বডি - অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

বডি
অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়





ছড়ানো ঝিল ভর ভরন্ত । ওপারে ঝোপঝাড় জঙ্গল। এপারে কাঁচা রাস্তা আবলা খাবলা । শুক্লা রাতে চাঁদের আলো খেলা করে ঝিলের জলে।ওপারের জঙ্গল থেকে শেয়ালের দল ডাকতে শুরু করে আচমকা।এপারে শিবমন্দিরের বাইরে ল্যাম্পপোস্টের আলোর ছটা মাখা আঁধারে বসে রাত বারোটা অব্দি চার পাঁচজনে মিলে এন্তার মদ খায়। মদ গিলতে গিলতেই যে যার ঘর সংসারের জমিয়ে রাখা বিষ বাষ্প উগরে দেয়। নেশা চড়ে গেলে কেউ কাঁদে কেউ হাসে। সুহাস আর তারক অশ্রাব্য গালাগালি করতে থাকে। বোধহয় ভগবান বা ভাগ্যের উদ্দেশ্যে।
বাইপাস এখান থেকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার ফারাকে। লোকাল পুলিশ ফাঁড়ি মুকুন্দপুরে। ওখান থেকে রাতের ঝিঁঝি ডাকা আঁধারে
মাঝে মাঝে কড় কড় কড় কড় করতে করতে পুলিশের জিপ এসে দাঁড়ায় জলার ধারে।
বাইপাসের দিকে মুখ করে পাশাপাশি তিনটে বিশাল বিল্ডিং উঠছে।জমির পিছন দিকে পলিথিন ঘেরা টিনের শেডের নীচে সিমেন্ট বালি স্টোন চিপসের অস্থায়ী স্টোর রুম। বৃষ্টি হলে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ে টি নের চালে। রকমারি মাপের জি অাই স্টীলের পাঁজা পাঁজা রড এনে ফেলে রেখে গেছে সাপ্লায়াররা। পেঙ্গুইন বিল্ডার তিন তিনটে কন্স্ট্রাকশানের কাজ চালাচ্ছে একসঙ্গে। এই সব জলা আগাছায় ভরা প্লটে ফ্ল্যাটগুলো জলের দরে ছাড়া হবে ফিলহাল। সামনের দিকে একটু দোকান বাজার মল টল বসে গেলে ব্যস্ ..... দাম চলে যাবে ছাপোষা লোকের আওতার বাইরে।
শিখর পাঁজি যতটা সম্ভব ঘরের বাইরেই থাকে। গলা পর্যন্ত চুল্লু খেয়ে রাত দুটো নাগাদ ঘরে ঢোকে। সকালে যখনই ঘুম ভাঙে তখনই বেরিয়ে যায়। ঘরে থাকতে পারে না। তার পরিবার যন্ত্রণার লৌহকপাটের ভিতরে বাস করে।
বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করে এক ঠিকাদারের অধীনে। মা ক্যানসার রুগী। অন্তিম অবস্থা। যন্ত্রনায় দুমড়ে যেতে যেতে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে প্রায় বিনা চিকিৎসায়। কিন্তু মরণ কি অত সহজে আসে ! একটা বিনাপয়সার হাসপাতালে ছিল কিছুদিন । কিন্তু সেখানে ছুটি করে দিল। বলল, ‘ এখানে আর রেখে কি করবেন..... এ পেশেন্টের তো আর কিছু হওয়ার নেই.... আর যে কটা দিন থাকে বাড়িতেই রাখুন.... কত পেশেন্ট লাইনে রয়েছে, মিছিমিছি একটা বেড আটকে রাখা .....।’
না: ... বেড আটকে রাখা গেল না।
একটা ভাই কেরালা না কর্নাটক কোথায় যেন চলে গেছে। আর একটা ভাই কেপমারি করতে গিয়ে ধরা পড়ে বেদম মার খেয়ে আপাতত: জেলে আছে। কতদিন থাকতে হবে কেউ জানে না। উকিল দেবার পয়সা নেই, লোকও নেই। কোর্টে কেস ওঠেনা। ওটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার কেউ নেই।
শিখর একটা কাপড়ের দোকানে কাজ করে। বাজার খারাপ । বছরে দশ মাস ফাঁকা যায়। খদ্দের নেই। তিনমাস পরে পরে মাইনে পায়। চুল্লুর টাকা তারকরা জোগায়। তারক আর সুহাস মিনি বাসের কন্ডাক্টর। চুল্লুর সঙ্গে মাঝে মাঝে পিঁয়াজি কিংবা চর্বির বড়াও হয়। তারকের দিল আছে বলতে হবে। জমানো পয়সা খরচ করছে তাতে সন্দেহ নেই। কারণ মাস দুই হল মিনি বাস বসে আছে। তেলের যা দাম মালিকের পোষাচ্ছে না। বাস বার করছে না। সুতরাং সুহাস বা তারক কারোরই আমদানি নেই। তবু শিখরকে , দিশি হলেও মাল তো খাওয়াচ্ছে।দিল আছে বলতে হবে।
শিখরের মাঝে মাঝে মনে হয়
মা- টাকে যদি একটু করে খাওয়ানো যেত বোধহয় যন্তন্নাটা একটু চাপা পড়ত। কি জানি কতদিনে এ কষ্টের তারকাঁটা থেকে ছাড়ান পাবে বেচারি মা-টা। ‘মরে গেলে’ আর কোন কষ্ট নেই বোধহয়।
অন্ধকার বেশ ঝামরে ধরেছে। ওদিকের ল্যাম্পপোস্টে আলো বিগড়ে গেছে। কবে মেরামত হবে কে জানে । জলার ওপাশে ঝুঁঝকো ঝোপের আড়াল থেকে হঠাৎ একপাল শেয়াল উঁচু পর্দার কোরাসে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে লাগল। একটা জিপ কড় কড় কড় কড় করে ওই কাঁচা রাস্তার একপাশে এসে দাঁড়াল। একজন জিপে বসে বসেই টর্চ ফেলল জি আই স্টীলের পাঁজার ওপর । পরষ্পরে জড়িত আবদ্ধ শীতঘুমে আচ্ছন্ন সরীসৃপপুঞ্জের মতো পড়ে থাকা ‘বিল্ডিং মেটিরিয়াল’-এর শরীর ঝিকমিক করতে লাগল।
একটা গলা শোনা গেল জিপের মধ্য থেকে- ‘ একটা কথা মনে রেখ বিপ্লব ....কেস দিতে না পারলে এখানে পোস্টিং ধরে রাখা মুশ্কিল হয়ে যাবে। চাপ শুধু ডিপার্টমেন্টের নয়, পেঙ্গুইন কোম্পানিরও আছে। তাদেরও তো খসছে নাকি ?’
বিপ্লববাবু বললেন, ‘ সে তো বটেই
..... ‘

শিখরের বাবা কার্ত্তিক কাল কাজ করতে করতে ভারা থেকে পড়ে গিয়ে পায়ে চোট খেয়েছে। কপাল ভাল তেমন গুরুতর চোট লাগেনি। বাড়ির মালিক সজ্জন ব্যক্তি । তিনিই সঙ্গে সঙ্গে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। না, ভাঙেনি। তবে ভালোরকম মচকেছে হাঁটু আর পায়ের গোছ। ঠিকে দার নিজে এসে পৌঁছে দিয়ে গেল কার্ত্তিককে। এসব সমস্যা তেমন হয়নি। তবে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হল যে, মাস দুই বসে থাকতে হবে এখন । পায়ের চোট না সারলে কাজে যাওয়া মুশ্কিল।
যাও বা গাড়ি চলছিল টাল খেতে খেতে, গাড্ডায় পড়ে থেমে গেল হ্যাঁচকা টানে।

সকাল দশটার সময় বাস রাস্তার মুখে তারকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল শিখরের।তারক বলল, ‘রাতে আসিস কিন্তু । আজ দারুন চাট আনাব। বহুৎ মজা পাবি। তাছাড়া কিছু প্ল্যান প্রোগ্রামের কথাও আছে। আসিস কিন্তু। ‘
— ‘ কিরকম প্ল্যান ? ‘
— ‘ আয় না .... বলব অখন .... ‘

পেঙ্গুইন কন্স্ট্রাকশানের বোর্ড মিটিং চলছে । ডালহৌসি, নেতাজি সুভাষ রোডে সেঞ্চুরি প্লাজার আটতলায়।
পীযূষ কেডিয়া সাহেব বললেন, ‘ লাইসেন্স তো আমরা পেয়ে গেছি। সো উই শুড গেট দি ওয়ার্ক আন্ডার ওয়ে ইমিডিয়েটলি। মেটিরিয়াল পড়ে আছে আনগার্ডেড অবস্থায়। লোক্যাল পুলিশ স্টেশনে অবশ্য ইনফর্ম করা আছে। ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং , আনঅফিসিয়ালি পে-ও করতে হচ্ছে টু টেক কেয়ার অফ।
স্টি ল উই শুড নট মেক এনি ফারদার ডিলে।নন পারফর্মিং অ্যাসেট মিনিমাইজ করতে হবে আমাদের। আদারওয়াইজ ইট ইজ ডিফিকাল্ট টু সারভাইভ। কম্পিটিশান ইজ সো স্কেদিং।’

