অন্ধকারে খুনের খেলা -কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

 



অন্ধকারে খুনের খেলা
কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
 
 
বিল্ডিংটার গা ঘেঁষে বডিটা পড়ে আছে । স্থির, নিথর একটা দেহ । দেখে অ্যাপারেন্টলি মনে হয়, প্রায় থেঁৎলেই গেছে মাথাটা । একটা হাত গুঁজড়ে আছে শরীরের তলায় । ডান পা-টা ভাঁজ হয়ে গেছে, আর বাঁ পায়ের চটিটা খুলে গিয়ে পড়ে আছে একটু দূরে । তবে শরীরের কোথাও কোনও রক্তের দাগ নেই, শুধু মাথাটা কেৎরে আছে বাঁ দিকে, আর সেই মাথার তলার দিক থেকে শুকিয়ে কালো হয়ে যাওয়া রক্তের ধারা খানিকটা দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়ে জমাট বেঁধে রয়েছে ।
একটা নিঃশ্বাস ফেলে সুতীর্থ সান্যাল উঠে দাঁড়াল বডির পাশ থেকে । এস-আই দত্তের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী নাম ভদ্রলোকের ?”
“সেটা তো এখনও জানা যায়নি । এই বিল্ডিং-এর কেউই এঁকে চেনে না বলছে । অথচ এই বাড়িটার ওপর থেকেই যে পড়েছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই ।” সাব ইন্সপেক্টর মলয় দত্ত পাঁচতলা বিল্ডিংটার ওপরদিকে তাকাল ।
সুতীর্থও একবার বিল্ডিংটার ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখল । তারপর ধীরে ধীরে দৃষ্টি নামিয়ে আনল একটু একটু করে । গোটা বাড়িটার সবগুলো তলা জরিপ করে নিচ্ছিল ওর দৃষ্টি । ওদের ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েকজন কনস্টেবল । আর একটু দূরে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল বিল্ডিংটার দু-চারজন লোক আর একজন দারোয়ান । চোখে কৌতূহল, কিন্তু পাশাপাশি মনের মধ্যে ধুকপুকুনি । পুলিশ ওদের এই মুহূর্তে এলাকা ছাড়তে বারণ করেছে । তার মানেই জেরা আর টানাহেঁচড়া চলবে । আর যদি জানা যায় যে এটা মার্ডার, তাহলে তো আর দেখতে নেই ।
সেইসময় দত্ত বলল, “কী বুঝলেন ? সুইসাইড না খুন ?”
সুতীর্থ সোজাসুজি দত্তের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “একটা বাইরের লোক আত্মহত্যা করার জন্যে অচেনা একটা বাড়িতে ঢুকে একেবারে ছাদে চলে যাবে, কথাটা কি বিশ্বাসযোগ্য ?”
“রাইট । আমিও সেটাই ভাবছিলাম মিঃ সান্যাল । তার মানে এই বাড়িরই কেউ একে সঙ্গে করে এনেছে, তারপর ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে খুন করেছে, তাই না ?”
সুতীর্থ অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “হতেও পারে, নাও হতে পারে । কেউ একে নিয়ে এলে দারোয়ান দেখতে পেত না ?”
দত্ত একটু বিব্রত হয়ে বলল, “সেটাই তো সমস্যা । দারোয়ানের ঘরটা থেকে যদিও সিঁড়ি আর লিফটের জায়গাটা দেখা যায়, কিন্তু দারোয়ান তো একে কখনও দেখেইনি বলছে ।” কথাটা বলে দত্ত দূরে দাঁড়ানো লোকটার দিকে তাকাল । সিড়িঙ্গে চেহারা লোকটার । বয়েস পঞ্চাশের ওপরে । ড্রেস পরা না থাকলে একে দারোয়ান বলে ভাবাই যেত না ।
সুতীর্থও গম্ভীরভাবে লোকটার দিকে দেখছিল । গম্ভীর স্বরেই বলল, “হুম, আরেকবার নেড়েচেড়ে দেখতে হবে । এখানকার লোকগুলোকেও একটু বাজিয়ে দেখা দরকার । তবে তার আগে ভিক্টিমের পরিচয়টা …”
“সে কাজ শুরু হয়ে গেছে মিঃ সান্যাল,” দত্ত বেশ প্রত্যয়ের সঙ্গেই বলে উঠল, “মুখের একটা ক্লোজ আপ ছবি তুলে আমি অলরেডি থার্ড অফিসার চৌধুরীকে হোয়াট্‌স-অ্যাপে পাঠিয়ে দিয়েছি । সেটা সমস্ত থানায় পাঠিয়ে লোকটাকে ট্রেস করার চেষ্টা করা হবে ।”
“গুড । আর ডাক্তার কখন আসছেন ?”
“এই তো, এবার এসে যাবেন । উনি দেখে নিলেই বডি পোস্টমর্টেমে পাঠাব । গাড়ি তো রেডি ।”
সুতীর্থ চোখ তুলে গেটের বাইরে দাঁড়ানো কালো গাড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল,“বেশ । তাহলে বডিটা চলে যাওয়ার পরই আমি ওদের সঙ্গে কথা বলব ।” বলতে বলতে বডিটাকে পাশ কাটিয়ে সুতীর্থ বিল্ডিংটার পেছনের দিকে হাঁটা দেয় । গোটা বাড়িটা আগে একবার ঘুরেফিরে দেখে নেওয়া দরকার ।
 
# # # # #
 
সাতসকালেই খবরটা এসেছিল সুতীর্থর কাছে । কলকাতার একেবারে উত্তরপ্রান্তে সদ্য গড়ে ওঠা একটা বিল্ডিং কমপ্লেক্সে একটা লোকের বডি পাওয়া গেছে । সুইসাইড না খুন বোঝা যাচ্ছে না । লোকটার পরিচয়ও জানা যায়নি । নিউটাউন থানার ওসি দীপঙ্কর বোস খবরটা দিয়ে বলেছিলেন, “কাইন্ডলি আপনি একবার ওখানে যান মিঃ সান্যাল । দত্ত অলরেডি চলে গেছে ওখানে । কিন্তু কোনও থই পাচ্ছে না । প্লিজ আপনি যদি একটু হেল্প করতে পারেন ।”
বছর তিনেক আগে থেকে ওসি দীপঙ্কর বোসের সঙ্গে পরিচয় সুতীর্থর । তখন উনি এই নিউটাউন থানার দায়িত্বে ছিলেন না । ছিলেন বেহালা থানায় । ওখানেই একটা কেসে জব্বর ফেঁসে যাওয়া অবস্থা থেকে তাঁকে উদ্ধার করে সুতীর্থ । তারপর থেকেই ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠতে সময় লাগেনি । এমনকি এর পরেও নানা কেসে সুতীর্থ তাঁকে টুকটাক সাহায্য করেছে বিভিন্নভাবে । কাজেই এবারেও তাঁর এই অনুরোধ ও ফেলতে পারেনি । ঠিকানা জেনে নিয়ে হাজির হয়েছে এখানে ।
বড় রাস্তা থেকে একটু ভেতরে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় বিল্ডিংটা । আশেপাশে যদিও আর কোনও বাড়ি এখনও নেই, কিংবা সীমানা নির্দিষ্ট করে কোনও পাঁচিল দেওয়া হয়নি এখনও, তবে চারপাশের অবস্থা দেখে মনে হয়, এদিকে ওদিকে আরও কিছু বিল্ডিং তৈরী হবে । কারণ জায়গায় জায়গায় বালি, সিমেন্ট আর ইঁটের স্তূপ রাখা । সম্ভবত একটা গোটা কমপ্লেক্সই হয়তো গড়ে উঠবে জায়গাটা ঘিরে, আর তার প্রথম বিল্ডিং এটাই । যদি খুনই হয়ে থাকে, তাহলে খুনী খুব ভালো জায়গাই বেছে নিয়েছে বলতে হয় । নিশ্চিন্ত নিরূপদ্রব একটা জায়গা । কারও চোখে পড়ার কোন সম্ভাবনাই নেই ।
ঘুরতে ঘুরতে বাড়িটার পেছনদিকে চলে গিয়েছিল সুতীর্থ । এদিকটাও একদম ফাঁকা, আর বেশ নোংরা । প্রচুর রাবিশ পড়ে আছে কিছুটা জায়গা জুড়ে । আশ্চর্য ব্যাপার ! এটা যদি খুনই হয়ে থাকে, তাহলে খুনী তো ভিক্টিমকে ধাক্কা মেরে এইদিকে ফেলতে পারত । তাতে তো রিস্ক আরও কম হত ! তা না করে বিল্ডিং-এর পাশের দিকে ফেলল কেন ? তার মানে কি খুনী একেবারেই নিশ্চিন্ত ছিল যে কেউই দেখতে পাবে না ? নাকি ঠিকমতো পজিশন পায়নি ? যেখানে সুযোগ পেয়েছে, সেখানেই ধাক্কাটা দিয়েছে ?
আর যদি এটা সুইসাইড হয় ? তাহলে তো বোঝাই যাচ্ছে, লোকটা অগ্রপশ্চাৎ কিছু বিবেচনা না করেই ঝাঁপ দিয়েছে । এরকম মানসিক অবস্থায় যেটা খুবই সম্ভব । কিন্তু আত্মহত্যা কিংবা খুন, যেটাই হোক, মূল সমস্যা হল লোকটা বাইরের লোক । এরকম বাইরের একটা লোক কীভাবে বাড়িতে ঢুকল, সেটার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত জট খুলবে না । আর তার জন্য এ বাড়ির যে-কটা লোক আছে, তাদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেরা করাটা খুব দরকার । ভাবতে ভাবতে বিল্ডিংটা ঘুরে সামনের দিকে চলে এল সুতীর্থ । আর তখনই তার চোখে পড়ল, ডাক্তার এসে গেছেন । মৃতদেহটা টেনে চিৎ করে শুইয়ে পরীক্ষা করছেন । তার মানে আর খুব একটা দেরি হবে না । ডাক্তারের প্রাথমিক পরীক্ষা হয়ে গেলেই বডি চলে যাবে পোস্টমর্টেমে । তারপর সুতীর্থ তার জেরা করার কাজ শুরু করে দিতে পারবে । একবার কব্জি উল্টে হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে একটা সিগারেট ধরাল সুতীর্থ । তারপর একবার ছাদটা ঘুরে আসার জন্য পা বাড়াল । সকালের আবহাওয়াটা বেশ ভালো । সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে । অথচ এর মধ্যেই একটা লোকের অপঘাত মৃত্যু । জীবন কী আশ্চর্য !
 
# # # # #
 
আধঘন্টার মধ্যেই সব প্রসিডিওর শেষ করে বডি নিয়ে চলে গেল পুলিশ । একজন কনস্টেবল শুধু রয়ে গেল দত্তর সঙ্গে । বিল্ডিং-এর যে লোকগুলো দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের দিকে তাকিয়ে এবার দত্ত ঘোষণা করল, “আপনারা শুনুন । এই বাড়ির সমস্ত ফ্ল্যাটের যারা যারা আছেন, তাদের প্রত্যেককে একে একে আমরা ডাকব । যা জিজ্ঞাসা করা হবে, তার উত্তর দেবেন । কোনকিছু লুকোবার চেষ্টা করবেন না, যা জানেন তাই বলবেন । ভয় পাওয়ার কিছু নেই, সত্যি কথা বললে আপনাদের কোনও ক্ষতি হবে না । কিন্তু কিছু লুকোবার চেষ্টা করলে আমরা ছেড়ে দেব না । মনে থাকে যেন ।”
কথাটা বলার পর দত্ত একবার সুতীর্থর দিকে তাকাল, ওর সমর্থন পাবার আশায় । সুতীর্থ মৃদু হেসে মাথা নেড়ে জানিয়ে দিল, সব ঠিক আছে । তারপর চিন্তিতমুখে দত্তর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “কিন্তু আমরা বসব কোথায় ?”
দত্ত মিনিটখানেক চুপ করে কী যেন ভাবল । তারপর বলল, “গ্রাউন্ড ফ্লোরে একটা হলঘর আছে, মোটামুটি বড়ই । বিল্ডিং সংক্রান্ত মীটিং-ফিটিং ওই ঘরেই অ্যারেঞ্জ করা হয় । আপাতত এই দারোয়ান ভদ্রলোকওই ঘরেই আছেন । ওখানেই ব্যবস্থা করি ?”
সুতীর্থ মাথা নেড়ে সায় দিতে দত্ত কনস্টেবলকে ইশারা করে এগিয়ে গেল দাঁড়িয়ে থাকা দলটার দিকে । তারপর দারোয়ানের সঙ্গে দু-একটা কথাবার্তার পর তারা ঢুকে গেল বিল্ডিংয়ের সামনের গেটটা দিয়ে । সুতীর্থ পিছন ফিরল । সবকিছু রেডি হলে দত্ত ওকে ডেকে নেবে । ততক্ষণ আরেকটু খুঁটিয়ে এখানটা দেখে নেওয়া যাক, যদি কোনও ক্লু পাওয়া যায় ।
বিল্ডিংয়ের ঠিক নিচেটায় খানিকটা খোলা উঠোন । শান বাঁধানো । প্রায় গোটা বাড়িটাই চারপাশে এই উঠোন দিয়ে ঘেরা । চওড়া উঠোনটার সীমানা ঘিরে বেশ কিছু গাছ লাগানো । ফুলের গাছ আর বাহারি গাছ । আর গাছগুলো শুধু এই সামনের দিকে আর পাশের দিকেই লাগানো হয়েছে । বিল্ডিংটার পেছনদিকে কোনও গাছপালা নেই । তবে গাছগুলোর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, অনেকদিন আগে গাছগুলো কোনক্রমে লাগানো হয়েছিল, তার পর থেকে সেরকম যত্ন নেওয়া হয়নি । তাই এর মধ্যে বেশ কিছু আগাছাও জন্মে গেছে ।
অবস্থা দেখে আপনমনে মাথা নাড়ল সুতীর্থ, তারপর উঠোনের যেখানে বডিটা পড়ে ছিল, সেখানটায় এল । বডির চারপাশ ঘিরে একটা দাগ টেনেছিল পুলিশ । এখন সেই দাগটা আর শুকনো রক্ত ছাড়া আর কিছুই নেই সেখানে । এপাশে ওপাশে নজর করে দেখতে দেখতে বেশ কিছুটা সময় নষ্ট হল । কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না । ইতিমধ্যে বেশ চড়া রোদও উঠে গেছে । অগত্যা গাছের ছায়ার দিকে এগিয়ে গেল সুতীর্থ ।
আর ঠিক তখনই এক ঝলকের জন্য তার চোখে পড়ল, ঘাস আর আগাছার মধ্যে কী যেন একটা চকচক করে উঠল । নেহাৎ কৌতূহলের বশে পায়ে করে আগাছা সরিয়ে দেখতেই চোখে পড়ল, একটা মোবাইল ফোন পড়ে আছে । কার ফোন ? নিশ্চয়ই ওই লোকটার ! ওপর থেকে পড়ার সময় বুকপকেট থেকে ছিটকে এসে পড়েছে এই আগাছার মধ্যে ! তাই পুলিশ এর খোঁজ পায়নি । চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠল সুতীর্থর । যাক, এখানে আসার পর থেকে কেসটা নিয়ে যেভাবে হতাশ হয়ে পড়ছিল, ভেবেই পাচ্ছিল না কোনদিক থেকে শুরু করবে, এবার তা থেকে মুক্তি । এই মোবাইল থেকেই অজানা কোনও সূত্র পাওয়া গেলেও যেতে পারে । আজই দত্তকে দিয়ে এই ফোনের ডেটা চেক করাতে হবে, বিশেষ করে কল লিস্ট । রুমালে জড়িয়ে ফোনটা তুলে নিয়ে পকেটে ঢোকাল সুতীর্থ ।
 
