লাভার্স মিট - ছন্দা বিশ্বাস


 

লাভার্স মিট
ছন্দা বিশ্বাস
 
 
 
সেদিন অচানক দেখা হয়ে গেল বহ্নির সাথে। মেল্লি বাজারের কাছে পথটা যেখানে দুইদিকে ভাগ হয়ে গেছে- একটা রাস্তা চলে গেছে কালিম্পঙএর দিকে, আর ডানদিকেরটা সোজা তিস্তা বাজার হয়ে গ্যান্টক। বাদিকের রাস্তাটা ক্রমশঃ উপরের দিকে উঠে গেছে। সেই সংযোগস্থলে দাড়িয়েছিল বহ্নি। আমি বাস থেকে নেমে কোথায় যাবো ভাবছি ঠিক সেই সময়ে মনে হল কে যেন আমার নাম ধরে ডাকল। সেই চেনা স্বর, সেই ডাকনাম, যাকে এতোটাকাল আমি সযতনে মুঠোয় ভরে রেখেছিলাম।
আমাকে রাস্তার পাশে একেলা দাঁড় করিয়ে বাসটা চলে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি রাস্তার পাশে গার্ড ওয়ালের রেলিং-এ ভর দিয়ে বহ্নি বসে আছে। আমাকে দেখেই বোধ হয় ও উঠে দাঁড়ালো। হাত নেড়ে ডাকল সেই চেনা ভঙ্গিমায়।
হেমন্তের বিকেল। বেলা দ্রুত নিঃশেষ হচ্ছিল। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি ছেঁড়াছেঁড়া মেঘ গুলো ভো কাট্টা ঘুড়ির মতো উড়তে উড়তে কোথায় চলে যাচ্ছে। রাস্তার দুইপাশে শুকনো পাতাগুলো ফর ফর করে সরে সরে যাচ্ছে বাতাসে। আমি শ্লথ পায়ে একটু একটু করে বহ্নির দিকে এগিয়ে গেলাম, আর বহ্নিও আমার দিকে ।
রাস্তার পাশে একটা মোটাসোটা পাইনের ছায়ায় এসে দাঁড়ালাম। বহ্নি সেই তখন থেকে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কী দেখছে বহ্নি? কী এত দেখার আছে? আমি মুখ তুলে আলতো করে ওকে একবার দেখে নিলাম। ওর চোখের ধূসর দৃস্টি বলে দিচ্ছে ও যেন কিছু হারিয়েছে। একটা শুষ্ক নদীখাত , ধূধূ শূন্যতা ধরা পড়ল ওর চোখে। চারবছর আগে যেদিন আমি ওকে ছেড়ে চলে আসি তারপর আজ এইপ্রথম ওর সাথে আমার দেখা হল।
বহ্নি গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল,”কেমন আছো?”
আমি সামান্য মুখ তুলে কার্তিকের ক্লান্ত বিষণ্ণ বিকেলের মতো মাথা নাড়ি। কী বলব, নতুন করে কীই বা বলার আছে আমার? একটা ঝিম ধরা রোদ্দুর পাইনের জঙ্গলে অলসভাবে শুয়ে ছিল। কিছু নাম না জানা পাখি আপন মনে ডাকছিল। মনে হছিল ওরা যেন পরস্পরের সাথে বাক্যালাপ করছে। বহ্নি আমার দিক থেকে সেরকম কোনো কথা শুনতে না পেয়ে বলল,”মা মারা গেছে, জানো?”
আমি ওর বুকের ভিতরে পদ্মার পাড় ভাঙ্গার শব্দ শুনতে পেলাম। মা যে ওর জীবনে কতটা জায়গা জুড়ে ছিল সেটা আমি জানতাম। বাবা মারা গেছে সেই ছোটোবেলায়। সেই থেকে ওর মা ই ওকে একা হাতে বড় করেছে। লেখাপড়া শিখিয়েছে। কিন্তু মানুষ করতে পেরেছিলেন কী? ইউনিভার্সিটিতে আমি যে বহ্নিকে চিনতাম সেই ছটফটে, প্রানবন্ত বহ্নি, যে দারুন সুন্দর রবীন্দ্রসংগীত গায়, গীটার বাজায়, বাখ, বেটোফেন এবং মোৎজার্ট শুনতে ভালবাসে, সেই বহ্নিকে প্রকৃতভাবে জানলাম বিয়ের পরে। সে যে বন্ধুদেরকে নিয়ে রেসের মাঠে টাকা ওড়ায়, যখন তখন এদিক সেদিক বেরিয়ে পড়ে, কোথায় যায় বাড়ীতে বলে যায় না- এক কথায় বোহেমিয়ান জীবন কাটায়, সেটা জানতাম না। মা আমার কাছে অনু্যোগ করতেন,"এবারে শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। ও তো আমার কোনো কথাই শোনে না।”
ওর মা ছিলেন মাটির খুব কাছের মানুষ। আর তেমনি সর্বংসহা। কথাও বলতেন ভীষণ আস্তে আস্তে। খুব ছেলেবেলায় বাবাকে হারিয়েছিল বহ্নি। তখন ওর সবে তিন বছর বয়স। অফিস থেকে রাতের ট্রেনে বাড়ি ফিরছিলেন। সেদিন কেন জানি উনি ট্রেনে ঘুমিয়ে পরেছিলেন। হঠাৎ পাশের একজন যাত্রী ওনাকে জাগিয়ে দিয়ে বলেন, ওনার যেখানে নামার কথা ছিল সেই স্টেশানটা এইমাত্র ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ট্রেনটার খুব বেশি গতি ছিল না। উনি সেই অবস্থায় ধড়পড় করে ট্রেন থেকে নামতে গেলেন। কিন্তু ঘুম চোখে বুঝতে পারেন নি ট্রেনটা যে ততক্ষণে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে এসেছে। উনি প্ল্যাটফর্ম মনে করে লাফিয়ে নামতে গিয়ে একেবারে ট্রেনের নীচেয় লাইনে পড়ে গেলেন।
কথাগুলো বিয়ের আগেই বহ্নির মুখ থেকে জানতে পারি। সেই থেকে কঠোর সংগ্রাম করে মা ওকে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির গন্ডি পার করিয়েছেন। বহ্নি খুব ছোটোবেলায় বেশ লাজুক প্রকৃতির ছিল। পরে যত বড়ো হয়েছে সেই সাথে ওর স্বভাবেরও বেশ কিছু পরিবর্তন আসতে শুরু করে দিয়েছে। বাবা না থাকায় এটা সম্ভব হয়েছে বলে আমার মনে হয়। ওদের দেশের বাড়িতে বেশ কিছু জমি-জমা , পুকুর, বাঁশঝাড়, ফলের বাগান ছিল। সেখান থেকে কাকা-জেঠারা ওদের ভাগের ভাগ সামান্য কিছু পাঠাতেন। পরে বহ্নি বড় হলে ওর প্রাপ্যটা একদিন বুঝে বিক্রি করে টাকাগুলো ব্যাঙ্কে রাখে। বহ্নি সেখান থেকে টাকা তুলে খরচ করত। ওর মতো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট এম এস সি পাশ করে কোথাও চাকরি বাকরির চেষ্টা না করে ঘুরে বেড়াতে লাগল। দুদুটো প্রাইভেট কোম্পানীর অফার ও হেলায় প্রত্যাখান করল।
একটু একটু করে পৈত্রিক সম্পত্তি জলাঞ্জলি যাচ্ছে দেখে আমি তাকে বাধা দেই। বোঝাই। কিন্তু বহ্নি শোনার পাত্র নয়। প্রায় রাতে আমাদের দুজনার ভিতরে গোলমাল বাঁধতো। একটা শয্যা ভেঙ্গে দুটো শয্যা হল। কথা বলা বন্ধ হল, এমনকি মুখ দেখাদেখিও। শাশুড়ী সন্তানের মন ঘোরানোর জন্যে এখানে সেখানে মানত করা, বিগ্রহের দশা কাটানোর জন্যে নানান পুজো করতে লাগলেন। কিন্তু সেসবে কোনো লাভ হল না।
