মলয় চ্যাটার্জী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
মলয় চ্যাটার্জী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

সুর সঙ্গম - মলয় চ্যাটার্জী

 
সুর সঙ্গম
মলয় চ্যাটার্জী 
 
 
            প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত পার্টিতে হৈ হুল্লোড় করার পর সায়ক ভেবেছিলো ঘুমের যেটুকু বাকি থাকবে সেটা ফ্লাইটেই পুষিয়ে নেবে | কিন্তু সকাল নটা পনেরোর এই ফ্লাইটে গুছিয়ে বসতে না বসতেই ঘুমের বদলে চিন্তা এলো ভিড় করে | বিজনেস ক্লাসে সে অর্থে কোনোই লোকজন নেই | যার মানে লখনৌ অবধি সায়ক নিশ্চিন্ত একেবারে | কোনও অটোগ্রাফের ঝামেলা থাকবেনা সেভাবে | শুধু ঝামেলা এখন এই চিন্তা | সেটা মনে হয় আগামী পরশুদিন পর্যন্তই থাকবে | ওইদিনই ফিরবে সায়ক | আসলে যাওয়াটারই বা দরকারটা যে কি , সেটাই এখনও বুঝে উঠতে পারছে না ও | 
 
            খুব ছোট বয়স থেকেই গান নিয়েই আছে সায়ক | হারমোনিয়াম নিয়ে সকাল হলেই বসে পরতো রেওয়াজে | পাড়ার ছোটোখাটো জলসাতে ডাকও পেতো নজরুল গীতি গাইবার জন্য | বিনা পয়সায় যদিও | অবশ্য মিষ্টির একটা প্যাকেট ঠিকই জুটতো | ছোটবেলা থেকেই সায়কের ঝোঁক ক্লাসিক্যালের দিকে | সেটাই মন দিয়ে শিখতে শিখতে বয়স যখন তেইশ হোলো , তখন একেবারে বলতে গেলে মনের খেয়ালেই নাম দিয়েছিলো অত্যন্ত নামজাদা এক টিভি চ্যানেলের বহুল প্রচারিত এক সংগীত প্রতিযোগিতায় | তাদের ভাষায় সেটা ছিল মিউজিক্যাল হান্ট | সেই শুরু সায়কের | সেই প্রতিযোগিতায় যদিও চতুর্থ হয়েই থামতে হয়েছিল , কিন্তু জাজ , গেস্ট জাজ আর আপামর দর্শকদের কাছে ততদিনে ক্লাসিকাল রকস্টার তকমাটা ও পেয়েই গেছে | গান যে শুধু কানে শোনার বিষয় না হয়ে চোখে দেখার বিষয়বস্তুও হতে পারে , সেটা তখন সায়কের বোঝা হয়ে গিয়েছে | সেই জাজদের আনুকূল্যেই তার পরে দুটো সিনেমায় একটা করে গান রেকর্ড করার সুযোগ এসেছিলো তার সামনে | তার মাঝেই একটা গান হয়েছিল পুরো সুপার ডুপার হিট | আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সায়ককে | এখন তো একটা গান রেকর্ড করে ইউ টিউবে দিয়ে দিলে, পরের দুদিনে আড়াই কি তিন লাখ ভিউয়ারের রিপোর্ট পায় ও | সিনেমার গান পিছু এখনই পাঁচলাখ নেয় , যদিও আসল রোজগারটা হয় স্টেজ শো করেই | প্রতি মাসেই খান দশ বারো শো লেগেই আছে , তার মাঝে বছরে দুতিনবার ফরেন ট্রিপ তো আছেই |
 
            সায়ক বুঝে গেছে , বয়স এখন ঊনত্রিশ | কামিয়ে নেওয়ার এটাই সময় | অতএব নাও কামিয়ে যতদিন পারো | এর পর নতুনদের জায়গা তো ছাড়তে হবেই | ততদিন এই গান সম্বল করেই ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স করে রাখতে হবে আকাশছোঁয়া |
 
            আর এই গান রেকর্ড করতে গিয়েই আলাপ হয়েছিল অলক ব্যানার্জি আর তার একমাত্র মেয়ে সুমির সাথে | ভদ্রলোক কলকাতায় একটা রেকর্ডিং কোম্পানির মালিক | এই মুহূর্তে পূর্ব ভারতে সবচেয়ে বড়ো রেকর্ডিং ষ্টুডিওটারও মালিক উনি | এর আগে সায়কের গোটা ছয়েক গান রেকর্ড হয়েছে ওনার ষ্টুডিও থেকে | বছর পঞ্চান্নর এই ভদ্রলোকের মেয়ে সুমির সাথে যে সায়কের এখন জোরকদমে প্রেম চলছে , সেটা আর কারও অজানা নেই এখন | ফিল্মি ম্যাগাজিন আর টিভি চ্যানেলের দৌলতে সবাই এটাও জেনে গেছে , সামনের বছরেই ওদের বিয়ে | এখন সায়ক ডাকে অলক আঙ্কেল বলে , কিন্তু সে ডাক বদলে পাপা হয়ে যাবে আর কয়েক মাস পরেই |
 
            সবই ঠিক চলছিল , বাদ সাধলো গত সপ্তাহের একটা রেকর্ডিং | ভৈরবীর ওপর তৈরী করা এই গানটা মিউজিক ডিরেক্টর আর অ্যারেঞ্জারের পছন্দ হলেও , অলক আঙ্কেলের আর কিছুতেই মন ভরে না | তিন মিনিট রেকর্ড হয় , আর উনি ভুরু কুঁচকিয়ে মাথা নেড়েই চলেন | শেষে ওনার ঘরে ডেকেই নিলেন সায়ককে |
-- সায়ক , তোমার কি মনে হচ্ছে যে সব ঠিকঠাক আছে | আই মিন ভৈরবী এভাবে না গেয়ে যদি অন্যভাবে গাওয়া যায় |
-- কিভাবে চাইছেন আঙ্কেল ?
-- উঁহু , আমার চাওয়াটা বড়ো কথা নয় | বড়ো কথা তোমার চাওয়াটা |
-- আমার তো বেশ তৈরীই লাগছে আঙ্কেল |
টেবিলের ওপর কিছুক্ষন আঙ্গুল বাজিয়ে বলে উঠলেন অলক ব্যানার্জি ,
-- এক কাজ করো , দিন তিন চারেকের জন্য তোমায় পাঠাই বরং একজনের কাছে | আমায় কিছু বলতে হবে না , তুমি নিজেই তাহলে তফাৎটা ধরতে পারবে |
মনে মনে যথেষ্ট অপমানিত হলেও , এই মুহূর্তে আঙ্কেলকে না চটিয়ে হাতে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে | রাজত্ব আর রাজকন্যা একসাথে কেই বা হারাতে চায় |
সেই অলক আঙ্কেলই টিকিট করে দিয়েছেন লখনৌয়ের ফ্লাইটের |
কে নাকি এক ফিরদৌস বেগম আছে , তার কাছে গিয়েই নিয়ে আসতে হবে ভৈরবীর তালিম |
 
            একদম ঠিক সময়ে ফ্লাইট ল্যান্ড করার জন্য মোটামুটি বারোটার আগেই বের হতে পারলো সায়ক এয়ারপোর্ট থেকে | ভিআইপি লাউঞ্জ দিয়ে বেরিয়েছে , তাও সানগ্লাস আর টুপিটা পরেই আছে , বলা তো যায় না কোথায় কিভাবে চিনে ফেলে উপদ্রব শুরু করে ফ্যানেরা | কিন্তু বেরিয়েই মেজাজটা গেলো গরম হয়ে | রহমত নামে যে ছেলেটা নিতে এসেছে সায়ককে , সে নিয়ে এসেছে একটা সাধারণ ফোর হুইলার | যাতে কিনা আবার এসিটাও চলেনা | আরও দুঃখের এটাই যে ,সে ব্যাটাচ্ছেলে চেনেই না সায়ককে | মনে মনে নিজের মার্সিডিজটা ভাবতে ভাবতে আর অলোক আঙ্কেলের শ্রাদ্ধ করতে করতে ও গাড়িতেই চেপে পরলো সায়ক |
গাড়ি কানপুর রোড হয়ে যখন ভিআইপি রোডে পরেছে , তখন একবার গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল এ গাড়ির ড্রাইভার ছেলেটাকে ..
-- রহতে কাঁহা হ্যায় এ ফিরদৌস বেগম ?
-- কৌন ... আম্মা ?
-- আম্মা মতলব ? তুমহারে মা জি হ্যায় কেয়া ?
-- আরে নেহি নেহি জনাব | হাম সব তো উনহে আম্মা পুকারতে হ্যায় |
আর বেশি কথা বাড়ায়নি ও | কিন্তু সে গাড়ি যখন জেল রোড , কুমার জগদীশ মার্গ হয়ে ফয়েজ-উল-জামান মসজিদের পিছনদিকে একটা দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাড়ালো , তখন পুরো আঁতকেই উঠলো সায়ক | এই পুরোনো তাপ্পি মারা বাড়িতেই থাকতে হবে নাকি ওকে ?
যদিও গাড়ি থেকে নামতেই অপার বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো যেন সায়কের জন্যই | ঘিয়ে রঙের সালোয়ার কামিজ আর মাথায় জরির ওড়না দেওয়া টকটকে ফর্সা আর অসাধারণ সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি বছর পঁচাত্তরের এক বৃদ্ধা এসে দাড়ালেন সামনে | তারপরই খোদ বাংলায় বলে উঠলেন ..
-- আইয়ে বেটা , রাস্তায় কোনও অসুবিধা হয়নি তো ?
-- আপনি বাঙালি ? মানে আপনিই ফিরদৌস বেগম ? ইয়ে , মতলব আপহি আম্মা হ্যায় কেয়া?
-- হাঁ বেটা | লেকিন আপ অন্দর তো আইয়ে পহেলে, গোসল করে খেয়ে নিয়ে থোড়া আরাম কর লিজিয়ে বেটা | উসকে বাদ বাতে হোঙ্গে |
স্নান সেরে দুপুরে খাওয়ার সময়েই খেয়াল করেছে সায়ক যে ভাত ডালের সাথে তিন রকমের মাছ আছে পাতে | মনে হয় বাঙালি ছেলের যাতে মাছ ছাড়া খেতে কষ্ট না হয় তার জন্যই এই ব্যবস্থা | তার ওপর অলক আঙ্কেল নিশ্চয়ই বলেই পাঠিয়েছেন এদের যে কাকে পাঠাচ্ছেন তিনি | খাতির তো মনে হচ্ছে সেই জন্যেই হচ্ছে |
 