# # # # #
 
পাঁচতলা বিল্ডিং । প্রত্যেক তলায় এদিকে ওদিকে দুটো করে মোট দশটা ফ্ল্যাট । তার মধ্যে মাত্র চারটে ফ্ল্যাটে এখন পর্যন্ত লোক এসেছে । দোতলায় একটা অবাঙালি ফ্যামিলি, পাঁচতলায় নিয়োগী দম্পতি, আর তিনতলার দুটো ফ্ল্যাটই বুক্‌ড । একদিকে ফ্যামিলি নিয়ে আছেন মিঃ অরূপ বিশ্বাস, আর অন্যটায় পজেশন নিয়েছেন মলি মিত্র বলে এক ভদ্রমহিলা । যদিও তিনি নিয়মিত এখানে বাস করেন না, মাঝে মাঝে আসেন । গত সপ্তাহের মাঝামাঝি তিনি শেষবার এখানে এসেছিলেন ।
অগত্যা সুতীর্থ বাকি তিনটে ফ্ল্যাটের লোকজনকেই এক এক করে ডেকে পাঠাল । প্রথমে দোতলার মিঃ অরোরার ফ্যামিলি । ভদ্রলোক সোনার কারবারী, বউবাজারে তাঁর নিজস্ব গয়নার দোকান । আর তাঁর স্ত্রী নিতান্তই গৃহবধূ, সাতেপাঁচে থাকেন না । আট বছরের একটা বাচ্চাকে সামলাতেই ব্যস্ত থাকেন । কাজেই তাঁদের কাছ থেকে কোনও খবরই উদ্ধার করা গেল না । শুধু জানা গেল, গতকাল মিঃ অরোরা দোকান থেকে ফিরে আসেন রাত আটটার সময় । তাঁর নিজের একটি গাড়ি আছে, নিজেই চালান । একতলার গ্যারেজেই সেই গাড়ি রাখা থাকে । রোজকার মতো গতকালও মিঃ অরোরা দোকান থেকে ফিরে এসে গাড়ি গ্যারেজ করে সরাসরি দোতলায় উঠে যান । তারপর আর বেরোননি । তাঁর স্ত্রী আর ছেলেও ঘরেই ছিল । না, রাতে কোন অস্বাভাবিক কিছু তাঁরা দেখেননি বা শোনেননি । আর এই মৃত ভদ্রলোককেও তাঁরা কোনদিন দেখেননি । কাজেই চেনার কোনও প্রশ্নই ওঠে না ।
এরপর তিনতলার অরূপবাবুর ফ্যামিলি । অরূপ বিশ্বাস সরকারী চাকুরে । তাঁর স্ত্রী ও একটি ছেলেকে নিয়ে থাকেন । ছেলের বয়েস চব্বিশ কি পঁচিশ বছর । সে-ও চাকরি করে, তবে তার চাকরি একটা প্রাইভেট ফার্মে । গতকাল অরূপবাবু ও তাঁর স্ত্রী সন্ধে থেকে ঘরেই ছিলেন, টিভি দেখছিলেন । আর ছেলে রোজকার মতো অফিসফেরত ক্লাবে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরেছে রাত দশটায় । তারাও কেউ অস্বাভাবিক কিছু দেখতে বা শুনতে পাননি । আর ভিক্টিমকে তাঁরাও চেনেন না ।
দেখেশুনে ক্রমশই হতাশ হয়ে পড়ছিল সুতীর্থ । কোথাও কোনও ক্লু-ই কি পাওয়া যাবে না ? দুটো ফ্যামিলির সঙ্গে কথা বলার পরও এখন পর্যন্ত প্রায় কিছুই জানা যায়নি । শুধু একটু সন্দেহের আভাষ পাওয়া গেছে অরূপবাবুর ছেলে অভিলাষের আচরণে । সে বড্ডো তাড়াহুড়ো করছিল অফিস যাবে বলে । কোনরকমে প্রশ্নের উত্তরগুলো দিয়ে চলে যেতে পারলেই যেন বাঁচে । কিন্তু কেন ? এই প্রশ্নটাই মাথায় ঘুরঘুর করছিল সুতীর্থর ।
তবে একটু পরেই পাঁচতলার নিয়োগী দম্পতির সঙ্গে কথা বলার সময় অন্য একটা খবরে একটু চাঙ্গা হয়ে উঠল সে । রিটায়ার্ড ব্যারিস্টার মিঃ নিয়োগী আর তাঁর স্ত্রী দুজনেই নিপাট ভালো মানুষ । নিঃসন্তান দম্পতি তাঁরা, কোনও ছেলেমেয়ে হয়নি । বহুদিন ধরে ভবানীপুরে ভাড়া থাকার পর এখানে ফ্ল্যাট কিনে উঠে এসেছেন মাস দুয়েক হল । তাঁরা থাকেন পাঁচতলায় । রোজ রাত্রে নটার মধ্যে ডিনার সেরে নিয়ে তাঁরা ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখেন । কালও তাই দেখছিলেন । তার মধ্যেই কোনও একটা সময়ে নাকি তাঁরা একটা আওয়াজ শুনেছিলেন । সম্ভবত কেউ বা কারা ছাদের দরজাটা খুলেছিল । ছাদটা কমন, তাই যে কোনও ফ্ল্যাটের বাসিন্দাই যে-কোন সময় ছাদে উঠতে পারেন । আর পাঁচতলার ঠিক ওপরেই সেটা থাকায় ছাদের দরজা খোলা বা বন্ধের শব্দ নিয়োগীদের ফ্ল্যাট থেকে ভালভাবেই শোনা যায় । তবে শব্দটা শুনলেও ওঁরা খুব একটা গুরুত্ব দেননি, কারণ বাইরের ব্যাপারে ওঁরা খুব একটা মাথা গলান না ।
কিন্তু এই খবরটা সুতীর্থকে বেশ চাঙ্গা করে তুলল । কারণ এতক্ষণে ঘটনার সময়টা মোটামুটি আন্দাজ করা গেল । এবার দেখতে হবে ওই রাত নটার আশেপাশে দারোয়ান কোথায় ছিল । সুতীর্থ নিয়োগী দম্পতিকে বিদায় দিয়ে দারোয়ানকে ডেকে পাঠাল ।
 
