-১-
রুটির
দোকানে উবু হয়ে বসে চটপট করে রুটি বেলছে কমলা। তারই সাথে তাল মিলিয়ে
ঝপাঝপ করে গনগনে আঁচে রুটি সেঁকেও নিচ্ছে। আগুনের তাপে নাকে মুখে ঘামের
ফোঁটা জমে কালো মুখটা বেশ চকচক করছে এই হিমের রাতেও। দোকানের মুখটাতে বেশ
ভিড় জমেছে। তাদের মধ্যে কেউ একজন চেঁচিয়ে বলে ওঠে, "কিগো কমুমাসি আমারটা
হল, তখন থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছি।" "এই যে দিচ্ছি বাবা একটু
সবুর কর। তাড়াহুড়ো করলে কাল এসে বলবি মাসি তোমার রুটি কাঁচা ছিল। ভালো করে
রুটি সেঁকেও দাওনি।" কথাটা বলেই আবার খুন্তি দিয়ে চাটুতে রুটি উল্টাতে
থাকে কমলা।
দোকানের বাইরে
একদল ছেলেবুড়ো খরিদ্দার ভিড় করে দাঁড়িয়ে কী সব এন.আর.সি , সি.এ.এ নিয়ে
আলোচনা করছে। কমলা এসব বোঝেও না বোঝবার চেষ্টাও করে না।
রুটির
দাম দিতে গিয়ে একটাকার ছোট কয়েন দিল ছেলেটা। সেটা নিয়ে কমলা মুচকি হেসে
বলল,”তুই দিচ্ছিস দে। আমি নিলাম কিন্তু তোদের ফেরত দিতে গেলেই, না বলিস না
বাবা। আজকাল ভিখারিও ছোটকয়েন নিতে চায় না।“ কথাগুলো বলেই আবার রুটি বেলতে
লাগল কমলা। চাকিতে বেলুন দিয়ে আটার লেচি বেলে রুটিতো নয় যেন পূর্ণিমার চাঁদ
তুলছে কমলা।
ঠিক এইভাবেই
সন্ধে ছ'টা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত রোজ রুটির দোকান চালায় কমলা। সকালের
দিকটা চা,বিস্কুট,পাউরুটি, ঘুগনি আর বিকাল থেকে শুধুরুটি। তবে চা করে
বিকেলেও এক ফ্লাস্ক রেখে দেয়। একা হাতে আর কতদিক সামলাবে।
৩৬৫দিনই তার জীবনের আহ্নিক গতি রুটির ঘূর্ণনের মতো ঘোরে।
-২-
মফস্বল
শহরে এখন বাড়ির বৌরা সব বিবি হয়েছে। কেউ প্রয়োজনে কেউ অপ্রয়োজনে। যাদের
টোনা-টুনির সংসার অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী দু'জনে চাকরি করে তাদের তো কমলার
দোকানে মাস কাবারি রুটির হিসাব করাই থাকে। কিন্তু যে সব স্ত্রীরা সারাদিন
বাড়িতে থাকে তারাও সন্ধের পর থেকে টিভি সিরিয়ালের সৌজন্যে রান্নাঘর মুখো
হতে চায় না। অফিস ফেরত বাড়ির কর্তাটিকে মুঠোফোনে আদেশ করা হয় এই বলে, "
কিগো বাড়ি আসার পথে কমলার দোকান থেকে দশটা রুটি নিয়ে এসো। আমার গা'টা কেমন
ম্যাজম্যাজ করছে। আটা মাখতে পারবো না। ট্রেনে বসে বসে ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে
রুটি আনতে ভুলে যাও যদি তবে কিন্তু ভাত গিলতে হবে।" স্বামী বেচারা আর কী
করে, যুগধর্ম মানতে বাধ্য তারা। কারণ রুটি না নিয়ে গেলে বাড়ি ঢুকে এককাপ
চা তো দূর, চাঁদবদনীদের হাসিমুখগুলো কপূর্রী ঠাকুর হয়ে, উবে যায়। গিন্নীরা