        দোতালার যে ঘরে সায়কের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে , সেটা মোটামুটি ভাবে বেশ পরিষ্কার হলেও ঘরে ঢোকার সময়েই বোঝা গিয়েছিলো যে এঘরে কোনও এসি নেই | আর শুধু এঘরে কেন , গোটা বাড়িটাতেই তো এসির চিহ্নমাত্র নেই | এই দোতালা বাড়িটাতে ওই বৃদ্ধা তার স্বামী নিয়ে থাকে | যে স্বামীর নামও জেনেছে ও , বশির আহমেদ | সেও এক আশি বছরের বুড়ো | ফেজটুপি পরা সে বুড়োকে দেখতে এমন কিছু না হলেও তার মুখে যদিও হাসি একটা লেগেই আছে সবসময় | কিন্তু অতশত এখন ভেবেও আর লাভ বিশেষ নেই | খেয়ে এসে সে ঘরের খাটের ওপরেই শুয়ে পরলো সায়ক |
বিকালে চায়ের পর নিজের ঘরে ডাকলেন ফিরদৌস বেগম |
-- আইয়ে বেটা , অব শুনাইয়ে আপকা ভৈরবী |
এঘরে পা দিয়েই সায়ক দেখে নিয়েছে ঘরের কোণে দাড় করানো তানপুরাটাকে | মানে এই বৃদ্ধা যে কোনও এককালে গানটান করতেন সেটা বোঝাই যায় | কিন্তু আজকের দিনে মিউজিক যে কত মডার্ন হয়ে গেছে তা ইনি জানবেন কিভাবে | খাটের একপাশে বসেছেন তিনি , আর একপাশেই বসলো সায়ক | সোজাসুজিই প্রশ্ন করলো ...
-- একটা রাগকে কত রকম ভাবে গাওয়া যায় সে সম্মন্ধে আইডিয়া আছে কিছু আপনার ?
-- আরে বেটা , আমাকে আম্মাই বলে ডাকা হোক আর মা বলেই ডাকা হোক , মেরা কোই বদলাঁও আয়েগি কেয়া ?
-- ফিরভি ...
-- নেহি বেটা , কোই তকলিফ নেহি হোগি | এক বাত কহিয়ে বেটা , আপ এইসেহি গায়েঙ্গে ইয়া তবলেকে সাথ গায়েঙ্গে |
-- তবলা !!! আছে এখানে ? আর আমার সাথে সঙ্গত করার মতো তবলচি পাওয়া যাবে এখানে?
-- তবলা হ্যায় বেটা | পর তবলে পর যো বয়েঠেঙ্গে উনকা কাবলিয়ত আপ জ্যায়সে কলাকারকে সামনে শায়দ কম হো জায়েঙ্গে | থোড়া রুখ যাইয়ে , ম্যায় বুলাতি হুঁ উনহে |
একটু পরেই বৃদ্ধা ডেকে আনলেন তার স্বামী বশির আহমেদকে | নিজেই বললেন ..
-- লিজিয়ে , বাচ্চে কো থোড়া রহম তো কিজিয়ে|
রহম !!!!! আঁতকে উঠলো সায়ক | এই বুড়োটা তার সাথে সঙ্গত করবে কি , এর তো নিজেরই মনে হচ্ছে হাত কাঁপে বয়সের জন্য | আর তাকেই কিনা বলা হচ্ছে রহম করার জন্য | আজ এই দুই বুড়োবুড়িকে বোঝাতেই হবে যে গান জিনিসটা হেলাফেলার বস্তু না |
ততক্ষনে আম্মার খাটের তলা থেকে হারমোনিয়াম তবলা সবই বেরিয়েছে | খাটের ওপরে হারমোনিয়াম নিয়ে বসলো সায়ক | শুধু বশির মিঞা কিছুতেই খাটে উঠলেন না | খালি বলেন ...
-- আরে নেহি নেহি ... আপ ইৎনে বড়ে কলাকার হ্যায় , আপকো সাথ এক উঁচাই পে হাম ক্যায়সে বয়ঠেঙ্গে |
 
            যে গান রেকর্ড করার কথা ছিল সেই , "তেরে নয়না পে মর যাঁওয়া সারি জিন্দেগী " গানটাই ধরলো সায়ক | মিনিট কুড়ি পর যখন হারমোনিয়াম বন্ধ করলো তার মাঝেই দুবার ভৈরবীর পর্দা ছুঁয়ে তারানা শেষ করেছে , আর খুব আশ্চর্য্যের সাথে খেয়াল করেছে যে দুবারই ওই বুড়ো বশির আহমেদ সমে ফিরেছে ধা তেরেকেটে ধা-এর তিরকিট পুরো সম্পূর্ণ করে | নাঃ , মানতেই হবে যে বুড়ো তবলাটা ভালোই শিখেছিল এককালে |
এবার মুখ খুললেন আম্মা |
-- হাঁ বেটা , ক্যায়সা লাগা আপকো |
-- আজব ব্যাপার , ও তো আপলোগ কহেঙ্গে |
-- ঠিক হ্যায় বেটা , ওহ সব বোলনা বাদ মে | পহেলে এক অউর কাম হো যায়ে | মিঞাসাব , আপ জরা রহমতকো বুলাইয়ে না |
মিঞা গেলেন রহমতকে ডাকতে | রহমত এলে আম্মা বললেন ..
-- রহমত বেটা , তেরা ঘরসে কাগজ অউর রং কা বক্সা লা তো জরা |
হচ্ছেটা কি এসব ? এখন কি এই বুড়ি ওকে এঁকে এঁকে ভৈরবী বোঝাবে নাকি ! নেহাৎ গোটা ব্যাপারটায় অলক আঙ্কেল জড়িয়ে আছে , না হলে কে আর এই আপদদের সহ্য করতো |
সে কাগজ আর রঙের বাক্স এলো একটু পরেই | আম্মা তাকালেন সায়কের দিকে |
-- লিজিয়ে বেটা , আপকো দিল অউর দিমাগ মে যো ভৈরবী হ্যায় , উসকা তসবির বনাইয়ে |
চ্যাংড়ামিরও একটা লিমিট থাকা উচিত | কলকাতায় ফিরেই রিপোর্ট করতে হবে আঙ্কেলকে |
-- কেয়া সোচ রহা হ্যায় বেটা ? পরশু তো আপ চলে যায়েঙ্গে | উসসে পহেলে থোড়া ইস বুড়িয়া বাত শুন লিজিয়ে |
আম্মার কথায় কাগজ আর রং নিয়ে বসে সায়ক | আঁকা যদিও শেখেনি , কিন্তু ভৈরবী যে ভোরের রাগ এই জানার ওপর ভিত্তি করেই ভোর আঁকতে শুরু করে | সে আঁকা শেষ হলে প্রথমে দেখেন আম্মা , তারপর নজর বোলান ওই বশির আহমেদ | মাথা নাড়া শুরু হয় দুজনেরই |
আম্মাই মুখ খোলেন প্রথমে |
-- আজ রাত কুছ নেহি , কাল সুরয নিকালনেসে পহলে আপ চলেঙ্গে মেরা সাথ |
-- কাঁহা ?
-- উপর |
-- মতলব ?
কিছু আর বলেন না আম্মা | মৃদু হেসে রাতের খাবার তৈরী করার জন্য বেরিয়ে যান ঘর থেকে|
 
            সে রাতের খাওয়ার পর ঘুমটা বেশ জব্বরই হচ্ছিলো , কিন্তু আম্মার ডাকে ধড়ফড় করে উঠে সায়ক দেখে ঘড়িতে মাত্র সাড়ে তিনটে | ওনার কথামতোই প্রাতঃকৃত্য সেরে উঠে আসে ছাতে | ততক্ষনে পাশের মসজিদ থেকে শুরু হয়েছে ফযরের নামাজের আজান | চারিদিক অন্ধকারের মাঝে আম্মা বসে আছেন একটা চাটাইয়ের ওপর | তারই একপাশে বসতে বলেন সায়ককে | আম্মার হাতে গতকালের সেই ভৈরবী আঁকা ছবি|
হালকা , খুবই হালকা একটা আলো যেন ফুটছে আস্তে আস্তে | যেন ভারি অনিচ্ছায় | আধো ভোরের সেই আবছায়া আলোয় সেই ছবি এবার ধরলেন আম্মা সায়কের সামনে |
-- দেখ বেটা , ইয়ে তেরা ভৈরবী | অউর ওহ আশমান পে ভৈরবী নিকাল রহা হ্যায় |
প্রথমেই চমকে ওঠে সায়ক | গতকাল থেকে এই প্রথমবার আম্মা তাকে আপনি বলা ছেড়ে তুই বলে সম্বোধন করলেন | এবার ভালোভাবে নিজের আঁকা ছবির দিকেই তাকায় সায়ক |
এ কি করেছে সে | তার ছবিতে রঙের এতো প্রাচুর্য্য কেন | এতো মনে হচ্ছে বেনারসি কাপড়ে তৈরী ধুতি পরিহিত আর মহামূল্যবান অলংকারে ভূষিত হয়ে পূজা দিতে চলেছে কোনও পূজারী |
যেখানে ভগবান গৌণ | মুখ্য শুধু প্রাচুর্য্য |
সম্বিৎ ফেরে আম্মার কণ্ঠে
"সুমিরন করলে মেরে মন
তেরে বিতি যাতি উমর হরি নাম বিনা ...."
ভৈরবীতে ভজন ধরেছেন আম্মা |
সোনা যেন গলে গলে পরছে তার কণ্ঠ বেয়ে | যেন অন্ধকার কাটিয়ে রাগ ভৈরবী নিজেই আসছেন সায়কের সামনে , আম্মার রূপ ধরে |
"কূপ নির বিনু ... ধেনু চির বিনু
ধরতি মেঘ বিনু
যেয়সে তরভর ফল বিন হিনা
তেয়সে প্রাণী হরি নাম বিনা ...... "
ইশারা করেন আম্মা সায়ককে ...
-- গলা মিলা বেটা , ইয়ে ভজন সন্ত কবীর কা হ্যায় | বাদমে গুরু নানকজি নে ইসে আপনায়া
সরগম চলছে আম্মার |
নি সা গা মা ধা পা গা মা গা রে সা
গলা মেলায় সায়ক ...
সা নি ধা নি সা
সা রে গা মা
গা মা ধা পা
গা মা পা মা গা রে সা
"কাম ক্রোধ লোভ নিভারো
ছাড় দে অব সব সন্ত জনা
কহে নানক শাহ শুন ভক্তজনো
ইহা যুগ মে নহি কোহি আপনা "
শেষ হয়েছে ভজন | কাঁদছে সায়ক | এই প্রথম ভৈরবীর ছবি দেখলো সে | আম্মা হাত রাখলেন মাথায় |
-- চল বেটা, ঘর চল |
সেদিনটা পুরোই যেন মুহ্যমান হয়ে থাকলো সায়ক | বুঝতেই পারছে , এতদিন গান বলে ও যা জেনে এসেছে তা শুধু আড়ম্বর ছাড়া আর কিছুই নয় |
দুপুরে খেতেও পারেনি ভালো ভাবে | ওইভাবে ঝিম ধরা অবস্থাতেই কাটিয়েছে সারাদিন | এখন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে গেছে বেশ কিছুটা আগেই | দোতালার নির্দিষ্ট ঘরে ইশার নামাজ সারছেন বৃদ্ধ বশির আহমেদ |
হঠাৎই নাড়া খায় সায়ক |
রাগ বেহাগে ঠুমরি ধরেছেন আম্মা |
"হামসে নজরিয়া কাহে ফেরি বলমা ..... "
আহা হা হা ....
যখন পকড় ধরছেন ..
নিরেসা গামাপা গামাগা রেসা
সমস্ত স্বর যেন শুদ্ধ হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে গোটা বাড়িতে |
এই ভাবেই কি তৈরী হয় রাগ বেহাগের বিমূর্ত ছবি ...
নি সা গা মা গা পা মা' গা মা গা রে সা
পা নি সা
গা রে সা
সা মা গা পা
পা মা' গা মা গা রে সা
-- কেয়া সোচ রহা হ্যায় বেটা ?
নামাজ সেরে বেরিয়ে এসেছেন বশির আহমেদ |
-- সোচতা হুঁ কে উনহে আম্মা কহুঁ ইয়া মাতা সরস্বতী কহুঁ |
-- তুম বেটা সচমে নেহি জানতে হো তুমহারি আম্মাকি বারি মে |
-- নেহি ...
-- তো শুনো বেটা | যো তুমকো ভেজা ওহ অলক কে বুয়া হ্যায় বেগমসাহিবা |
-- মতলব ....
-- মতলব কুছ নেহি | মেরা সাথ সাদি কর লিয়ে , ইসলিয়ে উনকি আব্বা , যানিকি অলককে দাদাজী উনকে বেটাকো কসম দিলায়ে থা কে কভি রিস্তা না রাখনেকা | সাদিসে পহলে উনকি নাম থে কস্তুরী , অউর বাদ মে বন গয়ে ফিরদৌস |
-- অউর অলক আঙ্কেল ?
-- ওহ আতে হ্যায় ইধার | উনকা কহনা হ্যায় , কসম তো থে মেরে পাপাকো | ম্যায় কিঁউ না আয়ে ইধার |
-- অউর ইয়ে মাতা সরস্বতী মাফিক গলা কাঁহাসে মিলা আম্মাকো ?
-- কেয়া বাতাউ বেটা | ইস হিন্দুস্থানি গানে কে নূর থে ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাব | উনকে গান্ডাবন্ধ চেলা থে ওস্তাদ শরাফত হুসেন খাঁ সাব | তুমহারি আম্মা উনহিকা সাগির্দ থে | বেটি বুলাতে থে ওহ তুমহারি আম্মাকো |
-- কেয়া বোল রহে হ্যায় আপ ?
-- হাঁ বেটা , শায়দ তুম নজর কিয়ে হো , ম্যায় নামাজ পড়তা হুঁ | পর তুমহারি আম্মা সির্ফ সুর কে জড়িয়ে পয়গম্বর কো বুলাতে হ্যায় | নামাজ অউর পূজা মে কেয়া রাখখা হ্যায় বেটা | চাহে আল্লাহ , চাহে ভগবান , অগর সুর কি জড়িয়ে ওহ মিল যায়ে তো উসসে বড়ি বাত তো অউর কুছ নেহি বেটা |
-- মিঞাসাব , কুছ তো আপনে লিয়ে ভি রাখিয়ে |
রাগ বেহাগ দিয়েই পুজো অথবা নামাজ শেষ করে উঠে এসেছেন আম্মা |
-- আরে নেহি নেহি ...
-- কিঁউ , কিঁউ না বোলু ? শুনো বেটা , ইয়ে যো তুমহারে সাথ বেফজুল বাতে কর রহে হ্যায় , কুছ আপনে বারি মে বাতায়া কেয়া ?
-- নেহি তো ...
-- বেটা , হিন্দুস্থান কে তবলে নওয়াজ থে ওস্তাদ আহমেদ জান থেরকুয়া খান সাব | অউর এক জমানে মে ইয়ে মিঞাসাব উনকে গান্ডাবন্ধ চেলা থে পুরে দশ সাল |
সায়ক স্তম্ভিত | এ কাদের সামনে বসে আছে সে | একদিন আগেও যে অহংকার ছিল মনের মধ্যে , তা ইতিমধ্যেই নিঃশেষ হয়ে গেছে |
আম্মার ডাকে হুঁশ ফেরে সায়কের |
-- দের মত করনা বেটা | কাল তো তুঝে লওটনা হ্যায় |
নিজের স্মার্টফোনের দিকে হাত বাড়ায় সায়ক | একেবারে নির্দিষ্ট নম্বর টিপে কানে চেপে ধরে ফোন | ওপ্রান্তে তখন নিজের ফোন তুলে নিয়েছেন অলক ব্যানার্জী |
-- হ্যালো আঙ্কেল ...
-- হ্যাঁ সায়ক , বলো |
-- আঙ্কেল রেকর্ডিং ক্যানসেল করে দিন |
-- কেনোওওও ? এনি প্রবলেম ?
-- প্রবলেম কিছু না আঙ্কেল | যতদিন না সুর দিয়ে ছবি আঁকা শিখছি , ততদিন আর আম্মার পা ছাড়ছি না আমি |
বেশ কিছুক্ষন নিস্তব্ধতার পর বলেই ফেললেন অলক ব্যানার্জী ...
-- বেঁচে থাকো বাবা | লক্ষে অবিচল থাকো | তবে রেকর্ডিং ক্যানসেল হলেও তো বিয়ে আর ক্যানসেল করা যায় না | ওই অঘ্রানেই তোমার আর সুমির বিয়েটা হবে | ততদিন সুমির পিসিদিদা আর দাদামশাইয়ের কাছেই না হয় থাকো তুমি |
***************************

