ব্রহ্মদৈত্যের বিপদ - সংগ্রামী লাহিড়ী

 ব্রহ্মদৈত্যের বিপদ
সংগ্রামী লাহিড়ী

 



হরিশঙ্করের বয়স অল্প, তিনকুলে কেহ নাই, গ্রামে দূরসম্পর্কের মামার বাড়ীতে মানুষ। পিতামাতা নাই, বহুকাল হইল গত হইয়াছেন। মামা-মামী তুতো ভাগিনেয়কে আশ্রয় দিয়াছিলেন নিতান্তই লোকলজ্জায়। অনাথ বালকটিকে দূর দূর করিয়া খেদাইলে গ্রামের আর পাঁচটি লোকে যাহা বলিবে তাহা আর যাহাই হউক, শ্রুতিমধুর হইবে না। অতএব তাঁহারা ঢেঁকি গিলিয়াছিলেন, অর্থাৎ হরিশঙ্করের মোটা ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, সেইসঙ্গে গ্রামের বিদ্যালয়টিতে ভর্তিও করিয়া দিয়েছিলেন। হরিশঙ্কর দুই মাইল হাঁটিয়া বিদ্যালয়ে যাইতো। পথে যাহার বাগানের ফলপাকুড় যখন যাহা চোখে পড়িত তাহার সদ্ব্যবহার করিত। বিদ্যালয়ে গিয়া সহপাঠীদের সহিত ফুটবল পিটাইতো। মোটের উপর তাহার সময় মন্দ কাটিত না।
 

সমস্যা দেখা দিলো পড়াশোনা লইয়া। হরিশঙ্কর মধ্যমেধার ছাত্র। বিশেষতঃ গণিতশাস্ত্র লইয়া তাহার ভীতির সীমা পরিসীমা ছিল না। ষান্মাসিক ও বাৎসরিক পরীক্ষাগুলি তাহার রাতের ঘুম কাড়িয়া লইত। শয্যায় ঘনঘন পার্শ্ব পরিবর্তন করিয়া বা মেষসংখ্যা গণনা করিয়াও কোনো উপকার হয় না। গণিতশাস্ত্রের বইয়ের পৃষ্ঠা হইতে সংখ্যাগুলি উঠিয়া আসিয়া নৃত্য শুরু করে।
এমনি এক নিদ্রাহীন রজনীতে হরিশঙ্কর শয্যায় টিঁকিতে না পারিয়া বাহিরের খোলা আকাশের তলে আসিয়া দাঁড়াইল। আকাশ অভিমুখে চাহিয়া জানা-অজানা সর্বপ্রকার দেবতার উদ্দেশ্যে পরীক্ষা বৈতরণী পার করিয়া দিবার জন্য আকুল প্রার্থনা নিবেদন করিতে লাগিল। দৈবযোগে সেসময় এক পরোপকারী ব্রহ্মদৈত্য আকাশপথে ভ্রমণ করিতেছিলেন। হরিশঙ্কর তাঁহার নজরে পড়িয়া গেল।
ব্রহ্মদৈত্যটি তাঁহার পূর্বজীবনে গণিতশাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন। খোদ কে সি নাগের কাছে অঙ্ক শিখিয়াছেন, মনুষ্য-জীবনে ছাত্র ঠেঙ্গাইয়া সুনাম ও দুর্নাম দুইই কুড়াইয়াছেন।   চৌবাচ্চা হইতে নলযোগে জল ঢোকা ও বাহির হইবার হিসাব তাঁহার কাছে জলের মতোই সোজা। এ হেন গণিতজ্ঞ ভূতপ্রবর হরিশঙ্করের বিলাপ শুনিয়া তাহার সামনে আবির্ভূত হইলেন।
