মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

মায়াম মিয়াম জেগে আছে - মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়

 

মায়াম মিয়াম জেগে আছে

মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 

‘কী হল, এত হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছ কেন ? কোন সমস্যা হয়েছে ?’

‘আমি এখন কথা বলার অবস্থায় নেই শালিনী ।’

‘এই তোমার মস্ত বড় সমস্যা বিবেক । এতগুলো কথা বলতে পারলে, শুধু আসল কথাটা ছাড়া ।’

‘ওফ্‌, না শুনে ছাড়বে না তুমি । জঙ্গলে আবার পোচার ঢুকেছিল । আগের দুবারের মতো এবারেও অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে তাদের । এবারে সংখ্যায় তারা পাঁচ ।’

‘এখনো ওরা জঙ্গলে ঢোকার সাহস পায় ! ওরা কি জানে না যে …  তবে বেশ হয়েছে । ওরা যত শেষ হয় ততো আমার শান্তি ।’

‘শুধু তোমার একার নয়, আমারও শান্তি । তবে এটা ঘটল প্রায় তিনবছর বাদে । ওরা বোধহয় না জেনেই জঙ্গলে ঢুকে পড়েছিল । আমি জানি গিয়ে কী দেখব । তবে ডিউটি তো আমাকে করতেই হবে ।’

শালিনীকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফরেস্ট অফিসার বিবেক চৌধুরী বেরিয়ে গেলেন জীপ নিয়ে ।

 

                                    ##### 


 

 ‘মায়াম, মায়াম ।’

‘কী হয়েছে বিবেক ? মায়ামকে ডাকছ কেন ?’

‘আরে মায়ামকে ডাক । এসে দেখতে বলো ওর জন্য কী এনেছি ।’

‘কী এনেছ গো ?’

‘ওহ্‌ শালিনী, তুমি তো দেখছি মেয়ের থেকেও বেশি কৌতুহলী হয়ে উঠেছ।’

‘ঠিক আছে । বলতে হবে না তোমায় । মায়াম, মায়াম । বাইরের ঘরে আয়। পাপা ডাকছে তোকে ।’

‘ইস, সেই প্রথম দিনের মতো নাক ফোলানো রাগটা আজও একইভাবে রয়ে গেছে । এইজন্যেই তোমার ওপর প্রেমটা প্রথম দিনের মতোই রয়ে গেছে ।’

‘কী করছ ? ছাড়ো । মায়াম এক্ষুণি এসে যাবে । দেখলে কী ভাববে বলো তো ?’

‘কী আবার ভাববে ? ভাববে আমার পাপা আর মায়ের মধ্যে প্রেমটা এখনো অটুট । আমার চোদ্দ বছরের ম্যাচিওর্ড মেয়ের আনন্দই হবে ।’

‘যত তোমার অসময়ে আদিখ্যেতা । ছাড় এখন ।’

শালিনীর কথায় হা হা করে হেসে ওঠে বিবেক ।

‘কী হয়েছে পাপা ? ডাকছিলে আমায় ?’

‘হ্যাঁ রে মা । বাইরে চল, দেখ তোর জন্য কী এনেছি ।’

‘কী পাপা ?’

‘আরে চল না । নিজেই দেখতে পাবি ।’

বাইরে বেরিয়ে মায়াম অবাক হয়ে যায় । বেশ খানিকক্ষণ কথা বলতে পারে না ।

‘পাপা, ও কি আমাদের সঙ্গে থাকবে ?’

‘হ্যাঁ । যতদিন না ও সুস্থ হচ্ছে । তবে সুস্থ হলে ওকে ওর নিজের জায়গায় রেখে আসতে হবে ।’

‘তুমি কিছু চিন্তা করো না পাপা । ওর দেখভালের দায়িত্ব আমার । খুব তাড়াতাড়ি ওকে সুস্থ করে তুলব । ইউ আর সো নাইস পাপা । লাভ ইউ সো মাচ।’

আনন্দে মায়াম পাপাকে জড়িয়ে ধরে । শালিনী শুধু মুখটা গম্ভীর করে শুকনো গলায় বলে ওঠে, ‘সামনে পরীক্ষা । পড়াশোনায় এতটুকু ঢিলেমি দেখলে তোমার একদিন কী আমার একদিন ।’

‘হবে না মা ।’ পাপার পিঠে মাথা রেখে আলতো স্বরে উত্তর দেয় মায়াম ।

 

                                    #####

 

বিবেক আর শালিনীর ভালবাসার সংসারের বয়স তখন সাত । কিন্তু না, তখনো পর্যন্ত কোন কচি গলা, ছোট্ট তুলতুলে হাত তাদের সংসারে আসেনি । বিবেকের পোষ্টিং তখন রাজস্থানে । সরিস্কা টাইগার রিজার্ভ ফরেস্টে । ওখানে যতটুকু ডাক্তার দেখানো সম্ভব দেখিয়েছিল বিবেক আর শালিনী । কিন্তু তেমন কোন আশ্বাস পায়নি । অথচ তাদের কোন শারীরিক ত্রুটি আছে তেমনটাও কিন্তু ডাক্তার বলেননি । শেষপর্যন্ত একদিন বিবেক বলে, ‘আমি কয়েকদিন ছুটি নিই । তারপর আমরা ভেলোর চলে যাই । সেখানে ভাল করে চেকআপ করে ফিরব । কী বলো শালিনী ?’

‘আর কি কিছু হবে বিবেক ? আমি কি আদৌ কোনদিন মা ডাক শুনতে পাব ?’

‘দেখো, এত সহজে হাল ছেড়ে দেবার মানুষ আমি যে নই, তা তুমি ভাল করে জানো । আর সব রকম চেষ্টার পরেও যদি কিছু না হয়, তখন ধরে নেব এই জীবনে তোমার আর আমার মধ্যে আসার কেউ ছিল না । তাই আসেনি । কিন্তু এটা তখনই মানব, যখন সম্পূর্ণ চেষ্টা করব ।’

শালিনী আর অমত করেনি । তার একসপ্তাহ পর দিন কুড়ির ছুটি নিয়ে পাড়ি দিয়েছিল ওরা ভেলোরে । নাহ্‌, ভেলোরের উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা আর ডাক্তারবাবুরা কেউ কোন আশার আলো দেখাতে পারেননি । শারীরিকভাবে দুজনেই সুস্থ । কিন্তু নতুন অতিথি কেন আসতে পারছে না সে বিষয়ে সঠিক কোন তথ্য তাঁরা দিতে পারেননি ।

আর একটা দিনও দেরি না করে শালিনীরা ফিরে এসেছিল তাদের বাড়িতে । দুজনের মনেই চাপা কান্না, অথচ কেউ কাউকে বুঝতে দিতে চায় না । অদ্ভুত এক লুকোচুরি খেলায় মেতেছে দুজনে । আসলে যেটুকু আশা বা ভরসা ছিল দুজনেরই মনের গভীরে তা একেবারে শেষ হয়ে গেছে ।

কিন্তু বাড়ি ঢোকার আগের মুহূর্তে তাদের জীবন আর বাড়িতে পা রাখার মুহূর্তে তাদের জীবন একঝটকায় যে আমূল বদলে যাবে তারা কল্পনাও করতে পারেনি ।

বারান্দায় পা রাখতে যাবে শালিনী, দেখে একটা ফুটফুটে বাচ্চা কাপড় জড়ানো অবস্থায় শুয়ে আপন মনে খেলছে । আবার হেসেও উঠছে । নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি শালিনী । দৌড়ে এসে কোলে তুলে নিয়েছিল ।

‘বিবেক দেখো, ঈশ্বরের খেলা দেখো । তিনি চান আমরা এই ফেলে যাওয়া বাচ্চাটার বাবা-মা হই । তাই তিনি সব কিছু ঠিক থাকা সত্ত্বেও আমাদের কোলে সন্তান দেননি ।’

বিবেক শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় । কিন্তু তার মন অন্য চিন্তায় ডুবে যায় । বাচ্চাটা কার ? কোথা থেকে এলো ? যে বা যারা রেখে গেছে তারা কি জানত, সে আর শালিনী এখন বাড়িতে কিছুদিন থাকবে না ? তাহলে কি এটা কেউ পরিকল্পনামাফিক করেছে ? নাকি বিষয়টা পুরোপুরি কাকতালীয় ! বাচ্চাটাকে দেখে মনে হচ্ছে না একেবারে সদ্যোজাত । অন্তত মাস দুই-আড়াই হবে।

‘কী হলো বিবেক ? কিছু বলছ না কেন ?’