তখন সিরিয়ালের 'রাসমনি'র মতো এমন দাপট দেখায় যে সংসারে 'স্বামী কেন আসামী'
সিনেমাও হিট হয়ে যায়।
আবার
কোনো কোনো স্বামীর রাতে রুটি না হলে সকালে কোষ্ঠ সাফ হয় না। তাতে বায়ুর
নিন্মগতি প্রাপ্ত হয়। যাতে ভদ্রসমাজ নাকে রুমাল চাপা দেয়।
এও
এক পরিবর্তন। সময়ের সাথে সাথে আরো কত পরিবর্তনের সাক্ষী থাকে কমলা। মনে
মনে হাসে আর বলে, তা বাপু বেশ, তোমরা বিবিয়ানি করো তাই আমরা খেটেখুটে পেট
চালাতে পারি।
- ৩-
রুটির
দোকান বন্ধ করে কমলা বাড়ি ঢোকার আগে তেমাথার মোড়ে বুড়ো অশ্বত্থ গাছের নিচে
ষষ্ঠীর থান বলে কপালে হাত ঠেকায় ভক্তিমনে। অশ্বত্থ গাছটার ডানদিকে বড়
পুকুরটা মজে গিয়ে এঁদো ডোবায় পরিণত হয়েছে। তাই কমলার মনে ভারি দুঃখ হয়। সে
ভাবে সময়ের সাথে সাথে ভরন্ত সংসারও এই ভাবেই মজাপুকুরে বদলে যায়। এইসব
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়িতে ঢুকেই বিছানায় শোয়া অসুস্থ স্বামীর সেবায়
নিজেকে নিয়োজিত করে।
আজকাল
কমলার স্বামী একসময়ের তেজিয়াল অজিত দত্ত এখনও কথায় কথায় কমলাকে ঝাঁঝিয়ে
উঠে গালমন্দ করে। কমলার তাতে মান অভিমান তো দূর, কোনো বিরক্তিবোধও নেই। সেই
ছোট থেকে জ্ঞান হওয়া ইস্তক শুনে এসেছে মায়ের মুখে। মেয়েদের স্বামী ছাড়া
গতি নেই। পতি পরম গুরু।
আজ
অনেকদিন বাদ মায়ের কথা মনে পড়ল কমলার। উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জে সুভাষ কলোনিতে
তার বাপের বাড়ি। মার মুখে শুনেছিল,তার বাপ-মা ওপার বাংলার মানুষ। রায়টের
সময় প্রাণের ভয়ে চলে এসেছে এদেশে। যদিও তার জন্ম রায়গঞ্জেই হয়েছে।
অগ্রহায়ণ মাসে নবান্নের সময় জন্মেছিল বলে,পাড়ার লোকে মাকে বলেছিল, "তোমাগো
ঘরে লক্ষ্মী আইসে।"
এখন পুরোনো কথাটা মনে পড়তেই কমলা মনে মনে একটু হেসে নিল। তারপর ভাবলো হেমন্ত ঋতুতে জন্ম বলে তার জীবনটাও হেমন্তর মতো হারিয়ে গেছে।
শরত ও শীতের চাপে পড়ে অস্বিস্তহীন হয়ে আছে হেমন্ত।
দুইদিদির
পরে আবার মেয়ে জন্মেছিল বলে ছোটথেকেই অনাদর, অবহেলায় বড় হয়েছে। তারউপর
গায়ের রং ছিল কালো। তাই তার মা মাঝে মাঝেই বলত কপাল চাপড়ে," আমার প্যাটেই
ক্যান যে হইলি পুড়াকপালী! তোর নগে আমার জীবনটাও ভাজাপুড়া হইয়া গেল গ্যা।"
এসব চিন্তা ভাবনায় কমলার রাতের ঘুমটা ঠিক মতো হল না।
পরের
দিন বিকালে বাড়ি থেকে দোকান আসবার সময় কমলা দেখে পাড়ার মেয়েরা খেলছে,
"এলাটিং বেলাটিং সইলো, কিসের খবর হইল।" কমলা মনে মনে হাসে আর ভাবে সময়
এগিয়ে গেছে কত। সবার হাতে এখন বড় বড় ফোন তবুও এক টুকরো পুরোনো স্মৃতির মতো
তাদের এলাকায় রয়ে গেছে হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলা।
কমলার মনে পড়ে যায় এই খেলার কথা। আর তার সাথে খেলার মহাত্ম্যের কথা।
একটু
বড় হতেই বেড়াল পার করবার মতো কমলার বিয়েটা হয়ে যায় অজিত দত্তের সঙ্গে।
অজিত দত্ত তখন লিলুয়ার কোনো এক লেদ কারখানায় কাজ করতো। হাট্টাকাট্টা যুবক
পুরুষ। গায়ের রং কালো হলেও কমলার মুখে লালিত্য ছিল। বড় বড় চোখে ছিল
মায়াকাজল। একমাথা কোমর ছাপানো চুল। অজিত দত্তের মা এই দেখেই কমলাকে ছেলের
বৌ করে এনেছিল। রগচটা ডাকাবুকো অজিত দত্ত প্রথম জীবনে কমলাকে ভালোবাসা,
আদর, আবদার সবই দিয়েছিল কমলা বাধ্য মেয়ে বলে। আর ছিল শাশুড়ির ভালোবাসা।
নিয়তিদেবী কমলার ভাগ্যটা খুব যত্ন করে গড়েছে।
বিয়ের
বেশ কিছু বছর পরে একটি ছেলে বিপুল ও মেয়ে পূজাকে নিয়ে কমলার যখন ভরাট
পাঁচজনের সংসার। ঠিক তখনই অজিত দত্ত বিছানায় পড়লেন। ম্যাসিভ হার্ট
অ্যাটাক। ডানদিকের হাত-পা প্যারালাইসড। কমলা তখন আতান্তরে। কী করবে
ভেবেই কুল কিনারা করতে পারে না। শাশুড়ি তখন সাহস দিয়ে বললেন, " শক্ত হ মা।
তোকেই হাল ধরতে হবে। মেয়েরা সারা জীবন ত্যাগ স্বীকার করে। তোকে ভগবান
পরীক্ষায় ফেলেছে। তোর উপর আমার অগাধ বিশ্বাস। তুই সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ন
হবি।"
অসুস্থ স্বামী ও
দুই বাচ্চাকে শাশুড়ির জিম্মায় ফেলে রেখে আয়ার কাজ নিয়েছিল কমলা। কিন্তু
বিধিবাম। দিনের বেলায় কাজ তবুও মেনে নিয়েছিল অজিত দত্ত। কিন্তু নাইট ডিউটি
শুরু হতেই বিছানায় শুয়ে শুয়ে তরপানি শুরু হল, "কার সাথে সারারাত ফস্টিনষ্টি
করে এলি নষ্ট মেয়ে মানুষ।" প্রথম প্রথম কমলা কেঁদে ভাসাতো। শাশুড়ি এসে
আড়াল করতো কমলাকে। কিন্তু দিনের পর দিন ছেলেমেয়ের সামনে এই অপমান মেনে নিতে
পারলো না। আবার প্রতিবাদ করতেও পারলো না।
তাই
আয়ার কাজে ইতি দিয়ে এই পালপাড়া অঞ্চলেই দুবাড়ি রান্নার কাজ নিল। তাতেও যখন
সাংসারের অভাব মেটাতে পারে নি তখন সাহস করে এই রুটির দোকান দেওয়া কমলার।
-৪-
আজ
বৃহস্পতিবার। আজকের দিনটাই কমলা একটু বেলা করে দোকান খোলে। বৃহস্পতিবার
সকালটা কমলার জীবনে একটু আনন্দ ডেকে আনে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই অসুস্থ
স্বামীকে
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে নিজে স্নান করল
কমলা। তারপর একটা ফিকে রংয়ের ছাপা শাড়ি পরে, চুল আঁচড়ে বিনুনি বাঁধলো।
কপালে ছোট করে সিন্দুরের টিপ পড়ল। মাথার সিঁথিতে সিন্দুরের রেখা টেনে হাতের
