গ্র্যান্ডফাদার ক্লক - কেয়া চ্যাটার্জী


গ্র্যান্ডফাদার ক্লক
কেয়া চ্যাটার্জী
 

    শমিত আর নয়নার এন্টিকের খুব শখ। সেই জন্যেই রাসবিহারীর ফ্ল্যাটটা কেনার পর নতুন আসবাবের বদলে ওরা ঘর সাজিয়েছিল পুরোনো আসবাব দিয়ে। খাট, ড্রেসিং টেবিল, আলমারি, সোফা, ডাইনিং টেবিল, ফুলদানি সব স--ব পুরোনো ধাঁচের বা বিভিন্ন দোকান থেকে খুঁজে আনা আসবাব। নতুন ফ্ল্যাট দেখতে এসে এরকম মান্ধাতা স্টাইলের আসবাব দেখে অনেকে নাক কুঁচকেছে, অনেকে চোখ কপালে তুলেছে, অনেকে গালে হাত দিয়ে অবাক হয়েছে। কিন্তু শমিত-নয়না কোনো এক্সপ্রেসনেই তেমন পাত্তা দেয়নি। আসলে থাকবে তো ওরা দুজন। তাহলে থাকার জায়গাটা অন্য কারুর পছন্দ অনুযায়ী কেন হবে? ওদের হাসি খুশি সংসারের ওরাই রাজা।
 
      নয়না একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরি করে। সিনিয়র সেলস এক্সিকিউটিভ পোস্টে। ওর হাতের নীচে কাজ করে আরো একশো জন। শমিত একটু ভুবনভোলা। একটা কোম্পানীতে বেশিদিন থাকতে পারেনা। কোনো একসময় কমার্স নিয়ে গ্রাজুয়েশন করেছিল। সেই সুবাদে হিসেব রক্ষকের কাজ পেয়ে যায় মাঝে সাঝে। একটা লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদক সে। নিজে খুব ভালো কবিতা লেখে। প্রতিবাদী কবিতা, সমাজমুখী কবিতা।  সাহিত্য নিয়ে বেশিরভাগ সময়টাই কেটে যায়। নতুন লেখকদের দু-একটা এন.জি.ও-র সাথেও যুক্ত শমিত। এতো সব কর্মের পরে টাকা রোজগারের কর্মের বেলায় ভুল হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক শমিতের পক্ষে। একবার-দুবার নয় বেশ কয়েকবার চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছে সে। ঘরে ফিরে শমিতের মুখ দেখে নয়নাও বুঝে যায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। এই পুনরাবৃত্তি এতবার ঘটেছে ওদের জীবনে যে শমিতের অভিব্যক্তি নয়নার প্রায় ঠোঁটস্থ। 
  
