পাঠ প্রতিক্রিয়া
সায়ন তালুকদার
বই: গানের ভুবন
লেখক: বুদ্ধদেব গুহ
প্রকাশক: দেজ পাবলিশিং
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১১২ পাতা
মূল্য: ৮০ টাকা
অনুভবে_ছুঁয়ে_দেখা
তিনি বনজ্যোৎস্নার তান্ত্রিক। তিনি বনফুলের পুরোহিত। তিনি ঝরা-বনপাতার বাউল। তাঁর সাহিত্যসাধনার সালোকসংশ্লেষে নীরবে এসে মিশেছে টাঁড়, বন, অরণ্যের নিবিড় আলো-জল-বাতাস।
তিনি 'ঋজুদা'। তিনি বুদ্ধদেব গুহ।
বাংলা সাহিত্যজগতকে কাঁদিয়ে, চিরঋণী করে তিনি চলে গেলেন নক্ষত্রলোকের অন্য পাড়ে,কোনও এক নামহীন অজানা দেশে...
বহু বিচিত্রতায় ভরপুর এবং অভিজ্ঞতাময় ছিল তাঁর জীবন। ইংল্যান্ড, ইউরোপের প্রায় সমস্ত দেশ, কানাডা, আমেরিকা, হাওয়াই, জাপান, থাইল্যান্ড ও পূর্ব আফ্রিকা তাঁর দেখা। পূর্ব ভারতের বন-জঙ্গল, পশুপাখি ও বনের মানুষের সঙ্গেও তাঁর সুদীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। 'সাহিত্য-রচনায় মস্তিষ্কের তুলনায় হৃদয়ের ভূমিকা বড়' - এই মতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন।
জঙ্গল তাঁর লেখায় বারে বারে ধরা দিয়েছে। তিনি জঙ্গলের প্রেমে পড়েছেন বারবার। দশ বছর বয়সে শিকার শুরু করলেও নিজেকে শিকারী বলে পরিচয় দিতে কখনও চাননি। 'জঙ্গলের জার্নাল' তার চেয়ে ভালো আর কেউ লিখেছেন কী?
খুব সুন্দর করে চিঠি লিখতে পারতেন, তাঁর যেকোনো উপন্যাস পড়লেই তা বোঝা যায়! ‘সবিনয় নিবেদন’ উপন্যাস তো পুরোটাই পত্রপোন্যাস! ঋতি ও রাজর্ষি একজন আরেকজনকে না দেখে না শুনে চিঠির এক অদ্ভুত ব্যাকরণে বুনতে থাকে তাদের সম্পর্ককাব্য। অদেখাকেও যে চিঠি লিখে প্রিয় ব্যক্তিতে রূপ দেওয়া যায়, তার সাথে খুনসুটি করা যায়, করা যায় অভিমানী অভিযোগ, চিঠি লিখে যে কাউকে ভালোবাসাও যায়- তার এক অনবদ্য প্রমাণ ‘সবিনয় নিবেদন’।
তাঁর লেখা 'মাধুকরী'’ বাংলা সাহিত্যের জগতে অন্যতম একটি মাইলফলক। পৃথু, কুর্চি, রুষা, মগনলাল, ঠুঠা-এই সকল চরিত্রের মধ্যে কী যে জাদু ছড়িয়ে আছে যা এড়ানো সম্ভব নয় কোনো পাঠকের পক্ষেই। এই উপন্যাসে কেউ কারও পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান করে না, এত সমান্তরালভাবে চরিত্রগুলোকে সম্পৃক্ত রেখেও বয়ে যেতে দিতে তিনিই পারেন!
আজ তাঁরই লেখা 'গানের ভুবন' প্রসঙ্গে আমার পাঠানুভবেই তাঁর প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ।
প্রথমেই বলে রাখি এই বই স্মৃতিকথামূলক।
লেখক
যেসকল গুণী শিল্পীদের সান্নিধ্যে এসেছেন,তারই কিছু স্মৃতিকথন এ বইয়ের
দু-মলাট জুড়ে। শুরুতেই লেখক জানিয়েছেন, "প্রথমেই স্পষ্ট করে বলা দরকার যে
আমি একজন বিশুদ্ধ 'আতাঈ'। গানবাজনার কিছুই বুঝি না। গান গাইতেও জানি না।
কিন্তু গানই আমার প্রাণ। আমার 'অ্যাকিলিসে'স হিল'।
ছাত্র
বয়সে লেখক গান শিখেছিলেন তুলসী লাহিড়ীর ভাই সামু লাহিড়ীর কাছে।
আকাশবাণী তখন গার্স্টিন প্লেসে। অডিশন দিতে গিয়ে গাইলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত,
"মম মন উপবনে"। কিছুদিন পর অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে আসা চিঠিতে জানতে পারেন
তিনি পাশ করেননি।সত্তর দশকের শেষে অথবা আশির দশকের গোড়ায় যখন সেই
অডিশন-ফেল করা তাকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অডিশন বোর্ডের মেম্বার করলেন
কর্মকর্তারা তখন বিষম লজ্জায় পড়েছিলেন বুদ্ধদেব গুহ। গানের স্কেল
সম্পর্কে তার ধারণা, "চানঘরে ঢুকে যেদিন যত জোরে কর খুলি সেদিন কলের জল
পড়ার আওয়াজ যে স্কেলে বাঁধা হয়ে যায়,সেদিন সেই স্কেলই আমার স্কেল হয়ে
যায়"।
সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে বি.কম পড়াকালীন তিনি
ভর্তি হন 'দক্ষিণী'-তে। 'দক্ষিণী'-র সূত্রে বিভিন্ন গুণী শিল্পীদের
সংস্পর্শে আসেন লেখক। তাঁদের মধ্যে আছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত জগতের সুনীল কুমার
রায়,প্রসাদ সেন,অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়,কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়,নীলিমা
সেন,সুবিনয় রায়,শান্তিদেব ঘোষ প্রমুখ দিকপাল শিল্পীরা। তার স্ত্রী
প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকা ঋতু গুহ ঠাকুরমার সঙ্গে আলাপও এই
'দক্ষিণী'-তেই। "একক গাইল একটি ছিপছিপে ফর্সা,সদ্যযুবতী মেয়ে,তাঁতের
লাল-কালো ডুরে শাড়ি পরা। দু'বিনুনি করা। লাল ব্লাউজ,কানে রুবির একজোড়া
লাল দুল। গাইল, "জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ,ধন্য হল,ধন্য হল
মানবজীবন"। সে গান শুনে আমার জীবনও ধন্য হল। মহড়া শেষ হওয়ার পরে জানলাম
নবীনা গায়িকার নাম ঋতু গুহঠাকুরতা এবং সে শুভ গুহঠাকুরতার মেজদাদা
এন.সি.গুহর মেয়ে"।
কণিকা
বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে লেখক বলেছেন, "মোহরদি যে খুবই সুন্দরী সে
সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিলেন নিজে। সাজতেও খুব ভালোবাসতেন। ঋতুর কাছে পরে
শুনেছি যে,ঋতুর মায়ের আলমারি খুলে অনেক বাছাবাছি করে শাড়ি পড়তেন
উনি"।শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসবের বৈতালিকে লেখকের হাত ধরে গানের দলের মধ্যে
ঢুকিয়ে দিতেন মোহরদি। 'আমি রূপে তোমায় ভোলাব না', 'স্বপনপারের ডাক
