প্রেমের গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
প্রেমের গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

খেলাঘর - টুম্পা বিশ্বাস

 

খেলাঘর
টুম্পা বিশ্বাস 
 

 


ঘুম ভাঙতেই বিছানা ছেড়ে করে উঠে বসল অবন্তী। পায়ের পাতাটা নামিয়ে দিল ঠাণ্ডা মেঝেতে। মেঝেটাকে ছুঁয়ে সে বুঝতে চাইল যে তার স্বপ্নটা ভেঙে গেছে। ছোটবেলা থেকেই একটা মানসিক ব্যাধির শিকার সে। রাতের পর রাত বিভিন্ন ধরনের, বিচিত্র আদলের দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে অবন্তী,প্রায়ই । এখন এতটা বয়স হল, তবুও দুঃস্বপ্নের থাবা থেকে নিজের ঘুমটাকে বাঁচাতে পারেনি সে। বয়সের সাথে সাথে দুঃস্বপ্নের তীব্রতা, রঙ, গন্ধ, স্পর্শ বদলেছে কেবল ।

ছোটবেলায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে দেখতো যে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে প্রশ্ন সব চেনা অথচ তার কাছে কোন কলম নেই। কারো কাছে চেয়েও সে কলম পাচ্ছে না। তাই চেনা প্রশ্নের জানা উত্তরগুলো খাতা অব্দি লেখা হয়ে উঠছে না আর। 

স্কুলের গন্ডি পার হবার পর যখন পৃথিবীটা সবে একটু একটু করে আরও বড় হচ্ছিল, যখন কলেজের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে থাকা বড় বড় কৃষ্ণচূড়ার গাছগুলোতে ফুল ফুটলে মনে হতো যে ওরা বুঝি অবন্তীর জন্যই ফুটছে,যখন মনটা আরেকটু রঙিন  হচ্ছিল, পরিণত হচ্ছিল অবন্তীর, তখন প্রায়শই সে স্বপ্ন দেখত,তার পছন্দের যুবককে সে মনের ভাব ব্যক্ত করতে গেছে আর যুবক জানাচ্ছে যে সে ইতিমধ্যেই অন্যের কাছে দায়বদ্ধ। সেই স্বপ্ন এতবার দেখেছে অবন্তী যে শেষমেশ আর যুবককে মনের কথা জানানোই হয়ে ওঠেনি কোনদিন।  

তারপর একসময়  শিক্ষাগত যোগ্যতাকে ঝুলিতে ভরে  বারবার, বিভিন্ন ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে বসতে হয়েছে অবন্তীকে। প্রত্যেক ইন্টারভিউয়ের আগের রাত্তিরে ঘুমোতে ভয় পেয়েছে অবন্তী। প্রহর গুনেই রাত কাটিয়েছে সে। তার মাঝে যখনই তন্দ্রা এসেছে চোখের পাতায়, তখনই অবন্তী দেখেছে কর্তৃপক্ষের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষগুলোর সামনে তাকে নাজেহাল হতে হচ্ছে। কখনো কখনো দেখেছে ইন্টারভিউ বসেছে পাহাড়ি গুহায়। একবার এমনও দেখেছিল অবন্তী যে, প্রশ্নের জবাব দিতে না পারায় তাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে ইন্টারভিউ রুমে।

স্বপ্নগুলো জেগে থাকা অবস্থায় যতটাই হাস্যকর মনে হোক না কেন, ঘুমের পর্দার আড়ালে সেগুলো হৃদপিণ্ডটাকে জোরে চেপে ধরত। মনে হত শ্বাসরোধ করে মারবে তারা অবন্তীকে।

আজও ঘুম ভাঙতে একটু সময় লাগল অবন্তীর,ধাতস্থ হল ধীরে ধীরে। ঘুমের শেষ ছোঁয়াটুকু মুছে নিয়ে চোখ মেলে ও তাকিয়ে রইল অভিনবর মুখের দিকে। ঘুমন্ত অভিনব এখনও শান্তির দেশে। অবন্তীর দুঃস্বপ্নের অস্থিরতা টের পায়নি ও।বিয়ের পর পর যখন অবন্তী ঘুম ভেঙে বিধ্বস্ত হয়ে বিছানায় উঠে বসত মাঝরাতে, অভিনব তখন স্নেহের স্পর্শে অবন্তীর ভয়,আতঙ্ককে লাঘব করে দিত।তারপর একসময় একঘেয়ে হয়ে যায় ব্যাপারটা।এখন অভিনবর আঙুল অভিযোগের ভঙ্গিতে ওঠে অবন্তীর দিকে।
"সারাদিন মাথার মধ্যে যত নেতিবাচক কথা নিয়ে খেলা করো।সেগুলোই স্বপ্নে ফিরে আসে।জীবনের রোদ নিয়ে, সুগন্ধ নিয়ে ভাবো,দেখবে দুঃস্বপ্ন পালাবে।"
অবন্তী যুক্তিটা বোঝে। কিন্তু মনের মধ্যে চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালানো আশঙ্কার তীরগুলো, দুশ্চিন্তার কালো হাতগুলো অবন্তীকে ইতিবাচক হতে দেয় না।
একটু তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে আজ।অনেকটা দূরের পথ।কিন্তু দূরত্বটা সমস্যা নয়।মনের মধ্যে দুলতে থাকা প্রশ্নগুলোই সমস্যা। আদৌ কি গিয়ে লাভ হবে কিছু? 

এই প্রথম অভিনবকে না জানিয়ে এতবড় সিদ্ধান্ত নেওয়া। বিয়ের পর থেকে অভিনব এত বেশি অবলম্বন দিয়েছে যে অবন্তীর মনটা লতানে গাছের মতো হয়ে গেছে। শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াবার প্রয়োজনটাই আর বোধ করা যায় না।

অথচ বিয়ের আগে পর্যন্ত অবন্তীকে লড়তে হয়েছে বাঁচার জন্য।তিয়াসাকে বারবার রাস্তাঘাটে, পাড়ায় বেপাড়ায় উত্যক্ত করত বলে সুবিনয়কে একবার প্রচন্ড অপমান করেছিল অবন্তী।ব্যাপারটা পুলিশ অব্দি গিয়েছিল।লোকসমাজে মাথা নীচু হয়ে যাওয়ার কারণে সেসময় কত হুমকি দিয়েছে সুবিনয়।ফোনে,নামবিহীন চিঠিতে।তবু পাখির মতো ডানা ছড়িয়ে বোনকে আড়াল করে গেছে অবন্তী।তার আগে বাবা চলে যাওয়ার পর মার যাবতীয় প্রাপ্য, পেনশন সব যোগাড় করে এনেছে। সব কাগুজে জটীলতা মিটিয়েছে নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে। তারপর চাকরিটা জোটার পর নিজের পাগুলো শক্ত মাটি পাবে ভেবে হাঁফ ছেড়েছিল মনে মনে।অথচ তারপরও জীবনের একটা ভুল সিদ্ধান্ত আবার নড়বড়ে করে দিয়েছিল মনের ভিতর থাকা মাটির কুঁড়ে ঘরটাকে।

সেসময় কত রাতে স্বপ্নে শিউরে উঠত।দেখত কে যেন তার গায়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে অ্যাসিডের ধারা।ও পালাতে চেয়েও পারছে না।বহুদিন পর্যন্ত ওর ধারণা ছিল যে সুবিনয় এত সহজে ওকে ছেড়ে দেবে না।পুরো পরিবারটার অস্তিত্বের ওপরই ঝুলে থাকত এক অদৃশ্য প্রশ্নচিহ্ন। কবে, কোন সু্যোগে নেমে আসবে খাঁড়া, অহরহ এটাই ছিল অবন্তীর ভাবনা।

কিন্তু তেমন কিছুই হল না।জীবন নিজের খাতেই বয়ে চলল।তিয়াসা নিজের পছন্দের জীবনসঙ্গী বেছে নিয়েছে। অমল সত্যি সহৃদয় যুবক।শাশুড়ি একা মানুষ হওয়ার সুবাদে সে তিয়াসাকে হরণ করে নিয়ে যায় নি বিয়ের পর। তিয়াসা বাপের বাড়িতেই থাকছে।অমল নিজের বাড়ি আর শ্বশুর বাড়ির তাল মিলিয়ে দু বাড়িতেই বসত করে ঘুরেফিরে।

বোনটার থিতু হওয়ার পর অবন্তীও বেছে নিয়েছে অভিনবকে।বৃক্ষের মতো,ছাদের মতো,ছাতার মতো অভিনব সাথে থেকেছে, রক্ষা করেছে।আজ অবশ্য অভিনবর অজান্তেই অবন্তী যাবে গল্পের পুরনো পাতাগুলো আরও একবার উল্টে দিতে।অফিসে যাওয়ার নাম করে অবন্তী বেরোয়।অভিনবও অফিসের জন্য তৈরী হচ্ছিল। অভিনবর পরিণত চোখগুলো অবন্তীর মধ্যে কিছু অসহজতা টের পেল।
"আজ একটু এলোমেলো লাগছে তোমায়?শরীর ঠিক আছে?" অভিনব জানতে চায়। 
"হ্যাঁ,ঠিক আছে। " কোনরকমে জবাব দেয় অবন্তী,অসহজ হয়েই।
"আর মন?" অভিনবর গভীর দৃষ্টি মাপতে থাকে অবন্তীকে।
"মনের কথা নিয়ে অত মাথা ঘামালে চলে?তুমিই তো বলো মনকে কম গুরুত্ব দিতে।" একটু খোঁচা লুকিয়ে থাকে অবন্তীর কথায়। 
"তাহলে মানছো যে মন খারাপ? "

এরপর আর অবন্তী সাড়া দেয়নি।এর বেশি বললে অভিনব ঠিক তার কাছ থেকে সত্যিটা আদায় করে নেবে।অবন্তী তাই নিজের কাজগুলো গুছিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।এখন বাসের জানলার ধারের জায়গাটা দখল করে বসে সে বাতাসের আদর খেতে খেতে রওনা হচ্ছে তার আজকের গন্তব্যের দিকে। মাত্র একটা সপ্তাহ তাকে আবার নতুন নতুন দুঃস্বপ্নের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যদি মনামির সাথে সেদিন হঠাৎ দেখা না হতো তাহলে এই চিন্তার ঢেউ তার জীবনে আছড়ে পড়ত না।

সেদিন অফিস থেকে বেরোতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল। তার ওপর বাসও পাওয়া যাচ্ছিল না কোন কারণে। অবশেষে যে বাসটা এল তাতে চড়তে হলে রীতিমতো শক্তি প্রদশর্ন করতে হবে।উঠবে কিনা ভাবতে ভাবতেই অবন্তী হাতের ওপর একটা চেনা স্পর্শ পেয়েছিল।মনামির সাথে সেই বিয়ের আগে দেখা।মনামি চাকরি পেয়েছিল অবন্তীর বছর খানেক আগে।সেই সূত্রেই মনামি ব্যাঙ্গালোর চলে যায়। অবন্তীর বিয়েতেও থাকতে পারেনি।

সেদিন হঠাৎ দেখা হওয়ার রেশটা দুজনের কেউই হঠাৎ করে মিলিয়ে যেতে দিতে চায়নি।তাই একটা রেস্তোরাঁর ছিমছাম, নিরিবিলি পরিবেশে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ হাতে দুজনে বসেছিল মুখোমুখি। ছেড়ে আসা মেয়েবেলার খুনসুটির গল্প শেষ হতেই চায় না।সেসবের মধ্যেই বর্তমান এসে পড়ে। মনামি এখনও স্বাধীন,অবিবাহিতা। পায়ে শিকল পরে নি।অবন্তী সুখী গৃহস্থের হাসি মুখে লেপে অভিনবর ছবি দেখিয়েছিল মুঠোফোনে। ছবিটা দেখে মনামি একটু স্তব্ধ হয়েছিল।

অবন্তী কারণ জানতে চাইলে মনামি আহত কন্ঠে জিজ্ঞেস করেছিল,
"বিয়ের আর লোক পেলি না?"
এ কথার পরে হয়ত পুরনো বন্ধুত্বকে তালা বন্দী করে সেই মুহূর্তেই অবন্তী চলে আসত।হয়ত আর কোনদিন মনামির মুখদর্শনও করত না।কিন্তু মনামি আর অবন্তী ছোটবেলা থেকে একসাথে শৈশব,কৈশোর আর যৌবন ছুঁয়ে বড় হয়েছিল। আমের আচার আর স্বাবলম্বিতার স্বপ্ন একসাথে ভাগাভাগি করে বেঁচেছিল তারা।কাজেই হঠাৎ মনামির এমন মন্তব্যের কারণ কি তা জেনে নেবার আগ্রহ অবন্তীকে দিয়ে প্রশ্ন করিয়ে নিয়েছিল।

"একথা কেন বলছিস?অভিনব আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছে। তার আগে পর্যন্ত আমি শুধু লড়েই গেছি।সমাজের সাথে, ভাগ্যের সাথে, নিজের দারিদ্র্যের সাথে। অভিনব এসে আমাকে শিখিয়েছে লড়াই করার পর শান্তি নেমে আসে।সেই শান্তি সংসারকে ঘিরে থাকে পাখির ডানার মতো।ও ছাড়া আমি অচল।"

সেদিন মনামি অবন্তীর এই আবেগের স্রোত দেখে স্মিত হেসেছিল।তারপর খানিকটা বিষাদ কন্ঠস্বরে মেখে নিয়ে বলেছিল,

"আমাকে ভুল বুঝিস না।আমি তোকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। সুবিনয়ের সাথে সেই সরাসরি লড়াইয়ের দিনগুলোতেও দেখেছি তুই তিয়াসাকে বাঁচাতে কি প্রাণপণে লড়েছিস। তোর সম্মানবোধ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তাই আবার অভিনবকে বেছেছিস দেখে আজ অবাক হলাম।"

অবন্তী মনামির কথাবার্তার যুক্তিটুকু বুঝতে পারছিল না।সে অবাক হয়েই জানতে চেয়েছিল, 
"সুবিনয়ের সাথে অভিনবর কি সম্পর্ক?"

মনামিও অবাক হয়েছিল এরপর।
"তুই জানিস না?সুবিনয়ের বাড়ির বিশাল বড় হলঘরটা ওদের অফিসঘর বা বৈঠকখানা বলতে পারিস।ওর বাবা তো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মকর্তা। হাজার মানুষ ওদের বাড়ি যায় প্রয়োজনে,অপ্রয়োজনে।আমিও একবার গিয়েছিলাম।ওদের ওই হলঘরের দেওয়াল জুড়ে বিশাল বড় ছবি আছে ফ্রেমে বাঁধানো। ছবিতে সুবিনয়ের সাথে কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে অভিনব।ওরা নাকি আশৈশব বন্ধু। "

কথাটা অবন্তীর মাথাটাকে টলোমলো করে দিয়েছিল।ঠিক যেভাবে ঢেউ দোলায় পালতোলা নৌকাকে তেমনই তার ভাবনাগুলো দোল খাচ্ছিল অস্থিরতায়।তবে কি অভিনব সুবিনয়ের সাথে তার সংগ্রামের কথা জানে না?কিন্তু না জানলেও কেন এতদিনের সহাবস্থানের পরও কোনোদিন সে অবন্তীকে তার আশৈশব বন্ধুর কথা বলে নি খেলাচ্ছলেও?