আমি পরাজিত সৈনিকের মতো একদিন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। তারপর কলকাতা ছেড়ে জলপাইগুড়ি চলে এলাম একটা ইংরাজি মাধ্যমের ইস্কুলে চাকরি নিয়ে। বিজ্ঞাপনটা টেলিগ্রাফে দিয়েছিল। আমার ভাগ্য এতোটা সুপ্রসন্ন হবে ভাবতে পারিনি।
আমি এতক্ষণ মাথা নীচু করে কথাগুলো ভাবছিলাম। বহ্নি আমার কাছে সরে এসে বলল,"কত রোগা হয়ে গেছ তুমি।”
ওর কথায় সেই আগের মতো তেজ ছিল না। ক্লান্ত, শীর্ণ, পলি পড়া নদীর মতো স্খলিত, শিথিল ছিল ওর স্বর। আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। দেখি এই চার বছরে সে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছে। ওর মুখে প্রাজ্ঞ এক পথিকের ছায়া দেখতে পেলাম। সেই তালগাছের মত ল্যাগবেগে শরীরটা শালগাছের মতো সুঠাম না হলেও বৃক্ষের আদল নিয়েছে। যেখানে ক্লান্ত পথিক দুদন্ড বিশ্রাম নিতে পারে।
বহ্নি আস্তে আস্তে আমার হাতটা ধরে বলল,”তুমি কি আজও আমায় ঘৃণা করো?”
"ঘৃণা তোমাকে কোনোদিনই করিনি। বলতে পারো তোমাকে যে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলাম, সেই জায়গা থেকে তুমি সরে এসেছিলে। একজন পুরুষ মানুষ যে বিয়ে করে স্ত্রীর দায়িত্ব নিতে পারে না আবার সেই স্ত্রী যদি চাকরী করে তখন সেটা নিয়েও নোংরা কুৎসিত ইঙ্গিত করতে ছাড়ে না। সেক্ষেত্রে আমার কীই বা করার ছিল? তোমার বিধবা মায়ের সামান্য সে কটি টাকা ছিল সম্বল বলতে সেটুকু ধ্বংস করতে?”
আমি কোনোরকম ধৈর্যচ্যুতি না ঘটিয়ে খুব শান্ত গলায় আস্তে আস্তে কথাকটি বললাম।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে একটা বাঁকের মুখে দাঁড়িয়েছিলাম। একের পর এক বাস, লরি, ট্রাক, প্রাইভেট গাড়িগুলো জাতীয় সড়ক ধরে ছুটছিল। আমাদের ঠিক পিছনে একটা ঝোরা ছিল। পাহাড়ের অনেক উপর থেকে সরু জলধারা এসে পড়ছে নীচেয়। সেখানে অনেক ধরনের পাখির ডাক শোনা যাচ্ছিল। কিছু বুনো ফুল ফুটে ছিল পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে। শাদা শাদা ডেইজি ফুলগুলো শিশুর মতো মাথা দোলাচ্ছিল। পাশেই সিটট্রোনিলার ঝোপ থেকে কয়েকটা পাখির ডাক শোনা গেল। একটা কাঠবেড়ালি সড় সড় করে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পাশের একটা আতা গাছে উঠে পড়ল। এবং চিড়িক চিড়িক করে ডাকতে লাগল। কিছু চড়ুই জলের ধারে এসে জলপান এবং বৈকালিক স্নান সারতে লাগল।
বহ্নি আমাকে বলল, "তুমি কোথায় যাচ্ছিলে জানা হল না? তুমি কি এদিকে কোথাও থাকো? নাকি কোনো চাকরী নিয়েছ?”
বহ্নির কথা শেষ হলে বললাম,”নাহ, তেমন কোথাও যাবো বলে বের হই নি। এই ছুটির দিন দেখে ভাবলাম একটু বেরিয়ে আসি। তাই কোথায় যাব ভাবতে ভাবতে এদিকে চলে এলাম ।”
"মানে আমার মতই বোহেমিয়ান?”
