মজলো আমার মন ভ্রমরা
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
আশ্বিনমাস
শেষ হয়ে গেছে পক্ষকাল পূর্বেই। হিমভেজা কূয়াশার মিহি আবরণ একটু একটু করে
গঙ্গার ওপরে জড়ো হয়ে এক ভাব তন্ময়তার সৃষ্টি করেছে। পূর্বাকাশের রক্তিমাভায়
একটি দিবসের নবোদয় মুহূর্তটি যেন উন্মুখ হয়ে আছে।
মধ্যমাকৃতির
সুগৌর এক যুবাপুরুষ আপাতত গঙ্গার ঘাটের অভিমুখী। বেশ কিছুদিন হল নিশাকালের
সুষুপ্তিতে তিনি আগ্রহ হারিয়েছেন। আজকাল প্রায়সই তাঁর মধ্যরাত্রি
অতিক্রান্ত হয় স্বহস্তে রচিত পঞ্চমুন্ডির আসনে বিল্বতলায়।
বিস্ময়ের
ব্যাপার এই যে তিনি সাধক যেমন, তেমন পদগীতিকারও। ব্রহ্মময়ীর এই সন্তানটির
স্বকন্ঠে মাতৃনামের গীতিসুষমায় বঙ্গদেশ সুরভিত। এব্যাপারে তাঁর একটি সঙ্গীও
আছে তার নাম আজু গোঁসাই। গানের সঙ্গে সঙ্গে সে তার শ্রীখোলটিকেও যোগ্য
সঙ্গত করে। মাতৃনামের সুরধ্বনী যখন তাঁর কন্ঠে আসে তখন সেই সুধায় মাতোয়ারা
হয়ে যান স্বয়ং তিনিও।
সন্ন্যাস
তিনি গ্রহণ করেননি বটে তবু কাষায় বস্ত্র ও একটি বহির্বাস কেবল তাঁর
অনুষঙ্গ। এঁর জায়াটির এই মহেশ্বরপ্রতীম আপনভোলা মানুষটিকে নিয়ে অনুযোগহীন
সপ্রেম গৃহস্থালি। তিনটি কন্যাসন্তানের সর্বকনিষ্ঠটির নাম ব্রহ্মময়ী।সাধকের
সিদ্ধিলাভ আর সন্তানটির জন্মের সমাপতনই এর কারণ বলা যেতে পারে।
গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে প্রসাদ জলে নামেন পূর্বাস্য হয়ে,
" ডুব দে রে মন কালী ব’লে।
হৃদি-রত্নাকরের অগাধ জলে,
ডুব দে রে মন কালী ব’লে..."
ধীরে ধীরে অরুণরাগে সূর্যোদয় ঘটে।
আহা!
মন ভ্রমরা শ্যামাপদে যদি মজে থাকে তবে কেমন সদারঙ্গে বিভোর থেকেই মহামায়ার
পদধ্বনি হৃদিকন্দরে শ্রবণ করা যায়! তিনি ও তাঁর মাতৃকা ব্রহ্মময়ী যেন
অভিন্ন। বাল্যের পাঠশালায় শেখা অন্যসকল বর্ণমালা বিস্মৃত হয়ে শুধু 'কালী'
শব্দের 'ক' বর্ণটিতেই আজীবন বিভোর তিনি। পরিহাসপ্রিয় প্রসাদ নিজেকে বলেন
'কালীর বেটা' !
আর কয়েকদিন
পরই দীপাণ্বিতা অমানিশা। মাতৃআরাধনার জোগাড় করতে পত্নী সর্বাণীর সাহায্য
প্রয়োজন। মাতৃমূর্তিটির নির্মাণে তিনি স্বয়ং আর কুম্ভকার পল্লীর হরিরামকে
সংবাদ দিলেই বাকি কাজ হয়ে যাবে। সর্বাণী অন্নভোগ প্রস্তুতিতে স্বয়ং
অন্নপূর্ণা। ইদানীং অন্নভোগ সামান্য হলেও আয়োজন করা এখন আর কঠিন নয়।
রাজানুগ্রহে কয়েকবিঘা দেবত্র ধানজমিতেই এই খাস চালের কৃষিকর্ম হয়ে থাকে।
হরিরাম বেলায় এসে দন্ডবৎ করে। কবিপত্নী তৎক্ষণাৎ অতিথি সেবায় বাতাসা আর জলের ঘটিটি এগিয়ে দেন।
এই
গৃহে সবার অবারিত দ্বার। হরিরাম জানায় যে আজ-কালের মধ্যেই মূর্তির
কাঠামোটি বেঁধে একমেটে প্রলেপটি সমাপ্ত করে দেবে বিনামূল্যেই। তারপর সেই
অর্ধসমাপ্ত দেবীমূর্তি সাধক-কবির হাতে চিন্ময়ী হয়ে উঠবেন ধীরে ধীরে। প্রসাদ
শুনে প্রফুল্ল হয়ে ওঠেন।
কাচকী
মাছ, তিন্তিরির টক আর শালীধানের সামান্য অন্নপাক দিয়ে দ্বিপ্রাহিক আহার
সারেন প্রসাদ। আহারান্তে গৃহের অন্যান্য সব কাজ সেরে, সন্তানগুলিকে
দিবানিদ্রায় রেখে, কবিগৃহিণী অবশেষে আসেন পতি সন্নিকটে। সর্বাণী
শ্যামলবরণী। মাথায় মেঘবরণ একঢাল চুল। আভরণহীন হলেও একটি শান্ত মুখশ্রী তার,
সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সুগভীর আয়ত চক্ষুদ্বয়। প্রসাদের হাতে স্বহস্তে রচিত
তাম্বুলগুলি নিবেদন করতে যেতেই সবেগে প্রসাদ তাকে নিজ বক্ষে চেপে ধরেন। এই
নারীটি তার সিদ্ধিদ্বার উন্মুক্ত করে না দিলে কুন্ডলিনীর পরম জাগৃতি ও
আসঙ্গ ব্রহ্মস্বাদ অধরাই রয়ে যেত। বিপরীতবিহারে প্রসাদ গ্রহণ করতে থাকেন
সহস্রার কমলের পরম উন্মেষের ঐশী আনন্দ।
মূর্তি
নির্মাণ প্রায় পরিশেষের পথে। ধনত্রয়োদশী তিথিতে প্রসাদ মূর্তির চক্ষুদান
অঙ্কন করলেন। কি জীবন্ত দেখাচ্ছে তাঁর ব্রহ্মময়ীকে এবার। সন্তানদের ক্রোড়ে
বসিয়ে তিনি উচ্চস্বরে গেয়ে ওঠেন,
"আমি তাই কালোরূপ ভালোবাসি,
জগ-মন মজিলি এলোকেশী।
শ্যামা মন মজিলি এলোকেশী, ভালোবাসি"
সর্বাণী
জানেন আগামী তিনটি দিবস ও রজনী পতিদেবটিকে চোখের নাগালে পাওয়ার সম্ভাবনা
কম। মাতৃনামের জোয়ারে তিনি নিজে ভাসবেন আবার ভাসাবেনও।
মহাপূজার
রাত্রিটি অবশেষে আগত। প্রসাদের পূজায় গীতগুলিই মন্ত্রের মত। তবুও
তন্ত্রোক্ত পদ্ধতিতে করন্যাস,অঙ্গন্যাস প্রভৃতি উপাচার মান্য করে তিনি
বীজমন্ত্র জপ করেন। দেবীঘট স্হাপনের পূর্বে শুদ্ধির মন্ত্র উচ্চারিত হয়
সাধক -কবির মন্দ্র স্বরে,
"গঙ্গাদ্যাঃ
সরিতঃ সর্ব্বাঃ সরাংসি জলদা নদাঃ। হ্রদাঃ প্রস্রবণাঃ পুণ্যাঃ
স্বর্গপাতালভুগতাঃ। সর্ব্বতীর্থানি পুণ্যানি ঘটে কুর্ব্বন্তু সন্নিধিম্॥"
জবাপুষ্প
আর বিল্বপত্রের অপরূপ সাজে মাতৃমূর্তি যেন প্রকৃতই চিন্ময়ীস্বরূপীনী।
প্রসাদ সন্ধ্যাকাল থেকেই কিঞ্চিৎ কারণ পানে ঢলোঢলো। মাতৃআরাধনার
জন্য
নির্বাচিত সর্বশ্রেষ্ঠ গীতগুলি আজ তাঁর কন্ঠে উচ্চকিত। আজু গোঁসাইএর হাতেও
আজ কালের মন্দিরার মত তার শ্রীখোলটি সঙ্গতে রত। কবি আর সাধকের মিলনে রচনা
হয়েছে যুগান্তকারী ভাবাবেশের।
" দেহের মধ্যে সুজন যে জন
তার ঘরেতে ঘর করেছি,
দেহের মধ্যে সুজন যে জন
তার ঘরেতে ঘর করেছি,
এবার শমন এলে হৃদয় খুলে
দেখাব ভেবে রেখেছি,
অভয় পদে প্রাণ সঁপেছি.."
সর্বাণীর
সর্বদেহ রোমাঞ্চিত হয়। প্রসাদ যেন একটু অধিক ভাববিহ্বল আজ, সেকি শুধুই
কারণানন্দের জন্য? মৃৎপাত্র করে সে অন্নভোগ অার পাঁচ রকম ভাজা সাজিয়ে আনে
সঙ্গে পরমান্ন। প্রসাদ টের পান কুন্ডলিনীর জাগৃতি, ক্রমশ ব্রহ্মসারাৎসার
জগতের দ্বার সুষুম্নাপথে উন্মোচিত হতে থাকে।
পূজা
সমাপন হয় মধ্যরাত্রি পার করেই। তারপর সপরিবারে দেবীমূর্তিকে প্রণাম করে
উঠোনে আসন বিছিয়ে অন্নভোগ সেবায় বসেন সাধক-কবি। সঙ্গে আজু আর চর্মকার
বলরাম এরা প্রসাদের নন্দী ভৃঙ্গী স্বরূপ। ভোজনান্তে একটি ভান্ডে সামান্য
কিছু ভোগ সংগ্রহ করে তিনি গৃহের পিছনে বাঁশবনের দিকে অগ্রসর হন। শিস্ দিয়ে
বিশেষ কাউকে যেন আহ্বান করেন প্রসাদ। মুহূর্তে দুটি শৃগাল অন্ধকারে
প্রোজ্জল দুটি চক্ষু মেলে সম্মুখে গোচর হয়। এদের নাম 'জয়া' আর 'বিজয়া'।
প্রসাদ শিবাভোগ শেষে গৃহে ফেরেন রাত্রির শেষভাগে।
এরপর
প্রসাদ যেন একটু আত্মমগ্ন হয়ে পড়েন । সুষুম্নাপথে সহস্রার পদ্মের দলগুলি
এখন পূর্ণবিকশিত। এই অবস্হায় বেশীক্ষণ স্হিতিতে অবস্হান করা
যায়না।কুটিরাভ্যন্তরে সর্বাণী ক্লান্ত দেহে সন্তানসহ ততোক্ষণে নিদ্রামগ্ন।
প্রসাদ তাঁর কুটিরটি বড় মমতায় প্রদক্ষিণ করেন একবার। তাঁর গৃহের আঙিনায়
সর্বদীপ্তিতে আজ ব্রহ্মময়ী বিরাজ করছেন। সে দিকে বেশীক্ষণ চেয়ে থাকলে মন
উন্মার্গগামী অবস্হা থেকে স্বাভাবিকভূমিতে অবতরণ করাও কঠিন হয়ে পড়ে। এরপর
বিল্বতলায় পঞ্চমুন্ডের আসনটিকে প্রণাম করলেন আভূমি নত হয়ে। কালী
কল্পতরুমূলে আজ তিনি ভ্রমণের জন্য ক্রমশ প্রস্তুত করছেন দেবতনুটিকে।
সূর্যোদয়ের
মুহূর্তে দর্পণে বিসর্জন করে মঙ্গলকলসের সূত্রটি ছিন্ন করে অঝোর ধারায়
প্লাবিত হন তিনি। ভববন্ধনটিও কি তবে ছিন্ন হবে এবার?
উলুধ্বনিতে মাতৃমূর্তি বরণ করে সর্বাণী। শিশুগুলি ফেনী বাতাসা আর চিনির মঠ মুখে করে এই কৃত্য দেখে বিস্ময়ের চোখে।
মাতৃকামূর্তি শিরোপরে স্হাপন করে প্রসাদ অগ্রবর্তী হন গঙ্গার তীরের অভিমুখে। সদ্যরচিত গীতটি এবার কন্ঠে ফেরে তাঁর,
" এমন দিন কি হবে মা তারা।
যবে তারা তারা তারা বলে তারা বেয়ে ধরবে ধারা।।"
সর্বাণী
দূয়ারপ্রান্ত থেকে অপসৃয়মান আলোকদ্যূতিটিকে মাতৃনামের ধারায় ভাসতে ভাসতে
অভীষ্টপথে চলে যেতে দেখেন। তার চোখের কোণে দুটি অশ্রুকণা সদ্য ঊষার
শিশিরবিন্দুর মতই।
গঙ্গাবক্ষে
তখন পূর্ণ জোয়ার। কুমারহট্টের এই ঘাটটি সাবর্ণগোত্রীয় রায়চৌধুরিদের
নির্মিত। একটি একটি করে সিঁড়ি পার হয়ে এক্ষণে ভরা গঙ্গায় নামেন সাধক -কবি।
জলের
মধ্যে স্রোতের টানটি আজ প্রবল। প্রসাদ নিশ্চিন্ত মনে ব্রহ্মময়ীর মূর্তিটি
বিসর্জন দিতে চলেছেন জলের মধ্যভাগে। গঙ্গোদকের পূণ্য স্পর্শে ক্রমেই
ব্রহ্মলীন হয়ে যাচ্ছেন তিনি। প্রথম দুটি ডুব দিয়ে সবে উঠলেন। সমগ্র
কৃষ্ণকায় শ্মশ্রুগুম্ফ ও বৃষস্কন্ধ স্পর্শকরা দীর্ঘ কুঞ্চিত কেশরাজি সিক্ত
এখন। তাঁর চক্ষুদুটিতে পরমপ্রশান্তির ছোঁয়া। তাঁর সাধের ব্রহ্মময়ীর
মূর্তিটি ভাসতে ভাসতে এবারে জলের গভীরে নিমজ্জিত হতে চলেছে। সহাস্য প্রসাদ
তপোভূমির উচ্চমার্গে আগেই প্রবেশ করেছেন রাত্রিযামে। ভববন্ধন খন্ডন করে
ভাবজগতে চিরবিলীন হবার পূর্বে তিনি শেষবার গেয়ে ওঠেন,
" তিলেক দাঁড়া ওরে শমন,
বদন ভ’রে মাকে ডাকি,
আমার বিপদকালে ব্রহ্মময়ী,
আসেন কি না আসেন দেখি "
অন্তিমডুবটির পর কালাকালের জলতরঙ্গে প্রসাদের জীবন ভেসে যায় মাতৃনামের বৈতরণীতে।
ধন্য কবি ! ধন্য তোমার ঐশী সাধনা।
..............................................
অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি