল গোল চোখে দেখছে। বুলবুলি তুলো সরু করে জলে ভিজিয়ে মুখের কাছে এনে আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিতেই ফোঁটায় ফোঁটায় জল পড়ল ছানাটার মুখে,"না হাঁ কর"। আস্তে আস্তে হাঁ করে জল খেতে লাগল ছানাটা।

বুধানী বলল, "আহা কত তেষ্টা পেয়েছিল বল দিনি।"

বুলবুলির জামা ভিজে উঠেছে গড়িয়ে পড়া জলে। ছানাটা অল্প উসখুস করে উঠল। বুলবুলি ছানাটাকে কোল থেকে নামাতে যেতেই সে ছোট্ট ছোট্ট আঙ্গুল দিয়ে জামাটা আঁকড়ে ধরল,"কি হল, ছাড়"। আরেকবার নামাতে গেলে ছানাটা আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরল জামা। বাগচী গিন্নী মুখ টিপে হেসে বললেন, "তোকে পছন্দ হয়েছে। ওই জন্য আঁকড়ে আছে।"

বুলবুলি একদৃষ্টে প্রাণীটার ভীত ছোট্ট ছোট্ট চোখওয়ালা হালকা রোমশ মুখটার দিকে তাকিয়ে অল্প হাসল। গোল গোল অবুঝ চোখে অবলা মরণাপন্ন প্রাণীটাও ওকে দেখছে অদ্ভুত নির্ভরতায়।

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। বিনবিনে গান গাইতে গাইতে মশার ঝাঁক দল বেঁধে ঘুরছে মাথার ওপর। বুলবুলি মানবশিশুর মত করে কোলে জড়িয়ে নিল ছানাটাকে। বুলবুলির নখ অসাবধানে অল্প ছুঁয়ের গেল প্রাণীটার লালচে ক্ষতয়। "ইস, ষাট ষাট" বুলবুলির কালো চোখদুটোর দৃষ্টি নরম হয়ে উঠল। তার মুখের রেখায় লালচে সূর্যের আলো । উঠে দাঁড়িয়ে  বলল, "বুধানী পিসি একবার ঘরে এসো তো। টাকা দিচ্ছি। দুধের ফিডিং বোতল আর এক প্যাকেট দুধ এনে দাও তো।"

******

-"বুলবুলি রে, এবার নিশ্চিন্ত । বিট অফিসের লোক এসে গেছে।" বাগচী গিন্নী ঘরে ঢুকলেন।
বুলবুলি একমনে ছানাটাকে বোতলে দুধ খাওয়াচ্ছে বোতলে। চক চক শব্দ করে অবিকল মানবশিশুর মত দুধ খাচ্ছে ছানাটা। বুলবুলি মায়ের দিকে তাকালো। মুখ দেখে মনে হল না সে নিশ্চিন্ত হয়েছে। সাবধানে পুরো দুধটা খাইয়ে ফাঁকা বোতল নামিয়ে রাখল মাটিতে। তারপর গলায় উদ্বেগ নিয়ে বলল, "ওরা নিয়ে গিয়ে যত্ন করবে তো?"

-"আরে হ্যা। ওদের কত পশুদের ডাক্তার আছে।"
-"ওকে যদি না দিই, ও থাকুক না আমার কাছে। আমি যত্ন করে সুস্থ করে ছেড়ে দেব।" বুলবুলির গলার স্বরে কাতরতা এমন ভাবে ফুটে উঠল যে বাগচী গিন্নী নির্বাক হয়ে রইলেন। মেয়ের মাথায় হাত রেখে নরম সুরে বললেন, "তা কি হয় রে? ওরা ওর ঠিক মত চিকিৎসা করবে। যদি আমাদের কাছে মরে যায়?"
-"মরবে না। আমি ঠিক মায়ের মত  যত্ন করে ওকে বাঁচাবো। আমি ওকে ছাড়ব না কারোর কাছে।" বুলবুলির গাল বেয়ে বড় বড় জলের ফোঁটা নীরবে গড়িয়ে পড়ল।

বাগচী গিন্নী কী বলবেন বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন,
-"শোন মা ,জানোয়ারের ভালোবাসা মানুষের মত নয়। এই যে তুই ওর সেবা করলি, ও ঠিক এই বাড়ি আর তোকে মনে রাখবে। সুস্থ হয়ে জঙ্গলে চলে যাবার পর দেখবি আবার তোর কাছে ঠিক একদিন আসবে। তোর হাত থেকে খেয়ে যাবে।" মেয়ের চুলে আঙ্গুল ডুবিয়ে আদর করতে লাগলেন। সন্তানহীন আত্মজার কষ্ট তিনি মর্মে মর্মে বোঝেন। জলভরা চোখে তিনি মনে মনে মেয়েকে আশীর্বাদ করে বললেন,"অবলা প্রাণীর সেবা করলে ভগবানের সেবা হয়। দেখিস মা ষষ্ঠীর পুত আসবে এবার তোর কোল আলো করে। তোর বুক ফাঁকা থাকবে না।"

বিট অফিসের লোকজন খাঁচায় ভরে নিল ছানাটাকে। যাবার আগেও বুলবুলির জামাটা আঙ্গুলে শক্ত করে ধরা ছিল। অবুঝ চোখ দুটো যেন বলছিল, "রাখো না তোমাদের কাছে আমায়।" বুলবুলি কান্না গিলে আদর করে বলল, "যা বাবু, সুস্থ হয়ে আসিস আবার। আমিও খোঁজ নেব তুই কেমন রইলি।"

অন্ধকারে ঢাকা রাস্তায় বন দফতরের গাড়ি বাঁক নিয়ে ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে গেল।  বাগচী গিন্নী জোড়হাত মাথায় ঠেকিয়ে বললেন, "ওই টুকু বাচ্চা , যেন রক্ষা পায় ।ঠাকুর তুমি দেখো।" বুলবুলি জলভরা চোখে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল। দুটো নামানুষী চোখের নির্ভরতার ভাষা তার শূন্য বুকের মধ্যে আশ্রয় খুঁজে বেড়াতে লাগল। নাহ, বড্ড মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছিল ছানাটা একবেলাতেই। ফেরার অপেক্ষা করলে ও কী সত্যিই ফিরবে! হয়ত ফিরবে না। একেবারে ভুলেই যাবে।

বুলবুলি চোয়াল শক্ত করল, তাকেও ভুলতে হবে, এক্কেবারে ভুলতে হবে।
 

****সমাপ্ত**** 

অলঙ্করণ :-  প্রিয়াঙ্কা সরকার



অন্য পূজো - শাশ্বতী মুন্সী


 অন্য পূজো
 শাশ্বতী মুন্সী 
 

 
 

 গলির চৌমাথার মোড়ে গাড়িটা এসে দাঁড়াতে ভাড়া মিটিয়ে ক্যাব থেকে নেমে পড়লো মালবিকা | কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ এবং ডানহাতে ধরা ভারী  বিগ শপারটা নিয়ে মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলো বাড়ির সদরে | কলিং বেলের সুইচে আলতো চাপ দিতে সুরেলা ধ্বনির অনুরণন ভেসে এলো দরজার ওপ্রান্ত থেকে | একটু অপেক্ষার পরে শাশুড়ি মা দরজা খুলতে সিঁড়ির নিচ দিয়ে ভেতরে ঢুকে বাঁ-হাতি দেওয়ালের এক সাইডে ভ্যানিটি ব্যাগটা বিগ শপারের ওপরে রাখলো | তারপর হাত-পা ধুয়ে ব্যাগ দুখানা রেখে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসতে এক গ্লাস ঠান্ডা জল বৌমার দিকে এগিয়ে দিয়ে  উল্টোদিকের সোফায় বসলেন হেমলতা দেবী | পুরো জলটা পান করতে ঘর্মাক্ত শরীরের গরম ভাব খানিক জুড়োলো | মালবিকার ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে হেমলতাদেবী বললেন,
 -" খুব পরিশ্রম গেলো না.. তা, এতো দেরি হলো যে.. সব কেনাকাটা আজই করে নিলে?"
 -" হ্যাঁ মা, কিনতে যখন গেছি তাই আর কিছু বাকি রাখলাম না.. হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলে স্কুলে আর ছুটি পাবো না.. তাছাড়া ভাদ্রের বিজবিজে গরমে ভিড় ঠেলে বারবার যেতেও বিরক্ত লাগে..!"
-" তা যা বলেছো, পূজো এলেই যেন কেনাকাটার হিড়িক লেগে যায়.. নাও, এবার তোমার ছেলেপুলেদের সামলাও দিকি নি, বিকেল থেকে মা কখন আসবে, কতগুলো জামা নিয়ে আসবে, আমাদের নিয়ে গেলো না কেন --- প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে দিলো আমায়.."

ওনার কথা শেষ হওয়া মাত্র দোতলার সিঁড়ি দিয়ে দুপদাপ করে নেমে একছুটে সোজা ড্রয়িং রুমে ঢুকে কোনো দিকে না তাকিয়ে মায়ের দু'পাশে বসে পড়লো চার মিনিটের ছোট-বড় দুই ভাইবোন | মালবিকার যমজ সন্তান -- তাতান আর তুতুন | দু' জোড়া হাতের আদরের ভঙ্গির বাহুডোরে তার শরীরের ক্লান্তি নিমেষে উধাও | ওই অবস্থায় আবদ্ধ থেকে নরম স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,
 -" সারাদিন দুষ্টুমি করিস নি তো.. খেয়েছিস ঠিক মতো? "
 -" একটুও দুষ্টু করি নি মা... ঠাম্মি কাঁটা ছাড়িয়ে দিতে মাছ দিয়ে সব ভাত খেয়ে নিয়েছি আমরা.. ", একসাথে বললো দুজনে |
 -" বাহ্.. কিন্তু লক্ষ্মী সোনার ঠাম্মিকে অতো প্রশ্ন করে জ্বালাতন করছিলে কেন? আমি তো বলেই গেছি কোথায় যাচ্ছি কেন যাচ্ছি.. ভিড় আর রাস্তায় জ্যাম ছিল বলে ফিরতে দেরি হয়ে গেলো..
 হাতের বন্ধন শিথিল করে ঠাম্মির দিকে বারেক তাকিয়ে নিলো তাতান | বলে,
 -" ঠাম্মি যে কিছুতেই বলছিলো না আমাদের জন্য জামা প্যান্ট কিনে আনবে কিনা.."
 -" তোদের পুজোর পোশাক তো কেনা হয়ে গেছে.."
 -" সে তো দুটো বাবা দিয়েছে, পিসি আর জেঠু একটা করে, মামারবাড়িটা বাকি আছে আর মাসি এখনো দেয় নি.. "
দাদার কথার খেই ধরে নেয় তুতুন | দুঃখী স্বরে বললো,
-" তুমি কিন্তু এবারে একটাই জামা কিনে দিলে মা..!"

