কেয়া চ্যাটার্জী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
কেয়া চ্যাটার্জী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

গোলক - ধাঁধা - কেয়া চ্যাটার্জী

 

গোলক - ধাঁধা
কেয়া চ্যাটার্জী

 
 

 মিশরে এই গোলকটা আমায় আমার এক সহকর্মী, গাজী, দিয়েছিল আমার তেত্রিশতম জন্মদিনে। বলেছিল, “যেদিন অন্তরাত্মার সাথে তোমার যোগাযোগ হবে, সেদিন এর রং পরিবর্তন হবে।” কী? অন্তরাত্মার সাথে যোগাযোগ? সেটা আবার কী? যতসব আজগুবি কথা। আমি পাত্তা দিইনি সেদিন। অফিসের কাজে মাঝে মধ্যেই আমায় যেতে হয় হিল্লি দিল্লি। তাই অনেকেই আমায় চেনে। আমায় খাতির করে। আমিও সেটা বেশ উপভোগ করি। কেনই বা করবো না বলুন তো? একটা ডুবন্ত কারখানার হাল ধরে তাকে তুলে এনেছি পারে। এখন সেই কারখানার শেয়ার কিনতে মানুষ মরিয়া হয়ে পড়েছে। সেই কোম্পানির সাথে ডিল করতে ছুটে আসে দেশি বিদেশি কোম্পানি। নেল কাটার থেকে হেয়ার স্টাইলার, রান্না ঘরের বাসন থেকে কারখানার বড় বড় যন্ত্রপাতি সব কিছুতেই আমার কোম্পানির কর্মীদের ছোঁয়া। সারাদিন ওদের নাওয়া খাওয়ার সময় নেই। মেশিন অনবরত ঘটর ঘটর চলেই যাচ্ছে। সেই কোম্পানির ম্যানেজার আমি অজিতেশ বসু। 

    হুইস্কিতে চুমুক দিয়ে আমি গাজীর দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে হাসলাম, " অন্তরাত্মার সাথে কানেকশন হবে কিভাবে? সন্ন্যাস নিয়ে? অজিতেশ বসু সন্ন্যাস নিলে তোমাদের চলবে তো?" গাজী কেমন অদ্ভুত হাসল, "তোমার বড্ড অহংকার বেড়েছে বোস। অহংকার কিন্তু পতনের কারণ।" আমি মিশরীয় ভাষা খুব একটা জানি না। জানলে হয়তো গাজীকে দুটো খিস্তি মেরে দিতাম অনায়াসে। কিন্তু বিদেশ বিভুঁয়ে অকারণ রিস্ক নিয়ে লাভ নেই। ডিলটা মিটিয়েই ফিরতে হবে কলকাতা। আমাদের তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকীর জন্য ঘটা করে আয়োজন করেছে তমশা। এই একটা দিন ওর পুতুল খেলার জন্য আমি সব ছেড়ে বাড়িতে বসে থাকি। ওর পরিবার, বন্ধু বান্ধব, কলিগের কাছে আমাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখায়। দেখো কেমন বর পেয়েছি! সুপুরুষ, সুচাকুরে। আমিও যে সেটা উপভোগ করি না তা নয়। সারা বছর কাজ পাগল আমি কয়েক ঘন্টার জন্য পারিবারিক, সোশ্যাল হয়ে উঠি। 

   কাজী হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে গেলে আমি গোলোকটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখি। কাঁচের তৈরী শ্বেত শুভ্র একটা গোলক। বসার ঘরের শো কেসে বেশ মানবে। ইউনিক গিফট হিসেবে তমশাকেও চমকানো যাবে। কিন্তু গাজী হঠাৎ এরকম অদ্ভুত একখানা বস্তু আমায় উপহার দিতে গেল কেন? ব্যাটার অন্য কোন মতলব নেই তো? এমনিতেই মাঝে মধ্যে ছিচকে চুরির দায়ে জেল খাটে। আবার স্মাগলিং করছে না তো? আমি খুব ভালো করে খুঁটিয়ে দেখি। না এটা না ভেঙে এর ভিতর কিছু ঢোকানো যাবে না। অন্য কোন পথ নেই। তবে পুরোটাই সাদা। আমি স্থির করলাম মনে দোলাচলতা নিয়ে লাভ নেই। এটা এই হোটেলেই রেখে যাবো।

    রুম ছেড়ে দিয়ে গাড়িতে এসে বসেছি। কথামতো গোলোকটা রুমেই বিছানার পাশের টেবিলে রেখে এসেছি। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগের মুহূর্তে হঠাৎ হোটেলের একটি ছেলে দৌড়ে দৌড়ে এসে দিয়ে গেল জিনিসটা। ছেলেটির চোখে বিস্ময় ও ভয় মাখা, "স্যার এটা আপনি ফেলে যাচ্ছিলেন।" আমি বললাম, "না না এটা আমার নয়।" কিন্তু ছেলেটি নাছোড়। কিছুতেই এই জিনিস সে হোটেলে রাখতে দেবে না। অগত্যা গোলোকটা নিয়েই যাত্রা করতে হল। এয়ারপোর্টে ঢোকার আগে লাগেজের মধ্যে খুব সাবধানে প্যাক করলাম। কাঁচের জিনিস। ভেঙে গেলে আরেক ঝামেলা। ভীষণ বিরক্তি লাগছিল। যত ঝামেলা! যদিও কোন বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি আমায়। নির্বিঘ্নেই পৌঁছে গেছিলাম কলকাতা।
    
     তমশা ব্যাগ আনপ্যাক করতে করতে বস্তুটা বের করে আনলো। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে আমার দিকে তাকালো। আমি আমার অপ্রতিভভাব কাটিয়ে উঠে হাসি মুখে বললাম, "অ্যান্টিক। সামলে রেখো কিন্তু।" ও সন্দেহ কাটাতে পারে না তবু হেসে ড্রইংরুমের একটা তাকে গোলকটা রেখে দেয়। দরজা খুলেই যাতে গেস্টদের চোখে পড়ে। পরেরদিনই বাড়িতে অনুষ্ঠান। তমশা এই নিয়ে আর বেশি ঘাটালো না। আমি অনায়াসেই বলতে পারতাম জিনিসটা গাজী দিয়েছে। কেন যে বলতে পারলাম না?
  " বাবা! অজিতেশের কি জ্যোতিষ চর্চার ভূত চাপল নাকি?" পার্টির মাঝেই সফ্ট ড্রিংকে চুমুক লাগাতে লাগাতে বলে উঠল তমশার বন্ধু শ্রীতমা। এতক্ষন কেউ গোলোকটাকে নজর করেনি। ওর কথাতেই প্রায় সকলে এসে জড়ো হলো শেলফের সামনে। একে একে সকলে সপ্রশ্ন চোখে তাকালো আমার দিকে। আমি ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য অন্য কথা পারলাম। যেন এমন কিছুই না। তবে মনে হল যেন কেউ আমার কথা বিশ্বাস করল না। 
    একটা ব্যাপার ভীষণ তাড়া করে বেড়াচ্ছে আমায় আজকাল। কলকাতায় নামার পর থেকেই আমি কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়েছি। আমার সেই সেলফ কনফিডেন্স, সেই অহংকার, ধারালো বুদ্ধি কেমন যেন ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। আমি কোন কাজই ঠিক মতো করতে পারছি না। কেউ যেন আমায় বিশ্বাস করছে না। সেদিন তমশা যেভাবে তাকিয়েছিল, বিবাহ বার্ষিকীর দিন অতিথিরা যেভাবে চেয়েছিল আমার দিকে আমি যেন কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম নিজের ভেতর। এরকম তো কখনো হয়নি। যখন পড়াশোনা শেষ করার লড়াই লড়ছিলাম, যখন চাকরির জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, যখন নিজের সর্বস্ব দিয়ে উন্নতির চেষ্টায় লেগেছিলাম — কখনো এতো দুর্বল হয়ে পড়িনি। কখনো মনে হয়নি আমায় সবাই অবিশ্বাস করছে। আমার মাথার ভেতর তৈরী করা ফাঁদ সবাই দেখতে পাচ্ছে। যে অজিতেশ বসু সমীহ চায়, সম্মান চায়, খ্যাতি, প্রতিপত্তি, যশ চায় তাকে সবাই ঘেন্না করছে। আমার ভেতরটা ক্রমে ক্ষয়ে যাচ্ছে। আমি যেন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি।
   ঘুমটা ভেঙে গেল। মোবাইলের ঘড়িতে রাত তিনটে। ঘরে এসির তাপমাত্রা সর্বনিম্ন। তবু আমার জামা ঘামে ভিজে গেছে। ওয়াশরুমে এসে মুখে চোখে জল ছিটিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিলাম। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। কেন যে এমন হয়ে পড়ছি জানি না। কদিনের মধ্যেই ডাক্তার দেখানো দরকার। প্রয়োজন হলে মানসিক ডাক্তারও। হলের ঘড়িতে একটানা আওয়াজ হচ্ছে টিকটিক। হঠাৎ চোখ গেল সেই গোলোকটার দিকে। অন্ধকারে যেন আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এতটা আলোকিত তো দেখিনি আগে! অবশ্য রাত্রে জিনিসটাকে তো ভালো করে দেখিইনি কখনো। গোলোকটা হাতে নিয়ে বসে পড়লাম সোফায়। আহ! কি শান্তি। ভেতরটা কেমন শান্ত হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। অপলক তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে গোলোকটার দিকে। কি সুন্দর রং! অন্তরের সব গ্লানি, সব দুর্বলতা, মলিনতা, ক্লেদ যেন ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একি, এটা কি হচ্ছে? রংটা হঠাৎ পাল্টে যাচ্ছে কেন? সাদা রং পাল্টে গিয়ে হয়ে উঠছে সবুজ। সবুজ, সবুজ— ঈর্ষার রং সবুজ। হ্যাঁ হিংসেই তো করতাম আমি পরাগকে। তমশার সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল পরাগের সেই কলেজ জীবন থেকে। সেই সুবাদেই ওর বাবার কোম্পানীতে চাকরিটা পেয়ে যায়। তখন আমি সামান্য ক্লার্ক। চোখে স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়ার। ম্যানেজারের চেয়ারটা না পেতে পারলে যেন শান্তি নেই। তমশাকে কি আমি ভালোবেসেছিলাম কখনো? না বোধহয়। ও-ই তো ছিল আমার স্বর্গে ওঠার একমাত্র সিঁড়ি। বাধা ছিল পরাগ। সেইজন্যই তো সব প্ল্যান। এক পার্টির রাতে ঘুমের ওষুধ মেশালাম ওর ড্রিঙ্কসে। রিটাকে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম। টাকা কথা বলে কিনা! পরাগ বেসামাল হতেই ওকে হোটেলের রুম খুলে দেওয়া হল। ও শুয়ে পড়ল। শুধু আমি জানলাম ও বেহুঁশ। তারপর সুযোগ বুঝে টুক করে রিটাকে ঢুকিয়ে দিয়ে কয়েকটা অন্তরঙ্গ ছবি আর একটা এম এম এস। ব্যাস, ওদের সম্পর্ক ভাঙতে বেশিদিন লাগেনি। পরাগ মুখ লুকাতে কোথায় যেন পালিয়ে গেল। অনেকে বলে নাকি সুইসাইড করেছে। আমি খোঁজ নিইনি। নিয়েই বা কি লাভ? যেখানে আমার ধান্দা নেই, সেখানে আমার শ্রম নেই। তারপর তমশাকে জালে ধরতে কম কশরৎ করতে হয়নি। ইন্টেলেকচুয়াল মেয়ে। যতসব ন্যাকামি! 
      এই তো, এই তো আবার রং পাল্টাচ্ছে। রং পাল্টে হয়ে যাচ্ছে লাল। লাল, লাল — লোভের রং লাল। তমশাকে বিয়ে করার পর আমার একটাই উদ্দেশ্য ছিল, কোম্পানির সর্বেসর্বা হয়ে ওঠা। একমাত্র কন্যা সন্তানের পিতা সমস্ত সম্পত্তিই মেয়ের নামে করে গেছিলেন। ধীরে ধীরে আমার জাল গোটাতে গোটাতে সবটাই কুক্ষিগত করে ফেললাম। কিন্তু ও হরি! এতো কিছুর পর পুরোটাই ব্যর্থ। কোম্পানি শুধু নামেই বড়। ভেতরটা ফাঁপা। একটু হাত সাফাই করতে গেলেই ধসে পড়বে। অভিজ্ঞ বুড়োর ঠিক নজরে পড়েছে সেটা। অগত্যা হাল ধরতে হল। একবার যদি বুড়ো মরে তার সব সম্পত্তি তমশার আর তমশা মরলে....হা..হা..হা...
    ওই তো ওখানে দাঁড়িয়ে তমশা। ওর চোখে ঘৃণা। ওর চোখে রাগ। পাশে কে? পরাগ? এখনো, এখনো তমশার মন প্রাণ জুড়ে পরাগ? আমি নেই? বেইমান মেয়ে! রাগে আমার সারা শরীর ফুঁসতে শুরু করেছে। লাল আরো গাঢ় লাল হয়ে যাচ্ছে গোলোকের রং। শ্বশুরের সাথে কোম্পানির একাউন্ট নিয়ে বচসা হচ্ছিল সেদিন। তপব্রত লাহিড়ী অজিতেশ বসুকে সন্দেহ করছে। হ্যাঁ আমি সরিয়েছিলাম পঞ্চাশ হাজার। তাতে কি? প্রমাণই বা কই? তলে তলে যে আমি কোম্পানি বেচে ফেলার মতলব এঁটেছি তা কি আর জানতে বুড়ো?  লোকটা আমায় চোর বলল। অপমানে মাথা গরম হয়ে গেল। হাঁপানির রোগ ছিল লোকটার। সুযোগ বুঝে ইনহেলারটা পকেটে ঢুকিয়ে বেরিয়ে গেলাম। শ্বশুর বাড়িতেই তো থাকতাম। তপব্রত লাহিড়ীর ঘরে ঢুকে ইনহেলারের শিশিটা নামিয়ে রেখে দিলাম। কেউ বুঝল না এটা খুন। সবাই জানল অসুস্থতার ফলে মৃত্যু। ঐ তো ঐ ব্যালকনির সামনে দাঁড়িয়ে মিস্টার লাহিড়ী। আমায় দেখে হাসছে। বিদ্রুপের হাসি। তাচ্ছিল্যের হাসি। বলছে অজিতেশ বসু লুসার। 
    আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমি লুসার? এতদিন এত পরিশ্রমের পরেও আমি লুসার? আমি দুহাতে ওদের কলার চেপে ধরলাম। তোমরা আবার ফিরে এসেছ? পরাগ, তুমি তমশাকে আর পাবে না। আর এই যে মিস্টার লাহিড়ী তোমায় আবার, আবার খুন করবো আমি। কিন্তু, কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? এরা তো মৃত। এরা কিভাবে এলো? হঠাৎ মনে হল আমি যেন হাওয়ায় ভাসছি। আবার মিশে যাচ্ছি মাটির বুকে। লাল, লাল— প্রেমের রং লাল। আমার চারিদিকে লাল রক্তের ছড়াছড়ি। তমশা ব্যালকনি থেকে বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে আমার দিকে। ওর হাতে সেই গোলক। শ্বেতশুভ্র রং। স্নিগ্ধ। তুমি কাঁদছ তমশা। আমার মতো কীটের জন্য? তুমি আমায় ঘৃণা করো তমশা। আচ্ছা, ঘৃণার রং কী? তুমি স্বছতোয়া নদীর মতো নির্মল। তাই তো গোলোকটা রং পাল্টাচ্ছে না। আমার ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে তমশা।  চোখ বন্ধ হওয়ার আগে গাজীর কথা মনে পড়ল, "যেদিন অন্তরাত্মার সাথে তোমার যোগাযোগ হবে সেদিন রং পাল্টে যাবে।" রঙ পাল্টেছে গাজী। তোমার জ্বালা জুড়িয়েছে তো?

