সময়ের বিপদ আপদ - সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী


 

সময়ের বিপদ আপদ
সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
 


- “তুমি এখনও ঐ আ -পদ বলে বিচ্ছিরি জিনিসটা ইউজ করছ মা?”
আমার কিশোরী মেয়ে মুনিয়ার মুখে এই কথা শুনে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম।
আমরা সবাই যেসব জিনিসগুলো একেবারে স্বাভাবিক ভাবে দৈনন্দিন ব্যবহারের
তালিকায় রাখি, ওর সেগুলো ঠিক পছন্দ হয় না, এটা জানতাম। ও যত বড় হচ্ছে তত এইসব পছন্দ অপছন্দগুলো প্রকাশ করছে, স্বাভাবিক। এই স্বভাবটা ওর বাবার থেকেই পেয়েছে, বিপ্লব, আমার প্রাক্তন স্বামী। দুনিয়ার এই যন্ত্রসভ্যতায়
ক্রমাগত বদলে যাওয়াকে ঠিক মেনে নিতে পারত না। মুনিয়া যেটা বলছে, সেই আ-পদ অর্থাৎ আণবিক পদার্থ রূপান্তরক যন্ত্রটা এখন ঘরে ঘরে। একটা ভীষণ
কার্যকরী পোর্টেবল কোয়ান্টাম ম্যাটার ট্রান্সমিশন ডিভাইস। আমি সেই কথাই
বলে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করি, “দেখ মুনিয়া এগুলো তো এখন সবাই ব্যবহার করে।
এত সস্তা আর উপযোগী। আ-পদ ছাড়া চলে নাকি?”
- “কিন্তু মা, তুমি বুড়ি হয়ে যাচ্ছ! বুঝতে পার না? সব ঐটার জন্য।”
- “কী বলছিস এসব আবোলতাবোল?”
- “ঠিকই বলছি মা। আসলে তুমি তো অনেকদিন আয়না দেখো না, তাই হয়ত...”
- “আয়নার কী দরকার বল তো? ভি আই পি (ভার্চুয়াল ইমেজ প্রোভাইডার)
থাকতে ওসব অবসোলেট জিনিস কেউ রাখে এখন বাড়িতে? তুই যে কী করে এত
সেকেলে হলি!”
- “দরকার আছে মা। তোমার ঐ ছাতার মাথা ভি আই পি’তে সব মনগড়া
প্রতিবিম্ব দেখায়, চকচকে, ঝকঝকে, তুমি ঠিক যেমনটি দেখতে চাও, তাই
দেখায়। দাগ, ছোপ, কুঞ্চনের লেশ মুছে দিয়ে একশ’ শতাংশ নিখুঁত ছবি! বাস্তব
দেখলে যদি দুশ্চিন্তা করো, তাই।”
- “মুনিয়া! তোকে কে এসব জ্ঞান শেখায় বল তো? তুই কি ভালো হতে চাস না?
এসব উল্টোপাল্টা আচরণ করতে থাকলে তোকে কী করে আবার আমার কাছে
নিয়ে যাব বল তো? জানিসই তো ওয়েব লর্ডের নিয়ম কত কড়া!”
- “হুহ! রাখো তোমাদের ওয়েব লর্ড! একটা না মানুষ না যন্ত্র কিনা গোটা
দেশটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে আর তোমরা বুঝেও বুঝতে পারছ না কী সর্বনাশটা
ঘটছে তোমাদের অগোচরে!”