নোয়ায় সিন্দুর ঠেকালো।
ঘরের মধ্যে পরিপাটি করে
গোছানো সিংহাসনে মা লক্ষ্মীর পটে ঘট পেতে বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মীপুজো করল।
না পাঁচালি পড়ার মতো বিদ্যে বা সময় কমলার নেই। কিন্তু ভক্তিশ্রদ্ধা আছে।
এককাপ চা স্বামীকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও চাখেয়ে কমলা লোনে গেল।
'বন্ধন'
ক্ষুদ্রঋণ গোষ্ঠীর লোন। গ্রুপের নাম 'উৎসাহ'। তাদের পাড়াতেই টিনাদের
বাড়িতে প্রত্যেক সপ্তাহে লোন বসে। হপ্তা প্রতি লোনের কিস্তি শোধ করতে হয়।
আগে গ্রুপটা ছোট ছিল। এখন আড়ে-বহরে বেড়েছে। আসলে 'বন্ধন' যবে থেকে নিজেও
ব্যাঙ্ক হয়ে গেছে তবে থেকে এই গোষ্ঠীও আকারে আয়তনে বেড়েছে। তাতে কমলার
ভালোই লাগে। তাকে সবাই মাসি মাসি বলে ডাকে। লোনের স্যার আসার আগে সকলের
মুখে তাদের সংসারের সুখদুখের গল্প শুনে নিজের কষ্টটা জলো লাগে কমলার কাছে।
মাঝে মাঝে লঘু হাসিঠাট্টাও হয়। তবে আজ টিনা গ্রুপের সব মহিলাদের বুঝিয়ে
বলছে সেই আগে শোনা,এন. আর, সির কথা।
চুপচাপ স্বভাবের কমলা টিনাকে জিজ্ঞেস করল,
" হ্যাঁরে মা টিনা এটা কী রে? এই এন. আর.সি।"
টিনা
কলকাতার কলেজে পড়া মেয়ে ভালো শ্রোতা পেয়ে অনেক কথা বোঝালো কমলাকে। যার
মোদ্দা কথাটুকু ধরলে এটাই দাঁড়ায়, ভোটারকার্ড আধারকার্ড থাকলেই তুমি এ
দেশের নাগরিকত্বের দাবীদার নও। এমনকি এখানে জন্মালেও এ দেশের নাগরিক হবে
না। তোমার বাবা মাকেও এদেশে জন্মাতে হবে। কথাটা শুনে কেউ একজন বলল," ওসব
গুজব। আসলে প্রতিবেশী দেশের সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব দেবার নিয়ম এন.আর.সি।"
টিনার সাথে তার জোর তর্ক বেঁধে গেল।
কোনটা
ঠিক কোনটা ভুল তা কমলা জানেনা। কিন্তু মনটা কু ডাকল তার। কথাটা শোনার পর
থেকেই নিরীহ কমলার মনে একরাশ চিন্তা ঢুকে গেল। তবুও নিজেকে কাজের মধ্যে
সংসারের দায়িত্বে ডুবিয়ে দিল।
লোনের
কিস্তির টাকা দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে মনে টিনার মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায়
কমলার চোখদুটো জলে ভরে উঠল। যদি ঠিক সময় মতো টিনার মা 'বন্ধন' এর লোনের
কথা না বলতো, তবে কমলার রুটির দোকান আর হতো না। প্রত্যেক বছরে লোন নিয়ে
নিয়ে কমলা দোকানের ব্যবসা বাড়িয়েছে। পৌরসভার সরকারি বাড়ি প্রকল্পের
ডিপোজিট মানি জমা দিয়ে বাড়ি বানিয়েছে। বিপুল বড় হতে তাকে টোটো কিনে দিয়েছে।
পূজার বিয়ে দিয়েছে। এমনকি শাশুড়ি মারা যাবার পর তার শ্রাদ্ধশান্তির কাজটাও