Malay Chatterjee



মালবকৌশিক - মলয় চ্যাটার্জী

 

মালবকৌশিক

 

মলয় চ্যাটার্জী 

 

    সকালের দিকে আচমকাই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর এখন আকাশ বেশ ঝকঝকে হয়ে উঠেছে । দূরে পূবদিকে যদিও কিছুটা মেঘের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে , কিন্তু তাতে যে এইমুহূর্তে বৃষ্টির কোনো আশঙ্কা নেই সেটা বলে দেওয়াই যায় । সময়টা চৈত্রের মাঝামাঝি হওয়ার কারণে দামোদরকে এখন সত্যিই মনে হচ্ছে যেন বিধবার সিঁথির মতো। সে নদের একেবারে মাঝবরাবর না চলে এই সুবৃহৎ গহনার নৌকাটি চলেছে কিছুটা দক্ষিণ দিকের পার ঘেঁষে । সূর্যদেবের মাথার ঠিক ওপরভাগে অবস্থান করতে এখনো প্রায় তিন দণ্ড দেরি আছে । এইসময়েই ছইয়ের ভিতর থেকে নৌকার সম্মুখভাগের পাটাতনে এসে দন্ডায়মান হলেন ত্রিলোক গোস্বামী । এদিকের পাটাতনে আর কারও আসার হুকুম নেই । এদিকটা  সম্পূর্ণভাবেই তার জন্য ছেড়ে রাখা হয়েছে । প্রথমেই গুন টানতে থাকা মাল্লার দিকে তাকিয়ে তারপর তিনি দৃষ্টিপাত করলেন ধীরলয়ে চলা দামোদরের দিকে। তারপর ছইয়ের ওপর দিয়ে তাকালেন নৌকার পিছনে হাল ধরে থাকা মাঝির দিকে । এ নৌকার সাথেই শক্ত করে বাঁধা তুলনায় অনেক ছোট এক বাছারি নৌকাও চলেছে ঢেউ ভেঙ্গে । সেদিকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলতে গিয়েও প্রথমে জিজ্ঞাসা করলেন ....

 

-- কি মনে হচ্ছে গো ? আজ সন্ধ্যার আগে পৌঁছাতে পারবো তো মশাগ্রামে ? 

মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে উত্তর দিলো মাঝি...

-- তা পৌঁছাবো ঠাকুর, আকাশ দেখে তো মনে হচ্ছে অসুবিধার কোনো কিছুই নেই।

 

পিছনের বাছারির গলুইতে বসা বছর তিরিশের লোকটির দিকে তাকিয়ে বললেন ত্রিলোক...

-- ওর যাতে অসুবিধা না হয় সেটাও দেখো তুমি। 

এই একটি গহনার নৌকাতেই আসা যেত সবাই মিলে; কিন্তু ও লোকটি যে.....

 

    এই তো ঠিক দুই দিন আগের ঘটনা। নিজগৃহে সংগীতশিক্ষা দিচ্ছিলেন ত্রিলোক। প্রৌঢ়ত্বে পা দেওয়া ত্রিলোকের নিবাস এক সময় বিষ্ণুপুরে থাকলেও বর্তমানে উনি নিজের আশ্রয়স্থল গড়ে নিয়েছেন দামোদরের এপারে গোপীনাথপুরে। বাসস্থান এখানে উঠিয়ে নিয়ে আসলেও শিষ্যের কোনো অভাব নেই ত্রিলোকের। এক সময় সমগ্র বিষ্ণুপুরেই সংগীতগুরু হিসাবে ওনার খ্যাতি ছিল গগনচুম্বী। এমনিতেও মল্ল রাজাদের গড় এই বিষ্ণুপুর চিরকালই সংগীতের কদর করে এসেছে। সে কদর অবশ্য আজও বর্তমান,কিন্তু প্রথমে ১৭৬৫ সনের দেওয়ানি লাভের পর বিষ্ণুপুর চলে যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। তারপর মারাঠা বর্গির আক্রমণ ও ১৭৭০ সালের বিভীষিকাময় মন্বন্তরের কারণে নিজগৌরব হারায় বিষ্ণুপুর। আর এই তো কয়েকবছর আগেই বাঁকুরাকে সদর এবং বিষ্ণুপুরকে পৃথক করে গঠিত হয়েছে পশ্চিম বর্ধমান জেলা। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণেই বিষ্ণুপুরের সংগীতজগৎ এখন টলোমলো। তাছাড়া যে কারণে বিষ্ণুপুরের সংগীতের এত খ্যাতি,সেই ধ্রুপদীসংগীতশৈলীতেও বর্তমান প্রজন্ম আর সেইভাবে যেন আকৃষ্ট হচ্ছে না। তারা এখন সংগীতে মনোরঞ্জনের দিকেই বেশি উৎসাহী। এর কারণ যদিও বুঝতে পারেন না ত্রিলোক গোস্বামী, কিন্তু তিনি এটা বোঝেন যে কালের সাথে সাথে , যুগের তালে ওনার নিজেকেও তাল মিলিয়ে চলতেই হবে। অতএব মূর্তির গায়ে অলঙ্করণ করার মত ওনাকেও শ্রোতার মনোরঞ্জনকারী সংগীত শিক্ষা দিতে হয় নিজের শিষ্যদের। 

এমনিতে মিঞা তানসেনের প্রত্যক্ষ বংশধর বাহাদুর খাঁয়ের সাথেই ধ্রুপদ এসেছিল বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের দরবারে। তবে ত্রিলোক গোস্বামীর নিজবংশমর্যাদাও কিছু কম নয়।১৬শতকের গোড়ায় বৃন্দাবনের গোস্বামীরা, শ্রীনিবাস, নরোত্তমদাস এবং শ্যামানন্দ নামে যে তিনজন বৈষ্ণব নেতাকে বিভিন্ন গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের জন্য একটিই সাধারণ ঈশ্বরতত্বের কাঠামো তৈরী আর প্রচারের উদ্দেশ্যে খেতুড়ির মহাসম্মেলনে পাঠিয়েছিলেন, তাদের মাঝে শ্যামানন্দ ছিলেন সহজাত গায়ক। তিনি এই সম্মেলনে বাংলার বৈষ্ণবসমাজে ধ্রুপদ গায়কীতে এক নতুন ধরনের ভক্তি সংগীতের সূচনা করেন। আর আজকের ত্রিলোক গোস্বামী সেই হলেন সেই শ্যামানন্দেরই বংশধর। 

 

    সংগীতগুরু হিসাবে ওনার খ্যাতি এখন ছড়িয়েছে বিষ্ণুপুর বাঁকুড়া ছাড়াও অন্যান্য জেলাগুলোতে। লোকে বলে "গান গেয়ে কিভাবে শ্রোতার মন জয় করা যায় সেটা শিখতে যদি চাও তো তিলোক গোঁসাইয়ের কাছে যাও।" 

 

    সেদিনও এক শিষ্যকে উনি শেখাচ্ছিলেন যে কিভাবে কোমল নি-র জায়গায় শুদ্ধ নি ব্যবহার করলে রাগ মালকোষ পরিণত হয় রাগ চন্দ্রকোষে। এই সময়েই সর্বক্ষণের সঙ্গী তরণী এসে দাঁড়ায় ওনার সম্মুখে। দ্বারের দিকে দেখিয়ে বলে ওঠে..

-- আজ্ঞে গোঁসাইঠাকুর, একজন আপনার দর্শন পাওয়ার জন্য এসেছেন। 

-- কে আবার এলো এই সময়ে। তুমি যাও তরণী,ওনাকে এই ঘরেই নিয়ে এসো।

বলা সত্ত্বেও তরণী তবুও ইতস্ততঃ করছে দেখে পুনরায় উনি জিজ্ঞাসা করলেন .....

-- কি হলো তরণী ? যাও...

-- আজ্ঞে ঠাকুর , লোকটি বিধর্মী। 

-- বিধর্মী ? সে কি ? কি নাম ? কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সে ? 

-- আজ্ঞে নাম বলেছে মুস্তাক আলি। আর এ গৃহের বাইরের রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে আছে। আর বলছে যে আপনার সাথে তার বড় দরকার। 

-- চলো তো দেখি। 

তাড়াতাড়ি গৃহের দ্বারে এসে দেখলেন ত্রিলোক যে একেবারেই মলিন বস্ত্র পরিহিত এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে দ্বারপ্রান্তে। ত্রিলোক গোস্বামীকে দেখে কপালে হাত ঠেকায় সে। মুখে বলে....

-- গোঁসাই ঠাকুর , এবার যে না গেলেই নয়। 

বড় আশ্চর্য্য হন ত্রিলোক। এই যুবক তাকে চিনলো কিভাবে ? আর কোথায় যাওয়ারই বা কথা বলছে এ। বলেন...

-- তুমি আমাকে চিনলে কিভাবে ? 

-- আজ্ঞে দামোদরের দুই কূলেই যে আপনার খ্যাতি বিরাজ করেছে। আপনাকে না চেনা তো অপরাধ ঠাকুর। 

-- তা ঠিক, কিন্তু কোথায় যাওয়ার কথা বলছো তুমি? 

-- আমাকে যে পাঠানো হয়েছেই ঠাকুর আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যিনি পাঠিয়েছেন, তিনি বলেও দিয়েছেন যে আপনি আসবেনই ওনার শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করতে। 

-- কার কথা বলছো তুমি ? আর যাবোটাই বা কোথায় ?

-- আজ্ঞে এখন আসছি সোমরাগিরি থেকে। তবে যিনি পাঠিয়েছেন তিনি বলেছেন যে গুপ্তিপাড়ার দরবেশ বললেই আপনি ঠিক চিনতে পারবেন। 

 

    সহসা কোনো অন্ধকার ঘরের দ্বার খুললে যেমন সে ঘরের অন্ধকারের ওপর বাইরের আবছা আলো এসে পড়ে, গুপ্তিপাড়ার নাম শুনে ত্রিলোকের অবস্থা হলো ঠিক সেইরকম। মনের কোণ থেকে যেন উঠে এলো শৈশবকাল। মনে পড়লো যে এই গুপ্তিপাড়াতেই জন্ম হয়েছিল ওনার। জন্মের পরের আট বছরও ওনার কেটেছিল এই গুপ্তিপাড়াতেই। সংগীতের প্রতি অমোঘ আকর্ষণে ওই শিশুকালেই সেইসময় তিনি শুনতে যেতেন স্থানীয় মন্দিরের ভজন গান। এইসময়েই গুপ্তিপাড়ায় এসে উপস্থিত হন এক সুফি সাধক। নাম মহম্মদ গোলাম দরবেশ। শুধুই সংগীতের মাধ্যমে তিনি ডাকতেন তার উপাস্যকে। রাগ মালকোষে যখন আকুল হয়ে গাইতেন "তেরে সামনে সব কো আনা পড়েগা মেরে মালিক " তখন যেন মনে হতো যে নিজের সবটুকু দিয়েই উনি ওনার মালিককে ডাকছেন। শিশু ত্রিলোক যেন ছায়াসঙ্গী হয়ে গিয়েছিল সেই দরবেশের। এমনকি ভাগ্যান্বেষণের জন্য ত্রিলোকের পিতা যখন যাত্রা করেন বিষ্ণুপুরের উদ্দেশ্যে , সেদিন ছোট্ট ত্রিলোক কেঁদে ভাসিয়েছিল তার দুচোখ। দরবেশকে কিছুতেই ছেড়ে যেতে চায়নি সে। শেষে ছোট্ট ত্রিলোকের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে আস্বস্ত করেন সেই দরবেশ,আর বলেন... 

-- শোচো মত বেটা, আভি তুম যাও। পর ইয়াদ রাখনা, ওয়াক্ত আনে সে তুমে ম্যায় বুলা লুঙ্গা। 

 

    বিষ্ণুপুরে এসেই ত্রিলোক শুরু করেন সংগীতের তালিম নিতে। এ ঘটনা আস্তে আস্তে মুছেও যায় তার মন থেকে। এরপর সংগীতগুরু হিসাবে খ্যাতির সাথে সাথে অতীতও যেন বিস্মৃতপ্রায় হয়ে যায় ধীরে ধীরে।

আজ এতদিন পরে সেই গুপ্তিপাড়া আর দরবেশের কথা শুনে হঠাৎই যেন ঝাঁকি খেলেন ত্রিলোক গোস্বামী। দরবেশ বলেছিলেন বটে যে সময় হলেই ডেকে নেবেন। কিন্তু কিসের সময় সেটা আর জানা হয়নি ওনার। কৌতূহলভরে এবার তাই প্রশ্ন করলেন উনি...

-- আর কিছু বলেননি উনি ? মানে এতদিন পর আমায় ঠিক কি প্রয়োজনে স্মরণ করছেন উনি? 

-- না গোঁসাইঠাকুর, উনি শুধু বলেছেন যে আপনাকে এইটুকুই বলতে। আর আপনাকে নাকি যেতে হবেই। 

 

    কেমন জানি বিহ্বল হয়ে পড়েন ত্রিলোক। হঠাৎই খেয়াল হয় যে বিধর্মী হলেও এই মুহূর্তে মুস্তাক আলি ওনার গৃহে অতিথি। তাড়াতাড়ি তরণীকে নির্দেশ দেন যে মুস্তাকের জন্য জল এবং আহার্য্যের ব্যবস্থা করতে। গৃহের অদূরেই এক কুটিরে থাকার ব্যবস্থাও করতে বলেন উনি। তারপর সেদিন এবং গতকাল প্রায় সারাদিনই চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন ত্রিলোক। খালি ভেবেছেন যে দরবেশের বলা ওই সময় কিসের ইঙ্গিত করছে। অবশেষে গতকাল বৈকালে মনস্থির করেই ফেলেন তিনি। তরণীকে বলেন যে ওনার যাত্রার উপযুক্ত নৌকার ব্যবস্থা করতে। বর্তমানে যেস্থলে আছেন দরবেশ , সেই সোমরাগরির দূরত্বও এই গোপীনাথপুর থেকে বড় কম নয়। পদব্রজে বা গরুর গাড়িতে এই দূরত্ব পার করা যায় ঠিকই , কিন্তু তা যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। এবং ত্রিলোক গোস্বামীর বর্তমান সামাজিক সম্মানের পরিপন্থীও বটে। সেই কারণেই স্থির হয়েছে যে নৌকাযাত্রায় মশাগ্রাম পর্যন্ত যাওয়ার পর সেখান থেকে গরুর গাড়িতে মেমারি,সেনের ডাঙ্গা হয়ে যাওয়া হবে সোমরাগরি। সেইমতই দামোদর বেয়ে এই সামনের গহনার নৌকায় চলেছেন ত্রিলোক, আর পিছনের বাছারিতে চলেছে মুস্তাক আলি। 

 

    সোমরাগিরির ভাঙাচোরা মসজিদে যখন পৌঁছলেন ত্রিলোক, তখন সন্ধ্যা হয় হয়। মসজিদের বাইরেই দেখলেন ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছেন এক বৃদ্ধ। পরনে শুধু মলিন পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি। দুধসাদা অবিন্যস্ত পক্ককেশ আর বুক পর্যন্ত ঢাকা দাড়ি হাওয়ায় উড়ছে। বলিরেখাময় মুখমন্ডলে যেন খেলা করে বেড়াচ্ছে স্বর্গীয় হাসি। শরীরে বয়স থাবা বসিয়েছে, যদিও শৈশবের দেখা গোলাম দরবেশকে চিনতে খুব একটা অসুবিধা হলো না ত্রিলোকের। কিন্তু এখন উনি আর সেই ছোটটি নেই, এখন সংগীতমহলে ওনার খ্যাতি অত্যন্ত বিশাল। তাই উচ্ছাস গোপন করে শান্তস্বরেই শুধোলেন....

-- শুধুমাত্র আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্যই এসেছি আমি। বলুন , কি আপনার শেষ ইচ্ছা ? 

বহুদিন বঙ্গদেশে থাকতে থাকতে বাংলা বলতে এখন আর কোনো অসুবিধা হয়না দরবেশের, তবে সামান্য উর্দুর টান যে রয়ে গেছে সেটা বোঝাই যায়। সেভাবেই বললেন তিনি...

-- হোবে বেটা, ওহ সোব হোবে। পর পহলে তুম আরাম করো। তুমহারি রহনে কে লিয়ে অলগসা জাগা কা ইন্তেজাম কিয়া হ্যায় বেটা। অউর খানে কা সব বন্দোবস্ত ভি ওহি পর হ্যায় বেটা। পর বেটা, খানা তুমাকেই পাকাতে হোবে। 

-- কিন্তু.....

-- নেহি বেটা, আজ আরাম করো। কাল বাত হোবে। 

 

    আবার ঘুরে মসজিদে ঢোকার আগে ত্রিলোকের সাথে আসা মুস্তাককে এবার ইঙ্গিত করেন তিনি ওনার থাকা খাওয়ার জায়গাটা দেখিয়ে দিতে। তাড়াতাড়ি মুস্তাক এবার এগিয়ে আসে সেই কাজ করতে। হতভম্ব ত্রিলোককে নিয়ে সে পৌঁছায় মসজিদের অনতিদূরেই এক জীর্ণ কুটিরের সামনে। মুখে শুধু বলে...

-- আসুন গোঁসাই, এখানেই আপনার থাকার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। 

--কিন্তু মুস্তাক.....

-- জানি গোঁসাই, সে চিন্তা করবেন না। এ ছিল এক ব্রাহ্মণেরই ঘর। বেশ কিছুদিন হলো তারা এখানকার ভিটে ছেড়ে নদী পেরিয়ে চলে গেছে নবদ্বীপে। আর আপনার আহারের জন্য যা যা আনা হয়েছে, তাতেও আমরা কেউ হাত লাগাইনি। সবই এখানকার এক হিন্দু ভাই নিয়ে এসে রেখেছেন। 

-- সে না হয় হলো, কিন্তু উনি কি বলার জন্য শুধু আমাকেই স্মরণ করেছেন সেটার বিষয়ে কি কিছু জানো তুমি ?

-- ক্ষমা করবেন গোঁসাইঠাকুর। ও ব্যাপারে যা বলার সেসব ওই ফকিরবাবাই বলবেন। এবার আমায় আজ্ঞা করুন। আমায় গিয়ে ওনার জন্য রাতের খাবার বানাতে হবে। 

চলে যায় মুস্তাক, আর ক্লান্ত অবসন্ন শরীর নিয়ে সেই কুটিরের ভিতর প্রবেশ করেন ত্রিলোক। রাতের খাবার বানাতে হবে এখন। তারপরেই আজকের মতো শরীরকে বিশ্রাম দেওয়ার পালা। 

 

    পরদিন প্রত্যুষেই নিদ্রা ভাঙে ত্রিলোকের। মসজিদ আর এই কুটিরের মাঝে ব্যবধান প্রায় সিকি মাইলের। চারপাশে কেমন জানি ঝুপসি হয়ে আছে বড় বড় গাছগুলো। তার মাঝেই আছে যদিও কয়েক জরাজীর্ণ গৃহ, তবে সেখানে যে কেউ বাস করেনা এখন সেটা বোঝাই যায়। মনে হয় এখানকার বাসিন্দারা সবাই ঘর ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি দিয়েছে পেটের তাগিদে। তবে অনতিদূরে দুএকঘর হিন্দুর বাসও যেন চোখে পড়লো ওনার। মনে মনে ভাবলেন যে তাদের মধ্যেই কেউ মনে হয় ওনার জন্য আহারের সামগ্রী রেখে গেছে এই কুটিরে। 

নিতান্ত অলসতা আর কৌতূহলের মাঝে সারাদিন কাটিয়ে যখন সন্ধ্যার পর সে কুটিরের দাওয়ায় বসে নিজের মনেই গুনগুন করে পুরবীর কলি গাইতে শুরু করেছেন ত্রিলোক, তখনই মুস্তাকের কাঁধে ভর দিয়ে সে কুটিরের সামনে এসে দাঁড়ালেন দরবেশ। ত্রিলোক কিছু বলার আগে নিজের থেকেই বলে উঠলেন..

-- আমি জানি বেটা, আমার ঘরে যেতে তোমার অসুবিধা আছে। কিন্তু তোমার ঘরে আসতে আমার তো কোনো অসুবিধা নেই। আমি কি এই দাওয়ায় বসবো বেটা ? 

 

    লজ্জায় ভারী সঙ্কুচিত হয়ে পড়েন এবার ত্রিলোক। বিধর্মীর ছোঁয়া খাবার উনি খান না একথা সঠিক। কিন্তু চার কুড়ি বয়স পার করা এক বৃদ্ধকে উনি ঘরের দাওয়ায় বসার অনুমতি দেবেন না, এ চিন্তাও যে বাতুলতা। বিশেষ করে এই গৃহে থাকার আয়োজনও যখন তিনিই করে দিয়েছেন। তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন...

-- সে কি কথা ! বসবেন না কেন ? আর তাছাড়া আমি তো আপনার কাছ থেকে ওই ইচ্ছা আর সময়ের কথা শোনার জন্যেই অপেক্ষা করছি। 

কোনোরকমে সেই দাওয়ায় বসলেন দরবেশ। তারপর প্রথমে মুস্তাককে বললেন যে ঘন্টাখানেক পর আবার ঘুরে আসতে। এবার ধীরস্বরে বলেন ত্রিলোককে...

-- হাঁ বেটা , অব শুনাও। 

-- কি শুনতে চাইছেন আপনি ? বলবেন তো আপনিই, শোনার জন্য তো আমিই বসে আছি। 

-- সে তো বলবোই বেটা। লেকিন পহলে তুম শুনাও। আজ ম্যায় তুমহারি গানা শুননে কে লিয়ে হি আয়ে হ্যায়।

-- বেশ বলুন কি গাইবো ? 

-- ওহি, ইঁহা আনেসে পহলে যো তুম গা রহে থে, ওহ মালকোষ শুননে কা মন কর রহে হ্যায় বেটা। 

চমকে ওঠেন ত্রিলোক। এখানে আসার ঠিক আগে যে উনি ওই রাগ মালকোষ গাইছিলেন সেটা এতদূরে বসে দরবেশ জানলেন কিভাবে ? তাকিয়ে দেখলেন দরবেশের মুখে যেন স্নিগ্ধ হাসির ছটা লেগে আছে। শুনতে পেলেন উনি বলছেন ....

-- কি ভাবছো বেটা ? আমি কিভাবে জানলাম তাই তো ? ও কুছ নেহি হ্যায়। ওহ সব বাদমে বাতায়েঙ্গে। পহলে তুম গানা শুনাও আপনা। 

গান শুরু করার আগে শুধু জিজ্ঞাসা করেন ত্রিলোক যে ওনার গান তো সবই হরি বা কৃষ্ণের গুনগান নিয়ে। সেটা শুনতে দরবেশের কোনো অসুবিধা হবে কিনা। স্মিত হেসে দরবেশ বলেন..

-- বেটা , চাহে আল্লাহ চাহে ভগবান , পর সুর তো একহি হ্যায় না। 

আর দেরি করেন না ত্রিলোক। আলাপ ধরেন রাগ মালকোষের। 

সা... নিসা...গাসা...গামা... গাসা... গামা....ধাসা..

চোখ বন্ধ করে শুনতে থাকেন দরবেশ। কিছু পরে যখন পকড় ধরে সবে ত্রিলোক শুরু করেছেন.....

ধানি... সামা...মাগা... মাগাসা....

হঠাৎই চোখ খুলে বলে ওঠেন দরবেশ....

-- বেটা তুম কিসকো শুনা রহে হো ? 

-- মানে ? সামনে তো শুধু আপনিই বসে আছেন। আর আপনিই তো এই রাগ মালকোষ শুনতে চাইলেন। আপনাকেই শোনাচ্ছি। 

-- পর বেটা, আমি তো তোমাকে কিছু দিতে পারবো না।

-- মানে ? এখানে দেওয়াদেয়ির কথা আসছে কেন ?আর আপনি দিলে আমি নেবই বা কেন ?

-- না বেটা, সে কথা নয়। তোমার গান শুনে মনে হচ্ছে কি তুম কুছ পানে কে লিয়েহি গা রহে হো। মতলব ইয়া তো রূপেয়া, ইয়া সাবাশি। অ্যায়সে নেহি বেটা,সির্ফ আপনে আপ কো লিয়ে তুম গাও বেটা। ম্যায় ওহি শুননা চাহতা হুঁ।

-- নিজের জন্য মানে ? আমি তো নিজেই গাইছি।

-- হাঁ বেটা, তুমি নিজে গাইছো। পর নিজের জন্য গাইছো কি ? তোমার গান শুনে মনে হচ্ছে কি যে ইয়ে গানা খতম হোনে কি বাদ ইয়া তো তুমহে কুছ নজরানা মিলেগা, ইয়া তো কিসিসে সাবাশি, ওহ নেহি বেটা , সির্ফ আপনে দিল কো খুশ করনে কে লিয়ে গাও তুম।

-- আপনি ভুলে যাচ্ছেন যে আমি কিন্তু এই সঙ্গীতের শিক্ষাদানই করে থাকি।

-- ওহ সব ম্যায় নেহি জানতা হুঁ বেটা। পর শুনে লাগছে কি যে তুমি গানে কে সাথ রাগ মালকোষকো ঠিক সে নেহি বুলা রহে হো। 

-- মানে....

-- না বেটা, আজ তুমি শোচো। অউর সির্ফ শোচো বেটা। ম্যায় কাল ফির আউঙ্গা। 

 

    সেরাতে দরবেশ চলে যাওয়ার পর ভেবে ভেবেও কিছু কূলকিনারা পান না ত্রিলোক। খালি মনে হয় যেন অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই এখানে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা বোধহয় হঠকারীতাই হয়েছে। পরদিন দুপুরেও শুধুমাত্র সামান্য ফলাহার করেই অপেক্ষায় থাকেন ত্রিলোক। সে কুটিরের দাওয়ায় বসে দুচোখে তন্দ্রা আসে তার। হঠাৎই দেখেন যে এক সৌম্যকান্তি পুরুষ অপূর্ব জ্যোতি অঙ্গে মেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে। কিছু বলার আগেই তিনি বলে ওঠেন "আমি আসবো ত্রিলোক , শুধু তোমায় আকুল হয়ে ডাকতে হবে আমায়।" হতচকিত নয়নে প্রশ্ন করেন ত্রিলোক, "কিন্তু কে আপনি ?" আবার উত্তর আসে সেই দিব্যকান্তি পুরুষের থেকে, "আমি স্বয়ং রাগ মালকোষ ত্রিলোক। ডাকো আমায়, সর্বস্ব দিয়ে ডাকো তুমি, তবেই তো তুমি জানবে আমায়। তবেই তো ছুঁতে পারবে আমায়।"  

যেন বহুদিনের নিদ্রায় বিজড়িত কোনো রাজকুমারকে ছোঁয়ানো হয়েছে সোনার কাঠি ,রুপোর কাঠি। ধড়মড় করে নিদ্রাভঙ্গ হয়ে সটান উঠে বসেন ত্রিলোক। স্বপ্নে দেখা দিব্যকান্তি পুরুষ যেন ঘোর লাগিয়ে দিয়েছে ওনার অন্তরে। মনে মনে ভাবতে থাকেন যে ধ্রুপদের অর্থ হলো ধ্রুব পদ। ধ্রুপদে স্থায়ী অন্তরা সঞ্চারী আভোগ নামে চারটি কলি আছে। ধ্রুপদের বিশেষত্বই হচ্ছে যে রাগের বিশুদ্ধতা বজায় রাখা। আর সেই ধ্রুপদ অঙ্গে রাগ মালকোষ , সে তো পরম যত্নের ধন। 

মাল এবং কৌশিক , এই দুটি শব্দের সংযোগে সৃষ্টি হয়েছে মালবকোষ বা মালকোষ শব্দটি। যিনি কণ্ঠে সর্পের মতো মালা পরিধান করেন , অর্থাৎ ভগবান শিব। কথিত আছে সতীর দেহত্যাগ দেখে শিব যখন রুদ্রমূর্তি ধারণ করে তাণ্ডবলীলা শুরু করেন , তখন তাকে শান্ত করার জন্য এই রাগের সৃষ্টি করেন স্বয়ং দেবী পার্বতী। 

আর সেই রাগ মালকোষের সাথেই কিনা তিনি এতদিন করেছেন অবিচার। তুচ্ছ বাহবা আর উপঢৌকনের মোহে সেই রাগকে তিনি উপস্থিত করেছেন নিজের মর্জিমতো।

 

    সন্ধ্যা পার করে আজ আবার আসেন দরবেশ। ত্রিলোক কিছু বলার আগেই বলে ওঠেন তিনি...

-- কেয়া বেটা , মুলাকাত হুয়া কেয়া উনকে সাথ।

-- কার কথা বলছেন আপনি ? 

-- ওহি , যিনহনে আয়ে থে তুমহারি স্বপ্নে মে। 

আবার চমকে ওঠেন ত্রিলোক। তাকিয়ে দেখেন যে দরবেশ হাসছেন মিটিমিটি। ওইভাবে হাসতে হাসতেই তিনি এবার বলে ওঠেন....

-- কেয়া শোচ রহে হো বেটা ? মুঝে ক্যায়সে পতা চলা? ওহ সব ছোড়ো বেটা। অব শুনো , ইসিলিয়ে তো তুমে লে আয়া হুঁ মেরে পাস। আজ সে তুম সির্ফ উনকো পুকারেঙ্গে বেটা। ভুল যাও সবকুছ। অগলে পাঁচদিন তক এহি তুমহারা কাম হ্যায়। 

-- পাঁচদিন ! কিন্তু পাঁচদিনই বা বলছেন কেন আপনি? আর তাছাড়া আপনাকে তো কিছুই দিতে পারবোনা আমি। 

এবার ত্রিলোকের মাথায় হাত রাখেন দরবেশ। মুখে শুধু বলেন...

-- কিউ কি যো ওয়াক্ত কা তালাশ হ্যায়, ওহ পাঁচদিন বাদ হি আয়েগা বেটা। অউর ফিকর মত করো তুম,ম্যায় খুদ আপনি নজরানা মাঙ্গ লুঙ্গা তুমসে। ইসিলিয়ে তো তুম আয়ে হো ইধার। 

-- মানে ? আমি আপনার ওই নজরানা দেওয়ার জন্য এসেছি এখানে ? 

-- হাঁ বেটা। তুমাকে আসতেই হতো ইখানে। পর ইয়ে সব ছোড়ো তুম। তুম ইয়ে পাঁচদিন সির্ফ উনকো পুকারো। 

সেদিন আর কথা না বাড়িয়ে চলে যান দরবেশ। আর ত্রিলোক ভাবতে থাকেন , তাহলে কি ওনার শিক্ষা সম্পূর্ণ নয়। যেভাবে মালকোষ রাগকে উনি পেশ করেন শ্রোতাদের সামনে তাতে কি সত্যিই কোনো খামতি আছে ? কিন্তু ওনার পরিবেশনায় যদি কোনো খামতিই না থাকবে তাহলে ওই স্বপ্নই বা দেখলেন কেন উনি। 

 

    পরের পাঁচদিন বলতে গেলে ত্রিলোক শুধু আকুল ভাবে ডেকেই চললেন রাগ মালকোষকে। কোন রকম মুরকি নয় , কোনো গমক নয়, কোনো খটকা নয়, শুধু মনের আকুলতা দিয়ে গেয়ে চলেছেন "হরি আওবো আজ মন মন্দিরে।" শুধুই আরহ অবরোহ খেলা করছে তখন ওনার কণ্ঠে 

"নি সা গা মা ধা নি সা

 সা নি ধা মা গা মা গা সা" 

মন্দ্রসপ্তকে শুধু শোনা যাচ্ছে তখন ...

"সানিসা নিসানিধামা মাধানিসা

 সানিধামাসামা গামাগাসা সাগামাধামা...."

 

    এই পাঁচদিন ওনার জন্য আহার্য্য বস্তু এসেছিলো ওই কয়েকঘর হিন্দুর থেকে পালা করে। ত্রিলোক কোনোদিন প্রস্তুত করেছেন আহার, সে আহার গলধঃকরণ করেছেন কোনোরকমে। আবার কোনোদিন সব ভুলে শুধু ডেকেই গেছেন রাগ মালকোষকে। 

পঞ্চমদিন সন্ধ্যার পর ওনার কুটিরের সামনে এসে দাঁড়ায় মুস্তাক। মুখে শুধু বলে ...

-- এবার যে যেতে হবে গোঁসাই।

-- কোথায় মুস্তাক ? আবার কোথায় নিয়ে যেতে চাও আমায় ? 

-- সামনেই গোঁসাই। ফকিরবাবার ঘরে। 

চমকে উঠলেন ত্রিলোক। এই প্রথমবার শুনলেন যে মুস্তাক ওনাকে নিয়ে যেতে চাইছে দরবেশের ঘরে। তবে মনের অদম্য কৌতূহল পূরণ করার উদ্দেশ্যে চললেন এবার দরবেশের আস্তানার দিকে। 

 

    ওই সোমরাগরি মসজিদের পিছনেই ছোট্ট এক ভাঙাচোরা কুটিরে বাস দরবেশের। সে কুটিরের একপাশে খোলা নাবাল জমি, আর পিছনেই এক বিশাল বড় দীঘি। দরবেশের কুটির আর ওই দীঘির মাঝেই এক লম্বা তালগাছ। সে তালগাছের ভৌতিক ছায়া পড়েছে ওই দীঘিতে। মনে হচ্ছে যেন দীঘিতে প্রকৃতি এক তালগাছের ছিপ ফেলে চুপটি করে বসে আছে। 

কুটিরের বাইরে মাদুরের ওপর বসেছিলেন দরবেশ। ত্রিলোককে দেখে হেসে বললেন...

-- আ বেটা। তেরা রাহা দেখতে দেখতে ইতনা সাল হো গ্যায়া। অব ওহ ওয়াক্ত আ গয়ে , তু বৈঠ মেরে সামনে। 

 

    আজ যেন চমকের পর চমক আসছে ত্রিলোকের কাছে। সাক্ষাতের পর এই প্রথম দরবেশ ওনাকে তুই বলে সম্বোধন করলেন। সবে কিছু বলতে যাবেন উনি,তার আগেই দরবেশ বলে উঠলেন মুস্তাককে দিকে তাকিয়ে....

--যা বাচ্চা , ইয়াদ হ্যায় না তুঝে ম্যায় কেয়া করনে কে লিয়ে বোলা থা। তু সির্ফ ওহি কর, উসিসে জিন্দেগী বিত জায়গা তেরা। 

এবার মুখ খোলেন ত্রিলোক...

-- কিন্তু কিসের সময় ? কোন সময়ের কথা বলছেন আপনি ? আর আজই বা কেন ? 

ওই হাসিমুখেই বলেন দরবেশ....

-- তোকে বলেছিলাম না বাচ্চা কে মেরা নজরানা ম্যায় খুদ মাঙ্গ লুঙ্গা। আজ ওহ দিন আ গ্যায়া।  আজ তুঝে সবকুছ দেনে কে বাদ ম্যায় আজাদ হো যাউঙ্গা। 

-- কিন্তু আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না এখনও। 

-- নেহি সমঝে বেটা। আজ শবে-এ-মিরাজ হ্যায় রে বাচ্চা। তু রুখ জরা, আজ ম্যায় আপনি হাতসে তুঝে খিলাউঙ্গা। তেরে লিয়ে খানা ভি ম্যায় খুদ বানায়া। 

-- সেকি ? কেন ? 

-- আজ যে তোর আঁখ ফোটাতে হবে রে বাচ্চা। আজ যো ম্যায় চাহুঙ্গা , তুঝে ওহি করনা পড়েগা। 

 

    আরও কিছুক্ষণ কথা বলে , বলতে গেলে ত্রিলোককে আরও হতচকিত করে দরবেশ ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে কুটির থেকে নিয়ে আসলেন খাবার। পদ্মপাতায় ঢেলে দিলেন সামান্য গরম ভাত , দুধ আর মধু। হেসে বললেন....

-- খা বেটা, মেরা খানে কা সামান তো ইঁহা কে ওহ লোগ রোজ দেতে হ্যায় যো তেরে ঘর কে সামনেহি রহতা হ্যায়। পর আজ ম্যায় তেরে লিয়ে সব কুছ রাখখে থে। তোর জন্যই আজ আমি চাওল পাকিয়েছি বেটা। তু মেরে সামনে বৈঠ কর খা। 

    কোনো কথাই আর উনি বলতে দেন না ত্রিলোককে। পরম যত্নে বসিয়ে খাওয়ান ত্রিলোককে। সে আহার শেষে খানিক বিশ্রামের পর এবার বলেন দরবেশ....

-- লে বাচ্চা, অব ম্যায় শো রহা হুঁ। তু মেরে পাস বৈঠ কর পুকার উনকো। অব সব কুছ তেরে হাত মে হ্যায় রে বাচ্চা। সির্ফ একহি বাত ইয়াদ রাখনা বাচ্চা। আজ কি রাত সুর মত ছোড়না বেটা। 

-- মানে.....

-- না বেটা, কিচ্ছু ভাবতে হবে না। ব্যস সুর মত ছোড়না। 

বয়সের ভারে জীর্ণ ডানহাতখানি তুলে এবার ত্রিলোকের মাথায় রাখেন দরবেশ। তারপর গালে কপালে সে হাত দিয়ে ধীরে ধীরে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেওয়ার পর সেই মাদুরের ওপর সোজা টানটান হয়ে শুয়ে পড়েন দরবেশ। 

 

    যেন একটা ঘোরের মাঝেই এবার রাগ মালকোষে সুর লাগান ত্রিলোক। আকুল কণ্ঠে ডাক দেন "হরি আওবো আজ মন মন্দিরে।" 

আস্তে আস্তে যেন সুরের মাঝে ডুবতে থাকেন ত্রিলোক। মন্দ্রসপ্তকে যখন কণ্ঠ ভাসিয়ে দিচ্ছেন উনি, তখন কণ্ঠে কোমল নি-র ব্যবহার শুনে মনে হচ্ছে যেন বিশ্ব চরাচর জুড়ে ধীর লয়ে বেজেই চলেছে ডিরিডিরি ডিরিডিরি আওয়াজ। একমনে একাগ্রচিত্তে দুচোখ বন্ধ করে সুরের মাঝে সম্পূর্ণ ডুবে গেছেন যখন ত্রিলোক , তখন হঠাৎই যেন অনুভব করে উঠলেন যে ওনার শরীর গরম হয়ে উঠছে। মাথা যেন ভার হয়ে উঠেছে। যেন কোনো সুরসমুদ্রের ওপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছেন উনি। গান থামিয়ে চমকে চোখ মেললেন ত্রিলোক। দেখলেন উজ্জ্বল কিন্তু চোখ ধাঁধানো নয়, বরং আশ্চর্য এক মায়াবী আলোয় ভেসে গেছে চারদিক। অদ্ভুত সুগন্ধে ম ম করছে চারিপাশ। ওনার গান থেমে গেছে, কিন্তু মাঠ প্রান্তর জুড়ে যেন হয়েই চলেছে একটা আওয়াজ। ডিরিডিরি -- ডিরিডিরি -- ডিরিডিরি। দরবেশ বসে আছেন ওনার সামনে। কিন্তু একি ? যেন মনে হচ্ছে শুন্যে ভাসমান হয়ে বসেছেন দরবেশ। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন ত্রিলোকের দিকে। আর যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে দরবেশের কণ্ঠস্বর "সুর মত ছোড়না বেটা, সুর মত ছোড়না।" 

     

    আর সহ্য করতে পারলেন না ত্রিলোক। ভয়ে বিস্ময়ে চোখ বন্ধ করে ফেললেন আবার। তারপর দরবেশের বলা কথামতো কণ্ঠে সুর ধরলেন আবার .......

"নিসাধানিসামা সাগামাগাসা গামাধানিধাসা 

গামাধানিসাগা গামাগাসানিসা 

ধানিসামা গামাধানিসাগাসা সামা ..........."

 

    আস্তে আস্তে, যেন খুব আলতো করে চোখের ওপর মায়ার পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে কেউ, এইভাবে ভোরের আলো ফুটতে থাকে। আবার পাখিদের গানে ভরতে থাকে ভুবন। গান থামিয়ে চোখ মেলেন ত্রিলোক। 

সামনে শুয়ে আছেন দরবেশ। এক নজর দেখলেই বোঝা যায় যে সে দেহ প্রাণহীন। যেন রাগ মালকোষ স্বয়ং এসে সুরলোকে নিয়ে গেছেন দরবেশ মহম্মদ গোলামকে । 

আসন ছাড়েন ত্রিলোক। ঘুরে মসজিদের সামনে এসে দেখেন যে মসজিদের ভাঙ্গা সিঁড়িতে বসে আছে মুস্তাক। শুধু তাই নয়, এই কাকভোরেও আশপাশ থেকে এসে হাজির হয়েছেন বেশ কিছু মানুষ। মুখ তোলে মুস্তাক, চোখে টলটল করছে জল। একরাতেই যেন সব দ্বন্দ্ব ঘুচে গেছে ত্রিলোকের। মুস্তাকের কাঁধে হাত রাখেন তিনি..

-- মুস্তাকভাই , তুমি প্রথম থেকেই সব জানতে; তাই না? 

-- না গোঁসাই, ফকিরবাবা শুধু বলেছিলেন যে গতকাল উনি ওনার মালিকের সাথে মিলবেন। তবে গতকাল রাতে ওনাকে ঠিক ওই জায়গায় মাদুরের ওপর বসতে দেখেই আমি আন্দাজ করেছিলাম। 

-- কেন মুস্তাকভাই। ওই জায়গার কি কোনো বিশেষত্ব আছে নাকি ? 

চোখে জল নিয়েও ম্লান হাসে মুস্তাক। বলে...

-- গোঁসাই , উনি বলেইছিলেন আগে যে ঠিক ওই জায়গায় যেন ওনাকে কবর দেওয়া হয়। কিন্তু আপনি এখন কি করবেন গোঁসাই। আপনার ফেরার ব্যবস্থা করতে যে দেরি হবে আজ। 

এবার মুস্তাকের হাত দুটোই চেপে ধরলেন ত্রিলোক। এতক্ষনে ওনার চোখও জলে ভরে গিয়েছে। সেই অবস্থাতেই বললেন.....

-- না মুস্তাকভাই, এখন নয়। ফিরতে তো আমায় হবেই। তবে তার আগে যিনি আমার চোখ ফুটিয়েছেন তার কবরে মাটি দেওয়ার কাজটাও যে আমায় করতে হবে আগে। তারপর তো আমারখোঁজার পালা।

-- খুঁজবেন ? কি খুঁজবেন গোঁসাই আপনি ? 

-- বুঝলেনা , আমার গুরু তার নৌকাটা ঠেলে দেওয়ার জন্যেই তো আমায় বেছে নিয়েছিলেন। আমাকেও যে এবার একজনকে খুঁজতে হবে মুস্তাকভাই যে আমার শেষ সময়ে আমার নৌকাটাকে ঠেলে দেবে। 

 

    আকাশ ইতিমধ্যেই পরিষ্কার হতে শুরু হয়েছে। সবাই সবার কাজে লেগে পড়বে এখন। এই দিনও শেষ হয়ে রাত নামবে একসময়। হয়তো কালের নিয়মে পাল্টে যাবে এই মসজিদের কাঠামো। হয়তো আবার অগুন্তি মানুষের ভীড়ে ভরে উঠবে এই জনপদ। 

তাকালেন ত্রিলোক গোস্বামী সামনের দিকে। কাঁচা রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে ওনার পায়ের সামনে থেকেই। এবার রাস্তায় নামার পালা ওনার। 

 

চরৈবতি......চরৈবতি.......... 

....................................................

 (গল্পে বর্ণিত চরিত্রগুলি সবই লেখকের কল্পনাপ্রসূত। এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল পাওয়া গেলে তা নেহাতই কাকতালীয় হিসাবেই গণ্য হবে। )

Malay Chatterjee