ধারাবাহিক- মহাপ্রস্থানের পথে - অয়ন দাস


ধারাবাহিক

 মহাপ্রস্থানের পথে
অয়ন দাস

 || প্রথম পর্ব ||

১.
 
সন্ধ্যাবেলা বেশ একচোট কালবৈশাখী হয়ে গেলো। ঝড় থেমে গেলেও, ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়েই চলছে। স্টাডিরুমের খোলা জানালাটা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে নিবিষ্ট চিত্তে বসেছিলেন প্রফেসর জনার্দন নন্দী। চোখেমুখে একটা গভীর উদ্বেগের ছাপ। গুরুতর কিছু ব্যাপারে বেশ চিন্তামগ্ন হয়ে রয়েছেন। একটা সায়েন্স জার্নালে অনেকক্ষণ ধরেই মনোনিবেশ করার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলেন তিনি। কিন্তু কিছুতেই মন বসতে চাইছে না। তাঁর মনের ভাব অনেকটা বাইরের ওই জমাট বাঁধা অন্ধকারের মতো হয়ে রয়েছে। একরাশ দুশ্চিন্তার কালো মেঘ আলো প্রবেশের পথে সমূহ বাধার উৎপত্তি করছে।


ঢং করে পুরোনো গ্র্যান্ডফাদার ঘড়িতে সাড়ে বারোটার ঘন্টা বাজতেই একটু তটস্থ হয়ে উঠলেন প্রফেসর। বেশ রাত হয়ে গেছে, এতক্ষণ খেয়ালই করেননি তিনি।


আসলে কয়েকদিন ধরেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। কেউ তাঁকে বার বার ফোন করে পঁচিশ বছরের পুরোনো একটা স্মৃতি উস্কে দিতে চাইছে, যা তিনি সারাটা জীবন ধরে ভুলে থাকার অদম্য প্রয়াস করে গেছেন। কিন্তু একদিনের জন্যও বিস্মৃত হতে পারেননি। আজ এতগুলো বছর পর কেউ হঠাৎ করে কেন তাঁকে জোর করে স্মৃতির সরণি বেয়ে সেই বিশেষ ঘটনার মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাইছে, কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না প্রফেসর নন্দীর।

হাতের ম্যাগাজিনটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন টেবিলের কোণে। নাঃ এভাবে হয় না। এর একটা বিহিত দরকার। এরপর তো তিনি উন্মাদ হয়ে যাবেন। কী চাইছে লোকটা ? কেন এভাবে অতীতের কবর খুঁড়ছে সে?

বাইরের দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকতে থাকতেই একটা ঘটনা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

একটা বাড়ি। ছোট একচিলতে ঘরে দুটো প্রাণী। হঠাৎ দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগলো ঘরটা। আর সেই সাথে আর্ত চিৎকার। জ্বলন্ত দেহ নিয়ে একজন ঝলসে যাচ্ছে। আর তিনি স্বার্থপরের মতো পালিয়ে এলেন।

উফঃ কী বীভৎস ! মাথাটা দপ করে ধরে গেল আবার। গত পঁচিশ বছরে এত হাজার বার চেষ্টা করেও ভুলতে পারেন নি এসব দৃশ্য গুলো। কিন্তু আজ কে সেগুলো আবার নতুন করে মনে করাতে উদ্যত হলো ?

এসব ভাবতে ভাবতে তন্ময় হয়ে পড়েছিলেন বলেই বোধহয় খেয়াল করতে পারেননি যে ঘরে একজন দ্বিতীয় ব্যক্তি প্রবেশ করেছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রফেসর নন্দী টের পেলেন পেছন থেকে একটা বলিষ্ঠ হাত তাঁর গলায় পেঁচিয়ে ধরলো এবং অন্য হাতে তাঁর নিজের হাতদুটোকে পেছন দিক থেকে মুচড়ে তাঁকে পুরোদস্তুর কব্জা করে ফেলেছে। মুহূর্তের ধস্তাধস্তি এবং সেই সাথে একটা ধপ করে শব্দ। মেঝেতে পড়ে গেলেন তিনি। পাকা শিকারীর সাথে এক নিরীহ ইতিহাসের প্রফেসর কী করেই বা পারবেন!

চোখের নিমেষে তাঁকে কাবু করলো আগন্তুক। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটি কোমর থেকে একটা পিস্তল বার করে তাক করলো তাঁর দিকে।

-" ফলকটা কোথায় ? ওটা আমার চাই প্রফেসর", একটা হিমশীতল কন্ঠে প্ৰশ্নটা ধেয়ে এলো প্রফেসর নন্দীর দিকে।

-" আ..আমি জানিনা বিশ্বাস করো। কে তুমি ?", ভয়ার্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর।
-" প্রশ্ন নয়, উত্তর চাইছি। কোথায় সেটা ?"
-" আমি সত্যি জানিনা। কী বলছ এসব ?"

আগন্তুকের মুখ দেখা যাচ্ছে না। আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা। বাগিয়ে থাকা পিস্তলের নলে একটা সাইলেন্সর লাগানো রয়েছে।

আগন্তুক আরো সন্নিকটে এসে দাড়ালো। আবার জিজ্ঞেস করলো, " ফলকটা কোথায় প্রফেসর ? ওটা না নিয়ে আমি যাবো না যে।"

ভয়ে, বিস্ময়ে রীতিমত ঘেমে উঠেছেন প্রফেসর নন্দী। কাতর গলায় বললেন, " আমার কথা বিশ্বাস করো, আমি জানিনা"।

ঠিক তখনই খুট করে একটা শব্দ হতেই প্রফেসর বুঝলেন সেফটি ক্যাচ খোলা হলো পিস্তলের। আর তার ট্রিগারে একটা কালো দস্তানা পরা হাতের তর্জনী নিশপিশ করছে মরণ ছোবল দেবার জন্য।

২.

ব্যারাকপুরের এদিকটা রাত হয়ে গেলে বড্ড বেশি জনশূন্য হয়ে পড়ে। রাত ন'টার পর লোকজন খুব বেশি বেরোয় না। সেখানে এখন প্রায় রাত দুটো বাজছে। গোটা পাড়া ঘুমিয়ে রয়েছে। নিস্তব্ধ, থমথমে পরিবেশে একটি মোটরবাইক এসে দাঁড়ালো রাস্তার ধারের দ্বিতল বাড়িটার সামনে। বাতিস্তম্ভের আলোগুলোর কয়েকটা জ্বলছে নিভছে। এই এক সমস্যা। কিছুতেই ওগুলো ঠিক থাকে না। আগন্তুকের এসব দৃশ্য বড়ই চেনা। কারণ তাকে হামেশাই এমন রাত করে বাড়ি ফিরতে হয়। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক, কুকুরের কান্না আর অন্ধকারের এই বোবা রূপের অনেকদিনের সাক্ষী সে।

গাড়িটা জায়গামতো দাঁড় করিয়ে, নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায় আগন্তুক। এ বাড়িতে একাই থাকে সে। একাকীত্ব তার কম দিনের সঙ্গী নয়। অগ্নিকুন্ডে ঘৃতাহুতি দিয়ে যে নিধনযজ্ঞ শুরু করেছে সে, কেই বা তাকে একাজে সাথ দেবে! নিজের মনের সাথে যুঝতে থাকা ভালো মানুষটাকে কবেই তো গলা টিপে হত্যা করেছে নিজহাতে। আর যে কোনো বিকল্প নেই। তাতে অবশ্য কোনো অনুশোচনা নেই তার। সে হলো ধর্মযুদ্ধের সৈনিক। শোক করা, দুঃখ প্রকাশ করা, এসব তার মানায় না।

ঘরে এসে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থাকলো সে। তারপর মোবাইলটা নিয়ে একটা নম্বর ডায়াল করলো। ওপাশে ফোনটা রিসিভ করতেই আগন্তুক নিজের পরিচয় দিলো, " ম্যয় বৃষকেতু বোল রাহা হু। কাজ হয়ে গেছে, কিন্তু জিনিসটা এখনো পাইনি।"

----

মিনিটখানেক কথাবার্তা যা হলো সব হিন্দিতেই হলো। কথা শেষ করে বৃষকেতু একটা ছবির সামনে দাঁড়ালো। ছবিতে আদিনাথ শঙ্কর নটরাজ ভঙ্গীতে উদ্যত। তাতে ফুল দিয়ে একটা ধুপ জ্বালিয়ে দেয়। পাশেই লাল শালুতে মোড়া বেশ কয়েকটা বই।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, চাণক্য নীতি, কাশীরাম দাসের মহাভারত ছাড়াও রয়েছে নানা ধর্মীয় গ্রন্থ।

ভক্তিভরে সেগুলোকে প্রণাম করে সে। তারপর সোফায় বসে গা টা এলিয়ে দেয়।

ঘরে টিমটিম করে একটা নাইটল্যাম্প জ্বলছে মাত্র। সেই আবছায়া আলো আঁধারীর মধ্যেই হাল্কা সুরে তার অতি প্রিয় গানটা বাজছে-

"... কুছ এইসে ভি পল হোতে হে

জব রাত কে গ্যাহরে সন্নাটে

গ্যাহিরি সি নিন্দ মে শোতে হে .... "

৩.


সকাল সকাল রাতুলের ঘুমটা কিছুতেই যেন ভাঙতে চায় না। রাত অব্দি কাজ করা আর সকালে দেরি করে ওঠা ওর বরাবরের অভ্যাস। সেই কলেজে পড়ার সময়, হোস্টেলে থাকতে এমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো। সেই থেকে ওর এই নিশাচরসম স্বভাব।

কিন্তু আজ এরকম ঘুমটা ভেঙে গেলো কেন ? কোথাও কেউ কোনো কথা বলছে কি ? উঁহু কথা নয়, গান হচ্ছে তো-

" বাঁশরি বাজাতে চাহি, বাঁশরি বাজিল কই।
বিহরিছে সমীরণ, কুহরিছে পিকগণ,
মথুরার উপবন কুসুমে সাজিল ওই "

আরে এটাতো ওর ফোনের রিংটোন। মোবাইলটা বাজছে। ঘুম চোখে এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পারলো রাতুল। এত সকালে কার আবার কী দরকার পড়লো ?

অনেক কষ্টে আধবোজা চোখে ধড়মড় করে উঠে বসে ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে শ্রীময়ীর গলা পেলো- " নিশ্চই বেলা অব্দি মোষের মত পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস।"

-" বাবাঃ এদ্দিন পর, কী মনে করে ? আর করলি তো করলি একেবারে এই ভোরবেলায়", কাঁচা ঘুমটা ভেঙে যাওয়ায় মেজাজটা একটু খিঁচড়ে গিয়েছিলো রাতুলের।

-" ভোরবেলা মানে ?, সাড়ে আটটা হতে চললো। এটা তোর ভোরবেলা ? আর এতদিনের আবার কী আছে শুনি ?"

-" হুম। না কিছুই না। তা আমি ঘুমোচ্ছি তাতে তোর এত সমস্যা কিসের হ্যাঁ ? নিশ্চই কোনো দরকার পড়েছে?"

-" ব্যাপারটা সিরিয়াস। একবার আসতে পারবি ?"

-" আসবো মানে... কোথায় ? কী বলছিস বলতো ? তুই আছিস কোথায় এখন ?"

-" ফোনে এত কথা বলা যাবে না। একটা মার্ডার কেস। তোর একটু হেল্পের দরকার। দেরি করিস না। চটপট তৈরি হয়ে বেরো।"

-" ওয়েট ওয়েট। পুলিশের হঠাৎ আমায় দরকার পড়লো কেন খামোকা?"

-" রাতুল এটা ইমার্জেন্সি। তোকে ফোনে এত কিছু বোঝাতে পারবো না। তুই চলে আয় এখুনি।"

-" হ্যাঁ, মানে... কিন্তু... আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কেসটা কী ? আর যাবোই বা কোথায় ? "
-" এড্রেসটা তুই চিনিস। পানিহাটি তে। ভিকটিম তোর আমার সকলেরই পরিচিত।"
-" হোয়াট! কে মার্ডার হয়েছে?"
-" প্রফেসর জনার্দন নন্দী।"

৪.


সকালের খবরের কাগজটা ব্যালকনি থেকে তুলে নিয়ে সবেমাত্র সোফায় বসেছে আই. পি. এস অফিসার শ্রীময়ী ব্যানার্জি। প্রথম পাতাটা উল্টানোর আগেই ফোনটা কেঁপে উঠলো শব্দহীনভাবে।

ফোনে রিংটোন রাখা একেবারেই পছন্দের নয় ওর। সারাদিন হাজারো মিটিং, ব্যস্ততা এসবের মধ্যে ফোনটা এতবার সাইলেন্ট মোডে রাখতে হয় যে আজকাল রিংটোন রাখাই ছেড়ে দিয়েছে শ্রীময়ী।

স্ক্রিনে চোখ রাখতেই শ্রীময়ী বুঝলো কমিশনার সাহেব ফোন করছেন।

একটু শশব্যস্ত হয়েই ফোনটা ধরলো শ্রীময়ী-" গুড।মর্নিং স্যার।"

-" মর্নিং। বাট নট গুড এট অল। শুনুন, আপনি ইমিডিয়েটলি একবার পানিহাটিতে প্রফেসর জনার্দন নন্দীর বাড়ি যান। মার্ডার কেস। যেহেতু এটা একটা হাই প্রোফাইল মামলা, মিডিয়াও ইনভলভড হয়ে যাবে। তার আগে একটা প্রিলি দরকার। আপনাকেই যেতে হবে", এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে গেলেন বিমলেন্দু বর্মন, কলকাতা পুলিশের সদ্য ভারপ্রাপ্ত কমিশনার।

টেবিলের ওপর রাখা চা টা এখনো মুখে দিতে পারেনি শ্রীময়ী। জনার্দন নন্দী, পানিহাটি এই শব্দগুলোই শ্রীময়ীকে চমকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলো শুধু, " স্যার কে মার্ডার হলো?"

-" প্রফেসর নন্দী নিজেই খুন হয়েছেন। তোমার ওখানে যাওয়াটা জরুরী, তুমি বেরোও, আমি ফলো আপ করছি পরে", বলেই ফোনটা ছেড়ে দিলেন মিঃ বর্মন।

ধড়াস করে উঠলো শ্রীময়ীর বুকটা। মানে !!!!!!

প্রফেসর জনার্দন নন্দী। সেই বিখ্যাত মানুষটা আজ আর নেই!

যদিও শ্রীময়ী ইতিহাসের ছাত্রী ছিলো না, কিন্তু প্রফেসর নন্দী ইউনিভার্সিটিতে সবার কাছেই সমান জনপ্রিয় ছিলেন। ওনাকে প্রায় সর্ববিষয়ে বিশারদ বলা যেতে পারে। থুড়ি বলা যেতো। কি তাড়াতাড়ি সবকিছু অতীত হয়ে যায়! ওনার মুখের অমলিন হাসিটার কথাই আজ বার বার মনে পড়ছে শ্রীময়ীর।

দেখা হলে নিশ্চয় চিনতে পারতেন আজও। ওনার মত স্মৃতিশক্তি আর কজনেরই বা হয়। একবার কাউকে দেখলে, সহজে ভুলতেন না। গাড়িতে যেতে যেতে এসব পুরোনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো শ্রীময়ীর।

কলেজ বা ইউনিভার্সিটি তে পড়ার দিনগুলোর কথা কি কেউ ভুলতে পারে। প্রচন্ড হাওয়া যেমন এক টুকরো কাগজকে উড়িয়ে দেয়, এইসব সোনালী দিনগুলোও কেমন হুশ করে চলে যায়। এখানেই শ্রীময়ীর সাথে রাতুলের প্রথম দেখা। তখনো প্রেম বস্তুটা ওদের অভিধানে প্রবেশ করেনি।

প্রথম দিকে রাতুলের সাথে তেমন একটা বন্ধুত্ব ছিলো না। পরে অবশ্য ওদের নিয়ে কানাঘুষো বেশ ভালোই হতো। কিন্তু ওই যে কথায় আছে না, ভাগ্য যেদিকে নিয়ে যায়, মানুষ সেদিকেই যায়। কীভাবে যে দুজনের রাস্তাটা হঠাৎই আলাদা হয়ে গেলো টেরই পেলো না কেউ। রাতুলকে পেয়ে বসলো উচ্চশিক্ষার নেশা আর শ্রীময়ী বনে গেল আই.পি.এস অফিসার। কিন্তু তখন কেই বা ভেবেছিল যে তার এত বছর পর আবার তাদের মুখোমুখি দাঁড় করাবে তাদেরই প্রিয়তম অধ্যাপক শ্রী জনার্দন নন্দী, তাও জীবদ্দশায় নয়, মরণোত্তর।

"পাঞ্চজন্য", ১০/৮, আর ব্যানার্জি রোড, পানিহাটি, কলকাতা- ৭০০১১০। নামটা প্রফেসর নন্দীই দিয়েছিলেন। পাঞ্চজন্য হলো শ্রীকৃষ্ণের শঙ্খর নাম। মহাভারত নিয়ে একটু বেশিই অনুরাগী ছিলেন বলেই বোধহয় বাড়ির এমন নামকরণ।

পানিহাটি শহরের গঙ্গার ধারে পেল্লায় বাড়িখানায় ঢুকতেই শ্রীময়ী বুঝলো এখনো খবরটা বিশেষ জানাজানি হয়নি। নইলে লোকে লোকারণ্য হয়ে যেতো। ভালোই হলো মিডিয়ার লোকজন আসার আগেই একটু শান্তিতে কাজ করে নেওয়া যাবে।

৫.

প্রফেসর নন্দীর স্টাডি রুমে ঢুকেই থমকে দাঁড়ালো শ্রীময়ী। ইস! সৌম্য মুখখানার কি পরিণতিই না হয়েছে। ইউনিভার্সিটিতে ওনার মত হ্যান্ডসাম চেহারা আর ঠিক কতজন প্রফেসরের ছিল মনে করতে পারে না শ্রীময়ী। সেই মানুষটাই আজ তার চোখের সামনে প্রাণহীন দেহে শুয়ে রয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে গুলি করা হয়েছে। একটা গুলি বুকের বামদিকে কাঁধের কাছ থেকে তিন ইঞ্চি নীচে আর অন্যটা তলপেটের সামান্য ওপরে লেগেছে। রক্তের একটা ধারা ওনার শরীর থেকে প্রায় ছ'ফুট দূরে চৌকাঠ অব্দি গড়িয়ে এসেছে।

কিছুক্ষণ আগেই ফটোগ্রাফার আর ফরেনসিক এক্সপার্ট এসে নিজেদের কাজ শুরু করে দিয়েছে। শ্রীময়ী এসে আগে গোটা স্টাডিরুমটা একবার ভালো করে নিরীক্ষণ করলো। তেমন কোনো ধস্তাধস্তির চিহ্ন নেই। শুধু ওনার স্টাডি টেবিলের জিনিসগুলো বেশ ছড়ানো রয়েছে। অতর্কিতে আক্রমন হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। টেবিলে ছড়িয়ে থাকা জিনিসপত্র বলছে, সম্ভবত উনি কাজ করছিলেন, এমন সময় কেউ পেছন থেকে এসে.......।

এবার একটা খটকা লাগলো শ্রীময়ীর।

আততায়ী যদি পেছন থেকে এসে থাকে তবে গুলি সামনে থেকে করলো কী করে ? তার মানে প্রফেসর ঘুরে দাঁড়িয়ে একটু হলেও বাধা দিতে গিয়েছিলেন। তারপর টেবিলের ওপরই সামান্য ধস্তাধস্তি হয় এবং আততায়ী সেই মুহূর্তেই গুলি করে। পর পর চিত্র গুলো মনে করে একটু নিজের মত ভাবার চেষ্টা করলো শ্রীময়ী।

-" কটা নাগাদ উনি মারা গেছেন বলে আপনার মনে হয় ?" , ফরেনসিক এক্সপার্ট মিঃ দাসকে প্রশ্নটা করলো শ্রীময়ী। ভদ্রলোকের সাথে এর আগেও দু একটা কেসে দেখা হয়েছে। বেশ কর্মপটু লোক। বললেন , " পোস্টমর্টেম করলে স্পেসিফিক সময়টা বলা যাবে। তবে যা মনে হচ্ছে মৃত্যু হয়েছে কাল রাত নটা থেকে দুটোর মধ্যে।"

-" আর ইউ শিওর ডক্টর ?", জিজ্ঞেস করলো শ্রীময়ী।

-" হান্ড্রেড পার্সেন্ট। রাইগর মরটিস সেট ইন করে মারা যাবার দু ঘন্টা থেকে ছয় ঘন্টার মধ্যেই। চোখের পাতা থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে গোটা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। মোটামুটি বারো ঘন্টার মধ্যে সেটা সর্বোচ্চ হয়। এক্ষেত্রে বডির যা কন্ডিশন তাতে এখনো পীক পয়েন্টে পৌঁছয় নি। সেই অনুযায়ীই আমি টাইমিংটা বললাম।"

-" ওহ আই সী। আর মৃত্যুর কারণ বুলেট ছাড়া অন্য কিছু পেলেন ?"

-" না গুলিটাই মুখ্য কারণ। তাই থেকেই প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। অন্য কোনো শারীরিক আঘাত তো দেখছি না।"

-" ওকে ডক, ক্যারি অন", বলে শ্রীময়ী ইতস্তত পায়চারি করতে লাগলো। কি এমন কারণ থাকতে পারে যে এরকম নৃশংস ভাবে প্রফেসরকে হত্যা করা হলো ?

ঠিক তখনই ডেস্কে রাখা ওনার নোটবুকটা ভালো করে লক্ষ্য করলো শ্রীময়ী। ওটাতে কিছু একটা লেখা রয়েছে। সম্ভবত কালি পেন ব্যবহার করা হয়েছে। দেবনাগরী হরফে লেখা একটা সংস্কৃত শ্লোক মনে হচ্ছে-

" स्वधर्ममपि चावेक्ष्य न विकम्पितुमर्हसि |
धर्म्याद्धि युद्धाच्छ्रेयोऽन्यत्क्षत्रियस्य न विद्यते ।। "


৬.


শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা বলে মনে হচ্ছে।!!!! যদিও এর সম্পূর্ণ অর্থ জানা নেই।

নিজের ডাইরিতে বাংলায় শ্লোকটা লিখলো শ্রীময়ী-

" স্বধর্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি।
ধর্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়োহন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে ।। "

এই শ্লোকের সাথে খুনের কী সম্পর্ক ! নাকি কোন সম্পর্কই নেই ? শ্রীময়ীর ভুরুটা সাংঘাতিক ভাবে কুঁচকে আছে। কে লিখেছে সেটা জানা দরকার। আপাত ভাবে মনে হচ্ছে খুনী প্রফেসর নন্দীকে হত্যা করে নিজেই এটা লিখে রেখে গেছে। কিন্তু এমনটা করার উদ্দেশ্য কী ?

একটা সাধারণ খুনের সাথে এই ঘটনাটা কোথাও যেন খাপ খেতে চাইছে না। এর একটা স্বতন্ত্র ধরণ রয়েছে। মনে হচ্ছে সব কিছুই চোখের সামনে রয়েছে, অথচ ধরতে পারছে না শ্রীময়ী। তার ওপর আবার শ্লোক টোক মিশে ইতিহাস পুরাণ সব একাকার হয়ে গেছে।

ইতিহাস কোনো কালেই শ্রীময়ীর প্রিয় বিষয় ছিলো না। মনে হচ্ছে একজন এক্সপার্টের সাহায্য লাগবে। হঠাৎ ওর একজনের কথা মনে পড়লো যে তাকে এ ব্যাপার সহায়তা করতে পারে।

রাতুল।

অনেকদিন সেভাবে কথাবার্তা হয় না, কিন্তু একবার ফোন করলে যে আসবে না এমনটা মোটেও নয়। রাতুল যে শুধু এই ব্যাপারে অভিজ্ঞ তা নয়, নির্ভরযোগ্যও বটে, যেটা এই মুহূর্তে সবথেকে বেশি প্রয়োজন। কাজেই পুরোনো বন্ধুত্বের খাতিরে তাকে একবার বলে দেখা যেতেই পারে।

রাতুলের নাম্বারে ফোন করতে না করতেই সাব ইন্সপেক্টর অনির্বাণ একটা ছেলেকে সাথে নিয়ে এসে উপস্থিত হলো। বলল, " ম্যাডাম ইনি হলেন প্রফেসর নন্দীর সেক্রেটারি। ইনিই প্রথম বডি দেখতে পেয়ে থানায় ফোন করে সবটা জানিয়েছিলো। "

শ্রীময়ী ইশারায় ওকে পাশের ঘরে নিয়ে যেতে বলে বার দুয়েক ফোনে চেষ্টা করলো রাতুলকে। তিনবারের বার ধরতে পারলো শেষমেশ- " কীরে বেলা অব্দি মোষের মত পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস...." বলতে বলতে করিডরের দিকে এগিয়ে গেলো শ্রীময়ী।


ক্রমশ...



Ayan Das



 

Comments (2)

Loading... Logging you in...
  • Logged in as
Darun hoche...but abar august a next porbo??suspense golpe eto time bhalo lage na....
1 reply · active 247 weeks ago
Suspense ta barche :D

Post a new comment

Comments by