শুচিস্মিতা চক্রবর্তী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
শুচিস্মিতা চক্রবর্তী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

আমার মুক্তি আলোয় আলোয় - শুচিস্মিতা চক্রবর্তী

 



আমার মুক্তি আলোয় আলোয়
শুচিস্মিতা চক্রবর্তী
 
            

(১)
 
 
- ভোকাট্টা...ভোকাট্টা...

    আকাশের বুক চিরে, বাড়ি-ঘরের ছাদ ছুয়ে ,গাছের উঁচু ডাল ছুঁয়ে  মাতাল হাওয়ায় তালে তাল মিলিয়ে ঘুরে ঘুরে নামছে চাঁদিয়ালটা আর তার পেছনে ছয় থেকে ষোলো মাঠের ধূলো,রাস্তার ভিড়,বাড়ির পাঁচিল সমস্ত বাধা ঠেলে ঘুড়ির স্বাধীনতাকে নিজের করায়ত্ত করার দৌড়ে সামিল।যার হাতে ঘুড়ি,সেই তার ভবিষ্যৎ মালিক।তাছাড়া দলে তখন তার কদরই আলাদা।এমন সময় ছন্দপতন।বাঁজখাই গলায় মায়ের ডাক
- পিকলু,শিগগির ঘরে ঢোক...

- আর একটু মা, ঘুড়িটা লুফেই আসছি

- না, এক্ষুনি। আর একটা কথা নয়!

অগত‍্যা শত অনিচ্ছা সত্ত্বেও গুটিগুটি পায়ে বাড়ি ঢোকে পিকলু ওরফে ঋদ্ধি।ওর ঘাড়ের ওপর দিয়ে হুশ করে দমকা হাওয়ায় মত এগিয়ে যায় ছেলে-ছোকরার দল।

- কতবার বলেছি ঐ সব আজেবাজে ছেলেগুলোর সাথে একদম খেলবিনা।পড়া নেই শোনা নেই সারাদিন টো টো করে সব ঘুরে বেড়ায় আর তোর যত মেলামেশা ওদের সঙ্গেই...
     যাও এক্ষুনি মাস্টারমশাই আসবেন, হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসে যাও।
ঘাড় গুঁজে একটি কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে পিকলু।বোঝাই যাচ্ছে একটি কথাও তার কানে ঢোকেনি।তার চোখে এখনও সেই মাতাল ঘুড়িটা ঘুরে ঘুরে নামছে আর পিকলু প্রাণপনে দৌড়ে চলেছে ...আর একটু ,আর একটু ;ঘুড়ির সুতো প্রায় পিকলুর হাতের মুঠোয়...

- বলি কথা কিছু কানে ঢুকছে?
 ধপাস করে ফিরে আসে পিকলু ঘরের ভেতর।মিনমিন করে বলে,
- ওরাও সবাই ইসকুলে পড়ে মা!

- আমাকে উদ্ধার করে বাবা! একটা বিশ্রী মুখভঙ্গি করে পিকলুর মা বলে,
তুই আর কোনদিন ওদের সাথে খেলবি না।এই আমি শেষ বারের মত বলে দিলাম।

- তাহলে আমি কাদের সাথে খেলব?পিকলুর চোখ জলে ভরে আসে।

- বাড়িতে থাকবে।পড়াশুনো করবে,ছবি আঁকবে,তবলা বাজাবে,গান শুনবে কিন্তু ঘরের বাইরে নয়।

(২)

- মুক্তি আর স্বাধীনতা দুইটো কি একই জিনিস বাবা?

- মুক্তি আর স্বাধীনতা, দুটোই প্রায় সমার্থক হলেও দুটোর মধ‍্যেই একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে ,বুঝলি রামদাস।
এই যে তুই সকাল থেকে সন্ধ্যে আমার কাছে পড়ে থাকিস , তোকে কেউ কিছু বলেও না ,তোর যা ইচ্ছে তুই তাই করিস।এটা তোর স্বাধীনতা।কিন্তু দিন শেষে সেই ঘরটিতে ফিরে যাস।যেখেনে তোর মা তোর অপেক্ষায় ভাতের থালা নিয়ে বসে আছে।সেইটে হল টান।পিছুটান।এর জন্য তুই কোথাও গিয়ে থাকতে পারিসনে,মন আকুলি বিকুলি করে তাইতো?

- হ‍্যাঁ, বাবা ; দিনশেষে একবারটি ঘরে যে ফিরতেই হবেক...

- ঐ,  ঐ হল গিয়ে মায়া! যতদিন থাকবে ততদিন ফিরে ফিরে যাবি। মুক্তি নেই।যেদিন আর ফিরে যেতে মন চায়বিনে সেইদিন জানবি তোর মুক্তি।

- তাইলে কি আমার মুক্তি নেই বাবা? 

- তোর কি চিন্তা রে পাগলা?তুই তো স্বাধীন রে...বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন বাবা অনিলানন্দ মহারাজ।

- আর আপনে বাবা?

      এক চমকে হাসি থেমে গিয়ে নিজের মধ্যেই হারিয়ে গেলেন বাবা।
- আমি? আমার মুক্তি নেই রে ...আর স্বাধীনতা তো নেইই।সেই ছোট্ট থেকেই বড্ড পরাধীন।

- আপনের তো বাবা, ঘর নেই, সংসার নেই, আগায়- পিছায় কুনো পিছ্টান নেই,আপনে তো পুরা স্বাধীন...