মিটিং-এর পর কফি সেশান হল। স্ন্যাক্সের ভূরিভোজ আয়োজন। প্রদীপ্ত মিত্র সিভিল ইঞ্জীনিয়ার। তাকেও ডাকা হয়েছিল। কন্স্ট্রাকশানের ব্লু প্রিন্ট তার তৈরি। কোম্পানির দুই বড় কর্ত্তা আর একবার করে চোখ বুলিয়ে নিলেন। এই সাইটে মোট
পনের কোটি টাকার টার্ন ওভার। রাফ অ্যাসেমেন্ট অনুযায়ী আট কোটি টাকা প্রফিট আসা উচিৎ। ইনপুট মোটেই নন পারফর্মিং লে অফ- এ রাখা উচিৎ নয় , পীযূষ কেডিয়া এ কথা বারবার স্মরণ করান তার এক্সিকিউটিভদের। কেডিয়ার মূল ব্যবসা অবশ্য আয়রণ অ্যান্ড স্টীলের। বিল্ডিং ডেভেলপমেন্টে নেমেছেন অতি সম্প্রতি। অতটা মেটিরিয়াল পড়ে আছে সাইটে। যদিও স্থানীয় থানায় জানানো আছে, তবু চিন্তা একটা আছেই। পীযুষ কেডিয়াকে একেবারেই হৃদয়হীন ব্যবসায়ীর স্তরে ফেলা যায় না। গরীব মানুষের জন্য তিনি অনেক করেন। কারো দুর্দশার খবর পেলে নিজেই পৌঁছে যান সেখানে এবং তাদের সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য উদ্যোগী হন। ওই বাইপাসের লাগোয়া সাইট ঘেঁসা এলাকাতেও, তিনি খবর পেয়েছেন দুরবস্থার যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে বেশ ক ঘর মানুষ। তার মধ্যে একজনের অবস্থা খুব ঘোরাল। পীযুষ কেডিয়া ঠি ক করেছেন পরশুদিন তিনি ওই এলাকায় যাবেন।

তারকের কোথা থেকে কিছু আমদানি হয়েছে। আজ রাতে চিলি চিকেন আনিয়েছে। বাংলার সঙ্গে জমবে ভাল। দু চার ঢোক মারবার পর ‘স্কিম’ টা বলে শিখরকে। নেশা চড়ার আগেই কথাবার্তা বলে নেওয়া ভাল। নক্শাটা অবশ্য সুহাসের।
সে বলে, ‘ এখানে দশ লাখ টাকার রড পড়ে আছে। চারটে সরে গেলে কোন শালা হিসেব পাবে না। খুব কমসম করে চারটে বেচতে পারলেও কমসে কম দু হাজার টাকা আসবে। মুকুন্দপুরে পার্টি আছে। মাল আমাদের ক্যারি করতে হবে । ওখানে তারিখ আলির লোক থাকবে, নামিয়ে নেবে। এটার সাকসেস হলে পরের বারের প্ল্যান ছকা যাবে। ‘
শিখর আর এক ঢোক মারে । জুলজুল করে সুহাসের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। চিলি চিকেনের টুকরো মুখে পুরে চিবোতে থাকে। টক ঝাল সস মেশানো নরম মাংসের স্বাদে গন্ধে মৌজে চোখ বুজে আসে শিখরের।
তার আচমকা মনে পড়ে যায় চাপচাপ যন্ত্রণার তলায় অসহায়ভাবে পড়ে থাকা তার মায়ের কথা।চোখ বুজে প্রবলভাবে চিলি চিকেন চিবোতে থাকে শিখর। আর এক ঢোক বাংলা মারে । জঙ্গলের ওদিক থেকে জমাট আঁধার ফালা ফালা করে একটা পেঁচা ডেকে উঠল হঠাৎ।
তারক বলল, ‘ আজ আর টানিস না শিখর। ধুমকি এসে গেলে কাজটা করতে পারবি না। একটা ঠেলাগাড়ি রেডি আছে। মাল তুলে বেরিয়ে পড়তে হবে। দুজন যাবে তোর সঙ্গে । তারাই ঠেলায় রড তুলে নেবে । তুই শুধু ওদের সঙ্গে যাবি। তারিখ আলি স্পটে থাকবে। মাল নামিয়ে নিয়ে পেমেন্ট দিয়ে দেবে তোর হাতে। এই খেপের পুরোটাই তোর । আমাদের কিছু দিতে হবে না। আমরা বুঝি .....
ওই যে দুজন .... ওখানে বসে আছে .... টাকা পাবার পর শুধু দুশো টাকা ওদের হাতে দিয়ে দিস।’
শিখরের কিছু বলার ছিল না। কি বলা উচিৎ তার মাথায় আসছিল না। সে মুখ ঘুরিয়ে দেখল ওদিকে অন্ধকারে একটা ভাঙা সিমেন্টের বেঞ্চে দুজন মানুষ বসে আছে। এখান থেকে যেটুকু ঠাওর করা যাচ্ছে .... দুটো সতের আঠেরো বছরের ছেলে। আগুনের দুটো ফুলকি দেখা যাচ্ছে। বিড়ি টানছে বোধহয়।