.......................................
অলঙ্করণ :-  প্রিয়াঙ্কা সরকার
 

 

গ্র্যান্ডফাদার ক্লক - কেয়া চ্যাটার্জী


গ্র্যান্ডফাদার ক্লক
কেয়া চ্যাটার্জী
 

    শমিত আর নয়নার এন্টিকের খুব শখ। সেই জন্যেই রাসবিহারীর ফ্ল্যাটটা কেনার পর নতুন আসবাবের বদলে ওরা ঘর সাজিয়েছিল পুরোনো আসবাব দিয়ে। খাট, ড্রেসিং টেবিল, আলমারি, সোফা, ডাইনিং টেবিল, ফুলদানি সব স--ব পুরোনো ধাঁচের বা বিভিন্ন দোকান থেকে খুঁজে আনা আসবাব। নতুন ফ্ল্যাট দেখতে এসে এরকম মান্ধাতা স্টাইলের আসবাব দেখে অনেকে নাক কুঁচকেছে, অনেকে চোখ কপালে তুলেছে, অনেকে গালে হাত দিয়ে অবাক হয়েছে। কিন্তু শমিত-নয়না কোনো এক্সপ্রেসনেই তেমন পাত্তা দেয়নি। আসলে থাকবে তো ওরা দুজন। তাহলে থাকার জায়গাটা অন্য কারুর পছন্দ অনুযায়ী কেন হবে? ওদের হাসি খুশি সংসারের ওরাই রাজা।
 
      নয়না একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরি করে। সিনিয়র সেলস এক্সিকিউটিভ পোস্টে। ওর হাতের নীচে কাজ করে আরো একশো জন। শমিত একটু ভুবনভোলা। একটা কোম্পানীতে বেশিদিন থাকতে পারেনা। কোনো একসময় কমার্স নিয়ে গ্রাজুয়েশন করেছিল। সেই সুবাদে হিসেব রক্ষকের কাজ পেয়ে যায় মাঝে সাঝে। একটা লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদক সে। নিজে খুব ভালো কবিতা লেখে। প্রতিবাদী কবিতা, সমাজমুখী কবিতা।  সাহিত্য নিয়ে বেশিরভাগ সময়টাই কেটে যায়। নতুন লেখকদের দু-একটা এন.জি.ও-র সাথেও যুক্ত শমিত। এতো সব কর্মের পরে টাকা রোজগারের কর্মের বেলায় ভুল হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক শমিতের পক্ষে। একবার-দুবার নয় বেশ কয়েকবার চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছে সে। ঘরে ফিরে শমিতের মুখ দেখে নয়নাও বুঝে যায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। এই পুনরাবৃত্তি এতবার ঘটেছে ওদের জীবনে যে শমিতের অভিব্যক্তি নয়নার প্রায় ঠোঁটস্থ। 
  
    এরকমই এক কর্মহীন দিনে শমিত আবিষ্কার করলো তার নতুন ফ্ল্যাটের ডোরবেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে সে ভাতঘুম ছেড়ে ঢুলতে ঢুলতে দরজা খুলেছে ও দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের মধ্যে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে এসেছে চারজন হাফপ্যান্ট পরিহিত কোমরে গামছা বাঁধা, গেঞ্জি পরা লোক। চোখ কচলে শমিত আরেকবার আবিষ্কার করলো তাদের হাতে একটা লম্বা ঘড়ি। লোকগুলো ঘরে ঢুকে যেতেই ওদের পিছন পিছন হিল তোলা জুতোয় হুল্লোড় তুলে প্রায় দৌঁড়ে ঘরে ঢুকল নয়না। শমিতকে পাশ কাটিয়ে লোকগুলোর উদ্দেশ্যে বলে উঠল, “দাদা এই ডানদিকের দেওয়াল ঘেঁষে রাখুন। না না, দেওয়ালে ঠেস দেবেন না। হ্যাঁ ঠিক আছে।” কাজ হয়ে গেলে লোকগুলির বকেয়া টাকা মিটিয়ে দরজা বন্ধ করে নয়না। শমিত ঘড়িটিকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে। নয়না শমিতের পর্যবেক্ষণে বাধা না দিয়ে চলে যায় ওয়াসরুমে।
 একটা গ্র্যান্ডফাদার ক্লক। মাটি থেকে প্রায় এক মানুষ উঁচু। কালো কুচকুচে। তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই তবে কাঠের ওপর ছেনি হাতুড়ির আঘাতে তোলা নক্সাগুলি খুবই সুন্দর। মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না।  শমিত বস্তুটার গায়ে হাত ছোঁয়াল। হাত বোলাল নক্সার চারিদিকে। ধীরে ধীরে ঘড়ির পেন্ডুলামটা নাড়িয়ে দিতেই ঢং ঢং শব্দ করে ডানে বামে একবার দুলে আবার থেমে গেল। নয়না কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারেনি শমিত। অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল ঘড়িটার দিকে। এরকম জিনিস এর আগে কখনো দেখেনি সে। এতো পুরোনো একটা জিনিস, এতো যত্নে রাখা! নয়নার কণ্ঠে ঘোর কাটে তার, “ঘড়িটা কিন্তু চলে না।” শমিত দেখল নয়না এর মধ্যেই ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। ফ্রিজ থেকে একটা বোতল বের করে ঢকঢক করে ঠান্ডা জল গলায় ঢালছে। শমিত চোখ কুঁচকে বলল, “চলে না? তাহলে শব্দ হলো যে?"
― ওই শব্দই সার। কাঁটা নড়ে না।
― তাহলে কিনলি কেন?
― কেন আবার, জিনিসটা দেখ। প্রায় আশি বছরের পুরোনো। কতো যত্নে রাখা দেখ! 
― বন্ধ ঘড়ি রাখবি? একবার সারিয়ে নিলে হতো না?
― সারাতে গেলে অনেক খরচ পরে যাবে। শোপিসের মতো থাকবে। চাপ নেই। কেন তোর পছন্দ নয়?
― পছন্দ । বাট...
― কফি খাবো।
 
     শমিতকে আর কথা বাড়াতে দেয়না নয়না। শমিতও আর কথা বাড়ায় না। বোঝে যে নয়না আর বাড়তি কথা শুনতে রাজি নয়। বলাবাহুল্য, তার মতো উড়নচন্ডী স্বভাবের ছেলের পক্ষে দক্ষিণ কলকাতায় ফ্ল্যাট, দামি আসবাবপত্র, নিত্য নৈমিত্তিক জীবন যাপনের খরচ যোগানো সম্ভব হতো না কখনই। যদি না নয়নার মতো সহনশীল মেয়ে তার পাশে থাকত। সংসারের প্রায় সবই নয়নার রোজগারে চলে। তাই শমিতকে মাঝে মধ্যে নয়নার খামখেয়ালিপনাকে প্রশ্রয় দিতে হয়। শমিতের সব ব্যর্থতা, স্বপ্নকে নিজের করে নিয়েছে নয়না। নয়না না থাকলে শমিত হয়তো যন্ত্র হয়ে যেত।
 
     শমিত রান্নাঘরে যাওয়ার আগে আরেকবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ঘড়িটা। একটা শোপিসই বটে। কোনো কাজ নেই। ন্যূনতম সময়টুকুও দেখায় না। শমিত একবার হাসল,  সেও এ বাড়ীতে ঘড়িটার মতোই। শোপিস। ন্যূনতম বাজারটুকুও করেনা।
  
    অনিমেষদের বাড়ি থেকে ফিরতে বেশ দেরী হলো শমিত-নয়নার। আজ অনিমেষ-পিয়ালীর পাঁচ বছরের বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ ছিল । অনিমেষ নয়নার অফিস কলিগ। দরজার লক খুলে সুইচে হাত দেওয়ার আগে শমিত একবার তাকালো ঘড়িটার দিকে। কয়েক পলকের জন্য যেন মনে হলো ঘড়িটার পেন্ডুলামটা দুলছে। শমিত কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল। বোঝার চেষ্টা করলো ঘটনাটা তার চোখের ভুল নাকি বাস্তব। নয়না ঘরে প্রবেশ করে লাইট জ্বালিয়ে বলল, “কি রে লাইট টা জ্বালা?" শমিত চমকে তাকালো নয়নার দিকে। বলল, “ঘড়িটা চলছিল।" নয়না তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল, “ক'পেগ চড়িয়েছিস? বন্ধ ঘড়ি নাকি চলছে। আমি আলী বাবুকে জিজ্ঞাসা করেছি, উনি বলেছেন গত পঁচিশ বছর এই ঘড়ি নড়েনি। আলিপুরের এক পার্সি ফ্যামিলি বাড়ী ছাড়ার আগে আলিবাবুর কাছে বেশিরভাগ ফার্নিচার বিক্রি করে দিয়ে গেছেন।” শমিত আরেকবার ঘড়িটার সামনে দাঁড়ালো। না পেন্ডুলাম নড়ছে না। যদি কোনো রকম হেলদোল হতো তাহলে ওদের ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তা থেমে যেত না। অন্তত বিজ্ঞানসম্মতভাবে তো না-ই। বেশি কিছু ভাবলো না সে। বেশি ভাবলে নেশাটা কেটে যাবে। 
  
    কিন্তু মনের ভিতর একটা খচখচানি রয়েই গেল। এতটা ভুল? না খুব বেশি নেশা তো সে করেনি। জানলার কাঁচ ভেদ করে আসা রাস্তার লাইটপোস্টের আলোয় সে স্পষ্ট দেখেছে পেন্ডুলামটা নড়ছিল। তাহলে আলো জ্বলার সাথে সাথে পেন্ডুলামটা থেমে গেল কি করে? হাওয়া? না, হাওয়া ঢোকার কোনো জায়গাই নেই। ঘরের সব জানলা বন্ধ। আর অতো ভারী বস্তুটা হাওয়ায় নড়বে ভাবাই যায়না।
  
     কিছুতেই ঘুম আসছে না শমিতের। সে কি ঘড়িটা নিয়ে বেশি ভাবছে? সে কি ঘড়িটার  সাথে একাত্ম হয়ে পড়ছে? সেই জন্যই আজ সারা সন্ধ্যে সে এই পুরোনো ঘড়ির সম্বন্ধে ভেবেছে? বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে চোখটা বুজে আসল আর সঙ্গে সঙ্গে কানে এলো একটা শব্দ― ঢং, ঢং। লাফিয়ে উঠল শমিত। সে কি ভুল শুনল? নাঃ স্পষ্ট শব্দ। ঘড়ির শব্দ। এরকম শব্দ তো এর আগে তাদের ফ্ল্যাটে শোনা যায়নি। শমিত তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দরজার কাছে এসেও গতি কমিয়ে দিল। তার কানে ভেসে আসছে আরেকটা শব্দ। ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ। বেশ জোরে। ক্রমাগত শব্দটির গতি আরো বাড়ছে। শমিত এবার খুব সাবধানে দরজাটা খুলল। হ্যাঁ শব্দটা ড্রয়িং রুম থেকেই আসছে। সারা ঘরটা যেন ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দে ভরে গেছে। শমিত এবার পা রাখল ড্রয়িং রুমে আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এক অন্যরকম অস্বস্তি চেপে ধরল তাকে। মনে হলো যেন কয়েক জোড়া চোখ তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। যেন শমিত এসে পড়ায় ওদের অসুবিধা হয়েছে। ওরা যেন ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়েছে। এদিকে শমিত চোখের সামনে কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে ঘরের মধ্যে গরম হাওয়া খেলে বেড়াচ্ছে। মাঘ মাসের রাত্রেও শমিতের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। শমিত ধীরে ধীরে পিছতে শুরু করলো। মনে হলো যেন আরো কয়েকজন তার দিকে এগিয়ে আসছে। টিকটিক শব্দটা অব্যাহত। আড় চোখে দেখল গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকের দিকে। পেন্ডুলাম দুলছে। হ্যাঁ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে শমিত। পেন্ডুলামটা ভীষণ স্বাভাবিক গতিতে দুলছে। কি এক অদ্ভুত অনুভূতি পেয়ে বসল তাকে। তার দিকে কারা যেন হিংস্র চোখে তাকিয়ে আছে। এখুনি এই জায়গা না চাইলে হয়তো সে প্রাণে বাঁচবে না। শমিত দ্রুত পায়ে পড়িমরি করে ছুটল শোয়ার ঘরের দিকে। দরজা বন্ধ করে বিছানায় উঠে কম্বল চাপা দিয়ে জাপটে ধরল নয়নাকে। অঘোরে ঘুমোনো নয়নাও জড়িয়ে ধরল স্বামীকে। সারারাত শমিতের ঘুম এলোনা। ঘড়ির শব্দ যেন তার মস্তিষ্কে প্রবেশ করেছে। ভোরের আলো জানলা চুঁয়ে ঘরে প্রবেশ করলে সেই শব্দ মিলিয়ে গেল। শমিতের চোখে ঘুম নেমে এলো।

“এই সমু ওঠ। কি রে দশটা বাজে।” নয়নার ডাকে ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ে শমিত। সারা ঘরে আলো খেলা করছে। চোখ মেলতেই বুঝতে পারল তার মাথাটা ধরেছে। নয়না মুখে প্রসাধন লাগাতে লাগাতে জিজ্ঞেস করলো, “কি রে শরীর খারাপ?” শমিত নিঃশব্দে ঘাড় নেড়ে জানালো― না। ড্রয়িং রুম পেরিয়ে বাথরুম যাওয়ার পথে নজরে এলো ঘড়িটা। নির্বিবাদী জড়পদার্থের মতো দাঁড়িয়ে আছে। নয়না ব্যাগ গোছাতে গোছাতে ঘর থেকে বেরিয়ে শমিতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার পাশে এসে দাঁড়ালো, “এনিথিং রং?" শমিত নয়নার দিকে না তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, “ঘড়িটা কোথা থেকে এনেছিস?" 
― কেন? বললাম যে আলিবাবুর কাছ থেকে। আমাদের বেশির ভাগ ফার্নিচারই তো ওঁর থেকে নেওয়া। তোর পছন্দ হয়নি জিনিসটা, না?
― পছন্দ।
― তাহলে?
― ঘড়িটা ঠিক সুবিধের না।
― মানে?
― মানে... তুই ফিরে আয় অফিস থেকে তারপর...বলবো।

    মুখে বললেও আদপে শমিত নয়নাকে গতরাতের কোনো কথাই জানালো না। আসলে সে অপেক্ষা করছিল আরেকটি অভিজ্ঞতার। আদৌ কাল সে সঠিক দেখেছে কি না সেটা যাচাই করতে। নয়নাকে কিছু বললে সে হয়তো নেশার অজুহাতে উড়িয়ে দিতে পারে তার কথাগুলো। শমিত তাই আরেকবার অপেক্ষা শুরু করলো।
 
     সুযোগও এসে গেল। রাত দুটো। আবার বেজে উঠল ঘড়ি। শমিত চোখ মেলল। নাঃ কোনো ভুল নেই। সে পা টিপে টিপে চলল দরজার দিকে। আগেরদিনের মতোই খুলল দরজাটি। এবারেও মনে হলো তার আগমনে কারা যেন তার দিকে তাকালো। কিন্তু ওদের দৃষ্টিতে আগেরদিনের মতো অসন্তোষ নেই, আছে উদাসীনতা। শমিত জল খাওয়ার অছিলায় এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে। সে অনুভব করলো চোখগুলিও তাকে অনুসরণ করছে। গেলাসে জল ঢেলে সে বসল সোফায়। চারিদিক অন্ধকার, রাস্তার আলোর ছটা এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে। নিস্তব্ধ রাজপথ। তবু শমিতের মনে হলো যেন একটু আগে এই ঘরে মজলিস বসেছিল। দেশীয় নয়, বিদেশি মজলিস। পিয়ানো বাজাচ্ছিল কেউ, কেউ গান করছিল, কেউ হয়তো সুরা পান করতে করতে সেই গান মত্ত হয়ে শুনছিল। কেউ ফিসফিস করে মজার কথা বলে লুটিয়ে পড়ছিল সঙ্গিনীর কাঁধে। শমিতের মনে হলো এইসব কিছু তার পদচারণায় স্তব্ধ হয়ে গেছে। তারা তার চলে যাওয়ার অপেক্ষা করছে। শমিত বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারলো না। আবার আগেরদিনের মতো ঘরে ঢুকে ধড়ে প্রাণ পেল সে।
  
    সকাল হতে নয়নাকে অবাক করে শমিত বলে উঠল, “নয়ন আমার জন্য প্লিজ একটা চাকরি খুঁজে দে। যা খুশি। আমার ঘরে থাকতে ভালো লাগছে না।” নয়না এরকম প্রস্তাবে যতটা খুশি তার থেকেও বেশি অবাক। কারণ এর আগে শমিতকে এই ধরণের প্রস্তাব দিয়েছে সে কিন্তু শমিত ফুৎকারে তা উড়িয়ে দিয়েছে। আজ স্বয়ং শমিতের মুখে এই কথা শুনে সে আনন্দে জড়িয়ে ধরে স্বামীকে। সন্ধ্যেবেলা খবর দিল আগামী সপ্তাহের শুক্রবার মিস্টার সরকারের অফিসে শমিতকে দেখা করতে হবে। শমিতের ভেতরটা গুলিয়ে উঠল। ভয়ে, আতঙ্কে। নয়না অফিসে যাওয়ার পর সারা সকাল, দুপুর তাকে একা থাকতে হয় ফ্ল্যাটে। সঙ্গে থাকে ওই ঘড়ি। ঘড়িটার পাশ থেকে যাওয়ার সময় মনে হয় যেন ঘড়িটা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নয়নাকে সে বলতে পারছে না এসবের কিছুই। নয়না কেন, তার অনুভূতি গুলো কাউকেই বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। আগামী শুক্রবার মানে এখনো পাঁচ পাঁচটা দিন। শমিত দিন গুনতে শুরু করে।
 
      আরেকটা রাত। শমিতের চোখ খুলে গেল। হ্যাঁ শব্দ। ঢং---- ঢং। মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে দেখল আবার রাত দুটো। কিন্তু এবারে এক অন্যরকম টান অনুভূত হতে লাগল তার। যেন কেউ তাকে ড্রইংরুমের দিকে ডাকছে। সে কোনো শব্দ শুনতে পারছে না কিন্তু অনুভব করছে কারা যেন তার জন্য বসে আছে বাইরের ঘরে। শমিত উঠে দাঁড়ায়। আবার দরজার দিকে পা বাড়ায়। ড্রইংরুমে গিয়ে বসে। এখন তার সেই অস্বস্তি হচ্ছে না। তার নিজেকে অবাঞ্চিত মনে হচ্ছে না। এই ঘরের অধিবাসীরা যেন তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। শমিত অনুভব করল তার কান ছুঁয়ে গেল একটি শীতল বাতাস। কেউ যেন কিছু বলল। তার স্নায়ুগুলি শান্ত হয়ে গেছে। শমিতের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল।

    পর পর চার রাত ঘুমায়নি শমিত। প্রতি রাত্রে দুটোর সময় তার ঘুম ভেঙে যায়। সে ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসে সম্মোহিতের মতো। তারপর কি যে হয় তার মনে থাকে না আর। তার লেখার খাতা পড়ার ঘরের টেবিল ছেড়ে ডাইনিং টেবিলে ঘোরাঘুরি করে। প্রায় দিনই নয়না তাকে সোফায় ঘুমন্ত অবস্থায় আবিষ্কার করেছে। আজকাল তার লেখার পরিমাণ বেড়েছে। প্রতিবাদী কবিতার ধাঁচ পাল্টে প্রেমের কবিতা হয়েছে। নিজের ভেতর এক পূর্ণতা অনুভব করছে শমিত। সে যেন বন্ধু পেয়েছে। তার মতো অসফল ব্যক্তির কথা শোনার লোক পেয়েছে। কিন্তু শমিত তাদের দেখতে পায় না। অনুভব করে। আসলে বিছানা ছেড়ে সোফায় বসা ইস্তক তার মনে থাকে ঘটনাক্রমগুলি কিন্তু তারপর শমিতের মস্তিস্কে কোনো ছবিই ধরা থাকে না। শমিতের মনে হয় সে যেন সারারাত কাদের সাথে গল্প করে। কবিতা শোনায়। সবই আবছা স্মৃতি। তারা ওকে উৎসাহ দেয় লেখার। কিন্তু শমিতকে ওরা এই ফ্লাটের বাইরে যেতে দেয় না। শমিতেরও ইচ্ছে হয়না কারুর বাড়ি যেতে। বন্ধুদেই সাথে দেখা করতে। নয়নার সাথে ঘুরতে যেতে। কারা যেন এই ফ্ল্যাটের চার দেওয়ালে তাকে আটকে রেখেছে।
 
   শুক্রবার বাড়ী ফিরে নয়না দেখল শমিত তার লেখার টেবিলের ওপর প্রায় উপুড় হয়ে কিছু লিখছে। অন্য কোনদিন হলে শমিতকে সে বিরক্ত করতো না। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা।  শমিতের টেবিলের ওপর একটা থাপ্পড় কষিয়ে সে বলে উঠল, “আমার মান সম্মানের কথা কবে ভাববি তুই শমিত? তুই নিজে চাকরির কথা বলেছিলি আমায়, আমি বলিনি। তাও আজ তুই গেলি না! মিস্টার সরকার আমায় ফোন করে যা নয় তাই বললেন। আমি কিছুই বলতে পারলাম না। কারণ আমি তো এটাই ডিসার্ভ করি। কেন গেলি না বল, কেন গেলি না?” শমিত ফ্যালফ্যাল করে নয়নার দিকে তাকিয়ে  বলল, “ওরা যেতে বারণ করল যে।" নয়না শমিতের চোখ দেখে একটু ভয় পেল। আশঙ্কা হলো। সে বলল, “কারা বারণ করলো তোকে?” শমিত কাগজে মনোনিবেশ করে বলল, “আমার বন্ধুরা।"
― কোন বন্ধুরা?
― যারা রাত্রে আসে।
― রাত্রে কারা আসে?
শমিত লাজুক মুখে তাকালো নয়নার দিকে। নয়নার বুক কেঁপে উঠল। এ কাকে দেখছে সে! এরকম ভাব-ভঙ্গী তো শমিতের নয়। এরকম চোখ, হাসি, চাহুনি তো শমিতের নয়। সে শমিতের হাতে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলো, “কারা আসে রাত্রে শমিত? আমায় বল। প্লিজ বল।” শমিত নয়নার কাছে এসে বলতে শুরু করলো এই কয়দিনের গল্প।

―“মিস্টার সেন, আপনার বন্ধুরা আপনার সাথে কি কথা বলে?"
― আমি জানি না।
― একটু মনে করার চেষ্টা করুন।
― না, মনে পড়ছে না।
― ঠিক আছে। মাথায় চাপ দিতে হবে না। মিসেস সেন আমি ওনাকে যে ওষুধ গুলো লিখে দিচ্ছি রেগুলার খাইয়ে যাবেন। আর পরের মাসে আবার একবার আসবেন। 
  মনোবিদের চেম্বার থেকে বেরিয়ে নয়না শমিতের কাঁধে হাত রেখে বলল, “ভরসা রাখ সমু সব ঠিক হয়ে যাবে।"
― তুই আমায় বিশ্বাস করলি না নয়ন।
― আমি...
নয়নার কথা শেষ হওয়ার আগেই  শমিত হাঁটা লাগলো।
  
    শমিতকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বোলাতে শুরু করল নয়না। কপালে চুমু এঁকে শমিতকে আবার আশ্বস্ত করলো, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তার তাকে শিখিয়ে দিয়েছে এই কথাটা বারবার বলতে। শমিতের যেন কোন মতেই নিজেকে অবাঞ্চিত মনে না হয়। আসলে কর্মজীবনের ব্যর্থতাই তাকে পুরোনো অচল ঘড়িটার সাথে একাত্ম করে তুলেছে। তাই ওর মধ্যেই সে নিজেকে খুঁজে পায়। ঘড়িটাকে ও নিজের প্রতিচ্ছবি করে তুলেছে। একাত্মতা অনুভব করছে। ওই ঘড়িই যেন ওর সব অনুভূতি বুঝতে পারে। নয়না ভাবার চেষ্টা করে ঠিক কোথায় খামতি থেকে গেছে তার চেষ্টায়। কেন শমিত একটা জড়বস্তুর সাথে নিজেকে এক করে নিচ্ছে।  
   কিছুক্ষনের মধ্যে শমিত ঘুমিয়ে পড়লে সেও ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুম ভেঙে যায় একটা শব্দে। খুট করে একটা শব্দ উঠতেই নয়না তাকে দরজার দিকে। দরজা খুলে কে যেন ড্রইংরুমে গেল। পাশে তাকিয়ে দেখল শমিত বিছানায় নেই। নয়নার বুক কাঁপল। এতো হাই ডোজের ওষুধ খেয়ে শমিতের কোনমতেই ঘুম ভাঙার কথা নয়। সে সন্তর্পনে পা রাখে ড্রইংরুমে। দেখে শমিত তার দিকে পিঠ করে, পুরোনো ঘড়িটার সামনের সোফায় বসে আছে। ঘরের ভেতর এক অসহ্য গুমোটভাব। নয়না ডাকে, “শমিত কি করছিস তুই?" শমিত তার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দেয়, “তুই এখন যা নয়ন। ওরা অফেন্ডেড হচ্ছে।"
― কারা?
― আমার বন্ধুরা।
― শমিত ঘরে কেউ নেই। শুধু তুই আর আমি।
― আছে। তুই দেখতে পারছিস না।
― পাগলের মতো কথা বলিস না শমিত উঠে আয়। এক্ষুনি উঠে আয় বলছি।
নয়না এগিয়ে এসে শমিতের হাত ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করে। শমিত তাকায় নয়নার দিকে আর তাতেই তার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে আসে। শমিতের চোখ দুটো পাথরের মতো সাদা। তার কানে ভেসে আসে আরেকটা শব্দ টিকটিক...টিকটিক...ঢং.... সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রবল ধাক্কা অনুভব করে নয়না। কে যেন তাকে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ঠেলে ফেলে দিল। শমিত ঠায় বসে রইল সোফায়। নয়না দরজার ছিটকে পরে জ্ঞান হারাল।

   পরদিন সকালে কোলাহলে ঘুম ভাঙে শমিতের। সোফাতেই শুয়েছিল সে। চোখ খুলতেই দেখল বেশ কয়েকজন লোক গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকটা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। শমিত বাধা দিতে এলে নয়না সামনে এসে দাঁড়ায়। তার চোখের কোণে কালি। ডানদিকের গালটা ফুলে কালো হয়ে গেছে। শমিত আঁতকে ওঠে, “কি হয়েছে তোর?” নয়না সেই কথায় আমল
 বলে, “তুই ঠিক বলেছিলি। বন্ধ ঘড়ি বাড়ীতে রাখাটা ঠিক নয়। ওটা আলিবাবু কে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর আজ আমরা একটু ঘুরতে বেরোবো। ডেট। ওকে?” 
শমিত মৃদু প্রতিবাদ করে বলল, “কিন্তু ওরা?"
― কেউ নেই শমিত। বিলিভ মি। একটু ঘুরে আসি চল। দেখবি ফ্রেশ লাগবে। সব কাজে মন বসাতে পারবি। প্লিজ, চল। ঘড়িটার কথা আর ভাবিস না।

    নয়না বলল বটে কথাগুলো কিন্তু গত রাতে দেখা দৃশ্য সে কাউকে বলতে বা বোঝাতে পারবে না। তাই সকাল হতেই আলিবাবুর দোকানে ফোন করে ঘড়িটা নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেছে সে। আর বলেছে ওরা দুজন যেকোনো এক সময় তার দোকানে যাবে। আলিবাবুও বহুদিনের খদ্দেরকে না চটিয়ে লোক পাঠিয়েছেন তড়িঘড়ি।
শমিত ঘাড় নাড়ে। নয়নার কোনো কথাতেই সে খুব একটা বাধা দেয়না, আজও দিল না। আর এই ঘড়ির আপদ বিদায় হলে সে নিজেও বাঁচে। কতো রাত যে সে ঘুমোতে পারে নি। কতো দিন যে সে ভয়ে ভয়ে আতঙ্কে দিন কাটিয়েছে। তা শুধু সেইই জানে। বাড়ীর বাইরে পা রাখেনি বহুদিন। কে যেন তার পায়ে বেড়ি পরিয়ে রেখেছিল। কিছুতেই তাকে ছাড়ছিল না সেই শক্তি। ঘড়িটার সাথে যদি সেই অস্বস্তিকর অনুভূতিগুলোও চলে যায় তবে জীবনটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে আবার।
ঘড়িটা নিয়ে চলে যেতেই শমিত সেই ফাঁকা জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করে কিছু একটা। নয়না আঁতকে উঠে শমিতকে টেনে আনে দূরে। মাথা নেড়ে আবার বলে, ওটা নিয়ে আর চিন্তা করিস না। চল বেরিয়ে পরি।
     ওরা ঘর বন্ধ করে বেরিয়ে গেল। কতদিন পর যে এরকম একটা দিন কাটালো ওরা, তা হয়তো ওদের নিজেদেরই মনে নেই। কলকাতা ছেড়ে হাইওয়ে ধরে অনেকটা লংড্রাইভ সেরে, রেস্তোরাঁয় খাবার খেয়ে ওরা পৌছল আলিবাবুর দোকানে। আলিবাবু তখন দোকান বন্ধ করতে উদ্যত হচ্ছেন। ওদের দেখে একটু বিরক্ত হলেও তা প্রকাশ করলেন না। চেয়ার পেতে বসতে দিলেন ওদের। নয়না কোনো প্রকার ভণিতা না করে বলে উঠল, “আলিবাবু ঘড়িটায় অস্বাভাবিক কিছু আছে। ঘড়িটা আপনি কোথা থেকে পেয়েছেন? কে আপনাকে ওটা বিক্রি করেছে। প্লিজ বলুন আমাদের।" আলিবাবু বৃদ্ধ ও অভিজ্ঞ মানুষ। নয়নার মুখ দেখে বুঝলেন কিছু একটা ঘটেছে। উনি বললেন, “দেখো, একজন পারসিক মহিলা এসে আমায় অনেক পুরোনো আসবাব বিক্রি করে যান মাসখানেক আগে। তার মধ্যে এই ঘড়িটাও ছিল। আমি আমার দোকানের নিয়ম মতো সেই মহিলার ফোন নম্বর দিতে পারি তোমাদের। কিন্তু এই ঘড়িটার মধ্যে যদি অস্বাভাবিক কিছু থেকে থাকে তা জানা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”


     যখন ফ্ল্যাটে ঢুকল তখন প্রায় রাত সাড়ে ন'টা। দরজা খুলে ঘরে পা রাখতেই রক্ত হিম হয়ে গেল শমিত-নয়নার। সারা ঘরে শব্দ উঠছে টিকটিক। জানলা চুঁয়ে আসা আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ডানদিকের দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে কালো রঙের গ্র্যান্ড ফাদার ক্লক। 
 
.........................
 