একটু ঘটা করে লোনের টাকাতেই করেছে। শাশুড়ির উপর একটু টান বেশি কমলার। জগতে
ওই একটা মানুষই তাকে বুঝতো।
বন্ধনের লোন ও রুটির দোকান কমলার জীবনে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে আছে।
-৫-
প্রত্যেক
শনিবার পালপাড়া অঞ্চলে ভিখারিরা ভিক্ষা করতে আসে। ওদের এলাকা অনুযায়ী দিন
ঠিক করা থাকে। কমলা আজকের দিনে একজনের অপেক্ষায় থাকে। না সে ঠিক ভিখারি নয়।
সে বাউল। উমা দাস বাউল। গায়ে গেরুয়া শাড়ি। সঙ্গে গেরুয়া সুতির চাদর চাপা
থাকে। নাক থেকে কপাল পর্যন্ত রসকলি। বগলে খোমর চেপে আঙুলে করে তার টান
দিয়ে গলা ছেড়ে গান ধরে বুগবুগির আওয়াজের সাথে,
" তুমি ভেবেছো কী মনে, এই ত্রিভুবনে
তুমি যাহা করে গেলে কেউ জানেনা
বারে বারে আর আসা হবে না।
এমনও মানব জনম আর পাবে না
বারে বারে আর আসা হবে না।"
গানটা
শেষ করেই কমলাকে একগাল হেসে বলে ওঠে," পেন্নাম গো দিদি পেন্নাম। নিতাইয়ের
কিরিপায় সব ভালো তো। তা দেখো কেনে, বাসি রুটি যদি এক আধখান থাকে তোমার
দোকানে... তো গরম চায়ের সাথ একটুন দাও কেনে। ভারী জার পড়েছে ইবারে।
খিদেটো লেগেছে দিদি।তোমার দোকান থেকি বেরিয়ে নদীর ধারে একটুন বসে জিরোবো
গায়ে রোদ মেখে। বাকি সাথিরাও ওদিক পানে এসে জড়ো হবে।"
কমলা
উমা বাউলকে যত্ন করে দোকানের বেঞ্চে বসিয়ে চা রুটি খাওয়ালো। শেষে যাবার
আগে পাঁচটা টাকা উমা বাউলকে হাতে দিল। উমা বাউল যতক্ষণ ছিল ততক্ষণ কমলার
মুখে এক তৃপ্তির হাসি ঝুলে ছিল। কত নতুন নতুন জায়গার খবর দেয় উমা বাউল। কত
নতুন মানুষ। কত রকম তাদের স্বভাব। এগুলো শুনে কমলার মন আকাশ কুসুম ভাবে।
যদি সে পাখি হত তবে উড়ে যেত সেইসব জায়গায়। তার জীবনটা কুয়োর ব্যাঙ হয়েই
কেটে গেল। তবুও মুখ ফুটে কারো বিরুদ্ধে কখন অভিযোগ নেই কমলার।
বড়রাস্তার
ধারে রোজের হিসাবে ভাড়ার গুমটি দোকান কমলার। আজ আবার সরকারি দপ্তর থেকে
রোড মাপাজোখ হচ্ছে। রাস্তা না কি চওড়া হবে। গুমটি সব ভাঙা হতে পারে।
এইসব দেখে কমলার মন খারাপ আরো বেড়ে যায়। উমার গান শুনে যে আনন্দটুকু হয়েছিল সেটাও মিলিয়ে যায় একনিমেষে।
-৬-
বিপুল
টোটো চালাতে চালাতে এই পালপাড়ারই এক উঠতি প্রোমোটারের মেয়েকে প্রেমে করে
বিয়ে করেছে। আসলে বিপুল হল মাকালফল। দেখতে সুন্দর। কিন্তু ব্যক্তিত্ব থেকে
বিদ্যাবুদ্ধি কোনটাই তার নেই। তাই বাপের এক মেয়ে রিচা, বাপের আদরের
দুলালী বিপুলকে ঘরজামাই করে রেখেছে।
মাঝে মাঝে কমলার
রুটির দোকানে এসে উদাত্ত কন্ঠে রবীন্দ্র সংঙ্গীত গাওয়ার মতো করে "মা..."
বলে ডাকে। আর টাকা চায়। আর কমলাও মমতামাখা চোখে বিপুলকে দেখে গলে জল হয়ে
কিছু টাকা হাতে দেয়।
হঠাৎ
করে এতদিন রোগভোগের পর অজিত দত্ত মারা গেল এক ম্যাড়মেড়ে বুধবারে ঘুঘু
ডাকা দুপুরে। কমলা তখন সদ্য দোকান থেকে এসেছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার লোনের
কিস্তির টাকা গুছিয়ে রাখছিল ঠিক সেই মুহূর্তে, অজিত দত্ত হেঁচকি তুলে তার
জীবনাবসান ঘটালো।
পূজা শ্বশুরবাড়ি থেকে জামাইকে সঙ্গে করে এল।
বিপুল
এল রিচাকে নিয়ে। পূজাই একটু বাবার জন্য হাউমাউ করে কাঁদলো। কমলা সব
দেখছে। কিন্তু চোখে জল তার আসছে না। তবে কি শোকে পাথর হয়ে গেল কমলা?
রিচার বাবাই সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিল। অন্ত্যেষ্টি কাজ দ্রুত শেষ হল।
অজিত দত্তের মৃত্যু সংবাদ ও শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন
দেবার জন্য পূজা আত্মীয় স্বজন কে ফোন করল।
পূজার
দুই মাসি। একজন রায়গঞ্জে থাকে। আর এক মাসি আসামের ধুবড়িতে থাকে। সবার শেষে
আসামের মাসিকে ফোন করে পূজা ফোনটা কমলাকে ধরিয়ে দিল মায়ের মনটা হালকা
করতে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আর এক।
আসামের
মাসি ফোনে কমলার গলা পেয়েই আর্তনাদের মতো করে বলল, "ভৌনটি আমি কীবা নমরি
বাঁচি আছো। তোর ভিনদৈয়ক ডিটেনশন ক্যাম্পত আটক করি থৈছে। কেনেকৈ জীয়াই থি
থাকিম কোয়া? এন.আর.সিয়ে সকলো শেষ করি দিলে, শেষ হৈ গল আমার সংসার।" কমলা
আবার এন.আর.সির নামটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। মেয়েকে ফোনটা দিতেই লাইন হট
করে কেটে গেল।
তেরো দিনে ঘাটকাজ, তারপরের দিনে শ্রাদ্ধ ও শেষে আঁশপান্না বা মৎসমুখী হয়ে বাড়ি যখন ফাঁকা, তখন কমলার মনটা হু,হু করতে লাগল।
অনেকদিন
বন্ধ থাকার পর দোকান খুলেছে কমলা। মনমরা হয়ে দোকানদারি সামলে রাতে বাড়ি
ফিরে কমলার ভালো লাগে না ঘরে। অজিত দত্তের গালমন্দ শোনা শেষের দিকে
অভ্যেসে পরিণত হয়েছিল। ভালোমন্দ যেমনটি হোক। বিছানায় অসুস্থ হয়ে পরে
থাকতো। তবুও কেউ তো কমলার জন্য অপেক্ষা করতো। বাড়ি ফেরার একটা তাগিদ তো
ছিল কমলার জীবনে। আজকাল বড়ই একাকিত্ব নিঃসঙ্গতায় ভোগে কমলা। শাশুড়িমার কথা
মনে পড়ে খুব। সব থেকেও আজ কমলার জীবনে কিছুই নেই।
-৭-
আজ
আবার বৃহস্পতিবার। কমলা যথারীতি লোনে গেছে টিনাদের বাড়ি। বদলানোর মধ্যে
বেশভূষা বদলেছে। অন্যদিনের মতোই সবাই কমলাকে "মাসি মাসি" বলে এটা ওটা
শোনাচ্ছে।
আজকে লোনে নতুন স্যর এসেছেন। কিস্তি জমা দেবার পর নতুন স্যর বললেন," কমলা দত্ত কার নাম?"