- না রে না ; এই যে তোরা রোজ আসিস্,গল্প করিস্,এই যে আমার বাসা এই ফেলে কি আমি যখন যেদিকে ইচ্ছে চলে যেতে পারছি? পারছি না রে...কেন জানিস্?এই তোদের ভালোবাসা, তোদের সাথে কাটানো সময়,ভালো সময়, এই ছেড়ে যেতে পারছিনা...এটাই মায়া। জড়িয়ে গিয়েছি ।মুক্তি নেই।

- বাবা,আপনের বাড়ির কথা মনে পড়ে?মায়ের কথা,বাপের কথা?

- ও আমার আগের জন্ম রে! তবে মনে কি আর পড়ে না! পড়ে, ইস্কুল, বই,ব‍্যাগ,তবলা,ঘুড়ি...
আবার আনমনা হয়ে পড়েন বাবা।কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে সামনের তালগাছটার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
রামদাস গলা খাঁকারি দিলে আবার ফিরে আসেন।

- মুখগুলো ভালো করে আর মনে পড়ে না জানিস্ ; সব মায়েরাই বোধ হয় একই রকম দেখতে, তাই না রে?

(৩)
 
    তারপর থেকে সত‍্যিই মা আর কোনোদিন  বাইরে বেরোতে দেয়নি।ঘরের চার দেওয়ালে বন্দি পিকলুর মন ছুটে চলত দেশ থেকে দেশান্তরে,সাগর নদী পেরিয়ে মেঘের ভেলায় পাড়ি দিয়ে বহুদূর।
পড়াশোনায় বরাবর ভালো পিকলু।মনের ইচ্ছে পাইলট হবে।উড়ে বেড়াবে দেশ দেশান্তরে।কিন্তু আবার সেই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ।বাবা বললেন,
- ঐসব প্লেন টেন চালানো হবে না।ভালো রেজাল্ট যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ো।ভবিষ্যৎ ভালো।
দাঁতে দাঁত চেপে কেটেছিল চারটে বছর। সেখানেও দারুণ রেজাল্ট।শেষ সেমিস্টারের আগেই লোভনীয় অঙ্কের চাকরি।
মা-বাবা দুজনেই ভীষণ খুশি হয়েছিলেন।প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করেছিলেন ছেলেকে।
-“আরও বড় হও, পৃথিবীর সমস্ত আনন্দ তোমাকে ঘিরে থাকুক”

পিকলু বড় হয়ে আকাশ ছুঁতে চেয়েছিল, সেই চাঁদিয়ালটার মত ।কিন্তু তার সুতোটাও অকালেই ছিঁড়ে পড়েছিল।

    ন’টা পাঁচটার ঘেরাটোপে অস্হির হয়ে উঠেছিল পিকলু।শরীর মন বিদ্রোহ করতে শুরু করে।মা-বাবা ভাবেন যৌবন তার স্বাভাবিক চাহিদার বশবর্তী।পিকলুর বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে শুরু করেন।
আবার বাঁধন।এক নয়,দুই নয়,সাত পাকের বাঁধন।মা-বাবা,পরিজনদের কথা ভেবে এই কাজটাও করে নেয় পিকলু।বিয়ে, ফুলশয্যা আর মাত্র দুটো দিন ; নতুন বৌয়ের মুখটাও ভালো করে দেখেনা সে।নিজেকে আর ভুলিয়ে রাখতে পারেনা, সব ছেড়ে ছুড়ে রওনা দেয় নিরুদ্দেশে।মায়ের জন্য বুকটা প্রথমে মোচড় দিয়েছিল বটে, আর ঐ নববধূটির জন্য।ওর তো কোনো দোষ ছিল না!কিন্তু না আর পিছুটান নয়, এত পরাধীন জীবন,এত শিকল পিকলুর জন্য নয়।

    ঘুরতে ঘুরতে ট্রেনে,বাসে পায়ে হেঁটে পিকলু এসে পৌঁছেছিল মনিকর্ণিকার ঘাটে।ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত ,ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে হেঁটে যাচ্ছিল ঘাট বরাবর।হঠাৎ কানে এল অশ্রাব্য কিছু গালিগালাজ-
- শালা শুয়ো—বা—আমার সাথে ধান্দাবাজী? মুনাফা ?মুনাফার মন্তর বলতে হবে? শালা গতর খাটাবিনে ,গদিতে বসে মন্ত্র পড়ে মুনাফা হবে?জটাধারী সাধু দেখলেই খালি মতলব না? ম‍্যাজিসিয়ান মনে করিস্ নাকি? দুনিয়ার কোনো ম‍্যাজিসিয়ান পারবেক নাই,ঐ উ ম‍্যাজিসিয়ান ভি না...
বলে বামহাতের তর্জনী উঠিয়ে আকাশের দিকে নির্দেশ করেন আর ডানহাতে একখান চ‍্যালাকাঠ ছুঁড়ে মারেন কথাগুলো এতক্ষণ যার উদ্দেশ্যে বলছিলেন তার দিকে।ভাগ্য ভালো অল্পের জন্য ফস্কে গেল ।সে বেচারা পড়ি কি মরি করে কোনোরকমে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচে।

    দেখেই বোঝা যায় ব‍্যবসায়ী গোছের মানুষ।ইচ্ছে ছিল সাধুর কাছে মন্ত্র-তন্ত্র শিখে ব‍্যবসায় ভালো লাভের মুখ দেখবে।কিন্তু এ যা মূর্তি দেখল ,আর সারা জীবনেও বোধ হয় সাধু-সন্ন্যাসীর পথ মাড়াবেনা।
নিজের মনেই খানিক হেসে পিছনদিকে পা বাড়াতেই সেই গলা; কিন্তু এখন বেশ নরম।
- মুক্তি কি আর অত সহজ রে বেটা? তবে আজাদী মিলবে ।

