কবিতা - চন্ডাল - ডা: শুভায়ু দে

 চন্ডাল 

 ডা:শুভায়ু দে





আমাদের কোনো শাখা নেই।
শাঁখা থাক বা না থাক,বিবাহিত বা অবিবাহিত
ব্রাহ্মণ,শুদ্র,মুচি,মেথর বা আমাদের মতোই চন্ডাল—
এখানে যত্ন সহকারে পোড়ানোর সুব্যবস্থা আছে।

বিয়ে হয়নি বলে সুইসাইড করেছেন,অথবা লোনের চাপ
কিংবা প্রেমিক বা প্রেমিকার বিরহে এ্যাসিডকন্ঠী হয়েছেন?
বিশ্বাস করুন,ব্যাস একটা ধাক্কা।
সুরুৎ করে চলে যাবেন অগ্নিগৃহে।
ইহকাল আর পরকালের বিভাজিকায় দাঁড়ানো দরজাকবাট
চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে।

ওপারের খোঁজ আমার কাছে নেই।
এপারের বিভেদের সলিউউশান নেই।
তবে চিরাচরিত ইলিউশানে ভোগা মানুষদের শেষকৃত্য করি আমি।

আমি চন্ডাল।
উঁচুজাতের সাথে এত দীর্ঘক্ষণ বার্তালাপ করার অধিকার নেই।
ফোন নম্বর লাগলে ইনবক্স করতে পারেন। 

.....................

 Suvayu Dey

 


 

জোঁকা - পার্থপ্রতিম

 

জোঁকা
পার্থপ্রতিম
 
বিন্থটদের মানুষ ভয় পায়।
আবার বিন্থট ছাড়া মানুষের চলেও না।
দরকারে না পড়লে কেউ বিন্থটদের সংস্পর্শে আসতে চায় না। দরকার শেষ হলে তাড়ানোর জন্য ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।
বিন্থটরা জানে মানুষের ভালবাসা পাওয়ার জন্য তাদের জন্ম হয়নি।তাদের জন্ম মানুষকে পিশাচ এবং রাক্ষসদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য।
পৃথিবীতে পিশাচ ও রাক্ষসদের সংখ্যা কিছু কম নয়।
কিন্তু বিন্থটরা ক্রমেই কমে আসছে। আশ্রমে নতুন বিন্থটের জোগান খুব কম। কোন মানুষ সাধ করে আর বিন্থট হতে চায় না। মৃত্যুর পর তারা চায় শান্তিতে ঘুমোতে, পিশাচের সাথে লড়তে নয়।
বাড়ির লোককে মৃত্যুশয্যায় তারা শেষ ইচ্ছের কথা বলে যায় - তা হল চিতার অগ্নি।
গত বছর মাত্র বারোজন নতুন বিন্থট তৈরী হয়েছিল। আর তাদের মধ্যে দশজনেরই কোন পূর্বপরিচয় পাওয়া যায়নি। বিন্থট আশ্রমের গুরুজি বলেন - পূর্বপরিচয় অজানা থাকলে সেই মানুষকে বিন্থট করা খুব বিপজ্জনক।
বিন্থটদের কাজ খুবই দায়িত্বশীল৷
অপরিমিত ক্ষমতার সাথে আসে পর্যাপ্ত দায়িত্ব।বিন্থটদের প্রত্যেককে সেই দায়িত্ব নিতে হয়।
সেই দায়িত্ব হল কোনভাবেই কোন মানুষের কোন ক্ষতি না করা। নিজের প্রাণ দিয়ে হলেও মানুষকে রক্ষা করা।
অবশ্য বিন্থটদের প্রাণ থাকে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।
কারণ বিন্থটদের নিশ্বাস পড়ে না। আর বিন্থটদের খাদ্য হল পশুপাখির কাঁচা রক্ত৷ আর কিছু খায়না তারা। একদিন রক্তপান করলে তারা এক পক্ষ কাল না খেয়ে চলতে পারে। বিন্থটদের জল খাওয়ার প্রয়োজন হয় না।
তাই বেশির ভাগ মানুষ বিন্থটদের দানবের এক রকমফের বলে মনে করে এবং যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখে।
তবে গুরুজী বলে অনেক আগে বিন্থটদের সম্মান দিত মানুষ, ভয় পেলেও প্রাণ বাঁচানোর জন্য তাদের শ্রদ্ধা করত।
বিন্থটদের নিয়ে গাথা লেখা হত। রাতের বেলায় বিন্থটদের বীরত্বের গল্প করত মায়েরা। শিশুরা সেই শুনে ঘুমতো।
ঙিন একবার জিজ্ঞাসা করেছিল - গুরুজি, এখন তাহলে এই অবস্থা কেন? বিন্থটদের দেখলে মানুষ সরে যায়। দরকারে না পড়লে দশ হাতের মধ্যে আসে না। কেন?
এর কারণ হল পূর্বজন্মের সংস্কার - গুরুজি শান্তসুরে বলেছিলেন। - পূর্বজন্মের সংস্কার ছাড়া এমন হয় না। আগে বিন্থট হতেন রাজপরিবারের বীরেরা। যুদ্ধে আহত হলে তাঁরা নিজে বিন্থট হয়ে মানুষকে রক্ষা করার ব্রত নিয়ে আশ্রমে আসতেন।
এখন আমরা কাদের বিন্থট করছি! রাস্তায়, সরাইখানায় পড়ে থাকা মরতে বসা ভিখিরি, চোর, ডাকাতদের। প্রায় কারোরই পূর্বপরিচয় আমরা জানি না।
ওদের মধ্যে খুনেরাও যে লুকিয়ে নেই কে বলবে!
সেই স্বভাব যাবে কোথায়। ওদের থেকে যে বিন্থটরা তৈরী হয় তারা রুক্ষ, কুটিল, ক্রুর হয়। স্বাভাবিকভাবেই মানুষরা তাদের পছন্দ করবে না। তাই মানুষদের দোষ দিয়ে লাভ নেই৷
মানুষের অনেক খারাপ স্বভাবের মধ্যে একটা হল অমূলক গুজব রটানো। এক কণা চালকে এক থালা ভাত বানিয়ে দেওয়া।
তাই বিন্থটদের নামে অনেক বিভৎস গল্প চালু হয়েছে সময়ের সাথে।
এতে আশ্রমের কিছু করার নেই।
প্রতি বছর অন্তত দশজন বিন্থট না তৈরী করতে পারলে শহর গ্রাম বাঁচান মুশকিল হবে।
সব খেয়ে ফেলবে পিশাচে।
ঙিন মাথা নাড়ল।
ঙিন একজন নতুন বিন্থট। জন্মসাল পাঁচশো বাইশ৷
গুরুজি বললেন - ঙীন, ডাক এসেছে। দেড়শো মাইল দূরে হড্ডর অঞ্চলে একটা পিশাচের উপদ্রপ শোনা গেছে। ইতিমধ্যেই পাঁচজনের মৃত্যু ঘটেছে। হড্ডর থেকে দুজন এসেছিল বিন্থটের খোঁজে, দু থলে স্বর্ণমুদ্রা অগ্রিম দিয়ে গেছে। এবার যাবার সময় হয়েছে। আশ্রমে তোমার অস্ত্রশিক্ষা সম্পূর্ণ। তুমি নিজে কি মনে করছ?
তুমি কি পিশাচের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত।
ঙিন ঘাড় নাড়ল। বিন্থট হওয়ার পর প্রায় একবছর গুরুজি ও তাঁর দুই সহকারী নতুন বিন্থটদের অস্ত্রশিক্ষা দেন। ঙিনের সেই শিক্ষা শেষ হয়েছে।
অঘোরীবাবার মন্দিরে গিয়ে প্রণাম করে গুরুজির আশীর্বাদ নিয়ে ঙিন বেরিয়ে পড়ল। বিন্থটদের মনে আবেগ তেমন জন্মায় না। তবু, ঙিন নিজের মধ্যে একটা অন্যরকম উত্তেজনা অনুভব করছিল।
হড্ডর গ্রামে হেঁটে পৌছতে ঙিনের লাগল সাতদিন।
সে গ্রামে ঢুকতেই সেখানের লোকেরা তার উপস্থিতি বুঝতে পেরে সরে সরে যেতে লাগল। কেউ তার কাছে আসতে চায় না।
বিন্থটেরা নিজেদের পরিচয় লুকোয় না। তারা প্রত্যেকে ডান হাতে অঘোরীবাবার নামাঙ্কিত সোনালী বাজুবন্ধ পরে থাকে। তাছাড়াও বিন্থটদের চুল কটা হয়।
হড্ডর গ্রামের সভাপতির ঘরে সোজা গিয়ে উঠল ঙীন, নিজের পরিচয় দিল। যদিও সে বুঝতে পেরেছিল সভাপতি তাকে দেখামাত্র চিনতে পেরেছে।
মনের অস্বস্তি লুকিয়ে সে ঙিনকে যথাসাধ্য অভ্যর্থনা জানাল। বলল যে উপদ্রপ শুরু হয়েছে একটা জলপিশাচের।
মোট সাতজন গ্রামবাসীকে সেটা রাতের বেলায় ঘুমন্ত অবস্থায় পা ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে জলে ডুবিয়ে মেরেছে। তাদের দেহ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ঘর থেকে পুষ্করিণী পর্যন্ত ধুলোর ওপর ভারী কিছু টেনে নিয়ে যাওয়ার দাগগুলো শুধু পাওয়া গেছে।
সারা গ্রামের লোকজন আতঙ্কে সিঁটিয়ে রয়েছে৷
তারপর সভাপতি ঙিনকে বলল - তুমি যদি আমাদের রক্ষা কর আমরা সবাই তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।
কৃতজ্ঞতার কথা শুনেই মাথা গরম হল ঙিনের। মানুষের অনেক কিছু থাকতে পারে, কৃতজ্ঞতা বোধটা তাদের একদমই নেই৷
সে ঘষা ঘষা গলায় বলল- সে ঠিক আছে। আমার পারিশ্রমিক তিনশো স্বর্ণমুদ্রা। পিশাচ টা যদি নতুন প্রজাতির কিছু হয় তাহলে আরো পাঁচশো। আপাতত আমার তিনটে বড়ো ছাগল চাই। আর একটা গামলা।
সাতদিন না খেয়ে আছি।
সভাপতি ব্যাস্তসমস্তভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ঙিনের থাকার ব্যাবস্থা করা হল একটা আধভাঙা গোয়ালঘরে। গোরুগুলোকে সদ্য সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সারা ঘরটায় পচা গোবরের বোঁটকা গন্ধ।
ঙিন কিছু মনে করল না। মানুষের কাছ থেকে বেশি কিছু বিন্থটেরা আশা করে না।
শুধু পারিশ্রমিকটা ঠিকঠাক বুঝে নেয়।
পারিশ্রমিক না নিলে গুরুজির আশ্রম চলবে না। অঘোরীবাবার মন্দিরে বিন্থট তৈরী হওয়াও বন্ধ হয়ে যাবে। তখন মানুষদের পিশাচের হাত থেকে বাঁচাবার কেউ থাকবে না।
তাই লোকেরাও পারিশ্রমিক ঠিকঠাক পৌছে দেয়।
বহুকাল আগে কোন একটা গ্রাম পিশাচমুক্তির পর বিন্থটের পারিশ্রমিক দিতে গোলযোগ করেছিল।
তার পরের এক মাসের মধ্যে বিভৎস সব পিশাচ আর রাক্ষসের উপদ্রপ শুরু হয়েছিল সেই গ্রামে। বহু অনুরোধেও গুরুজি আর কোন বিন্থট পাঠাননি সেখানে। শ্মশান হয়ে গেছিল পুরো অঞ্চল।
গুরুজি বলেন - সবই অঘোরীবাবার খেলা।
গোয়ালঘরের এককোণে চারটে মাঝারি আকারের ছাগল বাঁধা আছে। ঙিন তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তারা ভয়ে লাফালাফি করা শুরু করল।
ওরা বোধহয় আসন্ন মৃত্যু বুঝতে পেরেছে।
বেশি সময় নিল না ঙিন। হাতের কাছে পোশাক টা কনুই পর্যন্ত তুলল। দুহাত মুঠো করে জোরে ঘোরাতেই চেটোর কাছ থেকে দুটো ধারালো চকচকে লোহার ফলা বেরিয়ে এল।
দু হাতের এই ফলাদুটো হল বিন্থটের অস্ত্র। অঘোরীবাবার দান। গুরুজির নিজের হাতে বসিয়ে দেওয়া।
সাঁৎ সাঁৎ করে বাতাসে একটা আওয়াজ হল। মুন্ডহীন ছাগল চারটে নেতিয়ে পড়ল গামলার ওপর।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের রক্তে গামলাটা ভরে উঠল।
ঙিন সেটা তুলে কয়েক চুমুকে শেষ করে দিল। হাতের চেটোয় করে মুছে নিল মুখের রক্ত।
এখন দিন পনেরোর জন্য নিশ্চিন্ত।
পুষ্করিণীটা দেখে প্রথমেই খটকা লাগল। এতো ছোট জলাশয়ে জলপিশাচ থাকে কেমন করে। জলপিশাচের প্রিয় থাকার জায়গা হল বিশাল জঙ্গলে ঢাকা গভীর হ্রদ - টদ।
আর এই পুষ্করিণী তো গ্রামের একদম মাঝখানে। তিনদিকে ঘরবাড়ি। পুষ্করিণীর একদিকে আবার একটা মন্দির রয়েছে। কয়েকটা পুরনো বট অশ্বত্থ গাছ। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়টা হল পুষ্করিণীটা নতুন খোঁড়া। বছরখানেকের বেশি পুরনো নয়। ধারে ধারে এখনো কোদালের দাগ দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার।
জলপিশাচ পুরনো জলাশয় ছাড়া থাকে না।
গ্রামের লোকেরা নিশ্চয়ই কিছু লুকোচ্ছে।
সে সভাপতিকে বলল - পিশাচটাকে কেউ দেখেছে?
-- না।
-- তা হলে বুঝলে কি করে যে জলপিশাচ?
---আজ্ঞে সবাইকে যে জলেই টেনে নিয়ে গেছে। জলে তো জলপিশাচই থাকবে।
ঙিন একবার লোকটার দিকে আগুনদৃষ্টিতে তাকাল৷ গুটিয়ে গেল লোকটা।
পিশাচ আর রাক্ষসের কতরকম ভাগ হয় তা ও কি করে জানবে। আশ্রমে পিশাচ আর রাক্ষসের ওপর একশো দশ খন্ডের বই আছে। প্রত্যেকটা পড়তে হয়েছে ঙিনকে। জানতে হয়েছে কোন রাক্ষসের কোন দূর্বলতা। কোন পিশাচ কি সহ্য করতে পারে না।
জলে থাকে এমন পিশাচ আর রাক্ষস আছে প্রায় তিনশো প্রজাতির। এসব অজ্ঞ আর অকৃতজ্ঞ দূর্বল মানুষকে সেসব বলে কি লাভ!
সে বলল - আজ রাত থেকে সে গোটা গ্রাম পাহারা দেবে। সারারাত।
সভাপতি গ্রামের সবাইকে কি যেন বলল।তারপর সবাই চলে গেল।
ঙিন নিশ্চিত গ্রামের লোকেরা তার কাছে কিছু লুকোচ্ছে। কিছু একটা বলছে না তাকে।
প্রথম দুরাতে কিছু ঘটল না।
তৃতীয় রাত্রে পুকুরের পুব কোনে কিছু একটা ভারি জিনিস টেনে নিয়ে যাওয়ার শব্দ হল।
তাড়াহুড়ো করল না ঙিন। নিঃসাড়ে পুকুর পাড়ে যেতেই বুঝে গেল কি হয়েছে! সে বিশ্বাস করতে পারল না গ্রামের লোকেদের এত দুঃসাহস হল কিভাবে!
পুকুরের জল থেকে যেটা উঠে আসছে সেটা যে সে পিশাচ নয়।
ছাইয়ের মতো সাদা মুখ আর হলুদ চকরাবকরা জামা পরা সেটা একটা জোঁকা।
জোঁকাটা দাঁত বের করে হাঁসতে হাঁসতে জল থেকে উঠে পাশের একটা ঘরে ঢুকল। একটু বাদে একটা নির্জীব মহিলাকে পা ধরে টানতে টানতে জলে নিয়ে গেল।
তারপর মাঝপুকুরে গিয়ে টপ করে ডুবে গেল। মহিলাটার আর কোন হদিশ রইল না।
ঙিন চুপচাপ অন্ধকারে বসে বসে পুরো ব্যাপারটা দেখল। রাতেরবেকায় জোঁকাদের চাইতে ভয়ংকর কিছু নেই৷ রাত্রেবেলায় জোঁকা অদম্য। এমনকি বিন্থটেরও সাধ্য নেই রাতে জোঁকার কিছু করে।
তাই ঙিনের দেখা ছাড়া কোন উপায় ছিল না।
তাছাড়া গ্রামের সভাপতির সাথে বোঝাপড়াও বাকি ছিল।
তার জন্য সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
সকাল হতে মুঠো ঘুরিয়ে হাতের ফলা বের করে সভাপতির ঘরে গেল ঙিন। তারপরে সোজা সভাপতির কাঁধ থেকে একটা হাত কেটে ফেলল। আশপাশের লোক আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। তারা ভাবল এই বিন্থট পাগল হয়ে গেছে, এবার সবাইকে মেরে ফেলবে। তারা এদিক ওদিক ছোটাছুটি শুরু করে দিল।
ঙিন শীতল গলায় সভাপতিকে বলল - জোঁকা মানুষে তৈরী করে। তারপর নিজের লুকোন ধনরত্ন পাহারা দেবার কাজে লাগায়। তবে কোন কারণে মন্ত্র পড়া ভুল হলে জোঁকা জেগে উঠে যারা তাকে বানায় তাদেরকেই তীব্র আক্রোশে খুন করে। আমি জানতে চাই নতুন পুষ্করিণীর জোঁকাটাকে কে বানিয়েছে আর কেনই বা বানিয়েছে?
সভাপতির কাটা কাঁধ থেকে দরদরিয়ে রক্তপাত হয়ে চলেছে। সে হাঁফাতে হাঁফাতে জড়িয়ে মড়িয়ে যা বলল তা থেকে ঙিনের পুরো ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হল না।
মানুষ যে আসলে অত্যন্ত লোভী শয়তান সে বিষয়ে তার ধারণা আরো পোক্ত হল।
এই গ্রামে কয়মাস আগে পঁয়ত্রিশ একদল ভ্রাম্যমাণ পথিক আসে। তারা টাকা পয়সা দিয়ে সভাপতির বাড়িতে আশ্রয় নেয় রাতটুকু থাকার জন্য৷ তারা জানত না এ গ্রামের লোকেদের লুকোন ব্যবসাটা কিসের।
সে রাতেই বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে সব লোকগুলিকে খুন করে সভাপতি সহ গ্রামের লোকেরা। পথিকদলের সঙ্গে ছিল প্রচুর সোনা দানা, ধন রত্ন। অত মূল্যবান জিনিস নিরাপদে লুকিয়ে রাখতে সভাপতি একটা জোঁকা বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। পুকুর খোঁড়া শুরু হয়। পাশে মন্দির। মন্দিরের নিচে একটি গোপন ঘর। পথিক দলের মধ্যে একটা পনেরো বছরের ছেলে ছিল। তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল৷ পুকুর খোঁড়া শেষ হলে ওই মন্দিরের নীচে গুপ্তঘরে ছেলেটাকে মন্ত্র পড়িয়ে পুজো করে সোনাদানা ধনরত্নসহ রেখে আসা হয়।
তারপর সেই ঘরের দরজা এঁটে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এরপর ওই ধনরত্নে অজানা কেউ হাত দিলেই জোঁকার নজর পড়ত তার ওপর।
সে ওই ধনরত্ন পেলেও তা ভোগ করতে পারত না৷
তবে মন্ত্রে যদি গোলযোগ হয় তাহলে জোঁকা যারা তাকে মন্ত্র পড়ায় তাদেরকেই এক এক করে মারে। কাউকে ছাড়ে না।
হড্ডর গ্রামে ঠিক তাই হয়েছে।
এসব বলে সভাপতি কাতরাতে কাতরাতে ঙিনের পায়ে পড়ে গেল। বলল - আমাদের বাঁচাও বিন্থট। তুমি যা চাও তাই দেব আমরা। মন্দিরের সব ধনরত্ন তোমার। শুধু আমাদের প্রাণটা বাঁচাও৷
ঙিন বলল - ওই সম্পদ এখন অভিশপ্ত। জোঁকার সাথে লড়ার ক্ষমতা একজন বিন্থটের নেই। আর তোমাদের মতো মানুষকে বাঁচানোর কোন ইচ্ছে আমার নেই। আমার মনে হয়না গুরুজী এসব জানলে আমাকে তোমাদের রক্ষা করতে পাঠাতেন। জয় অঘোরী।
সব রকম পিশাচ আর রাক্ষসের মধ্যে সব থেকে নিষ্ঠুরতম হচ্ছে মানুষ৷ পিশাচরা নিজেদের খুন করে না। একমাত্র মানুষরাই নিজেদের একজনকে খুন করে একটা অভিশপ্ত, অতৃপ্ত জোঁকা তৈরী করতে পারে। আর সেই মানুষদের বাঁচানোটাই বিন্থটদের ভবিতব্য।
ঙিন আশ্রমের পথ ধরল। বিন্থটেরা নিশ্বাস নেয় না। নইলে এসময় ঙিন নিশ্চয়ই একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলত।
হড্ডর গ্রাম কিছুদিনের মধ্যেই শুনশান মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল। কেউ আর ওই গ্রামে কোন দিনও থাকেনি। শুধু বাদুড়, হায়েনা আর কিছু বুনো কুকুর ছাড়া।
...........
Partha Pratim
 

