নারীর ভূষন
অমৃতা মুখার্জী
ছোট দলটা তাঁবু পেতেছে গ্রামের মাঝখানে। গ্রাম মানে কুড়িয়ে
বাড়িয়ে শ দুই লোকের বসবাস,পেরু দেশের কোকো ক্যানিওনের
ধারে। গ্রামটি যেন দুলছে পাহাড় সোহাগী মেঘের দোলনায়, সবুজ ভুট্টা ক্ষেতের ঝালর আর বাঁকা রূপালী নদীর লেস দেওয়া ঘাগরা দুলিয়ে।
এই সুদূরে সুহানী আর তার ডাক্তার বন্ধুরা এসেছে মেডিক্যাল মিশন ট্রিপে। তারা সবাই থার্ড ইয়ারে পড়ে। এটা তাদের করতে কেঊ বাধ্য করে না। কিন্তু এতে অনেক অভিজ্ঞতা বাড়ে। আর এই গরীব দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় বাস করা মানুষের যে প্রভূত উপকার হয় সে তো বলাই বাহুল্য। কয়েক জন প্রফেসার আর প্রাক্টিসিং চিকিৎসক ও এসেছেন। ছেলে, মেয়ে, বুড়ো, বুড়ি,চাষা ভুষো সকলেই জড়ো হয়েছে। রোগবালাই তো কি ? হাসিমুখে ধৈর্য ধরে সব্বাই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। সুহানী দের সামনে প্লাস্টিকের টেবিলে সারি সারি কার্ডবোর্ডের বাক্সে ওষুধ, চ্শমা, প্রেশার মাপার যন্ত্র, সার্জিকাল সুচার, চোখ দেখার চার্ট থরে থরে সাজানো।
প্রথম যেদিন ফিতের চেয়েও সরু খাদের ধারের বিপজ্জনক রাস্তা টা দিয়ে তারা সবাই ব্যাকপ্যাক নিয়ে গাইডের পিছু পিছু এই গ্রামে এল, দেবশিশুর মত হাসি নিয়ে ন্যাড়ামুন্ডি একদল বাচ্চা তাদের ঘিরে ধরে স্বাগত জানিয়েছিল। হুটোপাটি করে পকেট হাতড়ে দুষ্টু গুলো চকলেট খুঁজছিল। সুহানী একটু পরেই বুঝতে পারল বাচ্চাগুলো বেশির ভাগই চোখে ভালো দেখে না। কেউ কেউ পুরো অন্ধ। প্রফেসর সার্জেন টমাস বুঝিয়ে বলেছিলেন, যে কাছেই একটা আসবেস্টসের খনি আছে। তার নোংরা জল নদীতে এসে মেশে। তাতেই ওদের রোজকার চান,রাঁধাবাড়া, খাওয়া। পেরু দেশের এই দুর্গম জায়গাতে কোন সেভাবে হাসপাতাল, ডাক্তার বা স্বাস্থ্য পরিসেবা নেই। তাই বেশির ভাগ মানুষ ই কোন না কোন দুরারোগ্য রোগে ভোগে। বাচ্চারাও পার পায়না।
সুহানী মনে মনে শিউরে উঠেছিল। আমেরিকার বিলাস বহুল শহরে বসে যাস্ট চিন্তা করা যায়না এরকম অবস্থা। অথচ এরা বেশ আনন্দেই আছে। এই দুর্গম জায়গাতে বসে রঙ্গীন সুতো দিয়ে বুনে অসাধারণ জামা, স্কার্ট, টুপি, পুতুল, কোমর বন্ধ বানায় মহিলারা। পুরুষরা নরম কাঠের মনমুগ্ধকর খেলনা,চামড়ার বেল্ট, জুতো, আর আলপাকার কার্পেট বানায়।
নরম স্বপ্নের ছোট ছোট রেশমের বলের মত আলপাকা নামের ভেড়ারাই এদের জীবন যাত্রার সম্বল। দিন আনে দিন খায়। কিন্তু ঈর্ষনীয় সৌন্দর্যবোধ আর শিল্পী সত্ত্বা। আর আমেরিকায় সব থেকেও কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিয়ে লোককে ডিপ্রেশনের ওষুধ খেতে হয়। মন ভাল রাখার জন্য।
আসার পর থেকেই চমক লেগে আছে। কাল একটি বাচ্চা এল, তাকে সব সময় বেঁধে রাখতে হয়। তা না হলে সে নিজের কপালে আঘাত করে করে ক্ষত তৈরি করে। রোগ টার নাম লিশ্ম্যান নিহান সিন্ড্রোম। জেনেটিক রোগ। সারেনা। কোনরকমে আংসাইটি কন্ট্রোল করে বাঁচিয়ে রাখা। ছেলেটিকে ডাক্তার ভেনেসা একটা ওষুধ দিলেন। আজ সে দিব্যি হাসি মুখে তার আলপাকা টি নিয়ে খেলে বেড়াচ্ছে। বাবা মা এত খুশি, চোখের জলে মাখামাখি হাসি মুখ নিয়ে এক বাটি গরম ক্রে ফিশ আর নারকোলের দুধ দেওয়া স্যুপ ডাক্তার ভেনেসা কে দিয়ে গেল।
বেশির ভাগ লোকই টিবি তে ভুগছে। ফুলকপি সাইজের ওয়ার্ট কারো যৌনাঙ্গে। বাচ্চাদের এক চোখে ছানি, কারো বা একটা কান নেই। মহিলারা সারভিকাল ক্যান্সারে ভুগছেন। প্রায় সকলেরি কোন না কোন জয়েন্ট ফুলে আছে । কনুই, গোড়ালি,হাঁটু। আরথ্রারাইটিসের মহামারি ।এর মধ্যে সামান্য মেডিকাল সাপ্লাই যেটুকু হাতে বয়ে আনা যায়। এখানে ট্রাক বা গাড়ী আসেনা। পেনিসিলিন ইঞ্জেকশন আছে বলে খুব সুবিধা হয়। মারাত্মক সিফিলিস আর নানা রকম ঘায়ের উপদ্রব । এরপর আছে ভয়ানক চাগাশ রোগ। আজ সকালে সু্হানীর ডিঊটি পড়েছে মহিলাদের বিভাগে। একটু দূরে দুজন মহিলা বসে ছিল উবু হয়ে। দারুন বাহারি ঘাগরা পরা । তেমনি রংদারি টুপি মাথায়। তাদের নাকি বাঁদিকের হাতের নিচে এক ধরনের ফোঁড়া হয়েছে তাই দেখাতে চায়।
উপরের কামিজ খুলে সাবধানে সাদা গাউন দিয়ে মুড়ে দিল সে মহিলার গলা থেকে কোমর অব্দি। বাঁদিকে বগলের তলায় সে দেখল গ্রোথ গুলোকে। এক গোছা আঙ্গুরের মত ছটা ফোঁড়া, কিন্তু কি আশ্চর্য কোন ঘা বা পুঁজ নেই তো! মহিলা একবারো বললেন না চাপ দিলে ব্যথা লাগছে। কি মুশকিল, বইতেও এরকম কোন আবসেস বা ফোঁড়ার ছবি নেই। হঠাৎ সে লক্ষ করল যে চিটচিট করছে কি যেন একটা আঠার মত জিনিস। কোন পচা গন্ধ নেই। ডক্টর জিওভানি কে শেষমেষ ডাকল সু্হানী আর ওর পার্টনার যোসেফ। উনি এসে ভাল করে দেখলেন। পেরুভিয়ান দোভাষী কে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন ওই মহিলার কোন বাচ্চা আছে কি না? সে কি এখনো ব্রেস্ট ফীড করে? সে জানাল হ্যাঁ। ডক্টর জিওভানি স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষন।
তার পর অন্য মহিলা যিনি একটু দূরে বসে ছিলেন তাকে ডাকলেন।
"তুমি কি ওর বোন?" জিজ্ঞেস করলেন। মহিলা লাজুক হাসলেন। মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল?
"আমি কি তোমাকে পরীক্ষা করতে পারি?"
মেয়েটি নি:সংকোচে কামিজ খুলে দেখালো। সি দকতর।
ওরা সকলে অবাক হয়ে দেখল যে মেয়েটির এক দিকের বুক সমতল। অন্যদিক সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ।
ডক্টর জিওভানি মাটিতে বসে পড়লেন। আভূমি নত হয়ে মাটিতে ক্রস কাটলেন। চোখে আনন্দে জল চিকচিক করছে।"বললেন পৃথিবীতে এরকম আশ্চর্য কেস বড় একটা আসেনা। এটা ফোঁড়া নয়। এটাকে বলে পলিম্যাস্টিয়া। মাল্টিপল ব্রেস্ট। জন্মের আগে মামারি গ্ল্যান্ডের সঠিক বিভাজন না হলে এরকম হয়। এমনকি পরের সন্তান জন্ম নিতে পারে একদিকে অসম্পূর্ণ অবস্থায়। পুরানে এক দেবীরছবি পর্যন্ত পাওয়া গেছে , তার নাম আর্টেমিস অফ এফেসুস। এর জন্য কোন অন্য অসুবিধা নেই। সন্তানের জন্ম দিতে অসুবিধা নেই। খুব বিরল ঘটনা। দশ লক্ষে হয়তো এক জোড়া। আর ওই ছোট বোনের যেটা হয়েছে সেটাও খুব বিরল। সেটার পোষাকী নাম আম্যাস্টিয়া। পলিম্যাস্টীয়া র বিপরীত।"
মহিলা দুজন লাজুক হাসলেন। ছবি তুলতে আপত্তি করলেন না। বাচ্চা কোলে দিব্যি হাসিমুখে দূরে দাঁড়ানো টুপি পরা লোক টাকে ডেকে নিলেন। ওই উনাদের দুজনেরি বর। লোকটি খুব গর্বিত লাজুক মুখে দুই বৌ ও ছানাপোনাদের নিয়ে দারুন পোজ দিল।
সুহানীর ভিতর টা কে যেন কুরে কুরে খাচ্ছিল। তার কত বড় বিদুষী বন্ধু রক্তিমা। যেমন লেখাপড়ায় তেমনি স্পোর্টসে। তার শিক্ষিত স্বামী এই অপরাধে একটা ছুতো করে তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিল। এই অপমান সহ্য করতে না পেরে একদিন রক্তিমা হাতের শিরা কেটে ফেলেছিল। শ্মশানে খুব বেশি লোক যায় নি। সুহানী গেছিলো।