সেকেন্ড ইনিংস
অঙ্কুর চক্রবর্তী
-১-
দাদা
খুব ভুল করেছে। অনিকে নিয়ে মুম্বই কিংবা দিল্লিতে চেষ্টা করা উচিত ছিল।
ছেলেটার পোটেনশিয়াল যে আছে সুকুমার বুঝেছিল অনেক আগেই। বছর পাঁচ বয়েস
থেকেই টেনিস বল জোরে ছুড়তে ভালবাসত অনিকেত। সুকুমারই তারপর ওকে হাতে ধরে
অ্যাকশন ঠিক করিয়েছে। সাত বছরের জন্মদিনে এনে দিয়েছে এস . জি-র ক্রিকেট
কিট, বলে দিয়েছে ইন্সুইং আউট সুইং-এ গ্রিপ কিভাবে বদল করতে হয়। এখন সে
সম্ভাবনাময় তরুণ পেসার। কিন্তু বাংলায় খেলে কি আর ইন্ডিয়া কল আপ পাবে এত
সহজে? বিশেষ করে যখন বাংলা এবছর রঞ্জি খেলছে প্লেট গ্রুপে।
দাড়ি
কামাতে কামাতে এসব কথাই ভাবছিল আটত্রিশ বছরের সুকুমার। সদ্য কাটা গালে
আফটার শেভ লাগালে যেরকম শিরশির করে, সেরকম শিরশিরে একটা ব্যথা সে অনুভব করে
মনের কোণে। ইন্ডিয়া খেলা হয়নি তার নিজের, আর হবেও না। অজস্র ঘরোয়া
ক্রিকেটার যারা আশা জাগিয়েও বিস্মৃতির অতলে চলে চায় সুকুমার তাদেরই
একজন।
বিবেকানন্দ পার্কে
সকালের জগিং করার সময়ও সাত বছর আগের মাঝরাতের একটা ঝগড়ার কথোপকথন তার
স্মৃতিতে উঁকি দিতে থাকে। মেলবোর্নের ফ্লাইট থেকে নেমে ট্যাক্সি ধরে
বাড়িতে এসেই জবাবদিহি চেয়েছে সে দাদার কাছে, " মা চলে গেলেন আর তুমি আমাকে
বলার প্রয়োজন পর্যন্ত মনে করলে না! অ্যাসিস্ট্যান্ট টিম ম্যানেজার মুখ
ফস্কে কথাটা বলে না ফেললে আমি জানতে পর্যন্ত পারতাম না! "
দাদা সুকোমল কৌপিন পরে সোফার ওপর বসেছিল। উস্কো খুস্কো চুলে হাত চালিয়ে বলেছিল, " ইডিয়েট! এই সুযোগ তুই আর পাবি না সুকুমার!"
" মা - কে দেখার শেষ সুযোগও তো আর পাবো না দাদা! শুধু তোমার জন্য"
"
তুই কি এখনও বুঝতে পারছিস না সুকুমার। এভাবে বিদেশ সফর ছেড়ে ব্যাক আপ
উইকেট কিপার বাড়িতে চলে এসেছে কেউ শুনেছে কস্মিনকালে? ইন্ডিয়া টিমে ডাক
পাওয়া কী ছেলের হাতের মোয়া? তোদের পেট পাতলা টীম ম্যানেজারকে কথাটা
জানানোই ভুল হয়েছিল"
" সে সব আমি বুঝে ..."
"
ইউসলেস ইউসলেস! ননসেন্স ! বেরিয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে", সুকুমারকে
কথাটা শেষ না করতে দিয়েই গর্জন করে উঠেছিলেন সুকোমল মুখার্জী।
বেরিয়েই
গেছিলো বরাবরের সেন্টিমেন্টাল সুকুমার, আর ওই বাড়ি মুখো হয়নি। ভাইপো
অনিকেতের করুণ মুখটা অনেকবার মনে পড়েছিল , কিন্তু দাদার " ইউসলেস!" কথাটা
এখনও কানে বাজে সুকুমারের। আর দাদার কথা সত্যি করেই উইকেটকিপার
ব্যাটসম্যান সুকুমার মুখার্জির আর জাতীয় দলে ডাক আসেনি, স্বপ্ন অধরাই থেকে
গেছে। দাদা অনেকবার তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও বিফল হয়েছেন।
পারিবারিক বিচ্ছেদ বা অন্য যে কারণেই হোক পরপর দুটি রঞ্জি সিজনে রান পায়নি
সুকুমার, তখন তার বয়েস বত্রিশ ছুঁয়েছিল । এরপর ভালো খেললেও বয়েসের কারণে
তাকে ভবিষ্যত পরিকল্পনায় সামিল করতে চাননি নির্বাচকমণ্ডলী।
এমনকি
গত রঞ্জি সিজনে প্রায় একশো ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলা সুকুমারকে বাংলা দল
থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে কোনরকম সৌজন্য না দেখিয়ে। শেষ পর্যন্ত কিছু পরিচিত
সূত্রে কথা বার্তা বলে সে এই সিজন খেলেছে সিকিমের রাজ্য দলের হয়ে, সে ঠিক
করেছে এটিই তার শেষ সিজন; এরপর অবসর।
রঞ্জি
ট্রফি খেলা হয় দুটি ডিভিশনে - এলিট এবং প্লেট। প্লেট ডিভিশন থেকে চারটি দল
সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়। তাদের মধ্যে থেকে বিজয়ী দুটি দল এলিট দলগুলোর
সাথে মূল রঞ্জি ট্রফিতে অংশগ্রহণ করতে পারে। সিকিম, ত্রিপুরার মত ছোট
দলগুলো থাকে প্লেট ডিভিশন এ। মজার ব্যাপার হলো যে গত বার বাংলা রঞ্জি ট্রফি
শেষ করে লীগ টেবিলের একদম শেষে। তাই তাদের অবনমন হয়ে গেছে প্লেট গ্রুপে।
সিকিম, ত্রিপুরা, জম্মু কাশ্মীরের মত টিমগুলোর সাথে খেলে জিতলেই তবে মূল
টুর্নামেন্টে এবার অংশগ্রহণ করতে পারবে বাংলা।
বাংলা
আর সিকিম দুটি টীমের পারফরমেন্স এবার যথেষ্ট ভালো, তারাই এখন মুখোমুখি হবে
প্লেট গ্রুপের সেমিফাইনালে। উনিশ বছরের তরুণ পেসার অনিকেত মুখার্জির গতিতে
ভর করে বাংলাকে ইতিমধ্যেই অপ্রতিরোধ্য দেখাচ্ছে। তিনটি ম্যাচ খেলে
ইতিমধ্যে তার ঝুলিতে সতেরোটি উইকেট। নিজের শেষ মরশুমে সিকিমের অভিজ্ঞ উইকেট
কিপার ব্যাটসম্যান সুকুমারকে যথেষ্ট দৃঢ় প্রতিজ্ঞ দেখিয়েছে। ৭৪, ৩৬, ৩৪*,
৫৮ এবং ১৭* (নট আউট) এর ইনিংসে সে বোলারদের সুযোগ দিয়েছে খুব কম।
সিকিম
বনাম বাংলার এই ম্যাচ নিয়ে উত্তেজনার পারদ চড়ছে বাংলার ক্রিকেট মহলে,
এলিট গ্রুপে যাওয়ার পথে এখন বাধা শুধু সিকিম। বাংলার পেসারদের সুবিধের
জন্য ইডেনের উইকেটে ঘাস রেখেছেন কিউরেটর। কাকা ভাইপোর মুখোমুখি ম্যাচ
নিয়েও গুঞ্জন উঠেছে ক্রিকেটীয় অলিন্দে। বাংলা নিজের খেলা ধরে রাখলে এটিই
হতে চলেছে সুকুমার মুখার্জির ফেয়ারওয়েল ম্যাচ। জগিং শেষ করে ফিরে এসে আজ
ম্যাচের আগের শেষ নেট সেশনের জন্য তৈরি হয়ে যায় সুকুমার।
-২-
প্রথম
দিন, সকাল সাড়ে নটা। শীতের সকালে জনা পঞ্চাশেক দর্শক ইডেনের বিশাল
গ্যালারির শূন্যতাকে বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। টসে জিতে ব্যাটিং নিয়েছে
বাংলা। প্যাড, উইকেটকিপিং গ্লাভস নিয়ে ড্রেসিং রুম থেকে বেরোনোর সময়
সুকুমারের দেখা হয়ে গেল অনিকেতের সঙ্গে
" কাকু.." অনি তখনও প্র্যাক্টিস কিটে, কারণ তার ব্যাটিং সবার শেষে।
ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে হালকা না হেসে পারে না সুকুমার। অনেক লম্বা হয়ে গিয়েছে অনিকেত, ছিপ ছিপে চেহারা, এক মাথা ঝাঁকরা চুল।
"বেস্ট অফ লাক অনি", পেশাদারী ভঙ্গিতে কথাটা বলে সুকুমার।
" গুড লাক টু ইউ টু অন ইওর লাস্ট ম্যাচ"
" লাস্ট ম্যাচ কিনা সেটা সময় বলবে অনি"
কথাটা
বলে তর তর করে সিড়ি বেয়ে নেমে আসে সুকুমার। বাংলা কি ধরেই নিয়েছে
ম্যাচটা তারা জিতে গেছে? অনিশ্চয়তার অপর নাম ক্রিকেট! চোয়াল শক্ত করে
সুকুমার।
স্টাম্পের পেছনে
জায়গা নেওয়ার আগে পিচের ওপর চোখ বুলিয়ে নেয় সুকুমার। হালকা ঘাস, সকালের
আদ্রতা শুরুর একঘন্টা ব্যাটসম্যানকে সংযত হতে বাধ্য করবে। বাংলার হয়ে ওপেন
করতে নেমেছে অতনু মিত্র এবং কল্লোল সেন। দুজনেই পোড়খাওয়া ক্রিকেটার।
কল্লোলের বয়েস চব্বিশ, ইতিমধ্যেই গোটা দশেক ওয়ান ডে খেলে ফেলেছে জাতীয়
দলের হয়ে। টেস্ট ম্যাচে সুযোগ পাওয়ার জন্য রঞ্জির এই মরশুম তার জন্য খুব
গুরুত্বপূর্ণ। হাইকোর্ট প্রান্ত থেকে নতুন বল হাতে সিকিমের হয়ে শুরু করবে
গুরুং।
প্রথম ওভার, মেডেন।
মাঝারি গতির পেসার গুরুং ছয়টি বলই রেখেছে অফ স্টাম্পের বাইরে। উইকেটের
পেছনে সুকুমার অনুভব করে বাতাসে বল হালকা কাটছে। কোনো ঝুঁকি না নিয়ে সুইং
থেকে নিজের ব্যাট বাঁচিয়ে সাবধানে ইনিংস শুরু করেছে অতনু।
শীতের
সকালের আমেজের সঙ্গে মানিয়ে টেস্ট ম্যাচ শুরু হয়েছে ধীর গতিতে। কিন্তু
অভিজ্ঞ সুকুমার বুঝতে পারছে ধীরে ধীরে সেট হচ্ছে বাংলার দুই ওপেনার। প্রথম
দশ ওভার শেষে বাংলা কোনো উইকেট না হারিয়ে ২৭ রানে পৌঁছে গেছে।
ফার্স্ট
চেঞ্জ হিসেবে এখন বল হাতে তুলে নিয়েছে তামাং। তামাংকে পুরোপুরি পেসার বলা
যায় কিনা তা সুকুমার জানে না, বোলিং অ্যাকশন কিছুটা সৌরভ গাঙ্গুলির মত,
গতিও সেরকমই। সর্ব্বোচ ১১০-১২০ কিমি বেগে বল করে সে। তার প্রধান অস্ত্র, অফ
কাটার এবং লেগ কাটার। প্রথম ওভারেই কল্লোল তাকে দুটো বাউন্ডারি হাঁকালো।
অপর প্রান্ত থেকে বল করতে আসা লেগ স্পিনারের বিরুদ্ধেও স্বচ্ছন্দ বাংলার
দুই ওপেনার। আঠারো অভার শেষে বাংলার রান এখন ৬৮/০।
সিকিমের
ক্যাপ্টেন থন্দুপ ভুটিয়া আবার বল তুলে দিয়েছেন তামাং এর হাতেই। সকালের
রোদ যত বাড়ছে পিচ ব্যাটসম্যানের জন্য তত সহায়ক হচ্ছে। আর সেটা প্রমাণ হলো
যখন ওভারের তৃতীয় ও চতুর্থ বলে স্টেপ আউট করে পরপর দুটি ছক্কা হাঁকিয়ে
নিজের হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করলো কল্লোল। বাংলার ড্রেসিং রুমের বাইরে তখন
হাততালি। সুকুমার এগিয়ে আসে ক্যাপ্টেন ভুটিয়ার কাছে, সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর
সে উইকেট থেকে দূরে না দাঁড়িয়ে কাছে এসে দাঁড়ায়। বল হাতে ছুটে আসছে
তামাং, হাতের গ্রিপ দেখে সুকুমারের অভিজ্ঞ চোখ বলে দিচ্ছে বল টা লেগ কাটার।
আবার স্টেপ আউট করতে ক্রিজের বাইরে বেরিয়ে আসে কল্লোল। এবার কিন্তু বল
কেটে বাইরে বেরিয়ে আসে, ব্যাটে বলে সংযোগ হয় না। চোখের পলকে অফ স্টাম্পের
বাইরে থেকে বল সংগ্রহ করে উইকেট ভেঙে দেয় সুকুমার। আউট! স্টাম্পড! হতভম্ব
কল্লোল উইকেটের দিকে একবার তাকিয়ে প্যাভিলিয়ন মুখো হয় । বাংলার স্কোর
৮২/১।
লাঞ্চের পরের সেশনে
কিন্তু বাংলার মিডল অর্ডারে র ওপর চেপে বসে সিকিমের লেগ স্পিনার আবদুল্লাহ
এবং পার্ট টাইম অফ স্পিনার ছেত্রী। মূলতঃ তাদের অবদানে চা বিরতির সময়
বাংলার ৬ ব্যাটসম্যান ফিরে গেছে প্যাভিলিয়ন এ। দলীয় স্কোর তখন ২০৪। নিজের
ব্যক্তিগত ৫৬ রানে অপরাজিত আছেন বাংলার অধিনায়ক প্রশান্ত দাশগুপ্ত।
চা
বিরতির পর প্রথম ওভারেই গুরুঙ্গের বলে খোঁচা দেয় বাংলার অলরাউন্ডার
শ্রীকান্ত। নিজের ডানদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাটির থেকে এক ইঞ্চি ওপরে ক্যাচটি
সহজাত ক্ষিপ্রতায় নিজের গ্লাভসবন্দী করে সুকুমার। টেল এন্ডার রা ক্রিজে
আসার সাথে সাথে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং শুরু করেন অধিনায়ক প্রশান্ত। শীতকালের
দিন ছোট, ব্যাড লাইটে খেলা শেষের দু ওভার আগে নিজের শতরান পূর্ণ করে সে।
কিছুক্ষণ আগে তাকে সঙ্গ দিতে ক্রিজে এসেছে বাংলার শেষ ব্যাটসম্যান অনিকেত
মুখার্জি। তিনবার খোঁচা দিতে দিতে বেঁচে গেছে সে। বোলার হিসেবে যতই
প্রতিভাবান হোক, ব্যাটসম্যান হিসেবে সে একেবারেই কাঁচা। উইকেটের পেছনে
দাঁড়িয়ে ভাইপোর ব্যাটিং টেকনিক দেখে মনে মনে না হেসে পারেনি সুকুমার।
কিন্তু তবু দিনের শেষে অপরাজিত থেকেছে সে ৭ রানে। বাংলার স্কোর ৯ উইকেটের
বিনিময়ে ২৮১। শীতের পরন্ত বিকেলে কাকা ভাইপো টুক টাক কথা বলতে বলতে যখন
ড্রেসিং রুমে ফিরছিল, তখন একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর ক্লাব হাউস থেকে বলে উঠলো, "
ওয়েল প্লেড! ব্রাভো!" সেদিকে তাকিয়ে সুকুমার দেখলো উপস্থিত হয়েছেন দাদা
সুকুমার মুখার্জি। কথা না বাড়িয়ে গ্লাভস খুলতে খুলতে সিকিমের ড্রেসিং
রুমের দিকে পা বাড়ায় সুকুমার।
- ৩ -
দ্বিতীয়
দিন আকাশ মেঘলা, কনকনে উত্তুরে হাওয়া। সুইং বলিংয়ের জন্য আদর্শ পরিবেশ।
বাংলার শেষ উইকেটের জন্য সিকিমকে অপেক্ষা করতে হল মাত্র দু ওভার। গুরুঙ্গের
ইয়র্কার বল সামলাতে না পারায় নিজের ১০ রানের মাথায় ক্লিন বোল্ড হয়ে যায়
অনিকেত। বাংলা প্রথম ইনিংসে ২৯১, ইডেনের স্কোর বোর্ডে জ্বলজ্বল করছে
প্রশান্তের অধিনায়কোচিত ১১৩ নট আউট।
শীতের
সকালের আদ্রতা আর গঙ্গার হাওয়াকে কাজে লাগিয়ে শুরুতেই ভয়ংকর হয়ে ওঠে
অনিকেত। ১২ ওভার শেষ হতে না হতেই মাত্র ৩৫ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে সিকিম যখন
ধুঁকছে তখন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান লেপচাকে সঙ্গ দিতে ক্রিজে আসে সুকুমার।
আর প্রথম বলে কাকাকে বাউন্সার দিয়ে স্বাগত জানায় অনিকেত। সুকুমার বুঝতে
পারে, অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে অনি। বলের গতি ১৪০ এর বেশ ওপরে। কখনও কখনও
লাইন লেংথ হয়ত কিছুটা ভুল করে, তবুও শতকরা ৬০ ভাগ বল সঠিক জায়গায়। তখন
অনিকেত নিজের লাগাতার সপ্তম ওভারে, অফ স্টাম্পের অনেক বাইরের একটি বল দেখে
চোখ জ্বলে ওঠে সুকুমারের। সপাটে কাট করে সেটাকে বাউন্ডারিতে পাঠায় সে।
প্রথমদিনের
মত দ্বিতীয় দিনও রোদ ওঠার সাথে ব্যাটিং সহজ হয়। মধ্যাহ্ন বিরতির আগে
পর্যন্ত আর কোনো উইকেট না হারিয়ে সিকিম পোঁছে যায় ৯০/৩ রানের স্কোরে।
স্কোরবোর্ড বলছে লেপচা ৫৪*, মুখার্জি ২৮*। বোলিং কার্ডে অনিকেত মুখার্জির
নামের পাশে ১২ ওভারে ২১ রানে ২ উইকেট।
বিশেষজ্ঞরা
বলেন দ্বিতীয় দিন লাঞ্চের পর ইডেন গার্ডেন্সে ব্যাট করার জন্য সেরা সময়।
বাংলা স্পিনারদের সহজেই কাবু করে ফেলে সুকুমার ও লেপচার জুটি। দলীয় ১৪২
রানের মাথায় নিজের অর্ধশত রান পূর্ণ করে সুকুমার। বাংলা দলের পুরোনো
সতীর্থদের মধ্যে কেউ কেউ এসে অভিনন্দন বলে যায়। কিন্তু এর তিন ওভার এর
মধ্যেই খেলার গতির সম্পূর্ণ বিপরীতে অফস্পিনার কল্যাণের বলে এলবিডব্লিউ আউট
হয়ে যায় সে নিজে ৬২ রানের মাথায়।
দ্বিতীয়
স্পেলে ফিরে এসে অনিকেত বোলিং শুরু করে নিজের চেনা ছন্দে। বাংলার পেসাররা
দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষ হওয়ার ঠিক আগে সিকিমকে অল আউট করে দেয় ২৭৩ রানে,
প্রথম ইনিংসে বাংলার লিড ১৮ রান। তখনও অনিকেত কিংবা সুকুমার কেউই জানত না
এই সামান্য ব্যবধান কত গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। সেদিন ইনিংস বিরতির সময়
থেকে শুরু হয় বৃষ্টি। আম্পায়াররা অগত্যা নিরুপায় হয়েই সেদিনের জন্য
খেলা শেষ করে।
-৪-
তৃতীয়
দিন প্রথমে বৃষ্টি এবং ভেজা আউটফিল্ডের কারণে বেলা দুটোর আগে খেলা কিছুতেই
শুরু করা গেল না। ভেজা সবুজ পিচ, মেঘলা আকাশ, বোলারদের জন্য আদর্শ পরিবেশই
বটে। বল যে মারাত্মক সুইং করছে উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে তা অনুভব করে
সুকুমার। বাংলার ব্যাটসম্যানরা একেবারেই সুবিধা করে উঠতে পারেনি দ্বিতীয়
ইনিংসে, দলীয় ১৬২ রানের মাথায় তারা অল ডাউন হয়ে যায় । সিকিমের দ্বিতীয়
ইনিংসে জয়ের জন্য চাই ১৮১ রান। ১৮১ এমন কিছু বড় লক্ষ্য নয় কিন্তু
চতুর্থ ইনিংসে এরকম বোলিং সহায়ক পরিবেশে এই রান তাড়া করাও যে কঠিন হবে
তারা যারা বিন্দুমাত্র ক্রিকেট খেলেছেন তারা জানেন।
আর
সিকিমের ড্রেসিংরুম যেই জিনিসটা আশঙ্কা করছিল ঠিক সেটাই হল; বল হাতে
অনিকেত এবং বাংলার পেসাররা অদম্য হয়ে উঠল। সিকিম দ্বিতীয় ইনিংসে তাদের
তিন উইকেট হারিয়েছে ১২ রানে। ব্যাট হাতে যখন সুকুমার ড্রেসিং রুমের সিড়ি
দিয়ে নেমে আসছে , ক্লাব হাউসে বাংলা ও সিকিমের কর্মকর্তারা মুখে দাড়িয়ে
হাততালি দিচ্ছেন। তারা ধরেই নিয়েছেন সিকিম ম্যাচটা হেরে যাচ্ছে অতএব
সুকুমারের এই শেষবার ব্যাট হাতে মাঠে নামা। ক্লাব হাউসে সুকোমল মুখার্জির
মুখটাও চোখ এড়ালো না সুকুমারের। ক্রিকেট দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাওয়ার
নাম, যতক্ষণ পর্যন্ত না শেষ বল হয়ে যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত লড়ে যেতে হবে
এই আজীবন জেনে এসেছে সুকুমার। হোক না গ্যালারি ফাঁকা, হোক না শেষ ইনিংস,
মনোসংযোগ করতে হবে বাধ্য ছাত্রের মত।
এরপর
ইডেন গার্ডেনে গুটি কয়েক দর্শক আর কর্মকর্তারা দেখলেন ক্রিকেট
ক্যারিয়ারের সূর্যাস্তে পৌঁছানো এক ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং প্রদর্শনী। ভালো
বল সে ছাড়লো, ফুল লেন্থ বলে ড্রাইভ, শর্ট বলে পুল। অনিকেত এবং বাংলার
রঞ্জি স্বপ্নের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন সুকুমার মুখার্জি।
অপরপ্রান্ত থেকে উইকেট পড়ে গেছে অবশ্য লাগাতার। সিকিম যখন তাদের নবম উইকেট
হারালো তখনো জেতার জন্য চাই আট রান। ব্যক্তিগত ৯৩ রানে ব্যাট করছে
সুকুমার।
হাইকোর্ট
প্রান্ত থেকে ছুটে আসছে বাংলার সেরা পেসার ম্যাচে ইতিমধ্যে নয় উইকেট নেওয়া
অনিকেত। শর্ট বল, নিজের ওজন পেছনের পায়ে নিল সুকুমার। চোখের ঠিক নীচে
ব্যাটে বলে সংযোগ হল। খট করে একটা শব্দ। হুক শট, দ্রুত পিচে এই শর্ট খেলা
প্রচন্ড কঠিন। বল উড়ে চলেছে। অনিকেত আর বাংলা ক্যাপ্টেন প্রশান্ত সমস্বরে
চিৎকার করে উঠল, " ক্যাচ..."। ঘাড় ঘুরিয়ে সুকুমার দেখল ডিপফাইন লীগের
মাথার ওপর দিয়ে বলটি উড়ে গিয়ে আছরে পড়লে ফাঁকা গ্যালারিতে। ছয় রান।
ভাইপোর দিকে তাকিয়ে হালকা হাসল সিকিমের বর্ষিয়ান উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান।
জেতার জন্য আর দুই রান,তার নিজের রান ৯৯। ইতিহাস দেখতে পাচ্ছে সে,
প্রথমবার রঞ্জির এলিট গ্রুপে সে দেখতে পাচ্ছে সিকিমকে। "ইউজলেস" নয় সুকুমার
মুখার্জি, বাংলার বিরুদ্ধে মধুর প্রতিশোধ আর মাত্র দু রান দূরে। ওভারের
শেষ বল, সিঙ্গেল নিয়ে স্ট্রাইক রাখতে হবে। অফ স্টাম্পের বাইরের বলটা
রেখেছে অনিকেত। থার্ড ম্যান অঞ্চলে একরান নেওয়ার জন্য ব্যাটটা পেতে দিল
সুকুমার। একটু রিভার্স সুইং করলো কি বলটা? উইকেট কিপার এর তালুবন্দি হতেই
সারা বাংলা টিম সমস্বরে আপিল করে উঠলো কট বিহাইন্ডের জন্য।
আম্পায়ারের
দিকে তাকালো সুকুমার.. না আম্পায়ার মাথা নাড়িয়ে জানালেন নট আউট। কিন্তু
সুকুমার জানে তার ব্যাটের কিনারা হালকাভাবে হলেও সংস্পর্শ করেছে বলের
সাথে; আর কেউ জানুক বা না জানুক ব্যাটসম্যান সব সময় জানে। ইডেন গার্ডেনে
তখন শেষ বিকেলের লম্বা ছায়া পড়েছে। ব্যাট বগলে নিয়ে গ্লাভস খুলতে খুলতে
প্যাভিলিয়নের দিকে হাঁটা লাগালো সুকুমার।
বাংলা
দল হতবাক, সমস্ত ইডেন হতবাক এবং ক্রিকেট ঈশ্বরও বোধ হয় এক মুহূর্তের জন্য
হতবাক হয়ে গেলেন। ওয়াকওভার। ব্যাটসম্যানকে আম্পায়ার আউট না দেওয়া
সত্ত্বেও, নিজে থেকে হার স্বীকার করে নেওয়া, একমাত্র জেন্টেলম্যানস গেম
ক্রিকেটেই সম্ভব। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বাংলা দল সোল্লাসে ফেটে পরলো। কিন্তু
তার মধ্যে থেকেই অধিনায়ক প্রশান্ত এসে করমর্দন করে গেলেন সুকুমার-এর সঙ্গে,
বললেন, " হোয়াট এ লাস্ট ইনিংস!"।
ড্রেসিংরুমে
সিড়ি দিয়ে ওঠার মুখে দেখা হয়ে গেল দুই ভাইয়ের।সুকুমার অবাক হয়ে দেখল
সুকোমল-এর চোখে তখন জল চিক চিক করছে। ছোট ভাইকে জড়িয়ে ধরে ভাঙ্গা গলায়
সে বলল, " এটা কী করলি ইডিয়েট? সেঞ্চুরি মাঠে ফেলে এলি?"
" সেঞ্চুরিটা মাঠে ফেলা থাক দাদা, সম্মানটা সাথে আছে।"
" আমার দেখা ঘরোয়া ক্রিকেটে সেরা সেকেন্ড ইনিংস ব্যাটিং এটা!", বিহ্বল স্বরে বলে ওঠে সুকোমল।
" সেকেন্ড ইনিংস তো সবে শুরু দাদা"
ভ্রু
দুটো ওপরে তুলে অবাক চোখে তাকালেন সুকোমল মুখার্জী। মৃদু হেসে মাঠে উৎসবরত
বাংলার ক্রিকেটারদের দিকে দেখিয়ে সুকুমার বললো, " অনির গতি আছে, কিন্তু
লাইন লেংথ নিয়ে বিস্তর খাটতে হবে। ওকে ঠিক দেখিয়ে দিতে হবে না?"
কলকাতার শীতের সেই শেষ বিকেলে নিজের ভাইকে একদিনের মধ্যে দ্বিতীয় বারের জন্য জড়িয়ে ধরলেন সুকোমল।
(সমাপ্ত)
Ankur Chakraborty