নৈঃশব্দের চূড়ায় - শ্যামাপ্রাসাদ সরকার

 

নৈঃশব্দের চূড়ায়
শ্যামাপ্রাসাদ সরকার 
 

        বিরাট একটা পাঁচিল। দূর থেকে দেখলে জেলখানারর কথা মনে পড়ে যাবে। তারপর একটা ফটকের ওপারে উঁচু মিনারটা আজও শহরের সমস্ত কোলাহলের সীমানা পেরিয়ে চুপ করে টিকে আছে। আসলে চারপাশটাই বদলে গিয়েছে অনেকটা। এখন শহরের আশেপাশে তেমন চিল-শকুনের দেখা মেলে না।
কিন্তু একটা সময় তারাও এখানে অপেক্ষা করে থাকত। কখন একটি মৃতদেহ নিয়ে বাড়ির লোকেরা পল-বিয়ারারের দলের হাতে সেটিকে নীরবে তুলে দেবে সেই মিনারের চূড়ায়। আর তারপর সেই মৃতদেহের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে এগিয়ে আসবে মাংসাশী পাখিরা। তাদেরডানার ঝাপটে আর ক্ষুধার চিৎকারে সমস্ত নীরবতা ভেঙে খানখান হয়ে যাবে। এখনতো আর চিল-শকুনেরা আর অপেক্ষা করে থাকে না। মৃতদেহও আসে না বললেই চলে। নওরোজজী দুকানওয়ালাদের মত শ' তিনেক পার্সী পরিবার টিকে আছে এই কলকাতায়। হ্যাঁ, বললে কি কেউ মানবে এই সেদিন পর্যন্ত কলকাতা শহরেই এক লক্ষ পার্সি নাগরিক বাস করত। ইস্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানির বদান্যতায় কলকাতা তখন সদ্যযৌবনা। কত জাতের বর্ণময় লোকের সমাহার তখন আর ততই বিচিত্র তাদের ব্যবসা। সেই সময় অগ্নি-দেব আহুর মাজ্দা র উপাসক পার্সিরাও এল কলকাতায়। বোম্বাই, সুরাটের পর জাঁকিয়ে বসল তিলোত্তমায়। আগে থেকেই ধনে-বিদ্যায়-ঐশ্বর্যে এগিয়ে ছিল সকলের থেকে। পসার জমিয়ে আরওবড়লোক হয়ে উঠল তারা।
পার্সি ব্যবসায়ী দাদাভাই বেহরামজি বানাজি সুরাট থেকে কলকাতা এসেছিলেন ১৭৬৭ সালে। কলকাতায় তাঁদের উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল একাধিক এন্টারপ্রাইজ। তবে বাঙলা ও বাঙালির সঙ্গে মিলেমিশে যেতে তাঁদের বেশি সময় লাগেনি। অনেকের তো পদবীর শেষে ‘বেঙ্গলি’ শব্দটাও যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। ঠিক যেমন করে পেশা বা ব্যবসাভিত্তিক ভাবে
' বাটলিওয়ালা', 'দারুওয়ালা', 'মিস্ত্রী এসব পদবী গুলো এসেছে।
*********
নওরোজজী দুকানওয়ালার বয়স এখন আশি ছুঁই ছুঁই। একা নির্জন একটা কামরায় সিনাগগ্ স্ট্রীটের ভেতরে তার পঞ্চাশ বছরের ভাড়া করা ফ্ল্যাট। তখন ভাড়া ছিল মাসে একশো দশ টাকা এতদিনে বেড়ে বারশো পঞ্চাশ। মালিক টালিক কেউ নেই। ফ্ল্যাটটা আদালতের রেজিস্টারের হাতে চলে গেছে তাও নয় নয় করে বছর দশেক হল। যে কোন দিন শমন পাঠিয়ে উঠিয়ে দিতে পারে। তাও নিজে নিয়ম করে রেন্ট কন্ট্রোলের অফিসে গিয়ে ভাড়া দিয়ে বেরোবার সময় রেভিনিউ স্ট্যাম্ন লাগানো রসিদটা পকেটে পুরতে পুরতে প্রতিবার একবার করে ভাবেন,
'যাঃ! এই শেষবার! সামনের মাসে বোধহয় আর আসতে হবেনা! '
নওরোজজীর জীবনেও যেমন ছুটির নোটিস আসতে দেরী করছে , তেমনি আদালতের ঘর ছেড়ে উঠে যাওয়ার শমনটাও আসব আসব করে এখনো আসেনি।
 
************
 
একা থাকাটাই অভ্যেস হয়ে গেছে বলে হলদেটে দেওয়ালে বাল্বের আলোয় নিজের কাঁপাকাঁপা ছায়াটাকেও আজকাল পছন্দ হয়না যেন! এতরকমের মৃত্যু দেখেছেন যে, সে আজ সব গা সওয়া হয়ে গেছে।
 
      নওরোজজীর একমাত্র ছেলে সোরাবজী গেল এয়ারফোর্সে চাকরী করতে । সেই তরতাজা তিরিশ বছরের ছেলে যখন প্লেন ক্র্যাশে মারা গেল তখন থেকেই আবার নতুন করে শূন্যতার সাথে বন্ধুত্ব পাতাতে বসা। ওই একবারই যা নওরোজজীর টাওয়ারে আসা হয়নি। নইলে তার আগে অবধি বাবা, মা, কাকা, ভাই, সোফিয়া...প্রতিটা প্রিয়জনকেই শেষবার নিয়ে এসে নিজের হাতে পল-বিয়ারারের হাতে জমা করে গেছেন। মাংসলোভী গৃধিণীদের ভুক্তাবশেষ হয়ে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেছে তারা। স্ত্রী সোফিয়া তো আগেই গেছিল। সোরাব তখন স্কুলে পড়ত। কাপড়ের ব্যবসায়ী রনি বিলিমোরিয়ার মেয়ে সোফিয়া যে কি করে নওরোজজীর প্রেমে পড়েছিল তা এক রহস্য বটে। অবশ্য তখন নওরোজজীও সুপুরুষ ছিল। পাক্কা ছ'ফুট লম্বা, হকি খেলা চেহারা আর টকটকে গায়ের রঙ। ওদের ছিল পোর্সেলিনের বাসন আর ফুলদানী তৈরীর একটা ছোট কারখানা। ট্যাংরা ছাড়িয়ে সে সব জায়গা তখন ধূ ধূ প্রান্তর একেবারে। বেশ ছিল কিন্তু দিনগুলো তখন। 
 
*********
 
      এরপর ছেলের বউ আফরিন একদিন সন্ধেবেলা ওদের বাড়ি ছেড়ে চলে গেল দুবছরের ফুটফুটে নাতনি শিরিনকে নিয়ে। সে আবার সংসার পাততে চায়! নাঃ, নওরোজজীর এ বিয়েতে কোনরকম আপত্তি ছিল না ঠিকই তবে নাতনীটাকে দেখতে না পাওয়া আর সিনাগগ স্ট্রীটের চারটে দেওয়ালের চাপা একাকীত্বটাই যা শুধু গিলে খেতে আসত। নাতনীটার ফেলে যাওয়া ফিডিং বোতলটায় দুধের গন্ধও শুকিয়ে চড়া পরে গেছে কবেই।
এরমধ্যে তো একবার তো ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যাও করার কথাও মনে হয়েছিল। কিন্তু না, ওষুধের স্ট্রীপটা খালি করতে আর শেষ অবধি সাহসে কুলোয়নি।
*********
শীতকালে হাঁপানির কষ্টটা বাড়ে। বুড়ো হওয়াটায় এটাই একটা অসুবিধা। বড্ড নড়বড়ে হয়ে যেতে হয়। বন্ধুবান্ধবের অধিকাংশই এখন সাদা কালো এ্যালবামের পাতা থেকে হাতছানি দেয়। সোফিয়াও ওকে ডাকে শুনতে পান! সোরাব ও যেন 'পাপা! পাপা! ' বলে সেইদিনগুলোর মত ট্রাইসাইকেলে চক্কর দেয়। এগুলোর কোনটাই যদিও চোখে দেখা যায়না। মনে হয় চারদিকের অনন্ত শূন্যতার মধ্যে এই ফিসফিসানিগুলোই বোধহয় বেঁচে আছে।
 
**********
 
     রোববার সকালবেলায় হাঁটতে হাঁটতে একবার টাওয়ারের কাছটায় গিয়ে দাঁড়ালেন। অনেক অনেক বছর আগে, যখন বেলেঘাটার খালটাও ছিল না, তখনকার সেই নিদ্রিত নীরবতার চেহারাটা যেন টাওয়ার অফ সাইলেন্সের আশেপাশে আজও থমকে আছে। আজকাল বোধহয় আর কেউ আসেনা এখানে। বিরাট পাঁচিলটা দূর থেকে দেখলে জেলখানার মত মনে হয়। তারপর সেটা পেরিয়ে একটা ফটকের ওপারে উঁচু মিনারটা বৃদ্ধ নওরোজজীর মতই উদাস, একা, শূন্য আর নিশ্চুপ হয়ে আছে বহুদিনই।
পা টিপে টিপে ওপরটায় উঠে আসলেন নিজেই। কিছু সামান্য শুকনো হাড়গোড় পড়ে আছে বলেই হয়তো মৃত্যুর গন্ধটা কিন্তু এখনো বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে।
কতজনের অশ্রু আর স্মৃতির অবশেষ এখানে!
নিজের আসার সময় হলে তো আর টের পাবেননা মৃত্যুর সেই নিরবিচ্ছিন্ন স্তব্ধতা কেমন করে চিল শকুনের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যায়।
পল-বিয়ারার দলের কাউকে দেখা যাচ্ছে না এখন। আচ্ছা যদি সোফিয়া, পল, সবার সাথে এখানে একবার দেখা হয়ে গেলে প্রথমে কি বলে ডাকবেন নওরোজজী? তারা যদি আজ সামনে এসে দাঁড়ায় ওঁকে চিনতে পারবে আগের মতোই? সোরাবের দেহের কয়লা হয়ে যাওয়া টুকরোগুলোই মিলেছিল আর্মির কফিনের ম্যে। নয়তো সোরাবকেও তো যদি এখানে আনতে হত.....
আর এসব ভাবতে ইচ্ছে করছেনা। চুপ করে মাথায় হাত দিয়ে বৃদ্ধ বসে থাকেন খানিক্ষণ। দুচোখের পাতায় যেন অন্ধকারের ডাক আসছে ধীর পায়ে।
সূর্যের আলো ঢেকে ততোক্ষণে লম্বা লম্বা ডানা ছড়িয়ে আস্তে আস্তে অসংখ্য শকুন আর মাংসভোজী পাখির দল নেমে আসছে....
আরো নীচে....আরো নীচে......
আর তাদের ডানার ঝটপট শব্দে একটু একটু করে ঘুম ভাঙছে নৈঃশব্দের চূড়োয়। 
......................
 
Shyama Prasad Sarkar