আজ তাই সুবিনয়ের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় অবন্তী।ভেবেছিল দারোয়ানের ঘর থেকেই ফিরতে হবে।সুবিনয় বাড়িতে ঢোকার প্রবেশাধিকার দেবে না।কিন্তু দিল।দারোয়ান ফোনে অবন্তীর পরিচয় জানানোর পরই তাকে ভেতরে যেতে বলা হয়।

বসবার ঘরটা একতলাতেই। বাড়িতে ঢোকার পর ওটাই সামনে পড়ে। ছবিটাও সসম্মানে দেওয়াল আলোকিত করছে,এখনও।সুবিনয় ঘরে ঢোকে খানিকটা বাদেই। 
-কেমন আছেন অবন্তী?এতদিন বাদে এখানে কি মনে করে? 
সুবিনয়ের গলায় পুরনো শত্রুতার রেশমাত্র নেই। 
-নিতান্ত প্রয়োজনেই এসেছি,অপ্রয়োজনে আসার সম্পর্ক তো নেই। 
অবন্তীর তিক্ততায় সুবিনয় হাসে।কিছু বলে না।অবন্তী ফের বলে,
-আমি এতদিন সুখী ছিলাম।ভেবেছিলাম লড়াইয়ের পাট চুকেছে,এবার শুধু শান্তি। কিন্তু সপ্তাহ খানেক আগে জানতে পারলাম যার হাত ধরে সুখের সন্ধানে চলেছি এতকাল সে বোধহয় শত্রুপক্ষের চর।অভিনব কেন আমাকে বিয়ে করেছে সুবিনয়?তাকে কাজে লাগিয়ে কি আপনি আমার পরিবারের আরও বড় ক্ষতি করবেন?আপনার অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়েও সে আমার আর আপনার বিরোধের কথা না জেনে আমাকে বিয়ে করেছে এটা তো বিশ্বাসযোগ্য নয়।

এতখানি বলে অবন্তী হাঁপাতে থাকে।সুবিনয় তাকে শান্ত হতে সময় দেয়।তারপর মৃদু,মোলায়েম সুরে বলে,
-আংশিক জানাটা ভালো নয়।পুরোটা শুনুন তবে।অভিনবকে আমি কাজে লাগাই নি।ও আমাকে কাজে লাগিয়েছিল।
আপনার প্রতি ওর মুগ্ধতা পাগলামির শেষ সীমা পেরিয়ে গিয়েছিল।কিন্তু পরিবারকে অগাধ জলে ডুবিয়ে আপনি যে ওর হাত ধরবেন না তা ও খোঁজ নিয়ে জেনেছিল।
বাবার মৃত্যুর পর আপনি যেভাবে তড়িঘড়ি পরিবারের হাল ধরেছিলেন তা দেখে ওর মুগ্ধতা আকাশ ছোঁয়।তিয়াসার বিয়ের ভার আপনার ওপর অথচ সে নিয়ে আপনার মাথাব্যথা নেই। তা দেখে ও আমাকে উত্যক্ত করে,ছক আঁকে।আমি তিয়াসাকে বিরক্ত করলে আপনি ওর জন্য পাত্র খুঁজতে শুরু করবেন এটাই ও ভেবেছিল।
আপনি যে পুলিশে চলে যাবেন তা ও ভাবেনি।আমার ওপর নানা কারণে ওর অনেক উপকার,দাবী।তাই ওর পাগলামিতে সায় দিয়ে কিছু অপ্রিয় কাজ করেছি।কিন্তু আপনি যদি ওকে ভুল বুঝে সরে যান তাহলে ও হয়তো নিজেকেই মুছে ফেলবে। যা পাগল ও! 

সে রাতে অভিনব বাড়ি ফিরলে অবন্তীকে দেখে অবাক হয়।বড় যত্ন নিয়ে সেজেছে অবন্তী।সিল্কের শাড়ি,চোখে কাজলের মায়া।বহুদিন বাদে সেদিন অবন্তীর গলায় সুর খেলা করে।
"খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি আমার মনের ভিতরে
কত রাত তাই তো জেগেছি বলব কী তোরে।।"
 
--------------------------- সমাপ্ত ----------------------------
 
অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি 
 

 

পরজন্ম - শরণ্যা মুখোপাধ্যায়

 

পরজন্ম

শরণ্যা মুখোপাধ্যায়

 
 

।।১।।

“না রে, ঠাম্মা ঠিক আর পাঁচটা মানুষের মত নয়! ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি! দাদাইকে পাইনি! আমার জীবনের প্রথম দশটা বছর ঠাম্মার সঙ্গেই কেটেছে। কত অদ্ভুত গল্প যে তখন শোনাত! সেগুলো পেলে আমাদের কাজটা ভাল হবে, বলছি তোকে আমি! আর কতদিন দেখাও ত হয়নি! এই সু্যোগে সেটাও হবে।…”

গোধূলি আর অনিন্দ্য! একই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বন্ধু। প্রোজেক্ট পেয়েছে বাড়ির পুরনো জেনারেশনের মুখে শোনা গল্পকে সাজানোর! গোধূলির ঠাম্মা, এখন যিনি বীরপুরে থাকেন, যেটা কিনা মুর্শিদাবাদের একটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম, সেখানে যাবার কথাই হচ্ছিল।

“ঠাম্মার কাছে যে কত গল্প শুনেছি! সাধারণ রূপকথা নয় রে সেগুলো! ওই লালকমল-নীলকমলের মত নয়! আমার ধারণা ঠাকুমা নিজেই বানাত গল্পগুলো! অথবা…

“বুঝে গেছি! ঠাম্মা রক্স! ব্যবস্থা কর, নেক্সট উইকেই যাব আমরা!...”

।।২।।

আঠারোশ’ চুয়ান্ন! এই বছর, এই শতক চীনের জন্য একান্তই শ্লাঘার! কিং রাজাদের রাজত্বে গড়ে উঠেছে কৃষির সুস্পষ্ট ভিত্তি। বানিজ্যেও যথেষ্ট নামডাক হয়েছে দেশের। ঘরে ঘরে সুফলা সন্তানরা ব্যস্ত থাকে নিজেদের কর্মকান্ডে! দেশ এগোচ্ছে, মানুষেরও এগোবারই কথা! ঠিক এই সময়টাই কিন্তু আবার সবচেয়ে কঠিন সময়! জীবনের পরীক্ষার! যখন মানুষ হাতের কাছে প্রয়োজন নির্বাহের সব জিনিসই পেয়ে যায় যখন তার হাতে অনেক সময় থাকে, তখনই তার আসল রূপ ধরা পড়ে! গভীর নির্জন রাস্তার অদৃশ্য দস্যুর মত বেরিয়ে আসে ভেতরের আদিম সূত্রগুলি! বাইরের কাজ কমে এলেই সন্ধান পড়ে নতুন কাজের, যে কাজ আসলে বিনোদন, খেলা! আর এইরকম একটা খেলাই সে সময়টায় বিখ্যাত বা কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল চিনের বিশেষ কয়েকটা প্রদেশে!

বাঘবন্দী খেলা!

চিনের জিংয়াং প্রদেশে প্রথম শুরু হয় ব্যাপারটা। ওখানকার দুংসিং গ্রামের জমিদারের কাছে দুখানা বাঘ ধরা পড়েছিল! একটি বাঘ, আর একটি বাঘিনী! জমিদার মশাইয়ের দুই ছেলে খেলা করত তাদের নিয়ে! খেলাটা ক্রমশ পীড়ায় পরিণত হয়, আর পীড়া হয়ে ওঠে অলস, হাতে অর্থ আর অকুণ্ঠ সময় থাকা মানুষদের বিনোদন। ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল খুব নির্দোষভাবে! জমিদারের ছেলেদের দুই মামা বেড়াতে এসেছিলেন তাদের বাড়িতে। সেখানেই একদিন ঘটনাটা ঘটে। খেতে দেবার সময় ওদের ট্রেনার যখন বাঘদুটোকে এক এক করে খাঁচার সামনে থাকা একটা লোহার জাল দিয়ে ঘেরা চত্বরে নিয়ে যেত। মেটিং-এর সময়ে একবার সে দ্বিতীয়জনকে খেতে দেবার আগেই একটা অন্য কাজ চলে আসে! আর ভুলবশত, একটা বাঘকে বাইরের চত্বরে বেঁধে সে চলে যায়, অন্যটি ভিতরেই থেকে যায়! কিছুক্ষণ পরেই আসল ব্যাপারটা হল! লোহার জালের একপাশ থেকে পুরুষ বাঘটা আছাড়ি-পিছাড়ি করতে থাকল আর বাঘিনীটিও ক্রমাগত ডাকতে থাকল তাকে! সে এক দর্শনীয় ব্যাপার! শোরগোল শুনে ট্রেনারটি ছুটে এসে বাঘদুটোকে এক জায়গায় করতে চায়, কিন্তু বাধা দেন ছেলেদুটির এক মামা যিনি ওখানেই দাঁড়িয়েছিলেন! তিনি এই মজাটা আরও কিছুক্ষণ চালানোর জন্য ট্রেনারকে বকশিশ দেন। কথাটা জমিদারমশাই অবদি পৌঁছায়! তিনি এসে ব্যাপারটা দেখে নিজেও আমোদ পান! আর ঠিক এই সময়েই জিনিসটা ঘটে! একটা আইডিয়া! একমুহূর্তের একটা ঘটনা, সেই ঘটনাই বহু প্রাণের দাম, কানাকড়ি ঠিক করে দিল! জমিদারমশাই শুরুতে গ্রামের কিছু গণ্যমান্য মানুষকে ডাকলেন। নাম দিলেন “লাও হু সিঝু”, বা টাইগার ড্রামা বা বাঘের নাটক! বাঘদুটোকে একটাকে আরেকটার থেকে আলাদা করে দেওয়া হত, তারপর তাদের চিৎকার আর পরস্পরের কাছে আসার ব্যর্থ চেষ্টা ছিল মনোরঞ্জনের অন্যতম উপাদান! এইভাবে ব্যাপারটা ছড়িয়ে পড়ল। প্রচার পেল, সঙ্গে এল টাকা! বাঘের নাটক দেখতে লোকে ভিড় জমাতে থাকল। বিদেশেও ছড়ালো এ খবর! বাঘ নাকি মানুষের মত কাঁদে, হাসে, ভালবাসে! গ্রামের পর গ্রামে দাবানলের মত ছড়ালো ব্যাপারটা!

বহু বড় ব্যবসায়ী এ কাজে নামলেন! পর্যটন শিল্পের একটা বড় আকর্ষণ হয়ে উঠল বাঘের নাটক! তারপর যা হয়! অনিচ্ছুক প্রাণীগুলোকে মেটিং-সিসনের বাইরেও নানাধরণের ওষুদ দিয়ে অস্থির করে তোলার ব্যবস্থা করা হত। তারপর পরস্পরকে পাবার জন্য যখন তারা পাগল হয়ে উঠত ঠিক সেইসময়টাতেই তাদের আলাদা করে দেওয়া হত, তারা পরস্পরের কাছে যাবার জন্য যখন আকুলিবিকুলি করত তখন তাদের নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কির ফোয়ারা ছুটত, হা-হা হাসি আর ভরাভর্তি মানুষের আদিম হিংস্রতা! তার সঙ্গে ক্রমশ বাড়তে থাকে অত্যাচার, খোঁচানো, খেপানো, মার… দিনের পর দিনের পর দিন। জমিদারের যে বাঘটাকে দিয়ে গল্প শুরু হয়েছিল, তার সারা গায়ে এখন ঘা! আর বেশিদিন তার বাকি নেই! জমিদার নতুন বাঘের খোঁজ শুরু করেছেন!

কিছুদিন হল তার বাঘিনীটিও অসুস্থ। খেলার দিন পিছিয়ে যাচ্ছে এখন! নির্জীব হয়ে পড়ে থাকা দুটো প্রাণীকে দেখে জমিদারের ম্যানেজারের মাথায় একটা প্ল্যান খেলল! দুটোকে আবার একসঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া যাক! তাহলে ওরা আবার সতেজ হয়ে উঠবে! কিন্তু বাস্তবে সেটা ঘটল না। এখন দুজন একসঙ্গে হলেও আর কিছুতেই মিলিত হতে চায় না। বাঘিনীটা প্রথম দিন বাঘটার কাছেই আসতে চায়নি। ম্যানেজার বলল এ কিছু নয়, দীর্ঘদিনের অনভ্যাস, আর তার সঙ্গে ভয়ও! ও দুদিনেই কেটে যাবে। বেশ! যেমন বলা, তেমনি কাজ। রাখা হল তাদের একসঙ্গে! একদিন দুদিন তিনদিন… কিন্তু না… ওরা কেউ কারোর কাছে এলো না। বাঘিনীটা এক-পা দু-পা করে বাঘটার কাছে এগোত, তারপর পিছিয়ে আসত! কী একটা ইনফেকশন হয়েছিল যেন। এভাবে এক সপ্তাহ গেল। এদিকে নতুন বাঘও পাওয়া যায় না! আর বাঘ ত নয় জোড়াবাঘ চাই! সে এত সহজে মেলে নাকি! শেষ ছমাসে বাঘে্র খেলা এতটাই জমেছে যে বহু ব্যবসায়ীই নতুন একজোড়া করে বাঘ নিজেদের কাছে জমিয়ে রাখছে যাতে দরকার পড়লে তারা পুরোনটার বদলে নতুন জোড়াকে কাজে আনতে পারে।

বাঘ না পেলে ব্যবসায় ক্ষতি অনিবার্য! আর মানুষ ক্ষমতা থাকা অবস্থায় কোনভাবেই ক্ষতি বরদাস্ত করে না! তার কাছে, তার অধীনে থাকা যে কোন জিনিসের একটাই মূল্য, তার সুখ! এইটা ধরে রাখতে গিয়েই যাবতীয় অসুখকে ডেকে আনে মানুষ! দিনদশেক পর বাঘদুটোকে চাবুক মারা শুরু হল! রমণের জন্য যত পিঠের চামড়া ফালা হতে থাকল, ততই যেন জেদ বাড়তে লাগল বাঘ আর বাঘিনীর। বাঘিনী খাওয়া ছেড়ে দিল এরপর! তিন, চার, পাঁচদিন গেল! বাঘিনী মারা গেল। একই খাঁচায়, বাঘটি তখনও জীবিত। তার থেকে ঠিক একফুট দূরে হাত-পা মেলে একেবারে রুগ্ন অবস্থায় পড়ে রইল বাঘিনীটি! একফুট দূর থেকে বাঘটি নির্নিমেষে তাকিয়ে রইল তার দিকে। তখন ত এসব ভিডিওর ব্যবস্থা ছিল না! নাহলে সেও এক দেখার জিনিসই হয়ে উঠেছিল বাবুবিবিদের কাছে। জমিদার মশাই “দুই প্রেমিকযুগলের শেষ গল্প” নাম দিয়ে খাঁচার সামনেই ব্যবস্থা করেছিলেন জমায়েতের। মৃত্যুকালেও বাঘিনীটি অর্থ জুগিয়ে গিয়েছিল জমিদারটিকে। আর বাঘটা? না সেদিনের পর তাকে আর কেউ খাওয়াতে পারেনি। ম্যানেজারটিকে দুর্বল হয়ে আসা একথাবায় প্রায় নিকেশ করার পর তার কাছেও যেতে পারেনি আর কেউ! বাঘিনীর মৃত্যুর তিনদিনের মাথায় সেও মারা যায়! বাস্তব জীবনে এরকম ঘটনা কেউ কখনো দেখেনি। অবাক হয়েছিল সবাই! প্রচুর টাকা আদায় করেছিল তাদের মালিক! অসহায় দুটো প্রাণীর মৃত্যুকে উৎসব বানিয়ে।

।।৩।।

“কীসের ছবি গো এটা? আগে দেখাওনি ত?”  

গোধূলির কথার উত্তরে ঠাকুমা মৃদু হাসলেন।

“সেই রাজপুত্তুরের কথা মনে আছে তোর? সেই যে, যার বাস ছিল গভীর বনে, বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে যে রাজবাড়ি ছেড়ে বনে এসে থাকত!  যে রাজকন্যের সঙ্গে একা একাই সময় কাটাত, তার সঙ্গী বলতে ছিল বনের পশুপাখি! আর শুধু লোকের ডাক পড়লে…”

“আরে ধুর, কোথায় তোমায় এই ছবিটার কথা জিজ্ঞেস করছি, আর কোথায় তুমি… এরকম অদ্ভুত ছবি আগে দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না ত? এটা কোথায়? আর এরা কারা? আর কাদেরই বা শাস্তি দেওয়া হচ্ছে? অনিন্দ্য দেখ…”

ঠাম্মার বিছানায় বসেছে দুই শাগরেদ। ঠাম্মার পুরোন দেরাজ ঘেঁটে বার হয়েছে যাবতীয় গুপ্তধন। পুরোন চিঠি, ছবি, খাতা… তারমধ্যেই রাখা ছিল হলদেটে কাগজের ওপর প্রায় অদৃশ্য হয়ে আসা অয়েল পেইন্টিং-টা! তিন চারজন লোককে খুঁটিতে বেঁধে রাখা, অনেক লোক জড়ো হয়েছে সেখানে! আর দূরে দাঁড়িয়ে আছে দুটো বাঘ! কোন প্রাচীনকালের ছবি! 

“খুব ক্যাপ্টিভেটিং! এটা চায়নার ছবি বলে মনে হচ্ছে ঠাম্মি! দাদু কি কখনও…”

“গল্প শুনবি না ওইসব দেখবি? তোদের দাদু ওসব আঁকত এককালে! কিছু ছবি রয়ে গেছে হয়ত!...”

“বল বল…”

“ত সেই রাজপুত্র ছিল বনচারী! কিন্তু হাজার হোক সে রাজার ছেলে, আর খুব দয়ালুও! তাই বনে থাকলেও তার গুণের কথা সবাই জানত। কেউ কোন বিপদে পড়লেই সবার আগে ছুটে আসত তার কাছে! রাজার কান অবদি যে খবর পৌঁছত না সে খবর পেত রাজপুত্র! লোকে তাকে জানাত দুঃখের কথা! রাজার কাছে ত তারা পৌঁছতে পারত না, তার বদ মন্ত্রীরা আটকে দিত তার আগেই! ঠিক সেরকমভাবেই একদিন কয়েকজন এসেছিল তার কাছে! গাঁয়ের জমিদারের অত্যাচারের কথা শোনাতে! সে জমিদার জাতের বাইরে বিয়ে করার জন্য এক চাষীভাই আর তার নতুন বিয়ে করা বৌকে কীভাবে মেরেছে, তারা বলেছিল! জামা খুলে দেখিয়েছিল পিঠের চাবুকের দাগ! রাজকুমার জমিদারকে আগে দুবার সাবধান করেছে আগে! কিন্তু সে সাবধান হয়নি! বারবার তিনবার! এবারে আর ছাড়লে না রাজার কুমার! সোজা গেল গ্রামের মাঝে, নিজের বন্ধু, বনের পশুদের সর্দারকে নিল সঙ্গে! তারপর গ্রামে যেতেই জমিদারদের সেকি লম্পঝম্প! কিন্তু বনের রাজার ক্ষমতার সঙ্গে তারা পারে কখনও? হার মানতেই হল! তারপর সুখেদুঃখে সেই চাষী পরিবার ভালভাবে দিন কাটাতে লাগল!...”

“কনসেপ্টটা দারুণ কিন্তু, বল? অনিন্দ্যর দিকে ফিরল গোধূলি! জাতপাতের কথাও আছে। বন্যপ্রাণীর প্রতি ভালবাসাও আছে, মানুষের প্রতিবাদের কথাও আছে!...”

“আসল কথাটাই ত বললি নারে!”

“কী?”

“এটা ত প্রেমের গল্প! রাজপুত্র কেন উতলা হয়েছিল? দুটো মানুষ পরস্পরের সঙ্গে থাকতে পায়নি বলে। ভালবাসার জন্য সব সম্ভব, বুঝলি!...”

“শোনো ঠাম্মা, এসব পুরোন কনসেপ্ট! তুমি শুধু গল্পগুলো বল, বাকি আমরা বুঝে নেব!...”

“তাই নাকি! তোরা বুঝি ভালবাসায় বিশ্বাস করিস না?... ভালবাসায় সব হয়, বুঝলি! পাথর কাঁদে, পশুও মানুষ হয়! মিলন পূর্ণ না হলে ফিরে আসে বারবার! অন্য শরীরে! হয়ত সবসময় সময় মেলে না, কিন্তু তারা আসেই জোড়ায় জোড়ায়! মিলবেই কোন না কোন জন্মে! সত্যিকারের ভালবাসাকে তাই ত বাঘ আর বাঘিনীর ভালবাসা বলে! তাদের কখনও আলাদা করা যায় না!...”

“আচ্ছা ঠাম্মা তুমি সত্যিই বিশ্বাস কর যে একজন্মের ভালবাসা পূর্ণ না হলে অন্যজন্মেও সেটা গড়ায়?”

“কেন করব না দাদুভাই, জগতটাই ত বিশ্বা্সীর! যে জানে, সে জানে!... জন্তুরও মানবজন্ম হয় সত্যিকারের ভালবাসায়, একজন্মেই চৌষট্টি লক্ষ যোনী পেরিয়ে…”

“ওহ, ঠাম্মি! তুমিও পার সত্যি!...”

“নারে গোধূলি! ঠাম্মার কথাটা হয়ত ভুল নয়! জাতকের গল্প পড়েছিস ত? কতবার কতরূপে জন্মেছেন বুদ্ধ!” কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে যায় অনিন্দ্য! তার পিঠে জন্মগত দাগটার কথা মনে পড়ে তার! তিনটে টানা চেরা দাগ! ঠাম্মা তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছেন তখন! কতবার যে ঘুরলেন! মানুষের জন্য, তাদের কাজে, কখনও সময় মেলে, একসঙ্গে হন! আবার কখনও আগেপিছে হয়ে যায় কাল!

দাদাই এবারে আগেই জন্মে গেছেন! টের পান ঠাম্মা! 

তাঁরও যে সেমিজের তলায় লুকোন আছে অনেক যুগের পুরোন চাবুকের দাগ!

..............................

 অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি


 

লাভার্স মিট - ছন্দা বিশ্বাস


 

লাভার্স মিট
ছন্দা বিশ্বাস
 
 
 
সেদিন অচানক দেখা হয়ে গেল বহ্নির সাথে। মেল্লি বাজারের কাছে পথটা যেখানে দুইদিকে ভাগ হয়ে গেছে- একটা রাস্তা চলে গেছে কালিম্পঙএর দিকে, আর ডানদিকেরটা সোজা তিস্তা বাজার হয়ে গ্যান্টক। বাদিকের রাস্তাটা ক্রমশঃ উপরের দিকে উঠে গেছে। সেই সংযোগস্থলে দাড়িয়েছিল বহ্নি। আমি বাস থেকে নেমে কোথায় যাবো ভাবছি ঠিক সেই সময়ে মনে হল কে যেন আমার নাম ধরে ডাকল। সেই চেনা স্বর, সেই ডাকনাম, যাকে এতোটাকাল আমি সযতনে মুঠোয় ভরে রেখেছিলাম।
আমাকে রাস্তার পাশে একেলা দাঁড় করিয়ে বাসটা চলে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি রাস্তার পাশে গার্ড ওয়ালের রেলিং-এ ভর দিয়ে বহ্নি বসে আছে। আমাকে দেখেই বোধ হয় ও উঠে দাঁড়ালো। হাত নেড়ে ডাকল সেই চেনা ভঙ্গিমায়।
হেমন্তের বিকেল। বেলা দ্রুত নিঃশেষ হচ্ছিল। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি ছেঁড়াছেঁড়া মেঘ গুলো ভো কাট্টা ঘুড়ির মতো উড়তে উড়তে কোথায় চলে যাচ্ছে। রাস্তার দুইপাশে শুকনো পাতাগুলো ফর ফর করে সরে সরে যাচ্ছে বাতাসে। আমি শ্লথ পায়ে একটু একটু করে বহ্নির দিকে এগিয়ে গেলাম, আর বহ্নিও আমার দিকে ।
রাস্তার পাশে একটা মোটাসোটা পাইনের ছায়ায় এসে দাঁড়ালাম। বহ্নি সেই তখন থেকে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কী দেখছে বহ্নি? কী এত দেখার আছে? আমি মুখ তুলে আলতো করে ওকে একবার দেখে নিলাম। ওর চোখের ধূসর দৃস্টি বলে দিচ্ছে ও যেন কিছু হারিয়েছে। একটা শুষ্ক নদীখাত , ধূধূ শূন্যতা ধরা পড়ল ওর চোখে। চারবছর আগে যেদিন আমি ওকে ছেড়ে চলে আসি তারপর আজ এইপ্রথম ওর সাথে আমার দেখা হল।
বহ্নি গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল,”কেমন আছো?”
আমি সামান্য মুখ তুলে কার্তিকের ক্লান্ত বিষণ্ণ বিকেলের মতো মাথা নাড়ি। কী বলব, নতুন করে কীই বা বলার আছে আমার? একটা ঝিম ধরা রোদ্দুর পাইনের জঙ্গলে অলসভাবে শুয়ে ছিল। কিছু নাম না জানা পাখি আপন মনে ডাকছিল। মনে হছিল ওরা যেন পরস্পরের সাথে বাক্যালাপ করছে। বহ্নি আমার দিক থেকে সেরকম কোনো কথা শুনতে না পেয়ে বলল,”মা মারা গেছে, জানো?”
আমি ওর বুকের ভিতরে পদ্মার পাড় ভাঙ্গার শব্দ শুনতে পেলাম। মা যে ওর জীবনে কতটা জায়গা জুড়ে ছিল সেটা আমি জানতাম। বাবা মারা গেছে সেই ছোটোবেলায়। সেই থেকে ওর মা ই ওকে একা হাতে বড় করেছে। লেখাপড়া শিখিয়েছে। কিন্তু মানুষ করতে পেরেছিলেন কী? ইউনিভার্সিটিতে আমি যে বহ্নিকে চিনতাম সেই ছটফটে, প্রানবন্ত বহ্নি, যে দারুন সুন্দর রবীন্দ্রসংগীত গায়, গীটার বাজায়, বাখ, বেটোফেন এবং মোৎজার্ট শুনতে ভালবাসে, সেই বহ্নিকে প্রকৃতভাবে জানলাম বিয়ের পরে। সে যে বন্ধুদেরকে নিয়ে রেসের মাঠে টাকা ওড়ায়, যখন তখন এদিক সেদিক বেরিয়ে পড়ে, কোথায় যায় বাড়ীতে বলে যায় না- এক কথায় বোহেমিয়ান জীবন কাটায়, সেটা জানতাম না। মা আমার কাছে অনু্যোগ করতেন,"এবারে শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। ও তো আমার কোনো কথাই শোনে না।”
ওর মা ছিলেন মাটির খুব কাছের মানুষ। আর তেমনি সর্বংসহা। কথাও বলতেন ভীষণ আস্তে আস্তে। খুব ছেলেবেলায় বাবাকে হারিয়েছিল বহ্নি। তখন ওর সবে তিন বছর বয়স। অফিস থেকে রাতের ট্রেনে বাড়ি ফিরছিলেন। সেদিন কেন জানি উনি ট্রেনে ঘুমিয়ে পরেছিলেন। হঠাৎ পাশের একজন যাত্রী ওনাকে জাগিয়ে দিয়ে বলেন, ওনার যেখানে নামার কথা ছিল সেই স্টেশানটা এইমাত্র ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ট্রেনটার খুব বেশি গতি ছিল না। উনি সেই অবস্থায় ধড়পড় করে ট্রেন থেকে নামতে গেলেন। কিন্তু ঘুম চোখে বুঝতে পারেন নি ট্রেনটা যে ততক্ষণে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে এসেছে। উনি প্ল্যাটফর্ম মনে করে লাফিয়ে নামতে গিয়ে একেবারে ট্রেনের নীচেয় লাইনে পড়ে গেলেন।
কথাগুলো বিয়ের আগেই বহ্নির মুখ থেকে জানতে পারি। সেই থেকে কঠোর সংগ্রাম করে মা ওকে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির গন্ডি পার করিয়েছেন। বহ্নি খুব ছোটোবেলায় বেশ লাজুক প্রকৃতির ছিল। পরে যত বড়ো হয়েছে সেই সাথে ওর স্বভাবেরও বেশ কিছু পরিবর্তন আসতে শুরু করে দিয়েছে। বাবা না থাকায় এটা সম্ভব হয়েছে বলে আমার মনে হয়। ওদের দেশের বাড়িতে বেশ কিছু জমি-জমা , পুকুর, বাঁশঝাড়, ফলের বাগান ছিল। সেখান থেকে কাকা-জেঠারা ওদের ভাগের ভাগ সামান্য কিছু পাঠাতেন। পরে বহ্নি বড় হলে ওর প্রাপ্যটা একদিন বুঝে বিক্রি করে টাকাগুলো ব্যাঙ্কে রাখে। বহ্নি সেখান থেকে টাকা তুলে খরচ করত। ওর মতো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট এম এস সি পাশ করে কোথাও চাকরি বাকরির চেষ্টা না করে ঘুরে বেড়াতে লাগল। দুদুটো প্রাইভেট কোম্পানীর অফার ও হেলায় প্রত্যাখান করল।
একটু একটু করে পৈত্রিক সম্পত্তি জলাঞ্জলি যাচ্ছে দেখে আমি তাকে বাধা দেই। বোঝাই। কিন্তু বহ্নি শোনার পাত্র নয়। প্রায় রাতে আমাদের দুজনার ভিতরে গোলমাল বাঁধতো। একটা শয্যা ভেঙ্গে দুটো শয্যা হল। কথা বলা বন্ধ হল, এমনকি মুখ দেখাদেখিও। শাশুড়ী সন্তানের মন ঘোরানোর জন্যে এখানে সেখানে মানত করা, বিগ্রহের দশা কাটানোর জন্যে নানান পুজো করতে লাগলেন। কিন্তু সেসবে কোনো লাভ হল না।