 দুই হাতের বেড়ে ছেলেমেয়েকে কাছে টেনে মালবিকা বোঝায়,

 বাবা, মায়েরা অনেক টাকা উপার্জন করলেই যে পুজোতে গন্ডা খানেক জামা কিনে দেবে, এটা কক্ষনো ভেবে রাখবি না..পাঁচ দিন পুজোতে পড়ার মতো জামা হলেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়.. কখনো ভেবেছিস, যেসব ছোট ছেলেমেয়েরা সিগন্যাল, বাস স্টপেজে ঘুরে ঘুরে হাত পেতে ভিক্ষা করে পয়সা চেয়ে খাবার কিনে খায়, তারা ক'টা জামা পায় পূজোতে কিংবা আদৌ পায় কি না! সারাবছরই যাদের লোকের ফেলে দেওয়া পুরনো ছেঁড়া, রং চটা জামা পরে কাটাতে হয়, তারা যে নতুন জামা পাওয়ার কথা ভাবতেই পারে না.. অর্থের জোর আছে এমন লোকেদের উচিত এইসব পথশিশুদের জন্য সাধ্যমতো কিছু করা.. পুষ্টিকর খাবার, পোশাক, দেওয়া, প্রয়োজনে কোনো সংগঠন বা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা.. তাই এবারে একটা জামা কম হলে সেই টাকায় যদি ৪/৫টি শিশুকে জামা কিনে দিই, তাতে কি তোদের মন খারাপ হবে?

সোফার সামনে রাখা পোশাকে ঠাসা বিগ শপারটার দিকে তাকিয়ে তুতুন বললো,
 -" ওতে কি তাহলে সব ওদেরই জামা,প্যান্ট আছে..!"
বোনের মনোভাব অন্যদিকে ঘোরাতে তাতান বলে ওঠে,
 -" শুনলি না মা কি বললো.. ওরাও আমাদের মতো মায়ের দেওয়া নতুন জামা পরে ঠাকুর দেখবে..
 -" প্যান্ডেলে গিয়ে তোরা যেভাবে ঠাকুর দেখিস, আনন্দ করিস, ভালো ভালো খাবার খাস, ওরা সেসবের কিচ্ছু পায় না বলেই তো এ বছরটা শুধু ওদের জন্যই আলাদা পুজোর বন্দোবস্ত করেছি আমরা.. ", বললো মালবিকা |
 -" তোমাদের অফিসের মাঠে পূজো হবে বলেছো, তাহলে বাবার মামবাড়ির দূর্গা পূজোতে যাবে না তুমি? ", বালকসুলভ প্রশ্ন উচ্চারিত হয় তাতানের কণ্ঠে | একটু ভেবে নিয়ে মালবিকা উত্তর দেন,
 -" যাবো তো বটেই.. তবে অন্যবারের মতো যে থাকতে পারবো না, পূজোর কিছু দায়িত্ব আমাকেও  নিতে হয়েছে, তবে অষ্টমী বা নবমীর দিন যখন হোক ঠাকুর দর্শন করে আসবো.. ",

 বৌমার কথায় স্মিত হাসেন হেমলতা দেবী |

 পেশায় স্কুল শিক্ষিকা(ভূগোল) মালবিকা বসুরায় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত | সহকারী সভাপতি | সারা বছর এই সংগঠন বিভিন্ন  জনকল্যাণমূলক প্রকল্প ভিত্তিক কাজ করে থাকে | এবারে তারা ঠিক করেছেন, পথশিশুদের নিয়ে দূর্গাপূজো করবে | সংগঠনের নানা কাজে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর শহরের ঘিঞ্জি বস্তি, গ্রাম-গ্রামান্তরে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ছুটে যায় প্রতিনিধিরা | চলতি বছর তেমনই এক প্রকল্পের কাজে দলের প্রতিনিধিত্ব করে বাঁকুড়ার কুলতলি গ্রামে গিয়ে মালবিকা দ্যাখে, ছোটদের কেউ অপটু হাতে সযত্নে প্রতিমা গড়ছে, কেউ বানাচ্ছে শোলার ফুল, আবার কেউ করছে দরমার কাজ | কৌতূহল বশে জিজ্ঞেস করতে ১২ বছরের মন্টু জানায়,
 -" বাবা ঠাকুরদাকে মাটির ঠাকুর বানাতে দেখেই শিখে নিয়েছি | মনের কল্পনায় মূর্তি গড়তে ভালো লাগে.. "
 বোঝে, মাটির তাল নিয়ে খেলতে খেলতে ছোট্ট আঙ্গুল গুলো অজান্তেই কারিগরিতে দক্ষ হয়ে উঠেছে | তাদের এই সহজাত দক্ষতাকে অভিনব রূপে ব্যবহার করার ভাবনা আসে মালবিকা'র মাথায় |

 সংগঠনের সভাপতি এবং সকল প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে স্থির হয় অফিসের পাশের খোলা মাঠে দূর্গা পূজোর আয়োজন করা হবে | কুমোরটুলির অর্ডারী প্রতিমা নয়, গ্রামের খুদে মৃৎশিল্পীদের তৈরী একচালায় সপরিবারে দেবী দূর্গা পূজিত হবেন | ঠাকুর গড়বে প্যান্ডেলের ভেতরে বসে | অন্দরসজ্জায় থাকবে বালক-কিশোরদের হাতের কাজের ছোঁয়া | গ্রাম থেকে এসে এই সময়টা অফিসের অব্যবহৃত ঘরে থাকবে ওরা এবং খাওয়ার খরচা ব্যয় হবে সংগঠনের ফান্ড থেকে |

 দাতাগোষ্ঠী, স্থানীয় অবস্থাপন্ন ব্যক্তিদের সহায়তায় বেসরকারি সংগঠনের ফান্ডে অর্থের সংকুলান হয় না | বিভিন্ন মানব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত করে থাকেন | মালবিকা'র স্বামীও প্রতি মাসে সংগঠনের তহবিলে অর্থ দান করেন | সমাজসেবী সত্ত্বা, উদার হৃদয়, কর্মোদ্যমী প্রয়াস -- এ হেনো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী স্ত্রী'র জন্য গর্ব অনুভব করেন চিরদীপ বসুরায় |

 কারিগরি বিদ্যে আর শিল্প-শৈলীর মেলবন্ধনে অপূর্ব সুন্দর প্রতিমা গড়ে নাবালক শিল্পীরা | বাঁশ, দরমা দিয়ে বানানো প্যান্ডেলের অভ্যন্তরীণ সাজে লাগে শোলা কেটে রং-তুলি বুলিয়ে তৈরী নকশাদার চিত্রালংকার | রাত নামলে শহর ভেসে যাওয়া উজ্জ্বল আলোর রোশনাইয়ের মাঝে জাঁকজমকহীন মণ্ডপে শোলার ফুলের ভেতর জ্বলে ওঠে রঙিন টুনি লাইট |

  জনা ৫০ পথশিশু এবং গ্রামের ওইসব ছোট  ছেলেমেয়েদের মধ্যে হাফ/ফুল শার্ট, হাফ/ফুল প্যান্ট, ফ্রক, স্কার্ট টপ, চুড়িদার ইত্যাদি পোশাক বিতরণ করা হয় মহালয়ার দিন | ভাত, লুচি, খিচুড়ি, লাবড়া, আলুর দম, ফুলকপির তরকারি, মাছ, মাংস, পায়েস, দই, মিষ্টি.. পাঁচদিন ধরে  চারবেলা পাত পেড়ে খাওয়ানো হলো পূজোর ঢালাও খাবার |

  শিশু, বালক বয়সী একঝাঁক কচিদের হাসি-মজা- কলরোলে মণ্ডপের ভেতর এবং প্যান্ডেলের বাহির মুখরিত হয় অনাবিল আনন্দ-তরঙ্গে | রোদ ঝলমলে পূজো প্রাঙ্গন জুড়ে  আন্দোলিত হয় খুশির গন্ধ মাখা শরতের মনোরম বাতাস | নতুন ছন্দে উৎসব উপভোগের অভিপ্রায়ে মালবিকার সন্তানেরাও এই ক'টি দিন সংগঠন-মাঠের পূজোয় সামিল হয় |

 মৃৎশিল্প এবং হস্তশিল্পের কল্যাণে কলকাতার ঠাকুর দর্শনের সুযোগ মিললো গ্রামীণ জনপদের বাসিন্দাদের | আর নিজেদের পূজোর আনন্দ-আহ্লাদে মেতে উঠলো কলকাতার ঠিকানাহীন পথবাসীরা |

 শহরের সঙ্গে গ্রামকে মিশিয়ে দেওয়ার মানবতা'র পূজোয় ধ্বনিত হলো মনুষ্যজাতির জয়গান |
 
....................
অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি

 

কাক - রুমি বন্দ্যোপাধ্যায়



কাক
রুমি বন্দ্যোপাধ্যায়
 

 