হরিশঙ্কর প্রথমটায় ঘাবড়াইয়াছিল। কিন্তু তাহার উপস্থিত বুদ্ধির কোনো অভাব ছিল না। যত গোল বাধিত অঙ্ক কষিতে বসিলে। সে চোখ পিটপিট করিয়া সামনের অপরূপ আবির্ভাবটিকে একটু মাপিয়া লইলো। লম্বা, সিড়িঙ্গে চেহারা, গলায় ফুটফুটে সাদা উপবীত, হরিশঙ্কর বুঝিল ইনি ব্রহ্মদৈত্য না হইয়া যান না। হরিশঙ্করের মামার বাড়ী কিঞ্চিৎ সাহিত্যরসিক ছিল। বাড়ীতে খুঁজিলে দুই-একখানা পুরাতন পূজাবার্ষিকী পাওয়া যাইত এবং তাহাতে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখনীতে ভূতের গল্পও থাকিত। পাঠ্যবইয়ের বাহিরে অপাঠ্য রসদগুলি আমাদের হরিশঙ্করের সর্বদাই প্রিয়। তাই তাহার অজানা ছিল না বুরুন নামে এক অঙ্কে তেরো পাওয়া ছাত্র কী করিয়া ভূতের কৃপায় একশো পাইয়াছিল। সে মনে মনে ভাবিল, ‘একবার পরখ করিয়া দেখিতে হয়।‘
ব্রহ্মদৈত্য খুবই সহানুভূতির সহিত কথা শুরু করিলেন, “কী বাবা, অঙ্ক নিয়ে সমস্যা?”
হরিশঙ্কর পাল্টা প্রশ্ন করিল, “তা তো বটে কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?”
ব্রহ্মদৈত্য হাসিয়া কহিলেন, “আমাদের Zানতি হয়, আকাশপথে যাচ্ছিলুম, তা দেখলুম তোমার চোখে ঘুম নেই।“
হরিশঙ্কর এবার তেরিয়া জবাব দিল, “তা না থাকলেই বা আপনার কী? আমি তো আপনার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে যাইনি?”
ভূতসমাজে মনুষ্যজাতির প্রতি সহানুভূতির অভাব নাই। ব্রহ্মদৈত্য ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “আহা, চটো কেন? চটো কেন? আমি কি তাই বললুম নাকি? আমার ঘুমে তুমি ব্যাঘাত ঘটাবেই বা কেন? আমি বলছি কী, আমি তোমায় সাহায্য করতে চাই।“
হরিশঙ্কর দেখিল, এ তো তাহার পড়া গল্পের সঙ্গে মিলিয়া যাইতেছে! অশরীরীগণ তাহা হইলে প্রায়ই মনুষ্যজাতিকে অংকে সাহায্য করিয়া থাকেন! সে এবার পুরোদস্তুর ইন্টারভিউ লইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া কহিল, “তাহলে আগে বলুন দেখি আপনার বিদ্যার দৌড় ঠিক কতটা?”
ব্রহ্মদৈত্য তাঁহার অঙ্ক লইয়া যাবতীয় ডিগ্রী, সার্টিফিকেট ইত্যাদির হিসাব দাখিল করিলেন। হরিশঙ্কর তাহাতে খুব যে সন্তুষ্ট হইলো এমন নহে। সে অতঃপর জানিতে চাহিল ব্রহ্মদৈত্যের স্কুল-ছাত্র পড়াইবার অভিজ্ঞতা আছে কিনা। ব্রহ্মদৈত্য তাঁহার কেশবিরল মস্তক চুলকাইলেন। জীবিতাবস্থায় তিনি কলেজে গণিতশাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন, স্কুলের ছাত্র পড়াইবার সুযোগ কখনো হয় নাই। সে কথা বলিতেই হরিশঙ্কর সজোরে ঘাড় নাড়িল, “নাঃ, আপনাকে দিয়ে হবে না।“
ব্রহ্মদৈত্য ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন, তীরে আসিয়া তরী বুঝি ডুবিয়া যায়, “সে কী বাবা? কেন? হবে না কেন?”
হরিশঙ্কর বলিল, “টিউশন না পড়ালে কেউ কখনো অঙ্ক শেখাতে পারে? এই আমাদের অঙ্ক স্যার  তারাপদবাবুর কথাই ধরুন না কেন। তিনি ব্যাচ কে ব্যাচ অঙ্ক করান, সকাল সাতটা থেকে দশটা, তারপর ইস্কুলটা খানিক জিরোবার জায়গা, আমাদের ক্লাসে এসে একটু ঘুমিয়ে নেন। আমাদের বলা থাকে যেন গোল না করি। তা আমরা লক্ষ্মীছেলে, ঐসময় কাটাকুটি খেলি, গোলমাল করি না। ইস্কুলের পর আবার তো স্যারের অঙ্কর ব্যাচ শুরু হবে, তাই একটু ঘুমোতে না পারলে স্যার বাঁচেন কী করে? পারবেন আপনি দিনে এমন আট-দশটা অঙ্কের ব্যাচ পড়াতে? পড়িয়েছেন তো কলেজে, সে তো শুনেছি দিনে দুটো ক্লাস – হুঁহ!”
ব্রহ্মদৈত্য কাকুতিমিনতি করিয়া বলিলেন, “তুমি আমাকে একবার সুযোগ দিয়ে দেখো, কথা দিচ্ছি - তোমায় অঙ্কে একশো পাওয়াবোই। যদি না পারি তাহলে আমার ব্রহ্মদৈত্য নাম তুমি পাল্টে রেখো।“
হরিশঙ্কর নিমরাজী হইল। দেখাই যাক না ব্রহ্মদৈত্যের এলেম কত দূর। সে বলিল, “ঠিক আছে, তাহলে কাল থেকেই শুরু করুন। এইরকম রাতের বেলায়। আমি বইখাতা নিয়ে পা টিপে টিপে বাইরে বেরিয়ে আসবো'খন, কেউ টেরটি পাবে না।“
ব্রহ্মদৈত্য ভারী খুশি, মানুষের উপকার করিবার সুযোগ মিলিয়াছে।
গোল বাধিল প্রথম রাতেই। পাটিগণিতএর বই খোলা হইয়াছে, তৈলাক্ত বাঁশের উপর বাঁদর উঠানামা করিতেছে। হরিশঙ্কর ফস করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা, বাঁশের ওপর তেল ঢালবার কোনো মানে হয়? এই তো, মামা দুবেলা মামীকে বলে, ‘ওগো অতো তেল নষ্ট কোরো না, তেল কি বিনি পয়সায় আসে’?”
ব্রহ্মদৈত্য অনেক কষ্টে তাহাকে বুঝাইলেন, ইহা অঙ্ক মাত্র, বাস্তবে এমন ঘটিবে না।
দ্বিতীয় ধাক্কা আসিল রাম ও শ্যামের অঙ্কে। তাহারা তাহাদের বয়সের সমানুপাতে কয়েকটি মার্বেলের গুলি নিজেদের মধ্যে ভাগ করিতে চাহে। ব্রহ্মদৈত্য কিছুতেই রামের নাম মুখে আনিতে পারেন না, কেবলই বলেন, “ইয়ে।“ কঠিন অঙ্ক কঠিনতর হইয়া উঠে। ‘ইয়ে’ শুনিয়া শুনিয়া হরিশঙ্করের ধৈর্যচ্যুতি ঘটিল। সে বলিল, “কাল থেকে আর আপনার আসার দরকার নেই।“
ব্রহ্মদৈত্য এইবার সত্যি রাগিলেন। অর্বাচীন বালক বলে কী? ব্রহ্মতেজে মুখমন্ডল রক্তবর্ণ হইলো। রোগা সিড়িঙ্গে চেহারা ফুলিতে লাগিল। দেখিয়া হরিশঙ্করের মতো ডাকাবুকো ছেলেও ভয় পাইল। তবে মুখে প্রকাশ না করিয়া সে উল্টা চাপ দিল, “এহ, নিজে পড়াতে পারেন না আবার রাগ দেখানো হচ্ছে। তবে যে বলেছিলেন আমায় অঙ্কে একশো পাইয়ে দেবেন? আপনার তো দেখছি কথা ও কাজের একেবারেই মিল নেই!”
ব্রহ্মদৈত্য চটিয়া লাল, "সেদিনের ছোকরা, এতবড় তোর সাহস? আমার কথায় কাজে মিল নেই? প্রাণপাত করছি তোকে অঙ্ক শেখাতে, আর সেই তুইই কিনা আমায় গাল দিস? হতভাগা, বিচ্ছু! আজ তোরই একদিন কী আমারই একদিন!"
হরিশঙ্করের দুই কর্ণ লক্ষ্য করিয়া ব্রহ্মদৈত্য দুই হস্ত বাড়াইলেন। ভাঁটার ন্যায় দুই চক্ষু হইতে অগ্নি বর্ষিত হইতেছে। মস্তক তালগাছে ঠেকিয়াছে। ভীত হইয়াও হরিশঙ্কর বুদ্ধি হারায় নাই, শুষ্ককণ্ঠে কোনোমতে বলিল, “রাম-রাম-রাম-রাম।”
ব্রহ্মদৈত্য এইবার মারাত্মক বিষম খাইলেন। তাঁহার সর্বাঙ্গে কেহ যেন বিছুটির পাতা ঘষিয়া দিল। ছোকরা দুষ্টবুদ্ধিতে অতিশয় দড়। গণিতে মাথা না খেলিলেও সঠিক বুঝিয়াছে কোন নাম তাঁহার নিকট বিষবৎ। আর্তনাদ করিলেন, "ওরে থাম, থাম।"
হরিশঙ্কর মওকা পাইয়াছে, ভালোমানুষের মতো মুখ করিয়া বলিল, "মামা বলেন, বিপদে পড়লে রামনাম করতে। আমি মামার সব কথা শুনে চলি। তবে হ্যাঁ, আপনি যদি আমায় অঙ্কে একশো পাওয়াতে পারেন, তাহলে আর আমার ওই নাম করার দরকার নেই। নইলে কিন্তু আমি বলতেই থাকবো, রাম-রাম-রাম-রাম, রাম-রাম-রাম-রাম।"
ব্রহ্মদৈত্য চটিয়া লাল হইলেন, ‘রাম-রাম’ ধ্বনি তাঁহার কাছে পরমাণু বিস্ফোরণের শব্দ হইতেও ভয়াবহ। কিন্তু এক্ষণে তিনি নিজের ফাঁদে নিজেই পড়িয়াছেন। অতএব হরিশঙ্করকে “বিচ্ছু, বদমায়েশ, মিচকে শয়তান” ইত্যাদি বাছা বাছা কিছু বিশেষণ প্রয়োগ করিয়া গালি দিয়া জ্বালা জুড়াইলেন আর বলিলেন, কথার খেলাপ তিনি করিবেন না। হরিশঙ্কর কলম হাতে যখনই কোনো অঙ্ক কষিতে যাইবে, তিনি আসিয়া তাহার কলম চালনা করিয়া অঙ্কটি কষিয়া দিবেন। তাহা হইলেই হরিশঙ্করের অঙ্কে একশোয় একশো বরাবরের মতো নিশ্চিন্ত।
হরিশঙ্কর দেখিল, তাহার কার্যসিদ্ধি হইয়াছে। সে এইবার ঢিপ করিয়া ব্রহ্মদৈত্যকে একটি পেন্নাম ঠুকিল। তবে সেই সঙ্গে বলিতে ছাড়িল না, “দেখবেন কথার খেলাপ যেন না হয়। হলেই কিন্তু আমি আবার মামাভক্ত হনুমান হয়ে গিয়ে রামধুন গাইবো। মনে থাকে যেন - হ্যাঁ।"
ব্রহ্মদৈত্য নাসিকা-কর্ণ মলিয়া বলিলেন, “নিশ্চয় মনে থাকবে বাবা। এ শিক্ষা আমার ভূতজীবনে আর ভুলছি না, মানুষ থেকে দূরে থাকাই ভালো"

..................................

অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি