উর্বী রায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
উর্বী রায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

ঝিল-মিল - উর্বী রায়

 

ঝিল-মিল
উর্বী রায় 
 


 


- "মা,ও মা, একটা গল্প বলো না!"
- "গল্প শুনবি? আচ্ছা বেশ, আজ তোকে বরং ঝিলের গল্প শোনাই। "

      কমলাটে-লাল সূয্যিটা লাবডুব লাবডুব করছে, একটু পরেই টুপ করে ডুব দেবে।বিকেলের হাওয়াতে বেশ  একটা শরৎ শরৎ গন্ধ ছড়িয়ে আছে। আউশমাঠটার গায়ে তুলোর মত কুচ্চি কুচ্চি কাশফুলেরা মিঠে হাওয়ায় দোল খাচ্ছে দিব্যি। 
  মাঠের গায়ে,  ঝাপড়া শিউলিগাছের ডালে  টুপড়ি বাসায় টুই টুনটুনি তার মা-টুনির গা ঘেঁষে  ঢুলুঢুলু চোখে বসে আছে। সূয্যিমামা ডুব দিলেই সেও ডুবে যাবে ঘুমনদীতে। কিন্তু তার আগে মায়ের কাছে টুইয়ের গল্প শোনা চাই।
   টুই বলে ওঠে,  
-"ঝিল? ঝিল কে গো?  "
মা-টুনি বলে,
- "ঝিল? ঝিল হলো বড্ড দুষ্টু আর ভীষণ মিষ্টি একটা ঘুড়ি।"
- " ঝিল ঘুড়ি? জানো মা, আমারও একজন ঘুড়িবন্ধু আছে। ও আমাকে বৃষ্টিনাচের বোল শেখাবে বলেছে। 
আচ্ছা , তুমি ঝিলের গল্প শুরু করো।'

   মা-টুনি টুইয়ের মাথায় নরম পালকের আদর বুলিয়ে গল্প শুরু করে,

" ওই যে দূরে, আকাশ জুড়ে রঙবেরঙের ঘুড়িরা উড়ছে,ওদের মধ্যেই ছিলো  দুই ঘুড়িবন্ধু,  একজন নীলঝিলমিল, আর একজন লালজোনাকি। দু'জনের ভারি ভাব ।নীলঝিলমিলের সারা শরীর সাগরনীলরঙা, তারউপর রূপোলী রঙের ঝিকিমিকি তারা। আর লালজোনাকির লালশরীরে রোদ পড়লে জোনাক-আলো ঝলমল করতো। 
   ওদের বয়স ছিলো প্রায় সমান । ঝিল যেদিন বুবকাইদের বাড়ি এলো, তার দু'দিন আগে জোনাকি এসেছিলো শিলুদের বাড়ি। বুবকাই আর শিলুর বাড়ি পাশাপাশি।  তাই ঝিল আর জোনাকিও রোজ একসাথে আকাশে উড়তো। ঝিল হাওয়ায় সাঁতার কাটতো, জোনাকি মেঘেদের সাথে গল্প করতো; আবার জোনাকি চামচিকেদের সাথে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতো, ঝিল আলসে চিলের পিছনে সোঁ করে  ছুটে গিয়ে চমকে দিয়ে আসতো।  
আকাশের বুকে উড়ে বেড়াতে ওদের ভীষণ মজা।ঠিক যেমন আমার টুই উড়তে  মজা পায়। কি তাই তো?"
       টুই জোরে ঘাড় নাড়লো ।বলল,
-" হ্যাঁ,  দারুণ মজা। কি সুন্দর বাতাস বেয়ে আলোয় নেয়ে  যেদিক খুশি ঘুরে বেড়ানো যায়।"
     মা-টুনি কপট  ধমকে বললো,
-" ওরে দুষ্টু!  যেদিক খুশি যাওয়া যায়!আর যেদিক খুশি যেতে গিয়ে হারিয়ে গেলে কি হবে? "
-" না না মা, আমি দূরে যেদিক খুশি যাই না,আমি তো কাছাকাছি যেদিক খুশি যাই। আমি মোট্টেও হারাবো না। তুমি ঝিলের গল্প বলো না...!" 
মা-টুনি হেসে বলে,
-" আচ্ছা বেশ। তো  হাসিতে, আনন্দে, ভালোলাগায় ঝিল- জোনাকির কাটছিলো বেশ দিনগুলো। 
   তারপর তো কাশের বনে শরৎ হাওয়ার দোলা লাগলো, কুমোর ঘরে আলো জ্বললো, দুগ্গামা'র কাঠামোয় মাটির প্রলেপ পড়লো, আর চলে এলো বিশ্বকর্মা পূজো।
      বিশ্বকর্মা পূজো ঘুড়িদের ভারি আনন্দের দিন।  লাল-নীল-বেগনী-গোলাপী বাহারি সব ঘুড়িরা মিলে আকাশখানা ভরে রাখে ।
   ঝিল -জোনাকিও মনের আনন্দে সেদিন আকাশে  উড়ছে, ভাসছে,ছুটছে, সোঁ করে উপরে উঠছে, গোঁত্তা খেয়ে নীচে নামছে, কখনো আবার প্যাঁচ প্যাঁচ খেলছে... সে বেজায় মজার ব্যাপার।
     এমন সময় হলো কি, প্যাঁচ খেলতে গিয়ে হঠাৎ ঝিলের সুতোটা কুট করে গেল কেটে! ব্যাস, ঝিল তখন লাটাই ছেড়ে হাওয়ার ঢেউয়ে উড়ে গেলো।
  জোনাকি প্রথমে বুঝতে পারেনি।যখন বুঝলো,তখন কি লাফালাফি!  ঝিলকে ডেকেই চলেছে,"ঝিল কোথায় যাচ্ছিস? যাস না, আমার জন্য দাঁড়া, আমিও যাবো তোর সাথে..ঝিইইল..."।
  ঝিলের কি আর দাঁড়াবার উপায় আছে? ও তো তখন  হাওয়ায় ভাসছে।  ভাসতে ভাসতে বেশ খানিক দূরেও চলে এসেছে।বুবকাই-জোনাকিরা আবছা হয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেছে। প্রথম দিকে একটু একটু ভয় করছিলো ঠিকই; কিন্তু এখন ঝিলের বেশ মজা হচ্ছে।
  কি সুন্দর  ইচ্ছেমতো উড়ছে ঝিল। কোনো পিছুটান নেই, কোনো বাঁধন নেই।  

   উড়তে উড়তে ঝিল  ভাবলো, সত্যিই তো, জীবনটা তার সুতোতেই বাঁধা ছিলো এতদিন। সে উড়তো ঠিকই,  কিন্তু ইচ্ছেমতো উড়তে পারতো কই! সে ডানে যেতে চাইলে বুবকাই তাকে বাঁয়ে পাঠাতো,পূবে যেতে চাইলে উড়িয়ে দিতো দক্ষিণে।  যখন  ভাবতো ও  মেঘ পেরিয়ে ওইইইইই দূর আকাশে ভেসে যাবে, তখনই সুতোয় পড়তো  হ্যাঁচকা টান।আবার যখন বনবন করে মাথা ঘুরতো, বেশি উঁচুতে যাবার ইচ্ছে মোট্টে থাকতো না, তখন বুবকাই ঝিলকে উড়িয়ে দিতো দূরে,আরও আরও দূরে।
কখনও আবার তার হলদে পাখির সাথে ঘোরা শেষ হত না,সাদামেঘের সাথে কথা ফুরতো না, তার আগেই ফিরতে হতো ঘরে।
   তারচেয়ে এই বেশ ভালো হলো। এখন ঝিল নিজের খুশি মতো যেদিক ইচ্ছে যাবে, কেউ ওকে বাধা দেবে না।  যেখানে খুশি, যত খুশি উড়বে,কেউ পিছন থেকে টেনে ধরবে না।   কি যে মজা ঝিলের। 
      খুশিমনে ঝিল ভেসে চলেছে। সুপুরি বাগানের উপর দিয়ে একদল বককে  উড়ে যেতে  দেখে ঝিলের  মনে পড়লো,সে তো মাঝেমাঝেই স্বপ্ন দেখতো  বেশ  উড়ে যাচ্ছে  দূর দিগন্তে, ঠিক ওই  সাদা বকেদের মতো।   বুবকাইদের বাড়ি, শিলুদের বাড়ি, চিকাই, পলু,  মন্নিকদের বাড়ি ছাড়িয়ে, পদ্মবিল পেড়িয়ে, বোসপাড়া, বেনেপাড়া,  চিরুণিবাজারের উপর দিয়ে আরও দূরে,অনেক দূরে.......।  ঝিল উড়ছে, শুধু উড়ছে।
   
       আজ নিজের অজান্তেই কেমন করে যেন ঝিলের সে স্বপ্ন সত্যি হয়ে গেছে। দিগন্তে উড়ে যাবার সেই সাধ ঝিল আজ পূরণ করবে।  
   যদিও   জোনাকির কথা মনে পড়লে মনটা খারাপ লাগছে...।হলদে পাখি, সাদা মেঘকেও ভুলতে পারছে না কিছুতেই।  
তবে একটা নিশ্চিন্তি। ও তো এখন স্বাধীন! তাই  যখনই ইচ্ছে হবে,উড়তে উড়তে ঘুরতে ঘুরতে এসে ওদের সাথে দেখা করে যাবে। "

     একঝাঁক চামচিকে শিউলিগাছের সামনেটায় এসে কিচিমিচি করছিলো। টুই ওদের বেশ করে বকে দিয়ে আবার মা-টুনির গল্পে মন দিলো।  মা-টুনি বলছে,

   "ঝিল তো দিব্যি এগোচ্ছে কালো মেঘ ছাড়িয়ে, সাদা মেঘ পেরিয়ে....আকাশের বুকে গা ভাসিয়ে । এরই মাঝে  ঝিলের বাসায় ফেরা চড়ুই, বাবুইদের সাথে দেখা হল, দূর ঠিকানায় পাড়ি দেওয়া পরিযায়ীদের সঙ্গে গল্প হল, ঘরফিরতি ঘুড়িদের সাথে নাচলো খানিক, মেঘের সঙ্গে খেলা  করতে করতে আলতো করে গা ভেজালো, আবার সেই মেঘেদের পিছনে লুকিয়ে থাকা সন্ধ্যাতারাটার সাথে  খুনসুটিও করলো, তারপর আবার উড়ে গেলো।
      হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ঝিল চিকাই,পলু, মন্নিকদের বাড়ি পেরিয়ে এবার এগিয়ে গেলো পদ্মবিলের দিকে। "

   - ঝিলের কি মজা, তাই না মা? 
টুই বলল। 
  
- "হ্যাঁ  সে তো মজাই। তা, ঝিল তো উড়ছিলো বেশ 
মনের আনন্দে। কিন্তু একটু পরে  আস্তে আস্তে ঝিলের কেমন অস্বস্তি হতে লাগলো। হাওয়াটা যেন কমে আসছে মনে হচ্ছে!"
-"যাহ! হাওয়া কমলে ঝিল উড়বে কি করে?"
  টুই আবার প্রশ্ন করলো। 
-" ঠিক তাই!  সেটা তো ঝিল ভাবেনি আগে! অন্যসময় বুবকাই ওকে নামিয়ে নিতো। কিন্তু এখন কি হবে ?

     এদিকে আবার চারপাশে ছোপ ছোপ অন্ধকার ফুটে উঠছে । আকাশে একটাও ঘুড়ি নেই আর । আবছা আঁধারি আলোয় শুধু সে-ই  ভেসে চলেছে।  একা, একদম একা....।

    ঝিল হঠাৎ খেয়াল করলো, ও আর আগের মতো  তেমন করে উড়তে পারছে না। ধীরে ধীরে নীচের দিকে নেমে আসছে।ঝিলের ভয় করতে লাগলো এবার। 

   সামনেই পদ্মবিল। কৃষ্ণপক্ষের আকাশ তার কালো রঙ পদ্মবিলের জলে  গুলে দিচ্ছে একটু একটু করে ।

সেই কালো জল ইয়াব্বড় হাঁ করে বসে আছে ঝিলের অপেক্ষায়। ঝিল যেইমাত্র ভাসতে ভাসতে বিলের উপর আসবে, ওমনি কপাৎ করে গিলে নেবে সে ঝিলকে।   
   এদিকে বিলের সামনেই ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে একটা নেড়া সেগুন গাছ। তার শুকিয়ে যাওয়া ডালপালা নিয়ে সেও বুঝি ঝিলকেই দেখছে একদৃষ্টে। ওকে হাতের কাছে পেলেই এফোঁড়ওফোঁড় করে দেবে তার খটখটে  শুকনো ডালগুলো দিয়ে।  
     আর বিলের সামনের ওই কাঁটাঝোপটা ঝিলকে দেখেই কেমন যেন দাঁতকিড়িমিড়ি করছে মনে হচ্ছে! 

   নাহ!এবার বড্ড  ভয় করছে ঝিলের।দিগন্তে ভেসে যাবার স্বপ্ন পালিয়ে গেছে মন থেকে। এখন নিজেকে বাঁচাবে কি করে মন জুড়ে তার সেই ভাবনা ।
ও একবার আকাশের দিকে তাকালো।  অমন ঝকঝকে আকাশখানা এখন শুধুই এক বিশাল ঘুটঘুটে অন্ধকার গর্ত । যে কয়েকটা তারা মিটমিট করছিলো, তারাও সুযোগ পেলেই মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়ছে।
     ঝিল এখন একা,  এক্কেবারে একা।কেউ নেই ওর পাশে। ওর খুব মনে পড়ছে বুবকাইয়ের কথা, জোনাকির কথা,হলদে পাখি, সাদা মেঘের কথা।ইস, আবার যদি ওদের কাছে ফিরে যাওয়া যেত! 
   কিন্তু তা আর হবে না,কোনও দিন,কক্ষনও হবে না। আর কখনো বুবকাই ওকে ওড়াবে না, আর কোনদিন জোনাকির সাথে দেখা হবে না, পাখিদের সাথে গল্প হবে না, মেঘের সাথে খেলা হবে না.....
    ঝিলের খুব কান্না পেলো। ও খেয়াল করলো, হাওয়া প্রায় থেমেই গেছে।  

কি করবে এবার ঝিল? একদিকে রাক্ষুসে বিলটা যেন হা হা করে  ডাকছে, এদিকে আয়, এদিকে আয়,খাই তোকে কপাৎ  করে.......।আরেকদিকে ভূতুড়ে গাছটা হিঁ হিঁ করে হেসে ওকে বলছে, আঁয় আঁয়, কাছে আঁয়, তোঁকে আজ ফালাফালা কঁরি। " 
  
ছোট্ট টুই মা-টুনির গা ঘেঁষে একটু জড়োসড়ো হয়ে বসলো।ইস, ঝিলের কি হবে এবার!
মা-টুনি বলে চলেছে, 
     " ঝিল দেখলো হালকা  হাওয়ার একটা অদৃশ্য সুতো ঝিলকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আর কোনো উপায় না দেখে ও শেষে হালকা হাওয়ার কাছে মিনতি করলো, সে যেন ঝিলকে ওই ভূতুড়ে গাছ, কালো বিল আর কাঁটাঝোপের হাত থেকে বাঁচিয়ে বিলটার ওপারে পৌঁছে দেয়। 
   ঝিলের মিনতি শুনে হালকা হাওয়া হেসে বললো ,বেশ,  তাই হবে। "

- যাক, কেউ তো ঝিলের পাশে আছে।
   টুই যেন একটু স্বস্তি পেলো।
মা-টুনি বলছে,
   "কিন্তু খানিক বাদেই ঝিল বুঝলো,হালকা হাওয়া তার কথা রাখেনি।সে ঝিলকে ওই ভূতুড়ে গাছের  দিকেই  টেনে নিচ্ছে। 
   আসলে ঝিল তো জানতোই না যে হালকা হাওয়া ভূতুড়ে গাছের বন্ধু ছিলো।"

- ইস, কি দুষ্টু ওরা!  
      টুই বলে উঠলো। 

-"  কিন্তু ভূতুড়ে গাছের দিকে গেলে যে ঝিল কিছুতেই বাঁচাতে পারবে না নিজেকে!  আবার সামনেই কাঁটাঝোপ আর কালো পদ্মবিল। কোনদিকে যাবে ও! 
ঝিল প্রাণপণ  চেষ্টা করলো উল্টো দিকে ফিরে যাবার। কিন্তু চেষ্টা  করলেই তো হল না! ওইটুকু পাতলা পুচকে একটা ঘুড়ি, সে কি আর হালকা হাওয়ার টান এড়াতে পারে! 
  তাই ভাসতে ভাসতে ঝিল ভূতুড়ে গাছের দিকেই এগিয়ে গেলো।আর গাছটার কাছাকাছি আসতেই হলো কি,  সেই গাছ সুযোগ বুঝে একখানা সরু শুকনো ডাল এগিয়ে দিলো ঝিলের দিকে, আর তক্ষুণি কোত্থেকে দমকা শিরশিরে খোনা হাওয়া এসে ঝিলকে এক ঝটকায় আটকে দিলো সেই ডালে।
  আটকানোর সময় শুকনো ডালটা ঝিলের লেজের কাছটাতে  ফড়ফড় করে ছিঁড়ে দিলো খানিকটা। 
ঝিল  যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলো । 
    এরইমধ্যে ও দেখলো শিরশিরে খোনা হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে দুলতে দুলতে ভূতুড়ে গাছের বাকি  ডালগুলোও এগিয়ে আসছে ওর দিকে।সর্বনাশ!  
এখানে আটকে থাকলে তো ওরা এক্ষুণি ঝিলকে ছিঁড়েখুঁড়ে একসা করে দেবে! 
না না,  এভাবে হারলে চলবে না। এই ডালটা থেকে মুক্তি পেতেই হবে ওকে। 
   ঝিল তখন করলো কি, বেজায় ছটফট করতে শুরু করলো। কোনক্রমে যদি লেজের কাছটা ছিঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে,তা সে যতই ব্যথা লাগুক, তবে ভূতুড়ে গাছটার হাত থেকে বেঁচে যাবে ...। 
   বেশ খানিক্ষণের চেষ্টাতে সেরকমটাই হলো । ওর ছটফটানি আর শিরশিরে খোনা হাওয়ার ধাক্কাধাক্কিতে লেজের কাছে যেখানটা আটকে ছিলো, সেখানটা ফুস করে ছিঁড়ে গেলো। ব্যাস একঝটায় ঝিল ছিটকে বেরিয়ে এলো ভূতুড়ে গাছের কবল থেকে। 
  কিন্তু  শিরশিরে খোনা হাওয়া অত সহজেই কি ছাড়ে  ওকে! ঝিল বাইরে আসতেই সে এমন এক জোরসে টান দিলো যে ঝিল টাল সামলাতে না পেরে সোঁওওত করে  ভেসে গেলো  সোজা বিলের  হাঁ করা কালো মুখের দিকে। ততক্ষণে যন্ত্রণার চোটে ওর প্রায় অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা।শুধু জলে পড়ার আগে  মনে হল, ঝিলের ছেঁড়া সুতোটায় যেন হালকা টান লাগলো.....।"

   মা-টুনি থামলো। 
টুই দমবন্ধ করে শুনছিলো এতক্ষণ। মা-টুনি থামতেই সে তাড়া দিলো,
-  ও মা থামলে যে! তারপর কি হল বলো না..!
-  তারপর? তারপর অনেক পরে একসময়  ঝিলের জ্ঞান ফিরলো।ও চোখ মেলে চাইলো।
-  যাক বাব্বা! তারমানে ঝিল বেঁচে গেছিলো।
- হ্যাঁ, বেঁচে গেছিলো। আর চোখ মেলে ঝিল কি দেখলো বলতো?
- কি দেখলো? 
- ঝিল দেখলো , ও বুবকাইয়ের বাড়িতে আছে।
-  সে কি! বুবকাইয়ের বাড়ি!ওখানে ঝিল  কি করে গেলো মা? যাদু করে? 
- ধুর বোকা! যাদু করে যাওয়া যায় নাকি! 
- তাহলে? 
- বুবকাই এসে ওকে নিয়ে গেছিলো। 
- বুবকাই কি করে ঝিলকে পেলো? ঝিল তো বিলের জলে পড়ে গেছিলো! 
-  নাহ, পড়েনি। ও যেই বিলের জলে পড়তে যাবে, ঠিক তখনই বিলের পাড়ের কাঁটাঝোপটা ঝিলের ছেঁড়া সুতোটাকে খপ ধরে নিয়েছিলো।
- তারমানে সেই কাঁটাঝোপটাই ঝিলকে বাঁচিয়ে দিলো ? 
- হ্যাঁ রে, ওকে দেখে তো ঝিল বড্ড ভয় পেয়েছিলো। কিন্তু ও-ই ঝিলকে বাঁচালো শেষমেশ। 
- আর ঝিল বুবকাইয়ের কাছে গেলো কি করে?
- আসলে হয়েছিলো কি,ঝিল বুবকাইয়ের বড্ড প্রিয় ছিলো কিনা,তাই  ঝিলের সুতো কেটে যেতে বুবকাই ওর পিছু নিয়েছিলো। সারা বিকেল,সন্ধ্যে ঝিলকে খুঁজতে খুঁজতে  বুবকাই চলে এসেছিলো পদ্মবিলে। সেখানেই ও কাঁটাঝোপে আটকে থাকা ঝিলকে দেখতে পেয়েছিলো।তারপর সুতো ছাড়িয়ে  উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছিলো বাড়িতে। 
- তারপর ? 
- তারপর  বুবকাই ওর শরীরের ছেঁড়া জায়গাগুলোয় আঠা-কাগজ- সেলোটেপ দিয়ে যত্ন করে তাপ্পি মেরে দিয়েছিলো।আর ধীরে ধীরে  ঝিলও সুস্থ হয়ে উঠেছিলো।
- আচ্ছা মা,ঝিল কি এখন বুবকাইয়ের কাছেই আছে?
- আছে তো। তবে বেশি  উড়তে পারে না  , কষ্ট হয়। তাই বুবকাই ওকে মাঝেমধ্যে বাইরে আনে। 
- আর তখন  আবার জোনাকি, হলদে পাখি,সাদা মেঘ সব বন্ধুদের সাথে ঝিলের আবার দেখা হয়, তাই না?
- হ্যাঁ, সব্বার সাথে দেখা হয়।
- তারমানে তো হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের সাথে ঝিলের আবার মিল হয়ে গেছে। কি ভালো না মা? 
   টুইয়ের কথায় মা- টুনি হাসলো। 

- বুবকাইদের বাড়িতে আমাকে একদিন নিয়ে যাবে মা? আমিও বন্ধু পাতাবো ঝিলের সাথে।
- আচ্ছা বেশ, পাতাবি না হয়। ঝিলের গল্প তো শেষ। এখন ঘুমো দেখি।
    মা-টুনি টুইয়ের মাথায় ঠোঁট বুলিয়ে দিলো।

  আকাশের বেগুনীতে কালচে রঙ ধরছে। একটা,দু'টো করে তারা ফুটে উঠছে। 
   ঝিলের কথা ভাবতে ভাবতে  টুইয়ের ঘুমভরা ঢুলুঢুলু চোখদু'খানা  আলতো করে বুজে এলো।
  মা-টুনির আদর খেতে খেতে ছোট্ট টুই ডুব দিলো ঘুমনদীতে।
...........
 
Urbi Roy
 
অলঙ্করণ :-  সহিষ্ণু কুড়ি