শালিনীর কথায় ভাবনা কেটে যায় ।

‘কী বলি বলোতো ?’

‘তুমি কী বলবে আমি জানি না । তবে আমি যেটা বলছি সেটাই তুমি করবে। প্লিজ বিবেক, ধরে নাও না, এটা স্বয়ং ঈশ্বরের চাওয়া ।’

শালিনীর কথা শোনার পরেও যতভাবে সম্ভব বাচ্চাটার পরিচয় জানার জন্য খোঁজখবর নিয়েছিল বিবেক । কিন্তু কী অদ্ভুতভাবে সব পরিচয় হারিয়ে বসেছিল বাচ্চাটা । শেষপর্যন্ত সমস্তরকম আইনি নিয়মকানুন মেনে দত্তক নিয়েছিল মায়ামকে । প্রথমদিন বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢোকার পরে শালিনী বলেছিল, ‘ওর একটা নাম আমি ঠিক করে ফেলেছি ।’

‘এইটুকু সময়ে নামও ঠিক করে ফেললে ! তুমি কিছু পারো শালিনী ।’

‘ভাল করে দেখো না ওর চোখের দিকে । কী ভীষণ মায়াভরা । আমি ওর নাম রেখেছি মায়াম ।’

 

                                    #####

 

মায়ামের যখন তিন বছর বয়স রাজস্থান থেকে বদলি নিয়ে সোজা উত্তরবঙ্গ চলে এসেছিল বিবেক । ভেবেছিল ছোট্ট মায়ামকে যদি তার জন্মবৃত্তান্ত কেউ বলে দেয়, তাহলে হয়তো ওই কচি মেয়েটা নিতে পারবে না । কিন্তু শালিনী আর বিবেক ঠিক করেছে আজ মায়ামকে তার জন্ম পরিচয় দেবে । আজ মায়ামের আট বছরের জন্মদিন । শালিনী ভয় পেয়েছিল । তার মত ছিল না মায়ামকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাতে, তাও তার জন্মদিনে । কিন্তু বিবেকের কথাগুলোও একেবারে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারেনি ।

‘শুভ জন্মদিন সোনা ।’ বিবেক মেয়েকে বলে ।

‘পাপা, লাভ ইউ ।’ বলেই মায়াম প্রণাম করে বিবেককে ।

‘বড় হও । সুন্দর মনের মানুষ হও ।’ কথাগুলো বলতে-বলতে শালিনী পায়েসের বাটি হাতে ঘরে ঢোকে । মায়াম ছুটে গিয়ে মাকেও প্রণাম করে । পায়েস খাওয়ার পর বিবেক বলে ওঠে, ‘মায়াম, আজ একটা কথা বলতে চাই তোকে ।’

‘বলো না পাপা । আমি শুনছি ।’

‘আগে তুমি বলো, তুমি আমার ব্রেভ গার্ল তো ?’

‘অফকোর্স পাপা । বলো না কী বলবে ।’

‘যা বলব তোমায় সেটা তোমার ধারণার বাইরে । কিন্তু সত্য চিরকাল সত্যই থাকে । আর আমি বা তোমার মা তোমাকে সেই সত্যের আলো থেকে বঞ্চিত করতে চাই না ।’

‘পাপা, আমার খুব ভয় করছে । কী সব কঠিন কথা বলছ ।’

‘ভয় পাবার কিছু নেই মায়াম । আর তুমি তো আমার ব্রেভ গার্ল । কি, তাই তো ?’

‘ইয়েস পাপা । বলো তুমি ।’

‘মায়াম, তুই আমাদের বায়োলজিক্যাল ডটার নয় । আমি যখন রাজস্থানে পোস্টিং ছিলাম তখন সেই বাংলোর ব্যালকনিতে তোকে কে বা কারা ফেলে রেখে গিয়েছিল । তারপর আমি অনেক খোঁজখবর নিয়েছি । কিন্তু কিছু হদিশ পাইনি । তারপর যখন তোর তিন বছর বয়স আমি বদলি হয়ে এখানে চলে এলাম ।’

ছোট্ট মায়াম চুপ করে যায় সবটুকু শুনে । কিছুটা অপেক্ষার পর শালিনী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না । মায়ামকে জড়িয়ে নিজের কোলে টেনে নেয় । মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘একটা কথা জেনে রাখ মায়াম, আমি আর তোর পাপা তোকে পেয়ে নতুন জীবন পেয়েছি । তুই আমাদের জীবনে আসার আগে দিনগুলো ক্রমশ ধূসর থেকে ধূসরতর হয়ে উঠছিল । তুই আসার পর আমরা ঝলমলে আলোর সন্ধান পেয়েছি । আর চুপ করে থাকিস না । এবার কিছু তো বল ।’

মায়াম হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে । সেই কান্না বিবেক, শালিনীর মনে যতটুকু দ্বিধা, সংকোচ ছিল সব ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে আরও উজ্জ্বল করে তোলে ।

 

                                     #####

 

আজ মায়ামের চোদ্দ বছরের জন্মদিন । অদ্ভুত কিন্তু দারুণ একটা উপহার সে পেয়েছে তার পাপার কাছ থেকে । মায়ের ডাকে বাইরে আসে মায়াম ।

‘বাইরে গিয়ে দেখ, তোর পাপা আজ জন্মদিনের গিফট এনেছে ।’

‘কী গিফট ?’

‘বলতে পারব না । আমাকে বলেনি । উপরন্তু বাইরে গিয়ে দেখার পারমিশনটুকুও নেই । আগে তুই দেখবি । তারপর আমি ।’

‘পাপা সবসময় তোমায় খ্যাপায় মা । দাঁড়াও, আমি বাইরে গিয়েই তোমায় ডাক দিচ্ছি ।’

‘মায়াম এদিকে আয় ।’ বিবেক ডাক দেয় বাইরে থেকে ।

অবাক হয়ে যায় মায়াম । পাপা গিফট হিসেবে কী এনেছে !

‘পাপা তুমি একে কোথায় পেলে ?’

‘খুব খারাপ ঘটনা রে মা । কাল রাতে জঙ্গলে পোচার ঢুকেছিল । এর মাকে মেরে ফেলেছে । এতটাই ছোট, যে মানুষের সাহায্য ছাড়া ওকে দেখভাল করা অসম্ভব । তাই আমি বাড়িতে নিয়ে এলাম । একটু বড় হলে ওকে জঙ্গলেই রেখে আসতে হবে ।’

মায়াম অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে । ছোট্ট হরিণটা এখনই কত সুন্দর । তাহলে ওর পূর্ণবয়স্ক মা আরও কত সুন্দর ছিল । এই পোচাররা কতটা নির্দয় । তারা জীবনে টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না । সুন্দর, সৌন্দর্য এই শব্দগুলোর কোন স্থান নেই তাদের জীবনে । পরিবর্তে আছে নিষ্ঠুরতা, হিংস্রতা ।

মায়াম এগিয়ে আসে হরিণটার দিকে । গায়ে হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘তোর নাম দিলাম মিয়াম । আজ থেকে আমরা ফ্রেন্ড ।’

 

                                #####

 

বিবেক বনদপ্তরের নির্দেশে সর্বক্ষণ দেখভালের জন্য একজন রক্ষী বহাল করে মিয়ামের জন্য । কিন্তু তা সত্ত্বেও মায়াম নিজের স্কুল, পড়া, আর ঘুম বাদে বাকী সময়টা মিয়ামের সঙ্গে কাটাত । এমনকি খাবারটাও মিয়ামের কাছে এসে খেত । আর মিয়ামও যেন অপেক্ষা করত কখন মায়াম আসবে তার কাছে ।

মিয়াম একটু বড় হতে বাইরে নিয়ে যাবার পারমিশন দিলো বিবেক । তখন মায়ামের আনন্দ দেখে কে ? সে আর মিয়াম মাঝেমাঝেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়ত । অদ্ভুত এক বোঝাপড়া তৈরী হয়ে গিয়েছিল ওদের মধ্যে । মিয়াম কী করে যেন টের পেয়ে যেত মায়ামের মনখারাপের কথা । সে তখন তার শরীরটা মায়ামের গায়ে ঘষে দিয়ে যেন বোঝাতে চাইত, আমি তো আছি তোমার কাছে । আসলে মায়াম মনখারাপ করত তার বায়োলজিক্যাল বাবা মায়ের কথা ভেবে । কী এমন ঘটেছিল তাদের জীবনে, যে তাকে অনাথ করে ফেলে দিয়ে চলে যেতে হয়েছিল ।

কিন্তু মনখারাপ বেশিক্ষণ থাকে না । মিয়াম আদর করে তার উপস্থিতি মনে করিয়ে দেয় । সেই সঙ্গে মায়ামের মনে ভেসে ওঠে বিবেক আর শালিনীর অকৃত্রিম ভালবাসা আর আদরের মুহূর্তরা । বেরিয়ে পড়ে মিয়ামকে নিয়ে জঙ্গলে।

 

                                    #####

 

মিয়ামকে সঙ্গে করে জঙ্গলে ঘোরা এখন মায়ামের রুটিন হয়ে গেছে । তার টেন বোর্ডের পরীক্ষা হয়ে গেছে । পড়ার চাপ নেই । তাই যখন খুশি ঘোরা, খেলাটাই এখন রুটিন মায়াম আর মিয়ামের ।

আজও তারা জঙ্গলে ঘুরতে বেরিয়েছে । কিন্তু দিনটা আর পাঁচটা দিনের মতো ছিল না । আর তারাও সামনের জঙ্গলে না গিয়ে গভীর জঙ্গলে চলে গিয়েছিল । তার ওপর শুরু হয়েছিল ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি । আর সূর্য যেন সেদিন কোন ইঙ্গিত না দিয়েই হঠাৎ অস্ত চলে গিয়েছিল ।

মায়াম বৃষ্টিতে ভিজে কাঁপছিল । কোনরকমে একটা বড় গাছের নিচে মিয়ামকে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল । বৃষ্টিটা একটু কমলেই বাড়ির দিকে রওনা দেবে । কিন্তু বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ ছিল না । শেষপর্যন্ত মায়াম সিদ্ধান্ত নেয় ভিজেই বাড়ি ফিরবে । নাহলে মা, পাপা ভীষণ চিন্তায় পড়ে যাবে । আর মায়াম কখনো চায় না, তার জন্য মা বা পাপা চিন্তা করুক বা তার কারণে কোন কষ্ট পাক ।

মিয়ামের পিঠে হাত বুলিয়ে বলে মায়াম, ‘আজ কপালে বকুনি আছে রে মিয়াম । এত দূরে চলে এসে তুই, আমি কেউ ভাল করিনি । চল, ভিজে-ভিজেই ফিরি । নাহলে মা, পাপার চিন্তা আরও বাড়বে ।’

মিয়াম কী বুঝল সেই জানে । কিন্তু চলতে শুরু করল ।

কিন্তু খানিকটা যাওয়ার পর মায়ামের কীরকম অস্বস্তি হতে লাগল । একা না হলেও রাতে সে পাপার সঙ্গে একাধিকবার জঙ্গলে এসেছে । জঙ্গল তার রক্তে মিশে আছে । কিন্তু আজকের জঙ্গল এত থমথমে কেন ?

মায়ামের ভাবনা ছিঁড়েখুঁড়ে যায় গুলির শব্দে । তাহলে কি পোচার ঢুকেছে জঙ্গলে ? এ তো ভীষণ বিপদের কথা । পোচাররা এতটাই ক্ষিপ্র, বনরক্ষী আসার আগেই তাদের কাজ মিটিয়ে পালিয়ে যায় । কিন্তু এত জোরে গুলির শব্দ তো হয় না । অন্তত তার পাপা তেমনটাই বলেছিল ।

মিয়ামকে নিয়ে জোরে পা চালায় মায়াম । কিছুটা পথ পার হওয়ার পরেই চারজনের একটা দল তাদের ঘিরে ধরে ।

‘তোমরা কারা ? এই জঙ্গলে কী করছ ? আর এভাবে আমাদের পথ আটকালে কেন ?’ বেশ জোরের সঙ্গে জানতে চায় মায়াম ।

পথ আটকে দাঁড়ানো চারটে ছেলে হো হো করে খুব জোরে হেসে ওঠে । এর পরে যা ঘটল তা মায়াম কল্পনাও করতে পারেনি । জঙ্গলে বড় হওয়া মায়াম শহরের ভাল-মন্দের অনেক কথা শুনলেও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা কিছুই ছিল না । একজন মানুষ আর একজন মানুষের সঙ্গে এতটা অসভ্যতা করতে পারে মায়ামের তা কল্পনাতেও ছিল না । সবটুকু বোঝার আগেই মায়াম ওই চারজন ছেলের কব্জায় পড়ে গেল । শুধু কান্না আর চিৎকার ছাড়া কিছু করার ছিল না মায়ামের ।