বহ্নি সেই আগের মত দাঁত বের করে হাসতে লাগল। তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল,"এই, তুমি বিয়ে করেছ?”
আমি বিস্ময় মাখা সুরে বললাম, "কেন বলতো? হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?”
"নাহ, এমনি জানতে চাইলাম। স্রেফ কৌতূহল বলতে পারো।“
আমি গলায় ছদ্ম রাগ মাখিয়ে বললাম,"কেন, আমাকে দেখে কি বিবাহিত মনে হচ্ছে?”
“কী করে বুঝবো?”
"যেভাবে একজন বিবাহিত মহিলাকে দেখে সবাই বোঝে, সেইভাবে।”
“সেতো আমার কাছে থাকতেও তুমি সিঁথিতে সিন্দুর পরতে না, আর এখনও তাই।”
"তুমি সেই সিন্দুরের মর্যাদা দিয়েছিলে কোনোদিন? শুধু বৌএর সিঁথিতে সিন্দুর দিলেই কাজ শেষ হয়ে যায় না, তাকে লালন করতে হয়, মর্যাদা দিতে হয়।”
"দূর আমি আর কবে এসবের মানে বুঝতে শিখলাম। সারাটা জীবনই তো শুধু বন্ধুদের নিয়ে হৈচৈ করে কাটিয়ে দিলাম। “
আমি মনে মনে বলি,"এতদিনে তাহলে অন্ততঃ সেই উপলব্ধিটা হল?”
বহ্নি সেই কথার রেশ টেনে বলে,”জানো মা না ঠিকই বলেছিলে। তুমি চলে যাবার পরে একদিন অনেক রাতে মা আমার ঘরে এল। আমার সে রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিল না। খোলা জানালা দিয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ছেঁড়াখোড়া মেঘের ভিতর দিয়ে একটা বাঁকা চাঁদ ভেসে চলেছিল দূরে কোথায়,-।
মা আস্তে আস্তে আমার বিছানার পাশে বসে বসল। তারপর আমার মাথায় হাত বোলাতে বলাতে বলল," কী রে ঘুমাসনি এখনো?”
"ঘুম আসছে না মা।”
"শোন, আমি ভেবে দেখলাম শ্লোকের মতো মেয়ের সাথে যখন তুই ঘর করতে পারলি না তখন তোর আর সংসার করা হবে না বুঝতে পারছি। আমি ওকে যতটুকু দেখেছি তাতে বুঝতে পেরেছিলাম ও তোকে ছায়া দিয়ে আগলে রাখত। যেভাবে আমি তোকে রেখেছি এতটাদিন। এই ছায়াটা খুব দরকার। কিছু ছেলে আছে সে নিজে নিজেই বনস্পতি হয়ে ওঠে। আর কিছু ছেলে আছে যাদের একজন নারীর সাহচর্য নিয়ে বড় হয়। প্রথমে মা, তারপরে বউ। একটা ছায়াগাছের খুব দরকার বুঝলি? বিয়ের পরেও তাদের ছেলেমানুষী যায় না কিছুতেই। সেই চারাগাছকে কিন্তু ছায়াগাছটিকে মান্যতা দিতে জানতে হয়। তাকে অপমান করবি অথচ তার ছায়ায় থাকবি সে তো হতে পারে না। পারলে তুই একবার ওর খোঁজ কর। “ আমার তখন তোমার উপরে বেশ রাগ কিম্বা বলতে পারো অভিমান হয়েছিল। ওইভাবে হঠাৎ করে আমাদের কাউকে কিছু না বলে বাড়ী থেকে চলে গেলে। মা অনেক কষ্টে মারা গেল, জানো? আমি তো মাকেও ঠিকমতো যত্ন করতে পারি নি। এখন সত্যি খুব কষ্ট হয়।”
আমি বহ্নির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর চোখের কোণদুটো চিকচিক করছে। ওর মুখে শ্রাবণ মেঘের ছায়া দেখতে পেলাম। একেবারে থমথম করছে মুখটা। আমি এই বহ্নিকে এর আগে কখনো দেখি নি।
আমি কী বলব ভেবে না পেয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিলাম। কিছুটা সময় নীরবতায় কেটে গেল। হয়তো বহ্নি মনে মনে আমারই মত অতীতচারণা করছে।
একসময় বলে উঠল,”এই শ্লোক, শোনো না, তোমার যদি আপত্তি না থাকে আমার সাথে একটা জায়গায় যেতে পারো।”
আমি বহ্নির মুখের দিকে তাকালাম। ও কি মনে করছে আমাকে? এই যে এতদিন বাদে ওর সাথে আমার দেখা হল, আমি কথা বলছি বেশ সহজভাবে তাতে কি ও মনে করেছে আমি ওকে ক্ষমা করে দিয়েছি? যাকে ভালবেসে একদিন বিয়ে করেছিল বিয়ের পরে তাকে কোনোদিন সেই মর্যাদা দিয়েছে? ও একা একাই সব সিদ্ধান্ত নিত। আমার কোনো কথাই শুনত না। এই চার বছর আমি কোথায় গেলাম, কীভাবে আছি, একবার আমার কোনো খবর পর্যন্ত নিয়েছে? আর এখনও কী আমাকে ও আগের মতোই অসহায় ভাবছে? ভাবছে, ও যা বলবে আমি এখন ওর সব কথা শুনে চলব? নাকি অনেক দিন বাদে পুরানো স্বামীর সাথে দেখা হয়েছে ভেবে আহ্লাদে গলে যাবো?
আমি চোখের পলক না ফেলে বহ্নিকে জরীপ করার চেষ্টা করি। বুঝতে চেষ্টা করি ও কতটা সৎ আছে। যে কথাগুলো বলছে সেগুলো সব সঠিক কিনা। নাকি এতদিন বাদে আমাকে দেখে হঠাৎ আবেগ প্রবণ হয়ে পড়েছে?
আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বহ্নি কেমন যেন মুষড়ে গেল। চোখ সরিয়ে আস্তে আস্তে টেনে টেনে বলল,"সরি, ডোন্ট টেক আদারওয়াইজ। যদি কিছু ভুল করে থাকি, ক্ষমা করে দিও। আসলে তোমাকে দেখে না আমি মুহূর্ত্যের জন্যে সবকিছু ভুলে গেছিলাম ।”
আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এ কোন বহ্নি? তবে কি দুঃখের আগুনে পুড়ে ও খাটি ইস্পাতে পরিণত হয়েছে? নাকি এসব শুধুই কথার কথা। তবে এই মুহূর্ত্যে বহ্নির কথাগুলো শুনতে আমার খারাপ লাগছিল না। ও তো আমার সম্বন্ধে কতো কথা জিগ্যেসা করল। আমি তো ওর সম্মন্ধে কিছুই জানলাম না। ও ই বা এখানে কী করছে? ও কী আবার বিয়ে করেছে? আজকালকার ছেলেদের কাউকে বিশ্বাস নেই। এতদিন কি আর একা আছে? নিশ্চই কাউকে না কাউকে জুটিয়ে নিয়েছে।
আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বলল,"ভাবছ তো আমি এখানে কেন? তুমি আমাদের ছেড়ে চলে আসার পরে ব্যাঙ্কের পরিক্ষায় বসি। আর প্রথম বারেই বেড়ালের ভাগ্যে শিকেটা ছেড়ে। এখন আমি এই সামনেই একটা গ্রামীণ ব্যাঙ্কে জয়েন করেছি। যাবে?”
বহ্নির কথার ভিতরে কোথায় যেন একটা আত্মবিশ্বাস এর সুর শুনতে পাই। যে সুর টা শোনার জন্যে এতটাকাল অধীর অপেক্ষায় বসেছিলাম।
সব অভিমান ভুলে বলি,"কোথায়?”