আমি পরাজিত সৈনিকের মতো একদিন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। তারপর কলকাতা ছেড়ে জলপাইগুড়ি চলে এলাম একটা ইংরাজি মাধ্যমের ইস্কুলে চাকরি নিয়ে। বিজ্ঞাপনটা টেলিগ্রাফে দিয়েছিল। আমার ভাগ্য এতোটা সুপ্রসন্ন হবে ভাবতে পারিনি।
আমি এতক্ষণ মাথা নীচু করে কথাগুলো ভাবছিলাম। বহ্নি আমার কাছে সরে এসে বলল,"কত রোগা হয়ে গেছ তুমি।”
ওর কথায় সেই আগের মতো তেজ ছিল না। ক্লান্ত, শীর্ণ, পলি পড়া নদীর মতো স্খলিত, শিথিল ছিল ওর স্বর। আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। দেখি এই চার বছরে সে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছে। ওর মুখে প্রাজ্ঞ এক পথিকের ছায়া দেখতে পেলাম। সেই তালগাছের মত ল্যাগবেগে শরীরটা শালগাছের মতো সুঠাম না হলেও বৃক্ষের আদল নিয়েছে। যেখানে ক্লান্ত পথিক দুদন্ড বিশ্রাম নিতে পারে।
বহ্নি আস্তে আস্তে আমার হাতটা ধরে বলল,”তুমি কি আজও আমায় ঘৃণা করো?”
"ঘৃণা তোমাকে কোনোদিনই করিনি। বলতে পারো তোমাকে যে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলাম, সেই জায়গা থেকে তুমি সরে এসেছিলে। একজন পুরুষ মানুষ যে বিয়ে করে স্ত্রীর দায়িত্ব নিতে পারে না আবার সেই স্ত্রী যদি চাকরী করে তখন সেটা নিয়েও নোংরা কুৎসিত ইঙ্গিত করতে ছাড়ে না। সেক্ষেত্রে আমার কীই বা করার ছিল? তোমার বিধবা মায়ের সামান্য সে কটি টাকা ছিল সম্বল বলতে সেটুকু ধ্বংস করতে?”
আমি কোনোরকম ধৈর্যচ্যুতি না ঘটিয়ে খুব শান্ত গলায় আস্তে আস্তে কথাকটি বললাম।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে একটা বাঁকের মুখে দাঁড়িয়েছিলাম। একের পর এক বাস, লরি, ট্রাক, প্রাইভেট গাড়িগুলো জাতীয় সড়ক ধরে ছুটছিল। আমাদের ঠিক পিছনে একটা ঝোরা ছিল। পাহাড়ের অনেক উপর থেকে সরু জলধারা এসে পড়ছে নীচেয়। সেখানে অনেক ধরনের পাখির ডাক শোনা যাচ্ছিল। কিছু বুনো ফুল ফুটে ছিল পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে। শাদা শাদা ডেইজি ফুলগুলো শিশুর মতো মাথা দোলাচ্ছিল। পাশেই সিটট্রোনিলার ঝোপ থেকে কয়েকটা পাখির ডাক শোনা গেল। একটা কাঠবেড়ালি সড় সড় করে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পাশের একটা আতা গাছে উঠে পড়ল। এবং চিড়িক চিড়িক করে ডাকতে লাগল। কিছু চড়ুই জলের ধারে এসে জলপান এবং বৈকালিক স্নান সারতে লাগল।
বহ্নি আমাকে বলল, "তুমি কোথায় যাচ্ছিলে জানা হল না? তুমি কি এদিকে কোথাও থাকো? নাকি কোনো চাকরী নিয়েছ?”
বহ্নির কথা শেষ হলে বললাম,”নাহ, তেমন কোথাও যাবো বলে বের হই নি। এই ছুটির দিন দেখে ভাবলাম একটু বেরিয়ে আসি। তাই কোথায় যাব ভাবতে ভাবতে এদিকে চলে এলাম ।”
"মানে আমার মতই বোহেমিয়ান?”
বহ্নি সেই আগের মত দাঁত বের করে হাসতে লাগল। তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল,"এই, তুমি বিয়ে করেছ?”
আমি বিস্ময় মাখা সুরে বললাম, "কেন বলতো? হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?”
"নাহ, এমনি জানতে চাইলাম। স্রেফ কৌতূহল বলতে পারো।“
আমি গলায় ছদ্ম রাগ মাখিয়ে বললাম,"কেন, আমাকে দেখে কি বিবাহিত মনে হচ্ছে?”
“কী করে বুঝবো?”
"যেভাবে একজন বিবাহিত মহিলাকে দেখে সবাই বোঝে, সেইভাবে।”
“সেতো আমার কাছে থাকতেও তুমি সিঁথিতে সিন্দুর পরতে না, আর এখনও তাই।”
"তুমি সেই সিন্দুরের মর্যাদা দিয়েছিলে কোনোদিন? শুধু বৌএর সিঁথিতে সিন্দুর দিলেই কাজ শেষ হয়ে যায় না, তাকে লালন করতে হয়, মর্যাদা দিতে হয়।”
"দূর আমি আর কবে এসবের মানে বুঝতে শিখলাম। সারাটা জীবনই তো শুধু বন্ধুদের নিয়ে হৈচৈ করে কাটিয়ে দিলাম। “
আমি মনে মনে বলি,"এতদিনে তাহলে অন্ততঃ সেই উপলব্ধিটা হল?”
বহ্নি সেই কথার রেশ টেনে বলে,”জানো মা না ঠিকই বলেছিলে। তুমি চলে যাবার পরে একদিন অনেক রাতে মা আমার ঘরে এল। আমার সে রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিল না। খোলা জানালা দিয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ছেঁড়াখোড়া মেঘের ভিতর দিয়ে একটা বাঁকা চাঁদ ভেসে চলেছিল দূরে কোথায়,-।
মা আস্তে আস্তে আমার বিছানার পাশে বসে বসল। তারপর আমার মাথায় হাত বোলাতে বলাতে বলল," কী রে ঘুমাসনি এখনো?”
"ঘুম আসছে না মা।”
"শোন, আমি ভেবে দেখলাম শ্লোকের মতো মেয়ের সাথে যখন তুই ঘর করতে পারলি না তখন তোর আর সংসার করা হবে না বুঝতে পারছি। আমি ওকে যতটুকু দেখেছি তাতে বুঝতে পেরেছিলাম ও তোকে ছায়া দিয়ে আগলে রাখত। যেভাবে আমি তোকে রেখেছি এতটাদিন। এই ছায়াটা খুব দরকার। কিছু ছেলে আছে সে নিজে নিজেই বনস্পতি হয়ে ওঠে। আর কিছু ছেলে আছে যাদের একজন নারীর সাহচর্য নিয়ে বড় হয়। প্রথমে মা, তারপরে বউ। একটা ছায়াগাছের খুব দরকার বুঝলি? বিয়ের পরেও তাদের ছেলেমানুষী যায় না কিছুতেই। সেই চারাগাছকে কিন্তু ছায়াগাছটিকে মান্যতা দিতে জানতে হয়। তাকে অপমান করবি অথচ তার ছায়ায় থাকবি সে তো হতে পারে না। পারলে তুই একবার ওর খোঁজ কর। “ আমার তখন তোমার উপরে বেশ রাগ কিম্বা বলতে পারো অভিমান হয়েছিল। ওইভাবে হঠাৎ করে আমাদের কাউকে কিছু না বলে বাড়ী থেকে চলে গেলে। মা অনেক কষ্টে মারা গেল, জানো? আমি তো মাকেও ঠিকমতো যত্ন করতে পারি নি। এখন সত্যি খুব কষ্ট হয়।”
আমি বহ্নির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর চোখের কোণদুটো চিকচিক করছে। ওর মুখে শ্রাবণ মেঘের ছায়া দেখতে পেলাম। একেবারে থমথম করছে মুখটা। আমি এই বহ্নিকে এর আগে কখনো দেখি নি।
আমি কী বলব ভেবে না পেয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিলাম। কিছুটা সময় নীরবতায় কেটে গেল। হয়তো বহ্নি মনে মনে আমারই মত অতীতচারণা করছে।
একসময় বলে উঠল,”এই শ্লোক, শোনো না, তোমার যদি আপত্তি না থাকে আমার সাথে একটা জায়গায় যেতে পারো।”
আমি বহ্নির মুখের দিকে তাকালাম। ও কি মনে করছে আমাকে? এই যে এতদিন বাদে ওর সাথে আমার দেখা হল, আমি কথা বলছি বেশ সহজভাবে তাতে কি ও মনে করেছে আমি ওকে ক্ষমা করে দিয়েছি? যাকে ভালবেসে একদিন বিয়ে করেছিল বিয়ের পরে তাকে কোনোদিন সেই মর্যাদা দিয়েছে? ও একা একাই সব সিদ্ধান্ত নিত। আমার কোনো কথাই শুনত না। এই চার বছর আমি কোথায় গেলাম, কীভাবে আছি, একবার আমার কোনো খবর পর্যন্ত নিয়েছে? আর এখনও কী আমাকে ও আগের মতোই অসহায় ভাবছে? ভাবছে, ও যা বলবে আমি এখন ওর সব কথা শুনে চলব? নাকি অনেক দিন বাদে পুরানো স্বামীর সাথে দেখা হয়েছে ভেবে আহ্লাদে গলে যাবো?
আমি চোখের পলক না ফেলে বহ্নিকে জরীপ করার চেষ্টা করি। বুঝতে চেষ্টা করি ও কতটা সৎ আছে। যে কথাগুলো বলছে সেগুলো সব সঠিক কিনা। নাকি এতদিন বাদে আমাকে দেখে হঠাৎ আবেগ প্রবণ হয়ে পড়েছে?
আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বহ্নি কেমন যেন মুষড়ে গেল। চোখ সরিয়ে আস্তে আস্তে টেনে টেনে বলল,"সরি, ডোন্ট টেক আদারওয়াইজ। যদি কিছু ভুল করে থাকি, ক্ষমা করে দিও। আসলে তোমাকে দেখে না আমি মুহূর্ত্যের জন্যে সবকিছু ভুলে গেছিলাম ।”
আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এ কোন বহ্নি? তবে কি দুঃখের আগুনে পুড়ে ও খাটি ইস্পাতে পরিণত হয়েছে? নাকি এসব শুধুই কথার কথা। তবে এই মুহূর্ত্যে বহ্নির কথাগুলো শুনতে আমার খারাপ লাগছিল না। ও তো আমার সম্বন্ধে কতো কথা জিগ্যেসা করল। আমি তো ওর সম্মন্ধে কিছুই জানলাম না। ও ই বা এখানে কী করছে? ও কী আবার বিয়ে করেছে? আজকালকার ছেলেদের কাউকে বিশ্বাস নেই। এতদিন কি আর একা আছে? নিশ্চই কাউকে না কাউকে জুটিয়ে নিয়েছে।
আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বলল,"ভাবছ তো আমি এখানে কেন? তুমি আমাদের ছেড়ে চলে আসার পরে ব্যাঙ্কের পরিক্ষায় বসি। আর প্রথম বারেই বেড়ালের ভাগ্যে শিকেটা ছেড়ে। এখন আমি এই সামনেই একটা গ্রামীণ ব্যাঙ্কে জয়েন করেছি। যাবে?”
বহ্নির কথার ভিতরে কোথায় যেন একটা আত্মবিশ্বাস এর সুর শুনতে পাই। যে সুর টা শোনার জন্যে এতটাকাল অধীর অপেক্ষায় বসেছিলাম।
সব অভিমান ভুলে বলি,"কোথায়?”
"এই তো এখান থেকে খুব বেশীদূর নয়। বড়োজোর মিনিট কুড়ি লাগতে পারে।”
আমার এদিকটা সেই ভাবে আসা হয়ে ওঠেনি। তাছাড়া এই মুহূর্ত্যে আমার কোথাও যাওয়ার ছিল না। তাই বহ্নির কথায় কেমন করে যেন রাজি হয়ে গেলাম। বললাম,"চল, যাওয়া যাক। তবে সন্ধ্যার আগে আগে কিন্তু আমায় ফিরতে হবে।”
"কেন, কাউকে কথা দেওয়া আছে?”
'সে একপ্রকার বলতে পারো।” আমিও হেঁয়ালির হাসি ছড়িয়ে দিলে বললাম।
বহ্নি সামনে একটা ট্রেকার দাঁড় করিয়ে তাতে আমাকে নিয়ে উঠে বসল। মেল্লি বাজার ছাড়াতেই কয়েকটা নেপালি বাচ্চা তাদের মায়ের সাথে ট্রেকারে উঠল। ভারী মিষ্টি দেখতে বাচ্চাগুলো। একটা বাচ্চার গালদুটো যেন আপেলের মতো। আমি অবাক হয়ে বাচ্চারটার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে বহ্নি আমার হাত টিপে কি একটা ইঙ্গিত করল।
ভারী অসভ্য তো! আমি কটমট করে ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হানলাম। বহ্নি মাথা নাড়তে নাড়তে বলল,"নে বাবা, আমার দোষটা কোথায় বুঝলাম না।”
"সরি, বাবাকে আর এর ভিতরে এনো না। সামনে তাকাও।”
"সরি ম্যাডাম, এই মুখে কুলুপ আটলাম। আজকাল তো কথা বলা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি।”
কিছুটা পথ পেরতেই সামনে তিস্তা বাজার । আমাদের নামিয়ে দিয়ে ট্রেকারটা চলে গেল।
আমি বহ্নির সাথে সাথে এগুতে লাগলাম। কিছুটা পথ যাওয়ার পরে একজায়গায় বহ্নি দাঁড়িয়ে পড়ল। বেশ সুন্দর জায়গাটা। দুই দিকে সবুজ পাহাড়। মাঝখানে বেশ চওড়া জায়গা, সেখানে দুইদিক থেকে দুটো নদী এসে মিশেছে। সংযোগস্থলে ডেল্টা আকৃতির বালির চড়া পড়েছে। বেশ কিছু দলকে দেখলাম নদীতে র‍্যাফটিং করছে। বেশ কিছু পর্যটকের ভিড়।
"এটাই কি তাহলে ত্রিবেণী?”
আমি জিগ্যেস করি।
"হুম্ম, অনেকে এই জায়গাটাকে ‘লাভার্স মীট’ ও বলে থাকে।”
আমি দুই নদীর সংযোগ স্থলের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বহ্নি দেখাল,"দেখো দেখো এটা তিস্তা, আর ঐদিক থেকে যেটা এসেছে ওটা হল রঙ্গিত, গ্রেট রঙ্গিত।“
এখানে তিস্তা বেশ খরস্রোতা। দেখলাম, জায়গাটা বেশ শান্ত । দুদিকে খাঁড়া পাহাড়, সেখানে ধাপে ধাপে নানার গাছের সারি। একদিকে কালিম্পং পাহাড় অপরদিকে সিকিম পাহাড়। দেখি তিস্তার জলে নীল আকাশ মুখ দেখছে। বেশ কিছু পাখি বালির চড়ে ওড়াউড়ি করছে। সুর্য ডুবে গেলেও আকাশে নানান রঙ্গের খেলা চলছিল। প্রকৃতির এই সুন্দর রূপ আমাকে মুগ্ধ করল। আমি মোহাবিষ্টের মতো বেশ কিছুসময় তাকিয়ে রইলাম সেই দিকে।
বহ্নি হঠাৎ আমার বেশ কাছে সরে এসে বলল,”তোমার কাঁধে একটা হাত রাখবো?”
আমি ‘না’ বলতে পারলাম না।
............................
 
অলঙ্করণ :-  সহিষ্ণু কুড়ি