পাঠ প্রতিক্রিয়া - সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

 

পাঠ প্রতিক্রিয়া

সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

 

বই: অচেনা সময়ের কাব্য 
লেখক: অমিতাভ সরকার
প্রকাশক: ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি
 


 
 



ছোট্ট চেহারার একটি বই।দারুণ প্রচ্ছদপট।উৎসর্গপত্রের পর ভূমিকা একটি কবিতা দিয়ে শুরু।কবি আর কবিতার একাকার সম্পর্ক যেন উদীয়মান 
কবির ভাবনায়।সূচীপত্রে কবিতার  নামকরণগুলি বেশ অন্যরকম লাগলো। আধুনিক বাংলা কবিতাকে  সংজ্ঞায়িত 
করা,তার মূল্যায়ন করার যোগ্যতা বা ধৃষ্টতা কোনোটাই আমার নেই।একজন সাধারণ পাঠক হিসাবে আমার যেটা মনে হয়েছে সেইটাই লেখার চেষ্টা করেছি মাত্র।
ভূমিকার কবিতার শেষে কয়েকটা লাইন-

'মনের চোরাকুঠুরীর তালা 
খুলে গেছে হঠাৎই।
চাবিটা তালার গায়ে ঝোলানো। 
কেউ কি তালাটা আর লাগাবে?’

লাইনগুলো মনে রেখাপাত করে গেল।এইটা কি দেহতত্ত্বের উপলব্বি না অন্য কিছু!আমাদের  মনের তালাচাবি নিয়েই তো রোজকার চলা এ জীবন। কখন খোলা, বন্ধ হওয়া সে তো আমাদের বোঝার বাইরে।তবু  তাই নিয়েই সব।

প্রথম কবিতা বইএর নামেই।'অচেনা সময়ের কাব্য' কবিতাটির প্রথম কয়েকটি লাইন,

'সেই একই ছায়াপথে 
পাগলের মতো আনাগোনা। 
সময় বোঝায় তার দামটা।
বৃত্তে জীবন যেন আটকে।'

যে কঠিন জীবনবৃত্তে আমরা বন্দী তার স্বরূপ সুন্দরভাবে প্রস্ফুটিত।  
শব্দের ব্যবহারগুলো প্রশংসার দাবী রাখে,
যেমন,প্রকৃতির পাঠশালা, আলপিন শব্দ,ঘুম-ভাঙা বেকার,কিৎ কিৎ খেলা।
কবিতার শেষে বর্তমান সময়ের বাস্তব চেহারার সাথে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার সুর
যেন এই লাইন কয়েকটিতে

'আজও রাত আটটায়
আজানের চেনা সুর ভাসে।
মানুষ তো একই আছে।
তবু।
অচেনা সময়।

আর কতদিন? '

সত্যিই আর কতদিন এই দুর্দশা নিয়ে আমাদের চলতে হবে জানি না।
পরের কবিতা  'অর্থনীতির সূত্র' এ রূপকের অন্তরালে সেই জ্ঞানের খোঁজ। 
'অস্তিত্ব' কবিতাটি যেন আমাদের বর্তমান  অস্তিত্বকেই ফুটিয়ে তুলেছে সুনিপুণভাবে।
'অদ্ভুত খেলা' ভক্ত আর ভগবানের চিরন্তন গল্প।চৌষট্টি পাতার এই পুস্তিকার বিষয় বিন্যাস বেশ সুন্দর লাগলো।কবিতাগুলোর কিছু কিছু লাইন অসাধারণ। কখনও বিষয়বস্তুর মধ্যে গিয়ে
হঠাৎ বেরিয়ে আসা পাঠককে চমকিত করবে কিছু জায়গায়।'আকাঙ্ক্ষা' গদ্য কবিতা বেশ লাগলো। অসাধারণ লাইন,
'চলাচল কবেকার রিকশায়?
তুই একা স্কুল থেকে আসতিস। '
এই কবিতারই  পরের কবিতা 'বন্যা' যেখানে 'কুমীর-ডাঙা খেলা' জীবনের কষ্ট থেকে কবিতার শেষে আশাবাদে উত্তরণ হয়েছে। বর্তমান কালে সমাজ বন্ধু, চিকিৎসক, সাধারণ  মানুষের জীবনযুদ্ধের কাহিনী অসাধারণভাবে কবির কলমে ফুটে উঠেছে 
'আজব যুদ্ধ 'কবিতায়।'মাছ-খোঁজা ' বেশ লাগলো। কবি লিখছেন, 
'হৃদয়-গভীরে কেউ ঢোকে না।
বাইরেটা ভালো হলে সব ঠিক।'

এই কবিতারই শেষে বলা হচ্ছে,

'জ্ঞানের পুকুর-চুরি হচ্ছে।
পুকুরই সে যদি আজ অগভীর, 
দম্ভ কিভাবে সব লুটবে?'
খুবই যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন। 

'মৎসাবতার' এ নামকরণেই ইতিহাস পুরাণের স্পর্শ, যেখানে 
'সুরাসুরে সংহার পৃথিবী। ',
'জীবন তো কয়েকটা সংখ্যা;'
 লাইনগুলো সময়ের বেদনাকে বেশ সাবলীলভাবে তুলে ধরছে।
'সূর্য নামার পর' যেন  শব্দমালা দিয়ে নির্মিত  শহরে জীবনের খন্ড  চিত্র। 
' জীবন-চালচিত্র ','মনে পেরেক','শ্রদ্ধা' 'আড়ালে','বিবাহ','মুক্তি',' এপার - ওপার','পৃথিবীর অপেক্ষা ' প্রভৃতি বেশ কিছু ছোটো কবিতা  এই কবিতা সঙ্কলনের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করেছে।ইতিহাসের প্রসঙ্গ এসেছে কিছু লেখা যেমন, 'জরা','পুঁজি','বিশ্বাস'। 'ভাইরাস', 'পথ চলা','গণেশ পুজো 'কবিতাগুলি এক কথায় বলতে গেলে অসাধারণ। 'বিষ' যে কোনো কবিতার নাম হতে পারে,কবিতাটা না পড়লে বোঝা যাবে না।প্রকৃতি ও বাদ যায় নি।'মাটির টানে','চাঁদ নেমেছে','বৃষ্টি-ছোঁয়া' তে নিসর্গ ফিরে এসেছে। 'পর্বত-প্রান্তরের ডাক' পড়ে মনে হচ্ছিলো, যেন পাহাড়ে ছুটে যাচ্ছি প্রেমিকার হাত ধরে।ভারী সুন্দর। কখনো কখনো প্রেম আর প্রকৃতি যেন  একাকার 
হয়ে যাচ্ছে।'প্রেম','জলের ছোঁয়া'  বিমূর্ত প্রেমের কবিতা।  'বিবাহ' কবিতাটি পড়তে গিয়ে থামলাম। 'ভালোবাসার সন্ধানে' যেন  আমাদের জীবনেরই  কথা প্রকৃতির আভাসে।'ঘরে ফেরা', 'খবরে গণিত ' এই দুঃসহ কালের কষ্টকে ফুটিয়ে তোলে।তবে 
এর মধ্যে 'গীতবিতান','আমার রবীন্দ্রনাথ' যেন পৃথক ধর্মী অথচ শ্রান্ত মনের শ্রেষ্ঠ আবাসস্থল। যেখানে 'গীতবিতান' কবিতার কয়েক লাইন,

'সুরগুলো সব ছবির মতো ভাসে,
কথা বলে গানের বইএর পাতা।'

'কথা-সুরের ভাবের ঘরে ঢুকে
 আবার যেন কখন ফিরে আসা।'

'গীতবিতানের প্রাণের পাতা খোলা'

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের সঙ্কলন গ্রন্থ নিয়ে তরুণ কবি অমিতাভের
এই লেখনীর  অরূণোদয়ের কুর্ণিশ না করে উপায় নেই। 

'আমার রবীন্দ্রনাথ' এ কবিগুরুকে নিয়ে আমাদের মনের আশ্রয় ফুটে উঠেছে,

'ইষ্টকথার মতো ভঙ্গুর বুভুক্ষু হৃদয়ের ভিটামিন ভিটেমাটিহারাদের মাটি এনে দেয়।'


'দেহ পুড়ে বেঁচে থাকা 
চেতনার শেষ তলে।'

এই লাইনগুলো পড়তে বসে যেন কবিতা আর নিছক লেখনীতে সীমাবদ্ধ থাকে না।কবিগুরুর ব্যপ্তিতে লেখনীও লাভ করে বলিষ্ঠতা। 

ক্রিকেটার মহেন্দ্র সিং ধোনিকে নিয়ে
'ধোনি ' কবিতাটিও বেশ ভালো।

'তোমার কাজে তুমি বড়ো,
আদর্শ আজ তোমায় দেখায়।

ভালোবাসায় বাসই তোমার,
সবার মনের বিরাট জমি।'

এ তো উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান ক্রিকেট অধিনায়ক ধোনির জয়গাথা।আসলে কবিতাই কবিকে চেনায়।পাঠকেরা সেই কবিতা রূপ কথার আস্বাদ লাভ করে ভরিয়ে তোলে কালের যাত্রাপথ। 

এছাড়া 'কঠিন প্রশ্ন','ছবি আঁকা', 'রিক্ত কুলায়' কবিতাগুলির শৈল্পিকতা, অভিনবত্ব সব ধরণের  পাঠকদের ভালো লাগবে বলে আশা রাখি।
অন্য ধরণের কবিতার কথায় আসা যাক।
আসলে যে বই এর নাম 'অচেনা সময়ের কাব্য' সেখানে তো সময়কাল উপেক্ষিত হতে পারে না কোনোভাবেই। তাই কবিতাও অন্য প্রবাহে প্রবাহিত হলেও তাকে সমকালে ফিরে আসতে হয়েছে।
এই অচেনা সময়ে চেনা মানবমনের  সহজাত রূপ,প্রবৃত্তি ফুটে উঠেছে  'খাদ্য','ডাস্টবিন','করোনায় আক্রান্ত ','করোনা টেস্ট ','ত্রুটির ফাঁদে' 
কবিতায়।লেখাগুলোর সহজ সাবলীল  ভাষা সবাই উপভোগ করতে পারবেন।'টুপি খোলা ', 'দেখানো', 'পারে ফেরা' জীবন-যাত্রার এক একটি ভিন্নধর্মী সংলাপ বলে মনে হয়েছে।লেখা দীর্ঘতর হয়ে যাচ্ছে।কবিকে অভিনন্দন।তবে যতিচিহ্ন, বানানের ব্যাপারে আরেকটু নজর রাখলে ভালো হত।ওইটুকু বাদ দিয়ে 'অচেনা সময়ের কাব্য'  পঞ্চাশোর্ধ কবিতার স্বরমালিকা  বেশ ভালো  লাগলো। উদীয়মান কবির কলম 
চলতে থাকুক।বইটার দামও এই দুর্মূল্যের বাজারে বেশ কমই মনে হলো।পড়ুন,হয়তো আরও অনেক চমক লুকিয়ে আছে কবিতার গভীরে।পাঠকদের ভালো লাগবে।

বইটি প্রকাশ করেছেন  ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি,৯ শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০৭৩।প্রচ্ছদ এঁকেছেন শ্রী শঙ্খজিৎ জানা।প্রথম প্রকাশ গতবছর মহাষ্টমী ।
.................
 

 







 

Comments

Loading... Logging you in...
  • Logged in as
There are no comments posted yet. Be the first one!

Post a new comment

Comments by