    এরকমই এক কর্মহীন দিনে শমিত আবিষ্কার করলো তার নতুন ফ্ল্যাটের ডোরবেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে সে ভাতঘুম ছেড়ে ঢুলতে ঢুলতে দরজা খুলেছে ও দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের মধ্যে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে এসেছে চারজন হাফপ্যান্ট পরিহিত কোমরে গামছা বাঁধা, গেঞ্জি পরা লোক। চোখ কচলে শমিত আরেকবার আবিষ্কার করলো তাদের হাতে একটা লম্বা ঘড়ি। লোকগুলো ঘরে ঢুকে যেতেই ওদের পিছন পিছন হিল তোলা জুতোয় হুল্লোড় তুলে প্রায় দৌঁড়ে ঘরে ঢুকল নয়না। শমিতকে পাশ কাটিয়ে লোকগুলোর উদ্দেশ্যে বলে উঠল, “দাদা এই ডানদিকের দেওয়াল ঘেঁষে রাখুন। না না, দেওয়ালে ঠেস দেবেন না। হ্যাঁ ঠিক আছে।” কাজ হয়ে গেলে লোকগুলির বকেয়া টাকা মিটিয়ে দরজা বন্ধ করে নয়না। শমিত ঘড়িটিকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে। নয়না শমিতের পর্যবেক্ষণে বাধা না দিয়ে চলে যায় ওয়াসরুমে।
 একটা গ্র্যান্ডফাদার ক্লক। মাটি থেকে প্রায় এক মানুষ উঁচু। কালো কুচকুচে। তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই তবে কাঠের ওপর ছেনি হাতুড়ির আঘাতে তোলা নক্সাগুলি খুবই সুন্দর। মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না।  শমিত বস্তুটার গায়ে হাত ছোঁয়াল। হাত বোলাল নক্সার চারিদিকে। ধীরে ধীরে ঘড়ির পেন্ডুলামটা নাড়িয়ে দিতেই ঢং ঢং শব্দ করে ডানে বামে একবার দুলে আবার থেমে গেল। নয়না কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারেনি শমিত। অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল ঘড়িটার দিকে। এরকম জিনিস এর আগে কখনো দেখেনি সে। এতো পুরোনো একটা জিনিস, এতো যত্নে রাখা! নয়নার কণ্ঠে ঘোর কাটে তার, “ঘড়িটা কিন্তু চলে না।” শমিত দেখল নয়না এর মধ্যেই ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। ফ্রিজ থেকে একটা বোতল বের করে ঢকঢক করে ঠান্ডা জল গলায় ঢালছে। শমিত চোখ কুঁচকে বলল, “চলে না? তাহলে শব্দ হলো যে?"
― ওই শব্দই সার। কাঁটা নড়ে না।
― তাহলে কিনলি কেন?
― কেন আবার, জিনিসটা দেখ। প্রায় আশি বছরের পুরোনো। কতো যত্নে রাখা দেখ! 
― বন্ধ ঘড়ি রাখবি? একবার সারিয়ে নিলে হতো না?
― সারাতে গেলে অনেক খরচ পরে যাবে। শোপিসের মতো থাকবে। চাপ নেই। কেন তোর পছন্দ নয়?
― পছন্দ । বাট...
― কফি খাবো।
 
     শমিতকে আর কথা বাড়াতে দেয়না নয়না। শমিতও আর কথা বাড়ায় না। বোঝে যে নয়না আর বাড়তি কথা শুনতে রাজি নয়। বলাবাহুল্য, তার মতো উড়নচন্ডী স্বভাবের ছেলের পক্ষে দক্ষিণ কলকাতায় ফ্ল্যাট, দামি আসবাবপত্র, নিত্য নৈমিত্তিক জীবন যাপনের খরচ যোগানো সম্ভব হতো না কখনই। যদি না নয়নার মতো সহনশীল মেয়ে তার পাশে থাকত। সংসারের প্রায় সবই নয়নার রোজগারে চলে। তাই শমিতকে মাঝে মধ্যে নয়নার খামখেয়ালিপনাকে প্রশ্রয় দিতে হয়। শমিতের সব ব্যর্থতা, স্বপ্নকে নিজের করে নিয়েছে নয়না। নয়না না থাকলে শমিত হয়তো যন্ত্র হয়ে যেত।
 
     শমিত রান্নাঘরে যাওয়ার আগে আরেকবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ঘড়িটা। একটা শোপিসই বটে। কোনো কাজ নেই। ন্যূনতম সময়টুকুও দেখায় না। শমিত একবার হাসল,  সেও এ বাড়ীতে ঘড়িটার মতোই। শোপিস। ন্যূনতম বাজারটুকুও করেনা।
  
    অনিমেষদের বাড়ি থেকে ফিরতে বেশ দেরী হলো শমিত-নয়নার। আজ অনিমেষ-পিয়ালীর পাঁচ বছরের বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ ছিল । অনিমেষ নয়নার অফিস কলিগ। দরজার লক খুলে সুইচে হাত দেওয়ার আগে শমিত একবার তাকালো ঘড়িটার দিকে। কয়েক পলকের জন্য যেন মনে হলো ঘড়িটার পেন্ডুলামটা দুলছে। শমিত কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল। বোঝার চেষ্টা করলো ঘটনাটা তার চোখের ভুল নাকি বাস্তব। নয়না ঘরে প্রবেশ করে লাইট জ্বালিয়ে বলল, “কি রে লাইট টা জ্বালা?" শমিত চমকে তাকালো নয়নার দিকে। বলল, “ঘড়িটা চলছিল।" নয়না তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল, “ক'পেগ চড়িয়েছিস? বন্ধ ঘড়ি নাকি চলছে। আমি আলী বাবুকে জিজ্ঞাসা করেছি, উনি বলেছেন গত পঁচিশ বছর এই ঘড়ি নড়েনি। আলিপুরের এক পার্সি ফ্যামিলি বাড়ী ছাড়ার আগে আলিবাবুর কাছে বেশিরভাগ ফার্নিচার বিক্রি করে দিয়ে গেছেন।” শমিত আরেকবার ঘড়িটার সামনে দাঁড়ালো। না পেন্ডুলাম নড়ছে না। যদি কোনো রকম হেলদোল হতো তাহলে ওদের ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তা থেমে যেত না। অন্তত বিজ্ঞানসম্মতভাবে তো না-ই। বেশি কিছু ভাবলো না সে। বেশি ভাবলে নেশাটা কেটে যাবে। 
  
    কিন্তু মনের ভিতর একটা খচখচানি রয়েই গেল। এতটা ভুল? না খুব বেশি নেশা তো সে করেনি। জানলার কাঁচ ভেদ করে আসা রাস্তার লাইটপোস্টের আলোয় সে স্পষ্ট দেখেছে পেন্ডুলামটা নড়ছিল। তাহলে আলো জ্বলার সাথে সাথে পেন্ডুলামটা থেমে গেল কি করে? হাওয়া? না, হাওয়া ঢোকার কোনো জায়গাই নেই। ঘরের সব জানলা বন্ধ। আর অতো ভারী বস্তুটা হাওয়ায় নড়বে ভাবাই যায়না।
  
     কিছুতেই ঘুম আসছে না শমিতের। সে কি ঘড়িটা নিয়ে বেশি ভাবছে? সে কি ঘড়িটার  সাথে একাত্ম হয়ে পড়ছে? সেই জন্যই আজ সারা সন্ধ্যে সে এই পুরোনো ঘড়ির সম্বন্ধে ভেবেছে? বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে চোখটা বুজে আসল আর সঙ্গে সঙ্গে কানে এলো একটা শব্দ― ঢং, ঢং। লাফিয়ে উঠল শমিত। সে কি ভুল শুনল? নাঃ স্পষ্ট শব্দ। ঘড়ির শব্দ। এরকম শব্দ তো এর আগে তাদের ফ্ল্যাটে শোনা যায়নি। শমিত তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দরজার কাছে এসেও গতি কমিয়ে দিল। তার কানে ভেসে আসছে আরেকটা শব্দ। ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ। বেশ জোরে। ক্রমাগত শব্দটির গতি আরো বাড়ছে। শমিত এবার খুব সাবধানে দরজাটা খুলল। হ্যাঁ শব্দটা ড্রয়িং রুম থেকেই আসছে। সারা ঘরটা যেন ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দে ভরে গেছে। শমিত এবার পা রাখল ড্রয়িং রুমে আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এক অন্যরকম অস্বস্তি চেপে ধরল তাকে। মনে হলো যেন কয়েক জোড়া চোখ তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। যেন শমিত এসে পড়ায় ওদের অসুবিধা হয়েছে। ওরা যেন ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়েছে। এদিকে শমিত চোখের সামনে কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে ঘরের মধ্যে গরম হাওয়া খেলে বেড়াচ্ছে। মাঘ মাসের রাত্রেও শমিতের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। শমিত ধীরে ধীরে পিছতে শুরু করলো। মনে হলো যেন আরো কয়েকজন তার দিকে এগিয়ে আসছে। টিকটিক শব্দটা অব্যাহত। আড় চোখে দেখল গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকের দিকে। পেন্ডুলাম দুলছে। হ্যাঁ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে শমিত। পেন্ডুলামটা ভীষণ স্বাভাবিক গতিতে দুলছে। কি এক অদ্ভুত অনুভূতি পেয়ে বসল তাকে। তার দিকে কারা যেন হিংস্র চোখে তাকিয়ে আছে। এখুনি এই জায়গা না চাইলে হয়তো সে প্রাণে বাঁচবে না। শমিত দ্রুত পায়ে পড়িমরি করে ছুটল শোয়ার ঘরের দিকে। দরজা বন্ধ করে বিছানায় উঠে কম্বল চাপা দিয়ে জাপটে ধরল নয়নাকে। অঘোরে ঘুমোনো নয়নাও জড়িয়ে ধরল স্বামীকে। সারারাত শমিতের ঘুম এলোনা। ঘড়ির শব্দ যেন তার মস্তিষ্কে প্রবেশ করেছে। ভোরের আলো জানলা চুঁয়ে ঘরে প্রবেশ করলে সেই শব্দ মিলিয়ে গেল। শমিতের চোখে ঘুম নেমে এলো।

“এই সমু ওঠ। কি রে দশটা বাজে।” নয়নার ডাকে ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ে শমিত। সারা ঘরে আলো খেলা করছে। চোখ মেলতেই বুঝতে পারল তার মাথাটা ধরেছে। নয়না মুখে প্রসাধন লাগাতে লাগাতে জিজ্ঞেস করলো, “কি রে শরীর খারাপ?” শমিত নিঃশব্দে ঘাড় নেড়ে জানালো― না। ড্রয়িং রুম পেরিয়ে বাথরুম যাওয়ার পথে নজরে এলো ঘড়িটা। নির্বিবাদী জড়পদার্থের মতো দাঁড়িয়ে আছে। নয়না ব্যাগ গোছাতে গোছাতে ঘর থেকে বেরিয়ে শমিতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার পাশে এসে দাঁড়ালো, “এনিথিং রং?" শমিত নয়নার দিকে না তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, “ঘড়িটা কোথা থেকে এনেছিস?" 
― কেন? বললাম যে আলিবাবুর কাছ থেকে। আমাদের বেশির ভাগ ফার্নিচারই তো ওঁর থেকে নেওয়া। তোর পছন্দ হয়নি জিনিসটা, না?
― পছন্দ।
― তাহলে?
― ঘড়িটা ঠিক সুবিধের না।
― মানে?
― মানে... তুই ফিরে আয় অফিস থেকে তারপর...বলবো।

    মুখে বললেও আদপে শমিত নয়নাকে গতরাতের কোনো কথাই জানালো না। আসলে সে অপেক্ষা করছিল আরেকটি অভিজ্ঞতার। আদৌ কাল সে সঠিক দেখেছে কি না সেটা যাচাই করতে। নয়নাকে কিছু বললে সে হয়তো নেশার অজুহাতে উড়িয়ে দিতে পারে তার কথাগুলো। শমিত তাই আরেকবার অপেক্ষা শুরু করলো।
 
     সুযোগও এসে গেল। রাত দুটো। আবার বেজে উঠল ঘড়ি। শমিত চোখ মেলল। নাঃ কোনো ভুল নেই। সে পা টিপে টিপে চলল দরজার দিকে। আগেরদিনের মতোই খুলল দরজাটি। এবারেও মনে হলো তার আগমনে কারা যেন তার দিকে তাকালো। কিন্তু ওদের দৃষ্টিতে আগেরদিনের মতো অসন্তোষ নেই, আছে উদাসীনতা। শমিত জল খাওয়ার অছিলায় এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে। সে অনুভব করলো চোখগুলিও তাকে অনুসরণ করছে। গেলাসে জল ঢেলে সে বসল সোফায়। চারিদিক অন্ধকার, রাস্তার আলোর ছটা এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে। নিস্তব্ধ রাজপথ। তবু শমিতের মনে হলো যেন একটু আগে এই ঘরে মজলিস বসেছিল। দেশীয় নয়, বিদেশি মজলিস। পিয়ানো বাজাচ্ছিল কেউ, কেউ গান করছিল, কেউ হয়তো সুরা পান করতে করতে সেই গান মত্ত হয়ে শুনছিল। কেউ ফিসফিস করে মজার কথা বলে লুটিয়ে পড়ছিল সঙ্গিনীর কাঁধে। শমিতের মনে হলো এইসব কিছু তার পদচারণায় স্তব্ধ হয়ে গেছে। তারা তার চলে যাওয়ার অপেক্ষা করছে। শমিত বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারলো না। আবার আগেরদিনের মতো ঘরে ঢুকে ধড়ে প্রাণ পেল সে।
  
    সকাল হতে নয়নাকে অবাক করে শমিত বলে উঠল, “নয়ন আমার জন্য প্লিজ একটা চাকরি খুঁজে দে। যা খুশি। আমার ঘরে থাকতে ভালো লাগছে না।” নয়না এরকম প্রস্তাবে যতটা খুশি তার থেকেও বেশি অবাক। কারণ এর আগে শমিতকে এই ধরণের প্রস্তাব দিয়েছে সে কিন্তু শমিত ফুৎকারে তা উড়িয়ে দিয়েছে। আজ স্বয়ং শমিতের মুখে এই কথা শুনে সে আনন্দে জড়িয়ে ধরে স্বামীকে। সন্ধ্যেবেলা খবর দিল আগামী সপ্তাহের শুক্রবার মিস্টার সরকারের অফিসে শমিতকে দেখা করতে হবে। শমিতের ভেতরটা গুলিয়ে উঠল। ভয়ে, আতঙ্কে। নয়না অফিসে যাওয়ার পর সারা সকাল, দুপুর তাকে একা থাকতে হয় ফ্ল্যাটে। সঙ্গে থাকে ওই ঘড়ি। ঘড়িটার পাশ থেকে যাওয়ার সময় মনে হয় যেন ঘড়িটা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নয়নাকে সে বলতে পারছে না এসবের কিছুই। নয়না কেন, তার অনুভূতি গুলো কাউকেই বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। আগামী শুক্রবার মানে এখনো পাঁচ পাঁচটা দিন। শমিত দিন গুনতে শুরু করে।
 
      আরেকটা রাত। শমিতের চোখ খুলে গেল। হ্যাঁ শব্দ। ঢং---- ঢং। মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে দেখল আবার রাত দুটো। কিন্তু এবারে এক অন্যরকম টান অনুভূত হতে লাগল তার। যেন কেউ তাকে ড্রইংরুমের দিকে ডাকছে। সে কোনো শব্দ শুনতে পারছে না কিন্তু অনুভব করছে কারা যেন তার জন্য বসে আছে বাইরের ঘরে। শমিত উঠে দাঁড়ায়। আবার দরজার দিকে পা বাড়ায়। ড্রইংরুমে গিয়ে বসে। এখন তার সেই অস্বস্তি হচ্ছে না। তার নিজেকে অবাঞ্চিত মনে হচ্ছে না। এই ঘরের অধিবাসীরা যেন তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। শমিত অনুভব করল তার কান ছুঁয়ে গেল একটি শীতল বাতাস। কেউ যেন কিছু বলল। তার স্নায়ুগুলি শান্ত হয়ে গেছে। শমিতের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল।

    পর পর চার রাত ঘুমায়নি শমিত। প্রতি রাত্রে দুটোর সময় তার ঘুম ভেঙে যায়। সে ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসে সম্মোহিতের মতো। তারপর কি যে হয় তার মনে থাকে না আর। তার লেখার খাতা পড়ার ঘরের টেবিল ছেড়ে ডাইনিং টেবিলে ঘোরাঘুরি করে। প্রায় দিনই নয়না তাকে সোফায় ঘুমন্ত অবস্থায় আবিষ্কার করেছে। আজকাল তার লেখার পরিমাণ বেড়েছে। প্রতিবাদী কবিতার ধাঁচ পাল্টে প্রেমের কবিতা হয়েছে। নিজের ভেতর এক পূর্ণতা অনুভব করছে শমিত। সে যেন বন্ধু পেয়েছে। তার মতো অসফল ব্যক্তির কথা শোনার লোক পেয়েছে। কিন্তু শমিত তাদের দেখতে পায় না। অনুভব করে। আসলে বিছানা ছেড়ে সোফায় বসা ইস্তক তার মনে থাকে ঘটনাক্রমগুলি কিন্তু তারপর শমিতের মস্তিস্কে কোনো ছবিই ধরা থাকে না। শমিতের মনে হয় সে যেন সারারাত কাদের সাথে গল্প করে। কবিতা শোনায়। সবই আবছা স্মৃতি। তারা ওকে উৎসাহ দেয় লেখার। কিন্তু শমিতকে ওরা এই ফ্লাটের বাইরে যেতে দেয় না। শমিতেরও ইচ্ছে হয়না কারুর বাড়ি যেতে। বন্ধুদেই সাথে দেখা করতে। নয়নার সাথে ঘুরতে যেতে। কারা যেন এই ফ্ল্যাটের চার দেওয়ালে তাকে আটকে রেখেছে।
 
   শুক্রবার বাড়ী ফিরে নয়না দেখল শমিত তার লেখার টেবিলের ওপর প্রায় উপুড় হয়ে কিছু লিখছে। অন্য কোনদিন হলে শমিতকে সে বিরক্ত করতো না। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা।  শমিতের টেবিলের ওপর একটা থাপ্পড় কষিয়ে সে বলে উঠল, “আমার মান সম্মানের কথা কবে ভাববি তুই শমিত? তুই নিজে চাকরির কথা বলেছিলি আমায়, আমি বলিনি। তাও আজ তুই গেলি না! মিস্টার সরকার আমায় ফোন করে যা নয় তাই বললেন। আমি কিছুই বলতে পারলাম না। কারণ আমি তো এটাই ডিসার্ভ করি। কেন গেলি না বল, কেন গেলি না?” শমিত ফ্যালফ্যাল করে নয়নার দিকে তাকিয়ে  বলল, “ওরা যেতে বারণ করল যে।" নয়না শমিতের চোখ দেখে একটু ভয় পেল। আশঙ্কা হলো। সে বলল, “কারা বারণ করলো তোকে?” শমিত কাগজে মনোনিবেশ করে বলল, “আমার বন্ধুরা।"
― কোন বন্ধুরা?
― যারা রাত্রে আসে।
― রাত্রে কারা আসে?
শমিত লাজুক মুখে তাকালো নয়নার দিকে। নয়নার বুক কেঁপে উঠল। এ কাকে দেখছে সে! এরকম ভাব-ভঙ্গী তো শমিতের নয়। এরকম চোখ, হাসি, চাহুনি তো শমিতের নয়। সে শমিতের হাতে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলো, “কারা আসে রাত্রে শমিত? আমায় বল। প্লিজ বল।” শমিত নয়নার কাছে এসে বলতে শুরু করলো এই কয়দিনের গল্প।

―“মিস্টার সেন, আপনার বন্ধুরা আপনার সাথে কি কথা বলে?"
― আমি জানি না।
― একটু মনে করার চেষ্টা করুন।
― না, মনে পড়ছে না।
― ঠিক আছে। মাথায় চাপ দিতে হবে না। মিসেস সেন আমি ওনাকে যে ওষুধ গুলো লিখে দিচ্ছি রেগুলার খাইয়ে যাবেন। আর পরের মাসে আবার একবার আসবেন। 
  মনোবিদের চেম্বার থেকে বেরিয়ে নয়না শমিতের কাঁধে হাত রেখে বলল, “ভরসা রাখ সমু সব ঠিক হয়ে যাবে।"
― তুই আমায় বিশ্বাস করলি না নয়ন।
― আমি...
নয়নার কথা শেষ হওয়ার আগেই  শমিত হাঁটা লাগলো।
  
    শমিতকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বোলাতে শুরু করল নয়না। কপালে চুমু এঁকে শমিতকে আবার আশ্বস্ত করলো, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তার তাকে শিখিয়ে দিয়েছে এই কথাটা বারবার বলতে। শমিতের যেন কোন মতেই নিজেকে অবাঞ্চিত মনে না হয়। আসলে কর্মজীবনের ব্যর্থতাই তাকে পুরোনো অচল ঘড়িটার সাথে একাত্ম করে তুলেছে। তাই ওর মধ্যেই সে নিজেকে খুঁজে পায়। ঘড়িটাকে ও নিজের প্রতিচ্ছবি করে তুলেছে। একাত্মতা অনুভব করছে। ওই ঘড়িই যেন ওর সব অনুভূতি বুঝতে পারে। নয়না ভাবার চেষ্টা করে ঠিক কোথায় খামতি থেকে গেছে তার চেষ্টায়। কেন শমিত একটা জড়বস্তুর সাথে নিজেকে এক করে নিচ্ছে।  
   কিছুক্ষনের মধ্যে শমিত ঘুমিয়ে পড়লে সেও ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুম ভেঙে যায় একটা শব্দে। খুট করে একটা শব্দ উঠতেই নয়না তাকে দরজার দিকে। দরজা খুলে কে যেন ড্রইংরুমে গেল। পাশে তাকিয়ে দেখল শমিত বিছানায় নেই। নয়নার বুক কাঁপল। এতো হাই ডোজের ওষুধ খেয়ে শমিতের কোনমতেই ঘুম ভাঙার কথা নয়। সে সন্তর্পনে পা রাখে ড্রইংরুমে। দেখে শমিত তার দিকে পিঠ করে, পুরোনো ঘড়িটার সামনের সোফায় বসে আছে। ঘরের ভেতর এক অসহ্য গুমোটভাব। নয়না ডাকে, “শমিত কি করছিস তুই?" শমিত তার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দেয়, “তুই এখন যা নয়ন। ওরা অফেন্ডেড হচ্ছে।"
― কারা?
― আমার বন্ধুরা।
― শমিত ঘরে কেউ নেই। শুধু তুই আর আমি।
― আছে। তুই দেখতে পারছিস না।
― পাগলের মতো কথা বলিস না শমিত উঠে আয়। এক্ষুনি উঠে আয় বলছি।
নয়না এগিয়ে এসে শমিতের হাত ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করে। শমিত তাকায় নয়নার দিকে আর তাতেই তার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে আসে। শমিতের চোখ দুটো পাথরের মতো সাদা। তার কানে ভেসে আসে আরেকটা শব্দ টিকটিক...টিকটিক...ঢং.... সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রবল ধাক্কা অনুভব করে নয়না। কে যেন তাকে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ঠেলে ফেলে দিল। শমিত ঠায় বসে রইল সোফায়। নয়না দরজার ছিটকে পরে জ্ঞান হারাল।

   পরদিন সকালে কোলাহলে ঘুম ভাঙে শমিতের। সোফাতেই শুয়েছিল সে। চোখ খুলতেই দেখল বেশ কয়েকজন লোক গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকটা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। শমিত বাধা দিতে এলে নয়না সামনে এসে দাঁড়ায়। তার চোখের কোণে কালি। ডানদিকের গালটা ফুলে কালো হয়ে গেছে। শমিত আঁতকে ওঠে, “কি হয়েছে তোর?” নয়না সেই কথায় আমল
 বলে, “তুই ঠিক বলেছিলি। বন্ধ ঘড়ি বাড়ীতে রাখাটা ঠিক নয়। ওটা আলিবাবু কে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর আজ আমরা একটু ঘুরতে বেরোবো। ডেট। ওকে?” 
শমিত মৃদু প্রতিবাদ করে বলল, “কিন্তু ওরা?"
― কেউ নেই শমিত। বিলিভ মি। একটু ঘুরে আসি চল। দেখবি ফ্রেশ লাগবে। সব কাজে মন বসাতে পারবি। প্লিজ, চল। ঘড়িটার কথা আর ভাবিস না।

    নয়না বলল বটে কথাগুলো কিন্তু গত রাতে দেখা দৃশ্য সে কাউকে বলতে বা বোঝাতে পারবে না। তাই সকাল হতেই আলিবাবুর দোকানে ফোন করে ঘড়িটা নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেছে সে। আর বলেছে ওরা দুজন যেকোনো এক সময় তার দোকানে যাবে। আলিবাবুও বহুদিনের খদ্দেরকে না চটিয়ে লোক পাঠিয়েছেন তড়িঘড়ি।
শমিত ঘাড় নাড়ে। নয়নার কোনো কথাতেই সে খুব একটা বাধা দেয়না, আজও দিল না। আর এই ঘড়ির আপদ বিদায় হলে সে নিজেও বাঁচে। কতো রাত যে সে ঘুমোতে পারে নি। কতো দিন যে সে ভয়ে ভয়ে আতঙ্কে দিন কাটিয়েছে। তা শুধু সেইই জানে। বাড়ীর বাইরে পা রাখেনি বহুদিন। কে যেন তার পায়ে বেড়ি পরিয়ে রেখেছিল। কিছুতেই তাকে ছাড়ছিল না সেই শক্তি। ঘড়িটার সাথে যদি সেই অস্বস্তিকর অনুভূতিগুলোও চলে যায় তবে জীবনটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে আবার।
ঘড়িটা নিয়ে চলে যেতেই শমিত সেই ফাঁকা জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করে কিছু একটা। নয়না আঁতকে উঠে শমিতকে টেনে আনে দূরে। মাথা নেড়ে আবার বলে, ওটা নিয়ে আর চিন্তা করিস না। চল বেরিয়ে পরি।
     ওরা ঘর বন্ধ করে বেরিয়ে গেল। কতদিন পর যে এরকম একটা দিন কাটালো ওরা, তা হয়তো ওদের নিজেদেরই মনে নেই। কলকাতা ছেড়ে হাইওয়ে ধরে অনেকটা লংড্রাইভ সেরে, রেস্তোরাঁয় খাবার খেয়ে ওরা পৌছল আলিবাবুর দোকানে। আলিবাবু তখন দোকান বন্ধ করতে উদ্যত হচ্ছেন। ওদের দেখে একটু বিরক্ত হলেও তা প্রকাশ করলেন না। চেয়ার পেতে বসতে দিলেন ওদের। নয়না কোনো প্রকার ভণিতা না করে বলে উঠল, “আলিবাবু ঘড়িটায় অস্বাভাবিক কিছু আছে। ঘড়িটা আপনি কোথা থেকে পেয়েছেন? কে আপনাকে ওটা বিক্রি করেছে। প্লিজ বলুন আমাদের।" আলিবাবু বৃদ্ধ ও অভিজ্ঞ মানুষ। নয়নার মুখ দেখে বুঝলেন কিছু একটা ঘটেছে। উনি বললেন, “দেখো, একজন পারসিক মহিলা এসে আমায় অনেক পুরোনো আসবাব বিক্রি করে যান মাসখানেক আগে। তার মধ্যে এই ঘড়িটাও ছিল। আমি আমার দোকানের নিয়ম মতো সেই মহিলার ফোন নম্বর দিতে পারি তোমাদের। কিন্তু এই ঘড়িটার মধ্যে যদি অস্বাভাবিক কিছু থেকে থাকে তা জানা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”


     যখন ফ্ল্যাটে ঢুকল তখন প্রায় রাত সাড়ে ন'টা। দরজা খুলে ঘরে পা রাখতেই রক্ত হিম হয়ে গেল শমিত-নয়নার। সারা ঘরে শব্দ উঠছে টিকটিক। জানলা চুঁয়ে আসা আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ডানদিকের দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে কালো রঙের গ্র্যান্ড ফাদার ক্লক। 
 
.........................
 
Keya Chatterjee