কাক দুটো কোথা থেকে এসে জুটেছে কে জানে‌? গাগুলোতে ঐ তিতকুটে কালোটা আরেক পরত বেশি চড়ানো। ওদের যেন অন্য কোথাও যাওয়ার ইচ্ছেও নেই, কোন কাজকর্ম‌ও নেই। শ্যাওলা পড়া কুয়োর পাশে হিলহিলে দুটো উচ্ছে গাছের মাচা করা আছে, সেখানেই বসে থাকে। অঞ্জু এঁটো বাসন মাজার সময় রোজ ওদের দেখতে পায়।

অঞ্জুদের বাড়িতে মাছ-মাংস কালেভদ্রে আসে। এলেও ছেলে-মেয়ে দুটো হাড়মাস পর্যন্ত চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। ল্যাজার দিকের মাছ সস্তায় পায়। মাছওয়ালা বঙ্কু অঞ্জুর বর বিনয়ের চেনা। আগে বটতলা বাজারে পাশাপাশি দুজনে বসত।মাটিতে নীল প্লাস্টিক পেতে সবজি বিক্রি করত। এখন বছর তিনেক হল বিনয় জয়পুরে। সাত/সাত এর একটা ছোট্ট খুপরিতে থাকে। জরি, চুমকি, পাথর শাড়িতে সেলাই করে  বসায়। জারদৌসি শাড়ির কারিগর, ওদের ওখানে মেয়েরা সবসময় এইরকম ঝলমলে শাড়ি পরে ।বিনয় নীল রঙের একটা জারদৌসি শাড়ি এনে দিয়েছিল একবার বউএর জন্য। দেখে মনে হয় শাড়িটা মাঝরাতের আকাশ, তারায় ভরা। গায়ে দিলে এত চকমক করে যে লজ্জায় কোনদিন পরতেই পারেনি‌ ও। সেটা সেকেন্ডহ্যান্ডে কেনা আলমারিটাতেই তোলা থাকে উপরের তাকে, কোণ ঘেঁষে। দুটো ন্যাপথলিনের বল ঢোকানো আছে ভেতরে।

ল্যাজার লম্বা কাঁটাটার দিকে তাকিয়ে অঞ্জু হতাশ হয়। এতোটুকু মাছের নরম শরীর লেগে নেই ওখানে যে কাকদুটো ঠুকরে ঠুকরে খাবে। তাও কিসের জন্য যে ওগুলো অন্য কোথাও যায় না! অঞ্জু খ্যাসখেসে গলা নিয়ে ওদের 'হুস হুস' করে তাড়ায়, আবার কখন‌ও শুকিয়ে যাওয়া ডাল মাখা ভাত ছিটিয়ে দেয়।

অঞ্জু যে সময় বাসন মাজে সেই সময় পাশের ঘরের চন্দনের বউ মুনিয়া দাঁতে গুড়াকু ঘষে চৌকাঠে বসে।  বিলাসপুরে ওদের জমি-জিরেত আছে। মাথাভর্তি কমলা সিঁদুর ওর মুখে খানিকটা কমলা রঙের আভা নিয়ে আসে। শাড়িটা  ইচ্ছে করেই হাঁটু অবধি তুলে ডালিম রঙা পায়ের গোছ দেখায়। ঠিক কাকে দেখায় কে জানে? তবে ও এলেই আসে পাশের ঘরের  ছেলে ছোকরাদের কলতলায় যাওয়ার তাড়া বেড়ে যায়। মুনিয়াও বলছিল
------ওই কাউয়া দুটো তুমি পুষেছো নাকি ভাবী? আমি কত ডাকি, ঘি মাখানো রুটি, ছাতু মাখা দিই তাও এদিকে আসে না।

মনে মনে হাসে অঞ্জু। ভাবে যত অভাগা তার কপালেই জুটেছে। হাসপাতাল থেকে যাকে নিয়ে এসেছে সেও কী কম অভাগী?  মেয়েটার চোখে জন্ম কাজল পরানো, জ্যৈষ্ঠের নির্দয়, খটখটে, চৌচির উঠোনে আঁজলা ভরে ঠান্ডা জল ছিটিয়ে দেয় ঐ মুখ। এত্তটুকুন হাঁ‌, হাই তোলার সময় দেখা যায়। পাখির বাচ্চার মত ভেতরটা টুকটুকে লাল। হাসপাতালে যখন প্রথম দেখল অঞ্জু আশার মেয়েকে  তখন গায়ে গর্ভের আঠা লেগে আছে। আশা তার নিজের মায়ের পেটের বোন। মা-বাপ অবশ্য মরে গেছে কবে, বাপের বাড়ির সম্পর্ক বলতে ছিল ওই ছোট বোনটা।

কাছেই একটা ফ্যাক্টরিতে মাছ কাটার কাজ করত আশা। মাঝে মাঝে সন্ধ্যেবেলায় চায়ের জল ফুটতে দিয়ে যখন সিরিয়াল দেখতে বসত অঞ্জু তখন পিছন থেকে এসে কানামাছির রুমালের মতো হাত দুটো চোখের ওপর খপাৎ করে চেপে ধরত। গা থেকে সব সময় বিটকেল মাছের গন্ধ বেরোতো ওর। ওই গন্ধেই ওকে চেনা যেত। তাও যে কেন ছেলেমানুষি খেলা খেলত! বিরক্ত হয়ে অঞ্জু বলত
-----ইস ম্যাগো, যা সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে আয়। কি করে থাকিস এই গন্ধে সারাক্ষণ। তুই তো ছোটবেলায় ঘেন্নায় মাছ-মাংস ছুঁতিস না।
আশা হেসে বলতো
------অভ্যেস রে দিদি , অভ্যেস। আগে আমারও গা গোলাতো, এখন আর কিছু মনে হয় না।

গায়ে আঁশটে গন্ধ নিয়েও বুকের ভিতরে যে তার একটা ওডিকোলন মাখানো স্বপ্ন ভুরভুর করত সেটা অঞ্জু জানত। যবে থেকে বুঝেছিল জরায়ুর নরম বিছানায় প্রাণের ধুকপুকানি শোনা যাচ্ছে তবে থেকেই সেই স্বপ্নের শুরু।
-----দেখিস দিদি আমার মেয়েই হবে। আর মেয়ে হলে আমি রাজকন্যার মত বড় করব।
অঞ্জু বলত
-----তোরা দুজনেই যা খরচে। যা রোজগার করিস তার থেকে বেশি উড়িয়ে দিস। তা না হলে কেউ 'ওলা' করে চিড়িয়াখানা বেড়াতে যায়, না দুদিন ছুটি পেতে না পেতেই ধেই ধেই করে মন্দারমনি ঘুরতে যায়?
------নারে এবার সব ছেড়ে দেবো।রাজাও বলেছে এখন থেকে টাকা জমাতে হবে। পোস্ট অফিসে কত সুদ দেয় রে দিদি?

দিদির কাছে এসেই গত তিন মাস ধরে দুহাজার টাকা  জমা করে যেত। ওর কাছে রাখলে নাকি খরচ হয়ে যাবে। টাকাপয়সা চুলকাতো ওর গায়ে। অঞ্জু সেই টাকাটা একটা পুরনো রেক্সিনের পার্সে জমিয়ে রাখত।

পাঁচ মাসেই পেটটা বেশ বড় হয়ে গিয়েছিল আশার। তাই নিয়েই হাঁপাতে হাঁপাতে আসত। অঞ্জু বলত
------সাবধানে চলাফেরা কর, প্রথম বাচ্চা সারাক্ষণ এত খলবল করিস কেন? পা ছড়িয়ে বসত মেঝেতে আশা
-------হারানদার দোকানের পাশে যে নতুন বেডিং স্টোর হয়েছে সেখানে একটা দোলনা দেখে এসেছি  দিদি! ভেতরের বিছানাটা কি তুলতুলে রে। হাত দিলে দুই আঙুল ডুবে যায়। আমাদের এই শক্ত তক্তপোশে  শোয়াব না আমার মেয়েকে। আমাকে দু হাজার টাকা দে না দিদি। কিনে আনি ওটা।

--------একদম না। বাচ্চা হওয়ার আগে ওর নাম করে কিছু কিনতে নেই জানিস না। আগে জন্মাক তারপর দেখা যাবে।

সেই রাজকন্যা জন্মাবার ঠিক ‌ এক সপ্তাহ আগে অলপ্পেয়ে অতিমারিতে অঞ্জুর বর মারা গেল। ডেলিভারি ডেটের দিন পাঁচেক বাকি থাকতেই গায়ে জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হল আশা। বাচ্চাটা হওয়ার পর একবারও বুকে ছোঁয়াতে পারল না নরম শরীরটাকে মেয়েটা। দূর থেকেই দেখেছিল কেবল। কি একটা বলতে চায়ছিল ক্ষীণ গলায়... অঞ্জুও হাঁকপাঁক করছিল শোনার জন্য কিন্তু এলাচের খোসার মতো  বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ঠোঁটগুলোর কষ বেয়ে আকুতি ছাড়া আর কিছু গড়িয়ে পড়েনি সেদিন। হাসপাতালে দশ দিন ছিল আশার মেয়ে তারপর সব নথিপত্র জমা দিয়ে ওকে নিয়ে এসেছে অঞ্জু, একমাত্র কাছের আত্মীয়া।

-----আমাদের ঘরে আর কি পাবে? তার থেকে হাসপাতালে রেখে দিলে ওরাই কোন অনাথ আশ্রমের ব্যবস্থা করতো। হয়তো কোন ভালো পরিবার থেকে ওকে দত্তক নিত কেউ। তাছাড়া সরকার‌ও তো শুনছি এসব বাপ মা হারা বাচ্চাদের টাকা পয়সাও দেবে বলেছে। তুমি এই ঝামেলা সামলাতে পারবে?
ফোনে বলেছিল বিনয়,সপ্তাহে দুদিন ফোন করে নিয়মমাফিক। 

কথাটা যে অঞ্জুর মনে আসেনি তা নয় কিন্তু যতবার ভেবেছে একটা বিসর্জনের বাজনা বেজে উঠেছে আর বুকটা চন্দনপুকুর হয়ে গেছে। চন্দনপুকুরে ডোবানো হত ওদের পাড়ার প্রতিমা। অঞ্জু, আশা দুই বোন হাত ধরাধরি করে দেখতে যেত। পুকুরের চারদিকে বড় বড় হ্যালোজেন লাইট লাগানো হত। খুব ভিড় হত। তাই দুজন দুজনকে শক্ত করে ধরে রাখত। বিসর্জনের পরের দিন ওই পুকুরে ভেসে উঠত শোলার মুকুট,  খড়ের কাঠামো, গাঁদার মালা। শ্মশান মনে হত।লোকালয়ের  মাঝেই দুপুরবেলায় লি লি করত বিসর্জনের পরের দিনের চন্দনপুকুর।

আশার মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে আসায় সব থেকে বেশী চটেছে অঞ্জুর নিজের মেয়ে বাবলি। স্কুলে পড়লে এবছর মাধ্যমিক দিত। কিন্তু লেখাপড়া তার মাথায় ঢুকল না। বস্তির উচ্ছন্নে যাওয়া মেয়েগুলোর  সাথে চোখে মুখের রঙ মেখে টিক্-টক্ ভিডিও বানাতে শুরু করেছিল তাই একরকম জোর করেই একটা সেলাইয়ের স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে অঞ্জু। মজুমদারের বাড়ি থেকে ওদের মেজ বউ দেখতে এসেছিল আশার মেয়েকে। দীক্ষা নেওয়া আছে বলে ওই বাড়িতে অন্নপূর্ণা পুজোর ভোগ রাঁধতে ডাকত ওকে, অনেক সময় আশাকেও নিয়ে গেছে। চারখানা সুতির পুরনো শাড়ি দিয়ে গেছে। নামেই পুরনো, বড়লোকদের আর কোন শাড়িই বা পুরোনো হয়। তারমধ্যে বেগুনি রঙের একখানা শাড়ি খুব পছন্দ হয়েছিল বাবলির।

-------আমাকে ওটা দাও না , কুর্তি বানাবো। হাত কাটা, ডিপ নেক। ওটাই বেশি চলছে এখন। নেকটা সাড়ে সাত নেব । ভি গলা, বুকের ঠিক খাঁজের কাছে এসে আবার উঠে যাবে লাইনটা । এমনভাবে কাটব না, সেলাই এর দিদিমণি হাঁ হয়ে যাবে। নিখুঁত করতে হবে ফিটিংসটা। সবার ফিগারে মানায় না , আমাকে হেব্বি লাগবে। দাওনা... দাওনা দেখাব তোমায় কেমন শিখলাম।

তাও দেয়নি অঞ্জু। তিন খানা শাড়ি কেটে কুটে কাঁথা বানিয়েছে মাঝখান দিয়ে ছোট ছোট রান সেলাই দিয়ে। আর বেগুনিটার একটা দিক বেঁধেছে মরচে পড়া গ্রিলে আর একটা দিক ঘুণ পোকা লাগা আলনায়। তৈরি হয়েছে দোলনা। বাচ্চাটার কোন জ্বালা নেই। পেটভরা থাকলেই হাত-পা নেড়ে খেলা করে। যেন বুঝে গেছে এ সংসারে থাকতে গেলে জ্বালাতন করা চলবে না, সবার মেজাজ বুঝে চলতে হবে। 

কিন্তু সে রাতে কি হয়েছিল কে জানে কান্না কিছুতেই থামছিল না। মাঝরাতে ওমন কান্নার চোটে বাবলি আর বিল্টু তো রেগেই অস্থির। অঞ্জুও নাজেহাল। হাত মুঠো করে সেকি চিল চিৎকার! বাইরে তখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। এত ঘন সেই বৃষ্টি যে মজুমদারদের সবুজ রঙের চারতলা বাড়ি, তিনখানা বড় সুপারি গাছ কিছুই আর ঠাহর করা যাচ্ছিল না। বুকের ওমে জড়িয়ে নিয়েছিল শিশুটাকে অঞ্জু ,বড় অসহায় লাগছিল ওর নিজেকে। হঠাৎ চোখ যায় বাইরে। শিরশির করে গায়ে পদ্মকাঁটা ওঠে, শীতল স্রোত সাঁতার কেটে নেমে যায় শরীর জুড়ে, দেখে ডানা মেলে উড়ে এসে ঐ দুটো কাক চুপচাপ গ্রিলের পাশে এসে বসল। 

ওদের গা থেকে জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে। এলোপাথাড়ি বৃষ্টিতে ভিজে ঝুপ দুটোই। কিন্তু একবারও চেষ্টা করছে না ডানা ঝাপটে সে জল ঝেরে ফেলতে বরং দুজনেই বড় উৎকণ্ঠা নিয়ে চেয়ে আছে বাচ্চাটার দিকে। ঠিক অবলা প্রাণীর দৃষ্টি নয় সেটা, সে দৃষ্টি কথা বলে। কালো কষ্টি পাথরের মতো চোখ দুটোতে যেন জলের ফোঁটা ধরানো। কারা ওরা! শুধুই কি দুটো কাক? তবে ওরা এসে বসতেই আশার মেয়ে এমন চুপ করে গেল কেন? কাপাস ফাঁটা নরম সুতলির মত এক চিলতে হাসি যেন ফুটে উঠল শিশুটার মুখে। যেন‌ এতক্ষন ধরে যার জন্য বায়না করছিল সে জিনিসটা হাতের কাছে পেয়ে গেছে! মেয়েটা ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত উড়ে গেল না কাকদুটো।

অঞ্জু আর ঘুমোতে পারল না। শেষ রাতে ওদের উড়ে যাওয়া পথটুকুর দিকে তাকিয়ে আচমকা ডুকরে উঠল।
....................................
 
অলঙ্করণ :-  পায়েল খান 

 

উত্তরন - ভবেশ দাস

 


উত্তরন 

 ভবেশ দাস  

 


 

                        

                                                            -১-
 
রুটির দোকানে উবু হয়ে বসে চটপট করে রুটি বেলছে কমলা।  তারই সাথে তাল মিলিয়ে ঝপাঝপ করে গনগনে আঁচে রুটি সেঁকেও নিচ্ছে। আগুনের তাপে নাকে মুখে ঘামের ফোঁটা জমে কালো মুখটা বেশ চকচক করছে এই হিমের রাতেও। দোকানের মুখটাতে বেশ ভিড় জমেছে। তাদের মধ‍্যে কেউ একজন চেঁচিয়ে বলে ওঠে, "কিগো কমুমাসি আমারটা হল, তখন থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছি।"  "এই যে দিচ্ছি বাবা একটু সবুর কর। তাড়াহুড়ো করলে কাল এসে বলবি মাসি তোমার রুটি কাঁচা ছিল। ভালো করে রুটি সেঁকেও দাওনি।" কথাটা বলেই আবার খুন্তি দিয়ে চাটুতে রুটি উল্টাতে থাকে কমলা। 

দোকানের বাইরে একদল ছেলেবুড়ো খরিদ্দার ভিড় করে দাঁড়িয়ে কী সব এন.আর.সি , সি.এ.এ নিয়ে আলোচনা করছে। কমলা এসব বোঝেও না বোঝবার চেষ্টাও করে না। 

রুটির দাম দিতে গিয়ে একটাকার ছোট কয়েন দিল ছেলেটা। সেটা নিয়ে কমলা মুচকি হেসে বলল,”তুই দিচ্ছিস দে। আমি নিলাম কিন্তু তোদের ফেরত দিতে গেলেই, না বলিস না বাবা। আজকাল ভিখারিও ছোটকয়েন নিতে চায় না।“ কথাগুলো বলেই আবার রুটি বেলতে লাগল কমলা। চাকিতে বেলুন দিয়ে আটার লেচি বেলে রুটিতো নয় যেন পূর্ণিমার চাঁদ তুলছে কমলা। 

ঠিক এইভাবেই সন্ধে ছ'টা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত রোজ রুটির দোকান চালায় কমলা। সকালের দিকটা চা,বিস্কুট,পাউরুটি, ঘুগনি আর বিকাল থেকে শুধুরুটি।  তবে চা করে বিকেলেও এক ফ্লাস্ক রেখে দেয়। একা হাতে আর কতদিক সামলাবে। 

৩৬৫দিনই তার জীবনের আহ্নিক গতি রুটির ঘূর্ণনের মতো ঘোরে।
                                    
                                                      -২-

মফস্বল শহরে এখন বাড়ির বৌরা সব বিবি হয়েছে। কেউ প্রয়োজনে কেউ অপ্রয়োজনে। যাদের টোনা-টুনির সংসার অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী দু'জনে চাকরি করে তাদের তো কমলার দোকানে মাস কাবারি রুটির হিসাব করাই থাকে। কিন্তু যে সব স্ত্রীরা সারাদিন বাড়িতে থাকে তারাও সন্ধের পর থেকে টিভি সিরিয়ালের সৌজন্যে রান্নাঘর মুখো হতে চায় না। অফিস ফেরত বাড়ির কর্তাটিকে মুঠোফোনে আদেশ করা হয় এই বলে, " কিগো বাড়ি আসার পথে কমলার দোকান থেকে দশটা রুটি নিয়ে এসো। আমার গা'টা কেমন ম‍্যাজম‍্যাজ করছে। আটা মাখতে পারবো না। ট্রেনে বসে বসে ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে রুটি আনতে ভুলে যাও যদি তবে কিন্তু ভাত গিলতে হবে।" স্বামী বেচারা আর কী করে, যুগধর্ম মানতে বাধ‍্য তারা। কারণ রুটি না নিয়ে গেলে বাড়ি ঢুকে এককাপ চা তো দূর, চাঁদবদনীদের হাসিমুখগুলো কপূর্রী ঠাকুর হয়ে, উবে যায়।  গিন্নীরা তখন সিরিয়ালের 'রাসমনি'র মতো এমন দাপট দেখায় যে সংসারে 'স্বামী কেন আসামী' সিনেমাও হিট হয়ে যায়।

আবার কোনো কোনো স্বামীর রাতে রুটি না হলে সকালে কোষ্ঠ সাফ হয় না। তাতে বায়ুর নিন্মগতি প্রাপ্ত হয়। যাতে ভদ্রসমাজ নাকে রুমাল চাপা দেয়।

এও এক পরিবর্তন। সময়ের সাথে সাথে আরো কত পরিবর্তনের সাক্ষী থাকে কমলা। মনে মনে হাসে আর বলে, তা বাপু বেশ, তোমরা বিবিয়ানি করো তাই আমরা খেটেখুটে পেট চালাতে পারি।
                             
                                                  - ৩-                                                  

রুটির দোকান বন্ধ করে কমলা বাড়ি ঢোকার আগে তেমাথার মোড়ে বুড়ো অশ্বত্থ গাছের নিচে ষষ্ঠীর থান বলে কপালে হাত ঠেকায় ভক্তিমনে। অশ্বত্থ গাছটার ডানদিকে বড় পুকুরটা মজে গিয়ে এঁদো ডোবায় পরিণত হয়েছে। তাই কমলার মনে ভারি দুঃখ হয়। সে ভাবে সময়ের সাথে সাথে ভরন্ত সংসারও এই ভাবেই মজাপুকুরে বদলে যায়। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়িতে ঢুকেই বিছানায় শোয়া অসুস্থ স্বামীর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে। 

আজকাল কমলার স্বামী একসময়ের তেজিয়াল অজিত দত্ত এখনও কথায় কথায় কমলাকে ঝাঁঝিয়ে উঠে গালমন্দ করে। কমলার তাতে মান অভিমান তো দূর, কোনো বিরক্তিবোধও নেই। সেই ছোট থেকে জ্ঞান হওয়া ইস্তক শুনে এসেছে মায়ের মুখে। মেয়েদের স্বামী ছাড়া গতি নেই। পতি পরম গুরু। 

আজ অনেকদিন বাদ মায়ের কথা মনে পড়ল কমলার। উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জে সুভাষ কলোনিতে তার বাপের বাড়ি। মার মুখে শুনেছিল,তার বাপ-মা ওপার বাংলার মানুষ। রায়টের সময় প্রাণের ভয়ে চলে এসেছে এদেশে। যদিও তার জন্ম রায়গঞ্জেই হয়েছে।  অগ্রহায়ণ মাসে নবান্নের সময় জন্মেছিল বলে,পাড়ার লোকে মাকে বলেছিল, "তোমাগো ঘরে লক্ষ্মী আইসে।" 

এখন পুরোনো কথাটা মনে পড়তেই কমলা মনে মনে একটু হেসে নিল। তারপর ভাবলো হেমন্ত ঋতুতে জন্ম বলে তার জীবনটাও হেমন্তর মতো হারিয়ে গেছে।  

শরত ও শীতের চাপে পড়ে অস্বিস্তহীন হয়ে আছে হেমন্ত। 

দুইদিদির পরে আবার মেয়ে জন্মেছিল বলে ছোটথেকেই অনাদর, অবহেলায় বড় হয়েছে। তারউপর গায়ের রং ছিল কালো। তাই তার মা মাঝে মাঝেই বলত কপাল চাপড়ে," আমার প‍্যাটেই ক‍্যান যে হইলি পুড়াকপালী! তোর নগে আমার জীবনটাও ভাজাপুড়া হইয়া গেল গ‍্যা।" এসব চিন্তা ভাবনায় কমলার রাতের ঘুমটা ঠিক মতো হল না। 

পরের দিন বিকালে বাড়ি থেকে দোকান আসবার সময় কমলা দেখে পাড়ার মেয়েরা খেলছে, "এলাটিং বেলাটিং সইলো, কিসের খবর হইল।" কমলা মনে মনে হাসে আর ভাবে সময় এগিয়ে গেছে কত। সবার হাতে এখন বড় বড় ফোন তবুও এক টুকরো পুরোনো স্মৃতির মতো তাদের এলাকায় রয়ে গেছে হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলা। 
কমলার মনে পড়ে যায় এই খেলার কথা। আর তার সাথে খেলার মহাত্ম্যের কথা। 

একটু বড় হতেই বেড়াল পার করবার মতো কমলার বিয়েটা হয়ে যায় অজিত দত্তের সঙ্গে। অজিত দত্ত তখন লিলুয়ার কোনো এক লেদ কারখানায় কাজ করতো। হাট্টাকাট্টা যুবক পুরুষ। গায়ের রং কালো হলেও কমলার মুখে লালিত‍্য ছিল। বড় বড় চোখে ছিল মায়াকাজল। একমাথা কোমর ছাপানো চুল। অজিত দত্তের মা এই দেখেই কমলাকে ছেলের বৌ করে এনেছিল। রগচটা ডাকাবুকো অজিত দত্ত প্রথম জীবনে কমলাকে ভালোবাসা, আদর, আবদার সবই দিয়েছিল কমলা বাধ‍্য মেয়ে বলে। আর ছিল শাশুড়ির ভালোবাসা। 

নিয়তিদেবী কমলার ভাগ‍্যটা খুব যত্ন করে  গড়েছে। 

বিয়ের বেশ কিছু বছর পরে একটি ছেলে বিপুল ও মেয়ে পূজাকে নিয়ে কমলার যখন ভরাট পাঁচজনের সংসার। ঠিক তখনই অজিত দত্ত বিছানায় পড়লেন। ম‍্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। ডানদিকের হাত-পা প‍্যারালাইসড।   কমলা তখন আতান্তরে। কী করবে ভেবেই কুল কিনারা করতে পারে না। শাশুড়ি তখন সাহস দিয়ে বললেন, " শক্ত হ মা। তোকেই হাল ধরতে হবে। মেয়েরা সারা জীবন ত‍্যাগ স্বীকার করে। তোকে ভগবান পরীক্ষায় ফেলেছে। তোর উপর আমার অগাধ বিশ্বাস। তুই সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ন হবি।" 

অসুস্থ স্বামী ও দুই বাচ্চাকে শাশুড়ির জিম্মায় ফেলে রেখে আয়ার কাজ নিয়েছিল কমলা। কিন্তু বিধিবাম। দিনের বেলায় কাজ তবুও মেনে নিয়েছিল অজিত দত্ত। কিন্তু নাইট ডিউটি শুরু হতেই বিছানায় শুয়ে শুয়ে তরপানি শুরু হল, "কার সাথে সারারাত ফস্টিনষ্টি করে এলি নষ্ট মেয়ে মানুষ।" প্রথম প্রথম কমলা কেঁদে ভাসাতো। শাশুড়ি এসে আড়াল করতো কমলাকে। কিন্তু দিনের পর দিন ছেলেমেয়ের সামনে এই অপমান মেনে নিতে পারলো না। আবার প্রতিবাদ করতেও পারলো না। 

তাই আয়ার কাজে ইতি দিয়ে এই পালপাড়া অঞ্চলেই দুবাড়ি রান্নার কাজ নিল। তাতেও যখন সাংসারের অভাব মেটাতে পারে নি তখন সাহস করে এই রুটির দোকান দেওয়া কমলার। 
                               
                                                      -৪-
         
আজ বৃহস্পতিবার। আজকের দিনটাই কমলা একটু বেলা করে দোকান খোলে। বৃহস্পতিবার সকালটা কমলার জীবনে একটু আনন্দ ডেকে আনে।  ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই অসুস্থ স্বামীকে 
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে নিজে স্নান করল কমলা। তারপর একটা ফিকে রংয়ের ছাপা শাড়ি পরে, চুল আঁচড়ে বিনুনি বাঁধলো। কপালে ছোট করে সিন্দুরের টিপ পড়ল। মাথার সিঁথিতে সিন্দুরের রেখা টেনে হাতের নোয়ায় সিন্দুর ঠেকালো। 
ঘরের মধ‍্যে পরিপাটি করে গোছানো সিংহাসনে মা লক্ষ্মীর পটে ঘট পেতে বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মীপুজো করল। না পাঁচালি পড়ার মতো বিদ‍্যে বা সময় কমলার নেই। কিন্তু ভক্তিশ্রদ্ধা আছে। এককাপ চা স্বামীকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও চাখেয়ে কমলা লোনে গেল। 

'বন্ধন' ক্ষুদ্রঋণ গোষ্ঠীর লোন। গ্রুপের নাম 'উৎসাহ'।  তাদের পাড়াতেই টিনাদের বাড়িতে প্রত‍্যেক সপ্তাহে লোন বসে। হপ্তা প্রতি লোনের কিস্তি শোধ করতে হয়। আগে গ্রুপটা ছোট ছিল। এখন আড়ে-বহরে বেড়েছে। আসলে 'বন্ধন' যবে থেকে নিজেও ব‍্যাঙ্ক হয়ে গেছে তবে থেকে এই গোষ্ঠীও আকারে আয়তনে বেড়েছে। তাতে কমলার ভালোই লাগে। তাকে সবাই মাসি মাসি বলে ডাকে। লোনের স‍্যার আসার আগে সকলের মুখে তাদের সংসারের সুখদুখের গল্প শুনে নিজের কষ্টটা জলো লাগে কমলার কাছে। মাঝে মাঝে লঘু হাসিঠাট্টাও হয়। তবে আজ টিনা গ্রুপের সব মহিলাদের বুঝিয়ে বলছে সেই আগে শোনা,এন. আর, সির কথা।
চুপচাপ স্বভাবের কমলা টিনাকে জিজ্ঞেস করল,
" হ‍্যাঁরে মা টিনা এটা কী রে? এই এন. আর.সি।"
টিনা কলকাতার কলেজে পড়া মেয়ে ভালো শ্রোতা পেয়ে অনেক কথা বোঝালো কমলাকে। যার মোদ্দা কথাটুকু ধরলে এটাই দাঁড়ায়,  ভোটারকার্ড আধারকার্ড থাকলেই তুমি এ দেশের নাগরিকত্বের দাবীদার নও। এমনকি এখানে জন্মালেও এ দেশের নাগরিক হবে না।  তোমার বাবা মাকেও এদেশে জন্মাতে হবে। কথাটা শুনে কেউ একজন বলল," ওসব গুজব। আসলে প্রতিবেশী দেশের সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব দেবার নিয়ম এন.আর.সি।"
টিনার সাথে তার জোর তর্ক বেঁধে গেল।
   
কোনটা ঠিক কোনটা ভুল তা কমলা জানেনা। কিন্তু মনটা কু ডাকল তার। কথাটা শোনার পর থেকেই  নিরীহ কমলার মনে একরাশ চিন্তা ঢুকে গেল। তবুও নিজেকে কাজের মধ‍্যে সংসারের দায়িত্বে ডুবিয়ে দিল।

লোনের কিস্তির টাকা দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে মনে টিনার মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় কমলার চোখদুটো জলে ভরে উঠল। যদি ঠিক সময় মতো টিনার মা  'বন্ধন' এর লোনের কথা না বলতো, তবে কমলার রুটির দোকান আর হতো না।  প্রত‍্যেক বছরে লোন নিয়ে নিয়ে কমলা দোকানের ব‍্যবসা বাড়িয়েছে। পৌরসভার সরকারি বাড়ি প্রকল্পের ডিপোজিট মানি জমা দিয়ে বাড়ি বানিয়েছে। বিপুল বড় হতে তাকে টোটো কিনে দিয়েছে। পূজার বিয়ে দিয়েছে। এমনকি শাশুড়ি মারা যাবার পর তার শ্রাদ্ধশান্তির কাজটাও একটু ঘটা করে লোনের টাকাতেই করেছে। শাশুড়ির উপর একটু টান বেশি কমলার। জগতে ওই একটা মানুষই তাকে বুঝতো। 

বন্ধনের লোন  ও রুটির দোকান কমলার জীবনে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে আছে।
    
                                                     -৫-

 প্রত‍্যেক শনিবার পালপাড়া অঞ্চলে ভিখারিরা ভিক্ষা করতে আসে। ওদের এলাকা অনুযায়ী দিন ঠিক করা থাকে। কমলা আজকের দিনে একজনের অপেক্ষায় থাকে। না সে ঠিক ভিখারি নয়। সে বাউল। উমা দাস বাউল। গায়ে গেরুয়া শাড়ি। সঙ্গে গেরুয়া সুতির চাদর চাপা থাকে।  নাক থেকে কপাল পর্যন্ত রসকলি। বগলে খোমর চেপে আঙুলে করে তার টান দিয়ে গলা ছেড়ে গান ধরে বুগবুগির আওয়াজের সাথে,

" তুমি ভেবেছো কী মনে, এই ত্রিভুবনে
   তুমি যাহা করে গেলে কেউ জানেনা

    বারে বারে আর আসা হবে না।

    এমনও মানব জনম আর পাবে না
     বারে বারে আর  আসা হবে না।"

গানটা শেষ করেই কমলাকে একগাল হেসে বলে ওঠে," পেন্নাম গো দিদি পেন্নাম। নিতাইয়ের কিরিপায় সব ভালো তো। তা দেখো কেনে, বাসি রুটি যদি এক আধখান থাকে তোমার দোকানে... তো  গরম চায়ের সাথ একটুন দাও কেনে।  ভারী জার পড়েছে ইবারে।  খিদেটো লেগেছে দিদি।তোমার দোকান থেকি বেরিয়ে নদীর ধারে একটুন বসে জিরোবো গায়ে রোদ মেখে।  বাকি সাথিরাও ওদিক পানে এসে জড়ো হবে।"

কমলা উমা বাউলকে যত্ন করে দোকানের বেঞ্চে  বসিয়ে চা রুটি খাওয়ালো। শেষে যাবার আগে পাঁচটা টাকা উমা বাউলকে হাতে দিল। উমা বাউল যতক্ষণ ছিল ততক্ষণ কমলার মুখে এক তৃপ্তির হাসি ঝুলে ছিল। কত নতুন নতুন জায়গার খবর দেয় উমা বাউল। কত নতুন মানুষ। কত রকম তাদের স্বভাব। এগুলো শুনে কমলার মন আকাশ কুসুম ভাবে। যদি সে পাখি হত তবে উড়ে যেত সেইসব জায়গায়। তার জীবনটা কুয়োর ব‍্যাঙ হয়েই কেটে গেল। তবুও মুখ ফুটে কারো বিরুদ্ধে কখন অভিযোগ নেই কমলার।

বড়রাস্তার ধারে রোজের হিসাবে ভাড়ার গুমটি দোকান কমলার।  আজ আবার সরকারি দপ্ত‍র থেকে রোড মাপাজোখ হচ্ছে।  রাস্তা না কি চওড়া হবে। গুমটি সব ভাঙা হতে পারে।

এইসব দেখে কমলার মন খারাপ আরো বেড়ে যায়। উমার গান শুনে যে আনন্দটুকু হয়েছিল সেটাও মিলিয়ে যায় একনিমেষে।

                                                       -৬-

বিপুল টোটো চালাতে চালাতে এই পালপাড়ারই এক উঠতি প্রোমোটারের মেয়েকে প্রেমে করে বিয়ে করেছে। আসলে বিপুল হল মাকালফল। দেখতে সুন্দর। কিন্তু ব‍্যক্তিত্ব থেকে বিদ‍্যাবুদ্ধি কোনটাই তার নেই। তাই বাপের এক মেয়ে রিচা, বাপের  আদরের দুলালী বিপুলকে ঘরজামাই করে রেখেছে।
মাঝে মাঝে কমলার রুটির দোকানে এসে উদাত্ত কন্ঠে রবীন্দ্র সংঙ্গীত গাওয়ার মতো করে "মা..." বলে ডাকে। আর টাকা চায়।  আর কমলাও মমতামাখা চোখে বিপুলকে দেখে গলে জল হয়ে কিছু টাকা হাতে দেয়। 

হঠাৎ করে এতদিন রোগভোগের পর অজিত দত্ত মারা গেল এক ম‍্যাড়মেড়ে বুধবারে ঘুঘু ডাকা দুপুরে। কমলা তখন সদ‍্য দোকান থেকে এসেছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার লোনের কিস্তির টাকা গুছিয়ে রাখছিল ঠিক সেই মুহূর্তে, অজিত দত্ত হেঁচকি তুলে তার জীবনাবসান ঘটালো। 

পূজা শ্বশুরবাড়ি থেকে জামাইকে সঙ্গে করে এল। 
বিপুল এল রিচাকে নিয়ে। পূজাই একটু বাবার জন‍্য হাউমাউ করে কাঁদলো। কমলা সব দেখছে। কিন্তু চোখে জল তার আসছে না। তবে কি শোকে পাথর হয়ে গেল কমলা?

রিচার বাবাই সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিল। অন্ত‍্যেষ্টি কাজ দ্রুত শেষ হল। 

অজিত দত্তের মৃত‍্যু সংবাদ ও শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন
দেবার জন‍্য পূজা আত্মীয় স্বজন কে ফোন করল।
পূজার দুই মাসি। একজন রায়গঞ্জে থাকে। আর এক মাসি আসামের ধুবড়িতে থাকে। সবার শেষে আসামের মাসিকে ফোন করে পূজা ফোনটা কমলাকে ধরিয়ে দিল মায়ের মনটা হালকা করতে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আর এক। 

আসামের মাসি ফোনে কমলার গলা পেয়েই আর্তনাদের মতো করে বলল, "ভৌনটি আমি কীবা নমরি বাঁচি আছো। তোর ভিনদৈয়ক ডিটেনশন ক‍্যাম্পত আটক করি থৈছে। কেনেকৈ জীয়াই থি থাকিম কোয়া? এন.আর.সিয়ে সকলো শেষ করি দিলে, শেষ হৈ গল আমার সংসার।" কমলা আবার এন.আর.সির নামটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। মেয়েকে ফোনটা দিতেই লাইন হট করে কেটে গেল।

তেরো দিনে ঘাটকাজ, তারপরের দিনে শ্রাদ্ধ ও শেষে আঁশপান্না বা মৎসমুখী হয়ে বাড়ি যখন ফাঁকা, তখন কমলার মনটা হু,হু করতে লাগল।

অনেকদিন বন্ধ থাকার পর দোকান খুলেছে কমলা। মনমরা হয়ে দোকানদারি সামলে রাতে বাড়ি ফিরে কমলার ভালো লাগে না ঘরে। অজিত দত্তের গালমন্দ শোনা শেষের দিকে অভ‍্যেসে পরিণত হয়েছিল। ভালোমন্দ যেমনটি হোক। বিছানায় অসুস্থ হয়ে পরে থাকতো। তবুও কেউ তো কমলার জন‍্য অপেক্ষা করতো। বাড়ি ফেরার একটা তাগিদ তো ছিল কমলার জীবনে। আজকাল বড়ই একাকিত্ব নিঃসঙ্গতায় ভোগে কমলা। শাশুড়িমার কথা মনে পড়ে খুব। সব থেকেও আজ কমলার জীবনে কিছুই নেই।

                                                          -৭-

আজ আবার বৃহস্পতিবার। কমলা যথারীতি লোনে গেছে টিনাদের বাড়ি। বদলানোর মধ‍্যে বেশভূষা বদলেছে। অন‍্যদিনের মতোই সবাই কমলাকে "মাসি মাসি" বলে এটা ওটা শোনাচ্ছে।
আজকে লোনে নতুন স‍্যর এসেছেন। কিস্তি জমা দেবার পর নতুন স‍্যর বললেন," কমলা দত্ত কার নাম?"
কমলা নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলল,"আমি স‍্যর।"
স‍্যর গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন, " আপনার বয়স ষাট হয়ে গেছে। অতএব আপনার নামে আর লোন স‍্যাংশন হবে না। আর দুটো কিস্তি শোধ হয়ে গেলে আপনাকে আর গ্রুপে আসতে হবে না।"

কমলা হতভম্ব হয়ে গেল। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো অবস্থা কমলার। যদিও ইদানিং লোনের টাকার প্রয়োজন ফুরিয়েছে তবুও দীর্ঘদিনের অভ‍্যেস। এই 'উৎসাহ' গ্রুপের সাহচর্য।  কমলা এবার কী নিয়ে থাকবে এই ভাবতে ভাবতে কোনোরকমে বাড়ি পৌঁছালো। 

অজিত দত্ত যে বিছানায় শুয়ে থাকতো সেই বিছানায় শুয়ে গলা ছেড়ে কাঁদলো অনেকক্ষণ। 
কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। 
সেই ঘুমের মধ‍্যে স্বপ্নে শাশুড়ি এসে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, " অনেক করেছিস মা এই সংসারের জন‍্য এবার মুক্তি নে।" 
ঘুম ভেঙে গেছে কমলার। দু'গালে জলের দাগ। এই কদিনেই আঁটোসাঁটো চেহারা ভেঙে আলুথালু হয়ে গেছে।  

কমলা নিত‍্যদিনের অভ‍্যেস বশে দোকান যায় না। আজ পর্যন্ত দোকান বন্ধ যায়নি কোনদিন। খালি গুরুদশার কটা দিন বাদ দিয়ে।

কমলা ভাবতে বসে, তার আর কিছু নেই।  তার লোন নেই। দোকান ভাঙা পড়ে রাস্তা চওড়া হবে। তাই দোকানও নেই। ছেলে মেয়ে থেকেও নেই। স্বামী নেই। বন্ধু নেই। রিফিউজি বাবামায়ের মেয়ে বলে তার নাগরিকত্ব থাকবে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে!

তার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতে চলেছে। আর ভাবতে পারে না কমলা। একবার হাহা করে হাসে এক হাউ হাউ করে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পরে। এইভাবে দু'দিন কেটে যায় নিমেষে। কেউ এতটুকু খোঁজ করে না কমলার। 

                                                    -৮-

শেষ চৈত্রে অতিরিক্ত গরম পড়েছে। কালবৈশাখীর দেখা নেই। বসন্তর কোকিলের কুহুতান কাকের ডাকের মতো কর্কশ শোনাচ্ছে। এখন শনিবারের বারবেলা পড়ে গেছে। আকাশের নৈঋত কোণে কালো মেঘ জমেছে।  খর বারে ঘোর অমাবস‍্যা। এ কিসের পূর্বাভাস!

কমলা ঘর থেকে বেরোয়। চোখের চাওনি ঘোলা। তিনদিনের উপোসী শরীর শুকিয়ে পাকিয়ে গেছে।  উন্মাদের মতো একমাথা রুখু কাঁচাপাকা চুল এলোকেশির মতো উড়িয়ে মলিণ হয়ে যাওয়া তিনদিনের বাসি কাপড় পরনে উদভ্রান্তের মতো পালপাড়া দিয়ে কমলা ছুটে যায় নদীর দিকে। 
নদীর পাড়ে এসে মনে মনে বলে, মাগো চরণে ঠাঁই দাও। বলেই নদীর জলে ঝাঁপ মারতে উদ‍্যত হয়। 

ঠিক সেই মুহূর্তে উমাদাস বাউল  পেছন থেকে কাঁধে হাত দিয়ে দু'চোখে বিশ্বাস ও আস্থা জাগিয়ে বলে, " দিদিগো আত্মহত‍্যা মহাপাপ নরকে গমন।" 

উমাদাস বাউল কমলাকে বুঝিয়ে  বলে," আমরা বাউল। সাধন ভজন করি আর আখড়াতে থাকি বট‍্যে।  দেশ, সময় আমাদের আটকে রেখে রসটো পাবে নাখো। তুমি আমাদের সাথকে চলো।"

উমাদাস বাউল কমলাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে মুখে তার গান, 

" এমন মানব জনম আর কি  হবে
    মন যা করো ত্বরায় করো এ ভবে
অনন্ত রূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই
শুনি মানবের উত্তম কিছুই নাই
      দেব-দেবতাগণ করেন আরাধন
            জন্ম নিতে মানবে।
মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে..."

---------------------------------×-------------------------------
 

 

মায়াটান - বাপ্পাদিত্য দাস

 

মায়াটান
বাপ্পাদিত্য দাস 
 

 



নিঃসঙ্গতার দোসর যখন নির্জনতা, অবসাদ তখন দখল নেয় পরিসরের, খিদে উবে যায়.. ঘুম পায়.. মনে উঁকি দেয় অমোঘ জিজ্ঞাসা.. বেঁচে থেকে কি হবে ? 

এখানে এসে থেকে এরকমটা হচ্ছে | 

তবে এখানে আমার কিছু বন্ধুও হয়েছে.. আকাশ, গাছ, পাখী, কাঠবিড়ালী, প্রজাপতি, গুবরে পোকা ..   আমার শহরে শুধু ইট কাঠ কংক্রিট আর  দৌড়ে বেড়ানো মানুষের ভীড় ছিল.. বন্ধু ছিলনা |

আমি সাধারণ,  মধ্যমেধার মানুষ |  ছাপ ফেলার মত কিছু করতে পারিনি জীবনে | আমি ভিড়ে মিশে থাকা সেই লাখো মনিষ্যি দের একজন,যাদের একটা নামই আছে শুধু |  চারপাশে সবাই কমবেশী ব্যাস্ত, শুধু আমার অখন্ড অবসর | পৈত্রিক বাড়ীর ভাড়া আর বাবার রেখে যাওয়া কিছু টাকা, আমার চলে যেত  | কোন কাজ খুব বেশীদিন ভালো লাগতো না, তাই কখনো কাজ আমায় ছাড়ত কখনো আমি কাজকে |

বন্ধুবান্ধব সবাই  নিজের নিজের জীবনে শিকড় গেড়ে বসেছে | কত ব্যাস্ততা তাদের.. কত গল্প.. বউয়ের টকঝাল খুনসুটি, সন্তানের স্কুল, পরীক্ষা, ভবিষ্যত | পরকীয়া, অবদমিত যৌনেচ্ছা.. সুগার, প্রেসার, আমাশা..ফ্ল্যাটের ইএমআই, গাড়ীর মাইলেজ .. বসের শয়তানি, বকেয়া ডিএ ..  কত্ত বিষয়, যা আমার নেই | তাই একসময় আরও একা হয়ে পড়লাম | 

একা থাকতে মাঝেমাঝে ক্লান্ত লাগত |  মনে হত, যদি একটা সংসার থাকত.. একটা মিষ্টি মত বৌ, 'পরনে ঢাকাই শাড়ী কপালে সিঁদুর',  ছেলেপিলে,  দায়িত্ত্ব, ঝগড়াঝাটি, অভিমান .. ভালবাসা আর কিছু ভীতু স্বপ্ন ! পরক্ষণে হাসি পেত | আমার মত লোকের আবার স্বপ্ন !

হঠাৎই এই চাকরীর সুযোগটা  এসেছিল |

আমার ভাড়াটে ছেলেটি একদিন বললো ..

- দাদা আজকাল কি করছেন ? 

কঠিন প্রশ্ন | যদি বলি কাজ করছি, তো কি কাজ ? কোথায় অফিস ? কত দেয় ?  যদি বলি কিছু করছিনা, তবে কেন করছেন না ? না করলে চলছে কি করে ? একঝুড়ি কথা .. আমার বেশী কথা বলতে ভালো লাগেনা .. তাই হুঁ হা করে এড়িয়ে যাব ভেবেছিলাম, কিন্তু সে ছেলে ছাড়লে তো ?

- একটা কাজ আছে , করবেন ?

এইরে ..আমার মত লোকের জন্যও কাজ ?

- আমাকেই বলছ কেন ? কাজের লোকের তো অভাব নেই ..

- না মানে .. ওরা একজন পিছুটান হীন লোক চাইছেন .. 

ঠিক | আমার  জীবনটা নিয়ে আমি যা খুশী করতে পারি, আমার কারো প্রতি কোনো দায় দায়িত্ব নেই..  কেউ বসে থাকেনা পথ চেয়ে | আমার না আছে শিকড়, আমার শুধু বন্ধ্যা পরিসর  |

আমি পিছুটান হীন |

আত্মোপলব্ধি.. একটা চিনচিনে ব্যাথা মেশানো মজা পেলাম | 

এখন আমি শহর থেকে দূরে, শাল মহুলের জঙ্গলে ঘেরা  জনপদে একটা আবাসিক স্কুলের কেরানী | ছাত্ররা বেশির ভাগই ছাত্রাবাসে থাকে |  হিসেবনিকেশ দেখা, খাতাপত্র লেখা, ছেলেপুলে গুলোর ওপর নজর রাখা, এইসব আমার কাজ  | থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ছাত্রাবাসেই | আমার জন্য বরাদ্দ ঘরটি  চমৎকার | জানলা খুললেই অনেকটা সবুজ জমি, ঢালু হয়ে মিশেছে গভীর জঙ্গলে যেখানে একটা বিশাল জলা আছে শুনেছি | রাতে ছাত্ররা খেয়ে শুয়ে পড়লে আমি ছাদে গিয়ে বসি  |  জঙ্গলের শব্দ শুনি.. গাছেদের ফিসফিসানি, রাতচরা পাখী আর অচেনা জন্তু জানোয়ারের ডাক, আর সব ছাপিয়ে কানে আসে জলের আওয়াজ, ছলাৎ ছলাৎ করে পাড়ে আছড়ে পড়া ছোট ছোট ক্ষণভঙ্গুর ঢেউয়ের  ডাক | রাত যত গভীর হয়, তত ওখানে জেগে ওঠে  অলৌকিক শব্দেরা.. ডাকে.. 