Keya Chatterjee
 

 

ধারাবাহিক - পান্তা দিদার গুপ্তধন - কেয়া চ্যাটার্জী

 

ধারাবাহিক

পান্তা দিদার গুপ্তধন
কেয়া চ্যাটার্জী
 
দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এইখানে 
 
 
                                    || অন্তিম  পর্ব  ||

                           
 ― ওই যে পশু পাখীর, ভূতের আওয়াজ শোনার ক্ষমতা?

―ভূতের ইয়ে, থুড়ি তেনাদের কথা আমি শুনতে পাই। তবে সে ক্ষমতা কিভাবে পেলাম তা আমি জানিনা। আমার ঠাকুর্দা একসময় পূজো অর্চনা করতেন। ঝাড়-ফুঁক, ভূত তাড়ানো এসবেও বেশ সিদ্ধহস্ত ছিলেন। আমি একটু বড় হতে তার সাথে সাথে ঘুরে বেড়াতাম। কিছু মন্ত্র শিখেছিলাম। ঠাকুর্দার চ্যালা হিসেবে বেশ বিশ্বস্ত হয়ে পড়েছিলাম। তখনই হয়তো কাজ করতে করতে এই ক্ষমতাটা চলে এসেছে। বুঝলি তো?

“আর পশু-পাখীর ভাষাটা?” বললাম আমি।

 দাদু বলল, “হ্যাঁ রে সেই কথাতেই তো আসছি।”

“এরপর কলকাতা থেকে একটা বাসে চেপে এসে পৌঁছলাম একটা ডকে। ডক বুঝিস তো? যেখান থেকে জাহাজ ছাড়া হয়। জায়গাটার নাম খিদিরপুর। তা সেখানে এসে কোথায় যাবো, কি করবো ভাবতে ভাবতে একদল শ্রমিকের সাথে ভিড়ে গিয়ে কিছু বাক্স নিয়ে ঢুকে পড়লাম জাহাজের ভেতরে। কেউ কাউকে চিনি না। কোথায় যাচ্ছি না জানিনা। রাত্রে খেতে বসে ধরা পরে গেলাম। মাথাপিছু রসদ মিলছে না। ক্যাপ্টেনের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। তিনি ভারী অমায়িক মানুষ। আমার উদ্ভ্রান্ত অবস্থা দেখে হয়তো তার মায়া হলো। কাজের বিনিময়ে খাবারের শর্ত দিলেন। মাইনে পত্তর কিছু পাবো না। আমি তাতেই রাজি। এই বা কি  কম। কথায় আছে। পেটে খেলে তবেই না পিঠে সয়। চারদিন তিনরাত সমুদ্রের উথাল পাথাল সহ্য করার পর একটা জায়গায় এসে পৌঁছলাম। জায়গাটার নাম আন্দামান। মনে হলো না বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে এসেছি। যেন আবার আরেক বঙ্গে পৌঁছে গেছি। গাছগাছালিতে ভরা, নির্মল একটা জায়গা। মজার ব্যাপার এখানেও সবাই বাংলা বলে। আর এখানেই আছে ভারতের ইতিহাসের সেই কুখ্যাত জেলখানা সেন্ট্রাল জেল। আন্দামানের জলের রং  কালচে। তাই একে বলা হত কালাপানি। এটা নাকি একটা দ্বীপ। সমুদ্রের মাঝে একটা ছোট্ট ভূমি। সেখানেই দিন কাটাতে শুরু করলাম। কতো কাজই না করেছি। মাছ ধরা, বেচা, জেলের পিওন, ব্যবসা, নৌকা চালানো, মুটে মজুর কি না করেছি। যত কাজ করেছি তত কাজের প্রতি নিষ্ঠা বেড়েছে। বুঝেছি কোনো কাজই ছোট নয়।”

    প্যাঙলাদা আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল। আমি চিমটি কেটে চুপ করিয়ে বললাম, “তারপর কি হলো দাদু?” দাদু বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খেয়ে আবার শুরু করলেন, “তা ওই আন্দামানেই আমার রোমাঞ্চকর জীবনের হাতে খড়ি। সারা সপ্তাহ এদিক ওদিক কাজ করি আর শুক্কুরবার বেরিয়ে পরি কখনো জঙ্গলে, কখনো পাহাড়ের চূড়ায়, কখনো বা ভাঙাচোরা বাড়িঘরের ভিতরে। কি না দেখেছি। রস আইল্যান্ডে জাপানিদের বাসস্থান, হাভলক আইল্যান্ডের তারা ভরা আকাশ, নীল আইল্যান্ডের ঘন নীল স্বচ্ছ জল। মাড ভলকানো। এভাবে বেশ ভালোই যাচ্ছিল দিন কিন্তু ওই যে টাকা রোজগারের সূতোয় আটকে থাকাটা কিছুতেই মানতে পারছিলাম না। সেই তো পিছুটান। সেই তো শিকড়ে আটকে থাকা। একদিন বেশ কিছু জমানো টাকা আর জামাকাপড় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বারট্যাং আইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। শুনেছি ওখানেই নাকি জারোয়া উপজাতি থাকে। ওরা ভীষণ হিংস্র। ওদের কয়েকজন অধিবাসীকে সরকার শিক্ষিত করে পাঠিয়েছিল ওদের সমাজে যাতে ওরাও ওই কয়েকজনকে দেখে সভ্য সমাজে এসে জীবন যাপনের কথা ভাবে। যেদিন পাঠানো হলো তারপরেরদিন ওই কজনের কাটা মুন্ডু ওরা রেখে গেল সমুদ্রের ধারে। ওরা নিজেদের গন্ডিতেই খুশি। জারোয়া সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছিলাম। ওদের চোখে দেখার ইচ্ছেটা সংবরণ করতে পারলাম না। বি.ট্যাং আইল্যান্ডে নেমে হাঁটা লাগালাম। চারিদিকে উঁচু উঁচু গাছ। ওদের শিকড়, মাথা কোনোটারই হদিশ মেলা কঠিন। একটা ছোট ভোজালি দিয়ে ছোট ছোট আগাছা কেটে পথ বানাতে বানাতে চলেছি। আসলে কোথায় যে চলেছি নিজেই বুঝতে পারছি না। তখনও জারোয়ার দেখা পাইনি। কিন্তু স্থির বিশ্বাস নিশ্চই ওদের সাথে দেখা হবে। মনের মধ্যে এক অদ্ভুত আশঙ্কার জন্ম হয়েছে। ওরাও মানুষ, আমিও মানুষ। তবু কতো পার্থক্য। দিনের আলো ফুরিয়ে এলো। আর এক পা-ও চলা সম্ভব নয়। ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এসেছে চারিদিকে। আমি একটা উঁচু মতন ডালপালা ঘেরা গাছ বেছে তাতে দড়ি আর কাপড়ের সাহায্যে দোলনা মতো বানিয়ে নিলাম। এতেই রাতটা কাটানো যাবে। ভোজালিটা হাতের কাছেই রাখলাম। কোনো পশু আক্রমণ করলে আত্মরক্ষা করা যাবে। তাছাড়াও, ব্যাগে ছিল একটা লাইসেন্সড বন্দুক। জেলে কাজে থাকতে জেলারের থেকে বাগিয়ে রেখেছিলাম। সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ জুড়িয়ে আসছিল।  মুড়ি-বাতাসা আর জল খেয়ে নিমেষে ঘুমিয়ে পড়লাম। তারপর কি যে হলো? দিনের আলো চোখে এসে লাগতেই বুঝলাম আমি পাশ ফিরতে পারছি না। শুধু তাই নয়, আমি হাত পা নাড়াতে পারছি না। বেশ কিছুক্ষণ নড়াচড়া ধস্তাধস্তি করে চোখ খুলে দেখলাম আমার হাত পা শক্ত রসি দিয়ে বাঁধা। চিৎকার করে বললাম, “কে আছো, আমায় খুলে দাও। বেঁধে রেখেছো কেন?” কেউ সারা দিল না। এবার চারিদিক ভালো করে দেখলাম। আমি দোলনায় শুয়েছিলাম। এখন পরে আছি মাটিতে। আমার ব্যাগ আর ভোজালি একটু দূরে পরে আছে। জায়গাটায় মনে হলো মানুষের বাস আছে। মাটির একটা অংশ পরিষ্কার করে রাখা, জায়গাটা পোড়াও বটে। যেন রান্না করা হয়েছে ওখানে। ইতস্তত খাবারের টুকরো পরে আছে। ভিতরটা ধক করে উঠল। তাহলে কি আমি কিডন্যাপ হলাম?

     না এইখানে তো সাধারণ মানুষের আসার কথা নয়। তবে কি আমি জারওয়াদের ডেরায় এসে পৌঁছলাম? ভীষণ খুশি হলাম। এত অনায়াসে এভাবে পৌঁছে যাবো আশা করিনি। পরক্ষণে ভয়ও হলো। এরা নাকি নরখাদক। আমায় কি শিকার হিসেবে ধরে আনল নাকি!

     শরীরের যন্ত্রণায়, খিদে তেষ্টায় শরীর আরো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। কতক্ষন এভাবে পরেছিলাম মনে নেই। হঠাৎ দেখলাম একটা উলঙ্গ বাচ্চা কোত্থেকে দৌড়ে এসে আমার মুখের উপর ঝুঁকে কিছু দেখল। তারপর মুখে অদ্ভুত শিস দিতে শুরু করল। সেই আওয়াজ শুনে চারপাশ থেকে আরো কিছু তেমনি উলঙ্গ নারী পুরুষ বেরিয়ে এসে আমাকে ঘিরে ধরল। ওদের দেখে মনে হচ্ছিল যেন ওরা এক অদ্ভুত জীব দেখছে। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। জারোয়ারা শুনেছি আজও পোড়া মাংস খায়। আমায় যদি কাবাব বানিয়ে খেতে চায় এবার, পালিয়ে প্রাণ বাঁচাবার শক্তি টুকুও তো নেই। আবার ইষ্ট নাম জপতে শুরু করলাম। খুব ক্ষীণ কণ্ঠে বললাম, একটু জল। কে কি বুঝল কে জানে? আমাকে কথা বলতে দেখে সবাই ভয়ে সরে দাঁড়াল। আমি এবার নিশ্চিত, ভোজালির কোপে না হলেও গলা শুকিয়ে মরে যাবো নির্ঘাৎ। এবার শুনলাম ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। না, বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি বা অন্য কোনো মনুষ্য কথিত ভাষা নয়। দুর্বোধ্য সে ভাষা। পৃথিবীর কোন সভ্য ভাষা যে তা নয় সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কিছুটা শিষের মতো। যেন অনেকগুলো পাখি গান ধরেছে। আমি আবার বললাম, জল। এবার ওদের মধ্যে থেকে একজন পুরুষ বেরিয়ে এসে একটা পাতার বাটি থেকে জল ঢেলে দিল আমার মুখে। তখন আমার পিপাসার্ত শরীরে ওই নোনতা সমুদ্রের জলই অমৃত। এবার যেন শরীরে বল পেলাম। বললাম, “আমায় খুলে দাও। আমি তোমাদের ক্ষতি করবো না।” পুরুষটি মাথা নেড়ে উঠে গেল। সন্দেহ হলো লোকটি কি আমার কথা বুঝল? তাহলে মাথা নেড়ে না বলল কিভাবে? একটা গাছের গুঁড়িতে পিঠ ঠেকিয়ে বসিয়ে রাখা হলো আমাকে সারাদিন। অনেক রকমের খাবার দেবার চেষ্টা করল ওরা কিন্তু সে সব খাবার দেখে আমার গা গুলিয়ে উঠল। সন্ধ্যে নামতেই জায়গাটায় কাঠকুটো দিয়ে আগুন জ্বালানো হলো। সেদিনের শিকার করা একটা হরিণ আর খরগোশ ঝলসাতে দেওয়া হলো সেই আগুনে। আমার গা গুলাতে শুরু করল। কেন যে বাড়ি ছাড়লাম। কেন যে এডভেঞ্চারের ভূত মাথায় চাপল। সত্যি বলছি তখন বাড়ীর কথা খুব মনে পড়ছিল। যখন মনে মনে নিজের মুণ্ডুপাত করছি তখনই জঙ্গল ভেদ করে আবির্ভুত হলেন এক সাধুবাবা। ঠিক যেন সুনীল গাঙ্গুলির সবুজ দ্বীপের রাজা। লম্বা লম্বা সাদা  দাঁড়ি গোঁফ, পরনে সাদা ধুতি আর উত্তরীয়, হাতে একটি পাত্র। চোখে এক অদ্ভুত চাউনি। উনি আসতেই সেই জারোয়াগুলি সরে দাঁড়াল। লোকটি একটি পাথরের ওপর বসলেন। সবাই একে একে তার সামনে এসে বসল। শিকারের সময় প্রাপ্ত ক্ষত গুলি এগিয়ে দিল ওঁর দিকে। উনি নাড়াচাড়া করে একটি লেপন লাগিয়ে দিলেন। কাউকে বা কিছু খাইয়ে দিলেন। আমি নিশ্চিত উনি সভ্য সমাজের। কিন্তু এখানে কি করছেন? আমি ওঁর সাথে কথা বলার একটা ফন্দি আটতে শুরু করলাম। তবে কোন ভাষায় উনি স্বচ্ছন্দ তা বুঝতে পারছিলাম না। যদিও এই কদিনে হিন্দি বলতে শিখে গেছি। 

    সকলে আবার খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেই ভদ্রলোক আমার সামনে একটি পাথরে এসে বসলেন। আমায় চমকে দিয়ে উনি বললেন, “ এখানে কি করতে?” আমি সাগ্রহে বলে উঠলাম, “আপনি বাঙালী?” উনি বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, “আমি ভারতীয়। মানুষ। কোনো জাতি বা সম্প্রদায়ের নই। এই জাতের চক্করে কারোর আর ভারতীয় হওয়া হলো না ” তারপর আমার দিকে তাকালেন, “এখানে এই মানুষগুলোকে নিজের মতো করে থাকতে দিলেই ভালো। এরা সভ্য হলেই এই উপজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সরকার চেষ্টা করছে ওদের সংরক্ষণের কিন্তু মানুষগুলো থাকতে দিলে তো। ওদের ধরে নিয়ে গিয়ে দাসে পরিণত করে ওরা। কি করতে এসেছো এখানে বলো?” ওঁর ধমকে কেঁপে উঠে বললাম, “আমি কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি। সত্যি বলছি। শুধু একবার ওদের দেখতে এসেছি।” 

― দেখতে এসেছো? ওরা কি চিড়িয়াখানার জন্তু নাকি? ওরা মানুষ। ঠিক তোমার মতো। শুধু ওরা তোমাদের মতো সভ্য নয়, তোমাদের ভাষা বলতে পারে না। 

    আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি এখানে এদের মধ্যে কি করছেন স্যার?” উনি একটু তির্যক হেসে বললেন, “স্যার? প্রাণের দায় পড়লেই স্যার এহ? আমি এখানে এদের বাঁচাতে এসেছি। এরা যাতে বিলুপ্ত হয়ে না যায় তার জন্য আমি ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। কি করবে তোমার সমাজ? কি করবে? আমায় পাগল বলবে, আমায় নিয়ে হাসাহাসি করবে, করুক না। তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমি আগেও বন্য গাছপালা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছিলাম, আমৃত্যু করবো।”

    ওঁর কথায় কিছুটা আঁচ করতে পারলেও পুরোটা বোঝার জন্য বললাম, “এক্সপেরিমেন্ট? আপনি কি বিজ্ঞানী?" উনি খেপে উঠে বললেন, “না আমি পাগল বিজ্ঞানী। পাগল।” রাগে ওর চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছেন। সে কি তেজ মানুষটার! ওই বয়সেও আমার মতো একজন যুবকের মনে ভয় জাগিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর কি জানি কি ভেবে একটা শিস দিতেই সেই ছেলেটা যে আমায় জল দিয়েছিল সে ছুটে এল। মহারাজ তাকে বাংলায় বললেন, “ওকে খেতে দে। হাত খুলে দিস, পা বাঁধা থাক।” কথা মতো আমার হাত খুলে আমায় খেতে দেওয়া হলো। ভাত, শাক আর পোড়া মাছ। দুদিনের অভুক্ত পেটে সেটাই যেন অমৃত। গোগ্রাসে গিলে ঢকঢক করে জল খেয়ে আমি যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। ছেলেটি আবার আমার হাত বেঁধে দিল। আমি তাকে অনুরোধ করলাম আমায় না বাঁধতে। সে স্পষ্ট বাংলায় উত্তর দিল যতক্ষণ না মহারাজ আদেশ দেন ততক্ষণ সে কিছু করতে পারবে না।”

     গল্প করতে করতে বুঝতেই পারিনি সময়ের হিসেব। প্রায় ঘন্টা দুয়েক পথ অতিক্রম করে যেখানে এসে পৌঁছলাম দাদু বললেন সেই জায়গাটার নাম বুড়ো বটতলা। প্যাংলাদাদা মুখ ভেটকে বলল, “ধুর বটতলা নয় তো গয়নাতলা। তুমি কোথায় নিয়ে এলে দাদু?” পাগলা দাদু মিটিমিটি হেসে বললেন, “এই বুড়োশিবের গায়ে একসময় লাগানো ছিল বড় বড় সোনার বেলপাতা আর চোখ। মাথার সাপটাও ছিল সোনার। ত্রিশূলটা অবশ্য লোহার ছিল। সবাই মনে করতো খুব জাগ্রত দেবতা, তাই যখন যার মনস্কামনা পূর্ণ হতো, ভগবানকে উপহার দিয়ে যেত। একরাত্রে সেই গয়না চুরি গেল। রে রে রে রে কান্ড। কিন্তু চোরকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। তখন থেকে এই জায়গাটাকে  গয়নাতলা বলেও ডাকা হতে লাগল।” আমি একবার বিড়বিড় করে মিলিয়ে নিলাম, “গয়নাতলার বুড়োশিব, দখিন হাওয়ার পাল/ফোকলা বটের ঝাড়ে ঝাড়ে সুলুক সন্ধান।”

    দাদু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ভাবতে থাকো ছোট নাতি। চলো বুদ্ধি খোলার জন্য একটু পেট ভরানো যাক।” দাদা জিজ্ঞেস করলো, “তুমি এই জায়গার সম্বন্ধে এতো কিছু জানলে কিভাবে দাদু।” দাদু হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরে দুহাত ওপরের দিকে তুলে চিৎকার করে উঠল, “এ যে আমার জন্মস্থান! আমার গ্রাম!”

    ভাত, ডাল, আলুভাজা, মাছের মাথা দিয়ে বাঁধাকপি, চিংড়ি মাছ দিয়ে এঁচোর, পার্শে মাছের ঝাল, চাটনি, মিষ্টি। একটা ছোট্ট ভাতের হোটেলে এরকম এক এলাহী খাওয়া খেয়ে আমাদের মন আনন্দ নিকেতন হয়ে উঠল। প্যাংলাদাদা পেটে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “আহ! কি খাওয়া খেলাম রে সুজু! এমন খাবার খেয়ে লম্বা একটা ঘুম দিতে পারলেই জীবনটা স্বার্থক।” পাগলা দাদু হেসে বলল, “ঘুমোলে আর গুপ্তধন পাবে না। চলো পা চালাই।” আমরা বললাম, “কোথায়?” এমন সময় মনে হলো, দাদা আশেপাশে নেই। খাওয়ার পর হাত ধুতে গেছিল পাশের ঝোপে এখনো তো ফিরল না। দাদাকে খোঁজা শুরু হলো। হোটেলের ত্রিসীমানায় সে নেই। অনেক হেঁকেও সারা পাওয়া গেল না। আমাদের মাথায় হাত। কোথায় গেল! খুঁজতে খুঁজতে চলে এলাম সেই বুড়োশিবতলায়। দেখি দাদা দাঁড়িয়ে আছে একটা বটগাছের নিচে। প্যাংলাদাদা দাদার মাথায় একটা গাঁট্টা দিয়ে বলল, “এই হতভাগা! এখানে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস যে? আমরা সবাই তোকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গেলাম।” দাদা তেমনি অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, “এই গাছটা দূর থেকে একটা ফোকলা বুড়োর মতো দেখতে লাগছিল জানিস। দেখ কোটরটা, যেন একটা দাঁত বিহীন বুড়ো দাদু। পান্তা দিদার ধাঁধায় আছে না, ফোকলা বটের ঝাড়ে ঝাড়ে সুলুক সন্ধান।” আমি একবার মনে মনে একটা ছক কষে নিয়ে বলে ফেললাম, “তার মানে এই মন্দিরের দক্ষিণ দিকে এই ফোকলা বটগাছের পূর্ব দিকে আমাদের যেতে হবে। কারণ সূর্য তো পূবদিকেই ওঠে। সেখানে কথামতো থাকতে হবে ধানের ক্ষেত। তাইতো দাদু?” দাদু হেসে বললেন, “বাহ! মাছের মাথা খেয়ে দুই নাতির বুদ্ধি তো বেশ খোলতাই হয়েছে দেখছি। তোর কি খবর রে প্যাংলা?” প্যাংলাদাদা মাথা চুলকে বলে উঠল, “গুপ্তধন ক্ষেতের মধ্যে লুকানো? মাটি খুঁড়তে হবে তাহলে।” সঙ্গে সঙ্গে কাকতলীয় কিনা কে জানে, একটা কাক প্যাংলাদাদার মাথায় ইয়ে করে পালাল। আমরা হাসব না কাঁদব ভেবে পাচ্ছিনা। প্যাংলাদাদা ব্যাজার মুখে একবার আকাশের দিকে আর একবার আমাদের দিকে তাকাতে থাকল। দাদু হেসে বললেন, “পেয়ে গেলি তো তোর উত্তর। এবার চল।” দাদু চললেন আগে আগে, আমরা চললুম পিছু পিছু। প্যাংলাদাদা পথে পরে থাকা শুকনো পাতা দিয়ে নিজের নোংরা মাথা পরিষ্কার করতে করতে কাকটার গুষ্টির তুষ্টি করতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর সামনে এলো একটা বিশাল বাড়ী। পাগলা দাদু গটগট করে ঢুকে গেল বাড়িটায়। আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি পরস্পরের দিকে। দাদু পিছন ফিরে বললেন,“কি রে দাঁড়িয়ে আছিস যে?” প্যাঙলাদা বলল, “এটা কি দিদার বাড়ি?” দাদু হেসে বললেন, “না এটা আমাদের জমিদারের বাড়ি। এখন কেউ থাকে না। সূর্য পাটে চলল। আজ রাতটা এখানেই থাকবো।” আমাদের গলা শুকিয়ে এল। রাতের বেলা ভাঙা বাড়িতে থাকব! এটা তো প্ল্যানে ছিল না। তবু উপায়ন্তর না পেয়ে ঢুকে গেলাম। যা থাকে কপালে বলে। দাদু সাফ সুতরা জায়গা দেখে তার থলের ভিতর থেকে একটা চাদর পেতে বসলেন। আমরাও বসলাম তার পাশে। সকলেরই পেট ভর্তি। খাওয়ার তেমন ইচ্ছে নেই। মনে পড়ল দাদুর গল্প টি শেষ হয়নি। আমি বললাম, “দাদু, গল্পটা তো শেষ করলে না। তুমি ওখান থেকে ছাড়া পেলে কিভাবে?” দাদু একটা লম্বা হাই তুলে বললেন, “তা খেয়ে দেয়ে সকলে যখন ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে। তখন সেই আদিবাসী ছেলেটি এসে আমার বাঁধন খুলে দিয়ে বলল, “মহারাজ আপনাকে ছেড়ে দিতে বলেছেন। আপনার ব্যাগ পত্র নিন আর পালান।” আমি বললাম, “এই ঘন অন্ধকারে আমি কোথায় যাবো? আমায় যদি কোনো পশু আক্রমণ করে?” ছেলেটি একটু চিন্তিত হয়ে একটি গাছের আড়ালে চলে গেল। আমিও ব্যাগটা বাগিয়ে তার পিছু পিছু চললাম। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে। দেখলাম ছেলেটি যে জায়গায় এল সেটি একটি গুহা। সে ভেতরে ঢুকে গেল, আমিও নিঃশব্দে চললাম তার পিছু পিছু। বেশ কিছুটা অলিগলি পথ পেরিয়ে দেখলাম একটা জায়গায় আগুন জ্বলছে। সেই আলোয় দেখলাম মহারাজ একটা চৌপায়ার ওপর বসে ধ্যান করছেন। ছেলেটি একটু গলা খাঁকারি দিতে উনি চোখ মেলে তাকালেন। ছেলেটি আমার কথাগুলি বলল। উনি স্মিত হেসে বললেন, “বাঙালি বাবু যখন চলেই এসেছেন তখন দেখাই করে যান।”  ছেলেটি অবাক হয়ে পিছন ফিরতেই আমায় দেখতে পেল। আমিও অবাক এত ঘন অন্ধকারে আমায় দেখতে পাওয়া অসম্ভব ভেবেছিলাম। ছেলেটি রেরে করে তেড়ে আসতেই মহারাজ তাকে বাধা দিলেন। তারপর আমায় ডেকে বসালেন আরেকটি চৌকির ওপর। 


    আমি অপরাধীর মতো বসলাম। বলা বাহুল্য ওঁর সম্পর্কে আমার কৌতূহল দমন করতে পারছিলাম না। উনি বললেন, “বাঙালির মনে অনেক প্রশ্ন। বরাবর তাই। যখন বাংলাদেশে গাছগাছড়া নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট শুরু করলাম তখনও বাঙালি আমায় পাত্তা দিল না। বলল কেমিক্যাল ওষুধের যুগে এসব গাছ পাতার ওষুধ কেউ পাত্তা দেবে না। আমার দীর্ঘ পনের বছরের পরীক্ষা নিরীক্ষা ওরা বিশেষজ্ঞদের সামনে তুলেই ধরল না। আমায় পাগল বলে বের করে দিল ইনস্টিটিউট থেকে। তারপর অনেক ঝড় ঝাপ্টার পর এই জঙ্গলে এসে আশ্রয় নিলাম। এদের পূর্বপুরুষরা তোমার মত করেই আমায় ধরে এনেছিল। সেদিন এক জারোয়া শিকার ধরতে গিয়ে আহত হয়েছিল। এরকম হলে ওদের মধ্যে নিয়ম সেই ব্যক্তিকে এক নিভৃত স্থানে রেখে আসার। কারণ সে ওই ক্ষতেই পচে মারা যাবে এটা ওদের স্থির বিশ্বাস। কিন্তু আমি বাধা দিলাম। আমার ভাষা ওরা বুঝল না বটে কিন্তু একজন আমার হাতের বাঁধন খুলে দিল। আমি ওদের বিশ্বাস অর্জনের জন্যই ওদের একজনকে সাথে নিয়ে আমার চেনা কিছু গাছগাছড়া খুঁজে আনলাম। তারপর তার প্রলেপ বানিয়ে ওই ব্যক্তির হাতে লাগিয়ে দিলাম। পরেরদিন ক্ষত অনেকটা সেরে গেল। ওরা ভাবল আমি হয়তো কোনো ম্যাজিশিয়ান। ওরা আমায় এখানেই রেখে দিল। আমার প্রয়োজনের সব ওরাই এনে দেয়। যে বিজ্ঞানের জন্য আমি আমার সমাজে ব্রাত্য সেই বিজ্ঞান আমায় ব্রাত্য সমাজের রাজা বানিয়ে দিল।" উনি থামলেন। কতটা কষ্ট, লাঞ্ছনা পেলে একটা মানুষ নিজের সব ছেড়ে এভাবে একদল আদিবাসীর সাথে থাকতে রাজী হয়। তারপর বললাম, “ওদের ভাষা কিভাবে রপ্ত করলেন?” উনি বললেন, “ওদের ভাষা হলো জঙ্গলের ভাষা। এই ভাষা শিখলে তুমি যেকোনো পশু পাখির ভাষা শিখে যাবে।” এই বলে তিনি আমায় জারোয়াদের ভাষা শেখাতে শুরু করলেন। সারা রাত আমি ওঁর কাছে সেই ভাষা শিখলাম। এক এক ধরণের শিষ। কোনোটা মিহি সুরের, কোনোটা খাদের, কোনোটা আবার মাঝারি। তাদের এক একেকটার একেক মানে। সে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। আশ্চর্য শিক্ষা জীবনের। আমি কোনোদিন ভুলতে পারবো না ওই রাতটা। জীবনের থেকে বড় শিক্ষা হয় না রে। আর কোনো বড় শিক্ষক নেই।