কমলা নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলল,"আমি স্যর।"
স্যর
গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন, " আপনার বয়স ষাট হয়ে গেছে। অতএব আপনার নামে আর
লোন স্যাংশন হবে না। আর দুটো কিস্তি শোধ হয়ে গেলে আপনাকে আর গ্রুপে আসতে
হবে না।"
কমলা হতভম্ব হয়ে
গেল। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো অবস্থা কমলার। যদিও ইদানিং লোনের টাকার
প্রয়োজন ফুরিয়েছে তবুও দীর্ঘদিনের অভ্যেস। এই 'উৎসাহ' গ্রুপের সাহচর্য।
কমলা এবার কী নিয়ে থাকবে এই ভাবতে ভাবতে কোনোরকমে বাড়ি পৌঁছালো।
অজিত দত্ত যে বিছানায় শুয়ে থাকতো সেই বিছানায় শুয়ে গলা ছেড়ে কাঁদলো অনেকক্ষণ।
কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে।
সেই ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে শাশুড়ি এসে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, " অনেক করেছিস মা এই সংসারের জন্য এবার মুক্তি নে।"
ঘুম ভেঙে গেছে কমলার। দু'গালে জলের দাগ। এই কদিনেই আঁটোসাঁটো চেহারা ভেঙে আলুথালু হয়ে গেছে।
কমলা নিত্যদিনের অভ্যেস বশে দোকান যায় না। আজ পর্যন্ত দোকান বন্ধ যায়নি কোনদিন। খালি গুরুদশার কটা দিন বাদ দিয়ে।
কমলা
ভাবতে বসে, তার আর কিছু নেই। তার লোন নেই। দোকান ভাঙা পড়ে রাস্তা চওড়া
হবে। তাই দোকানও নেই। ছেলে মেয়ে থেকেও নেই। স্বামী নেই। বন্ধু নেই। রিফিউজি
বাবামায়ের মেয়ে বলে তার নাগরিকত্ব থাকবে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে!
তার
অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতে চলেছে। আর ভাবতে পারে না কমলা। একবার হাহা করে হাসে
এক হাউ হাউ করে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পরে। এইভাবে দু'দিন কেটে
যায় নিমেষে। কেউ এতটুকু খোঁজ করে না কমলার।
-৮-
শেষ
চৈত্রে অতিরিক্ত গরম পড়েছে। কালবৈশাখীর দেখা নেই। বসন্তর কোকিলের কুহুতান
কাকের ডাকের মতো কর্কশ শোনাচ্ছে। এখন শনিবারের বারবেলা পড়ে গেছে। আকাশের
নৈঋত কোণে কালো মেঘ জমেছে। খর বারে ঘোর অমাবস্যা। এ কিসের পূর্বাভাস!
কমলা
ঘর থেকে বেরোয়। চোখের চাওনি ঘোলা। তিনদিনের উপোসী শরীর শুকিয়ে পাকিয়ে
গেছে। উন্মাদের মতো একমাথা রুখু কাঁচাপাকা চুল এলোকেশির মতো উড়িয়ে মলিণ
হয়ে যাওয়া তিনদিনের বাসি কাপড় পরনে উদভ্রান্তের মতো পালপাড়া দিয়ে কমলা ছুটে
যায় নদীর দিকে।
নদীর পাড়ে এসে মনে মনে বলে, মাগো চরণে ঠাঁই দাও। বলেই নদীর জলে ঝাঁপ মারতে উদ্যত হয়।
ঠিক
সেই মুহূর্তে উমাদাস বাউল পেছন থেকে কাঁধে হাত দিয়ে দু'চোখে বিশ্বাস ও
আস্থা জাগিয়ে বলে, " দিদিগো আত্মহত্যা মহাপাপ নরকে গমন।"
উমাদাস
বাউল কমলাকে বুঝিয়ে বলে," আমরা বাউল। সাধন ভজন করি আর আখড়াতে থাকি
বট্যে। দেশ, সময় আমাদের আটকে রেখে রসটো পাবে নাখো। তুমি আমাদের সাথকে
চলো।"
উমাদাস বাউল কমলাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে মুখে তার গান,
" এমন মানব জনম আর কি হবে
মন যা করো ত্বরায় করো এ ভবে
অনন্ত রূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই
শুনি মানবের উত্তম কিছুই নাই
দেব-দেবতাগণ করেন আরাধন
জন্ম নিতে মানবে।
মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে..."
------------------------------ ---×-------------------------- -----