# # # # #
 
সন্ধের একটু পরে নিউটাউন থানায় বসে ছিল সুতীর্থ । বিকেলের মধ্যেই অনেকগুলো খবর এসে গেছে ওসি দীপঙ্কর বোসের হাতে । সেগুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্যেই সুতীর্থকে ডেকে পাঠিয়েছেন তিনি ।
ওসির মুখে খবরগুলো শুনতে শুনতে সুতীর্থ বুঝতে পারছিল, সবকটাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খবর । প্রথমত, বডির সঙ্গে থাকা জিনিষপত্রের মধ্যে কোনও সুইসাইড নোট পাওয়া যায়নি । কাজেই সম্ভবত এটা খুনই । খুব ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে খুন ।
দ্বিতীয়ত, বালিগঞ্জ থানার সোর্স থেকে পাওয়া গেছে ভিক্টিমের পরিচয় । ভদ্রলোক ওই এলাকাতেই থাকতেন, নাম নীলাভ সরকার । একজন পার্টনারের সঙ্গে ইলেক্ট্রিক্যাল গুডসের ব্যবসা ছিল তাঁর । বেশ ভালোই পসার ছিল ব্যবসার । তবে ইদানীং নাকি পার্টনারের সঙ্গে খুব বেশি বনিবনা হচ্ছিল না । যাঁর সঙ্গে ব্যবসার শেয়ার ছিল নীলাভর, সেই বন্ধুর নাম পরিতোষ দাস । ইতিমধ্যে তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করে খোঁজখবরও নিয়ে নিয়েছে পুলিশ । তাতে জানা গেছে যে, গতকাল সন্ধে সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত পরিতোষ কাটিয়েছেন কলকাতার একটা ক্লাবে । এই অকাট্য অ্যালিবাই থাকার ফলে এই খুনের ব্যাপারে তাঁকে জড়ানো যাচ্ছে না ।
আর তৃতীয় সংবাদ, ওই মোবাইলের ডেটা থেকে যা উদ্ধার করা গেছে, তাতে নিউটাউনের ওই বাসিন্দাদের কারও সঙ্গে কোনও যোগাযোগের কথা আবিষ্কার করা যায়নি । বিল্ডিংয়ের সবার ফোন নম্বরই নিয়ে রেখেছিল পুলিশ । চেক করে দেখা গেছে, তাদের কারও নম্বরই নীলাভ সরকারের ফোনে সেভ করা নেই বা সেইসব ফোন থেকে কোনও ফোন আসেওনি, যায়ওনি । তবে একটা রহস্যময় নাম্বার পুলিশ পেয়েছে, যেটি নীলাভর ফোনে সেভ করা ছিল ; এমনকি গতকালও সেই নাম্বার থেকে ফোন এসেছে এই ফোনে । কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, এখন সেই নাম্বারটির নাকি আর কোনও অস্তিত্ব দেখাচ্ছে না ।
এই শেষের খবরটাই সুতীর্থর কাছে সবচেয়ে রহস্যময় বলে মনে হল । গতকালও সেই নম্বর থেকে ফোন এসেছে ভিক্টিমের কাছে, অথচ আজ আর নম্বরটার কোনও অস্তিত্ব নেই !
তাহলে কি এই ফোনের মালিকই সেই অজানা খুনী ? কাজ মিটে যাওয়ার পর সিমটা নষ্ট করে ফেলেছে ? কিন্তু সে কে ? আর নীলাভকে খুন করার কারণ কী তার ?
প্রশ্নটা মনে আসতেই সুতীর্থ নিজের মনেই হেসে ফেলল । কী ছেলেমানুষের মত কথা ভাবছে সে । খুনের কারণ জানলে কি আর খুনীকে ধরতে এত মাথা ঘামাতে হত ? আসলে এটা একটা বেসিক থিওরি । শতকরা নিরানব্বই ভাগ কেসেই খুনের মোটিভটা জানলেই খুনীর আন্দাজ পাওয়া সহজ হয়ে যায় । কাজেই এখানেও খুনী কে সেটা জানার আগে খুনের কারণটা জানতে হবে ।
দীপঙ্কর বোস ওকে হাসতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার ? আপনি হাসছেন যে ?”
সুতীর্থ একটু বিব্রত হয়ে বলল, “স্যরি মিঃ বোস । আসলে হঠাৎ ছেলেমানুষের মত একটা কথা মনে এল, তাই হেসে ফেললাম ।” এই বলে হাসার কারণটা বলল । তারপর দুহাত তুলে একটা আড়মোড়া ভেঙে বলল, “ওক্কে মিঃ বোস । আজ তাহলে ওঠা যাক । কাল পোস্টমর্টেমের রিপোর্টটা এলে আমাকে ফোন করবেন ।”
মিঃ বোস অবাক হয়ে বললেন, “সেকি ? উঠবেন মানে ? বললাম যে আজ আমার সঙ্গে ডিনার করে বাড়ি ফিরবেন !”
সুতীর্থ বলল, “ডিনার ? এখানে ? কে রাঁধবে দাদা ?”
“ধুর মশাই । আজকাল আবার কোনও কাজের জন্য সমস্যা হয় নাকি ? আপনার পকেটে যদি টাকা থাকে, আর হাতে থাকে একটা স্মার্ট ফোন, তাহলে আপনি দুনিয়ার সবকিছু করে ফেলতে পারেন ঘরে বসেই । এই তো, এখানে বসেই সুইগিতে অর্ডার করে দিলাম । নটা বাজলেই চলে আসবে মাটন বিরিয়ানি আর চিকেন কষা । কী বলেন, চলবে তো ?”
কথাটা বলে দীপঙ্কর বোস সুতীর্থর দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তার ধারালো চোখদুটো স্থির হয়ে গেছে । মাথার মধ্যে যেন ঘুরপাক খাচ্ছে একটা জটিল চিন্তা । ভাবতে ভাবতেই সুতীর্থ বলে উঠল, “আচ্ছা মিঃ বোস, এই যে আপনি বললেন, এখন টাকা আর ফোন থাকলে ঘরে বসেই সব কাজ সেরে ফেলা যায় । সেটা তো এ ক্ষেত্রেও হতে পারে, তাই না ? এইভাবেই তো মার্ডারও করে ফেলা যায় !”
“অবশ্যই যায়,” মাথা নেড়ে সায় দেন ওসি, “লোকে তো সুপারি দিয়ে আজকাল খুন করাচ্ছে । নিজের হাতে কালি না মেখে প্রফেশনাল কিলারকে দিয়ে …”
“আর তার ফলে অনেক সময় আসল অপরাধী ধরাও পড়ছে না, তাই না মিঃ বোস ?”
দীপঙ্কর বোস থমকে গিয়ে গভীর চোখে তাকিয়ে বললেন, “কী বলতে চান আপনি ?”
“মিঃ বোস, ওই যে আননোন নাম্বারটা, যেটা থেকে ভিক্টিমের কাছে ফোন এসেছিল, তার পুরো কললিস্ট চেক করিয়েছেন ? মানে ভিক্টিমের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, এমন কারও সঙ্গে ওই নাম্বার থেকে কোনও যোগাযোগ হয়েছিল কিনা ?”
“মাই গুডনেস ! সেটা তো করা হয়নি !” বলেই টেবিলে রাখা কলিংবেল টিপলেন দীপঙ্কর বোস । তারপর সুতীর্থর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার সন্দেহটা কী মিঃ সান্যাল ? তাহলে কি …”
সুতীর্থ মৃদু হেসে বলল, “আশা করি বুঝতেই পারছেন আমি কার কথা ভাবছি । দেখা যাক আমার অনুমান মেলে কিনা ।”
ইতিমধ্যে সেকেন্ড অফিসার দত্ত ঘরে ঢুকেছিল । দীপঙ্কর বললেন, “দত্ত, ওই আননোন নাম্বারটার কললিস্ট চেক করাতে কতক্ষণ লাগবে ?”
দত্ত একটু ইতস্তত করে বলল, “তা … কয়েক ঘন্টা তো লাগবেই স্যার । এমনিতেই রাত হয়ে গেছে, তারপর এমন হঠাৎ করে …”
“বেশ । যা সময় লাগে লাগুক, তুমি এখনই বলে দাও যেন ইমিডিয়েটলি শুরু করে । আর হ্যাঁ, ভিক্টিমের সঙ্গে রিলেটেড যতজনের নাম্বার পেয়েছ, সকলের নাম্বারের সঙ্গে চেক করতে বোলো ।”
দত্ত মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেলে দীপঙ্কর বোস চেয়ারের পিছনে হেলান দিয়ে বসলেন । সুতীর্থর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এবার ?”
সুতীর্থ অল্প হেসে বলল, “এবার খাবারের প্রতীক্ষা ।”
# # # # #
ভোর সোয়া ছটায় মোবাইলের রিংটোনে ঘুম ভাঙল সুতীর্থর । ফোনটা চোখের সামনে এনে দেখল, ওসি দীপঙ্কর বোস । সুইচ টিপে সাড়া দিতেই তাঁর উত্তেজিত গলা, “মিঃ সান্যাল, সাংঘাতিক ব্যাপার । ভাবতেও পারবেন না কী খবর পেয়েছি ।”
সুতীর্থ বলল, “কী খবর ? আমরা যা ভাবছিলাম তাই তো ? মানে ওই আননোন নাম্বার থেকে পরিতোষের ফোনে কল হয়েছে তো ?”
“ইয়েস ইয়েস । সেটা তো আমরা আন্দাজ করেইছিলাম, কিন্তু আর একটা খবর যেটা পেয়েছি, সেটা শুনলে অনুসন্ধানী সুতীর্থ সান্যালও রীতিমতো শক্‌ড হবেন । সেটা কী জানেন ? শুধু পরিতোষই নয়, ওই ফোন থেকে নীলাভ সরকারের স্ত্রীয়ের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে কয়েকবার ।”
“তার মানে ?” প্রায় চেঁচিয়ে উঠল সুতীর্থ ।
“সেটাই তো ধাঁধার মতো লাগছে মিঃ সান্যাল । শুনুন, পরিতোষকে তুলে আনা হচ্ছে থানায় । আপনি কি আসবেন ?”
সুতীর্থ একটু চিন্তা করে বলল, “নাঃ । আমি আর যাচ্ছি না । আপনারা আপনাদের কায়দায় পরিতোষের থেকে কথা আদায় করুন । আমি বেলার দিকে ফোন করছি আপনাকে ।”
ফোন রেখে দিয়ে একঝাঁক দুশ্চিন্তা নিয়ে হাবুডুবু খেতে লাগল সুতীর্থ । অনেকগুলো প্রশ্ন এখন পরপর জমা হচ্ছে ওর মনে । গতকাল পর্যন্ত নীলাভর বিজনেস পার্টনার পরিতোষ দাসই ছিল ওদের টার্গেট । কারণ নীলাভকে খুনের পেছনে এরই মোটিভ ছিল সবচেয়ে জোরালো । কিন্তু যেহেতু খুনটা হয়েছে রাত নটা থেকে দশটার মধ্যে, আর সেইসময় পরিতোষ ছিল স্পট থেকে অনেক দূরে, তাই তার ওপর সন্দেহ হবার কোনও কারণ নেই ।
কিন্তু সত্যিই কি তাই ? যদি এরকম হয় যে সে নিজে দূরে বসে থেকে কাউকে দিয়ে খুনটা করাতে চাইল ? ওসির ঘরে বসে এমনই একটা সম্ভাবনার কথা মাথায় এসেছিল সুতীর্থর । আর তাই সে ওই আননোন নাম্বারের কললিস্ট চেক করাতে চেয়েছিল ।
এখন দেখা যাচ্ছে ওর অনুমান নির্ভুল । তার মানে ওই নাম্বারের মালিককে পরিতোষ চেনে । আর সে যে নিউটাউনের ওই বিল্ডিংয়েরই কেউ, এ ব্যাপারেও কোনও সন্দেহ নেই । কে জানে, হয়তো তিনতলার অরূপবাবুর ছেলে অভিলাষই সেই অজানা খুনী !
যদিও দারোয়ান নীলাভকে ওখানে কারও সঙ্গে ঢুকতে দেখেনি, কারণ গতকাল দারোয়ানের কথা থেকে জানা গেছে যে, সাড়ে আটটার পর দারোয়ান বাইরে রুটি কিনতে গিয়েছিল, আর ভিড় ছিল বলে বেশ দেরি হয়েছে তার ফিরতে । আর ঠিক ওই সময়ের মধ্যেই খুনটা ঘটেছে । কাজেই দারোয়ানের তা জানার কথাও নয় । তবে দারোয়ান দেখুক বা না দেখুক, অনুমানের ভিত্তিতে যতদূর এগোনো গেছে, তার মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে কোনও ফাঁক ছিল না ।
কিন্তু এই নতুন খবরটা ! ওই নাম্বার থেকে নাকি নীলাভর স্ত্রীকেও ফোন করা হয়েছিল ! এটাই তো সমস্ত যুক্তিবুদ্ধিকে ওলটপালট করে দিচ্ছে । যদি অভিলাষ সেই খুনী হয়, অর্থাৎ পরিতোষের কথায় বা তার থেকে সুপারি নিয়ে সে খুন করে থাকে, সেই খুনের সঙ্গে নীলাভর স্ত্রীর সম্পর্ক কী ? তবে কি নীলাভর স্ত্রীর সঙ্গে অভিলাষের গোপন অবৈধ সম্পর্ক ছিল ? নাকি আসলে নীলাভর স্ত্রীই সেই মেঘনাদ, যে মেঘের আড়াল থেকে খুনটা করাতে চেয়েছে ? সে ক্ষেত্রে পরিতোষের ওপর ওদের সন্দেহ কি ভুল ?
সুতীর্থ আবার মোবাইলটা তুলে নিল হাতে । ওসি দীপঙ্কর বোসকে ধরল । তারপর বেশ কিছুক্ষণ ধরে শলা পরামর্শ হতে থাকল তাদের মধ্যে ।
 
# # # # #
 
পরের দিন সন্ধে সাতটা । উল্টোডাঙার মুচিবাজারে রাস্তার ওপর একটা জীপ এসে থামল । ওসি দীপঙ্কর বোস জীপ থেকে নেমে এগিয়ে গিয়ে সামনের দোতলা বাড়িটার সদর দরজার কড়া নাড়লেন । তাঁর পেছনে সুতীর্থ আর দুজন কনস্টেবল ।
দরজা খুলে দাঁড়ালেন একজন মাঝবয়েসী ভদ্রলোক । পুলিশ দেখেই হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, “কী ? কী ব্যাপার ? আপনারা … ?”
দীপঙ্কর স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যে প্রশ্ন করলেন, “এখানে মিস মলি মিত্র থাকেন ?”
“হ্যাঁ … কিন্তু …”
“তিনি আছেন বাড়িতে ?”
ভদ্রলোক ঘাড় নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ আছে । ওই তো, একতলার ওদিকে …” আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলেন । ওরা এগিয়ে গেল ।
মলি মিত্রর ঘরের দরজা বন্ধ । ধাক্কা দিতে দরজা খুলল, আর খোলামাত্রই স্পষ্ট ফ্যাকাশে হয়ে গেল তাঁর মুখ । দীপঙ্কর বোস একটু হেসে বললেন, “কী মিস মিত্র ? আমাদের আশা করেননি, তাই না ?”
জোর করে হাসার চেষ্টা করে মলি বললেন, “না, মানে পুলিশ কেন …”
সুতীর্থ এবার সামনে এগিয়ে এসে বলল, “ঘরে চলুন, বলছি ।”
সবাই একে একে ঘরে এসে ঢুকল । প্রথম প্রশ্ন সুতীর্থই করল, “মিস মিত্র, আপনি নীলাভ সরকার নামে কাউকে চেনেন নাকি ?”
মলি মিত্র ততক্ষণে নার্ভাস ভাবটা প্রায় কাটিয়ে ফেলেছে । কোনরকমে উচ্চারণ করল, “নীলাভ … সরকার …”
এবার কড়া গলায় দীপঙ্কর বললেন, “দেখুন মিস মিত্র, নাটক করবেন না । আজ থেকে তিনদিন আগে আপনার নিউটাউনের ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে নীলাভ সরকারকে আপনি ছাদ থেকে ফেলে খুন করেছেন । বলুন ঠিক কিনা ?”
এরকম জোরালো আক্রমণে কী বলবেন তা প্রথমে ঠিক করে উঠতে পারছিলেন না মলি মিত্র । তারপরেই তাঁর চোখদুটো জ্বলে উঠল । প্রায় মরিয়ার মতো বলে উঠলেন, “তার মানে ? কী বলছেন কী আপনারা ? খুন !! কেন ? আমি খুন করব কেন ? আর এসব ফালতু অভিযোগ আপনারা …”
“একদমই ফালতু অভিযোগ নয় মিস মিত্র,” সুতীর্থ কঠিন স্বরে বলে ওঠে, “যথেষ্ট প্রমাণ নিয়েই আমরা আপনার কাছে এসেছি । যার সুপারি নিয়ে আপনি কাজটা করেছেন, সেই পরিতোষ দাসই সবকিছু স্বীকার করেছেন ।”
এবার সমস্ত প্রতিরোধ এক নিমেষে শেষ হয়ে যায় মলি মিত্রের । হিসহিসিয়ে বলে, “পরিতোষ দাস ?”
“হ্যাঁ মিস মিত্র । তবে শুধু এই তো প্রথম নয়, এর আগেও আপনি বাবলু হাজরা বলে আর একজনের কাছ থেকে সুপারি নিয়ে বড়বাজারের এক ব্যবসায়ীকে খুন করেছিলেন, তাই না ?”
“ক্কে ? কে বলল ?” তোতলায় মলি মিত্র ।
দীপঙ্কর বোস বলেন, “আমাদের হাতটা অনেক বড় মিস মিত্র । কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কীভাবে কেউটে পাকড়ে ফেলি, তা আমরা নিজেই বুঝে উঠতে পারি না । এই যেমন আমরা জেনে গেছি যে ওই বাবলু হাজরার কাছ থেকেই পরিতোষবাবু আপনার ফোন নাম্বার পেয়েছিলেন । তারপর আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকার বিনিময়ে এই মার্ডারের কন্ট্র্যাক্ট করেন । আর আপনি শুধু এই কাজটা করার জন্য কিছুদিনের জন্য একটা ফোন নাম্বার ব্যবহার করেছিলেন । তারপর কাজ মিটে যেতে সেদিন রাতেই সেটা নষ্ট করে ফেলেন । ঠিক কিনা ?”
কথাটা বলে দীপঙ্কর বোস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকান মলির দিকে । তার তখন কথা বলার অবস্থা নেই ।
আবার কথা শুরু করেন দীপঙ্কর, “আর একটা কথা কী জানেন মিস মিত্র, ঠিকমতো একটা সূত্র পেলে প্রমাণ যোগাড় করার জন্য আমরা অনেক কিছুই করে ফেলতে পারি । যেমন ধরুন আপনার কেসটাতেই । খবর পাবার পর আপনার অজান্তেই আপনার নিউটাউনের ফ্ল্যাটের চাবি খুলিয়ে নিয়ে আমরা আপনার ফ্ল্যাট সার্চ করেছি । আর সেখানেই বেসিন থেকে আপনার নষ্ট করে দেওয়া ফোন আর সিমের পোড়া অংশ উদ্ধার করেছি আমরা । সেইসঙ্গে ওই ঘরের সেন্টার টেবিলের একটা অংশ থেকে পাওয়া গেছে নীলাভর আঙুলের ছাপ । এর পরেও কি আর কোনও প্রমাণ চাই মিস মিত্র ?”
মলি মিত্র এতক্ষণ দাঁড়িয়েই ছিলেন । এবার ধপ করে বসে পড়েন বিছানায় ।
মুখ খোলে সুতীর্থ, “কিন্তু শুধু এটাই কারণ নয় মিস মিত্র । নীলাভকে খুন করার পেছনে আর একটা কারণ ছিল আপনার, তাই না ? আর সেই কারণটা হলেন মিসেস অঞ্জনা সরকার, নীলাভর স্ত্রী । আসলে আপনার সঙ্গে মিসেস অঞ্জনার এক গোপন সম্পর্ক ছিল । আপনারা ছোট থেকে এক পাড়ায় থাকতেন, হয়তো তখন থেকেই এই সম্পর্ক, যেটা এখনও বজায় আছে । এমনকি মাঝেমাঝেই দুপুরের দিকে আপনি তাঁর বাড়ি যেতেন, এ খবরও আমরা পেয়েছি । এখন নীলাভকে মার্ডার করার সুপারি পেয়ে যেতে আপনি আর অঞ্জনা, দুজনেই হাতে চাঁদ পেলেন । নীলাভর সম্পত্তি এসে যাবে অঞ্জনার হাতের মুঠোয়, আর সেইসঙ্গে আপনাদের অবাধ মেলামেশারও আর কোনও অসুবিধে থাকবে না । ফলে আপনি এক ঢিলে দু পাখি মারার প্ল্যান করলেন । কিন্তু অপরাধ করা যে অত সহজ নয় মিস মিত্র । যেভাবেই হোক, কিছু না কিছু চিহ্ন তার রয়েই যায় । যেমন আপনার ওই নষ্ট করে দেওয়া ফোন । যদি শুধুমাত্র নীলাভর সঙ্গেই আপনি ওই ফোন থেকে কথা বলতেন, তাহলে হয়তো আপনি আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যেতেন । কিন্তু তা থেকে আপনি পরিতোষ আর অঞ্জনা দেবীর সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলেন, আর সেটাই আপনাকে ধরিয়ে দিল । তবে চিন্তা করবেন না, আপনার সঙ্গে পরিতোষ দাস আর অঞ্জনা সরকারকেও লক-আপে পোরার ব্যবস্থা আমরা করেছি । কাস্টডিতে আপনার সঙ্গীর অভাব হবে না ।”
সুতীর্থ চুপ করে । সুন্দরী মলি মিত্রর চোখেমুখে তখন একরাশ অন্ধকার নেমে এসেছে, রাতের আকাশের মতো ।
---------------------------------------------------------
Krishnendu Bandyopadhyay
 
অলঙ্করণ :-  সহিষ্ণু কুড়ি 
 

 

Comments

Loading... Logging you in...
  • Logged in as
There are no comments posted yet. Be the first one!

Post a new comment

Comments by