একটি ভূতের গল্প-অধিরাজ বিশ্বাস

 একটি ভূতের গল্প

 অধিরাজ বিশ্বাস



    বন্ধুর বাড়ি থেকে স্টেশনে এসে সম্রাট জানতে পারলো ট্রেন আসতে তখনো অনেকটা দেরী আছে। অগত্যা কোথাও বসে সময় কাটানো ছাড়া আর অন্যকোনো পথ নেই তার কাছে। স্টেশনে ভিড় বেশি না থাকলেও, বসার বেঞ্চগুলো প্রায় সব ভর্তি, শুধু দূরের ওই বেঞ্চটি ছাড়া। যদিও সেই বেঞ্চের এক কোনায় এক ভদ্রলোক বসে আছেন, হাতে একটা খাতা ও পেন নিয়ে। ভদ্রলোকটি পেন দিয়ে খস খস করে খাতায় কিছু লিখছেন, আবার কিছুক্ষণ পরে সেই পৃষ্ঠাটা ছিঁড়ে, দলা পাকিয়ে ফেলে দিচ্ছেন তার পায়ের কাছে। অন্যকোথাও বসার জায়গা নেই দেখে, অগত্যা সম্রাট গিয়ে ওই দূরের বেঞ্চটার একপাশে বসলো। বেঞ্চে বসার পরেও সে অনেকক্ষণ থেকেই লক্ষ্য করলো, ভদ্রলোকটির আচরণে কোনো পরিবর্তন নেই। ব্যাপারটি বুঝতে না পেরে সম্রাট ওই ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
--- দাদা আপনার কি কোনো সমস্যা হয়েছে? আমি কি কিছু সাহায্য করতে পারি?

ভদ্রলোকটি একবার সম্রাটের দিকে তাকালেন, তারপর আবার হতাশ ভাবে বললেন,
--- সাহায্য করবে? তুমি জানো আমার সমস্যাটা?

--- না, সেটা ঠিক জানি না, তবে যদি আপনি বলেন তাহলে চেষ্টা করতে পারি।

--- বেশ! তাহলে শোনো, আমি গল্পের প্লট খুঁজে পাচ্ছি না।

--- ওহ! আচ্ছা, আপনি তাহলে একজন লেখক। তা কি ধরনের গল্প লেখেন আপনি? 

--- ভূতের।

--- আরে ভূতের গল্প লেখা তো খুব সহজ, যে কেউ লিখতে পারে।

--- তাই নাকি? যে কেউ লিখতে পারে? তা অবশ্য ঠিক বলেছো, এখন যাকেই দেখি, সে গল্প লেখে। তা তুমি আমাকে একটা গল্পের প্লট দাও দেখি।

--- কোনো পুতুল নিয়ে লিখুন। যেমন ধরুন, একটি পরিবার একটা পুতুল কিনে আনবে তাদের মেয়ের জন্য, কিন্তু সেটা আনার পর তাদের বাড়িতে একটার পর একটা অঘটন ঘটবে। পুতুলটাকে যতই দূরে ফেলে দেবে কিন্তু পুতুলটি আবার বাড়ি ফিরে আসবে। শেষে এক তান্ত্রিক তাদেরকে বাঁচাবে। ব্যাস সিম্পল গল্প।

    ভদ্রলোকটি এতক্ষণ মাথা নিচু করে গল্পটা শুনছিলেন। গল্প শেষের পর সম্রাটের দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- গল্পটা ভালো, কিন্তু চলবে না। এটা লিখলেই বলবে অমুক লেখকের গল্প থেকে চুরি করা, বা তমুক লেখক এমনই একটা গল্প লিখেছেন। তারথেকে অন্যরকম কিছু বলো।

--- অন্যরকম তাইতো? একটু ভেবে নেই। হুমম....
হ্যাঁ, প্ল্যানচেট নিয়ে লিখতে পারেন, যেমন কয়েকজন বন্ধু মিলে প্ল্যানচেটে বসবে তাদের এক বন্ধুর বাড়ি, কিন্তু প্ল্যানচেটে ওরা ভূতের দেখা পাবে না। শেষে ওদের ভিতর একজন বাড়ি ফেরার আগে বাথরুমে গিয়ে দেখবে, ওরা যেই বন্ধুর বাড়ি প্ল্যানচেট করতে বসেছিলো, সে ওদের আসার আগেই বাথরুমে মরে পরে আছে। 