 

যে আলো আঁধার ছুঁয়েছে - দেবাশীষ তালুকদার

 

 যে আলো আঁধার ছুঁয়েছে
দেবাশীষ তালুকদার
 
 
       আমার উত্তপ্ত মিডিয়াম সাইজ ল্যাটেতে আমি যখন গভীর মনোযোগের সাথে চকোলেট পাউডার মেশাচ্ছিলাম, সোহম ততক্ষনে ক্যাফের একটা উইন্ডো সীটে বসে পড়েছে। আমি কফিতে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে তার দিকে এগিয়ে যেতেই সে তার দু ভুরু নাচিয়ে বলল,
— “শ্রেয়সী, সত্যিকারের ভালবাসায় তোমার বিশ্বাস আছে?”
আমি ফিক করে হেসে জানলার বাইরে তাকালাম। সূর্যটা ততক্ষনে ডুবে গেছে। গোধূলির সূর্যবিদায়ের তখন অনেক রঙ। সোহম টেবিলে আলতো নক করতেই আমি তার চোখে চোখ রেখে বললাম,
— “তোমরা আমেরিকায় বড় হওয়া কিডজ্ আবার সত্যিকারের ভালবাসার ধার ধারছো কবে থেকে? তোমাদের তো কারোর চোখের দিকে তাকালেই প্রেম হয়ে যায়!”
সে হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল,
— “ওহ্ শ্রেয়সী! not again!”
আমি মুচকি হেসে বললাম,
— “ঠিক আছে! কিন্তু সোহম, আমার যে ট্রু ফলস্ কোনরকম ভালবাসাতেই বিশ্বাস নেই! যত যাই বল ওসব ‘তোমাকে ছাড়া বাঁচব না’- টাইপ ভালবাসার দিন পৃথিবীতে আর নেই।“
— “কখনো প্রেমে পরোনি? সিরিয়াসলি...?”
— “কে বলেছে পরিনি? অনেকবার পরেছি।“
সোহম সব কটা দাঁত বের করে বলল,
— “ওয়াও! তবে শুনতে চাই ম্যাম!”
আমি কফিতে বিরাট একটা চুমুক দিয়ে বললাম,
— "তুমি কতক্ষণ শুনতে পারবে বলে মনে কর?”
— "তুমি যতক্ষণ বলতে পারবে বলে মনে কর!”
আমি অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললাম,
— "সোহম, টিনেইজ লাইফে আমি প্রথম যার প্রেমে পড়েছিলাম, সে আমার বাড়ির সামনে রোজ বিকেলে ক্রিকেট খেলতো। সে খেলতো আর আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিল্ করতাম। তার ঠিক এক সপ্তাহ পর আমি আবিষ্কার করলাম, ক্লাস এইটে পড়ুয়া সেই ইচড়েপাকা ছেলেটির একটি গার্লফ্রেন্ড আছে।… তোমার এইসব লেইম স্টোরি শুনতে ভাল লাগছে?”
— “না লাগছে না, এসব ষ্টুপিড স্টোরি সবার লাইফেই মোটামুটি কমন। আমি তোমার ট্রু লাভস্টোরি শুনতে চেয়েছি!!”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
— “ট্রু..? আমি তোমাকে আগেই বলেছি সোহম, ওসব ট্রু লাভস্টোরি বলে পৃথিবীতে কিছু নেই।”
— "কিছু নেই’....কথাটির পেছনেও অনেক কিছু থাকে....তাইনা??”
 