   তারপর দিনের আলো ফুটতেই সেই ছেলেটির সাথে আমায় পাঠিয়ে দিলেন সমুদ্রের দিকে। ছেলেটি এমন পথে আমায় নিয়ে এল যে আমি পিছন ফিরে পথ চিনতেই পাড়লাম না। বুঝলাম, পরে এই পথ খুঁজে পাওয়া আমার পক্ষে অসাধ্য। ছেলেটি সমুদ্রের ধরে একটি জেটিতে এনে দাঁড় করালো। তখন একটি জাহাজ ছাড়ছিল। ক্যাপ্টেনের সাথে কথা বলে ছেলেটি আমায় তুলে দিল জাহাজে। ব্যস আবার নিরুদ্দেশে দিলাম পাড়ি।” 

    গল্প শেষ হলো। অন্ধকারে ভরে গেল চারিদিক। দাদু একটা মোমবাতি জ্বাললেন। ঘুমে আমাদের চোখ ঢুলে আসছে। প্যাঙলাদা চারিদিক বেশ বিজ্ঞের মতো দেখতে লাগল। দেখতে দেখতে সে এ ঘর ও ঘর করতে লাগল। আমি আর দাদা মোটামুটি ঘুমিয়েই পড়েছিলাম দাদুর পাশে শুয়ে। হঠাৎ প্যাঙলাদার চিৎকারে ধড়মড়িয়ে উঠলাম। এদিক ওদিক খুঁজে একটা ঘরে এসে দেখলাম দাদা খাটে বসে হাঁপাচ্ছে। চোখ দুটো বিস্ফারিত। আমাদের দেখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল দাদুকে। শত প্রশ্নেও সে উত্তর দেয় না। ওর চোখ অনুসরণ করে দেখলাম  দেওয়ালে টাঙানো একটা ছবি। একজন ভদ্রমহিলার। মনে হলো এক জমিদার গিন্নী। আমি সেটির দিকে এগোতেই প্যাঙলাদা আমার হাত চেপে ধরল, “যাস না। ছবিটা নড়ছে।” আমি ওর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে হাত ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে যেতে বললাম, “ধূর তুমিও পারো দাদা। ছবি আবার নড়ে নাকি। হাওয়া লেগেছে হয়তো।” কিন্তু মনে মনে একটু যে ভয় পেলাম না তা নয়। কারণ ঘরটায় কোনো জানলা খোলা নেই। হাওয়া ঢোকার পথ নেই। আমি ছবিটার কাছে যেতেই সত্যিই মনে হলো যেন ভেতরের প্রতিকৃতিটা হালকা মাথা নাড়ল। আমি চমকে পিছিয়ে এলাম। সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। আমরা দাদুকে জড়িয়ে ধরলাম। সে আমাদের আশ্বস্ত করে বলল, “চুপ কর চুপ কর। আহ বৌদি। বাচ্চাগুলোকে এত ভয় দেখানোর কি আছে বলো তো?” অমনি উত্তর এল,“বাচ্চাগুলো যে এমন মাথা মোটা। বিশেষ করে প্যাঙলা। তা কি আমি জানতাম ঠাকুরপো?” আমরা অবাক এ যে পান্তা দিদার গলা। আমরা চারিদিকে মাথা ঘুরিয়ে বললাম, “ও দিদা। তুমি এখানে? এখানে থাকো?” উনি বললেন, “আমার অনেকদিনের শখ বুঝলি তো সুজু এই জমিদার বাড়ীতে থাকব। দাসী বাদী এসে পা টিপে দিয়ে যাবে। তা যখন ভূত হয়ে কোথাও জায়গা পাচ্ছিলাম না। দেখলাম এ বাড়ী খানা খালি। ব্যস ঢুকে পড়লাম। তবে মাঝে মাঝে তোদের বাড়ী যেতাম বিড়াল সেজে। আর ঐ মুখ্য প্যাঙলা কে ধাঁধার উত্তর দিতে। তা সে এমন গাম্বাট ছেলে আমাকে দেখলেই ভিরমি খেতো। আমি আর কিছু বলার সুযোগই পেতাম না। তার মধ্যে ঠাকুরপো এসে উঠলেন তোদের বাড়ীতে।  আমার মনে আশার উদয় হলো। তাহলে এবার আমার সেই গুপ্তধন উদ্ধার হবে।" 

    দাদা বলল, “কিন্তু দিদা তুমি যে ধাঁধাটা পুরো বলে যাওনি। আমরা বুঝব কিভাবে?”

    দিদা চিৎকার করে উঠলেন, “বলবো না। হতভাগা গুলো নিজের মাথার গোবর খরচ কর। আর শোন, আমার গুপ্তধন পেলে ওই জিনিসগুলো এনে এই ঘরে রেখে দিয়ে যাবি। যদি হেলা ছেদ্দা করে ফেলে দিয়েছিস তো দেবো তোদের ঘাড় মটকে।”

    দিদার গলা প্রতিধ্বনিত হতে হতে মিলিয়ে গেল। তারপর সব কিছু শান্ত। যেন ঝড় থেমে গেল। ছবিটা আবার স্থির হয়ে গেল।  আমরা কাঁপতে কাঁপতে আর প্যাংলাদাকে ধরে ধরে  আবার নিজের জায়গায় এসে বসলাম। একে অপরকে জড়িয়ে ধরেই সারারাত কাটিয়ে দিলাম। ঘুম এলেও ঘুমাতে পারলাম না। যদি দিদা চলে আসেন। কিন্তু আমাদের সকলের ভয়ের তোয়াক্কা না করে পাগলা দাদু সারারাত নাক ডেকে ঘুমালো। তার ডাকের চোটে তন্দ্রা এলেও পড়িমরি করে পালাচ্ছিল। আমরা জানলার দিকে তাকিয়ে রইলাম সকালের আশায়। এভাবে হয়তো কোনোদিন সকাল দেখার অপেক্ষা করিনি।

     সকাল হতেই আমরা পাগলাদাদুকে টেনে তুললাম ঘুম থেকে। আচমকা এমন আক্রমণে উনি একটু হতভম্ব হয়ে গেলেও পরে বিরক্ত হয়ে বললেন, “ধুর হতচ্ছাড়া। এতো তাড়াতাড়ি উঠে কি করবো?” আমরা তো এদিকে কিছুতেই এবাড়ীতে থাকবো না। তাকে টেনে বের করলাম রাজবাড়ী থেকে। বাইরেই মুখ হাত ধুয়ে, চা খেলাম, টিফিনের ব্যবস্থা এখানেই করতে হবে। তারপর সারাদিন হেঁটেই চলেছি, হেঁটেই চলেছি। মাঝে একটা হোটেলে ভাত খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটা। পথ যেন আর ফুরাতে চায় না। বিকেল হয়ে এল। সূর্য ঢলতে শুরু করেছে পশ্চিমে। আমাদের আর পা চলছে না। সারাদিন হেঁটেই কেটে গেল। মনে মনে ধাঁধাটা ভেজেই চলেছি। পড়া বলার মতো মুখস্থ হয়ে গেছে। এবার সামনে এলো একটা বিস্তীর্ণ মাঠ। সেই মাঠের চারিদিকে সারি সারি টিলা। এটাকেই হয়তো দিদা পাহাড় বলে উল্লেখ করেছেন। সেই টিলার সামনে বিস্তৃত জায়গা জুড়ে ধানক্ষেত। প্যাংলাদাদা “পেয়েছি” বলে লাফিয়ে উঠল। আমাদের মনেও আশার সঞ্চার হলো। পান্তাদিদা তাহলে মজা করেনি। কিন্তু ধাঁধাটা যে অসম্পূর্ণ। দাদুর দিকে তাকালাম। তিনিও কি সেই কথাই ভাবছেন? আমার কিছু বলার আগেই তিনি বললেন, “ছোট নাতি বলো এবার?” আমি মাথা নেড়ে বললাম, “মাটির প্রাসাদ মানে কি দাদু? প্রাসাদ কি মাটির হয়?” দাদু হেসে বললেন, “যার যেটা বাড়ি সেটাই তো তার প্রাসাদ রে ব্যাটা।” তার মানে এই যে সারি সারি মাটির বাড়ি তার মধ্যে একটা পান্তাদিদার বাড়ি আর সেখানেই আছে তার গুপ্তধন। 'মো' মানে কি মোহর? আমরা তড়িঘড়ি পা চালালাম। কিন্তু পান্তাদিদার বাড়ি কোনটি? আমরা তো কেউ চিনিনা। পাগলা দাদুই বলতে পারে। ধাঁধাটা যতটা সহজ ভাবছিলাম ততটা সহজ নয়। দাদু আমাদের এনে দাঁড় করালেন একটি ভাঙা বাড়ির সামনে। মাটির বাড়ি। তার একদিকের দেওয়াল ভেঙে পরে আছে। খড়ের ছাউনিও উড়ে গেছে ঝড়ে। এরকম আরো অবাক বাড়ি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে। যেন কোনো এক বিধ্বংসী ঝড়ে ছারখার করে দিয়ে গেছে একটা গোটা গ্রাম।

    প্যাংলাদাদা বলল, “এইটা কি দিদার বাড়ি?” দাদু মাথা নাড়লেন, “এককালে এটাও বাড়ি ছিল রে। ওই দূরে যে বাড়িগুলো দেখছিস ওগুলোর মধ্যে একটা বৌদির বাপের বাড়ী। এটা আমার পৈতৃক ভিটে। কিন্তু যেবার মড়ক লাগলো, বৌদির বাড়ির সবাই মারা গেল। আমাদের বাড়িও রক্ষে পেল না। সারা গাঁ উজাড় হয়ে যাওয়ার জোগাড়। সব যখন শুনলাম তখন আমি অনেক দূরে। ততোদিনে সব শেষ হয়ে গেছে। আমার কিছু করার জো নেই। ফিরে আসার টাকাকড়ি নেই। বাড়ি ছাড়ার অনেক জ্বালা রে দাদু! অনেক জ্বালা।” দাদুর কথা শেষ হতে না হতেই কি একটা আওয়াজে তাকিয়ে দেখি প্যাংলাদাদা একটা সরু লাঠি নিয়ে মাটি কোপাতে শুরু করেছে। শক্ত মাটি, রোদে জলে শুকিয়ে ফেটে গেছে। কোপাতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। আমরা অবাক হয়ে দেখছি যে ছেলের কাজের নামে জ্বর আসে সে কেমন হাতের আস্তিন গুটিয়ে গুপ্তধন খুঁজছে। দাদু রে রে করে উঠলেন, “করিস কি, করিস কি! ভিতের বাড়ি সব হুড়মুড়িয়ে পরবে যে।" প্যাংলাদা হাত নেড়ে বলল, “কিচ্ছু হবে না দাদু। ভরসা রাখো। আমার স্থির বিশ্বাস দিদা এখানেই তার গুপ্তধন পুঁতে রেখেছে। আরে বাবা গল্পে পড়নি? রাজা মহারাজারা ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা করতে তাদের সম্পত্তি মাটির নীচে, চোরা কুঠুরিতে লুকিয়ে রেখে যেত।” প্যাংলাদা দ্বিগুণ উৎসাহে আবার মাটি কোপাতে শুরু করলো। আমাদেরও নির্দেশ দিল ওকে সাহায্য করতে। আমরা এদিক ওদিক খুঁজেও মাটি কোপানোর কিছু পেয়ে আবার দাদুর পাশে এসে দাঁড়ালাম। দাদুর মুখটা ভীষণ গম্ভীর। দুদিন ধরে তাকে যেমন দেখেছি। তেমন মোটেই না। যেন ভীষণ রেগে গেছেন। যেন এক্ষুনি রাগে ফেটে পড়বেন। হঠাৎ আমাদের তিনজনকে চমকে দিয়ে দাদু চেঁচিয়ে উঠলেন, “থাম, থাম বলছি।”  প্যাংলাদা বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার হাতের লাঠিটাও এতক্ষণে ভেঙে গেছে। মাটিটা অবশ্য একটু খানি রূপবদল করেছে। দাদু এগিয়ে এসে বললেন, “তোরা কিচ্ছু জানিস না। বৌদি ঠিক বলেছিল। তোদের মাথায় গোবর ভরা।” বলে একটু এদিক ওদিক দেখলেন তারপর নরম সুরে বললেন, “ওরে মেয়েমানুষ বড় যত্ন জানে রে। ওসব মাটি খুঁড়ে নয়, এমন জায়গায় জিনিসটা রাখবে যা চোখেও পড়বে না আবার হাতের কাছেও। সরে আয়, সরে আয়।” প্যাংলাদাদা লাঠি ফেলে সরে এল। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। দাদু ঘরের চারপাশ দেখে নিয়ে নির্দেশ দিলেন কুলুঙ্গিতে খুঁজতে। আমরা অবাক। কুলুঙ্গি? কুলুঙ্গি আবার কি জিনিস!  প্যাংলাদা বলল, “এটা কোন ঘর? কুলুঙ্গি বলে কোনো জায়গা আছে নাকি? বাথ্রুমকে কুলুঙ্গি বলা হত নাকি?” দাদু এই কথায় হোহো করে হেসে উঠে দেওয়ালের একটা খোপে হাত ঢুকিয়ে কিছু ভাঙা মোমবাতি আর লোহার টুকরো বের করে আনলেন। বললেন, “এই জায়গাগুলোকে কুলুঙ্গি বলে। তোরা তো পাকাবাড়িতে থাকিস। এসব বুঝবিও না। চোখে দেখিসও নি। চল চল কাজে লেগে পর।” আমরা সঙ্গে সঙ্গে  ছড়িয়ে পড়লাম সারা বাড়িতে। তিনটে ঘর, গোয়াল ঘর, আতুর ঘর, রান্নাঘর সবই খোঁজা হলো কিন্তু গুপ্তধনের সন্ধান কোথাও পাওয়া গেল না। সূর্য তখন অস্তগামী। চারিদিকে অন্ধকারের ছায়া পড়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আঁধার নামবে। তখন তো আর এই ভাঙা মাটির বাড়িতে কিছু খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাছাড়া সাপ খোপের ভয়ও আছে। খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে হতোদ্যম হয়ে বসে পড়েছি ওই অপরিস্কার মাটিতেই। দূতদিনের পরিশ্রম একদম বৃথা। তারওপর আবার পান্তা দিদার আত্মার শাসানি। জিনিসগুলো না পেলে বাড়ীতে উৎপাতের শেষ থাকবে না। এদিকে বলছেও না যে এই বাড়ী ছাড়ার আগে সে তার গুপ্তধন কোথায় রেখে গেছিলেন। মানুষ নাহয় ভুলে যেতে পারে। ভূত হওয়ার পর তো তার মনে পড়বে সেসব। মাটিতে বসে আছি। আশার প্রদীপ প্রায় নিভু নিভু। হঠাৎ  প্যাংলাদাদার মাথায় কোথা থেকে একটা খাগের কলম এসে পরল। ওপরে তাকিয়ে দেখি খোলা চালের একটা খোপে একটা পায়রা ঘোরাঘুরি করছে। প্যাংলাদাদা আমাদের তুলনায় লম্বা, সে সটান লম্বা লম্বা হাত পা ফেলে ওপরে উঠল। আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে চেয়ে রইলাম দাদার দিকে। আদৌ কিছু পাওয়া যাবে কিনা কে জানে। প্যাংলাদাদা কিছু একটা নাড়াচাড়া করে চিৎকার করে “পেয়েছি” বলে একলাফে নেমে এলো মাটিতে। ওর হাতে দেখলাম একটা ছোট্ট কাঠের বাক্স। কাছে গিয়ে দেখলাম, বাক্সটার গায়ে ধূলো জমে গেছে পুরু হয়ে। ঢাকনার কাঠের ওপর নক্সা করা। একটা ছোট্ট তালা ঝোলানো বটে তবে তা মরচে পরে কালো হয়ে গেছে। মাথায় ঘুরতে লাগল হাজার চিন্তা। ঢাকনার ওপারে কি আছে? মোহর নাকি অন্য কিছু? কি লুকিয়ে রেখে গেছিল পান্তাদিদা? কোনো গুপ্তধনের নক্সাও হতে পারে। প্যাংলাদাদার চোখ চকচক করছে। সে হাত বাড়িয়ে  ধীরে ধীরে ঢাকনাটা খুলতেই আমাদের সব আশা ভস্মের মতো উড়ে গেল। ভেতরে ভর্তি কিছু ছেঁড়া কাগজ, পুরোনো উঁই কাটা বই, একটা খালি দোয়াত আর কিছু খাগের কলম। প্যাংলাদাদা পাংশুটে মুখে বলল, “ এমা! এটা কি?” দাদু কাগজগুলো হাতে নিয়ে একে একে খুলে দেখলেন। তাতে মেয়েলি হস্তাক্ষরে লেখা, ‘আমি পড়ি, আমি লিখি’, ‘বীণা কুমারী’, ‘শক্ত, ভক্ত, রক্ত’, ‘একে চন্দ্র ১’ । উঁই ধরা বইগুলি লক্ষ্মীর পাঁচালী, চাঁদমামার গল্প, ঠাকুমার ঝুলি। আমরা সপ্রশ্ন চোখে তাকালাম দাদুর দিকে। তিনি হেসে বললেন, “শিক্ষা। নারীশিক্ষা। এ এক বিরাট গুপ্তধন প্যাংলা। এক যুগে মেয়েরা পড়াশুনার অধিকারী ছিল না। তাদের নিজের প্রতিভা, নিজের ইচ্ছে লুকিয়ে রেখে বাঁচতে হতো। বাড়ির ছেলেরা দশবার ফেল করলেও তাদের পড়া ছাড়ানো হতো না। এদিকে মেয়েগুলো মেধাবী হলেও তাদের প্রাইমারীর পর আর পড়াশোনার সুযোগ দেওয়া হতো না। বৌদিরও মেধা ছিল কিন্তু সুযোগ ছিল না।  বৌদি লুকিয়ে পড়াশুনা করত। তার দাদাদের বই থেকে টুকে টুকে লিখত। আড়াল থেকে পড়া শুনে পড়া মুখস্থ করতো। ওই যে ওই ভাঙা মাটির বাড়িটা ছিল বৌদির বাবার বাড়ি। আমরা সব এক পাড়ার ছেলেমেয়ে। বীণা দিদি, মানে তোদের পান্তা দিদা, এগুলো লুকিয়ে আনত আমার কাছে। আমি বানান শুধরে দিতাম। আর লুকিয়ে রাখতাম আমার ঘরে। তখন আমিও পড়তাম থ্রি ক্লাসে। বীণা দিদিকে পড়া বুঝিয়ে নিজেকে বেশ বিজ্ঞ ভাবতাম। হে হে হে। কিন্তু যেদিন বিয়ের বয়স হলো সব বন্ধ হয়ে গেল। আমার দাদার সাথেই বিয়ের দিন ধার্য হলো। আমি তো বেশ খুশি। বীণা দিদি আমার বৌদি হয়ে আসছে। কতো খেলা হবে, কতো পড়াশুনা শেখাবো দিদিকে। বেশ কিছুদিন চলেওছিল সেইরকম। বৌদি বেশ শার্প ছিলেন। চট করে ধরে ফেলতেন। আমি ইস্কুলের সব পড়া শেখাতাম। আমারও বেশ পড়া হয়ে যেত। কিন্তু নিয়তি। নিয়তি বড় নিষ্ঠুর। সংসারের যাঁতাকলে মেয়েরা শুধুই পেষণ খায়। তাদের বাঁচার সময়টুকু কোথায় যে হারিয়ে যায়। বৌদির কোল জুড়ে খোকা এল, খুকু এল। সংসার বাড়ল। দায়িত্ব বাড়ল। ব্যাস সংসারের যাঁতাকলে বীণা দিদিকে সব স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হলো। কত বুদ্ধিমতি ছিলেন দেখছিস! তোদের কেমন ধাঁধা বলে ভুর্কি দিয়ে দিল। হাহাহা... ”  আমার গলার কাছে কি যেন আটকে এল। চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। সূর্য  যাওয়ার আগে তার শেষ রং ছড়িয়ে যাচ্ছেন। কতো কষ্ট পেয়েছে দিদা সারাজীবন। সব স্বপ্ন কেমন ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল তার। সমাজ শুধরেছে ঠিকই কিন্তু তার অজ্ঞতায় কতো মেয়ে এরকম অন্ধকারে ডুবে গেছে কে জানে! আমরা যে শিক্ষার সুযোগ পাই সেই সুযোগ অবহেলা করি। আর কয়েক বছর আগে এই সুযোগটুকুর জন্য কতো মানুষ চাতকের মতো চেয়ে ছিলেন।

     প্যাংলাদাদা পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে একা। ওর মনের ভিতর কি চলছে আমি জানি। দাদুর সঙ্গে আমরা গিয়ে দাঁড়ালাম ওর পাশে। দাদু তার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, “কি বড় নাতি, মন খারাপ? গুপ্তধন পাওয়া হলো না, বলো?” প্যাংলাদাদা অস্ফুটে বলল, “শিক্ষাই গুপ্তধন তাই না দাদু?” দাদু মাথা নাড়লেন, “ঠিক বুঝেছিস বাবা। একদম ঠিক।”  প্যাংলাদাদা বলল, “বাবাকে একটু বলবে আমায় আবার ইস্কুলে ভর্তি করে দিতে?”

    দাদু মাথা নেড়ে হাঁটা লাগালেন। আমরাও চললাম তার পিছু পিছু। হাতে সেই নক্সা করা কাঠের বাক্স। পান্তা দিদার অমূল্য রত্ন। যার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে যে।

                                            | সমাপ্ত।




Keya Chatterjee

                                 
  
                                        

ধারাবাহিক - পান্তা দিদার গুপ্তধন - কেয়া চ্যাটার্জী

ধারাবাহিক

পান্তা দিদার গুপ্তধন
কেয়া চ্যাটার্জী
 

|| দ্বিতীয় পর্ব  ||

                           
   

     সকলে মিলে চেপে ধরলাম। “বলো দাদু বলো। এতটা পথ কি গল্প না করে কাটানো যায়?” দাদু চোখ বুজে কিছুক্ষন তর্জনী দিয়ে কপালের মাঝখানে টোকা দিয়ে আবার আমাদের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন।

“একটু গুছিয়ে নিলাম বুঝলি তো। এত বড় জীবনের এত গুলো ঘটনা বলতে তো সময় লাগে। তা বিশ বছর আগে যখন সেই ডায়েরি খানা পেলাম তখন তো মনের মধ্যে যতো সুপ্ত ইচ্ছার আগ্নেয়গিরি তার লাভা নির্গমন করে আমায় ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। সেই রাতেই ধুত্তোরি তোর সংসার বলে বেরিয়ে পড়লাম। বাড়ি থেকে মিনিট দশেক হাঁটলেই মোড়ের মাথায় পৌঁছে যাওয়া যায়। তারপর আলপথ ধরে কিছুটা এগোলেই ট্রেন লাইন। সেই লাইন ধরে নাক বরাবর পূব মুখো হাঁটলেই স্টেশন। ঠিক করলাম স্টেশনে গিয়ে যেখানকার ট্রেন পাবো, জয় মা কালি বলে উঠে পরব। সেই মতো তো এগোচ্ছি। কিন্তু পথ আর ফুরোয় না। যাচ্ছি তো, যাচ্ছি তো, যাচ্ছি। প্রায় ঘন্টা খানেক বয়ে গেল। পূর্ণিমার চাঁদ মাথার ওপর ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসছে। চির পরিচিত গাছপালা গুলো কেমন যেন অচেনা ঠেকছে। ঠিক যেন কালো কাপড় মুড়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। এবার আমি আবিষ্কার করলাম যে আমি একই পথে বার ছয়েক ঘুরছি। এই আমগাছটা, পুকুরটা, মাটির দালানটা নয় নয় করে বড় পাঁচেক দেখলাম। বুকটা দুরদুর করতে শুরু করল। গাঁয়ে গঞ্জে ভূতের উপদ্রবের কথা কারুর অজানা নয়। আমি তেনাদের বিশেষ একটা পাত্তা দিতাম না কখনোই। কিন্তু তখন ওই অবস্থায় পরে বারবার তেনাদের কথা মনে হতে লাগল। মনে মনে ইষ্টনাম জপতে জপতে পেরোচ্ছি এমন সময় কোত্থেকে ঝুপ করে একটা কালো লোক আমার রাস্তা আটকে দাঁড়াল। আমি থমকালাম। অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। হাতের টর্চটাও ঠিক এই সময়ই বিগড়েছে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “ক-কে?” অমনি জলদ গম্ভীর সুরে উত্তর এল, “আত্মা। অশরীরি। তোরা যাকে বলিস ভূত, প্রেত। হুঁহ যতো সব জঞ্জাল।” শেষ কথাটা শুনেই আমার পিলে চমকে উঠল। এ যে জগন্নাথ স্যারের কথা। হ্যাঁ গলাটাও তাঁরই মনে হচ্ছে। তবু মনে জোর এনে আরেকবার জিজ্ঞাসা করলাম, “কার আত্মা? ভূতের আওয়াজ তো এত গম্ভীর হয় না।” উল্টো দিক থেকে উত্তর এলো, “কতবার তোদের পড়িয়েছি ভূত বলে কিছু হয় না। তাও তোরা ভুলে গেলি? আমার চল্লিশটা বছর বৃথাই গেল। জঞ্জাল যতসব।” আমার তো গলা শুকিয়ে কাঠ। জগন্নাথ স্যার পাঁচবছর আগে মারা গেছেন। আমি এখন তাঁর আত্মার সামনে দাঁড়িয়েই তার সাথে গল্প জুড়েছি! এদিকে ভূত বলছে ভূত বলে কিছু হয়না। এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে পড়েছি আবার সেই কণ্ঠস্বরে সম্বিৎ ফিরল। “তা তোর সাথে আমার কিছু দরকার ছিল।” আমার আবার পিলে চমকালো। একে অঙ্কের স্যার তায় আবার ভূত থুড়ি আত্মা। তার আমাকে প্রয়োজন। ঘাড় নেড়ে বললাম, “বলুন স্যার।” তিনি বললেন, “আমার ভিটেটা তো চিনিস। এই গ্রামের সীমান্তের ধূধূ পেরিয়ে পরের ধূধূ। সেখানে তোকে গিয়ে একখানা জিনিস হান্ডওভার করতে হবে।”

― কিন্তু স্যার আমি যে বিবাগী হওয়ার প্ল্যান নিয়ে বেড়িয়েছি।
― এহ, মাছ-মাংস ছাড়া ভাত চলে না সে আবার বিবাগী হবে বলে বেরিয়েছে। জঞ্জাল , জঞ্জাল। জঞ্জাল ভরে গেল দেশটা। 

তারপর উনি কি যেন ভেবে বললেন, “যাহ যাহ তোকে আর আমার কাজ করতে হবে না। আমি অন্য কাউকে ধরছি।” আমি তড়িঘড়ি বলে ফেললাম, “আহা! স্যার এভাবে রাগ করছেন কেন? বলুন না স্যার বলুন কি কাজ?”

স্যার মানে স্যারের ভূত কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। বললেন, “ঠিক বলছিস? পারবি তো? ফাঁকি দিলে কিন্তু মাঝ রাস্তায় এক পায়ে দাঁড় করিয়ে একশটা অঙ্ক করাবো।” আমি ঘাড় নাড়লাম, “পারবো, স্যার ঠিক পারবো। বলুন না।” মনে মনে বললাম, ঘাড় মটকাবে বলেনি এই আমার বাপের ভাগ্য।  অন্তত অঙ্ক করে বেঁচে তো থাকতে পারবো।

ভদ্রলোক তার ছায়া ছায়া হাত আকাশের দিকে তুলে ধরলেন। অমনি কোত্থেকে একটা চিঠি এলো উড়ে। চিঠিটা উনি আমার হাতে দিলেন। বললেন, “পঞ্চভূতে বিলীন হওয়া শরীর তো আর অফিসিয়াল কাজ করতে পারে না। এই চিঠিটা নিয়ে একবার তোমায় কলকাতা যেতে হবে। সেখানে ইউনিভার্সিটির অফিসে এই চিঠিটি দেখালে ওরা আমার নামে একটা সার্টিফিকেট আর পাঁচশত টাকা দেবে। জিনিসগুলো আমার বাড়িতে তোমায় পৌঁছে দিতে হবে।"
সন্দিগ্ধ হয়ে বললাম, “কিসের চিঠি স্যার? আসলে অফিসে গিয়েও তো বলতে হবে কি কাজে এসেছি।”