    থমকে দাঁড়িয়ে গেল পিকলু।চকিতে ফিরে দেখে সেই সাধু তখন পিকলুর দিকে তাকিয়েই মিটিমিটি হাসছেন।কোথায় সেই উগ্র রূপ! তার বদলে শান্ত সমাহিত বড় মায়াময় দুটো চোখ।যেন পিকলুকেই ডাকছে।
পিকলু মন্ত্রমুগ্ধের মত এক পা এক পা করে এগিয়ে যায়।হাতদুটো যেন নিজে থেকেই জড়ো হয়ে আসে।– “কি বললেন বাবা আপনি?”
- ছাড় ছাড়,উসব কথা ছাড় দিকি। প‍্যাটে তো দানাপানি পড়েনি।আয় আয় ভিতরে আয়।

    যেন কতকালের চেনা।কিছু আগেই যে মানুষটা আরেকজনকে দুরছাই করছিল,সেই মানুষই কিনা পিকলুর মতো এক অজানা অচেনাকে নিজের কুটিরে ডাকছে!
- অচেনা কাঁহা রে বেটা? এই তু এলি,এবার গল্প করবি,চিনে লিব।একটা মানুষকে চিনতে কতক্ষণ লাগে?
- আপনি কি মন পড়তে জানেন?
হাঃ হাঃ হাঃ করে দরাজ হাসি হেসে উঠলেন বাবা।মুখে বললেন, “ যা ঐ কোণের প‍্যাকেটটা লিয়ে আয়...”

    এতক্ষণ ভালো করে দেখেনি পিকলু।এবার চতুর্দিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখল ঘর বলতে ছেঁড়াখোঁড়া ত্রিপলের ছাউনি।কোণে একখান ভাঙা টুলের উপর চারটে নারকেলের খোল,একটা মাটির ঘড়া আর একটা প‍্যাকেট।একদিকে একটা দড়িতে ময়লা গামছা আর কিছু লাল কাপড় মতো,ঠিক তেমন যেরকমটা এখন ওনার লজ্জা নিবারণ করছে।
ধীরে ধীরে গিয়ে প‍্যাকেটটা নিয়ে সাধুর সামনে এল পিকলু।মনে হল ছাতুর প‍্যাকেট।নিয়ে আসা মাত্রই সাধু পিকলুর হাত থেকে ছোঁ মেরে ওটা নিয়ে সামনে রাখা কমন্ডলুর মধ্যে ঢেলে ঘটঘট করে নিজে খানিকটা খেয়ে বাড়িয়ে দিল পিকলুর দিকে-
- “লে পি’লে...দিল ঠান্ডা হবে।মাথা ভি।“
পিকলুও কথা না বাড়িয়ে গলায় ঢেলে নিল।
আহ্!কি শান্তি।চোখ জুড়ে ঘুম আসে পিকলুর।সেই সাধুর ছাউনিতেই খোলা মাটিতে শুয়ে পড়ে সে।

    সেই শুরু।আর বাড়ির কথা মনে করেনি সে।সাধুর সাথেই ঘুরে বেড়িয়েছে এক ঘাট থেকে আরেক ঘাট,পাহাড় থেকে সমুদ্র।যা পেয়েছে তাই খেয়েছে, যেখানে পেরেছে সেখানেই আশ্রয় নিয়েছে।সাধুবাবাই ওকে বলেছে,- “তু হাওয়ার মতো আছিস্,বেটা; একদম নিরমল,একদম সচ্চা।তোর নাম অনিলানন্দ”।
যেখানেই গেছে মানুষ ছেঁকে ধরেছে।তার গুরুর প্রেমের বাণী শোনার জন্য লোক ভিড় জমিয়েছে।কিন্তু কোনো জায়গায় গুরু বেশিদিন থাকেননি।ইহজগতেও না।দেহত‍্যাগের সময় ঠিক কত বয়স হয়েছিল পিকলু বলতে না পারলেও তাঁর বলে যাওয়া অমর বাণীগুলো পিকলু ওরফে অনিলানন্দর কন্ঠস্থ।গুরুর মতো শিষ‍্যের কাছেও লোক আসে দলে দলে।
তারা সব জীবনের পাঠ নেয়।না,কোনো সমস্যার সমাধান নয়,বরং সেটার সঙ্গে লড়ে জেতার মন্ত্র তারা অবশ্যই পায়।
এদের নানাবিধ সাংসারিক দেনা-পাওনা,সুখ-দুঃখের জালে জড়িয়ে পড়ে অনিলানন্দ।ভক্তদের বানিয়ে দেওয়া কুটিরে আশ্রয় নেন।আর কোথাও যাওয়া হয় না।
স্বাধীনতা হারায়।আবার জড়িয়ে পড়েন স্নেহের বাঁধনে।

(৪)
 
    প্রতিদিন এই বেলা পড়ে এলে একে একে মহল্লার নানা বয়সের পুরুষ-মহিলা জড়ো হয় চৌকিতে অনিলবাবার “পাঠ” শুনবে বলে।বাবা কোনোদিন গীতা পড়েন,তো কোনোদিন মহাভারত পড়েন।আবার মাঝে মাঝে কোরান, বাইবেল, গুরু গ্রন্থসাহেব তো কখনও জাতকের গল্প নিজের কথায় সরল করে ভক্তদের পড়ে শোনান।সবার সাথে বন্ধুর মতো মেশেন,দাদার মত পথ দেখান,বাবার মতো স্নেহ করেন।নানাবিধ প্রশ্নের উত্তরও দেন।শুধু নিজের কথা কিচ্ছুটি বলেন না।ওনার কথা কেউ জিজ্ঞেস করলেই বলেন
- ও তো আমার গতজন্ম, এ জন্মে আমি স্বাধীন।তোমাদের ভালোবাসাতেই আমার মুক্তি।