--- সব একরকম বুঝলে, সব একরকম। চলবে না এটাও।

--- আরে মশাই ভূতের গল্প একরকমতো হবেই। নতুন লিখতে গেলে একটু তন্ত্র বিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা করুন, তবে নতুন প্লট মাথায় আসবে।

--- আমি কিন্তু একটা গল্প ভেবেছি, কিন্তু শেষ করতে পারছি না। শেষটা যে কিভাবে লিখবো? উফ্! আমি শেষ বুঝলে তো, আমার দ্বারা আর কিছু হবে না।

--- আহা, এইসব ভাবছেন কেনো? আচ্ছা আপনি যেটা ভেবেছেন সেটা আমাকে বলুন, দেখি সাহায্য করতে পারি কিনা।

--- ঠিক আছে, তাহলে শোনো, দেখো শেষটা মাথায় আসে কিনা!

কথাটা বলে গল্প শুরু করলেন ভদ্রলোক। আর সম্রাটও বাধ্য ছেলের মত, পাশে বসে শুনতে লাগলো গল্পটা।

--- আচ্ছা আমার গল্পটির মূল চরিত্রের নাম সঞ্জয়। ছোটবেলা থেকেই টুকটাক লেখালেখির অভ্যাস ছিল সঞ্জয়ের, কিন্তু সংসারের টানাপোড়েনে সেই ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করতে পারিনি সে। কলেজের পড়াশুনা শেষ করেই সঞ্জয় একটা বেসরকারি অফিসে ঢুকে পরলো কাজের জন্য। সেই অফিসের এক লোকের থেকেই জানলো ফেসবুকের কথা। তারপর সেই ফেসবুক ঘাঁটতে ঘাঁটতেই জানতে পারলো, সেখানে নতুন কোনো মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করার পাশাপাশি, অনেক সাহিত্য চর্চার গ্রুপেও যোগদান করা যায়। অনেকেই সেই গ্রুপে তাদের নিজস্ব লেখা দেন। সেই লেখকদের লেখা পরে পাঠকরা যা উৎসাহ দেন, তা দেখে সঞ্জয়ের মনেও লোভের সঞ্চার হলো। লোভটা হলো বড় মাপের লেখক হয়ে ওঠার লোভ। গ্রুপগুলোতে অন্যরা যে লেখা পোস্ট করতো, তা সে রোজই পড়তো, আর মনে মনে ভাবতো এর থেকে তার লেখা অনেক গুন ভালো, অনেক তথ্য থাকে সেই সব লেখাতে। আবার এটাও ভাবতো যে, এদের লেখা যদি এত সমাদর পায় সবার কাছে, তাহলে তাকে তো এরা মাথায় করে রাখবে। সঞ্জয়ের ছোট থেকেই স্বপ্ন ছিলো বড় লেখক হবে, গাড়ি কিনবে, বাড়ি করবে, আশেপাশে সুন্দরীরা অটোগ্রাফের জন্য ঘোরাঘুরি করবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। সংসারের জন্য সেই ইচ্ছাগুলোকে বিসর্জন দিয়েছিলো সে, কিন্তু সেই সব গ্রুপগুলোতে যোগদানের পর তার মনের সেই সুপ্ত ইচ্ছাগুলো আবার জেগে উঠতে শুরু করলো।

    অবসর সময়ে ফেসবুকের গ্রুপগুলোতে টুকটাক লেখালেখি করতে শুরু করলো সঞ্জয়। প্রথম প্রথম দু-একজন পাঠক সেই লেখা পড়ে তাকে উৎসাহ দিতেন, কিন্তু তাতে সঞ্জয়ের মন ভরতো না। সে চাইতো হাজারো হাজারো লাইক, আর লক্ষ লক্ষ ফ্যান। এরপর আস্তে আস্তে যত দিন অতিবাহিত হলো, সঞ্জয় লক্ষ্য করলো  গ্রুপগুলোতে তার গল্পের পাঠক সংখ্যা বাড়ছে, আর সেই সাথেই বাড়ছে ফ্যান ফলোয়ার্স। এরপর থেকে পাঠকরা সরাসরি সঞ্জয়কে মেসেজ করা শুরু করে দিলো। আন্দাজ করতে পারছো তখন সঞ্জয়ের মনের অবস্থা কেমন ছিলো? পারবে না, আমি বা তুমি কেউই সেই সময়ে সঞ্জয়ের মনের অবস্থা কল্পনাও করতে পারবো না। কথায় বলে না, "উপরওয়ালা যবভি দেতা হ্যায়, ছপ্পর ফারকে দেতা হ্যায়", সঞ্জয়ের ক্ষেত্রেও তাই হলো। পাঠকদের পাশাপাশি এবার আসা শুরু হলো গ্রুপগুলোর অ্যাডমিন ও বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার ফোন। সবার একটাই কথা "লেখা চাই"। সঞ্জয়ও তাদের নিরাশ করলো না। নির্দিষ্ট সময়ে তাদের লেখা পাঠানো শুরু করে দিলো। আর এরপরই একে একে ভূতের গল্পের বইতে তার লেখা প্রকাশ পেতে থাকলো। 

    আস্তে আস্তে এলাকার লোকজন ও অফিসের লোকজনদের কাছে সে যেন হিরো হয়ে উঠলো। তবে এখানে বলে রাখা ভালো, সঞ্জয় শুধু ভূতের গল্পই লিখতো, তাই এলাকার লোকজন তাকে সামনাসামনি কিছু না বললেও, পেছনে "ভূতের লেখক" বলেই ডাকতো। যদিও তাতে সঞ্জয়ের কিছু এসে যেতো না। সে তখন ছুটছে এক মায়াবী হাতছানির পেছনে। নিজের অজান্তেই কখন যে সঞ্জয় একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে, তা সে নিজেও বুঝতে পারেনি। ক্রমশঃ তার মধ্যে বাড়তে থাকলো লোভ ও অহংকার।

    সেই বছর বইমেলাতে নিজস্ব দুটি বই ছাড়াও আরো পাঁচটি গল্পের বইতে তার লেখা প্রকাশ পাওয়ার পর, সেই অহংকার বোধ যেনো আরোই বেড়ে গেলো। আগে গ্রামের যে সব লোককে সে সম্মান দিয়ে চলতো, এখন তাদের মুখে মুখে তর্ক করতে পিছুপা হতো না সে। বাড়ির লোকরাও তার সেই বাজে ব্যবহার থেকে রেহাই পেত না। এরপর একরকম প্রায় জেদ করেই নিজের চাকরিটাও ছেড়ে দিলো সে। 

    চাকরি ছেড়ে দিলেও বেশ চলছিলো সঞ্জয়ের জীবনটা। একটার পর একটা বই প্রকাশ, নতুন নতুন মহিলাদের সাথে সম্পর্ক সবই চলছিলো চুটিয়ে। কিন্তু অঘটনটা ঘটলো কয়েকবছর পর। আচমকাই এক মহিলা প্রকাশক দাবি করে বসলেন, সঞ্জয় তার শ্লীলতাহানি করার চেষ্টা করেছে। এরপরই গোটা ফেসবুক জুড়ে  তোলপাড় শুরু হয়। অনেকেই ফেসবুকে সঞ্জয়ের কাছে জানতে চায় ঘটনাটার ব্যাপারে, কিন্তু সঞ্জয় তাদের উল্টে কদর্য ভাষায় আক্রমণ করে। সঞ্জয়ের এইরকম আচরণে পাঠকরাও তার বিরুদ্ধে চলে যেতে শুরু করে। যারা এতদিন তাকে নিয়ে নাচানাচি করতো, এখন তারাই সঞ্জয়কে নিয়ে নানা কথা তুলতে শুরু করে দিলো। একে একে কমতে থাকলো পাঠকের সংখ্যা, কিন্তু তখনও সঞ্জয়ের সেই বিষয়ে কোনো মাথা ব্যথা ছিলো না, সে ভাবছিলো তার কলমের জোর আছে, এই সব সে ঠিক কাটিয়ে উঠবেই। কথায় বলে অহংকার পতনের কারণ, আর ঠিক সেটাই হলো। যতদিন গেলো সঞ্জয় ততই ঝামেলায় জড়িয়ে পরলো, আর সেই সাথেই ভোঁতা হতে থাকলো তার কলম। আসলে ঐসব ঘটনায় তার মনটা এতটাই চঞ্চল হয়ে গেছিলো যে, আর নতুন লেখাতে মন বসাতে পারছিলো না সঞ্জয়। কিন্তু ঐদিকে প্রকাশকরা তাকে লেখার জন্য ক্রমাগত চাপ দেওয়া শুরু করেছে, তাই সে কোনরকমে কিছু গল্প লিখে জমা দেওয়া শুরু করলো। কিন্তু সেইসব গল্পগুলো ছিল একদম সাধারণ মাপের, তাই অনেক জায়গা থেকেই লেখা বাতিল হতে শুরু করলো। দু-একজন লেখা ছাপলেও, সেই বই তেমন বিক্রি হলো না। যারাও বা কিনলো, তারা সবাই বলতে শুরু করলো, অন্যের গল্প থেকে চুরি করে লেখা। গোটা ফেসবুক আগেই ভরে উঠেছিলো তার কেচ্ছাতে, এখন আগুনে ঘি ঢালার মত তাতে যোগ হলো এই গল্প চুরির বিষয়টি। 

    এরপর সে অনেক চেষ্টা করলো নতুন ভাবে শুরু করার, কিন্তু পারলো না। আস্তে আস্তে লেখালিখির জগৎ থেকে হারিয়ে যেতে থাকলো সে। নতুন গল্প লিখলেও প্রকাশকরা কেউ কেউ তখন বলতে শুরু করলো, "নতুন বোতলে পুরনো মদ ঢেলে ক’দিন আর সাহিত্য নেশায় ডুবিয়ে রাখা যায় পাঠকদের, অর্থাৎ বিষয়বস্তুগুলো একরকমের, একই গতে বাঁধা লেখা মানুষ আর নিতে পারবে না"। আবার কেউ বললো, "চোরের গল্পকে আমরা কোনো বইতে স্থান দেইনা"। আর কি, আস্তে আস্তে সঞ্জয় মানসিক অবসাদে ভোগা শুরু করলো। ঐদিকে চাকরিও ছেড়ে দেওয়ায় তার সম্পূর্ণ রোজগার বন্ধ। বই বিক্রির যে কটা টাকা পাওনা ছিলো, প্রকাশকরা আর দিলো না। পরিচিতদের হাতে পায়ে পড়ে ধার-দেনা করা শুরু করলো সে। ধার-দেনা করতে করতে এমন অবস্থা হলো যে, তাকে পালিয়ে বেড়াতে হতো পাওনাদারদের থেকে। ব্যাস এরপর একদিন এই স্টেশনে এসে ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

পাশে বসে থাকা সম্রাটের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসলো, "সুইসাইড?"

--- হ্যাঁ, আর কি বা করতো বেচারা?

--- তারপর?

--- তারপর কি? সব ফাঁকা। আর কিছু নেই, আর কিছু ভাবতে পারছি না।

কথাটা বলেই ভদ্রলোকটি আবারো তার হাতে ধরে রাখা খাতার থেকে একটা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে, দলা পাকিয়ে নিচে ফেলে দিলেন।

--- কিন্তু স্যার, এতে ভূতের ঘটনা কোথায়? প্লটটা খুব ভালো, কিন্তু এরপর ভৌতিক কিছু বা অলৌকিক কিছু যোগ করুন, দুর্দান্ত হবে। আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে, বলবো?

--- বলুন, শুনি আপনার আইডিয়া।

--- হ্যাঁ, এরপর লিখবেন সেই সঞ্জয়ের ভূত প্রকাশকদের ভূতের ভয় দেখাবে।

--- না, না, না, এটাও চেনা প্লট, এটা হবে না। এই জিনিসটাই সঞ্জয়ের সাথে ঘটেছিলো। যা লিখছিলো সবই চেনা প্লট, তাই একটু অন্যরকম কিছু চাই।

--- আচ্ছা, তাহলে এমনটা লিখুন ওই সঞ্জয়ের ভূত অন্যকারোর উপর ভর করবে, আর তাকে দিয়ে একটার পর একটা গল্প লিখিয়ে নেবে।

--- হুমম! এটা একটু শুনতে অন্যরকম লাগছে, একটু বিস্তারিত ভাবে বলুন শুনি।

--- হ্যাঁ বলছি, দাঁড়ান তার আগে একটু পান কিনে আনি ওই দোকানটা থেকে। আমার আবার পান ছাড়া বেশিক্ষণ চলে না। আপনি খাবেন?

--- নিয়ে আসুন, মিষ্টি পান।

    সম্রাট বেঞ্চ থেকে উঠে গেলো হাত পাঁচেক দূরের পানের দোকানটার দিকে। দোকানে গিয়ে জানতে পারলো মিষ্টি পান ফুরিয়ে গেছে, শুধুই ঝাল পাতা পান রয়েছে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছিলো না সম্রাট। দোকানদার বললো, 
--- দাদা দোকানটা এবার বন্ধ করবো, আপনি বরং ঝাল পাতা নিয়ে নিন। 

--- দাদা আমার নিজের হলে তো অসুবিধাই ছিলো না। আসলে ঐ মিষ্টি পাতা পান অন্য একজনের জন্য। ওই দেখুন বেঞ্চে যিনি বসে আছেন, তার জন্য।

--- কেনো দাদা আমার সাথে মজা করছেন? বললাম আমি দোকান বন্ধ করবো, তাও আপনি মজা করছেন।

লোকটির কথা শুনে একটু রেগে গেলো সম্রাট। সে একটুও মজা করেনি তাও লোকটি তার উপর এইরকম অভিযোগ আনছে। সম্রাট এবার গলার সুর একটু চড়িয়ে বললো,
--- আপনার চোখে ওই লোকটি পরছে না? ওই যার পায়ের নিচে অনেক দলা পাকানো কাগজ পরে আছে। ঐ লেখক লোকটিকে আপনি দেখতে পাচ্ছেন না? এবারতো আমার মনে হচ্ছে আপনি আমার সাথে মজা করছেন।

--- কি বললেন আপনি? লেখক? রাম.. রাম.. রাম..

--- আপনি রামকে ডাকছেন কেনো? তাড়াতাড়ি করুন, ট্রেনের ঘোষণা হয়ে গেছে, এই মালগাড়িটার পেছনেই আসছে আমার ট্রেন।

--- বাবু ওটা সাধারণ মানুষ না, ওটা ভূত। সঞ্জয় তালুকদারের ভূত। আগের বছর এই প্যাটফর্ম থেকেই চলন্ত মালগাড়ির সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। আসলে ওনার লেখা আর কেউ প্রকাশ করতে চাইতো না, প্রকাশকরা বাকি টাকাও দেয়নি শুনেছি, তাই মানসিক অবসাদে ওই কাজ করেন। সুইসাইড করার আগে প্রায় প্রতিদিন ওই বেঞ্চে এসে বসতেন, আমার দোকান থেকে ওই মিষ্টি পান খেতেন, আর সারাক্ষণ বিড়বিড় করে বলতেন "সব শেষ, সব শেষ"।

    দোকানদারের কথা শুনতে শুনতেই সম্রাটের সারা শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেলো। সেই সময়ে পেছন ঘুরে দেখার সাহসটুকুও তার ছিলো না। মালগাড়ির শব্দে তখন গোটা প্ল্যাটফর্ম গমগম করছে, ভয়ে ভয়ে একবার পেছন ফিরলো সম্রাট, দেখতে পেলো ভদ্রলোকটি আর বেঞ্চে বসা নেই, বরং দাঁড়িয়ে আছে প্ল্যাটফর্মের কিনারাতে। মালগাড়িটি তখন প্রায় তার কাছাকাছি চলে এসেছে, ঠিক সেই সময়েই মালগাড়িটার সামনে ঝাঁপিয়ে পড়লো ভদ্রলোকটি। সম্রাট সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে নিলো। তবুও সম্রাটের সারা শরীর তখন ভয়ে থরথর করে কাঁপছে, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না সেখানে, দোকানের বেঞ্চটা ধরে বসে পড়লো সেখানে। 

    সেইরাতে সম্রাট যে কিভাবে বাড়ি ফিরেছিলো, সেটা শুধু সে জানে। সম্রাটের খালি মনে হচ্ছিলো, হয়তো দোকানদার মিথ্যা বলেছে, লাইনের দিকে তাকালেই হয়তো সে দেখবে ওই লোকের ছিন্নভিন্ন দেহটা লাইনের উপর পড়ে আছে। তাকাবো না, তাকাবো না করেও, ট্রেনে ওঠার আগে একবার লাইনের দিকে তাকিয়েছিলো সম্রাট, কিন্তু লাইনের উপর কোনো দেহ সে দেখতে পায়নি। তারমানে ওই দোকানদার যা বলেছে সব সত্যি। বাড়ি ফিরে সম্রাট কাউকেই কিছু বলেনি ওই ঘটনার ব্যাপারে, শুধু বলেছিলো শরীর খারাপ, তাই রাতে কিছু খাবে না। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেও প্রায় সারা রাত ঘরের আলো জ্বালিয়ে জেগে কাটিয়েছে সে। কিছুতেই নিজের মনকে শান্ত করতে পারছিলো না সম্রাট, নিজের চোখে দেখা ঘটনা মিথ্যা হবে কি করে? এই প্রশ্নই তার মাথায় ঘুরছিলো। তাই ফেসবুক খুলে "সঞ্জয় তালুকদার" নামে সার্চ দিতেই সে সঞ্জয় তালুকদারের প্রোফাইলের ছবি দেখতে পেলো, হুবহু এক দেখতে। প্রোফাইলটা একটু ঘাঁটতেই সম্রাট দেখতে পেলো, অনেক গল্প সেখানে আপলোড করা আছে। সম্রাট আর দেরী করলো না, একটা একটা করে গল্প পড়া শুরু করে দিলো।

    এদিকে সারা রাত জেগে সঞ্জয় তালুকদারের লেখা গল্প পড়লেও, ভোরের দিকে একটু চোখ লেগে এসেছিলো সম্রাটের। একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠে ফেসবুকটা খুলেছিলো সে। বেশ অনেকগুলো নোটিফিকেশন এসেছে, তার মধ্যে একটি নোটিফিকেশনে লেখা, "Your post in ঋত্বিক(Ritwik) was approved by an admin". বেশ অবাক হলো সম্রাট, এমন নোটিফিকেশন তো আসার কথা না, তাহলে এটা কেনো আসলো? কথাটা চিন্তা করতে করতেই সেই নোটিফিকেশনে ক্লিক করলো সম্রাট। চোখের সামনে একটি পোস্ট ভেসে উঠলো। সেই পোস্টটা দেখে সম্রাটের গোটা শরীর জুড়ে যেনো একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে গেলো। হৃৎপিণ্ডের গতিবেগ আগের থেকে দ্বিগুণ বেড়ে গেলো, আর হাত কাঁপতে শুরু করে দিলো। 

    পোস্টটি আর কিছুই না, একটি সাহিত্য গ্রুপে পোস্ট করা একটি ভৌতিক গল্প। গল্পটির নাম ও বিষয়বস্তু শুরু হওয়ার আগে লেখা, "নতুনভাবে পথ চলা শুরু করলাম, সঞ্জয় তালুকদারের অনুপ্রেরণায়"। আর তার নিচে লেখা গল্পের নাম, 
"ভৌতিক লেখক", কলমে- সম্রাট(সঞ্জয়) ঘোষ। 

               সমাপ্ত
 Adhiraj Biswas