স্যার বললেন, “কয়েক বছর আগে অঙ্কের একটা শাখা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলাম। সেই নিয়ে তো নাওয়া খাওয়া মাথায় উঠল। সংসারে শান্তি নেই। ঘনঘন কলকাতা যাচ্ছি, আসছি। চারিদিকে তাড়া তাড়া বই ছড়ানো। তোদের জেঠিমা চিৎকার করে পাড়া মাথায় তুলতেন। তাও লেগেছিলাম সেটা নিয়ে। এ স্কোয়ার, এক্স স্কোয়ার, কিউব, টু দি পাওয়ার টুয়েন্টি। সংখ্যা নিয়ে এদিক ওদিক। ওপরে সংখ্যা, নীচে সংখ্যা, বাঁদিক, ডানদিক, চোখের সাথে মাটির ষাট ডিগ্রি এঙ্গেলে সংখ্যা, খাবার থালায় সংখ্যা, পায়খানার মগে সংখ্যা। চারিদিকে শুধু সংখ্যা আর সংখ্যা। এমনকি গৃহিণীর মুখেও ঘুরে বেড়াচ্ছে সংখ্যা আর সংখ্যা।" স্যার থামলেন। ভূত বলে কি মানুষ না। দম নেওয়ার প্রয়োজন আছে তো নাকি। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, “তারপর, বুঝলি তো, একদিন গবেষণা শেষ হলো। কিন্তু ততদিনে শরীর অশক্ত হয়ে পড়েছে। তাই আর কলকাতায় গিয়ে গবেষণাপত্রটি দিয়ে আসতে পারলাম না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানায় পোস্ট করে দিলাম। সে পোস্ট গেল তো গেল। তার না পেলাম প্রাপ্তি স্বীকার। না পেলাম কোনো স্বীকৃতি। মাঝখান থেকে অপেক্ষা করতে করতে পট করে পটল তুললাম। তা সেই থেকে এই আমগাছের মগডালে জায়গা করে নিলাম। ওই যে বলে না, আকাঙ্ক্ষা থেকে গেলে আত্মা মুক্তি পায়না। আমার গবেষণাপত্রের খবর না পাওয়া ইস্তক মনে শান্তি পাচ্ছিলাম না। সেই জন্য সারাদিন বাড়ীর উঠোনের নিমগাছে কাক হয়ে বসে থাকতাম। তা আমার গিন্নী আমায় থাকতে দিলে তো। যেই না দেখত একটা দাঁড়কাক ওর সাধের নিমগাছে বসে অমনি মুড়ো ঝাঁটা নিয়ে লাফাতে শুরু করতো। একে তো তার ওই দশাসই চেহারা, তার উপর কাকের থেকেও কর্কশ গলা নিয়ে এই সারা পাড়া মাথায় তুলে কাক তাড়াতে শুরু করল সকাল সকাল। ভূতেরও তো সহ্যের সীমা থাকে তাই না? তাই কাক থেকে মাছিতে পরিণত হলাম। মাছি হওয়ার পর একটু শান্তি পেলাম। নির্দ্বিধায় বসে থাকতাম বাড়ীর চালে। চিঠি আসবে আসবে করে এই কদিন আগে এল। বিশু পোস্টম্যান ঘন্টি বাজিয়ে দিয়ে গেল। তা আমার গৃহিণী সেটি দেখলেন। দেখলেন তার পটলপ্রাপ্ত স্বামীর নাম জ্বলজ্বল করছে বাদামি রঙের খামের ওপর। তাও সেটি ফেলে দিলেন জঞ্জালের স্তূপে। মটকা গেল গরম হয়ে। এত অচ্ছেদা! বেঁচে থাকলে কতো গবেষণা করতে পারতাম, কতো নাম ডাক হতো। তখন তুমিই গর্ব করে ঘুরে বেড়াতে নাকি? এখন চিঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দিল! দেখল না পর্যন্ত কি লেখা আছে! আবার আমি কাক হয়ে  উড়ে এসে বসলাম চিঠির ওপর। হ্যাঁ, বিশ্ব বিদ্যালয়ের স্ট্যাম্প মারা এ তো সেই চিঠি। ঠোঁটে তুলে নিয়ে এলাম এই আমগাছে। তারপর স্বমহিমায় ফিরে খাম খুলে পড়ে দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয় আমার গবেষণাপত্রকে স্বীকৃতি দিয়ে, একটা শংসাপত্র পাবলিশ করেছে আর পুরস্কার স্বরূপ আমার জন্য পাঁচশ টাকা রেখেছে। আর আমার গবেষণাটি ওদের সিলেবাসে নিয়েছে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলাম। এদিকে গিন্নির ওপর রাগও হলো চরম। এমন গুরুত্বপূর্ণ কাগজ নাকি জঞ্জালে বালতিতে ফেলে দিল! বদলা নিতে আবার কাক হয়ে বসলাম নিমগাছের ডালে। যেই না উনি কাক তাড়াতে এলেন অমনি মাথায় দুটো ঠুকরে দিয়ে হলাম পগার পার। কিন্তু এই চিঠি নিয়ে কেইই বা যাবে কলকাতা, কেইই বা সেই কাগজ নিয়ে আসবে। এতদিন ধরে অতৃপ্তি নিয়ে লটকে ছিলাম এই আমগাছে” 

এবার আমতা আমতা করে বললাম, “ কিন্তু স্যার একটা প্রশ্ন আছে, এই কাজটা আমাকেই করতে বলছেন কেন? আরো কতো তো লোক আছে গ্রামে।”

স্যার এবার দ্বিগুণ উত্তেজনা নিয়ে লাফিয়ে উঠলেন, “সেটাই তো রে হরি। আমি তো খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম একটা মাধ্যম। যার সাথে আমি যোগাযোগ করতে পারি। কিন্তু কাউকেই পাচ্ছিলাম না। কেউ আমার কথা শুনতে পায়না।  খগেন বাড়ুই ভূত সমাজের মাথা। সে একদিন আমায় ডেকে বলল, বুঝলে জগাদা এমন করে হবে না। যে মানুষ তোমার কথা শুনতে পাবে, সেই মানুষই তোমার কাজ করে দিতে পারবে। তুমি এক কাজ করো এই আমগাছে বসে আসতে যেতে সব মানুষকেই হাঁক দাও। যে তোমার ডাকে সাড়া দেবে তাকেই খপ করে ধরবে। তা একদিন দেখলাম তুই এই গাছের তলা দিয়ে যাচ্ছিস। সবার মতো তোকেও হাঁক দিলাম, “এই হরে” বলে। ভেবেছিলাম হয়তো শুনতে পাবি না। কিন্তু আমায় চমকে দিয়ে, তুই চারিদিকে তাকাতে শুরু করলো। আমি নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবারও ডাকলাম। তুই আবার পিছু ফিরলি। আমি এবার নিশ্চিত হলাম তুইই সেই মানুষ যে আমার কাজ করতে পারবি।” 

স্যার থামলেন। আমি ঢোঁক গিলে চিঠিটা পকেটে চালান করলাম। কি করতে বেরিয়েছিলাম, আর কি কাজে ঢুকে পড়লাম। অসুবিধা নেই  এডভেঞ্চারটা কলকাতা থেকেই শুরু হোক। ভূতের ব্যাপার। কাজ না করলে যদি শপথ ভুলে  ঘাড় মোটকে দেয়। অকালে প্রাণটা যাবে। তারপর মাস্টার-ছাত্র এই আমগাছের ডালে পা দুলিয়ে দুলিয়ে অঙ্ক করবে। স্যার যেমন করে এসেছিলেন ঠিক তেমন করেই ভ্যানিস হয়ে গেলেন। আমি কয়েক পা এগোতেই দেখি স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে। স্টেশন মাস্টারকে জিজ্ঞেস করে বুঝলাম আর কিছুক্ষণের মধ্যেই কলকাতার ট্রেন আসবে। বসে পড়লাম স্টেশনের সিঁড়িতে। যথাসময়ে ট্রেন এল। আমি টিকিট কেটে উঠে পড়লাম। মনে একটা খচখচানি রয়ে গেল। বেরোলাম আর ফিরবো না বলে। এদিকে স্যারের কাগজটা দিতে তো ফিরতেই হবে পাশের গ্রামে। দেখা যাক কি হয়। যা থাকে কপালে।

পরেরদিন সকাল সকাল চলে এলাম কলকাতা। সেই আমার প্রথম কলকাতা দর্শন বুঝলি তো। ওহ সে কি অভিজ্ঞতা। ঘুরে ঘুরে একটা ভদ্রস্থ ঘর পেলাম না। যা পেলাম তা টাকায় কুলায় না। অগত্যা আবার স্টেশনে এসে একটা খালি বেঞ্চি দেখে শুয়ে পড়লাম। ও বাবা! সেই বেঞ্চ নিয়েও সে শহরে কতো মারামারি তোরা তো জানিস না। সন্ধ্যে হতে একটা সিরিঙ্গে মতো লোক, খালি গায়ে, হাফপ্যান্ট পরে, আমায় ঠেলে তুলে দিয়ে বলল, “এই এটা আমার বেঞ্চি। তুই কে রে ব্যাটা এসে জুটেছিস?” আমি হাঁ হয়ে গেলাম। সরকারের তৈরি রেল স্টেশন। সেখানকার বেঞ্চ নাকি একজনের সম্পত্তি! তার পাশে দেখলাম আরো কজন এসে জুটেছে। তারাও সিরিঙ্গে লোকটাকে সমর্থন করে আমায় উঠে যেতে বলছে। আমি যারপরনাই অবাক ও হতবাক হয়ে উঠে গেলাম। স্টেশনের বাইরে সিঁড়িতে বসে রইলাম সারারাত।বসে এক রাত কাটিয়েছিলাম বুঝলি প্যাংলা। সেদিন বুঝেছিলাম এই হলো গিয়ে এডভেঞ্চার।

  সকাল হতেই চা-টা খেয়ে রওনা  দিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। স্টেশন থেকে কিছুটা পথ হেঁটেই মেরে দিলাম। বাস ভাড়া তো বাঁচবে। তাই অনেক। অফিসে গিয়ে চিঠিটা দিলাম। লোকটি চশমার ফাঁক দিয়ে আমায় আপাদমস্তক দেখে নিয়ে হাই তুলে বললেন, “ক্যান্ডিডেট কৈ? তাকে তো আসতে হবে।” আমি ততোধিক বড় হাই তুলে বললাম, “স্যার ক্যান্ডিডেট আসতে পারবেন না।”
― কেন শুনি?
― উনি পাঁচ বছর আগে পটল তুলেছেন। আপনাদের বিচারসভা রায় দিতে এত দেরী করল যে..”
― আপনি ক্যান্ডিডেটের কে?
― ছাত্র। ওঁর স্ত্রী আমায় দায়িত্ব দিয়েছেন।

লোকটি বিশ্বাস করলেন কি না কে জানে। একটা কাগজ আর ফাইল ঘেরা দরজা ঠেলে ঢুকে গেলেন। তারপর একটা বাঁধানো প্রমান সাইজের ফ্রেম এনে আমার হাতে দিলেন। বললেন, “এটা সবার সামনে ফুলের স্তবক সহ দেওয়ার কথা ছিল। উনি ছাত্রদের উদ্দেশ্যেও কিছু বলতে পারতেন। তা বাঁশ যখন নেই আর বাঁশি বাজবে  কি করে।” একটা কাগজে সই করে বেরিয়ে এলাম জিনিসটা নিয়ে। কাঁচ ও কাঠের সুন্দর ফ্রেমে বাঁধানো শংসাপত্র। স্যারের নাম সুন্দর হাতের লেখায় লেখা।  স্যারের জন্য খুব খারাপ লাগছিল। প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও সারাজীবন গ্রামের ইস্কুলে পড়ালেন। লোকে বলতো জগন্নাথ মাস্টার সংখ্যা দিয়ে কথা বলে। যে স্বপ্নের পিছনে ধাওয়া করলেন আজীবন সেই স্বপ্ন ধরা দিলেও তা ধরতে পারলেন না। হায় রে, জীবন! কাকে যে তুমি কখন পুষ্পবৃষ্টি দেবে তা তুমিই জানো। শংসাপত্র আর টাকা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে তো এলাম এবার অন্য খেয়াল মাথায় চাপল মাথায়। এ জিনিস তো পার্সেল করতে হবে। অতো টাকা তো ট্যাকে নেই। তাহলে আবার যেতে হবে গ্রামে? এতক্ষনে তো বাড়িতে নিশ্চই সবাই খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে  গ্রাম শুদ্ধ লোক জেনে গেছে আমি নিরুদ্দেশ। এদিকে পাশের গ্রামেই যদি ডাংডাং করতে করতে যাই, তাহলেই তো ধরা পড়ে যাবো। উফ, কি বিপদ! পরিবারের জন্য সব ব্যবস্থা করে এসেছি। খাওয়া পড়ার অভাব হবে না জীবনে। ছেলে সাবালক হলে চাকরিটাও পেয়ে যাবে। আর তো ফিরে যাওয়া যায়না। ভাবতে ভাবতে আবার হাঁটতে শুরু করলাম স্টেশনের দিকে। চিন্তা দিয়েছেন যিনি সেই চিন্তামণিই উপায় বলবেন। এইভাবে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ পেরিয়েছি হঠাৎ কাঁধে কেউ যেন হাত রাখল। ফিরে দেখলাম বিশু। আমার ইস্কুলের বন্ধু। এখন কলকাতায় বড় অফিসার। আমায় দেখে একগাল হেসে বলল, “কিরে হরে তুই এখানে?”

মনে পড়ল বিশু সরকারি চাকরি পেয়ে বেশ কিছুদিন আগে কলকাতায় চলে এসেছিল। কিন্তু আমি ওকে গোটা ঘটনাটা বলতে পারলাম না। ভূতের গল্প কেউ বিশ্বাস করবে না। উল্টে হাসাহাসি করে মাথাটাই দেবে গরম করে। হাসি মুখে স্যারের শংসাপত্র দেখিয়ে বললাম, “জগন্নাথ স্যারের এই জিনিসটা নিতে এসেছি।” বিশু অবাক হয়ে বলল, “জগন্নাথ স্যারের জিনিস? কিন্তু স্যার তো অনেকদিন হলো মারা গেছেন।” আমি মাথা নাড়লাম, “আরে সে কি আর জানিনা। এ অন্য ব্যাপার।” তারপর বিশুকে চিঠির ব্যাপারটা বললাম। তবে গল্পটা অন্যরকম ছিল। স্যারের বদলে চিঠিটা দিয়ে গেলেন স্যারের স্ত্রী। ওসব কাক, মাছি, মুড়ো ঝাঁটা সব বড়পত্রিকার সম্পাদকের মতো কেটে উড়িয়ে দিলাম। তারপর বললাম, “কিন্তু একটা বিপদে পড়েছি ভাই।”

― বিপদ? কি বিপদ রে?
― আমায় এখুনি এক জায়গায় যেতে হবে। ইমার্জেন্সি। না গেলেই নয়। এদিকে এই জিনিসটা বয়ে নিয়েও বেড়াতে পারছি না। যেখানে যাবো সেখান থেকে ফিরতে অনেক দিন লেগে যাবে। কি করি বলতো?
বিশু স্মিত হেসে বলল, “আগে চল আমার অফিস দেখে আসবি।” ঝাঁ চকচকে বলবো না তবে বিশুর অফিসটা যে বিল্ডিংয়ে সেই পুরোনো ব্রিটিশ আমলের বাড়িটা আমার খুব পছন্দ হয়ে গেল। বিশু আমায় ওর টেবিল ঘুরিয়ে নিয়ে এলো ক্যান্টিনে। চায়ের সাথে বেশ কিছু টা এর বন্দোবস্ত করে আমার কাছ থেকে জগন্নাথ স্যারের ঠিকানা লিখে নিল একটা কাগজে। তারপর একজন পিওনকে  টাকা পয়সা আর ঠিকানা দিয়ে সেদিনই জিনিসটা পোস্ট মারফত পাঠানোর নির্দেশ দিল। আমার কাঁধ থেকে এই বিশাল বোঝাটা যে এত সহজে নেমে যাবে তা ভাবতেই পারিনি। জগন্নাথ স্যার কি আমার ওপর নজর রাখছেন? তিনি কি এসব দেখলেন? দেখে আশা করি ক্ষেপে যাননি। নাহলে এখুনি তাঁর কথা মতো একপায়ে দাঁড় করিয়ে অঙ্ক কষতে দিতেন। বিশুর সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্প হলো। গ্রামের হল হকিকত জানলো। আমি কলকাতার রাস্তাঘাট, ট্রেন, অলিগলি বুঝে নিলাম। তারপর ওকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়ে ঝাড়াহাতপা হয়ে বেরিয়ে পড়লাম নিরুদ্দেশের উদ্দ্যেশে।”
পাগলা দাদু এবার থামলেন। চারিদিকে নিস্তব্ধতা। শুধু ট্রাক্টরের একটানা ঘরঘর আওয়াজ।

“কিন্তু দাদু তোমার সেই বিশেষ ক্ষমতাটা তুমি কি করে পেলে সেটা তো বললে না?” বলল প্যাঙলাদা।
― কোন বিশেষ ক্ষমতা বলতো?



Keya Chatterjee