ঠেলায় চারটে টাটার জি আই রড তুলে ঝোপঝাড়ের মধ্যে কাঁচা রাস্তা ঠেলে বড় রাস্তায় এসে উঠল।ছেলে দুটোই ঠেলা টানতে লাগল। রাস্তাঘাট ল্যাম্পপোস্টের ঝলমলে আলো মেখে ঘুমোচ্ছে। চারপাশ শুনশান । হুস হাস করে মাঝে মাঝে দু একটা গাড়ি ছুটে যাচ্ছে বাইপাস ধরে। রাত প্রায় দেড়টা বাজে।

ছেলে দুটোর নাম হিল্টন আর পদা । পদা বলল, ‘ ওই সামনের গলতায় তো ? ‘
— ‘ কি জানি ঠিক বুঝতে পারছি না .... দাঁড়া তারিখকে ফোন করছি ..... ‘ , শিখর মোবাইলের কন্ট্যাক্ট লিস্ট গড়াতে থাকে আঙুল দিয়ে।
— ‘ পরেরটা হলে কিন্তু আড়াইশো টাকা লাগবে .... ‘ , হিল্টন আর একটা বিড়ি ধরিয়ে বলে।
শিখর ফোনে তারিখকে পেয়ে যায়। জানা গেল, পরেরটা না ওই সামনের মোড়টাই। ওখানে তারিখের লোক দাঁড়িয়ে আছে। তারাই মাল নামিয়ে পেমেন্ট দিয়ে দেবে।
— ‘ না: ... নে টান টান .... সামনেরটাই ..... তোরা চোষবার জন্য বসে আছিস শালারা.... নে চল চল ......’ শিখর ফুরফুরে মেজাজে বলল।

‘ .... আরে দাঁড়া দাঁড়া ..... অত তাড়াহুড়ো কিসের ! মালেরা মুখটা একটু দেখা ..... ‘
গলাটা কানে আসা মাত্র হিল্টন আর পদা ঠেলাটা ছেড়ে দিয়ে পলকের মধ্যে রাস্তার পাশের অন্ধকার ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে কোথায় মিলিয়ে গেল নিমেষের মধ্যে ।
থানার দুজন স্টাফ অপ্রস্তুত হতচকিত শিখরের গায়ের কাছে এসে পড়ল।
— ‘ এই যে চাঁদু .... চ্যাম্পিয়ান লোক একেবারে .... ও: , এতদিনে জালে একটা মাছ পড়ল। তা মাল কোথায় খালাস করতে যাচ্ছিলি ?’ একজন বলল। আর একজন শিখরের কলারটা চেপে ধরল । ‘এরপর কি হবে জানিস ? ‘
আতঙ্কে দিশাহারা শিখরের মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোল না। ঘেমে নেয়ে তোতলাতে তোতলাতে শুধু বলতে পারল, ‘ আমি তো ... আমি তো ....’।
— ‘ তুই তো .... কি ? কোন শাহেনশা তুই ? চল চল .... থানায় গিয়ে জামাই আদর খেতে খেতে যা বলবার বলবি ....’
কড় কড় কড় কড় করতে করতে থানার জিপ এসে থামল।যে লোকটা শিখরের কলার ধরে ছিল
সে জোরালো এক গুঁতো মেরে বলল, ‘ চল ওঠ ওঠ .... হাতে টাইম নেই .... ‘ বলে ঠেলা মেরে শিখরকে জিপে তুলল।
জিপের সামনের সিটে বোধহয় বড়বাবু বা মেজবাবু বসেছিলেন। তিনি মোবাইল কানে লাগিয়ে কাকে যেন বলছেন, ‘ মালটা ষষ্ঠীতলায় রাস্তার ধারে পড়ে আছে। কেডিয়ার কোম্পানিতে খবর দিয়ে মালটা তুলিয়ে নাও। আমরা একটাকে তুলেছি। এটার যা ব্যবস্থা করার করব ....’

