ভুবনডাঙার হাট - টুম্পা বিশ্বাস

 

ভুবনডাঙার হাট
টুম্পা বিশ্বাস  


           আমি আশুতোষ মল্লিক,মধ্যবয়সী,সুচাকুরে,গৃহস্থ।মোটের ওপর শান্তির জীবন। তবে সুখ শান্তি সবটাই আপেক্ষিক। মানুষের স্বভাবই এমন যে সে সবেতেই অসন্তুষ্ট,খানিকটা শুঁয়োপোকার মতো,তার কেবল প্রজাপতি হবার সাধ,তার চাই খোলা আকাশ।

         আমি বরাবরই ভ্রমণপিয়াসী। ঘরের চারদেয়ালে বন্দী থেকেই জীবনের বেশিটা কাটে বলেই বছরে বার দুয়েক অন্তত আমাকে বেরোতে হয়।তবে নাম না জানা, লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা কোন অখ্যাত স্থানই আমার পচ্ছন্দ। দৈনন্দিন ভীড় থেকে পালাতে গিয়ে পর্যটকদের ভীড়ে গিয়ে পড়া,সে আমার পোষায় না।ফাঁদে পড়া জীবন আর ফাঁদে পড়া ভ্রমণ -দুই ই আমার কাছে অসহনীয়। 

         আজকাল ইন্টারনেটের যুগে অবশ্য এমন জায়গা পাওয়া ভার।পৃথিবী যেখানে মুঠোফোনে বন্দী সেখানে অখ্যাত জায়গা!আমি তবু চেষ্টা ছাড়ি না।কখনও ট্রেনের টাইম টেবিল কখনও গুগল বাবাজীর সহায়তা-মোট কথা পচ্ছন্দ মত জায়গা আমার খুঁজে বার করা চাই।একবার খবর পেলাম কোলকাতা থেকে ৩৫কিমি দূরে একটি জায়গার,নাম চন্দ্রকেতুগড়।বিদ্যাধরী নদীর তীরে অবস্থিত জায়গাটি নাকি মোটামুটি লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল,হালফিলে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে জায়গাটি খানিকটা প্রকাশ্যে এসেছে। তা হলেও জনগন এখনও ওখানে হামলে পড়ে না।

         সেবার পুজোর ছুটিতে ওখানেই উপস্থিত হলাম সপরিবারে, মানে স্ত্রী অনুরাধা আর ছেলে অর্ণবকে নিয়ে।আমার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে উঠলাম।ঐতিহাসিক জায়গাগুলি দেখে নিলাম পরেরদিনই।সমস্ত জায়গা জুড়ে বিভিন্ন স্তূপ, ঢিপি।এগুলোর নাকি ঐতিহাসিক গুরুত্ব অসীম। বিভিন্ন যুগের নিদর্শন নাকি পাওয়া গেছে এখানে। খনা মিহিরের ঢিপিটা দেখতে দেখতে মনটা কোন অতীতে চলে গিয়েছিল!!তাছাড়া জায়গাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেও মোহিত হলাম।সভ্যতার লোভী থাবা এখনও জায়গাটাকে গ্রাস করেনি।এখনও এখানে আকাশ গাঢ় নীল। নদীর ধারে হেঁটে নির্মল বায়ুসেবন করে যেন শহুরে ধোঁয়া ভর্তি ফুসফুসগুলো হাঁফ ছেড়ে বাঁচত।

        একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে ফিরলাম বন্ধুর বাড়ি।একদিন সন্ধ্যেবেলা আড্ডা দিচ্ছিলাম বারান্দায় বসে।আড্ডার বিষয়বস্তু ছিল- আশেপাশে আর কি কি দ্রষ্টব্য আছে।বন্ধুর কাছেই খবর পেলাম এখান থেকে আরো তিন চার কিমি দূরে একটা গ্রামে একটি সাপ্তাহিক হাট বসে প্রতি বুধবার। গ্রামের নাম ভুবনডাঙা।নামটাতেই আটকে গিয়েছিলাম।তাই হাটে যাওয়া মনস্থির করলাম পরেরদিন।পরেরদিনই ছিল বুধবার।তবে সেখানে নাকি কোন যানবাহনে যাওয়া চলবে না।জঙ্গলের ধার ঘেঁষে গ্রামটির অবস্থান। তাই হয় সাইকেল নাহয় পায়ে হাঁটা।আমার কাছে শেষোক্তটিই শ্রেয় মনে হল।

         গ্রাম্য হাট দেখতে আগ্রহ ছিল না বাকিদের।ছেলে আর তার মা যেতে রাজী হল না,হাঁটার ভয়েই বোধহয়।বন্ধুর থেকে পথনির্দেশ নিয়ে আমি একাই রওনা দিলাম।পথ খোঁজার মধ্যেও আনন্দ আছে।লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে হাট খুঁজে নিলাম।হাটে পৌঁছে দেখি আর পাঁচটা গ্রাম্য হাটের মতোই।বেশিরভাগ হাতের তৈরী জিনিস নিয়ে বসেছে গ্রামবাসীরা।ভীড় নেই। দোকানীরা যেন আড্ডার মেজাজে, বিক্রি না হলেও চিন্তা নেই। এদিককার অধিবাসীদের মূল জীবিকা নাকি চাষাবাদ।কাজেই হাটটা হয়ত জীবন মরণের প্রশ্ন নয় ওদের কাছে।

         জঙ্গলের সীমা দেখা যাচ্ছিল অনতিদূরেই।মনে হচ্ছিল খানিকটা জঙ্গল সাফ করেই যেন এই হাট বসানোর ব্যবস্থা করেছে গ্রামবাসীরা।যেহেতু এখানে পর্যটকদের আনাগোনা নামমাত্র সেহেতু বেশিরভাগ নিত্য ব্যবহারের সামগ্রীই বিক্রি হচ্ছিল ।বেতের চুপড়ি,সস্তা প্লাস্টিকের আয়না ইত্যাদি।কিন্তু পরিবেশটা বড় মনকাড়া। নীল আকাশের ক্যানভাসে দোকানীরা যেন রঙ তুলিতে আঁকা। দেখলাম খদ্দেররা দোকানীদের সাথে আড্ডায় মশগুল। 

         খানিকটা এগিয়ে দেখি এক কিশোরী পসরা সাজিয়ে বসে আছে।মায়াময় মুখ।আনমনা দৃষ্টি। তার পসরায় সুন্দর বেতের তৈরী জিনিস।একটা ফুলদান নজর কেড়েছিল।দাম জানতে চাইলাম।

"আমি এমনি জিনিস বেচি না গো বাবু।খরিদ্দার পচ্ছন্দ হলে তবেই বেচি।"

ওর কথায় হকচকিয়ে গিয়ে আমি বললাম, 
"এমন কথা তো শুনিনি কখনও।তা বল কিভাবে পচ্ছন্দ কর খরিদ্দারকে?"

"বাবু তোমার সবচেয়ে বড় দোষ কি? "

"দোষের কি অভাব আছে?তা হঠাৎ দোষের কথা কেন?"

"প্রশ্নের উত্তর প্রশ্নে হয় না বাবু।জবাব দাও।"

"রাগলে আমার মাথার ঠিক থাকে না,কি করি,কি বলি তার হুঁশ থাকে না।এটাই বোধহয় সবচেয়ে বড় দোষ।" খানিকটা ভেবে জবাব দিলাম।

"তাহলে বাবু ওই রাগকেই ত্যাগ করতে হবে।না করলে এ ফুলদান নষ্ট হয়ে যাবে।এই নাও।"

"সে কি গো,আমায় পচ্ছন্দ হয়ে গেল?"আমি অবাক হয়ে জানতে চাই।

"যে এককথায় নিজের দোষ স্বীকার করে তাকে পচ্ছন্দ না করে কি করি?"

         সেদিন ফুলদানটা নিয়ে বন্ধুর বাড়ি ফিরলাম।কিন্তু পুরোটাই যেন ঘোরের মধ্যে হল।এক গ্রাম্য বালিকা কি এ ভাষায় কথা বলে?আমি কি স্বপ্ন দেখলাম?তবে ফুলদানটা পেলাম কোথায়?পরেরদিনই কোলকাতায় ফেরার কথা।খুব যত্ন করে পুরনো খবরের কাগজে মুড়ে নিয়ে এলাম ওটাকে।বাড়ি ফিরে টেবিলে সাজালাম ফুলদানটা।যেই দেখত ওটার প্রশংসা করত।এমনকি দুরন্ত অর্ণবও দেখতাম ওটার দিকে তাকিয়ে বসে আছে।গিন্নী শত কাজ ফেলেও রোজ ওটা সাফ করতে বসত।অতিথিরা জানতে চাইত ওটা কোথা থেকে কেনা।বলাই বাহুল্য সেই কিশোরীর অদ্ভুত কথাবার্তা কাউকেই বলিনি।

         সেদিন দেখি গিন্নী ফুলদানে রজনীগন্ধা সাজাচ্ছেন, বিয়ের পর পর এটা দেখতাম।তারপর সাংসারিক ঘানিতে পিষ্ট হয়ে ওসব শখ চলে গিয়েছিল কবে।মনটা তাজা হয়ে গেল ফুলগুলো দেখে।
"রজনীগন্ধা! কত বছর বাদে!" গিন্নীকে বললাম আমি।
"আজ বেরিয়েছিলাম,রাস্তায় বিক্রি হতে দেখলাম, তাই নিলাম। তুমি তো ভালোবাসো।"গিন্নীর মুখে একটা সলাজ হাসি।যেন ফুলগুলো আনার জন্য লজ্জিত। 
"ভালোবাসি,তোমাকেও।"বললাম। গিন্নীর মুখটা আরো রাঙা হল। 
 এসে আমার মাথায় হাত রাখলেন গিন্নী ,কত যুগ পর।ফুলগুলো আর সাথে ফুলদানটা আমাদের দাম্পত্যের এক মিষ্টি মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইল।
 
         এদিকে আমার সুপুত্রও দেখি কেমন শান্ত হয়ে গেছে। আগে কথা না মানা,অগোছালো স্বভাবের জন্য মায়ের কাছে বকা খেত রোজ।আজকাল দেখি নিয়ম মেনে পড়ে,নিয়ম মতো খেলে,আর অবসরে ফুলদানটার দিকে তাকিয়ে কি ভাবে।একদিন দেখি ওটাকে নিয়ে কবিতাও লিখে ফেলেছে। ভারী ভালো লাগল সেদিন।ছেলেটা একটা অনুভবী মন নিয়ে বড় হচ্ছে।আসলে আমাদের সকলকে ওই সামান্য বস্তুটা মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলেছিল।আর সেই কিশোরী আমার মনের চিলেকোঠার ঘরে বসত করত সবসময়। কি ছিল তার সেদিনের কথাগুলোর মধ্যে, জানিনা।তবে তাকে ভুলতে পারিনি। 

         হ্যাঁ,বলা হয়নি,এ ক'মাস আমি রাগ করিনি একবারও।সবকিছু সুন্দর চলছিল।কিন্তু একদিন ছন্দপতন হল।অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখি গ্রামের বাড়ি থেকে আমার জ্যাঠামশাই এসেছেন। সোফায় বসে চা পান করছেন।সামনে আমার স্ত্রী মৃত্যুদন্ড পাওয়া আসামির মতো দাঁড়িয়ে আছেন।বুঝতে পারলাম জ্যাঠামশাই ইতিমধ্যেই একচোট বক্তৃতা সেরে ফেলেছেন। পুরনো রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল আমার মনে।আমাকে দেখেই জ্যাঠামশাই নতুন উদ্যোগে শুরু করলেন,

"তুই তো নিজের আত্মীয়দের ভুলেই গেছিস।আমার ভাইটা চলে গেল।তারপর তোরা তো বাড়িতে যাওয়াই ছেড়ে দিলি।মনে রাখিস,যারা নিজের গ্রাম,নিজের মানুষকে ভালোবাসতে শেখেনি তারা ঠিকমতো মানুষ হয়নি।"

         আমার চন্ডাল রাগ জেগে উঠল।নিজেকে বলতে শুনলাম, 

"তোমার ভাই যখন দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিল,কদিন খোঁজ নিয়েছিলে?সে যাবার পর নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছিলে কেবল।স্নেহ করেছো যে সম্মানের প্রত্যাশা কর?"

        এটুকুতেই জ্যাঠার মুখ অপমানে নীল হল।উনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, 

"স্নেহের টানেই এসেছিলাম আশুতোষ। "

উনি আর দাঁড়ান নি।আমিও ঘরের দরজা বন্ধ করে নিজের অভিমানের সাথে বোঝাপড়া করেছিলাম।আত্মীয়দের অনাত্মীয়তা আমাকে বরাবর পীড়িত করেছে।সেই পুঞ্জীভূত রাগটাই জ্যাঠামশায়ের ওপর বেরিয়ে এসেছিল।

         পরদিন সকালবেলা ঘুম ভাঙতে মনে হল যে কাল রাতে একটু বাড়াবাড়ি করেছি,অতটা না করলেও চলত।বাড়িতে আসা অতিথির অনাদর ভালো নয়।কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই।তাই রোজকার অভ্যাসমতো ফুলদানটাকে একবার দেখতে গেলাম।দেখি ফুলদান টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। কেউ বলতে পারল না যে সেটা কিভাবে ভাঙল।আমার মনটা তখন ছটফট করছে।কিশোরীর কথা বার বার মনে পড়ছে-রাগ করলে ফুলদান নষ্ট হয়ে যাবে।ইটকাঠের এই পৃথিবীতে কি অলৌকিক কিছু সম্ভব? এ ঘটনার ব্যাখ্যা কি সেটা না জানা পর্যন্ত স্বস্তি পাব না।

         বুধবার অফিস থেকে অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে ছুটি নিলাম।রওনা দিলাম চন্দ্রকেতুগড়ের উদ্দেশ্যে।বাড়িতে বললাম বন্ধু অসুস্থ। ভুবনডাঙার হাটে পৌঁছে কিন্তু কিশোরীর দেখা মিলল না।কিন্তু আমি তখন মরীয়া,আমাকে জানতেই হবে এসবের মানে কি?আশেপাশের বিক্রেতাদের কাছে বর্ণনা করতে তারা কিন্তু সহজেই চিনে নিল কিশোরীকে।প্রথমে কেউ অবশ্য আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে চায়নি।একজন বহিরাগতকে কেনই বা তারা তাদের আভ্যন্তরীণ খবর দেবে?শেষমেশ এক বৃদ্ধা আমাকে সেই ভাগ্যহীনার কাহিনী শোনালেন।আমি তাকে আমার সাথে কিশোরীর আগের দিনের সব কথাবার্তা আর আজকে তার খোঁজ করার কারণ জানিয়েছিলাম। 

"ওর নাম লক্ষী, বাবু।আমরা ডাকতাম লখাই।ভারী সরল মেয়ে, খানিকটা পাগলাটে।ওর মা ছোটবেলাতেই মরে গিয়েছিল। বাবা মাতাল,অন্য কারোর সাথে থাকত।লখাই ওর দাদুর ঘরে মানুষ। 

         তারপর একদিন বাবাটা ফিরে এল।থাকতে চাইল ওর সাথে।সে নাকি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।লখাইয়ের মনটা নরম।ও রাজী হল।কিন্তু শর্ত রাখল। বলল মদ ছাড়তে হবে।ছেড়েওছিল।কিন্তু একদিন কোন অনামুখো বন্ধু এল,তার পাল্লায় পরে আবার মদ খেল আপদটা।লখাই কি কান্নাই কাঁদল।পরেরদিন থেকে কি জ্বর এল মেয়ের।মেয়েটা আর উঠল না।"

         আমি শিউরে উঠলাম। কি জানি কেন আমার মনে একটা অদ্ভুত তত্ত্ব এল।লখাই আমাকে বলেছিল রাগ করলে তার তৈরী ফুলদান নষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ একটি দোষের বদলে একটি বস্তু।আর বাবাকে বলেছিল মদ না খেতে।তার বদলে বাবাকে সে তার আপন সত্তাকে দিয়েছিল।বাবা মদ খাওয়ার ফলেই কি তাহলে তার সেই সত্তা নষ্ট হয়ে গেল? 

         কিন্তু এও কি সম্ভব? মানুষ যুক্তিবদ্ধ জীব।সব রহস্যের মীমাংসা করেই সে শান্তি পায়।অথচ মানুষকে ঘিরে থাকে কত রহস্য।আমার কাছে লখাইও একটি নিরুত্তর প্রশ্নের মতো থেকে গেল আজীবন। 

        এরপর থেকে যখনই কোন অজানা জায়গায় গেছি বেড়াতে, কোন অচেনা মানবীকে প্রকৃতির কোলে বিচরণ করতে দেখেছি,তখনই লখাই আমার মনের মধ্যে ফিরে এসেছে। একবার মাত্র তাকে আমি দেখেছিলাম অথচ তার মুখ আমি ভুলিনি। তার তৈরী করা ফুলদানটা আমি নষ্ট করে ফেলেছিলাম নিজের দোষে,কিন্তু তাকে দেওয়া আমার কথা আমি আর ভাঙিনি।রাগকে আমি ত্যাগ করেছি।তাতে জীবন আমার কাছে স্বমহিমায় এসেছে। আমাকে ভরিয়ে রেখেছে সৌরভে।
...................................
 
Tumpa Biswas