শুনেছি' , 'দূরে কোথায় দূরে দূরে' গানগুলি মোহরদি ছাড়া আর কারও গলায়
শুনতে ভালো লাগে না বলে জানিয়েছেন লেখক।
জর্জদার
(দেবব্রত বিশ্বাস) কাছে গান শেখা লেখকের জীবনে এক মধুর অভিজ্ঞতা। একবার এক
ঘটনা ঘটেছিল, লেখক বলছেন, "সেদিন কোন গান আমাদের গাইতে হচ্ছিল আজ আর মনে
নেই তবে মনে আছে সেই গানের আভোগে বা সঞ্চারীতে অমিয় একটু ভুল
করেছিল।চিরদিনের হঠকারী আমি গুনগুন করে গেয়ে অমিয়কে ভুল ধরিয়ে দিতে
যেতেই জর্জদা হারমোনিয়াম ছেড়ে দিয়ে বললেন, "অন্ধ ল্যাংড়ারে পথ দেখায়"।
চিরদিনই
রবীন্দ্রসঙ্গীতের টপ্পার গানের প্রতি লেখকের বিশেষ দুর্বলতা ছিল। চন্ডীদাস
মালের কন্ঠে "তবে প্রেম কী সুখ হতো, আমি যারে ভালোবাসি, সে যদি
ভালোবাসিত"। এই নিধুবাবুর(রামনিধি গুপ্ত) টপ্পা গানটি শুনে তিনি ঋতুকে
বলেছিলেন, "আমি গান শিখব"।
"হিন্দুস্থান রেকর্ডস্"
থেকে পুরাতনী গানের ক্যাসেট বেরোবে। তাতে বুদ্ধদেব গুহ "ভালোবাসিব বলে
ভালোবাসিনে" গানটি রামকুমারের গায়কীতে ভালো মেলে বলে তাঁর মতো করে
গেয়েছিলেন।
ওস্তাদ রাশিদ
খানকেও খুব স্নেহ করতেন লেখক। তার 'আলাপ' লেখককে রীতিমতো মুগ্ধ করে। লেখকের
কাছে একবার অনুযোগ করেন রাশিদা, "কাকু,আমাকে সবাই রশিদ কেন বলে?আমার নাম
তো 'রাশিদ'"। রাশিদ খুব ভালো বিরিয়ানি রাঁধতে পারে এবং তা কয়েকবার খাবার
সৌভাগ্য হয়েছে লেখকের।
পুজোর
পরে জব্বলপুরে যাচ্ছেন লেখক। ট্রেনে আলাপ হল এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। নাম
সাওয়ান্ত। তিনি গান শেখান। উচ্চাঙ্গসঙ্গীত। একটি ঠুংরি এবং একটি ভজন
শোনালেন অনেক অনুরোধ-উপরোধের পর। লেখকের এত উৎসাহ দেখে তিনি লেখককেও গাইতে
বললেন। বুদ্ধদেব গুহ লিখছেন, "গানের ব্যাপারে আমার কোনও হেলদোল ছিল না।
গাইতে জানলে তো থাকবে! তার ছাড়া আমি তো সবসময়ই খালি গলাতেই গাই তাই বাজনা
ছাড়া গাইতে কোনো অসুবিধাই হয় না। ঈশ্বরের আশীর্বাদে 'স্কেল'-এর জন্যে
কোনও যন্ত্রের উপর আমাকে নির্ভর করতে হয় না"।
একবার
'দেশ' পত্রিকাতে সাগরময় ঘোষের অনুরোধে গান ও গায়ক-গায়িকা বিষয়ক দুটি
বইয়ের সমালোচনা করেছিলেন লেখক। 'স্মৃতির অতলে' এবং 'কুদরত্ রঙ্গিবিরঙ্গী'।
একবার
হৃষিকেশের গঙ্গার ত্রিবেণী ঘাটে একজন মারাঠি সন্ন্যাসীর সঙ্গে আলাপ
হয়েছিল লেখকের। লেখকের জবানিতেই শোনা যাক পরবর্তী কথোপকথন। উনি বললেন,
"গান ও গায়কদের প্রতি আপনার এত আগ্রহ কেন?আপনি কি গায়ক?
আমি চানঘরের গায়ক।
শুনি একটি গান।
লেখক শোনালেন, "জবনো অপনিপাদো'র বাংলা অনুবাদ "কেনো ভোলো মনে করো তাঁরে"।
উনি
শুনে তারিফ করলেন। লেখক তাঁর কাছে একটি গান শুনতে চাইলে তিনি বললেন, "গান
কি এখন শোনার? আপনি গভীর রাতে আসবেন। যখন ত্রিবেণী ঘাট একেবারেই
সুন-সান্নাটা হয়ে যাবে,যখন শুধু নদীর জলের OBLIGATO থাকবে তখনই আপনাকে
শোনাব গান। আসবেন"।
সমগ্র
বই জুড়ে অজস্র স্মৃতির ঝাঁপি উপুড় করে দিয়েছেন লেখক। আমরা সেখান থেকেই
খুঁজে নিই মণিমুক্তোরাশি। সমৃদ্ধ হই। আপনিও সেকালের নষ্ট্যালজিয়ায় ভেসে
যেতে হাতে তুলে নিন 'গানের ভুবন' ।
........................