আর মিয়াম ? সে পশু হয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল সেই রাতে ভালবাসা কাকে বলে । চারটে ছেলেকে তার শিং দিয়ে পায়ের খুর দিয়ে যথেষ্ট আঘাত করেছিল । কিন্তু একটা বন্যপ্রাণের ক্ষমতা শহরের আগ্নেয়াস্ত্রের কাছে কতটুকু ? গুলির আঘাতে মিয়ামের নিথর হয়ে যাওয়া শরীরটার দিকে তাকিয়ে মায়াম শেষ চিৎকারটা করেছিল । তারপর আর কোন বাধা দেয়নি ওই পাষন্ডগুলোকে ।

 

           

 

পরেরদিন বেশ কিছুটা বেলায় বনরক্ষীদের সাহায্যে মায়ামকে উদ্ধার করে বিবেক । তখন তার প্রাণটা ধুকধুক করছে । হাতের মুঠিতে একগোছা চুল । কোলে তুলে সোজা দৌড়েছিল হাসপাতালে । দীর্ঘ দশদিন যমে-মানুষে লড়াইয়ের পর বাড়ি ফিরে এসেছিল মায়াম । নাহ্‌, একটু ভুল হল, মায়াম নয়, মায়ামের শরীরটা ।

শালিনী, বিবেক ভীষণভাবে মানসিক সাপোর্ট দিয়ে মায়ামকে স্বাভাবিক করে তোলার কাজে প্রবৃত্ত হয়েছিল । কিন্তু মায়াম নিজে যেন সব হালটুকু ছেড়ে দিয়েছিল । ঠিকভাবে খায় না , ঘুমোয় না, কথাও বলে না শালিনী বা বিবেক কারোর সঙ্গে । যেন একটা পাথরপ্রতিমা ।

শালিনী সেদিন রাতেও মায়ামের সঙ্গেই ঘুমিয়েছিল । অনেক ছোট থেকে মায়ামের আলাদা ঘরে থাকা, পড়াশোনা করা, ঘুমানো অভ্যাস । কিন্তু এই ঘটনার পর থেকে শালিনী একা রাখার সাহস করেনি মায়ামকে । কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারেনি শালিনী । মায়াম বাথরুমে নিজের ওড়না গলায় পেঁচিয়ে নিজেকে শেষ করে দিয়েছিল । বাথরুমের দরজা ভেঙে বিবেক মেয়ের ঝুলন্ত দেহ বার করে এনেছিল ।

 

                                        #####

 

মায়াম ও মিয়াম চলে গেছে আজ প্রায় সাত বছর । তারপর থেকে পোচার ঢুকেছে জঙ্গলে বার চারেক । লাস্ট ঢুকেছে গত রাতে । সেটা প্রায় তিনবছর পর । হয়তো ওরা জঙ্গলের মিথ না জেনে ঢুকে পড়েছিল । মায়াম আর মিয়ামের মৃত্যুর পরে-পরেই পোচার ঢুকেছিল বার তিনেক । কিন্তু না । তারা কেউ বাঁচেনি । মায়ামের মত রক্তাক্ত শরীরে তাদের পাওয়া গেছে জঙ্গলে । তাদের পাশের মাটি ঘিরে ছোট হরিণের ক্ষুরের ছাপ । আর পাশে পড়ে থেকেছে তাদের মধ্যেই কোন একজনের মাথা থেকে ছেঁড়া একগোছা চুল ।

বিবেক আজও যাচ্ছে তার ডিউটি করতে । সে জানে আজকেও সে এইগুলোই দেখবে । মানে পোচারদের রক্তাক্ত শরীর, হরিণের ক্ষুরের ছাপ, আর একগোছা চুল । জঙ্গলে বাস করা মানুষজন এখন জেনে গেছে পোচার ঢুকলে তারা কেউ বাঁচবে না । মরতে তাদের হবেই । বিবেকও সেটাই বিশ্বাস করে ।

কারণ মায়াম আর মিয়াম জেগে আছে ।
 
...............................
Mousumi Bandyopadhyay