আমি একদিন যাব.. যেতেই হবে.. ওইখানে |

আজ ঢালু  জমিটায় শেষপ্রান্তে  এসে বসেছি | এখান থেকে বড় গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে আবছা দেখা যায় জলাটা  | আমার ভিতর এখন সেই  ইচ্ছেটা পাক খাচ্ছে .. চলে যাই এসব ছেড়েছুড়ে  জঙ্গলের গহীনে ওই জলাশয়ের কাছে | স্কুলের মাষ্টাররা  বারণ করেছেন যেতে .. সাপ খোপ, বুনো জন্তু সব  আছে ওদিকে.. আরও কিছু আছে ও জলায়.. ভয়ানক.. যারা আগে সাহস করে গেছে, কেউ কেউ ফেরেনি.. রান্নার মাসী বলে জলাটা ভূতুড়ে..  মায়াটান আছে .. নিশির ডাকের মত মানুষকে ভুলিয়ে টেনে নিয়ে যায় |

এখন শেষ বিকেল ..  লোকজন গরু ছাগলের খুঁট ধরে বেরিয়ে আসছে জঙ্গল থেকে .. মাথায় ঝরা শালপাতার বোঝা, অন্য হাতে কাঠকুটো .. কলকল করতে করতে ঘরে ফিরছে.. টুকরো কথা, হাসি, ছাগল গুলোর গলায় বাঁধা ঘন্টার টুংটাং আওয়াজ শোনা যাচ্ছে | ওদের পায়ে পায়ে মেঠো পথে ধুলো উড়ছে .. প্রাচীন গাছগুলোর মাথায় আগুনরাঙা  সূর্য ধীরে নেমে আসছে .. আমার  বিবশ মনে আছড়ে পড়ছে পাড়ে ধাক্কা খাওয়া জলের শব্দ .. ছলাৎ .. ছলাৎ .. 

ঘোর ভেঙে দেখি একটা ছোট্ট ছেলে ..  বছর দশেক বয়েস.. আদুল গা, একহাতে ঢলঢলে হাফপ্যান্টটা ধরা, অন্য হাতে একটা মাছ ধরার ছিপ, হনহন করে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে একা | এই শেষ বিকেলে একা একটা বাচ্চা ছেলে ওদিকে..

- এই ছেলে ..  কোথায় যাচ্ছিস? 

চমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ছেলেটা, আমাকে দেখছে .. 
একমাথা রুখুশুখু চুল, শ্যামলা মুখটায় টানা দুটো চোখ .. কি ভীষন মায়া তাতে ..

- তুমি কে ?

- আমি ওই স্কুলে থাকি | 

- ও .. তুমি জলা দেখতে যাবে ? 

আমি অবাক .. আমার জলা দেখার ইচ্ছের কথা ও জানল কি করে ?

- তোর নাম কি ?

- ছোটু..

- বেশ.. তা তোর প্যান্টুটা কি ঢলঢল করছে ? হাত দিয়ে ধরে আছিস যে ?

- হুঁ ..

- দাঁড়া .. 

হাঁটু মুড়ে বসলাম, প্যান্টুটা ধরে ওর কোমরের ঘুনশীর মধ্যে দিয়ে গলিয়ে ওপর দিকে তুলে দিলাম.. এবার টাইট হয়ে আটকে রইল  কোমরে .. একগাল হাসি দিল ছোটু ..

- চলো তোমায় জলা দেখিয়ে নিয়ে আসি .. আমি মাছ ধরব ওখানে .. মা আর আমি খাব ..

- তা বেশ .. চল ..

ছেলেটা সরল আর মিশুকে..

- ঘরে তোরা কে কে থাকিস রে ?

- আমি আর মা ..

- বাবা ?

- নেই .. চলে গেছে .. আর আসে না ..

বুকটা হু হু করে উঠলো .. এতটুকু ছেলে .. বাবা নেই .. 

ছোটু মহা উৎসাহে আপনমনে হাত পা নেড়ে বকবকম করতে করতে হাঁটছে .. তাল রাখতে গিয়ে হাঁফিয়ে যাচ্ছি ..

- তা মাছ ধরবি যে, চার কোথায় ?

- এইতো .. 

পকেট থেকে ছেঁড়া কাগজে মোড়া একদলা মোটা লালচে ভাত বার করে দেখাল |

- আচ্ছা ..

আমরা জঙ্গলে ঢুকে পড়েছি .. খুব চুপচাপ চারদিক |  পাখীর ডাক আর বড় গাছগুলোর নীচে পড়ে থাকা শুকনো পাতার ওপর দিয়ে আমাদের চলার শব্দ, আর কোনও আওয়াজ নেই .. 

শুধু একটা গন্ধ.. ভেজা, গহন, গভীর প্রাচীন গন্ধটা ধীরে আমার ইন্দ্রিয়কে বশ করে আনছে .. কি মাদকতা এই গন্ধে .. আমি অস্থির হয়ে উঠছি.. যেতে হবে.. আরও কাছে যেতে হবে..

- উই দেখো জলা .. আমরা এসে গেছি গো ..

হঠাৎ যেন উঁচু গাছ গুলোর মাথা থেকে ঝুপ করে দলাদলা নরম অন্ধকার নেমে এলো নীচে .. সেগুলো কুয়াশার মতো ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের ঘিরে .. আমরা এখন জলের একদম কাছে এসে দাঁড়িয়েছি ..

ছোটু পাড়ের কাদা মাড়িয়ে জলে নেমে ভাত বেঁধানো বড়শীটা ছুড়ে দিল.. পাশে আমি.. ওর সাথেই নেমেছি..

জলে একটা আলোড়ন উঠলো .. দেখলাম তোলপাড় হচ্ছে জল .. ছোটুর ছিপে টান পড়েছে .. ও ছিপটা টেনে  পাড়ের দিকে আনতে চাইছে, পারছেনা.. উলটে গভীরে নেমে যাচ্ছে..

আমি উৎসাহ পেয়ে গেলাম .. কোন রাঘব বোয়াল গেঁথেছে নির্ঘাত .. ওর হাতের পাশ দিয়ে চেপে ধরলাম ছিপটা .. টানতে লাগলাম পাড়ের দিকে ..

পারছি না .. পারছি না দুজনে .. উল্টে নেমে যাচ্ছি গভীরে .. ভিতর পানে .. থকথকে কাদায় গেঁথে যাচ্ছে পা.. আঁধার গভীর হচ্ছে চারপাশে .. পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে জলজ গাছ, শ্যাওলা .. ছোটুর হাতটা ছেড়ে গেল বোধহয় .. শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ছিপটায় টান দিলাম আর তখুনি.. 

আমার চারপাশে এক অপার্থিব দৃশ্যের জন্ম হল.. 

চরাচর জোড়া মিশকালো আকাশ.. মাথার ওপরে, সামনে, চারপাশে.. সলমা জরির ফুলকারি কাজের মত ঝিকিমিকি তারা .. আমার কোমর অবদি ডুবে আছে সেই তরল কালো আকাশে .. চারপাশে একটা স্রোতের টান.. অনেকটা দুরে জলের মধ্যে বিশাল এক ঘুর্ণী.. দুরন্ত টানে টেনে নেবে সব.. আমি বুঝতে পারছি কিন্তু এই আকাশ জল জঙ্গল ঘুর্ণী সবটা জুড়ে কি এক অমোঘ মায়া  আমায় ডাকছে .. হাতছানি দিচ্ছে.. ফিশফিশ করে বলছে .. আয়.. গভীরে আয় .. পাড়ে কেউ নেই তোর জন্য অপেক্ষায়.. শুধু শুকনো তেষ্টা আর নিস্করুণ শূন্যতা.. এখানে আয় ..গভীর শীতলতা আর নির্জন নির্বান.. তোর জন্য |

আমি বুঝলাম, এই অমোঘ ডাক, এই 
টান, অস্বীকার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছি,  .. বিবশ হয়ে পড়ছি..  সেই গন্ধটায় চারপাশে ম ম করছে .. আমি ডুবে যাচ্ছি সেই আদিম গন্ধে |

- মাছ পেয়েছি গো.. কই গেলে..

- ছোটু .. কোথায় তুই ?

- এইতো আমি, 

অনেক কষ্টে পিছু ফিরলাম, ছোটু পাড়ে দাড়িয়ে, ওর হাতে ধরা একটা ছটফটে রূপোলি মাছ | ওর মুখে হাসি, ও ডাকছে আমায়.. আমার বুকটা হু হু করে উঠল.. আমি যেন দেখতে পেলাম তকতকে নিকানো মাটির উনুনে, কাঠকুটরো আর শুকনো ডালপালার আগুনে লোহার কড়াইয়ে মাছ ভাজা হচ্ছে, সেই গন্ধে ম ম করছে চারপাশ.. 

ছোটু বসে আছে ভাতের থালার সামনে..
ঘোমটা পরে কেউ খাইয়ে দিচ্ছে ওকে আদর করে |

তারপর সে আমার দিকে ফিরল ..

- আসুন, এবার আপনিও বসুন..

মুখে সলজ্জ হাসি,  কপালে সিঁদুর, সিঁদুরের গুঁড়ো তার নাকের ওপর পড়েছে, ঘামে ভেজা মুখ,  ফুলছাপ ব্লাউজের নীচে একজোড়া ভরন্ত বুক.. নিরাভরন  হাতে ধরা গরম ধোঁয়া ওঠা একথালা ভাত..

আমার জন্য |

আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো, গলার কাছে দলা পাকানো কি একটা ঠেকছে ..

শরীরের সব শক্তি দিয়ে পাড়ের দিকে এগোলাম | 

এখন আমার হাতে ধরা ছোটুর হাত .. ওর গা মুছিয়ে দিয়েছি আমার  জামা দিয়ে .. 

ছোটু বকবক করছে, ওর গাঁয়ের কথা, বন্ধুদের কথা, মায়ের কথা..

এখন আমার শান্ত মনে শুকনো ডাঙার নিশ্চিন্তি .. ছোটুর হাতের উত্তাপ আমার গা শুকিয়ে যাচ্ছে.. আমি যেন দেখতে পাচ্ছি কেউ একজন অপেক্ষা করছে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের থালা নিয়ে.. আমার জন্য | তাঁর 'পরনে ঢাকাই শাড়ী কপালে সিঁদুর'..

নিকষ কালো অন্ধকার কেটে যাচ্ছে.. ছেঁড়া  মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ফুটফুটে একফালি চাঁদ |

আমার শরীর মন জুড়ে এখন শুধু এক অচেনা খিদে |

..........................................................

অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি