টুম্পা বিশ্বাস লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
টুম্পা বিশ্বাস লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

খেলাঘর - টুম্পা বিশ্বাস

 

খেলাঘর
টুম্পা বিশ্বাস 
 

 


ঘুম ভাঙতেই বিছানা ছেড়ে করে উঠে বসল অবন্তী। পায়ের পাতাটা নামিয়ে দিল ঠাণ্ডা মেঝেতে। মেঝেটাকে ছুঁয়ে সে বুঝতে চাইল যে তার স্বপ্নটা ভেঙে গেছে। ছোটবেলা থেকেই একটা মানসিক ব্যাধির শিকার সে। রাতের পর রাত বিভিন্ন ধরনের, বিচিত্র আদলের দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে অবন্তী,প্রায়ই । এখন এতটা বয়স হল, তবুও দুঃস্বপ্নের থাবা থেকে নিজের ঘুমটাকে বাঁচাতে পারেনি সে। বয়সের সাথে সাথে দুঃস্বপ্নের তীব্রতা, রঙ, গন্ধ, স্পর্শ বদলেছে কেবল ।

ছোটবেলায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে দেখতো যে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে প্রশ্ন সব চেনা অথচ তার কাছে কোন কলম নেই। কারো কাছে চেয়েও সে কলম পাচ্ছে না। তাই চেনা প্রশ্নের জানা উত্তরগুলো খাতা অব্দি লেখা হয়ে উঠছে না আর। 

স্কুলের গন্ডি পার হবার পর যখন পৃথিবীটা সবে একটু একটু করে আরও বড় হচ্ছিল, যখন কলেজের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে থাকা বড় বড় কৃষ্ণচূড়ার গাছগুলোতে ফুল ফুটলে মনে হতো যে ওরা বুঝি অবন্তীর জন্যই ফুটছে,যখন মনটা আরেকটু রঙিন  হচ্ছিল, পরিণত হচ্ছিল অবন্তীর, তখন প্রায়শই সে স্বপ্ন দেখত,তার পছন্দের যুবককে সে মনের ভাব ব্যক্ত করতে গেছে আর যুবক জানাচ্ছে যে সে ইতিমধ্যেই অন্যের কাছে দায়বদ্ধ। সেই স্বপ্ন এতবার দেখেছে অবন্তী যে শেষমেশ আর যুবককে মনের কথা জানানোই হয়ে ওঠেনি কোনদিন।  

তারপর একসময়  শিক্ষাগত যোগ্যতাকে ঝুলিতে ভরে  বারবার, বিভিন্ন ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে বসতে হয়েছে অবন্তীকে। প্রত্যেক ইন্টারভিউয়ের আগের রাত্তিরে ঘুমোতে ভয় পেয়েছে অবন্তী। প্রহর গুনেই রাত কাটিয়েছে সে। তার মাঝে যখনই তন্দ্রা এসেছে চোখের পাতায়, তখনই অবন্তী দেখেছে কর্তৃপক্ষের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষগুলোর সামনে তাকে নাজেহাল হতে হচ্ছে। কখনো কখনো দেখেছে ইন্টারভিউ বসেছে পাহাড়ি গুহায়। একবার এমনও দেখেছিল অবন্তী যে, প্রশ্নের জবাব দিতে না পারায় তাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে ইন্টারভিউ রুমে।

স্বপ্নগুলো জেগে থাকা অবস্থায় যতটাই হাস্যকর মনে হোক না কেন, ঘুমের পর্দার আড়ালে সেগুলো হৃদপিণ্ডটাকে জোরে চেপে ধরত। মনে হত শ্বাসরোধ করে মারবে তারা অবন্তীকে।

আজও ঘুম ভাঙতে একটু সময় লাগল অবন্তীর,ধাতস্থ হল ধীরে ধীরে। ঘুমের শেষ ছোঁয়াটুকু মুছে নিয়ে চোখ মেলে ও তাকিয়ে রইল অভিনবর মুখের দিকে। ঘুমন্ত অভিনব এখনও শান্তির দেশে। অবন্তীর দুঃস্বপ্নের অস্থিরতা টের পায়নি ও।বিয়ের পর পর যখন অবন্তী ঘুম ভেঙে বিধ্বস্ত হয়ে বিছানায় উঠে বসত মাঝরাতে, অভিনব তখন স্নেহের স্পর্শে অবন্তীর ভয়,আতঙ্ককে লাঘব করে দিত।তারপর একসময় একঘেয়ে হয়ে যায় ব্যাপারটা।এখন অভিনবর আঙুল অভিযোগের ভঙ্গিতে ওঠে অবন্তীর দিকে।
"সারাদিন মাথার মধ্যে যত নেতিবাচক কথা নিয়ে খেলা করো।সেগুলোই স্বপ্নে ফিরে আসে।জীবনের রোদ নিয়ে, সুগন্ধ নিয়ে ভাবো,দেখবে দুঃস্বপ্ন পালাবে।"
অবন্তী যুক্তিটা বোঝে। কিন্তু মনের মধ্যে চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালানো আশঙ্কার তীরগুলো, দুশ্চিন্তার কালো হাতগুলো অবন্তীকে ইতিবাচক হতে দেয় না।
একটু তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে আজ।অনেকটা দূরের পথ।কিন্তু দূরত্বটা সমস্যা নয়।মনের মধ্যে দুলতে থাকা প্রশ্নগুলোই সমস্যা। আদৌ কি গিয়ে লাভ হবে কিছু? 

এই প্রথম অভিনবকে না জানিয়ে এতবড় সিদ্ধান্ত নেওয়া। বিয়ের পর থেকে অভিনব এত বেশি অবলম্বন দিয়েছে যে অবন্তীর মনটা লতানে গাছের মতো হয়ে গেছে। শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াবার প্রয়োজনটাই আর বোধ করা যায় না।

অথচ বিয়ের আগে পর্যন্ত অবন্তীকে লড়তে হয়েছে বাঁচার জন্য।তিয়াসাকে বারবার রাস্তাঘাটে, পাড়ায় বেপাড়ায় উত্যক্ত করত বলে সুবিনয়কে একবার প্রচন্ড অপমান করেছিল অবন্তী।ব্যাপারটা পুলিশ অব্দি গিয়েছিল।লোকসমাজে মাথা নীচু হয়ে যাওয়ার কারণে সেসময় কত হুমকি দিয়েছে সুবিনয়।ফোনে,নামবিহীন চিঠিতে।তবু পাখির মতো ডানা ছড়িয়ে বোনকে আড়াল করে গেছে অবন্তী।তার আগে বাবা চলে যাওয়ার পর মার যাবতীয় প্রাপ্য, পেনশন সব যোগাড় করে এনেছে। সব কাগুজে জটীলতা মিটিয়েছে নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে। তারপর চাকরিটা জোটার পর নিজের পাগুলো শক্ত মাটি পাবে ভেবে হাঁফ ছেড়েছিল মনে মনে।অথচ তারপরও জীবনের একটা ভুল সিদ্ধান্ত আবার নড়বড়ে করে দিয়েছিল মনের ভিতর থাকা মাটির কুঁড়ে ঘরটাকে।

সেসময় কত রাতে স্বপ্নে শিউরে উঠত।দেখত কে যেন তার গায়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে অ্যাসিডের ধারা।ও পালাতে চেয়েও পারছে না।বহুদিন পর্যন্ত ওর ধারণা ছিল যে সুবিনয় এত সহজে ওকে ছেড়ে দেবে না।পুরো পরিবারটার অস্তিত্বের ওপরই ঝুলে থাকত এক অদৃশ্য প্রশ্নচিহ্ন। কবে, কোন সু্যোগে নেমে আসবে খাঁড়া, অহরহ এটাই ছিল অবন্তীর ভাবনা।

কিন্তু তেমন কিছুই হল না।জীবন নিজের খাতেই বয়ে চলল।তিয়াসা নিজের পছন্দের জীবনসঙ্গী বেছে নিয়েছে। অমল সত্যি সহৃদয় যুবক।শাশুড়ি একা মানুষ হওয়ার সুবাদে সে তিয়াসাকে হরণ করে নিয়ে যায় নি বিয়ের পর। তিয়াসা বাপের বাড়িতেই থাকছে।অমল নিজের বাড়ি আর শ্বশুর বাড়ির তাল মিলিয়ে দু বাড়িতেই বসত করে ঘুরেফিরে।

বোনটার থিতু হওয়ার পর অবন্তীও বেছে নিয়েছে অভিনবকে।বৃক্ষের মতো,ছাদের মতো,ছাতার মতো অভিনব সাথে থেকেছে, রক্ষা করেছে।আজ অবশ্য অভিনবর অজান্তেই অবন্তী যাবে গল্পের পুরনো পাতাগুলো আরও একবার উল্টে দিতে।অফিসে যাওয়ার নাম করে অবন্তী বেরোয়।অভিনবও অফিসের জন্য তৈরী হচ্ছিল। অভিনবর পরিণত চোখগুলো অবন্তীর মধ্যে কিছু অসহজতা টের পেল।
"আজ একটু এলোমেলো লাগছে তোমায়?শরীর ঠিক আছে?" অভিনব জানতে চায়। 
"হ্যাঁ,ঠিক আছে। " কোনরকমে জবাব দেয় অবন্তী,অসহজ হয়েই।
"আর মন?" অভিনবর গভীর দৃষ্টি মাপতে থাকে অবন্তীকে।
"মনের কথা নিয়ে অত মাথা ঘামালে চলে?তুমিই তো বলো মনকে কম গুরুত্ব দিতে।" একটু খোঁচা লুকিয়ে থাকে অবন্তীর কথায়। 
"তাহলে মানছো যে মন খারাপ? "

এরপর আর অবন্তী সাড়া দেয়নি।এর বেশি বললে অভিনব ঠিক তার কাছ থেকে সত্যিটা আদায় করে নেবে।অবন্তী তাই নিজের কাজগুলো গুছিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।এখন বাসের জানলার ধারের জায়গাটা দখল করে বসে সে বাতাসের আদর খেতে খেতে রওনা হচ্ছে তার আজকের গন্তব্যের দিকে। মাত্র একটা সপ্তাহ তাকে আবার নতুন নতুন দুঃস্বপ্নের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যদি মনামির সাথে সেদিন হঠাৎ দেখা না হতো তাহলে এই চিন্তার ঢেউ তার জীবনে আছড়ে পড়ত না।

সেদিন অফিস থেকে বেরোতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল। তার ওপর বাসও পাওয়া যাচ্ছিল না কোন কারণে। অবশেষে যে বাসটা এল তাতে চড়তে হলে রীতিমতো শক্তি প্রদশর্ন করতে হবে।উঠবে কিনা ভাবতে ভাবতেই অবন্তী হাতের ওপর একটা চেনা স্পর্শ পেয়েছিল।মনামির সাথে সেই বিয়ের আগে দেখা।মনামি চাকরি পেয়েছিল অবন্তীর বছর খানেক আগে।সেই সূত্রেই মনামি ব্যাঙ্গালোর চলে যায়। অবন্তীর বিয়েতেও থাকতে পারেনি।

সেদিন হঠাৎ দেখা হওয়ার রেশটা দুজনের কেউই হঠাৎ করে মিলিয়ে যেতে দিতে চায়নি।তাই একটা রেস্তোরাঁর ছিমছাম, নিরিবিলি পরিবেশে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ হাতে দুজনে বসেছিল মুখোমুখি। ছেড়ে আসা মেয়েবেলার খুনসুটির গল্প শেষ হতেই চায় না।সেসবের মধ্যেই বর্তমান এসে পড়ে। মনামি এখনও স্বাধীন,অবিবাহিতা। পায়ে শিকল পরে নি।অবন্তী সুখী গৃহস্থের হাসি মুখে লেপে অভিনবর ছবি দেখিয়েছিল মুঠোফোনে। ছবিটা দেখে মনামি একটু স্তব্ধ হয়েছিল।

অবন্তী কারণ জানতে চাইলে মনামি আহত কন্ঠে জিজ্ঞেস করেছিল,
"বিয়ের আর লোক পেলি না?"
এ কথার পরে হয়ত পুরনো বন্ধুত্বকে তালা বন্দী করে সেই মুহূর্তেই অবন্তী চলে আসত।হয়ত আর কোনদিন মনামির মুখদর্শনও করত না।কিন্তু মনামি আর অবন্তী ছোটবেলা থেকে একসাথে শৈশব,কৈশোর আর যৌবন ছুঁয়ে বড় হয়েছিল। আমের আচার আর স্বাবলম্বিতার স্বপ্ন একসাথে ভাগাভাগি করে বেঁচেছিল তারা।কাজেই হঠাৎ মনামির এমন মন্তব্যের কারণ কি তা জেনে নেবার আগ্রহ অবন্তীকে দিয়ে প্রশ্ন করিয়ে নিয়েছিল।

"একথা কেন বলছিস?অভিনব আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছে। তার আগে পর্যন্ত আমি শুধু লড়েই গেছি।সমাজের সাথে, ভাগ্যের সাথে, নিজের দারিদ্র্যের সাথে। অভিনব এসে আমাকে শিখিয়েছে লড়াই করার পর শান্তি নেমে আসে।সেই শান্তি সংসারকে ঘিরে থাকে পাখির ডানার মতো।ও ছাড়া আমি অচল।"

সেদিন মনামি অবন্তীর এই আবেগের স্রোত দেখে স্মিত হেসেছিল।তারপর খানিকটা বিষাদ কন্ঠস্বরে মেখে নিয়ে বলেছিল,

"আমাকে ভুল বুঝিস না।আমি তোকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। সুবিনয়ের সাথে সেই সরাসরি লড়াইয়ের দিনগুলোতেও দেখেছি তুই তিয়াসাকে বাঁচাতে কি প্রাণপণে লড়েছিস। তোর সম্মানবোধ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তাই আবার অভিনবকে বেছেছিস দেখে আজ অবাক হলাম।"

অবন্তী মনামির কথাবার্তার যুক্তিটুকু বুঝতে পারছিল না।সে অবাক হয়েই জানতে চেয়েছিল, 
"সুবিনয়ের সাথে অভিনবর কি সম্পর্ক?"

মনামিও অবাক হয়েছিল এরপর।
"তুই জানিস না?সুবিনয়ের বাড়ির বিশাল বড় হলঘরটা ওদের অফিসঘর বা বৈঠকখানা বলতে পারিস।ওর বাবা তো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মকর্তা। হাজার মানুষ ওদের বাড়ি যায় প্রয়োজনে,অপ্রয়োজনে।আমিও একবার গিয়েছিলাম।ওদের ওই হলঘরের দেওয়াল জুড়ে বিশাল বড় ছবি আছে ফ্রেমে বাঁধানো। ছবিতে সুবিনয়ের সাথে কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে অভিনব।ওরা নাকি আশৈশব বন্ধু। "

কথাটা অবন্তীর মাথাটাকে টলোমলো করে দিয়েছিল।ঠিক যেভাবে ঢেউ দোলায় পালতোলা নৌকাকে তেমনই তার ভাবনাগুলো দোল খাচ্ছিল অস্থিরতায়।তবে কি অভিনব সুবিনয়ের সাথে তার সংগ্রামের কথা জানে না?কিন্তু না জানলেও কেন এতদিনের সহাবস্থানের পরও কোনোদিন সে অবন্তীকে তার আশৈশব বন্ধুর কথা বলে নি খেলাচ্ছলেও?

আজ তাই সুবিনয়ের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় অবন্তী।ভেবেছিল দারোয়ানের ঘর থেকেই ফিরতে হবে।সুবিনয় বাড়িতে ঢোকার প্রবেশাধিকার দেবে না।কিন্তু দিল।দারোয়ান ফোনে অবন্তীর পরিচয় জানানোর পরই তাকে ভেতরে যেতে বলা হয়।

বসবার ঘরটা একতলাতেই। বাড়িতে ঢোকার পর ওটাই সামনে পড়ে। ছবিটাও সসম্মানে দেওয়াল আলোকিত করছে,এখনও।সুবিনয় ঘরে ঢোকে খানিকটা বাদেই। 
-কেমন আছেন অবন্তী?এতদিন বাদে এখানে কি মনে করে? 
সুবিনয়ের গলায় পুরনো শত্রুতার রেশমাত্র নেই। 
-নিতান্ত প্রয়োজনেই এসেছি,অপ্রয়োজনে আসার সম্পর্ক তো নেই। 
অবন্তীর তিক্ততায় সুবিনয় হাসে।কিছু বলে না।অবন্তী ফের বলে,
-আমি এতদিন সুখী ছিলাম।ভেবেছিলাম লড়াইয়ের পাট চুকেছে,এবার শুধু শান্তি। কিন্তু সপ্তাহ খানেক আগে জানতে পারলাম যার হাত ধরে সুখের সন্ধানে চলেছি এতকাল সে বোধহয় শত্রুপক্ষের চর।অভিনব কেন আমাকে বিয়ে করেছে সুবিনয়?তাকে কাজে লাগিয়ে কি আপনি আমার পরিবারের আরও বড় ক্ষতি করবেন?আপনার অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়েও সে আমার আর আপনার বিরোধের কথা না জেনে আমাকে বিয়ে করেছে এটা তো বিশ্বাসযোগ্য নয়।

এতখানি বলে অবন্তী হাঁপাতে থাকে।সুবিনয় তাকে শান্ত হতে সময় দেয়।তারপর মৃদু,মোলায়েম সুরে বলে,
-আংশিক জানাটা ভালো নয়।পুরোটা শুনুন তবে।অভিনবকে আমি কাজে লাগাই নি।ও আমাকে কাজে লাগিয়েছিল।
আপনার প্রতি ওর মুগ্ধতা পাগলামির শেষ সীমা পেরিয়ে গিয়েছিল।কিন্তু পরিবারকে অগাধ জলে ডুবিয়ে আপনি যে ওর হাত ধরবেন না তা ও খোঁজ নিয়ে জেনেছিল।
বাবার মৃত্যুর পর আপনি যেভাবে তড়িঘড়ি পরিবারের হাল ধরেছিলেন তা দেখে ওর মুগ্ধতা আকাশ ছোঁয়।তিয়াসার বিয়ের ভার আপনার ওপর অথচ সে নিয়ে আপনার মাথাব্যথা নেই। তা দেখে ও আমাকে উত্যক্ত করে,ছক আঁকে।আমি তিয়াসাকে বিরক্ত করলে আপনি ওর জন্য পাত্র খুঁজতে শুরু করবেন এটাই ও ভেবেছিল।
আপনি যে পুলিশে চলে যাবেন তা ও ভাবেনি।আমার ওপর নানা কারণে ওর অনেক উপকার,দাবী।তাই ওর পাগলামিতে সায় দিয়ে কিছু অপ্রিয় কাজ করেছি।কিন্তু আপনি যদি ওকে ভুল বুঝে সরে যান তাহলে ও হয়তো নিজেকেই মুছে ফেলবে। যা পাগল ও! 

সে রাতে অভিনব বাড়ি ফিরলে অবন্তীকে দেখে অবাক হয়।বড় যত্ন নিয়ে সেজেছে অবন্তী।সিল্কের শাড়ি,চোখে কাজলের মায়া।বহুদিন বাদে সেদিন অবন্তীর গলায় সুর খেলা করে।
"খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি আমার মনের ভিতরে
কত রাত তাই তো জেগেছি বলব কী তোরে।।"
 
--------------------------- সমাপ্ত ----------------------------
 
অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি 
 

 

ভুবনডাঙার হাট - টুম্পা বিশ্বাস

 

ভুবনডাঙার হাট
টুম্পা বিশ্বাস  


           আমি আশুতোষ মল্লিক,মধ্যবয়সী,সুচাকুরে,গৃহস্থ।মোটের ওপর শান্তির জীবন। তবে সুখ শান্তি সবটাই আপেক্ষিক। মানুষের স্বভাবই এমন যে সে সবেতেই অসন্তুষ্ট,খানিকটা শুঁয়োপোকার মতো,তার কেবল প্রজাপতি হবার সাধ,তার চাই খোলা আকাশ।

         আমি বরাবরই ভ্রমণপিয়াসী। ঘরের চারদেয়ালে বন্দী থেকেই জীবনের বেশিটা কাটে বলেই বছরে বার দুয়েক অন্তত আমাকে বেরোতে হয়।তবে নাম না জানা, লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা কোন অখ্যাত স্থানই আমার পচ্ছন্দ। দৈনন্দিন ভীড় থেকে পালাতে গিয়ে পর্যটকদের ভীড়ে গিয়ে পড়া,সে আমার পোষায় না।ফাঁদে পড়া জীবন আর ফাঁদে পড়া ভ্রমণ -দুই ই আমার কাছে অসহনীয়। 

         আজকাল ইন্টারনেটের যুগে অবশ্য এমন জায়গা পাওয়া ভার।পৃথিবী যেখানে মুঠোফোনে বন্দী সেখানে অখ্যাত জায়গা!আমি তবু চেষ্টা ছাড়ি না।কখনও ট্রেনের টাইম টেবিল কখনও গুগল বাবাজীর সহায়তা-মোট কথা পচ্ছন্দ মত জায়গা আমার খুঁজে বার করা চাই।একবার খবর পেলাম কোলকাতা থেকে ৩৫কিমি দূরে একটি জায়গার,নাম চন্দ্রকেতুগড়।বিদ্যাধরী নদীর তীরে অবস্থিত জায়গাটি নাকি মোটামুটি লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল,হালফিলে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে জায়গাটি খানিকটা প্রকাশ্যে এসেছে। তা হলেও জনগন এখনও ওখানে হামলে পড়ে না।

         সেবার পুজোর ছুটিতে ওখানেই উপস্থিত হলাম সপরিবারে, মানে স্ত্রী অনুরাধা আর ছেলে অর্ণবকে নিয়ে।আমার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে উঠলাম।ঐতিহাসিক জায়গাগুলি দেখে নিলাম পরেরদিনই।সমস্ত জায়গা জুড়ে বিভিন্ন স্তূপ, ঢিপি।এগুলোর নাকি ঐতিহাসিক গুরুত্ব অসীম। বিভিন্ন যুগের নিদর্শন নাকি পাওয়া গেছে এখানে। খনা মিহিরের ঢিপিটা দেখতে দেখতে মনটা কোন অতীতে চলে গিয়েছিল!!তাছাড়া জায়গাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেও মোহিত হলাম।সভ্যতার লোভী থাবা এখনও জায়গাটাকে গ্রাস করেনি।এখনও এখানে আকাশ গাঢ় নীল। নদীর ধারে হেঁটে নির্মল বায়ুসেবন করে যেন শহুরে ধোঁয়া ভর্তি ফুসফুসগুলো হাঁফ ছেড়ে বাঁচত।

        একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে ফিরলাম বন্ধুর বাড়ি।একদিন সন্ধ্যেবেলা আড্ডা দিচ্ছিলাম বারান্দায় বসে।আড্ডার বিষয়বস্তু ছিল- আশেপাশে আর কি কি দ্রষ্টব্য আছে।বন্ধুর কাছেই খবর পেলাম এখান থেকে আরো তিন চার কিমি দূরে একটা গ্রামে একটি সাপ্তাহিক হাট বসে প্রতি বুধবার। গ্রামের নাম ভুবনডাঙা।নামটাতেই আটকে গিয়েছিলাম।তাই হাটে যাওয়া মনস্থির করলাম পরেরদিন।পরেরদিনই ছিল বুধবার।তবে সেখানে নাকি কোন যানবাহনে যাওয়া চলবে না।জঙ্গলের ধার ঘেঁষে গ্রামটির অবস্থান। তাই হয় সাইকেল নাহয় পায়ে হাঁটা।আমার কাছে শেষোক্তটিই শ্রেয় মনে হল।

         গ্রাম্য হাট দেখতে আগ্রহ ছিল না বাকিদের।ছেলে আর তার মা যেতে রাজী হল না,হাঁটার ভয়েই বোধহয়।বন্ধুর থেকে পথনির্দেশ নিয়ে আমি একাই রওনা দিলাম।পথ খোঁজার মধ্যেও আনন্দ আছে।লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে হাট খুঁজে নিলাম।হাটে পৌঁছে দেখি আর পাঁচটা গ্রাম্য হাটের মতোই।বেশিরভাগ হাতের তৈরী জিনিস নিয়ে বসেছে গ্রামবাসীরা।ভীড় নেই। দোকানীরা যেন আড্ডার মেজাজে, বিক্রি না হলেও চিন্তা নেই। এদিককার অধিবাসীদের মূল জীবিকা নাকি চাষাবাদ।কাজেই হাটটা হয়ত জীবন মরণের প্রশ্ন নয় ওদের কাছে।

         জঙ্গলের সীমা দেখা যাচ্ছিল অনতিদূরেই।মনে হচ্ছিল খানিকটা জঙ্গল সাফ করেই যেন এই হাট বসানোর ব্যবস্থা করেছে গ্রামবাসীরা।যেহেতু এখানে পর্যটকদের আনাগোনা নামমাত্র সেহেতু বেশিরভাগ নিত্য ব্যবহারের সামগ্রীই বিক্রি হচ্ছিল ।বেতের চুপড়ি,সস্তা প্লাস্টিকের আয়না ইত্যাদি।কিন্তু পরিবেশটা বড় মনকাড়া। নীল আকাশের ক্যানভাসে দোকানীরা যেন রঙ তুলিতে আঁকা। দেখলাম খদ্দেররা দোকানীদের সাথে আড্ডায় মশগুল। 

         খানিকটা এগিয়ে দেখি এক কিশোরী পসরা সাজিয়ে বসে আছে।মায়াময় মুখ।আনমনা দৃষ্টি। তার পসরায় সুন্দর বেতের তৈরী জিনিস।একটা ফুলদান নজর কেড়েছিল।দাম জানতে চাইলাম।

"আমি এমনি জিনিস বেচি না গো বাবু।খরিদ্দার পচ্ছন্দ হলে তবেই বেচি।"

ওর কথায় হকচকিয়ে গিয়ে আমি বললাম, 
"এমন কথা তো শুনিনি কখনও।তা বল কিভাবে পচ্ছন্দ কর খরিদ্দারকে?"

"বাবু তোমার সবচেয়ে বড় দোষ কি? "

"দোষের কি অভাব আছে?তা হঠাৎ দোষের কথা কেন?"

"প্রশ্নের উত্তর প্রশ্নে হয় না বাবু।জবাব দাও।"

"রাগলে আমার মাথার ঠিক থাকে না,কি করি,কি বলি তার হুঁশ থাকে না।এটাই বোধহয় সবচেয়ে বড় দোষ।" খানিকটা ভেবে জবাব দিলাম।

"তাহলে বাবু ওই রাগকেই ত্যাগ করতে হবে।না করলে এ ফুলদান নষ্ট হয়ে যাবে।এই নাও।"

"সে কি গো,আমায় পচ্ছন্দ হয়ে গেল?"আমি অবাক হয়ে জানতে চাই।

"যে এককথায় নিজের দোষ স্বীকার করে তাকে পচ্ছন্দ না করে কি করি?"

         সেদিন ফুলদানটা নিয়ে বন্ধুর বাড়ি ফিরলাম।কিন্তু পুরোটাই যেন ঘোরের মধ্যে হল।এক গ্রাম্য বালিকা কি এ ভাষায় কথা বলে?আমি কি স্বপ্ন দেখলাম?তবে ফুলদানটা পেলাম কোথায়?পরেরদিনই কোলকাতায় ফেরার কথা।খুব যত্ন করে পুরনো খবরের কাগজে মুড়ে নিয়ে এলাম ওটাকে।বাড়ি ফিরে টেবিলে সাজালাম ফুলদানটা।যেই দেখত ওটার প্রশংসা করত।এমনকি দুরন্ত অর্ণবও দেখতাম ওটার দিকে তাকিয়ে বসে আছে।গিন্নী শত কাজ ফেলেও রোজ ওটা সাফ করতে বসত।অতিথিরা জানতে চাইত ওটা কোথা থেকে কেনা।বলাই বাহুল্য সেই কিশোরীর অদ্ভুত কথাবার্তা কাউকেই বলিনি।

         সেদিন দেখি গিন্নী ফুলদানে রজনীগন্ধা সাজাচ্ছেন, বিয়ের পর পর এটা দেখতাম।তারপর সাংসারিক ঘানিতে পিষ্ট হয়ে ওসব শখ চলে গিয়েছিল কবে।মনটা তাজা হয়ে গেল ফুলগুলো দেখে।
"রজনীগন্ধা! কত বছর বাদে!" গিন্নীকে বললাম আমি।
"আজ বেরিয়েছিলাম,রাস্তায় বিক্রি হতে দেখলাম, তাই নিলাম। তুমি তো ভালোবাসো।"গিন্নীর মুখে একটা সলাজ হাসি।যেন ফুলগুলো আনার জন্য লজ্জিত। 
"ভালোবাসি,তোমাকেও।"বললাম। গিন্নীর মুখটা আরো রাঙা হল। 
 এসে আমার মাথায় হাত রাখলেন গিন্নী ,কত যুগ পর।ফুলগুলো আর সাথে ফুলদানটা আমাদের দাম্পত্যের এক মিষ্টি মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইল।
 
         এদিকে আমার সুপুত্রও দেখি কেমন শান্ত হয়ে গেছে। আগে কথা না মানা,অগোছালো স্বভাবের জন্য মায়ের কাছে বকা খেত রোজ।আজকাল দেখি নিয়ম মেনে পড়ে,নিয়ম মতো খেলে,আর অবসরে ফুলদানটার দিকে তাকিয়ে কি ভাবে।একদিন দেখি ওটাকে নিয়ে কবিতাও লিখে ফেলেছে। ভারী ভালো লাগল সেদিন।ছেলেটা একটা অনুভবী মন নিয়ে বড় হচ্ছে।আসলে আমাদের সকলকে ওই সামান্য বস্তুটা মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলেছিল।আর সেই কিশোরী আমার মনের চিলেকোঠার ঘরে বসত করত সবসময়। কি ছিল তার সেদিনের কথাগুলোর মধ্যে, জানিনা।তবে তাকে ভুলতে পারিনি। 

         হ্যাঁ,বলা হয়নি,এ ক'মাস আমি রাগ করিনি একবারও।সবকিছু সুন্দর চলছিল।কিন্তু একদিন ছন্দপতন হল।অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখি গ্রামের বাড়ি থেকে আমার জ্যাঠামশাই এসেছেন। সোফায় বসে চা পান করছেন।সামনে আমার স্ত্রী মৃত্যুদন্ড পাওয়া আসামির মতো দাঁড়িয়ে আছেন।বুঝতে পারলাম জ্যাঠামশাই ইতিমধ্যেই একচোট বক্তৃতা সেরে ফেলেছেন। পুরনো রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল আমার মনে।আমাকে দেখেই জ্যাঠামশাই নতুন উদ্যোগে শুরু করলেন,

"তুই তো নিজের আত্মীয়দের ভুলেই গেছিস।আমার ভাইটা চলে গেল।তারপর তোরা তো বাড়িতে যাওয়াই ছেড়ে দিলি।মনে রাখিস,যারা নিজের গ্রাম,নিজের মানুষকে ভালোবাসতে শেখেনি তারা ঠিকমতো মানুষ হয়নি।"

         আমার চন্ডাল রাগ জেগে উঠল।নিজেকে বলতে শুনলাম, 

"তোমার ভাই যখন দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিল,কদিন খোঁজ নিয়েছিলে?সে যাবার পর নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছিলে কেবল।স্নেহ করেছো যে সম্মানের প্রত্যাশা কর?"

        এটুকুতেই জ্যাঠার মুখ অপমানে নীল হল।উনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, 

"স্নেহের টানেই এসেছিলাম আশুতোষ। "

উনি আর দাঁড়ান নি।আমিও ঘরের দরজা বন্ধ করে নিজের অভিমানের সাথে বোঝাপড়া করেছিলাম।আত্মীয়দের অনাত্মীয়তা আমাকে বরাবর পীড়িত করেছে।সেই পুঞ্জীভূত রাগটাই জ্যাঠামশায়ের ওপর বেরিয়ে এসেছিল।

         পরদিন সকালবেলা ঘুম ভাঙতে মনে হল যে কাল রাতে একটু বাড়াবাড়ি করেছি,অতটা না করলেও চলত।বাড়িতে আসা অতিথির অনাদর ভালো নয়।কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই।তাই রোজকার অভ্যাসমতো ফুলদানটাকে একবার দেখতে গেলাম।দেখি ফুলদান টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। কেউ বলতে পারল না যে সেটা কিভাবে ভাঙল।আমার মনটা তখন ছটফট করছে।কিশোরীর কথা বার বার মনে পড়ছে-রাগ করলে ফুলদান নষ্ট হয়ে যাবে।ইটকাঠের এই পৃথিবীতে কি অলৌকিক কিছু সম্ভব? এ ঘটনার ব্যাখ্যা কি সেটা না জানা পর্যন্ত স্বস্তি পাব না।

         বুধবার অফিস থেকে অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে ছুটি নিলাম।রওনা দিলাম চন্দ্রকেতুগড়ের উদ্দেশ্যে।বাড়িতে বললাম বন্ধু অসুস্থ। ভুবনডাঙার হাটে পৌঁছে কিন্তু কিশোরীর দেখা মিলল না।কিন্তু আমি তখন মরীয়া,আমাকে জানতেই হবে এসবের মানে কি?আশেপাশের বিক্রেতাদের কাছে বর্ণনা করতে তারা কিন্তু সহজেই চিনে নিল কিশোরীকে।প্রথমে কেউ অবশ্য আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে চায়নি।একজন বহিরাগতকে কেনই বা তারা তাদের আভ্যন্তরীণ খবর দেবে?শেষমেশ এক বৃদ্ধা আমাকে সেই ভাগ্যহীনার কাহিনী শোনালেন।আমি তাকে আমার সাথে কিশোরীর আগের দিনের সব কথাবার্তা আর আজকে তার খোঁজ করার কারণ জানিয়েছিলাম। 

"ওর নাম লক্ষী, বাবু।আমরা ডাকতাম লখাই।ভারী সরল মেয়ে, খানিকটা পাগলাটে।ওর মা ছোটবেলাতেই মরে গিয়েছিল। বাবা মাতাল,অন্য কারোর সাথে থাকত।লখাই ওর দাদুর ঘরে মানুষ। 

         তারপর একদিন বাবাটা ফিরে এল।থাকতে চাইল ওর সাথে।সে নাকি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।লখাইয়ের মনটা নরম।ও রাজী হল।কিন্তু শর্ত রাখল। বলল মদ ছাড়তে হবে।ছেড়েওছিল।কিন্তু একদিন কোন অনামুখো বন্ধু এল,তার পাল্লায় পরে আবার মদ খেল আপদটা।লখাই কি কান্নাই কাঁদল।পরেরদিন থেকে কি জ্বর এল মেয়ের।মেয়েটা আর উঠল না।"

         আমি শিউরে উঠলাম। কি জানি কেন আমার মনে একটা অদ্ভুত তত্ত্ব এল।লখাই আমাকে বলেছিল রাগ করলে তার তৈরী ফুলদান নষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ একটি দোষের বদলে একটি বস্তু।আর বাবাকে বলেছিল মদ না খেতে।তার বদলে বাবাকে সে তার আপন সত্তাকে দিয়েছিল।বাবা মদ খাওয়ার ফলেই কি তাহলে তার সেই সত্তা নষ্ট হয়ে গেল? 

         কিন্তু এও কি সম্ভব? মানুষ যুক্তিবদ্ধ জীব।সব রহস্যের মীমাংসা করেই সে শান্তি পায়।অথচ মানুষকে ঘিরে থাকে কত রহস্য।আমার কাছে লখাইও একটি নিরুত্তর প্রশ্নের মতো থেকে গেল আজীবন। 

        এরপর থেকে যখনই কোন অজানা জায়গায় গেছি বেড়াতে, কোন অচেনা মানবীকে প্রকৃতির কোলে বিচরণ করতে দেখেছি,তখনই লখাই আমার মনের মধ্যে ফিরে এসেছে। একবার মাত্র তাকে আমি দেখেছিলাম অথচ তার মুখ আমি ভুলিনি। তার তৈরী করা ফুলদানটা আমি নষ্ট করে ফেলেছিলাম নিজের দোষে,কিন্তু তাকে দেওয়া আমার কথা আমি আর ভাঙিনি।রাগকে আমি ত্যাগ করেছি।তাতে জীবন আমার কাছে স্বমহিমায় এসেছে। আমাকে ভরিয়ে রেখেছে সৌরভে।
...................................
 
Tumpa Biswas