       আমি ঠোঁট চেপে এক মুহুর্ত চুপ করে সোহম এর দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার চাইতে ভাল আর কেউই বোধহয় জানেনা, যে এই সোহম ছেলেটি আমাকে এভারেজের থেকে একটু বেশিই পছন্দ করে। আমেরিকার এই নিঃসঙ্গ জীবনে আমি যখন বন্ধুহীনতায় মোটামুটিভাবে নিজেকে একঘরে করে ফেলছিলাম, ঠিক সেই সময়েই সোহম এর সাথে আমার পরিচয়। এই 'ভালবাসা' বা 'প্রেম' বিষয়ে আমার বাজে ধরনের অভিজ্ঞতা না থাকলে এতদিনে আমি হয়ত ওকে ভালোবেসে ফেলতাম। আমার ওপর এই সোহমের এতটা আন্তরিক অনুভূতি থাকবার পরেও কিন্তু ও আমার নিজের চারপাশে তুলে রাখা দেয়ালটা কখনও ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করেনি। দেয়ালের ওপাশে থেকেই সে আমার সঙ্গে থাকে, আর অপেক্ষা করে এই ভেবে– কোনদিন হয়ত আমি নিজেই তাকে দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে দেব। আমি আমার প্রচন্ড আক্ষেপটাকে চেপে রেখে সোহম এর দিকে তাকালাম। কেন যে আমি এই ছেলেটিকে এখনও ভালবাসতে পারিনা..! ক্ষনিকের আটকে রাখা দীর্ঘশ্বাসটা ছেড়ে দিয়ে বললাম,
— "সোহম, আমার জীবনের একমাত্র সত্যিকারের ভালবাসাটি এসেছিল ঠিক পঞ্চমবার, কারো ব্যাক্তিত্বে মুগ্ধ হবার পর। আমি ছেলেটিকে প্রচন্ড ভালবাসতাম, হ্যা! ঠিক যেমন করে সিনেমার নায়িকারা সব ভুলে গিয়ে প্রেমিকের জন্য মরে যেতে চায়, আমি তাকে ঠিক তেমন করেই ভালবাসতাম। অথচ আমার জীবনের সেই সত্যি ভালবাসাটি কদিন টিকেছিল জানো? কেবলমাত্র সাত মাস সতেরদিন। সে চলে যাবার পর আজ অবধি কেটে গিয়েছে সাড়ে ছয় বছর…! অথচ দেখ, আমি দিব্যি বেঁচে আছি। তাই my dear সোহম, এই মুহুর্তে তোমাকে সাক্ষী রেখে আমি শ্রেয়সী, শপথ করে বলছি– 'এ পৃথিবীতে সত্য ভালবাসার গল্প বলে কিচ্ছু নেই!'"
সোহম কিছুক্ষণ থমথমে একটা ভাব নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আর আমি হাসিমুখে দুইহাত দিয়ে কফিমগের উষ্ণতা নিতে থাকি।
--- "জানো সোহম সত্যিই কি অবাক করা ব্যাপার! এতগুলো দিন চলে যাওয়ার পরেও অনির্বাণের কথা ভাবলে আজও আমার চারপাশটা কেমন যেন শীতল হয়ে আসে! অনির্বাণ কিংবা তার স্মৃতি, ধীরে ধীরে তার সব কিছুই অস্পষ্ট হয়ে এসেছে আমার মন থেকে। তার অপলক চেয়ে থাকা চোখ, ঠোঁটের এককোণ বাঁকানো হাসি, হাসবার অছিলায় তার ডানদিকে তাকিয়ে ছাড়া দীর্ঘশ্বাসের শব্দ!! আমি কি তাকে ভালবাসিনি? অথচ এতটা ভালবাসা দেবার পরেও সে আমার হয়ে কখনো থাকেনি...।"
— "কেন থাকেনি সে?”
— "ক্যারিয়ার। এই ড্যাশিং স্টেটসের হাতছানি আর কে রুখতে পারে বলো? আমিতো কোন ফ্যাক্টরই ছিলাম না! নিজের ক্যারিয়ারের জন্য এত দূরে চলে আসবার ডিসিশান সে যখন একাই নিয়ে ফেলেছিল, আমি তখন তার জন্যে ছিলাম শুধুই একটা দেওয়াল, যাকে সে অবলীলায় ভেঙ্গে যেতে পারে, যাকে ভেঙ্গে যাওয়ার দায়বদ্ধতায় একটা সেকেন্ডেও তার চোখের পাতা কখনও ভিজে উঠবেনা!”
— “কষ্ট হয়নি?”
— “হাসবে। শুনলে তুমি হাসবে।”
সোহম অপরাধীর মত মুখ করে বলল,
— “হাসব কেন?”
আমি ওর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললাম,
— "আমাদের সাত মাস সতের দিনের সম্পর্ক যখন শেষের দিকে, আমি তখন দাঁতে দাঁত চেপে রাত কাটিয়ে দিতাম। আমাকে কেউ কোনদিন কখনো কাঁদতে দেখেনি, সেই আমি রাতের পর রাত চোখের জল ফেলতাম। কেউ সেটা দেখেনি, তাই সবটুকু অপারগতা নিজের কাছে রেখে আমি চলে এসেছিলাম।”
— “তারপর?”
— "অনির্বাণের জন্য আমি যেদিন শেষবারের মত কেঁদেছিলাম, সেদিন কলকাতা শহরের বুকে প্রচন্ড শীত নেমেছিল। বাসে জানলার পাশের একটা সিটে বসে আমি সেদিন দুহাত শক্ত করে আমার মোবাইলটাকে চেপে ধরেছিলাম, যে মোবাইলে আসা একটি টেক্সটে অনির্বাণ আমাকে জানিয়েছিল,
– 'ভালবাসা নামক একঘেয়েমিতে তার এখন বিরক্তি চলে এসেছে, আমি যেন তাকে আর ধরে না রাখি'। টেক্সট্ পড়া শেষ হতেই সেদিন আমার চোখ থেকে শেষ কয়েক ফোঁটা কষ্ট ঝরে পরেছিল। তারপর থেকে অনির্বাণের জন্য আমি আর কোনদিন কাঁদিনি! সেই শেষবারের মতো কাঁদবার ঠিক দুদিন পর আমি অনির্বাণকে নিজে ডেকে বলেছিলাম— ‘অনির্বাণ, তুমি মুক্তি চাও? যাও আমি তোমাকে মুক্তি দিলাম।’ সোহম, আমার ট্রু লাভস্টোরির সেখানেই এন্ডিং হয়েছিল!”
 
      এতটুকু বলবার পর সোহম এর সামনে আমি সেদিন আর একটা কথাও বলতে পারিনি। আমার নিজেকে সেদিন সম্পূর্ণভাবে ব্ল্যাংক মনে হচ্ছিল। ফল সিজনের সেই হালকা শীত আমাকে প্রচন্ড রিক্ততায় মেরে ফেলতে চাইছিল যেন! কেন জানিনা, সোহমও সেদিন আর কিছু জানতে চায়নি, চুপচাপ আমাকে তার জ্যাকেটে জড়িয়ে আমাকে আমার ফ্ল্যাটে ড্রপ করে এসেছিল। অথচ আমার কথাগুলো আমি সেদিন শেষ করতে পারিনি। সোহম আমার কাছে যে সত্যি ভালবাসার গল্প শুনতে চেয়েছিল, সেই ভালবাসার অকল্পনীয় মৃত্যুকে আগলে রেখে আমি কিভাবে আজও বেঁচে আছি– সেই গল্পগুলো আমার ওকে বলা হয়নি। আমি হয়ত ড্রাকুলার মতই একাকী জীবন্মৃতের জীবন বেছে নিয়েছিলাম। আমাকে আমার নিজের হাতে শপে দিয়ে অনির্বাণও হয়ত ভাল কাজটাই করেছিল। তাই হয়তো নিজেকে নিয়ে আমি এখন ভালই আছি। যে ক্যারিয়ারের জন্য অনির্বান বহুদুরে চলে গিয়েছিল, আমিও সেলফিশের মত সেই ক্যারিয়ারকে কেন্দ্র করেই একদিন বাড়ি ছেড়েছিলাম। তবে একটা ব্যাপার কি পাঠক জানেন, নিজেকে এই পৃথিবীতে খুব অযোগ্য মনে হলে অনেক দূরের কোন দ্বীপে কাউকে নিয়ে বেঁচে থাকবার মতো একটা স্বপ্ন থাকতে হয়। খুব অলস দুপুরে পৃথিবীতে যখন বৃষ্টি নামে না – কল্পনার সেই দ্বীপে তখন প্রিয় মানুষটির সাথে বৃষ্টিতে ভেজা যায়। অনির্বাণ চলে যাবার পর আমার সে স্বপ্নটা আর নেই।
এরপর আকাশ নীল থেকে লাল হল, আর লাল থেকে আঁধার– আর আমিও ভুলে গেলাম যে, আমারও একটা আকাশ ছিল।
প্রিয় অনির্বান, আমি এখন আর ভুল ভেবে ভুল করিনা। আমি এখন বুঝতে শিখেছি, হালকা রঙের আলতো রোদও বরফ নদীর মত শীতলতা ছড়াতে পারে। এখন চাইলেও তুমি আমাকে আর রাংধনু দেখাতে পারবে না। আমার আকাশে এখন আর কোন বৃষ্টি নেই, আমার সব না পাওয়াগুলো এখন শুধুই শুভ্র, ঠিক তুষারের মতন। আমার চারপাশের পৃথিবীটা ছোট হতে হতে আমার জানলার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, আমিও সেই জানলার পাল্লা এঁটে দিয়েছি চিরদিনের মতো। অনির্বাণ, আমি যে চিরকাল আঁধার ভালবেসেছি, আলোতে আমার কেমন করে পোষাবে বলো? আমার এই আঁধারেই সোহম একটু একটু করে আলো জ্বালিয়ে এসেছে অনেকদিন ধরে। আমি ওকে আগে কোনদিন বলিনি আমার একটা গল্প আছে। এখানে আসবার পর আমি যখন সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলাম, এই সোহম তখন আলোর মত ঝলমল করা হাসিমুখ নিয়ে আমার পাশে বসে থাকত। প্রথমদিকে আমি বিরক্ত হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলতাম,
— "সোহম, তুমি সর্বক্ষণ এইভাবে যে আমার পাশে বসে থাকো, সেটা কিন্তু একটুও মানায় না, জানো সেটা?”
সোহম ফাটা বেলুনের মত চুপসে গিয়ে বলত,
— "তুমি এত রেসিস্ট, শুধুমাত্র আমার গায়ের রঙ ফর্সা নয় বলে তুমি আমাকে বেমানান বললে?”
— "তুমি কি ইচ্ছে করেই এমন করো? এত হাসিখুশি একটা মানুষ হয়ে আমার মত বোরিং পাবলিকের সাথে কি করে মিশছো?”
— "আমার যে ভাল লাগে, আমি কি করতে পারি?”
আমি সোহম এর এই অসম্ভব ইনোসেন্ট কথাবার্তায় আটকে যাই। সেই তো, আমরা মানুষরা বড় অসহায়; আমাদের ভাল লাগলে – আমরা কি করতে পারি?
সোহমকে এরপর আমি আর “না” করতে পারিনি। তার ভাল লাগে আমার সাথে থাকতে, আর ওর এই ভাল লাগার স্বীকৃতিটা আমি যদি নাও দিতে পারি, তবুও সে একইভাবে থাকবে আমার সাথে। ওর কি এভাবে বাঁচতে পেরেও ভাল লাগবে! কে জানে!
কিন্তু সেদিনের সেই সন্ধ্যায়, আমাকে বাড়িতে ছেড়ে আসবার পরদিন থেকে প্রায় দুই সপ্তাহ, ছেলেটা যেন বেমালুম গায়েব হয়ে গেল। আমার গল্প শুনে ও কি কোন আঘাত পেয়েছে তবে!!
আমার কখনো মন খারাপ হলে আমি আমার বাড়ির কাছে ছোট্ট একটা পাহাড়ে চলে যাই। উঠতে পারা যায় এরকম মোটামুটি একটা টিলার উপর গিয়ে আমি লম্বা হয়ে শুয়ে থাকি। কখনও চিৎকার করি, আবার কখনো বাকি সময়টাতে ছবি আঁকি। আমাকে ফলো করে সোহম একদিন চলে এসেছিল এখানে। আমি বিরক্ত হয়ে ওকে চলে যেতে বলায় ও কাচুমাচু হয়ে বলেছিল,
— "মনে কর, সোহম কোন মানুষ নয় – আমি সোহম একটা পাহাড়। কোন ফাংশান নেই। তবু থাকি!!”...
আজ আকাশের নিচে শুয়ে শুয়ে ওর ওই কথাটা মনে পরতেই ফিক করে হেসে ফেললাম আমি। পাশে তাকিয়ে সোহম নামের সেই পাহাড়টিকে দেখার খুব ইচ্ছে হল আমার। সত্যি! মানুষের মন কি বিচিত্র একটি জিনিস! কোইন্সিডেন্স কিনা জানিনা, ঠিক মিনিট পাঁচেক পরেই আমার মোবাইলে সোহম এর একটি কল এলো। আমি ফোন রিসিভ করতেই সে আলতো গলায় বলল,
— " শ্রেয়সী, আমি তোমার কাছ থেকে একটু সময় চাইতে পারি? তোমাকে একটা গল্প বলার ছিল।”
আমি আমার দীর্ঘশ্বাস আটকে বললাম,
— "সোহম, অনেক দিন তোমাকে দেখিনি! আমি আজ তোমাকে দেখতে চাই।“
সোহম যখন আমার পাশে এসে বসল, আমি বুঝতে পারলাম যে এই সোহমকে আমি আগে দেখিনি। আমি তাকিয়ে আছি বুঝতে পেরেই ও একটু ইতস্তত করে বলল,
— "ইয়ে আমি ঠিক আছি । আমি......”
আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললাম,
— "তোমার গল্পটা?“
সোহম এর দৃষ্টি হঠাৎ করে কোথায় যেন চলে গেল, তারপর আমার দিকে না তাকিয়েই ও বলতে শুরু করল--
— "আমার গল্প, একজন শ্রেয়সীর কিংবা একজন অনির্বানেরই গল্প। আমি যখন আন্ডারগ্র্যাড কোর্স শেষ করলাম, তখন একটা ফ্যামিলি ট্যুরে দেশে গিয়েছিলাম দুই মাসের জন্য - বাবার বেস্ট ফ্রেন্ডের বাড়িতে ছিলাম সেই সময়টা। সপ্তাহ দুয়েক যেতেই আমি লক্ষ্য করলাম, আমার ছোটবোন শোহিনী কোন একটা ব্যাপারে কেমন যেন বিহেভ করছে। প্রথমটায় টিনেইজ মেন্টালিটি ভেবেই উড়িয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু পরে বুঝতে পারি প্রবলেমটা আসলে অন্যকিছু। প্রথমবার দেশে বেড়াতে এসে শোহিনী প্রেমে পড়ে গিয়েছিল বাবার সেই বন্ধুর ছেলের। আমি গোপনে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম ছেলেটি ইতিমধ্যেই একটি রিলেশানে আছে। ওর নাম ছিল অনির্বান। শ্রেয়সী নামের একটি মেয়ের সাথে তার রিলেশান।“
আমি তখনো আঙ্গুল দিয়ে মাটির উপর নকশা কেটে চলেছি। সোহম যখন এইটুকু বলে থেমে গেল, আমি একবারের জন্যেও বিচলিত না হয়ে বললাম,
— "চুপ করে থেকো না, সোহম আমি শুনছি।“
— "আমি যখন শোহীনি কে ডেকে সত্যি কথাটা বললাম – শোহিনী বুঝল। বলল, এই ভালোবাসার অনুভূতিকে আর সে মনে ধরে বসে থাকবেনা। আমি নিশ্চিন্ত হলাম আর এরই মধ্যে আমাদের আবার ফিরে যাবার সময়ও হয়ে এল। আমেরিকা ফিরে এসে সবাই সবার মত কাজ কর্মে ব্যস্ত হয়ে গেলেও আমি লক্ষ্য করলাম, শোহিনী আর আগের মত নেই। সে যদিও বোঝাতে চাইছে যে সে ঠিকঠাক আছে, নিজেকে সামলে নিয়েছে। কিন্তু আমি জানতাম – ওর আসলে কিছুই ঠিক নেই। ওর পড়াশুনা, খাওয়া দাওয়া– সবকিছুই ব্যালেন্স হারাতে লাগল। একদিন মাঝরাতে ও সুইসাইড এটেম্পট করতে গেলে, আমি ভাগ্যক্রমে উপস্থিত হয়ে যাওয়াতে ওকে বাঁচাতে পারলাম। আমার কাছে ধরা পড়ে যাওয়ায় শোহিনী বলতে বাধ্য হল, সে আর থাকতে পারছেনা। অনির্বানের সাথে তার এখনো মেসেঞ্জারে কন্ট্যাক্ট হয়। সে নাকি ওকে তার লাভারের ছবিও দেখিয়েছে। ওর এতকিছু মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমি হতভম্ব হয়ে শোহিনীর দিকে তাকিয়ে থাকি – ওকে এভাবে হয়ত কেউ কোনদিন কাঁদতে দেখেনি। সেদিন ওর কান্না দেখে আমি প্রচন্ড বাজে একটা ডিসিশান নিই – আমি ঠিক করি, যে কোন মূল্যেই হোক না কেন অনির্বানকে আমি শোহিনীর কাছে নিয়ে আসব। আর এরপর অনির্বানের সাথে আমার ফ্রেন্ডশিপ – ওকে দেশের বাইরে আনার ব্যাপারে যত প্ররোচনা দেওয়া যায় সবটাই আমি করতে লাগলাম দিনের পর দিন। প্রথমদিকে ওর যে খুব একটা আগ্রহ ছিল তা নয়, কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে ওর রেজাল্ট যখন মনমত হল না, তখন ও আস্তে আস্তে নিজের ডিসিশান বদলাতে শুরু করল। ওর ডিসিশান যখন পেরেন্টস পর্যায়ে চলে গেল, তখন আমাদের দুই ফ্যামিলি মিলে ওর ডিসিশানের রোডওয়ে টা আরেকটু ইজি করে দিল। আর সেই ইজি রোডওয়েটা ছিল – শোহিনীর সাথে অনির্বানের বিয়ে।“
এতটুকু শুনেই চোখ বন্ধ করে ফেললাম আমি । দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
— "আমার আর শুনতে ইচ্ছে করছে না, সোহম“ সোহম মাথা নেড়ে বলল,
— “না, আমাকে বলতেই হবে শ্রেয়সী, সেই বিয়ের রাতেই আমি প্রথম বুঝতে পারি, যে শোহিনীর জন্য আমি আরেকটি মেয়ের সাথে কি ভীষণ অন্যায় করে ফেলেছি! আমার সেই অপরাধবোধ আমাকে প্রতিটা দিন শাস্তি দিতে থাকে। প্রায়শ্চিত্ত করব বলে আমি শ্রেয়সীকে খুঁজে বের করি। দূর থেকে তাকে যখন আসতে দেখতাম, আমার ইচ্ছে করত – আমি দু হাত জোড় করে তার কাছে ক্ষমা চাই। কিন্তু আমি পারতাম না। শেষ পর্যন্ত মেসেঞ্জারে তার সাথে কন্ট্যাক্ট করি। শ্রেয়সী, আমি আমার পরিচয় তোমাকে দিতে পারিনি। কিন্তু তোমার কি সেই মানুষটিকে মনে আছে যার সাথে কখনও দেখা হবেনা বলে তুমি তাকে তোমার সব কথা বলেছিলে? আমি জানিনা, তুমি ভুলে গেছ কিনা – কিন্তু ততদিনে আমি আরও একটি অন্যায় করে ফেলি। আমি বুঝতে পারি, আমার এ জীবনের সব ভাললাগা আমি তোমায় দিয়ে ফেলেছি। যখন সবকিছু তোমাকে বলতে যাব, ঠিক তখনই ভাগ্য তোমাকে নিজে থেকেই আমার দুয়ারে এনে দিল। তুমি জানালে, যে তুমি দেশের বাইরে আসছো আর যে জায়গায় আসার কথা বললে আমি ঠিক সেখানেই থাকি। আমার অপরাধী মন আবার চাইল, সব নতুন করে শুরু করতে। আমি মেসেঞ্জার অফ করে দিলাম – তোমাকে সরাসরি এপ্রোচ করলাম নতুন পরিচয়ে। কিন্তু দেখ, তবুও তুমি আমাকে ভালবাসতে পারলে না। তোমার অজান্তেই আমি তোমার সমস্ত দুঃখের কারন – অথচ তুমি সেটা বুঝতেও পারলে না। কিন্তু আমি আর তোমাকে ঠকাতে পারলাম না শ্রেয়সী। এই মুহুর্তে তোমার সবচেয়ে ঘৃণার মানুষটি যদি আমি হয়ে থাকি, আমি একটুও অবাক হব না। কিন্তু যেভাবেই হোক, should end it......আমি জানিনা আমার অ্যাটোন্মেন্ট কি হতে পারে – দুঃখিত বলবার যোগ্যতাও আমার নেই, শেয়শ্রী।”
অনেক্ষন চুপ করে থাকবার পর আমি শুধু বলেছিলাম,
— "সোহম, একে অপরের প্রতি অনেকটা অনুভূতি থাকার পরেও এ জীবনে একসাথে থাকাটা অনেক সময় সম্ভব হয়না। তোমার অপরাধ কতটুকু আমি জানিনা – আমি শুধু জানি, আমাকে আঁকড়ে রাখবার মত ভালবাসা অনির্বাণের কাছে ছিলনা। অনির্বান তার বর্তমানের জন্যই অনেক বেশি মূল্য দিয়েছিল, আর সেই মূল্যটা ও নিজের ইচ্ছেতেই দিয়েছিল। ওর নিজের ইচ্ছে না থাকলে তোমার কথা ও শুনত না!”
সোহম কিছু একটা বলতে চাইছিল, আমি ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম কোন এক অচেনা চাঁদের আলোয় ওর চোখে জল চিকচিক করছে। একটা বিশাল দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ও বলল,
— “তুমি কখনও তোমার কল্পনায় আমাকে দেখোনি, তাইনা শ্রেয়সী? আজকের পর থেকে 'ওয়ান পারসেন্ট অফ সামথিং' নামক চান্সটাও আমার আর নেই, তাইনা? আমি তোমাকে আর কোনদিন বোঝাতে পারব না, তুমি আমাকে ভালবাসতে না পারলেও আমার তাতে কোন ক্ষতি নেই। আমি শুধু তোমার পাশে থাকতে চেয়েছিলাম। যার কাছ থেকে আমি সব কেড়ে নিয়েছিলাম, তার কাছেই আমার অস্তিত্ব পড়ে রইল। শ্রেয়সী, তুমি কি আমাকে ক্ষমা করবে? তুমি কি আমাকে মনে রাখবে?...“
আমি ওর কথার সেই সুর অসমাপ্ত রেখেই সেদিন চলে এসেছিলাম। সোহম আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল, আর আমি ওকে অপরাধী না ভাবতে পারার অপরাধে দূরে চলে গিয়েছিলাম। অনেক দূরে। সেদিনের পর সোহম এর সাথে আমার যেদিন আবার দেখা হল – তার মধ্যে কেমন করে যেন কেটে গিয়েছিল সাড়ে তিন বছর। আমরা দুজনই তখন বছর ত্রিশ এর। ছেলেমানুষি ভালবাসায় হাস্যকর শিকারে পরিনত হয়ে হাহাকার করবার বয়স তখন আমাদের আর নেই।
-
সেই একই পাহাড় – আগেও যেমন ছিল, এখনও তেমনই আছে। জানিনা কেন আমি ভেবে নিয়েছিলাম, সোহমও একই রকম থাকবে। যে সত্যিকারের ভালবাসায় আমার একটুও বিশ্বাস ছিল না, আমি ধরে নিয়েছিলাম সেই ভালবাসা নিয়ে সোহম আমার অপেক্ষায় থাকবে। সেদিন সে সত্যিই আমার অপেক্ষায় ছিল।
— "সোহম, এই পাহাড়টিকে তোমার মনে আছে?"
— "শুধু মনে রাখা ? আমার কাছে তো এই পাহাড়টাই ছিল, শ্রেয়সী।"
—"আর আমি ভেবেছিলাম, ভুলে যাব। ভেবেছিলাম, যদি একদিন আমাকে ছাড়াই তোমার দিন ভাল যায়, যদি একদিন তোমাকে ছাড়াই আমার ভোরের স্বপ্নগুলো দিন হয়ে যায়, আমি আবার এখানে ফিরে আসব। তোমাকে আয়োজন করে মিস করব।"
— “তারপর ?”
— “পারিনি। It hurts ! সোহম ! যতটা আমি নিতে পারব বলে ভাবতাম, তার চেয়ে কষ্টটা যে আমার অনেক বেশি ছিল।”
— "একটা কথা জানো শ্রেয়সী? মানুষ চাইলেই যেমন ভালবাসতে পারেনা, তেমনি চাইলেই ভুলে যেতে পারেনা। খুব বেশি হলে হয়ত অভিনয় করতে পারে।"
— “তুমি করোনি কেন – অভিনয়?”
— “জানিনা। তোমার অপেক্ষায় থাকতে আমার ভাল লাগত – আমি কি করতে পারি?”
ভোরের প্রথম আলোয় হঠাৎ করে আমি আবিষ্কার করলাম, আমার দুচোখ অজান্তেই ভেসে যাচ্ছে।
— "সোহম! এতদিন পরে, আমি আবার নতুন করে ভালবাসতে শিখলাম কেন! বলতে পারো??......

............................

Debasish Talukdar



নৈঃশব্দের চূড়ায় - শ্যামাপ্রাসাদ সরকার

 

নৈঃশব্দের চূড়ায়
শ্যামাপ্রাসাদ সরকার 
 

        বিরাট একটা পাঁচিল। দূর থেকে দেখলে জেলখানারর কথা মনে পড়ে যাবে। তারপর একটা ফটকের ওপারে উঁচু মিনারটা আজও শহরের সমস্ত কোলাহলের সীমানা পেরিয়ে চুপ করে টিকে আছে। আসলে চারপাশটাই বদলে গিয়েছে অনেকটা। এখন শহরের আশেপাশে তেমন চিল-শকুনের দেখা মেলে না।
কিন্তু একটা সময় তারাও এখানে অপেক্ষা করে থাকত। কখন একটি মৃতদেহ নিয়ে বাড়ির লোকেরা পল-বিয়ারারের দলের হাতে সেটিকে নীরবে তুলে দেবে সেই মিনারের চূড়ায়। আর তারপর সেই মৃতদেহের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে এগিয়ে আসবে মাংসাশী পাখিরা। তাদেরডানার ঝাপটে আর ক্ষুধার চিৎকারে সমস্ত নীরবতা ভেঙে খানখান হয়ে যাবে। এখনতো আর চিল-শকুনেরা আর অপেক্ষা করে থাকে না। মৃতদেহও আসে না বললেই চলে। নওরোজজী দুকানওয়ালাদের মত শ' তিনেক পার্সী পরিবার টিকে আছে এই কলকাতায়। হ্যাঁ, বললে কি কেউ মানবে এই সেদিন পর্যন্ত কলকাতা শহরেই এক লক্ষ পার্সি নাগরিক বাস করত। ইস্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানির বদান্যতায় কলকাতা তখন সদ্যযৌবনা। কত জাতের বর্ণময় লোকের সমাহার তখন আর ততই বিচিত্র তাদের ব্যবসা। সেই সময় অগ্নি-দেব আহুর মাজ্দা র উপাসক পার্সিরাও এল কলকাতায়। বোম্বাই, সুরাটের পর জাঁকিয়ে বসল তিলোত্তমায়। আগে থেকেই ধনে-বিদ্যায়-ঐশ্বর্যে এগিয়ে ছিল সকলের থেকে। পসার জমিয়ে আরওবড়লোক হয়ে উঠল তারা।
পার্সি ব্যবসায়ী দাদাভাই বেহরামজি বানাজি সুরাট থেকে কলকাতা এসেছিলেন ১৭৬৭ সালে। কলকাতায় তাঁদের উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল একাধিক এন্টারপ্রাইজ। তবে বাঙলা ও বাঙালির সঙ্গে মিলেমিশে যেতে তাঁদের বেশি সময় লাগেনি। অনেকের তো পদবীর শেষে ‘বেঙ্গলি’ শব্দটাও যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। ঠিক যেমন করে পেশা বা ব্যবসাভিত্তিক ভাবে
' বাটলিওয়ালা', 'দারুওয়ালা', 'মিস্ত্রী এসব পদবী গুলো এসেছে।
*********
নওরোজজী দুকানওয়ালার বয়স এখন আশি ছুঁই ছুঁই। একা নির্জন একটা কামরায় সিনাগগ্ স্ট্রীটের ভেতরে তার পঞ্চাশ বছরের ভাড়া করা ফ্ল্যাট। তখন ভাড়া ছিল মাসে একশো দশ টাকা এতদিনে বেড়ে বারশো পঞ্চাশ। মালিক টালিক কেউ নেই। ফ্ল্যাটটা আদালতের রেজিস্টারের হাতে চলে গেছে তাও নয় নয় করে বছর দশেক হল। যে কোন দিন শমন পাঠিয়ে উঠিয়ে দিতে পারে। তাও নিজে নিয়ম করে রেন্ট কন্ট্রোলের অফিসে গিয়ে ভাড়া দিয়ে বেরোবার সময় রেভিনিউ স্ট্যাম্ন লাগানো রসিদটা পকেটে পুরতে পুরতে প্রতিবার একবার করে ভাবেন,
'যাঃ! এই শেষবার! সামনের মাসে বোধহয় আর আসতে হবেনা! '
নওরোজজীর জীবনেও যেমন ছুটির নোটিস আসতে দেরী করছে , তেমনি আদালতের ঘর ছেড়ে উঠে যাওয়ার শমনটাও আসব আসব করে এখনো আসেনি।
 
************
 
একা থাকাটাই অভ্যেস হয়ে গেছে বলে হলদেটে দেওয়ালে বাল্বের আলোয় নিজের কাঁপাকাঁপা ছায়াটাকেও আজকাল পছন্দ হয়না যেন! এতরকমের মৃত্যু দেখেছেন যে, সে আজ সব গা সওয়া হয়ে গেছে।
 
      নওরোজজীর একমাত্র ছেলে সোরাবজী গেল এয়ারফোর্সে চাকরী করতে । সেই তরতাজা তিরিশ বছরের ছেলে যখন প্লেন ক্র্যাশে মারা গেল তখন থেকেই আবার নতুন করে শূন্যতার সাথে বন্ধুত্ব পাতাতে বসা। ওই একবারই যা নওরোজজীর টাওয়ারে আসা হয়নি। নইলে তার আগে অবধি বাবা, মা, কাকা, ভাই, সোফিয়া...প্রতিটা প্রিয়জনকেই শেষবার নিয়ে এসে নিজের হাতে পল-বিয়ারারের হাতে জমা করে গেছেন। মাংসলোভী গৃধিণীদের ভুক্তাবশেষ হয়ে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেছে তারা। স্ত্রী সোফিয়া তো আগেই গেছিল। সোরাব তখন স্কুলে পড়ত। কাপড়ের ব্যবসায়ী রনি বিলিমোরিয়ার মেয়ে সোফিয়া যে কি করে নওরোজজীর প্রেমে পড়েছিল তা এক রহস্য বটে। অবশ্য তখন নওরোজজীও সুপুরুষ ছিল। পাক্কা ছ'ফুট লম্বা, হকি খেলা চেহারা আর টকটকে গায়ের রঙ। ওদের ছিল পোর্সেলিনের বাসন আর ফুলদানী তৈরীর একটা ছোট কারখানা। ট্যাংরা ছাড়িয়ে সে সব জায়গা তখন ধূ ধূ প্রান্তর একেবারে। বেশ ছিল কিন্তু দিনগুলো তখন। 
 
*********
 
      এরপর ছেলের বউ আফরিন একদিন সন্ধেবেলা ওদের বাড়ি ছেড়ে চলে গেল দুবছরের ফুটফুটে নাতনি শিরিনকে নিয়ে। সে আবার সংসার পাততে চায়! নাঃ, নওরোজজীর এ বিয়েতে কোনরকম আপত্তি ছিল না ঠিকই তবে নাতনীটাকে দেখতে না পাওয়া আর সিনাগগ স্ট্রীটের চারটে দেওয়ালের চাপা একাকীত্বটাই যা শুধু গিলে খেতে আসত। নাতনীটার ফেলে যাওয়া ফিডিং বোতলটায় দুধের গন্ধও শুকিয়ে চড়া পরে গেছে কবেই।
এরমধ্যে তো একবার তো ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যাও করার কথাও মনে হয়েছিল। কিন্তু না, ওষুধের স্ট্রীপটা খালি করতে আর শেষ অবধি সাহসে কুলোয়নি।
*********
শীতকালে হাঁপানির কষ্টটা বাড়ে। বুড়ো হওয়াটায় এটাই একটা অসুবিধা। বড্ড নড়বড়ে হয়ে যেতে হয়। বন্ধুবান্ধবের অধিকাংশই এখন সাদা কালো এ্যালবামের পাতা থেকে হাতছানি দেয়। সোফিয়াও ওকে ডাকে শুনতে পান! সোরাব ও যেন 'পাপা! পাপা! ' বলে সেইদিনগুলোর মত ট্রাইসাইকেলে চক্কর দেয়। এগুলোর কোনটাই যদিও চোখে দেখা যায়না। মনে হয় চারদিকের অনন্ত শূন্যতার মধ্যে এই ফিসফিসানিগুলোই বোধহয় বেঁচে আছে।
 
**********
 
     রোববার সকালবেলায় হাঁটতে হাঁটতে একবার টাওয়ারের কাছটায় গিয়ে দাঁড়ালেন। অনেক অনেক বছর আগে, যখন বেলেঘাটার খালটাও ছিল না, তখনকার সেই নিদ্রিত নীরবতার চেহারাটা যেন টাওয়ার অফ সাইলেন্সের আশেপাশে আজও থমকে আছে। আজকাল বোধহয় আর কেউ আসেনা এখানে। বিরাট পাঁচিলটা দূর থেকে দেখলে জেলখানার মত মনে হয়। তারপর সেটা পেরিয়ে একটা ফটকের ওপারে উঁচু মিনারটা বৃদ্ধ নওরোজজীর মতই উদাস, একা, শূন্য আর নিশ্চুপ হয়ে আছে বহুদিনই।
পা টিপে টিপে ওপরটায় উঠে আসলেন নিজেই। কিছু সামান্য শুকনো হাড়গোড় পড়ে আছে বলেই হয়তো মৃত্যুর গন্ধটা কিন্তু এখনো বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে।
কতজনের অশ্রু আর স্মৃতির অবশেষ এখানে!
নিজের আসার সময় হলে তো আর টের পাবেননা মৃত্যুর সেই নিরবিচ্ছিন্ন স্তব্ধতা কেমন করে চিল শকুনের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যায়।
পল-বিয়ারার দলের কাউকে দেখা যাচ্ছে না এখন। আচ্ছা যদি সোফিয়া, পল, সবার সাথে এখানে একবার দেখা হয়ে গেলে প্রথমে কি বলে ডাকবেন নওরোজজী? তারা যদি আজ সামনে এসে দাঁড়ায় ওঁকে চিনতে পারবে আগের মতোই? সোরাবের দেহের কয়লা হয়ে যাওয়া টুকরোগুলোই মিলেছিল আর্মির কফিনের ম্যে। নয়তো সোরাবকেও তো যদি এখানে আনতে হত.....
আর এসব ভাবতে ইচ্ছে করছেনা। চুপ করে মাথায় হাত দিয়ে বৃদ্ধ বসে থাকেন খানিক্ষণ। দুচোখের পাতায় যেন অন্ধকারের ডাক আসছে ধীর পায়ে।
সূর্যের আলো ঢেকে ততোক্ষণে লম্বা লম্বা ডানা ছড়িয়ে আস্তে আস্তে অসংখ্য শকুন আর মাংসভোজী পাখির দল নেমে আসছে....
আরো নীচে....আরো নীচে......
আর তাদের ডানার ঝটপট শব্দে একটু একটু করে ঘুম ভাঙছে নৈঃশব্দের চূড়োয়। 
......................
 
Shyama Prasad Sarkar 



চন্ডীবাবু - দেবাশীষ তালুকদার

 

চন্ডীবাবু 
দেবাশীষ তালুকদার 
 
 
 
            চন্ডীবাবুর সাথে আমার পরিচয় রিকশায়। আমি রিকশার প্যাসেঞ্জার, আর তিনি চালাচ্ছেন। শোভাবাজার থেকে উঠেছি, মেসে ফিরবো। রিকশায় উঠলে রিকশাচালকদের সাথে কথা বলার পুরনো অভ্যাস আমার।
-- নাম কি আপনার?
-- আজ্ঞে চন্ডী দলুই।
-- আচ্ছা চন্ডীবাবু! আপনি যে ২০ টাকার ভাড়া ৪০ টাকা চাইলেন, কাজটা কি ঠিক করলেন?
রিকশা চালাতে চালাতে পেছন ফিরে চন্ডী বাবু একবার অবাক চোখে তাকালেন আমার দিকে। সম্ভবতঃ এই প্রথম কেউ তাকে বাবু সম্বোধন করলো।
-- শুরুতে বেশী চাওন লাগে। আমি ২০ টাকা চাইলে আপনে বলতেন ১০ টাকায় যাইবেন?
-- অন্যরা হয়তো বলতো কিন্তু আমি বলতাম না। আপনি ৪০ টাকা থেকে যে ২০ টাকায় নামলেন, এটা কি ঠিক হলো? আপনি হবেন গিয়ে এক কথার মানুষ! তাইনা! ২০ টাকা বলবেন, ২০ টাকাই। কথার নড়চড় হবে না....
আমার মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই ধাক্কাটা লাগলো। ঠিক টাউন স্কুলের কাছে তেরাস্তায় বাম সাইড থেকে হঠাৎ করে আসা একটা স্কুটার ধাক্কা দিলো ঠিক রিকশার সামনের চাকা বরাবর। আমি ছিটকে পড়লাম রাস্তায়। ব্যাথায় চোখে অন্ধকার দেখলাম কিছুক্ষণ। চোখ খুলে দেখি চন্ডী বাবু আরেকটু দূরে পড়ে আছেন। মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে রাস্তা লাল হয়ে গেছে। গোটা বাহান্নর মতো বয়স, মুখটা তখনো হাসি হাসি।
আমার কয়েক জায়গায় কেটে গেলেও সিরিয়াস কোন ব্যাথা পাইনি। টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালাম। ইতিমধ্যে চারদিকে ভীড় জমে গেছে। রাস্তার দুজনের সহায়তায় চন্ডীবাবু কে নিয়ে গেলাম আর.জি.কর মেডিকেলে। কাঁটাছেড়ার জন্য সামান্য ব্যান্ডেজ আর ব্যাথার ওষুধ দিয়ে আমাকে ছেড়ে দিলো। কিন্তু চন্ডীবাবুর অবস্থা গুরুতর। দু ব্যাগ রক্ত লাগবে। ব্লাড গ্রুপ মিলে যাওয়ায় এক ব্যাগ আমি দিলাম, আরেক ব্যাগ জোগাড় করলাম।
চন্ডী বাবুর মোটামুটি সুস্থ হতে আট দিন লাগলো। প্রথম দুদিন আমিই ছিলাম পাশে, তৃতীয় দিনে ওনার স্ত্রী আর আট বছরের কন্যার খোঁজ পাওয়া গেলো। এর মধ্যে একটা ইনকোর্স পরীক্ষা, দুটো ক্লাস মিস হয়ে গেলো। তারথেকে বড় কথা, চন্ডী বাবুর চিকিৎসার খরচ সাড়ে সাত হাজার টাকা জোগাড় করতে নাভিশ্বাস উঠে গেলো আমার। মেসে থাকি, টিউশনি করি। সাড়ে সতশো টাকাই অনেক টাকা, আর এখানে সাড়ে সাত হাজার। চন্ডী বাবুর স্ত্রী হাতের দুটো চুড়ি বিক্রি করে পাচ হাজার টাকা আনলেন, আমি ধারদেনা করে দেড় হাজার আনলাম। বাকি হাজার টাকা হসপিটাল কর্তৃপক্ষ মাফ করে দিলেন।
-
-- আপনে কি কামডা ঠিক করলেন কন তো?
-- কি করেছি?
-- আপনে অন্য রিকশায় উঠছেন ক্যান আজকে দুপুরে?
-- তাড়া ছিল একটু, আপনাকে ফোন করার মতো সময় ছিল না।
-- আমি চন্ডী বাঁইচা থাকতে আপনের ভাড়া দিয়া অন্য রিকশায় ওঠা বন্ধ। এস্টপ! ফিনিশ! কল করবেন, আমি উইড়া আসুম। দরকার হইলে প্যাসেঞ্জার মাঝপথে নামাই দিয়া চইলা আসুম।
 
        আমি হাসলাম। গত তিন বছর ধরে চন্ডীবাবু আমাকে নিয়ে রিকশা চালায়। সকালে মেসের সামনে এসে দাঁড়ায়, আমি কলেজে আসি। তারপর সে খেপ মারতে যায়। বন্ধুরা দেখে হাসে, কেউ কেউ টিপ্পনিও মারে। আমার ক্লাস রুটিন ওনার মুখস্ত। ক্লাস শেষ হলে বের হয়ে দেখি রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। গত তিন বছরে একদিনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। জরুরী কাজে কোথাও যেতে হলে ওনাকে ফোন করতে হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে হাজির। প্যাসেঞ্জার নিয়ে খুব দূরে কোথাও যান না, কাছাকাছিই থাকেন যাতে ফোন করলে সবসময় পাই। অন্য কোন রিকশায় উঠলে রাগ করেন, শিশুসুলভ অভিমান। এই যেমন আজকে। আমি অনেক মানা করেছি, কোন কিছুতেই তাকে মানানো যায়নি। এই ব্যাপারে প্রচন্ড একগুঁয়ে, একরোখা। কখনোই ভাড়া নেন না, কোনো ভাবেই নেওয়ানো যায় না।
বিকালে টিউশনিতে যাই। রাতে ফেরার পথে আমরা রিকশায় কলকাতা শহরের এদিক সেদিক ঘুরি। চা খাই। আড্ডা দিই। সত্যি বলতে তিন বছরে চন্ডীবাবু আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু হয়ে গেছেন। মন খুলে গল্প করি ওনার সাথে। তিন বছরে চন্ডী বাবুর আর্থিক অবস্থার অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। গ্রামে জমিজমার বিবাদের জন্য সর্বস্ব হারিয়ে কলকাতায় এসে রিকশা চালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিছুদিন আগে বিবাদ মিটেছে আমার এক পুলিস আত্মীয়র সহায়তায়। কিছু জমি বিক্রি করে কৃষ্ণনগরে মনোহারি দোকান দিয়েছেন, তার ছোটভাই চালায়। মাঝে মাঝে বলি,
-- চন্ডীবাবু, আর কতদিন রিকশা চালাবেন? টাকাপয়সা তো কামাচ্ছেন, এবার একটু আরাম করুন।
-- যতদিন বাঁইচা থাকি, রিকশা চালামু। আপনের রক্ত যতদিন আমার শরীলে আছে, আপনের জন্য রিকশা চালামু।
--মানুষের শরীরে রক্ত চার মাস বাঁচে। এরপর নতুন রক্ত তৈরী হয়। আমার রক্ত যা ছিলো, ফিনিস হয়ে গেছে এতোদিনে।
-- আপনেরে কইছে। দুই পাতা পইড়া বেশী জাইনা গেছেন? রক্ত আজীবন থাকে শরীলে।
আমি বোঝাতে গেলেই, তর্ক শুরু হয়...।
রাত বাড়ে। চন্ডীবাবুর সাথে কলকাতা শহর ঘুরছি আমি। আমি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা শেখাই, গল্প করি। চন্ডী বাবু মনোযোগী শ্রোতার মতো শোনে। ডিপার্টমেন্টের গল্প, বন্ধুদের গল্প, বান্ধবীদের গল্প, স্যারদের গল্প, টিউশনির গল্প। মাঝে মাঝে কঠিন কঠিন পড়ালেখা আর বিজ্ঞানেরও গল্প। গাউসের ছোটবেলার গল্প, এডিসন কিভাবে এডিসন হলো, আর্কিমিডিসের ইউরেকা, লাইবনিজের ক্যালকুলাস, ফার্মার লাস্ট থিওরেমের গল্প। চন্ডীবাবু কিছু বোঝে, কিছু বোঝে না। মাঝে মাঝে প্রশ্নও করে,
-- এই যে মনে করেন আপনে রিকশায় বইসা আছেন। এখন আপনে পা দিয়া যতই ঠেলেন, রিকশা কিন্তু এক পাও সামনে যাইবো না। এইডা ক্যামনে হয়?
আমি তখন নিউটনের তৃতীয় সুত্র বোঝাই। চন্ডীবাবু উপহাসের হাসি হাসে।
-- আমি মাটিতে ঠেলা দিলে মাটিও আমারে ঠেলা দেয়? এইসব উল্টাপাল্টা ভুলভাল পড়াইয়া কলেজগুলা আপনেগো মাথাটা নষ্ট করতাছে।
আমরা চায়ের দোকানে দাঁড়াই, চা খাই। এই শহরের বেশীরভাগ চায়ের দোকানদার আমাদের চেনে। রাতে একটা পাগলা ধরনের কলেজের ছেলে আর এক রিকশাওয়ালা ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। আরেকটু রাত হলে চন্ডীবাবুর ঘরে যাই, ওনার মেয়েকে পড়াই। ওনার মেয়ের বয়স এখন এগারো, আমাকে দেখলে বাবার মতোই অভিমান করে। "কাকু, এতো দেরী করে আসো কেনো?"
-
-- আপনেরে একটা কথা বলুম। শোভাবাজার লঞ্চঘাটের সামনে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন চন্ডীবাবু।
-- কি কথা?
-- আমার একটা শখ, আপনে যখন বিয়া করবেন, কোনো পেরাইভেট ভাড়া করবেন না। আমার রিকশাতে যাইবেন, আমার রিকশাতেই বউ নিয়া আসবেন। আমি টাকা জমাইছি, বিয়ার দিন নতুন রিকশা কিনুম। আপনাদের দুইজনরে নিয়া রিকশা চালামু।
-- বিয়ের দিন রিকশায়? বৌ তো কিপটা বলে বিয়ের আগেই ডিভোর্স দিয়ে দেবে।
-- দিবো না। আপনার বউ আপনার মতোই ভালো হইবো। ওনারে আর আপনারে নিয়া রিকশায় বাইর হমু। আপনারা পিরিতের আলাপ করবেন, আমি কানে হেডফুন দিয়া রাখুম।
আমি হাসি চাপতে চাপতে বললাম,
-- চন্ডীবাবু, মনে করুন পড়ালেখা শেষে আমার বড়ো চাকরী হলো। অফিস থেকে তো গাড়ি দেবে। তখন তো গাড়িতে চড়তে হবে। তখন কি করবেন?
মূহুর্তে চন্ডী বাবুর মুখের হাসি চুপসে গেল। চুপ করে চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। স্পষ্ট দেখতে পেলাম, চোখের কোণে হালকা একটু জল চিকচিক করছে। আমি বিব্রত হয়ে গেলাম। কথাটা বলাই উচিৎ হয়নি।
অনেকক্ষণ চুপ থেকে চন্ডীবাবু মৃদু স্বরে বললেন,
— তাইলে আর কি করার, ডেরাইভিংটা শিখা লাগবো। এই মাসেই শুরু কইরা দেই! কি কন? এক ওস্তাদের লগে আমার চিনা-পরিচয় আছে। বাস চালানি শিখলে পেরাইভেটও পারুম, ঠিক কিনা?
আমি এবার হতম্ভব হয়ে যাই। এটাকে কি বলা যায়? ভালোবাসা? এই ভ্যালেন্টাইনদের যুগে, রিকশাওয়ালাদের চড় মারার যুগে এই ভালোবাসার স্থান কোথায়? আপনারা কি বলেন?
..........
 
Debasish Talukdar 



নায়কী কানাড়া - গৌতম সাহা

 


নায়কী কানাড়া  
গৌতম সাহা
 

       বারাকপুর শিল্পাঞ্চলের এক চটকলের অফিসে সামান্য চাকুরে সুধীরবাবু। অজাতশত্রু, ভালো মানুষ বলেই চেনে তাকে মানুষজন। আসাধারণ মেধা সম্পন্ন না হলেও পড়াশোনায় আর পাঁচটা ছাত্রদের থেকে খুব একটা পিছিয়েও ছিলেন না তিনি। সেই মাঝারিয়ানার সুবাদেই কলেজের গণ্ডি পেরিয়েই পাড়াতুতো কাকার সামান্য সুপারিশে পাওয়া এই চাকরি। স্ত্রী গৌরী প্রকৃত অর্থেই দেবী দুর্গার মতন। যেমন তার রূপ, তেমনি তার স্বভাব। অসম্ভব সুপুরুষ সুধীরবাবু যখন কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে তার স্ত্রী গৌরীকে নিয়ে যান মানুষজন এই জুটিকে প্রশংসা না করে পারেন না। গৌরীও তার স্বামীকে নিয়ে গর্বিত। সুধীরবাবু যে শিল্পী। ছাত্রাবস্থাতেই কি করে যেন তার মাথায় গানের ভূত চাপিয়ে দিয়েছে কেউ। অথচ এই বংশে গানের চর্চা যে তেমন ছিল তা নয়। সুধীরবাবু যে কী করে এই পথে চলে এলেন তা সবার কাছেই আশ্চর্যের। শুধু চলে এলেন না, নিজ অধ্যাবসায়ে, একনিষ্ঠ সাধনায় কিভাবে নিজেকে এই তল্লাটের অন্যতম সেরা শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন সেটা সত্যিই কল্পকাহিনীর মতন।
ফুলশয্যার দিন নতুন বউকে কাছে নিয়ে সুধীরবাবু আর কী কী বলেছিলেন তা মনে করতে না পারলেও একটা কথা কোনদিন ভুলবেন না গৌরী।
-“তোমার এক সতীন আছে জানো তো?’’ অবাক বিস্ময়ে নতুন বউ এর লজ্জা আর দ্বিধা নিয়ে ঘোমটার ফাঁক দিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়েছিলেন গৌরী। সেই সংশয় মাখা অপরূপ সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে অট্টহাস্যে ফেটে পড়েছিলেন সুধীরবাবু। হাত ধরে নববধূকে খাট থেকে নামিয়ে এনেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, “চল, তোমাকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।’’ বলে হাত ধরে তাকে নিয়ে এসেছিলেন পাশের ঘরে। ঘরের কোণায় রাখা বিশাল আকৃতির এক তানপুরার সামনে দাঁড় করিয়ে সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী কে বলেছিলেন সুধীরবাবু, “এই তোমার সতীন, নাও বন্ধুত্ব করে নাও।’’
 
      এই ব্যাপার! বাপরে বাপ, বুকের ধুকপুকুনি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল একেবারে! উনি যে শিল্পী, গান যে ওনার প্রাণ, এ তো জানে গৌরী। এলাকার মানুষজন সবাই চেনে ওকে এই তল্লাটের অন্যতম সেরা গায়ক হিসাবে। গৌরী তো বিয়ের সম্বন্ধের সময়েই জানে তা। তাও এমনভাবে ভয় দেখাতে হয়! রাগই হয়ে যায় গৌরীর একটু। কিন্তু নতুন বউ এর কি আর রাগ দেখানো সাজে! মুখে তাই রাগের ভাব না এনে মৃদু স্বরে বলে ওঠেন গৌরী, “আমি জানি, গান আপনার সবকিছু, সবাই আপনাকে আপনার গানের জন্য শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে।’’
-“তুমিও নিশ্চয়ই চাইবে যে তোমার স্বামীকে সবাই এইভাবে শ্রদ্ধা করুক, সম্মান করুক।’’
 
      বুঝেছিলেন গৌরী। হাজার হোক, তিনিও অভিজাত পরিবারের কন্যা। কোন কথার অন্তর্নিহিত অর্থ কী তা বোঝার শিক্ষা তার আছে, বোধও। মুখ নিচু করেই আশ্বস্ত করেছিলেন তার স্বামীকে, “আমি আপনার সংগীত চর্চার ক্ষেত্রে কখনো বাধা হয়ে দাঁড়াবো না। আপনি আগের মতই আপনার সাধনা নিয়ে থাকবেন, আমার জন্য কখনো আপনার এই সাধনায় বিঘ্ন ঘটবে না, আমি কথা দিলাম।’’
সংগীত অন্ত প্রাণ এক শিল্পীর কাছে তার স্ত্রী’র থেকে ফুলশয্যার দিনেই এর থেকে বেশী প্রাপ্তি কী থাকতে পারে! আপ্লুত হয়েছিলেন সুধীরবাবু। প্রথমদিনের সেই প্রাণে মধু ঢেলে দেওয়া আশ্বাস, তার পরে প্রকৃত অর্থেই তার সংসারকে মা দুর্গার মত চালিয়ে নিয়ে যাওয়া, তার সাধনার উৎকৃষ্ট বাতাবরণ প্রস্তুত করে দেওয়া- ভীষণরকম ভাবে ভালোবেসে ফেললেন তিনি তার স্ত্রী’কে। বছর ঘুরতেই গৌরীদেবীর কোল জুড়ে জন্ম নিল তাদের প্রথম পুত্র সন্তান। ভালোবেসে গৌরী তার নাম রাখলেন রামানুজ।
 
*******
 
       সুধীরবাবুর খ্যাতি তার বিবাহের পরে বেড়েই চলেছে। মফস্বলের একটু নামকরা যে কোন শাস্ত্রীয় সংগীতের আসরে সুধীরবাবুর উপস্থিতি, সংগীত পরিবেশনা সেই আসরে অন্য মাত্রা যোগ করে। এই তল্লাটে তার সমকক্ষ শিল্পী খুব কমই আছে, এই নিয়ে শ্রোতৃমহলে কোন দ্বিমত নেই। অথচ কলকাতার শিল্পী মহলে তার বিশেষ কোন নাম নেই, পরিচিতিও। কারণ অবশ্য একটা আছে। সুধীরবাবু মূলত যার কাছে সংগীত শিক্ষা করেছেন সেই পন্ডিত দীনকর রাও এর সঙ্গে কলকাতার নামজাদা সকল শিল্পীরই এক অঘোষিত বৈরীতা আছে। কেন, তা অবশ্য জানেন না সুধীরবাবু। অনেকেই মনে করেন যে দীনকর রাওয়ের সাথে তারই গুরুভাই তথা কলকাতা সংগীত সমাজের পুরোধা শিল্পী কুলদারঞ্জন বাবুর এক ব্যক্তিগত রেষারেষির কারণই দীনকর রাওকে কলকাতা ছাড়তে বাধ্য করেছিল। জানেন না ঠিক সুধীরবাবু। তবুও দীনকর রাও কলকাতা ছেড়ে চলে যাবার পর তাঁরই গুরুভাই এর কাছে তালিম পাবার জন্য, তাঁর সান্নিধ্যে আসার জন্য এক বিশিষ্ট শুভানুধ্যায়ীর অনুরোধে তার সঙ্গেই কুলদারঞ্জন বাবুর কাছে গিয়েছিলেন সুধীর।
কলকাতার শিল্পীদের স্বভাবসুলভ তাচ্ছিল্যভরা ভঙ্গীতে করা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন সুধীর।
- “কার কাছে শেখা হয়েছে?’’
-“আজ্ঞে, পন্ডিত দীনকর রাও....।’’
-“ওহ, দীন-কর! তা বেশ। কী গাওয়া হয়? খেয়াল? নাকি দীনকর এর মতন ঠুংরি? হা হা হা হা।’’
 
       তাচ্ছিল্যভরা অট্টহাসিতে ভেসে গিয়েছিল বালিগঞ্জের সুবিশাল সেই বাড়ি। ভালো লাগেনি সুধীরবাবুর। হাজার হোক গুরুনিন্দা শুনে, গুরুর প্রতি অবহেলা দেখে তাঁর কাছে নতুন করে শেখার কিংবা শিক্ষার জন্য তদবির করতে মন সায় দেয়নি আর। আর কারো অনুরোধে তার শিল্পী সত্তাকে পদদলিত করে কখনো কলকাতায় যাননি তিনি। গানের ঘরোয়া আসরে ক্কচিৎ কদাচিৎ আমন্ত্রণ পেয়েছেন, গেছেন, গান গেয়ে মাত করে এসেছেন, কিন্তু অনুষ্ঠানের তদবির করতে কিংবা কারও কৃপা পেতে কলকাতা মুখো হননি তিনি। যা তিনি তার গুণ্মুগ্ধদের থেকে পেয়েছেন তাতেই সন্তুষ্ট। পাশাপাশি তিনি এটাও জানতেন যে তার শিক্ষা সম্পূর্ণ নয়, আরো শিখতে পারলে ভালো হতো। মনে হতো আরো কোথায় শিখতে পারা যায়! কন্ঠসংগীতের আরো জটিল পথগুলোতে আলোকপাত কে করবে? কে দেখাবে আলো, কে চেনাবে পথ? কলকাতায় তো তার উপায় নেই, তাহলে তো কলকাতা ছাড়তে হয়! কিন্তু তার উপায় কোথায়? স্ত্রী, পুত্র, সংসার, চাকরী ফেলে তো আর অনির্দিষ্টের পথে পা বাড়ানো যায়না। সর্বোপরি, গৌরীকে ছেড়ে থাকবার কথা তিনি যে ভাবতেই পারেন না। তাই মনে ক্ষুধা থাকলেও যা পেয়েছেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকেন সুধীরবাবু।
 
*******
 
       কিন্তু শোভা কিছুতেই ছাড়বে না। এই আর একজন অদ্ভুত মেয়ে শোভা। টিটাগড় এর কেল্ভিনশন জুট মিলের জেনারেল ম্যানেজারের স্ত্রী। নিজে ডাকসাইটে গাইয়ে। সবাই বলে তার গান চোখ বুজে শুনলে আখতারী বাঈ গাইছে না শোভা গাইছে এটা আলাদা করা যায়না। টালিগঞ্জের নামকরা ফিল্ম ডিরেকটরেরা অবধি শোভা গাঙ্গুলীকে দিয়ে কোনো গান গাইয়ে নিতে পারলে বর্ত্তে যান। কিন্তু সে গাইবে না। রেডিওর বি হাই আরটিস্ট সে। মুড নেই তো প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করে দেওয়া তার কাছে কোন ব্যাপারই না। নিজে পারিবারিকভাবে রাজবাড়ির মেয়ে হওয়ায় রাজকীয় স্বভাব তার চলনে, বলনে কথাবার্তায়, আচার আচরণে। কাউকে সে পাত্তা দেয়না।
এহেন শোভা কিন্তু সুধীরবাবুর ভীষণ ফ্যান। একদিন তার বাড়ির এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে সুধীরবাবু গাইলেন কৌশী কানাড়া। বড় প্রিয় রাগ তার এই কৌশী কানাড়া। বস্তুত যেকোন কানাড়া অঙ্গের রাগই তার প্রিয়। তার গুণমুগ্ধরা বলে, ‘কানাড়ার রূপ আপনার গলায় আরো বেশি খোলে’।
গঙ্গার ধারের সেই বিলাসবহুল বাংলোর প্রতিটা কোণ দিয়ে যেন ঝরে পড়ছিল কৌশী কানাড়ার অপূর্ব সুর।
"রাজন কে শিরতাজ"
প্রেম বিরহের অদ্ভুত মেলবন্ধনে কৌশী কানাড়ার সুর আর গঙ্গার দিক থেকে মৃদু মন্দ ভেসে আসা শীতল বাতাস কী যে স্বর্গীয় বাতাবরণ তৈরী করেছিল তা একমাত্র সংগীতের ঈশ্বরই জানেন। মাঝ খামাজে ঠুংরী গেয়ে অনুষ্ঠান শেষ করলেন সুধীরবাবু।
সবার শেষে গাইবার কথা শোভা দেবীর। তিনিই এই অনুষ্ঠানের আয়োজক, উদ্যোক্তা, তিনিই শেষ শিল্পী। কিন্তু শোভা নিজে বেঁকে বসলেন। বললেন, “সুধীরদা’র এই গানের পরে আজ আমি আর গাইতে পারবো না।’’
শোভার এই রাজরাণীর মতন স্বভাব ও মেজাজ সম্বন্ধে সবাই ওয়াকিবহাল। কারো সাহস হলো না আর কিছু অনুরোধের। সময়ের আগেই এলাহি রাত্রিকালীন ভোজনের সূচনা করা হল। সবাই যখন ওই রাজকীয় ভোজনের স্বাদ নিতে ব্যস্ত, হাতে পানীয়ের গ্লাস নিয়ে সুধীরকে গঙ্গার দিকে টেনে নিয়ে গেলেন শোভা। গঙ্গার দিকে মুখ করে রাখা লোহার বেঞ্চে বসে সুধীরের একটা হাত নিজের হাতে টেনে নিয়ে ঈষৎ জড়ানো গলায় বললেন তিনি, “তোমাকে যদি এই জগতের কাছে বিখ্যাত না করে যাই সুধীর’দা, আমার নাম তবে শোভা গাঙ্গুলী নয়। সারা দেশের মানুষের কাছে তোমার নাম আমি পরিচিত করে যাবো।’’
ভয় পেলেন সুধীর। তিনি ছাপোষা মধ্যবিত্ত। বড়লোকের মতিগতি তিনি বোঝেন না, তাদের কথার অর্থও। দ্বন্দ্বে পড়ে যান তিনি। কী বলবেন এই অপূর্ব মোহময়ী নারীর কথার উত্তরে! বোঝেন না সুধীর, চুপ করে থাকেন।
 
*****
 
       ফ্যাক্টরী থেকে সবে ফিরেছেন সুধীর। গোধূলির আলো মেখে গেটের বাইরে ছাই রঙা বিরাট একটা কন্টেসা এসে দাঁড়ালো। ঊর্দি পরা ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে সুধীরের হাতে একটা চিরকূট ধরিয়ে দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুই বুঝতে পারলেন না সুধীর, শুধু পড়লেন, ‘তানপুরাটা শুধু সাথে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এসো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’
শোভার হুকুম। ইতস্তত করেন সুধীর। গৌরীর সাথে শোভাকে নিয়ে বহুবার তার কথা হয়েছে। আজ অবধি গৌরী কোনদিনও সুধীরের কোন মহিলা গুণমুগ্ধা, ছাত্রী কিংবা অতি উৎসাহী মহিলা শ্রোতাকে নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন নি। তবুও কেমন যেন বাধো বাধো লাগে সুধীরের। মুশকিল আসান হয়ে এগিয়ে আসেন গৌরীই। সমস্ত বিষয়টা যেন চোখের পলকে বুঝে ফেলেন তিনি। আলমারি থেকে পাটভাঙা সিল্কের পাঞ্জাবী স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে চোখের তারার ইশারায় বুঝিয়ে দেন, “যাও।’’ কৃতজ্ঞতায় মনটা আর্দ্র হয়ে যায় সুধীরের। গৌরীকে কি বলবেন ভেবে পাননা তিনি, শুধু এক মুহূর্তের জন্য তার হাতটা আঁকড়ে ধরেন গভীর ভরসায়।
অন্যদিনের মতন নয় আজ এই গঙ্গার ধারের বিশাল বাংলো। কেমন যেন একটু চুপচাপ, বাইরের পোর্টিকোয় দুটো বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে। কী গাড়ি কে জানে! কেউ কি এসেছে? শোভার যা পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান তাতে কোন এস্টেটের মহারাজার পরিবারের লোকের আসাটাও আশ্চর্যের নয়। সুধীরকে তলব কি তাহলে তেমন কোন বিশিষ্ট অতিথিকে গান শোনাবার জন্য? বুঝতে পারেন না সুধীর।
 
       সামনের বিশাল সেগুন কাঠের মূল প্রবেশ দ্বার দিয়ে তানপুরা হাতে প্রবেশ করতেই কোথা থেকে দৌড়ে এল শোভা। হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল গঙ্গার দিকের একটা বড় মাপের ঘরে। ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে যান সুধীর। ঘর জুড়েই ফরাশ বিছানো, অথচ কোন শ্রোতা নেই। এক প্রান্তে তাকিয়া শোভিত মঞ্চের আদল! অবাক বিস্ময়ে শোভাকে প্রশ্ন করতে যান সুধীর। মুখে হাত দিয়ে চুপ করিয়ে দেন শোভা। ফিসফিস করে বলেন, ‘একজনের সামনে তোমাকে গান গাইতে হবে সুধীর’দা, আমার মান রাখতে হবে আজ। আমি তাঁকে বলিনি এখনও যে এমন একজন শিল্পীর গান শোনাবো তাঁকে যে তিনি চমকে যাবেন।’
কেমন যেন সামান্য নার্ভাস হয়ে যান সুধীর। এমনিতে তার এই দোষ নেই, তানপুরা নিয়ে বসলে তিনি খুব তাড়াতাড়িই আত্মস্থ হয়ে যান। কিন্তু আজ কেন জানি একটু সংশয়েই পড়ে গেলেন। আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসাই করে ফেললেন, ‘কে তিনি?’
-‘তুমি তাড়াতাড়ি তানপুরা বেঁধে নিয়ে গান তো শুরু কর। আমি চাই তোমার গান তাঁকে টেনে নিয়ে আসুক এখানে’।
শোভা’র মুখের চাপা উত্তেজনাও নজর এড়ায় না সধীরবাবুর। ইতিমধ্যেই গুটিগুটি পায়ে কয়েকজন সংগীতপীপাসু পরিচিত, অপরিচিত মানুষজন ঘরে প্রবেশ করেছেন, লক্ষ্য করেন সুধীর। তারাশঙ্কর তার সাথে তবলা সঙ্গত করে। অবাক বিস্ময়ে তবলার ব্যাগ হাতে তাকেও ঘরে ঢুকতে দেখেন সুধীর।
একটা ছোটখাট সংগীত সভার আয়োজন করা হয়েছে চুপিচুপি, হয়ত কিছুটা তড়িঘড়ি করেই, অথচ তার কোন আগাম ফরমান নেই। অবাকই হন সুধীর। বেশ কিছু পরিচিত শ্রোতাদের উপস্থিতিতে আর তিনি নতুন করে ভাবেন না কিছু। প্রশ্ন করেন, “কিছুই তো প্রস্তুতি নেই নি, কী গাই বলো তো?”
-“সেদিনের সেই কৌশী কানাড়াই গাও।” আবদার করে শোভা।
মাটিতে শোয়ানো তানপুরা কোলে তুলে নেন সুধীর। খড়জের তারকে সামান্য মোচড়ে সূক্ষ্ম ভাবে ডি শার্পের সা তে মিলিয়ে নিতে নিতে বলেন, “আজ কৌশী না, নায়কী কানাড়া গাইবো।” শিল্পীর চোখের দিকে তাকিয়ে উপস্থিত শ্রোতারা বুঝতে পারেন, আত্মস্থ হচ্ছেন সুধীর; সুরের রঙে ভাব মিশিয়ে নায়কী কানাড়াকে প্রতিষ্ঠা করা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। অনতিদূরে গঙ্গার পাড়ে রাসমণির ঘাটে তখন সন্ধারতি শেষ হয়েছে। কালো চাদরে মুড়ে রাত্রি নেমেছে গঙ্গার উপরে।
"ক্যায়সে সমঝাউ তনরঙ্গওয়া"
 
        সুরের মোচড়ে উথাল পাথাল হয়ে উঠছে এই পুরনো দিনের বাংলো বাড়ি। সুধীরকে যেন আজ কোন এক অতিপ্রাকৃত শক্তি ভর করেছে। সুধীরের গলায় নায়কী কানাড়া আজ অবধি কেউ শোনেন নি তার পরিচিতরা। শুনেছেন আভোগী কানাড়া, কৌশী কানাড়া। দরবারি কানাড়া তো অজস্রবার। কিন্তু নায়কী কানাড়া? জীবনে এই প্রথম। প্রথমবারেই জীবনে প্রথম প্রকাশ্যে গাওয়া নায়কী কানাড়ায় মাতিয়ে দিলেন তিনি উপস্থিত শ্রোতাদের। সুরের বিস্তারে রাগের রূপকে প্রতিষ্ঠা করে তার সপ্তকের সা তে স্থিত হচ্ছিলেন সুধীর। বিলম্বিতের অন্তরার মুখটাকে ধরার পরিকল্পনা করে এগোচ্ছিলেন তিনি। ঠিক এই সময় ঘরের বাইরে যেন একটু মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল। অন্তরার গানের মুখ ধরতে গিয়েও পিছিয়ে এলেন সুধীর, সামান্য সময়ের জন্য মনোসংযোগ ছিন্ন হল।
-“কৌন গা রাহা হায়, কৌন গা রাহা হায়” বলতে বলতে টলোমলো পায়ে যিনি ঘরে ঢুকলেন তাকে দেখে সুধীর একা নয়, থমকে গেলেন উপস্থিত সক্কলে। যেন বিশ্বাস হচ্ছে না কারো, কে ইনি? ঠিক দেখছি তো? মৃদু, অতি মৃদু ফিসফাস এর আওয়াজও থেমে গেল যখন পরিপূর্ণ মদিরার পাত্র হাতে সুধীরের সামনে প্রায় তিন হাত দুরত্বে এসে পা গুটিয়ে বসে পড়লেন ওই বিস্ময় আগন্তুক। মাথা ঝোকানো সেই পরিচিত ভঙ্গীতে জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলেন, “গা বেটা, গা, বহুত আচ্ছা, গা...”।
 
*******  
 
        ঘুম আসছে না আজ সুধীরের কিছুতেই। যেন এখনও ঘোরের মধ্যে আছেন। সামনে বসে আছেন তার অন্যতম সংগীত দেবতা পন্ডিত ভীমরাও যোশী, আর তিনি তার সামনে গাইছেন! আর পন্ডিত যোশী সুরের দ্যোতনায় “ওয়া ওয়া”, সাপাট তানের বিদ্যুৎ গতির ছোবলে “কেয়া বাত কেয়া বাত” করছেন!
তার পরে যা ঘটল তা তো তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন না। সত্যিই কি এমন ঘটেছিল? কী করে সম্ভব হল এটা! বিলম্বিত শেষ করে তিনি দ্রুতের খেয়াল এ যাবেন ভাবছেন, হাতের পাত্র কে একটু দূরে সরিয়ে রেখে পন্ডিতজি বলে উঠলেন, “ইয়ে তো নায়কী কানাড়া হ্যায়, অউর এক তারহা কা নায়কী কানাড়া শুন....”।
আর এক ধরণের নায়কী কানাড়া শুনালেন পন্ডিতজি। দশ মিনিট। সুরের চলনের পৃথক রাস্তায় হেঁটে আবার ফিরে এলেন সুধীরের গাওয়া নায়কী কানাড়ায়, দুই একটা ছুট তান করে গানের খেই ধরিয়ে দিলেন সুধীরকে। অনির্বচনীয় এক স্বর্গীয় পরিবেশের সাক্ষী হয়ে থাকলেন উপস্থিত গুটিকয়েক শ্রোতা। রাজরাণীর মত যার চালচলন সেই শোভার চোখের কোণেও আনন্দাশ্রু চিকচিক্ করে উঠলো।
*****
খাটের উপরে কি শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে গৌরী! পাশে তার ছেলে । মায়ের বুকের ভিতর মুখ গুঁজে সেও গভীর নিদ্রামগ্ন। ঘুমোতে পারছেন না একমাত্র সুধীর। বাড়ি ফিরে গৌরীকে সবিস্তারে গল্প করেছেন আজকের ঘটনা। গৌরী ভীষণ খুশী হয়েছে, কিন্তু গৌরী জানেননা এই ঘটনার প্রকৃত অনুভূতি কেমন! সারা দেশ যাঁর গানে মোহিত হয়ে থাকে সেই জগতবিখ্যাত পন্ডিত ভীমরাও যোশী তার সাথে নায়কী কানাড়ার সুর মিলাচ্ছেন, গাইছেন একই বন্দিশ! একসাথে! তাকে বলে দিচ্ছেন, “অউর এক তারহা কা নায়কী কানাড়া শুন....”! গৌরী যতই তার গানের সমর্থক হোক, এই অপার্থিব অনুভূতির যে সূক্ষ্মতা তা সে ধরতে পারবে না। সুধীরের গায়ে যে লেগে আছে পন্ডিতজির আলিঙ্গনের স্পর্শ! গান শেষ হতেই নিজে থেকে উঠে এসে সুধীরকে জড়িয়ে ধরেছিলেন তিনি। অনেক আশীর্বাদ করে মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি সুধীরকে বলে উঠলেন, “তু মেরে পাশ চলা আ, পুনে মে। ওয়াহা ম্যায় তুঝকো আউর শিখাউঙ্গা। সারা দেশ তুঝে পহেচানেগা”।
গৌরীর নিদ্রামগ্ন, পবিত্র, দেবীর মতন মুখটাকে আবার দেখেন সুধীর। দেখেন ছেলের কচি কচি হাত দুটিকে। আবার মনে পড়ে সেই জলদ্গম্ভীর কন্ঠস্বরের নির্দেশনা।
“নৌকরী?! মা সরস্বতী কা আশীর্বাদ জিসকে উপর হ্যায়, উনহে নৌকরী কি ফিকর হোনা নেহি চাহিয়ে। নৌকরী ওয়াক্রী ছোড়, পুনা চলা আ, মেরে পাস...”।
বড় দ্বন্দ্বে পড়ে যান শিল্পী। কী করবেন তিনি! কোন পথে হাঁটবেন! উত্তর খুঁজে পান না। নিদ্রামগ্ন মা আর ছেলের ওই পবিত্র দৃশ্য তাকে বিহবল করে তোলে।
না, না, এ মহা পাপ হবে। তার নাম, তার খ্যাতির জন্য এদেরকে ছেড়ে সুদূর পুনা চলে যাওয়া ঘোর অন্যায় হবে। এই অন্যায় করতে পারবেন না সুধীর। নাই বা হল তাতে তার দেশজোড়া নাম!
খাটের পাশ থেকে আস্তে নেমে দাঁড়ান সুধীর। যে পাঞ্জাবী পরে তিনি আজ গাইতে গেছিলেন তা ঝোলানো ছিল দেওয়ালে সাঁটা সাবেকী ডায়মন্ড আকৃতির কাঠের হুকে। সেই পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা ছোট্ট কাগজ বের করে আনলেন সুধীর। দেখলেন ওই রাতের আবছায়াতেও। পন্ডিত ভীমরাও যোশীর নিজের হাতে লিখে দেওয়া তাঁর পুনা’র বাড়ির ঠিকানা ও ফোন নম্বর। কাগজটা মাথায় ঠেকালেন তিনবার। দেওয়াল আলমারি খুলে ভাতখন্ডেজির বই বের করে নায়কী কানাড়ার পাতা টা খুললেন। কাগজের টুকরোটা সেই পাতায় রেখে বই বন্ধ করে আলমারিতে তুলে রাখলেন সুধীরবাবু।
 
******* শেষ *******
Goutam Saha