আবার হারিয়ে যায় অনিলানন্দ।ভাবে,সত্যিই কি সে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে?ছোট থেকে যে স্বাধীনতার জন্য ঘর-পরিবার সমস্ত ত‍্যাগ করে এল,এই কি তাই! তবে মনে সেই আনন্দ নেই কেন?
গুরুজী যে বলতেন, “ত‍্যাগেই মুক্তি, ত‍্যাগেই আনন্দ”
ঘর-সংসার ত‍্যাগ করে বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্তি করছি,চিন্তা থেকে পেরেছি কি?মায়ের মুখ মনে না থাকলে কি হবে, মাঝে মাঝেই ঘুমের ঘোরে ‘পিকলু’ বলে যে আকুল ডাক শুনতে পাই! তার কি হবে? আর ঐ নববিবাহিতা স্ত্রী, ক্ষনিকের জন‍্যও গ্রহন না করেই যাকে ত‍্যাগ করে এলাম, সে কি ক্ষমা করতে পেরেছে? এ স্বাধীনতায় যে বড় বিষাদ মিশে আছে।

আঁধার নামে চৌকিতে।নারী-পুরুষেরা এক এক করে বাড়ির পথ ধরে।রামদাস ছোট্ট পিতলের লম্ফটাতে একটু তেল দিয়ে সলতেটা উসকিয়ে দেয়।
- বাবা, দুটো সন্দেশ আর একটু চিড়ে রেখে গেলাম ।খেয়ে লিবেন।
সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে অনিলানন্দ।

- সাবধানে যাস। বলে রামদাসের গতিপথের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তে গিয়েই  চোখ যায় আসরের কোণে বসা মহিলার দিকে।সেই কোন দুপুর থেকে উনি ওখানে ঠায় বসেই রয়েছেন।কোনও প্রশ্নও করেননি।
আজ মহাভারতের নবম অধ‍্যায় পড়তে পড়তে বারে বারে চোখ চলে যাচ্ছিল ঐ মহিলার দিকে।আগে কোনদিন ওনাকে এখানে দেখেছেন বলে তো মনে পড়ে না।চেনা চেনাও লাগছে না। ওনাকে দেখেই বারে বার অনিলানন্দ হারিয়ে যাচ্ছিলেন, ফিরে যাচ্ছিলেন নিজের অতীতে।অথচ এমন তো হওয়ার কথা নয়! তিনি তো অতীত ভুলেছেন বহু আগেই।তিনি স্বাধীন,তিনি মুক্ত।

    বারবার নিজেকে সামলে নিচ্ছিলেন।এখন সবাই চলে যাওয়ার পর মহিলা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন।পরনে হালকা রঙের তাঁতের শাড়ি।এখন আঁধার নামতে যদিও রঙ বোঝা যায় না।সাদা-সাদা মতোই মনে হয়।সারাদিন দেখলেও রঙটা ঠিক মনে করতে পারেন না অনিলানন্দ।মহিলা ধীর গতিতে এগিয়ে আসতে থাকে তার দিকে।আসরের প্রায় প্রত‍্যেক মহিলাকেই ‘মা’ বলে সম্বোধন করলেও কেন না জানে এনার ক্ষেত্রে সেই ‘মা’টি কিছুতেই মুখে এল না।সম্বোধন উহ‍্য রেখেই তিনি বললেন,
- আপনি কি কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে এসেছেন? সেই দ্বিপ্রহর থেকেই আপনাকে দেখছি, অথচ আপনার জিজ্ঞাসা কিছু ছিল বলে তো মনে পড়ছে না...

- আপনি ঠিকই ধরেছেন।আপনার কাছে আমার জিজ্ঞাস‍্য কিছুই নেই।যদিও আপনি মহাজ্ঞানী, আপনার অনেক ভক্ত...
মহিলার কথাগুলো বড় কঠোর, কর্কশ ঠেকে অনিলানন্দর কানে।তিনি বেশ বিরক্ত বোধ করেন।তবুও কন্ঠের উষ্মা যথাসম্ভব আড়াল করে ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন
- তাহলে এখনও আপনার এখানে কি প্রয়োজন?

- মুক্তি

- মুক্তি?আমি?আমি দেব মুক্তি?আমি আপনাকে মুক্তি দেওয়ার কে?

- শ্রীমান ঋদ্ধি ভট্টাচার্য্য।
চমকে ওঠেন অনিলানন্দ।তেলের বাতিটা ধীরে ধীরে মহিলার মুখের সামনে বাড়িয়ে ধরেন।

- কে আপনি? আমার পূর্বজন্মের নাম আপনি কি করে জানলেন?
কিছুক্ষণ নিকষ নীরবতা।তারপর ধীরে ধীরে চোখ তুলে সোজা অনিলানন্দর চোখে চোখ রেখে বলেন
- আমি ইন্দ্রাণী, ইন্দ্রানী মুখোপাধ্যায় ভট্টাচার্য্য ।প্রথমের নামটা যতটা দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেছিল,পরের ভট্টাচার্য্য শব্দটা ততটাই ক্ষীণ স্বরে মুখ দিয়ে বেরোল।

- ইন্দ্রানী ! নামটা বেশ শোনা শোনা...
অতর্কিতে হাত থেকে তেলের বাতিটা পড়ে যায় অনিলানন্দর।ইন্দ্রানী তাড়াতাড়ি পিছিয়ে গিয়ে সামাল দিয়ে আবার বাতিটা জ্বালানোর চেষ্টা করে।

- আপনি,মানে তুমি ইন্দ্রানী! কিন্তু আমিতো ...
কথা জড়িয়ে আসে অনিলানন্দর।কি বলবেন কিছুই বুঝতে পারেন না।সমস্ত অতীত যেন মাথার চারপাশে ঘুরপাক খেতে থাকে।সেই সানাই,জোড়ের মালা,সাতপাক,ফুলশয্যা তারপর পালিয়ে আসা,মনিকর্ণিকার ঘাটে গুরুজীর সাথে দেখা...সব।

- আপনি অকারণে ভীত হবেন না।এতদিন পর আমি আপনার কাছে কোনো দাবি নিয়ে আসিনি।আমার আপনার প্রতি কোনো ক্ষোভও নেই, কোনো প্রশ্ন বা কৈফিয়তও আমার চাই না।আমার শুধু মুক্তি চাই।

- কিন্তু আমি মুক্তি দেব কি প্রকারে? আমি তো সেই দিনই তোমায় সমস্ত বাঁধন থেকে মুক্ত করে চলে এসেছিলাম।তুমি তো স্বাধীন।আর তো কোনো বাঁধন নেই।
- হ‍্যাঁ, আমি স্বাধীন।সেই অর্থে আমার কোনো বাঁধন নেই কিন্তু আমি যে মুক্ত নই।এখনও আমার নামের পাশে অকারণে আপনার পদবীটা রয়ে গেছে।ঐটা থেকে যে আমার মুক্তি চাই!
অবাক চোখে চেয়ে থাকেন অনিলানন্দ।

- আমি সধবা নই,বিধবা নই,ডিভোর্সি নই ; স্বামী পরিত‍্যক্তা ! এ যে ঘোর অপবাদ, সমাজের চোখে অপরাধ।আমার কি দোষ ছিল আমি জানি না কিন্তু ঐ একটি পদবী আমার সমস্ত স্বাধীনতাকে খানখান করে দিয়েছে।হাজার নিষেধ আর নিয়মের বেড়াজালে বেঁধে দিয়েছে আমার জীবন।এর থেকে আমার মুক্তি চাই।বহু দিন ধরে আমি আপনার খোঁজ করে চলেছি...
- “এখন আমার কি করণীয় ইন্দ্রানী?” হাজার ভাঙা গড়া চলছে বুক জুড়ে।

- শুধু একটা সই।আমি আপনাকে বাঁধতে আসিনি।শুধু নিজের ন‍্যায‍্য স্বাধীনতাটুকু ভিক্ষা চাই।

- আমায় ক্ষমা করতে পারবে তো?

- সে ক্ষমতা আমার নেই। বলেই কাঁধের ঝোলানো ব‍্যাগ থেকে একতাড়া কাগজ বের করে বাতির সামনে মেলে ধরল।
কাগজগুলোকে ঠিক যেন ছোটবেলার সেই এক একটা চাঁদিয়া্লের মতো মনে হতে লাগল।ঢিল ছাড়লেই উড়ে যাবে নিরুদ্দেশে।এখন তো ডোরও নিজের হাতে নেই! 

    ধীরপদে ইন্দ্রানী আঁধারে মিলিয়ে গেল।স্বাধীনতা স্বাধীনতা করে সারাজীবন হাহাকার করে যাওয়া মানুষটাকে যেন বড় সহজেই এই তুচ্ছ শব্দটার গূঢ় অর্থ বুঝিয়ে দিয়ে গেল।প্রদীপের তেলও কমে এসেছে।রাতের আঁধার যেন বড় গাঢ় হয়ে আসছে।
সারাজীবন স্বাধীনতার পেছনে ছুটে চলা পিকলু আজ বুঝতে পারল আসল স্বাধীনতার অর্থ।বড় বড় জ্ঞান দেওয়া বাবা অনিলানন্দর সমস্ত অহং রাতের তারাদের আলোয় হারিয়ে গেল।গুরুজী যথার্থ বলতেন- “দিল খুশ,তো সব খুশ, আজাদী মন থেকে আসে বাচ্চা; মুক্তি তো মনের”।

পড়ে থাকল তার পর্ণকুটির,গোছানো আসর,চৌকি,তেলের বাতি...সব কিছু পেছনে ছেড়ে মনের আনন্দে আলোর পথে পাড়ি দিল অনিলানন্দ ; না না ,পিকলু...
 
........................................
 
Suchismita Chakraborty
 

 

বেলুন আর সেই ছেলেটা - শুচিস্মিতা চক্রবর্তী

 