- “চুপ চুপ! মুনিয়া! প্লিজ এসব আর বলিস না। এই ডিটেনশন চেম্বার থেকেও
তাহলে হয়ত তোকে অন্য জায়গায় ট্রান্সফার করে দেবে। তোর বাবার জেদের
পরিণতি কী হয়েছিল মনে নেই?” আঁতকে উঠি মেয়ের কথা শুনে।
- “দিক গে। কেয়ার করি না। বাবা সাহসী ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, মানুষ ছিল। আই অ্যাম প্রাউড অফ হিম। তা বল, তোমার নতুন বয়ফ্রেন্ড কেমন আছে?” ওর
গলায় প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গের সুর।
- “অর্চি, সে ভালোই আছে, খুব ভালো ছেলে।” মেয়ের কাছে এর বেশি কিছু বলতে
সঙ্কোচ বোধ হয়। অর্চি সত্যিই খুব ভালো। কেয়ারিং, ডমিন্যান্ট নয়, সব
সময় আমাকে খুশি রাখার চেষ্টা করে, শরীরে, মনে। অ্যান্ড্রয়েড মানব বলেই
হয়ত, প্রখর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সম্পন্ন। বিপ্লবের মত অমন
ঝগড়া করে না কক্ষনও। তবে মুনিয়া কোনদিনই ওকে পছন্দ করে না।
- “বেশ বেশ। তুমি ভালো থাকলেই আমিও হ্যাপি। কিন্তু প্লিজ মা, ঐ আ-পদ
টাকে বেশি ব্যবহার কোর না। গাড়ি আছে, স্কাইস্কুটি আছে, নিদেনপক্ষে
হাঁটাচলা করেও তো টুকটাক যাতায়াতগুলো সারতে পার মাঝেমাঝে!”
- “হাঁটা! তোর মাথাটা সত্যিই খারাপ হয়ে যাচ্ছে রে মা। সময়ের কত দাম জানিস
এখন? এই আ-পদে যেভাবে নিমেষের মধ্যে যে কোনও বস্তু এক স্থান থেকে
অন্যত্র স্থানান্তর করা যায়, সেটা হাঁটাচলা করে সম্ভব? আর গাড়ি,
স্কাইস্কুটি সবেতেই তো অনেক বেশি সময় লাগে।”
- “দেখো মা, তুমি হয় ব্যপারটা বুঝতে পারছ না, বা বুঝতে চাইছ না। সময় ওভাবে
বাঁচানো যায় না। ডাইমেনশনের সঙ্গে ছেলেখেলা করলে প্রকৃতি সেটা সহ্য
করে না। তুমি যে সময়টা বাঁচাচ্ছ বলে ভাবছ, সময় ঠিক সেটা তোমার জীবন
থেকে নিয়ে নিচ্ছে। প্রত্যেক নিমেষেই।”
- “উফ! কী সব...”
- “বলতে দাও মা। এটা রিলেটিভিটির সেই বিখ্যাত টুইন প্যারাডক্সের মত
খানিকটা। সেই যে দুই যমজ ভাই, যাদের একজন পৃথিবীতে রইল আর
আরেকজন প্রায় আলোর বেগে রকেটে চেপে মহাশূন্য ভ্রমণে গেল। এবার
যেহেতু আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বে তীব্রবেগে চলমান
রেফারেন্স ফ্রেমে মানে রকেটে সময় একটু ধীরে বইবে, তাই কয়েক বছর পর
পৃথিবীতে ফেরার পর নিশ্চয়ই দেখা যাবে ওখানে থাকা যমজ ভাইটি একটু বেশি
বুড়ো হয়েছে আর রকেটে ঘোরা ভাই একটু বেশি জোয়ান। কিন্তু বাস্তবে
এমনটা হবে না, কারণ এখানেই একটা মজার প্যারাডক্স বা হেঁয়ালি রয়েছে।
কারণ আপেক্ষিকতা অনুসারেই চলমান রকেটের সাপেক্ষে পৃথিবীতে থাকা

ভাইটিও তীব্র বেগে গতিশীল। ফলে সময়কে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। বয়স
দু’জনেরই সমান বাড়বে!”
- “তার সঙ্গে আ-পদের কী সম্পর্ক? এত ভালো একটা যন্ত্র।“
- “সম্পর্ক তো আছেই। প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ। তোমাদের ঐ যন্ত্রে
বস্তুগুলোকে প্রথমে অতিক্ষুদ্র কণিকাতে, তারপর শক্তিতে রূপান্তরিত
করে ফোটন মানে আলোর কণার বেগে এক জায়গা থেকে অভীষ্ট স্থানে পৌঁছে
দেয়, তারপর আবার শক্তি থেকে ভরে বা বস্তু অবস্থায় ফিরিয়ে আনে। কিন্তু
শক্তি আর সময়ের অনিশ্চয়তার সূত্রটা মনে করো। যে কোনও একটা যত
সুনির্দিষ্ট হবে, আরেকটা তত এলোমেলো, অনির্দিষ্ট হবে। এখন এই যে
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সময়ে তোমরা স্থানান্তর করছ, এতে তোমাদের কিছু না কিছু
শক্তিক্ষয় হচ্ছেই, তোমরা তিলে তিলে অকাল বার্ধক্যের দিকে যাচ্ছ মা!”
বলতে নেই, এমন ‘অবান্তর’ কথা শুনেও কেমন যেন শিউরে উঠলাম ভিতরে। সত্যি এমনটা হচ্ছে না তো? যদি একটা আয়না পাওয়া যেত কোথাও... বোধহয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম। মুনিয়ার ডাকে চমকে সম্বিৎ ফিরল।
- “কিছু খুঁজছ মা? এটা চলবে?”
মেয়ের হাতে একটা ছোট্ট হাত আয়না উঠে এসেছে। হাসিমুখে আমার দিকেই
এগিয়ে ধরেছে সেটা। কাঁপা কাঁপা হাতে সেটা ধরতে গিয়ে অস্ফুটে বলতে যাই – “তুই আবার এসব জিনিস এখানে...”
পুরোটা বলতে পারি না। আয়নাটা হাতের মুঠো থেকে খসে পড়ে। ভাগ্যিস মুনিয়ার বিছানাতেই পড়ল, না হলে ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যেত। এ আমি কী দেখলাম! চোখের নিচে কালি, দু’পাশে চামড়া কুঁচকে গেছে। কপালে বলিরেখা! গালের তলায় ত্বক ঝুলে যাচ্ছে! এটা আমি? তাহলে, তাহলে এতদিন যে...
হঠাৎ চেম্বারের ভিতর লাল আলো জ্বলে উঠল। আর সেইসঙ্গে একটা বিচ্ছিরি
কানে তালা ধরানো কর্কশ আওয়াজ। অ্যালার্ম বাজছে। আমি দরজার দিকে
এগোনোর চেষ্টা করার আগেই সেটা খুলে গেল। ভিতরে ঢুকে এল দু’জন সশস্ত্র
যন্ত্রদারোগা, আর, আর... তাদের পিছনে, একী, এ যে অর্চি! ও কী করছে
এখানে? আমি বলার আগেই যেন টেলিপ্যাথিতে প্রশ্নটা বুঝে জবাব দিল ও -

- “তোমায় নিয়ে যেতে এসেছি সোনা। এখানে আবহাওয়া ভালো না। তোমার শরীর খারাপ করবে।” ওর ঠোঁটে সেই পরিচিত হাসিটাই। কিন্তু এখন যেন সেটা বড় ক্রূর লাগছে।
- “কিন্তু, কিন্তু তুমি জানলে কীভাবে যে আমি...”
- “হা হা! কেন, জানতে পারি না?” অর্চির ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টি ঘুরে যায় আমার
মাথার হেলমেট আর হাতে লাগানো ছোট্ট ধাতব যন্ত্রাংশের দিকে। আ-পদ!
তাহলে এটা নজরদারিরও কাজে লাগে? মুনিয়ার কথা যদি আরেকটু আগে
শুনতাম। ইশ! দেরি হয়ে গেছে। আমাকে দু’পাশ থেকে জাপটে ধরে টেনেহিঁচড়ে
নিয়ে যাচ্ছে যন্ত্রদৈত্যেরা। হয়ত আমার বিগত কিছু সময়ের স্মৃতি মুছে দিয়ে
আবার ‘স্বাভাবিক’ করে দেবে... কিন্তু মুনিয়া? ওর কী হবে? ওকে কি আর
দেখতে পাব?
পিছনে দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একটানা কর্কশ অ্যালার্মের আওয়াজটা চাপা
পড়ে যাচ্ছে তার পিছনে। লাল আলোটা আরও তীব্রতর হয়ে আমার চেতনাকে
আচ্ছন্ন করে ফেলার আগে কি তাও বহুদূর থেকে কোনও ‘মা’ বলে ডাক কানে এল আমার?
....................
Saptarshi Chatterjee
 
অলঙ্করণ :-  সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
 
 

 

Comments

Loading... Logging you in...
  • Logged in as
There are no comments posted yet. Be the first one!

Post a new comment

Comments by