পেঙ্গুইন কন্স্ট্রাকশানের পীযূষ কেডিয়া কথার নড়চড় করার লোক নন। ব্যবসায়ী মাত্রেই শোষক এবং হৃদয়হীন মুনাফাখোর এই ধারণার যারা বশবর্তী শ্রী কেডিয়া তাদের বিরুদ্ধে মূর্তিমান প্রতিবাদ ।
বেলা এগারোটা নাগাদ জোরালো রোদ্দুরে ঝলমল করছে ঝিলের জল। তিনজন সহচর নিয়ে কেডিয়াজি এসে দাঁড়ালেন কার্ত্তিক পাঁজির ইঁটের হাড় পাঁজরা সার ঘরখানার সামনে। সঙ্গের একজন শিখরের নাম ধরে ডাকতে লাগল। ভেতর থেকে অবসন্ন ক্ষীণ কন্ঠে জবাব এল, ‘ যাই ..... এই যাই .... ‘
ভাঙ্গা পায়ে শরীরটাকে কোনমতে ঠেলেঠুলে বার করে আনল কার্ত্তিক। চোখে একরাশ ভয়। চোখদুটো কেমন যেন ভিজে টইটুম্বুর।
বলল, ‘ বাবুরা .... থানা থেকে ? ‘
— ‘ আরে না না ..... থানা থেকে আসব কেন ? পীযূষ স্যার এসেছেন এই এরিয়া কভার করতে। আপনাদের কি দরকার স্যারকে বলুন । ‘
শ্রী কেডিয়া প্রসন্ন মুখে বললেন, ‘ তোমার পা ভেঙেছে খবর পেয়েছি। তোমার ছেলেকে পেলে সুবিধা হত। এখন কি নেই ? ‘
কার্ত্তিক খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে জলকাটা কাকুতি ভরা চোখে কেডিয়াজির মুখের তাকিয়ে থেকে বলল, ‘ না .... বডিটা এখনও পাইনি । যদি বডিটা পাবার একটু ব্যবস্থা করে দেন স্যার ..... আর বিরক্ত করব না .... দয়া করুন স্যার ..... ‘
ভয়ঙ্কর বিস্ময়ে পীযূষ কেডিয়ার ভ্রু কুঁচকে গেল — ‘ মানে ! ‘
‘ আমার ছেলে তো কাল রাতে ধরা পড়েছিল স্যার। ও নাকি আপনাদের ওই রড নিয়ে ভাগছিল..... বডিটা পাওয়া গেছে ওই ষষ্ঠীতলার জলার ধারে। এখন মর্গে । সবাই বলল ও নাকি পালাতে যাচ্ছিল তাই .... থানার বন্ধ হাজত থেকে কি করে যে পালাল ......’
পীযূষ কেডিয়া এবং তার সঙ্গের তিনজন হিমশীতল নৈশব্দ্যে বাকরুদ্ধ, স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে রইল কার্ত্তিক মাঝির মুখের দিকে তাকিয়ে ।

সিভিল ইঞ্জীনিয়ার প্রদীপ্ত মিত্র প্লিন্থ-এর ডেপথ্ অঙ্ক কষে বার করে ফেলেছেন , যাতে চোদ্দ তলা বিল্ডিং-এর ‘বডি’ নির্ভুল খাপ খেয়ে যায়। আপডেটটা দিয়ে রাখার জন্য তিনি মিস্টার পীযূষ কেডিয়াকে ডায়াল করলেন।

কেডিয়াজির বুক পকেটে মোবাইল একটানা বেজে যেতে লাগল নীরব অবহেলায়।প্রথম মধ্যাহ্নের প্রখর আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ।


*****************************