"এই তো এখান থেকে খুব বেশীদূর নয়। বড়োজোর মিনিট কুড়ি লাগতে পারে।”
আমার এদিকটা সেই ভাবে আসা হয়ে ওঠেনি। তাছাড়া এই মুহূর্ত্যে আমার কোথাও যাওয়ার ছিল না। তাই বহ্নির কথায় কেমন করে যেন রাজি হয়ে গেলাম। বললাম,"চল, যাওয়া যাক। তবে সন্ধ্যার আগে আগে কিন্তু আমায় ফিরতে হবে।”
"কেন, কাউকে কথা দেওয়া আছে?”
'সে একপ্রকার বলতে পারো।” আমিও হেঁয়ালির হাসি ছড়িয়ে দিলে বললাম।
বহ্নি সামনে একটা ট্রেকার দাঁড় করিয়ে তাতে আমাকে নিয়ে উঠে বসল। মেল্লি বাজার ছাড়াতেই কয়েকটা নেপালি বাচ্চা তাদের মায়ের সাথে ট্রেকারে উঠল। ভারী মিষ্টি দেখতে বাচ্চাগুলো। একটা বাচ্চার গালদুটো যেন আপেলের মতো। আমি অবাক হয়ে বাচ্চারটার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে বহ্নি আমার হাত টিপে কি একটা ইঙ্গিত করল।
ভারী অসভ্য তো! আমি কটমট করে ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হানলাম। বহ্নি মাথা নাড়তে নাড়তে বলল,"নে বাবা, আমার দোষটা কোথায় বুঝলাম না।”
"সরি, বাবাকে আর এর ভিতরে এনো না। সামনে তাকাও।”
"সরি ম্যাডাম, এই মুখে কুলুপ আটলাম। আজকাল তো কথা বলা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি।”
কিছুটা পথ পেরতেই সামনে তিস্তা বাজার । আমাদের নামিয়ে দিয়ে ট্রেকারটা চলে গেল।
আমি বহ্নির সাথে সাথে এগুতে লাগলাম। কিছুটা পথ যাওয়ার পরে একজায়গায় বহ্নি দাঁড়িয়ে পড়ল। বেশ সুন্দর জায়গাটা। দুই দিকে সবুজ পাহাড়। মাঝখানে বেশ চওড়া জায়গা, সেখানে দুইদিক থেকে দুটো নদী এসে মিশেছে। সংযোগস্থলে ডেল্টা আকৃতির বালির চড়া পড়েছে। বেশ কিছু দলকে দেখলাম নদীতে র‍্যাফটিং করছে। বেশ কিছু পর্যটকের ভিড়।
"এটাই কি তাহলে ত্রিবেণী?”
আমি জিগ্যেস করি।
"হুম্ম, অনেকে এই জায়গাটাকে ‘লাভার্স মীট’ ও বলে থাকে।”
আমি দুই নদীর সংযোগ স্থলের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বহ্নি দেখাল,"দেখো দেখো এটা তিস্তা, আর ঐদিক থেকে যেটা এসেছে ওটা হল রঙ্গিত, গ্রেট রঙ্গিত।“
এখানে তিস্তা বেশ খরস্রোতা। দেখলাম, জায়গাটা বেশ শান্ত । দুদিকে খাঁড়া পাহাড়, সেখানে ধাপে ধাপে নানার গাছের সারি। একদিকে কালিম্পং পাহাড় অপরদিকে সিকিম পাহাড়। দেখি তিস্তার জলে নীল আকাশ মুখ দেখছে। বেশ কিছু পাখি বালির চড়ে ওড়াউড়ি করছে। সুর্য ডুবে গেলেও আকাশে নানান রঙ্গের খেলা চলছিল। প্রকৃতির এই সুন্দর রূপ আমাকে মুগ্ধ করল। আমি মোহাবিষ্টের মতো বেশ কিছুসময় তাকিয়ে রইলাম সেই দিকে।
বহ্নি হঠাৎ আমার বেশ কাছে সরে এসে বলল,”তোমার কাঁধে একটা হাত রাখবো?”
আমি ‘না’ বলতে পারলাম না।
............................
 
অলঙ্করণ :-  সহিষ্ণু কুড়ি