বেলুন আর সেই ছেলেটা

শুচিস্মিতা চক্রবর্তী



    টিপটিপ করে একনাগাড়ে বৃষ্টি হয়েই চলেছে।ছোট থেকে শুনে আসছি রথের দিন নাকি বৃষ্টি হয়, তাবলে সমানে বৃষ্টি হয়ে যেতে হবে! টুবলু সকাল থেকে মুখ ভারি করে বসে রয়েছে।একটু বৃষ্টিটা ধরলেই ও জানে মা ওকে নিয়ে রথের মেলায় যাবে।সকাল থেকে তাই কোনো দুষ্টুমি করেনি।জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে মাঝে মাঝেই বৃষ্টির তীব্রতা বোঝার চেষ্টা করছে আর গলা চড়িয়ে বলছে,
“ মা, এবার বোধ হয় একটু কমেছে, নিয়ে যাবে না মা মেলায়?”
ছেলের আকুলতায় আমিও বুঝি খানিক উতলা হয়ে উঠেছি।সেই ছোট্ট বেলায় ফ্রক পরে একহাতে বাবা আর আরেক হাতে শক্ত করে মায়ের হাত ধরে ভীড় ঠেলে মেলা দেখা,নাগরদোলা চড়া আর বেলুন কেনার কথা মনে পড়ে যায়।টুবলুর তো তেমন কোনো বায়নাই নেই।শুধু মেলায় গিয়ে রকমারি দোকান দেখা আর নাগরদোলা চড়া ব‍্যস।ওর জন্য আমারও মনটা খারাপ হয়ে যায়।মনে মনে ভাবি ,বৃষ্টিটা একটু ধরে এলেই বেরিয়ে পড়বো মা-ছেলে দুজনায়।
কিন্তু ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা হয়ে এল।আঁধার নামছে গাছের কোল বেয়ে।একটু পরেই টুবলুর বাবা অফিস থেকে ফিরবে।কিছুটা মন খারাপ নিয়েই বই খুলে বসে পড়ে টুবলু।দেখেই বুঝতে পারি ,বইয়ের দিকে একটুও মন নেই তার।দুই কান সজাগ হয়ে আছে বৃষ্টির আওয়াজ বাড়ছে না কমছে সেই দিকে।
গেটে একটা ‘খুট’ করে আওয়াজ হতেই দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে টুবলু ; “মা,বাবা এসে গেছে...”
--কি গো, ভিজলে নাকি? সেই সমানে বৃষ্টি হয়েই চলেছে।ভাবছিলাম, টুবলুটাকে নিয়ে একটু মেলায় যাব; তা আর বোধ হয় আজ হল না..
--কেন?এখন তো বৃষ্টি ধরে এসেছে।এবার যাও।
এক কাজ কর,চট করে এক কাপ চা আন, তারপর তিনজনে মিলেই মেলায় যাব।
“ইয়ে এ এ এ..”
টুবলু আনন্দে আত্মহারা হয়ে রেডি হতে ছুটল।আমিও ওর বাবার জন্য চা করে দিয়ে চটপট তৈরী হয়ে নিলাম।

    আমাদের এই দিকটা অনেকটা শহরতলির মত। কলকাতার গা ঘেঁষা হলেও উঁচু উঁচু আকাশছোঁয়া বাড়ি আর অফিস কোনোটাই তেমন চোখে পড়ে না।পরিবর্তে ছোট ছোট একতলা-দোতলা বাড়ি,দোকান-বাজার কিছু সবুজের সমাহার এখনও রয়েছে।তাই একটু সন্ধ‍্যে নামলেই মনে হয় বেশ খানিকটা রাত।ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক,অন্ধকারে জোনাকির আলো এখনও চোখে পড়ে।বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই রয়েছে পিয়ালদিঘীর মাঠ ; সেখানেই বসেছে রথের মেলা।
দুটো বড় বড় ছাতা একটা থলের মধ্যে পুরে তিনজন রওনা দিলাম রথের মেলায়।বাড়ি থেকে হাঁটাপথ।পথটা আধো অন্ধকার হলেও মাঠের কিছু দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে বড় নাগরদোলা ,আকাশের পেট ফুঁড়ে ঘুরে চলেছে।মাইকের আওয়াজ, জেনারেটরের শব্দ, ছোট বড় রকমারি দোকানের আলো তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।টুবলু আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে।টুবলুর চোখে খেলা করে আমাদের ছেলেবেলা।
 
    আমি ঘুরেফিরে কিছু ঘরসংসারের জিনিস পত্র কিনলাম।টুবলু কিছু রং-পেন্সিল,দু-একটা খেলনা গাড়ি কিনে নাগরদোলায় চড়ল।বাঁধনখোলা আনন্দ চোখে মুখে প্রকাশ পায় টুবলুর।ফেরার সময় কিছু খাওয়ার কিনে বাড়ির পথ ধরি তিনজনে।
 
    মেলার রোশনাই থেকে বেরিয়ে রাস্তায় কয়েক পা ফেলতেই হঠাৎ একটা কমবয়েসী ছেলে অন্ধকার ফুঁড়ে যেন আমাদের সামনে যেন আবির্ভূত হল।আমরা তিনজনেই ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম।পরণে হাফপ্যান্ট আর কালো মত একটা জামা।হয়ত অন্ধকার বলেই অমন রঙ মনে হচ্ছে।গায়ের রঙ ততোধিক কালো।মাথার চুল উস্কোখুস্কো।হঠাৎ করে ছেলেটি সামনে চলে আসায় কেমন যেন এক অদ্ভুত অনুভূতির সঞ্চার হয়।বিকট এক খ‍্যাসখ‍্যাসে গলায় ছেলেটি আমাদের বলে—
“ বেলুন নেবে গো,বেলুন? নাও না একটা...”
টুবলু বেলুন ভালোবাসলেও ঐ গলা শুনে আমাকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে।বুঝতে পারি ও বেশ ভয় পেয়ে গেছে।আমি হাত নেড়ে ছেলেটিকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে বলি।
--না না, আমরা বেলুন টেলুন নেব না; তুমি যাও।
ছেলেটির গলায় এবার একটু  আকুতি ফুটে ওঠে-
“ দুটো বেলুন নাও না গো, সেই থেকে একটাও বউনি হয়নি।খুব ভালো বেলুন..”
ঐ গলার আওয়াজ বেশিক্ষণ শুনলেই যেন অস্বস্তি লাগছে ; টুবলুর বাবা তাড়াতাড়ি বলে-
--ঠিক আছে,ঠিক আছে, দাও দুটো বেলুন।কত করে?
--এই বাবু, পনেরো করে এক একটা।
--এই নাও। বলে দুটো বেলুনের তিরিশ টাকা দিয়ে বেলুন দুটো নিয়ে আমরা ছেলেটিকে প্রায় কাটিয়ে আসছি এমন সময় শুকনো আকাশে কড় কড় কড়াৎ করে বুকফাটা বাজ পড়ে।অতর্কিতে সেই বিদ‍্যুতের ঝলকানিতে চোখ পড়ে ছেলেটির দিকে। এ চেহারা মানুষের ! ঝলসানো, কোঁচকানো পুড়ে যাওয়া এক বিকৃত মুখাবয়ব। আমি আঁতকে উঠি।টুবলু চিৎকার ভয়ে করে আমাকে জড়িয়ে ধরে।
আমরা প্রায় দৌড়ে পালিয়ে আসতে পারলে বাঁচি।
ছেলেটি আবার সেই অদ্ভুত খ‍্যাসখ‍্যাসে গলায় বলে ওঠে—
-ভয় পেলে দিদি,এ চেহেরা দেখে? তাইতো আঁধারে থাকি।চোর নই,খেটে খাই, তবু ছাড়লেনি গো ! সবাই মিলে অপবাদ দিয়ে মুখ পুড়ায়ে দিলে...আর এখন! একটা দীর্ঘশ্বাস মত বেরিয়ে এল।আমাদের শিড়দাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত যেন নীচের দিকে নেমে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে।
 
    আমাদের তখন ঐ ছেলেটির দুঃখজাগানিয়া গল্প শোনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে বা সাহস কোনোটাই ছিল না।কোনোরকমে তিনজনে একে অপরকে সাহস জুগিয়ে বাকি পথটুকু পেরিয়ে বাড়ি ফিরি। আকাশ তখন পুরোপুরি শান্ত।চারিদিকে অপার নিস্তব্ধতা।মাঝে মাঝে আকাশের বুক চিরে আঁকাবাঁকা পথের মত শব্দহীন বিদ‍্যুতের ঝলকানি।এ যেন ভয়ঙ্কর এক ঝড়ের পূর্বাভাস।
 
    তবুও নিজেদের ঘরে ফিরে শান্তি।তিনজনেই বাইরের জামাকাপড় ছেড়ে পরিস্কার হয়ে রাতের খাওয়া মিটিয়ে শোয়ার প্রস্তুতি করতে থাকি।একটা জিনিস তখন থেকে লক্ষ্য করছি,এত খেলনা পেয়ে ,মেলা ঘুরেও টুবলু যেন অসম্ভব রকমের শান্ত হয়ে রয়েছে।যেটা একেবারেই ওর স্বভাব বিরুদ্ধ।কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলেও মাথা নেড়ে খালি জবাব দিচ্ছে “ কই! কিছু না তো!”
তবে আমি বেশ বুঝেছি, ঐ ছেলেটিকে টুবলু কিছুতেই মাথা থেকে বের করতে পারছে না।বেলুন ওর ভীষন প্রিয় কিন্তু নিয়ে আসা থেকে এই বেলুনগুলো নিয়ে টুবলুকে একবারও খেলতে দেখলাম না।বেলুনগুলো যেন বড় অদ্ভুত ! স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ খানিকটা বড় আর যেন ভয়ঙ্কর রকমের স্থির।টুবলু ওগুলো নিয়ে খেলছেনা বলে দুটোকেই সুতো দিয়ে ঘরের একটা কোণে পেরেকের সঙ্গে বেঁধে দিয়েছি কিন্তু ফ‍্যানের হাওয়াতেও ওদুটোর কোনো নড়ন-চড়ন নেই।বহু বার নজর করলাম, ভাবলাম হাওয়াতে বেলুন নড়ে না? হয়ত চোখের ভুল ,হয়তো বা মনের কোণে কোনো ভয় থেকে এরকম মনে হচ্ছে।যখন নড়ছেনা তখনই হয়ত আমার চোখ পড়ছে।ছেলেটির অদ্ভুত খ‍্যাসখ‍্যাসে গলার স্বর,ঝলসানো চেহারা কিছুতেই যেন অবচেতন থেকে যেতে চাইছে না।হয়ত টুবলু বা ওর বাবারও তাই।
 
    কেউই মেলা থেকে ফিরে সে রকম কোনো কথাবার্তাই বলিনি। তারপর কাজ সেরে যে যার শুয়ে পড়লাম।বাইরে আবার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে।জল পড়ার টুপটাপ আওয়াজ শুনতে শুনতে কখন  যেন ঘুমিয়ে পড়েছি।
কড়্ কড়্ কড়াৎ...
বিকট একটা বাজের শব্দে হঠাৎ ঘুম ভাঙে।আমি চমকে বিছানায় উঠে বসি।ঘরের হালকা নীল নাইট বাল্বের আলোটা কেমন যেন দপদপ করে বন্ধ হয়ে যায়।আমি অন্ধকারে হাতড়ে দেখি পাশে টুবলু নেই।কোথায় গেল?
বাথরুমে? কই জলের শব্দ হচ্ছে না তো? আমি চিৎকার করে ডাকি “টুবলু” ...গলা দিয়ে কেমন যেন একটা খ‍্যাসখ‍্যাসে আওয়াজ বের হয়।ঠিক ঐ ছেলেটির মত!
 
    সারা শরীর ঘামতে শুরু করে।আমি দৌড়ে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে বিছানার ধারে শোয়া টুবলুর বাবার পায়ে ধাক্কা লেগে অন্ধকারে প্রায় হোঁচট খেয়ে পড়ি। কোনোরকমে সামলে ওর গায়ে ধাক্কা দিয়ে ওঠানোর চেষ্টা করি-
“এই ওঠো না,কি গো ওঠো...টুবলু কোথায়?এত অন্ধকার কেন? শুনছ? ওঠো না...”
 
    টুবলুর বাবা কি আমায় শুনতে পাচ্ছে না? ওর শরীর এত ঠান্ডা কেন? কিছু হল? 
আমার নিজের গলার স্বর নিজের কাছেই অচেনা মনে হচ্ছে।সেই এক অদ্ভুত খ‍্যাসখ‍্যাসে আওয়াজ ! আমি টুবলুর বাবার নিস্তেজ শরীর পেরিয়ে দরজার দিকে এগোই।কিন্তু কোথায় দরজা! ঘরের চারদিকের দেওয়াল হাতড়েও দরজা খুঁজে পাচ্ছি না কেন? আমি নিষ্ফল ক্রোধে, ভয়ে,হতাশায় দেওয়ালের গায়ে যত্রতত্র ঘুষি মারতে শুরু করি।আবার বিছানার কাছে দৌড়ে এসে টুবলুর বাবার গায়ে ধাক্কা দিতে শুরু করি...”ওঠো প্লিজ্..টুবলু কোথায় দেখ..” আবার দৌড়ে যাই দরজার খোঁজে ; দেওয়ালে সজোরে ধাক্কা খেয়ে পড়ি।
হঠাৎ মনে পড়ে সুইচ বোর্ডের কথা।ঐ তো ঘরের ঈশান কোনে ,ঠিক দরজার পাশেই তো ছিল সুইচ বোর্ডটা।হাতড়ে হাতড়ে নাগালে আসে সুইচ বোর্ড।বোর্ডের সবকটা সুইচ একসাথে টিপতে শুরু করি।কিন্তু আলো জ্বলছে না কেন? তবে কি লোডশেডিং?
 
    কিন্তু দরজা কোথায়? সুইচবোর্ডের পাশেই তো ছিল। এই তো এই তো দরজা ...শুধু পর্দা দেওয়া ; খোলাই তো আছে,তাহলে এতক্ষণ ধরে পুরো দেওয়াল হাতড়েও আমি দরজা খুঁজে পাচ্ছিলাম না কেন? গায়ের জোরে পর্দা প্রায় ছিঁড়ে ফেলে এক দৌড়ে শোওয়ার ঘর থেকে বাইরের ঘরে আসি।প্রথমেই চোখ পড়ে বেলুনদুটোর দিকে।সেই পেরেক থেকে ঝোলানো অবস্থাতেই কি ভয়ঙ্করভাবে আন্দোলিত হচ্ছে দুটো বেলুন।এতক্ষণ ফ‍্যানের হাওয়াতেও যেগুলো অদ্ভুত রকম স্থির ছিল, সেগুলো এখন বন্ধ ঘরে ,বিনা ফ‍্যানের হাওয়ায় এমনভাবে নড়ছে কি করে?মনে হচ্ছে, কেউ যেন ঐ বেলুনগুলোর ভেতর বন্দী হয়ে রয়েছে।প্রাণপণ চেষ্টা করছে বেলুন দুটো থেকে বেরিয়ে আসার।
 কিন্তু এ ঘরে আলো কি করে জ্বলছে? শোওয়ার ঘরে তো আলো জ্বললো না? এখানে তো সব দেখা যাচ্ছে।টুবলু কোথায় গেল?—“টুবলু...টুবলু,তুই কোথায়? বাথরুমে?”
 
    কই বাথরুমে তো কোনো আলো জ্বলছেনা? আমি অস্থির হয়ে বাথরুমের দরজা ঠেলে ভেতরের অন্ধকারে তাকাই।তখনই আবার কড় কড় কড়াৎ করে ভয়ঙ্কর একটা বাজ পড়ে।বাথরুমের কাঁচের জানলায় বিদ‍্যুতের আলো প্রতিফলিত হয়ে আমার চোখে পড়ে।ক্ষণিকের সেই আলোয় মনে হয় আমার সামনে দাঁড়িয়ে সেই চেহারা...ঝলসানো, কোঁচকানো, পুড়ে যাওয়া ভয়ঙ্কর সেই মুখাবয়ব! খ‍্যাসখ‍্যাসে গলায় দুটো বেলুন নিয়ে বলছে— “বেলুন নেবে দিদি, বেলুন? নাও না গো দুটো..”
আমি চিৎকার করে দরজা বন্ধ করে বাইরে তাকাতেই আবার দেখি হাওয়া-বাতাসহীন ঘরে অদ্ভুতভাবে আন্দলিত হওয়া সেই বেলুনদুটোকে।ওগুলো যেন কিছুতেই আর সুতোর বাঁধন মানছিল না।দুটো বেলুন যেন দুটো হাত হয়ে আমার গলার দিকে ধেয়ে আসছে...আর সেই অদ্ভুত খ‍্যাসখ‍্যাসে গলা-“বেলুন নেবে দিদি? বেলুন?”
 
    আমি আর সহ্য করতে পারছি না।চিৎকার করলে নিজের গলা দিয়েও বেরোচ্ছে সেই অদ্ভুত খ‍্যাসখ‍্যাসে স্বর! দু-হাতে মাথার চুল ছিঁড়ে দিতে ইচ্ছে করছে...
 
    হঠাৎ চোখ পড়ে টেবিলে রাখা কাঁটা চামচটার দিকে।প্রচন্ড আক্রোশে কাঁটা চামচটা হাতে তুলে নিয়েই শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি বেলুনদুটোর উপর ,ঠিক যেমনভাবে শেষ মুহুর্তে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত,অসহায় শিকার শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও করে প্রতিঘাত, বাঁচার ক্ষীণ আশায় ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারীর উপর।
 
    বাজ পড়ার মতই বেলুনদুটো ফাটার বিকট আওয়াজে খানখান হয়ে যায় ঘরের নিস্তব্ধতা।চারিদিক আলোয় আলোময় হয়ে ওঠে আর আমার চোখে নেমে আসে অতল অন্ধকার।ভূপতিত হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহুর্তে দূর থেকে শুনতে পাই টুবলুর ক্ষীণ স্বর...
“মা, মা, কি হল মা ? তুমি এখানে কেন?তুমি অমন করছ কেন মা??”

            
                                        **সমাপ্ত***
 
Suchismita Chakraborty