মিঠু আর দুখুলাল -সুস্মিতা কুণ্ডু


মিঠু আর দুখুলাল

সুস্মিতা কুণ্ডু 




    শীতের দুপুরগুলো ভারি আলসে। মিঠু ঘাসের ওপর বসে বসে জলের ওপর ভাসতে থাকা শোলার ফাতনাটার নাচ দেখে। মাঝে মাঝে একটা দুটো মাছ এসে মনে হয় বঁড়শিটার গায়ে ঠোক্কর লাগাচ্ছে, সেই ধাক্কাতে ফাতনাটা তিরতিরিয়ে কেঁপে উঠছে কিন্তু ডুবছে না। শীতের কনকনানিতে মাছগুলোরও মনে হয় খাওয়া দাওয়ায় অরুচি ধরেছে। তার ওপর এই শুকনো আটার গোলা দিয়ে চার দিলে মাছ কেন ব্যাঙও খাবে না। পিঁপড়ের ডিম, বোলতার চাক, কেঁচো নিদেনপক্ষে একটু বাসি পাঁউরুটি ঝোলা গুড় দিয়ে মেখেও যদি ডেলা করে দিত দুখুলাল তাহলে নাহয় কথা ছিল। কিন্তু সেসব কিচ্ছু করবে না দুখুলাল। ভাবগতিকখানা এমন যেন মাছ ধরার ভান করবে কিন্তু মাছ ধরা না পড়লেই ভালো। 

    অদ্ভুত মানুষ এই দুখুলাল। এই যে তেঁতুলদিঘির পাড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা মাথায় শোলার টুপি চাপিয়ে বাঁশের কঞ্চির ছিপ বাগিয়ে বসে আছে অথচ মাছে টোপ গিলল কিনা তাই নিয়ে কোনও হেলদোল নেই। সেই কোন সকালে দুটো বাসি পান্তা আধাআধি ভাগ করে খেয়ে মিঠু আর দুখুলাল বেরিয়েছে। এতক্ষণে সব হজম হয়ে পেটের ভেতর ছুঁচোগুলো বুড়িবসন্ত খেলতে শুরু করে দিয়েছে। বেশি ক্ষিদে পেলেই দুখুলাল গান ধরে, নিজেই কথার বাঁধন দেয়, নিজেই সুর বোনে, নিজেই গলায় সুর তোলে। মিঠুর চোখেও সেই মিঠে সুরের তালে তালে ঘুম নেমে আসে। পেটের ছুঁচোগুলোরও নির্ঘাৎ ঘুম পেয়ে যায় নইলে মোচড়মারা ব্যথাটা গায়েব হয়ে যায় কী করে? 

    তেঁতুলদিঘির পাড়ের বড় বড় তেঁতুলগাছের ঝিরিঝিরি পাতার ফাঁক গলে রোদ্দুর এসে খেলা করে দুখুলালের শোলার টুপিতে। দুখুলাল কখও টুপি খুলে মাথার একঝাঁকড়া নুনমরিচ চুলে রোদ্দুর মাখে। মিঠুরও পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, 
-“জানিস মিঠু! গাছেরা এই সূর্যের আলো, মাটির জল আর এই ফুরফুরে বাতাস খেয়েই পেট ভরিয়ে নেয় বুঝলি। শুধু তোর আমার মত লোকেদেরই যত খাইখাই! চল দেখি আজ আমরা পেটপুরে রোদ্দুরের ভোজ খাই।”
মিঠুর গরম গরম মাছভাজার বদলে এই রোদ্দুরভোজের বুদ্ধিখানা মোটেই পছন্দ হয় না। জল খেয়ে তবু নাহয় একটু হলেও পেট ভরে কিন্তু তাই বলে রোদ্দুর বাতাস! এই সবে পেট ভরে কখনও? দুখুলাল মিঠুকেও ওর নিজের মত বোকা ঠাউরেছে বুঝি! 

    নাহ্! গা ঝাড়া গিয়ে উঠে পড়ে মিঠু। জলের একটু কাছ ঘেঁষে গিয়ে চেয়ে দেখে ফাতনা ডুবল কিনা। কচু! ফাতনা ডোবা তো দূর উল্টে একটা সবজে ফড়িং এসে ফাতনার ওপর বসে ‘তা ধিন তা নানা’ করে নেচে চলেছে। মিঠু বার দু’য়েক চেষ্টা করে ফড়িংটাকে তাড়ানোর কিন্তু দুখুলালই মিঠুর কথা শোনে না তো ফড়িংয়ের শুনতে ভারি বয়েই গেছে। মিঠুর বেজায় রাগ হয় ফড়িংটার ওপর। ওই অত্তটুকু একটা পোকা সে কিনা মিঠুর মত বড় প্রাণীকে ভয় পায় না! তবে রে! কী করবে কী করবে ভাবতে ভাবতেই ফড়িংটা ফাতনা থেকে সটান উড়ে এসে বসল মিঠুর মাথায়। মিঠু ঘাড় ঝাঁকাতেই সে উড়ে গেল পাশের সেকুল গাছের ঝোপে। মিঠুও ছাড়ার বান্দা নয়, ছুটল পেছু পেছু। ফড়িং ব্যাটা তো জানেনা যে মিঠু প্রজাপতি ফড়িং তাড়া করতে ওস্তাদ। বোলতা ভীমরুল আরশোলা এদের একটু ভয় পায়, সমীহ করে চলে বৈকি মিঠু কিন্তু ফড়িং আর প্রজাপতির সাথে মিঠুর একটা রণং দেহী জাতীয় সম্পর্ক।

    ফড়িংটাও কম চালাক নয়! এ গাছ ও গাছ, এই ঝোপ ওই ঝোপ লাফিয়ে শেষমেষ এসে বসল মিঠুর নাকে। মিঠুর তো বেদম হ্যাঁচ্চো পেল। কোনও মতে হাঁচি চেপে ফড়িংটাকে উড়িয়েছে যেই না ওমনি, হ্যাঁঅ্যাঁচ্চোও! 
আর সেই হ্যাঁচ্চোর আওয়াজে আনমনা দুখুলাল ধড়মড়িয়ে রোদ্দুর মাখা নাকি খাওয়া থামিয়ে ছিপ ধরে টান দিল। ফক্কা! ছিপে না আছে মাছ, না আছে চার। দুখুলাল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে খানিক জলের দিকে খানিক ছিপের দিকে চেয়ে রইল। তারপর মাথাটাথা চুলকে, সূতো গুটিয়ে মিঠুকে বললে, 
-“চ মিঠু আজ বরং মাছধরা বাদ থাক বরং। তোতে আমাতে আজ মুড়িই চাট্টি খেয়ে নেব বরং।”

    মিঠুর মনটা ভারি খারাপ হয়ে যায় কিন্তু কী আর উপায়। চুপচাপ দুখুলালের পিছু নিল। তেতুঁলদিঘি ওদের বাড়ি থেকে কতদূরের রাস্তা! এতখানি পথ উজিয়ে এসে খালি হাতে ফিরতে কারোর ভালো লাগে? গুটিকয় পুঁটি মৌরলা শিঙ্গি মাছও যদি ধরতে পারত অন্তত, মুখরক্ষা হত। ওদিকে দুখুলাল বকবক করেই চলেছে, 
-“এটাই বেশ হল বুঝলি মিঠু! যদি মাছ পেতুম তাহলে যেতে হত সেই বাগুমুদীর দোকানে তেল কিনতে। বাগুমুদীর দোকানে আবার কতগুলো টাকা ধার পড়ে আছে বল দিকিনি! পুরনো ধার না শুধে নতুন করে তেল কিনতে গেলে লজ্জা লাগবেনা বল?”

    মিঠু মনে মনে ভাবে, বাগুমুদী এক নম্বরের চোর। এই তো গেলবার চাল কিনতে গিয়ে কী কাণ্ড কী কাণ্ড! সেই নিয়ে ছয়বার দুখু বাগুমুদীর টাকা শোধ করেছে তবু সে ব্যাটা একটা লাল কাপড়ে মোড়া ইয়া গাবদা খাতা খুলে পানখেকো দাঁত বার করে বলে কিনা, 
-“অ দুখু! তোমার তো বাপু দেড়শটা টাকা একনও শোধ হয়নেকো! তুমি বরং তোমার ওই হারমোনিটা বাঁধা রেখে যেও দিকি আমার কাচে। টাকা পেলে পরে ছাইড়ে নে যেও’খন। তদ্দিন আমার মেয়ে একটু বাজনাটা বাজ্জে নেবে না হয়।”
দুখুলালও তেমনি বোকার হদ্দ! সাধের হারমোনিয়মটা রেখে এল বাগুমুদীর কাছে। ওইটে কি দেড়শ টাকার যন্ত্র? দুখুর গুরুজী ওটা দুখুকে দিয়েছিল, কম করে হাজার দেড়েক টাকা দাম হবে। কিন্তু ওই যে দুখুলাল একটা মস্ত বোকা লোক। এমন ঠকা ঠকেও বলে কিনা,
-“বুঝলি মিঠু, হারমোনিয়ামটা আমিই বাজাই কিংবা বাগুমুদীর মেয়েই বাজাক, সুর তো তুলছে যন্ত্রটা বল? ওই বেলো টেনে বাতাস ঢোকালে সেই বাতাসই কত রকম সুর হয়ে বেরোয় জানিস ওটা থেকে। এমন আশ্চর্য যন্ত্র কি শুধু নিজের কাছে লুকিয়ে রাখার জিনিস? বিলোতে হয় বুঝলি মিঠু বিলোতে হয়।” 

    মিঠু অতশত বোঝে না! বাগুমুদীর দোকানের আশেপাশে গেলে বা দুখু ওর নাম ধরলেই মিঠুর ইচ্ছে করে দাঁত দিয়ে ওই লাল কাপড়ে মোড়া খাতাটা কুটিপাটি করে ছিঁড়ে দিতে। তেল চাল ডাল কিচ্ছু চাই না ওর দোকান থেকে। দুখুলাল জানে যে বাগুমুদীর ওপর মিঠুর খুব রাগ। হারমোনিয়ামটা এখনও বাঁধা পড়ে আছে কিনা বাগুর কাছে। কোনওদিন ছাড়াতে পারবে বলে মনে তো হয় না। দুখুলাল তাই আনমনে বলে চলে, কতকটা মিঠুকে, কতকটা নিজেকে,
-“বিলোতে হয় রে মিঠু! এই ছোট্ট বুকের খাঁচায় এত ভালোবাসা ভরে দিয়েছে ঠাকুর সেই ভালোবাসা বিলিয়ে দিতে হয় বুঝলি, নইলে সঅঅব জমে বরফ হয়ে যাবে। তখন আর কোনও তাপ উত্তাপ কষ্ট যন্ত্রণাতেও গলবে না সেই বরফ। কারোর কষ্টে যদি নাই কাঁদলি, কারোর খুশিতে যদি নাই হাসলি মিঠু, তাহলে এ জনমই যে মিছে। শুধু কটা জিনিস আঁকড়ে পড়ে থেকে কী হবে? আঁকড়াতে যদি হয়ই তবে হাসিটা আঁকড়ে ধর দিকি। খুশিটা জাপটে ধর দিকি। বাদবাকি সব ফস্কে যদি যায় যাক না, মন্দ কী!“

    মিঠু চুপটি করে মাথা নামিয়ে পথ চলে। সামনেই দুখুলাল  কথা কইছে আর হাঁটছে। মাথায় শোলার টুপি। একহাতে ছিপ আরেকহাতে মাছ রাখার ফাঁকা চুবড়িতে আটার শুকনো ডেলা। মিঠু ভাবে, আহারে দুখুলাল বড় গরীব, বড় দুঃখী মানুষ। 

    দুখুলাল গান ধরেছে, হারমোনিয়াম ছাড়াই। গানের কথাগুলো যেন সুরের নাও বেয়ে দূর থেকে ভেসে ভেসে আসে মিঠুর কানে। পূর্ণিমার চাঁদের আলোর মত নরম কথা, দুব্বোঘাসের ডগায় জমা ভোরের শিশিরের মত কোমল সুর। 
মিঠু বিলিয়ে দেয়, সব ক্ষিদেটুকু বিলিয়ে দেয় আকাশে বাতাসে। আর পেটে ব্যথা করে না। মাছভাজা খেতে মন চায় না। মিঠু ভাবে, দুখুলালের মত সুখী, বড়লোক দুনিয়ায় কেউ নেই। 

    ঝণাৎ করে লোহার শেকলটা খোলে দুখুলাল, দুইজনায় ঢোকে ঘরে। এক কোণে ছিপ চুবড়ি সব রেখে টিনের কৌটো হাঁটকায়। অ্যালুমিনিয়মের কাঁসিতে টিন উপুড় করে ঝেড়ে ঝেড়ে শেষবিন্দু অব্দি মুড়ি ঢালে। তারপর আদ্দেক ঢেলে দেয় মিঠুর কাঁসিতে। মিঠু নিঃশব্দে কাঁসিতে মুখ ডুবিয়ে মুড়ি চিবোয়। দুখুলাল নিজের কাঁসি থেকে মিঠুর পাতে আরও চারটি মুড়ি ঢেলে দিয়ে ওর ঘাড়ে গলায় কানে আঙুলে করে সুড়সুড়ি দেয়, হাত বোলায়। পরম মমতায় বলে ওঠে, 
-“ভাবিসনে মিঠু, কাল ঠিক মাছ ধরব। আর তেলও জোগাড় করব। বড্ড ঠাণ্ডা পড়েছে। তোকে একটা চটের থলে দিয়ে জামা করে দেব দাঁড়া। আয় দেখি এখন আমার কাছ ঘেঁষে বোস তো দেখি। একটা গান শোনাই। আমার ওসব হারমোনিয়াম তবলা বাঁশি কিছু লাগেনা বুঝলি? আমি হলুম দুখুলাল গাইয়ে!”

    নিজের ঠাট্টায় নিজেই হাসে দুখুলাল। গলা ছেড়ে গান ধরে। খোলা দরজা দিয়ে চাঁদের আলো আর মাঘের ঠাণ্ডা বাতাস হুহু করে ঢুকছে। তবুও মিঠুর ঠাণ্ডা লাগে না। আলোর সিঁড়ি বেয়ে দুখুলালের গানের সুরগুলো কেমন নেচে নেচে চাঁদের দিকে পাড়ি জমিয়েছে। ঘুমে ঢুলে পড়তে পড়তে মিঠু ভাবে, দুখুলাল ভারি আশ্চর্য একটা মানুষ, নইলে কেউ কুকুরছানার নাম মিঠু রাখে! 

(সমাপ্ত)

Susmita Kundu
                                

                             

Comments (7)

Loading... Logging you in...
  • Logged in as
পল্লবী পাল's avatar

পল্লবী পাল · 247 weeks ago

আমার খুব ভালো লেগেছে। মেয়েকে শোনালাম
Mita Chowdhury Saha 's avatar

Mita Chowdhury Saha · 247 weeks ago

অপূর্ব গল্প..খুব ভালো লাগলো
তপতী ভট্টাচার্য's avatar

তপতী ভট্টাচার্য · 247 weeks ago

খুব ভালো লাগলো
খুব মিষ্টি একটা গল্প । খুব ভালো লাগলো 😍😍
শুভদীপ 's avatar

শুভদীপ · 247 weeks ago

অসাধারণ
Sayantan Roy's avatar

Sayantan Roy · 246 weeks ago

গল্পটা বেশ অন্যরকম। অনেকদিন পরে এইরকম একটি লেখা পড়লাম, অনেকটা নবনীতা দির মতো লেখা চরিত্র গুলো। দারুন ভালো
Sudipa Samanta's avatar

Sudipa Samanta · 230 weeks ago

Mon chuye gelo..ak kothay durdanto

Post a new comment

Comments by