ধারাবাহিক - পান্তা দিদার গুপ্তধন - কেয়া চ্যাটার্জী

ধারাবাহিক

পান্তা দিদার গুপ্তধন
কেয়া চ্যাটার্জী
 

|| দ্বিতীয় পর্ব  ||

                           
   

     সকলে মিলে চেপে ধরলাম। “বলো দাদু বলো। এতটা পথ কি গল্প না করে কাটানো যায়?” দাদু চোখ বুজে কিছুক্ষন তর্জনী দিয়ে কপালের মাঝখানে টোকা দিয়ে আবার আমাদের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন।

“একটু গুছিয়ে নিলাম বুঝলি তো। এত বড় জীবনের এত গুলো ঘটনা বলতে তো সময় লাগে। তা বিশ বছর আগে যখন সেই ডায়েরি খানা পেলাম তখন তো মনের মধ্যে যতো সুপ্ত ইচ্ছার আগ্নেয়গিরি তার লাভা নির্গমন করে আমায় ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। সেই রাতেই ধুত্তোরি তোর সংসার বলে বেরিয়ে পড়লাম। বাড়ি থেকে মিনিট দশেক হাঁটলেই মোড়ের মাথায় পৌঁছে যাওয়া যায়। তারপর আলপথ ধরে কিছুটা এগোলেই ট্রেন লাইন। সেই লাইন ধরে নাক বরাবর পূব মুখো হাঁটলেই স্টেশন। ঠিক করলাম স্টেশনে গিয়ে যেখানকার ট্রেন পাবো, জয় মা কালি বলে উঠে পরব। সেই মতো তো এগোচ্ছি। কিন্তু পথ আর ফুরোয় না। যাচ্ছি তো, যাচ্ছি তো, যাচ্ছি। প্রায় ঘন্টা খানেক বয়ে গেল। পূর্ণিমার চাঁদ মাথার ওপর ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসছে। চির পরিচিত গাছপালা গুলো কেমন যেন অচেনা ঠেকছে। ঠিক যেন কালো কাপড় মুড়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। এবার আমি আবিষ্কার করলাম যে আমি একই পথে বার ছয়েক ঘুরছি। এই আমগাছটা, পুকুরটা, মাটির দালানটা নয় নয় করে বড় পাঁচেক দেখলাম। বুকটা দুরদুর করতে শুরু করল। গাঁয়ে গঞ্জে ভূতের উপদ্রবের কথা কারুর অজানা নয়। আমি তেনাদের বিশেষ একটা পাত্তা দিতাম না কখনোই। কিন্তু তখন ওই অবস্থায় পরে বারবার তেনাদের কথা মনে হতে লাগল। মনে মনে ইষ্টনাম জপতে জপতে পেরোচ্ছি এমন সময় কোত্থেকে ঝুপ করে একটা কালো লোক আমার রাস্তা আটকে দাঁড়াল। আমি থমকালাম। অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। হাতের টর্চটাও ঠিক এই সময়ই বিগড়েছে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “ক-কে?” অমনি জলদ গম্ভীর সুরে উত্তর এল, “আত্মা। অশরীরি। তোরা যাকে বলিস ভূত, প্রেত। হুঁহ যতো সব জঞ্জাল।” শেষ কথাটা শুনেই আমার পিলে চমকে উঠল। এ যে জগন্নাথ স্যারের কথা। হ্যাঁ গলাটাও তাঁরই মনে হচ্ছে। তবু মনে জোর এনে আরেকবার জিজ্ঞাসা করলাম, “কার আত্মা? ভূতের আওয়াজ তো এত গম্ভীর হয় না।” উল্টো দিক থেকে উত্তর এলো, “কতবার তোদের পড়িয়েছি ভূত বলে কিছু হয় না। তাও তোরা ভুলে গেলি? আমার চল্লিশটা বছর বৃথাই গেল। জঞ্জাল যতসব।” আমার তো গলা শুকিয়ে কাঠ। জগন্নাথ স্যার পাঁচবছর আগে মারা গেছেন। আমি এখন তাঁর আত্মার সামনে দাঁড়িয়েই তার সাথে গল্প জুড়েছি! এদিকে ভূত বলছে ভূত বলে কিছু হয়না। এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে পড়েছি আবার সেই কণ্ঠস্বরে সম্বিৎ ফিরল। “তা তোর সাথে আমার কিছু দরকার ছিল।” আমার আবার পিলে চমকালো। একে অঙ্কের স্যার তায় আবার ভূত থুড়ি আত্মা। তার আমাকে প্রয়োজন। ঘাড় নেড়ে বললাম, “বলুন স্যার।” তিনি বললেন, “আমার ভিটেটা তো চিনিস। এই গ্রামের সীমান্তের ধূধূ পেরিয়ে পরের ধূধূ। সেখানে তোকে গিয়ে একখানা জিনিস হান্ডওভার করতে হবে।”

― কিন্তু স্যার আমি যে বিবাগী হওয়ার প্ল্যান নিয়ে বেড়িয়েছি।
― এহ, মাছ-মাংস ছাড়া ভাত চলে না সে আবার বিবাগী হবে বলে বেরিয়েছে। জঞ্জাল , জঞ্জাল। জঞ্জাল ভরে গেল দেশটা। 

তারপর উনি কি যেন ভেবে বললেন, “যাহ যাহ তোকে আর আমার কাজ করতে হবে না। আমি অন্য কাউকে ধরছি।” আমি তড়িঘড়ি বলে ফেললাম, “আহা! স্যার এভাবে রাগ করছেন কেন? বলুন না স্যার বলুন কি কাজ?”

স্যার মানে স্যারের ভূত কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। বললেন, “ঠিক বলছিস? পারবি তো? ফাঁকি দিলে কিন্তু মাঝ রাস্তায় এক পায়ে দাঁড় করিয়ে একশটা অঙ্ক করাবো।” আমি ঘাড় নাড়লাম, “পারবো, স্যার ঠিক পারবো। বলুন না।” মনে মনে বললাম, ঘাড় মটকাবে বলেনি এই আমার বাপের ভাগ্য।  অন্তত অঙ্ক করে বেঁচে তো থাকতে পারবো।

ভদ্রলোক তার ছায়া ছায়া হাত আকাশের দিকে তুলে ধরলেন। অমনি কোত্থেকে একটা চিঠি এলো উড়ে। চিঠিটা উনি আমার হাতে দিলেন। বললেন, “পঞ্চভূতে বিলীন হওয়া শরীর তো আর অফিসিয়াল কাজ করতে পারে না। এই চিঠিটা নিয়ে একবার তোমায় কলকাতা যেতে হবে। সেখানে ইউনিভার্সিটির অফিসে এই চিঠিটি দেখালে ওরা আমার নামে একটা সার্টিফিকেট আর পাঁচশত টাকা দেবে। জিনিসগুলো আমার বাড়িতে তোমায় পৌঁছে দিতে হবে।"
সন্দিগ্ধ হয়ে বললাম, “কিসের চিঠি স্যার? আসলে অফিসে গিয়েও তো বলতে হবে কি কাজে এসেছি।”

স্যার বললেন, “কয়েক বছর আগে অঙ্কের একটা শাখা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলাম। সেই নিয়ে তো নাওয়া খাওয়া মাথায় উঠল। সংসারে শান্তি নেই। ঘনঘন কলকাতা যাচ্ছি, আসছি। চারিদিকে তাড়া তাড়া বই ছড়ানো। তোদের জেঠিমা চিৎকার করে পাড়া মাথায় তুলতেন। তাও লেগেছিলাম সেটা নিয়ে। এ স্কোয়ার, এক্স স্কোয়ার, কিউব, টু দি পাওয়ার টুয়েন্টি। সংখ্যা নিয়ে এদিক ওদিক। ওপরে সংখ্যা, নীচে সংখ্যা, বাঁদিক, ডানদিক, চোখের সাথে মাটির ষাট ডিগ্রি এঙ্গেলে সংখ্যা, খাবার থালায় সংখ্যা, পায়খানার মগে সংখ্যা। চারিদিকে শুধু সংখ্যা আর সংখ্যা। এমনকি গৃহিণীর মুখেও ঘুরে বেড়াচ্ছে সংখ্যা আর সংখ্যা।" স্যার থামলেন। ভূত বলে কি মানুষ না। দম নেওয়ার প্রয়োজন আছে তো নাকি। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, “তারপর, বুঝলি তো, একদিন গবেষণা শেষ হলো। কিন্তু ততদিনে শরীর অশক্ত হয়ে পড়েছে। তাই আর কলকাতায় গিয়ে গবেষণাপত্রটি দিয়ে আসতে পারলাম না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানায় পোস্ট করে দিলাম। সে পোস্ট গেল তো গেল। তার না পেলাম প্রাপ্তি স্বীকার। না পেলাম কোনো স্বীকৃতি। মাঝখান থেকে অপেক্ষা করতে করতে পট করে পটল তুললাম। তা সেই থেকে এই আমগাছের মগডালে জায়গা করে নিলাম। ওই যে বলে না, আকাঙ্ক্ষা থেকে গেলে আত্মা মুক্তি পায়না। আমার গবেষণাপত্রের খবর না পাওয়া ইস্তক মনে শান্তি পাচ্ছিলাম না। সেই জন্য সারাদিন বাড়ীর উঠোনের নিমগাছে কাক হয়ে বসে থাকতাম। তা আমার গিন্নী আমায় থাকতে দিলে তো। যেই না দেখত একটা দাঁড়কাক ওর সাধের নিমগাছে বসে অমনি মুড়ো ঝাঁটা নিয়ে লাফাতে শুরু করতো। একে তো তার ওই দশাসই চেহারা, তার উপর কাকের থেকেও কর্কশ গলা নিয়ে এই সারা পাড়া মাথায় তুলে কাক তাড়াতে শুরু করল সকাল সকাল। ভূতেরও তো সহ্যের সীমা থাকে তাই না? তাই কাক থেকে মাছিতে পরিণত হলাম। মাছি হওয়ার পর একটু শান্তি পেলাম। নির্দ্বিধায় বসে থাকতাম বাড়ীর চালে। চিঠি আসবে আসবে করে এই কদিন আগে এল। বিশু পোস্টম্যান ঘন্টি বাজিয়ে দিয়ে গেল। তা আমার গৃহিণী সেটি দেখলেন। দেখলেন তার পটলপ্রাপ্ত স্বামীর নাম জ্বলজ্বল করছে বাদামি রঙের খামের ওপর। তাও সেটি ফেলে দিলেন জঞ্জালের স্তূপে। মটকা গেল গরম হয়ে। এত অচ্ছেদা! বেঁচে থাকলে কতো গবেষণা করতে পারতাম, কতো নাম ডাক হতো। তখন তুমিই গর্ব করে ঘুরে বেড়াতে নাকি? এখন চিঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দিল! দেখল না পর্যন্ত কি লেখা আছে! আবার আমি কাক হয়ে  উড়ে এসে বসলাম চিঠির ওপর। হ্যাঁ, বিশ্ব বিদ্যালয়ের স্ট্যাম্প মারা এ তো সেই চিঠি। ঠোঁটে তুলে নিয়ে এলাম এই আমগাছে। তারপর স্বমহিমায় ফিরে খাম খুলে পড়ে দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয় আমার গবেষণাপত্রকে স্বীকৃতি দিয়ে, একটা শংসাপত্র পাবলিশ করেছে আর পুরস্কার স্বরূপ আমার জন্য পাঁচশ টাকা রেখেছে। আর আমার গবেষণাটি ওদের সিলেবাসে নিয়েছে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলাম। এদিকে গিন্নির ওপর রাগও হলো চরম। এমন গুরুত্বপূর্ণ কাগজ নাকি জঞ্জালে বালতিতে ফেলে দিল! বদলা নিতে আবার কাক হয়ে বসলাম নিমগাছের ডালে। যেই না উনি কাক তাড়াতে এলেন অমনি মাথায় দুটো ঠুকরে দিয়ে হলাম পগার পার। কিন্তু এই চিঠি নিয়ে কেইই বা যাবে কলকাতা, কেইই বা সেই কাগজ নিয়ে আসবে। এতদিন ধরে অতৃপ্তি নিয়ে লটকে ছিলাম এই আমগাছে” 

এবার আমতা আমতা করে বললাম, “ কিন্তু স্যার একটা প্রশ্ন আছে, এই কাজটা আমাকেই করতে বলছেন কেন? আরো কতো তো লোক আছে গ্রামে।”

স্যার এবার দ্বিগুণ উত্তেজনা নিয়ে লাফিয়ে উঠলেন, “সেটাই তো রে হরি। আমি তো খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম একটা মাধ্যম। যার সাথে আমি যোগাযোগ করতে পারি। কিন্তু কাউকেই পাচ্ছিলাম না। কেউ আমার কথা শুনতে পায়না।  খগেন বাড়ুই ভূত সমাজের মাথা। সে একদিন আমায় ডেকে বলল, বুঝলে জগাদা এমন করে হবে না। যে মানুষ তোমার কথা শুনতে পাবে, সেই মানুষই তোমার কাজ করে দিতে পারবে। তুমি এক কাজ করো এই আমগাছে বসে আসতে যেতে সব মানুষকেই হাঁক দাও। যে তোমার ডাকে সাড়া দেবে তাকেই খপ করে ধরবে। তা একদিন দেখলাম তুই এই গাছের তলা দিয়ে যাচ্ছিস। সবার মতো তোকেও হাঁক দিলাম, “এই হরে” বলে। ভেবেছিলাম হয়তো শুনতে পাবি না। কিন্তু আমায় চমকে দিয়ে, তুই চারিদিকে তাকাতে শুরু করলো। আমি নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবারও ডাকলাম। তুই আবার পিছু ফিরলি। আমি এবার নিশ্চিত হলাম তুইই সেই মানুষ যে আমার কাজ করতে পারবি।” 

স্যার থামলেন। আমি ঢোঁক গিলে চিঠিটা পকেটে চালান করলাম। কি করতে বেরিয়েছিলাম, আর কি কাজে ঢুকে পড়লাম। অসুবিধা নেই  এডভেঞ্চারটা কলকাতা থেকেই শুরু হোক। ভূতের ব্যাপার। কাজ না করলে যদি শপথ ভুলে  ঘাড় মোটকে দেয়। অকালে প্রাণটা যাবে। তারপর মাস্টার-ছাত্র এই আমগাছের ডালে পা দুলিয়ে দুলিয়ে অঙ্ক করবে। স্যার যেমন করে এসেছিলেন ঠিক তেমন করেই ভ্যানিস হয়ে গেলেন। আমি কয়েক পা এগোতেই দেখি স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে। স্টেশন মাস্টারকে জিজ্ঞেস করে বুঝলাম আর কিছুক্ষণের মধ্যেই কলকাতার ট্রেন আসবে। বসে পড়লাম স্টেশনের সিঁড়িতে। যথাসময়ে ট্রেন এল। আমি টিকিট কেটে উঠে পড়লাম। মনে একটা খচখচানি রয়ে গেল। বেরোলাম আর ফিরবো না বলে। এদিকে স্যারের কাগজটা দিতে তো ফিরতেই হবে পাশের গ্রামে। দেখা যাক কি হয়। যা থাকে কপালে।

পরেরদিন সকাল সকাল চলে এলাম কলকাতা। সেই আমার প্রথম কলকাতা দর্শন বুঝলি তো। ওহ সে কি অভিজ্ঞতা। ঘুরে ঘুরে একটা ভদ্রস্থ ঘর পেলাম না। যা পেলাম তা টাকায় কুলায় না। অগত্যা আবার স্টেশনে এসে একটা খালি বেঞ্চি দেখে শুয়ে পড়লাম। ও বাবা! সেই বেঞ্চ নিয়েও সে শহরে কতো মারামারি তোরা তো জানিস না। সন্ধ্যে হতে একটা সিরিঙ্গে মতো লোক, খালি গায়ে, হাফপ্যান্ট পরে, আমায় ঠেলে তুলে দিয়ে বলল, “এই এটা আমার বেঞ্চি। তুই কে রে ব্যাটা এসে জুটেছিস?” আমি হাঁ হয়ে গেলাম। সরকারের তৈরি রেল স্টেশন। সেখানকার বেঞ্চ নাকি একজনের সম্পত্তি! তার পাশে দেখলাম আরো কজন এসে জুটেছে। তারাও সিরিঙ্গে লোকটাকে সমর্থন করে আমায় উঠে যেতে বলছে। আমি যারপরনাই অবাক ও হতবাক হয়ে উঠে গেলাম। স্টেশনের বাইরে সিঁড়িতে বসে রইলাম সারারাত।বসে এক রাত কাটিয়েছিলাম বুঝলি প্যাংলা। সেদিন বুঝেছিলাম এই হলো গিয়ে এডভেঞ্চার।

  সকাল হতেই চা-টা খেয়ে রওনা  দিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। স্টেশন থেকে কিছুটা পথ হেঁটেই মেরে দিলাম। বাস ভাড়া তো বাঁচবে। তাই অনেক। অফিসে গিয়ে চিঠিটা দিলাম। লোকটি চশমার ফাঁক দিয়ে আমায় আপাদমস্তক দেখে নিয়ে হাই তুলে বললেন, “ক্যান্ডিডেট কৈ? তাকে তো আসতে হবে।” আমি ততোধিক বড় হাই তুলে বললাম, “স্যার ক্যান্ডিডেট আসতে পারবেন না।”
― কেন শুনি?
― উনি পাঁচ বছর আগে পটল তুলেছেন। আপনাদের বিচারসভা রায় দিতে এত দেরী করল যে..”
― আপনি ক্যান্ডিডেটের কে?
― ছাত্র। ওঁর স্ত্রী আমায় দায়িত্ব দিয়েছেন।

লোকটি বিশ্বাস করলেন কি না কে জানে। একটা কাগজ আর ফাইল ঘেরা দরজা ঠেলে ঢুকে গেলেন। তারপর একটা বাঁধানো প্রমান সাইজের ফ্রেম এনে আমার হাতে দিলেন। বললেন, “এটা সবার সামনে ফুলের স্তবক সহ দেওয়ার কথা ছিল। উনি ছাত্রদের উদ্দেশ্যেও কিছু বলতে পারতেন। তা বাঁশ যখন নেই আর বাঁশি বাজবে  কি করে।” একটা কাগজে সই করে বেরিয়ে এলাম জিনিসটা নিয়ে। কাঁচ ও কাঠের সুন্দর ফ্রেমে বাঁধানো শংসাপত্র। স্যারের নাম সুন্দর হাতের লেখায় লেখা।  স্যারের জন্য খুব খারাপ লাগছিল। প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও সারাজীবন গ্রামের ইস্কুলে পড়ালেন। লোকে বলতো জগন্নাথ মাস্টার সংখ্যা দিয়ে কথা বলে। যে স্বপ্নের পিছনে ধাওয়া করলেন আজীবন সেই স্বপ্ন ধরা দিলেও তা ধরতে পারলেন না। হায় রে, জীবন! কাকে যে তুমি কখন পুষ্পবৃষ্টি দেবে তা তুমিই জানো। শংসাপত্র আর টাকা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে তো এলাম এবার অন্য খেয়াল মাথায় চাপল মাথায়। এ জিনিস তো পার্সেল করতে হবে। অতো টাকা তো ট্যাকে নেই। তাহলে আবার যেতে হবে গ্রামে? এতক্ষনে তো বাড়িতে নিশ্চই সবাই খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে  গ্রাম শুদ্ধ লোক জেনে গেছে আমি নিরুদ্দেশ। এদিকে পাশের গ্রামেই যদি ডাংডাং করতে করতে যাই, তাহলেই তো ধরা পড়ে যাবো। উফ, কি বিপদ! পরিবারের জন্য সব ব্যবস্থা করে এসেছি। খাওয়া পড়ার অভাব হবে না জীবনে। ছেলে সাবালক হলে চাকরিটাও পেয়ে যাবে। আর তো ফিরে যাওয়া যায়না। ভাবতে ভাবতে আবার হাঁটতে শুরু করলাম স্টেশনের দিকে। চিন্তা দিয়েছেন যিনি সেই চিন্তামণিই উপায় বলবেন। এইভাবে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ পেরিয়েছি হঠাৎ কাঁধে কেউ যেন হাত রাখল। ফিরে দেখলাম বিশু। আমার ইস্কুলের বন্ধু। এখন কলকাতায় বড় অফিসার। আমায় দেখে একগাল হেসে বলল, “কিরে হরে তুই এখানে?”

মনে পড়ল বিশু সরকারি চাকরি পেয়ে বেশ কিছুদিন আগে কলকাতায় চলে এসেছিল। কিন্তু আমি ওকে গোটা ঘটনাটা বলতে পারলাম না। ভূতের গল্প কেউ বিশ্বাস করবে না। উল্টে হাসাহাসি করে মাথাটাই দেবে গরম করে। হাসি মুখে স্যারের শংসাপত্র দেখিয়ে বললাম, “জগন্নাথ স্যারের এই জিনিসটা নিতে এসেছি।” বিশু অবাক হয়ে বলল, “জগন্নাথ স্যারের জিনিস? কিন্তু স্যার তো অনেকদিন হলো মারা গেছেন।” আমি মাথা নাড়লাম, “আরে সে কি আর জানিনা। এ অন্য ব্যাপার।” তারপর বিশুকে চিঠির ব্যাপারটা বললাম। তবে গল্পটা অন্যরকম ছিল। স্যারের বদলে চিঠিটা দিয়ে গেলেন স্যারের স্ত্রী। ওসব কাক, মাছি, মুড়ো ঝাঁটা সব বড়পত্রিকার সম্পাদকের মতো কেটে উড়িয়ে দিলাম। তারপর বললাম, “কিন্তু একটা বিপদে পড়েছি ভাই।”

― বিপদ? কি বিপদ রে?
― আমায় এখুনি এক জায়গায় যেতে হবে। ইমার্জেন্সি। না গেলেই নয়। এদিকে এই জিনিসটা বয়ে নিয়েও বেড়াতে পারছি না। যেখানে যাবো সেখান থেকে ফিরতে অনেক দিন লেগে যাবে। কি করি বলতো?
বিশু স্মিত হেসে বলল, “আগে চল আমার অফিস দেখে আসবি।” ঝাঁ চকচকে বলবো না তবে বিশুর অফিসটা যে বিল্ডিংয়ে সেই পুরোনো ব্রিটিশ আমলের বাড়িটা আমার খুব পছন্দ হয়ে গেল। বিশু আমায় ওর টেবিল ঘুরিয়ে নিয়ে এলো ক্যান্টিনে। চায়ের সাথে বেশ কিছু টা এর বন্দোবস্ত করে আমার কাছ থেকে জগন্নাথ স্যারের ঠিকানা লিখে নিল একটা কাগজে। তারপর একজন পিওনকে  টাকা পয়সা আর ঠিকানা দিয়ে সেদিনই জিনিসটা পোস্ট মারফত পাঠানোর নির্দেশ দিল। আমার কাঁধ থেকে এই বিশাল বোঝাটা যে এত সহজে নেমে যাবে তা ভাবতেই পারিনি। জগন্নাথ স্যার কি আমার ওপর নজর রাখছেন? তিনি কি এসব দেখলেন? দেখে আশা করি ক্ষেপে যাননি। নাহলে এখুনি তাঁর কথা মতো একপায়ে দাঁড় করিয়ে অঙ্ক কষতে দিতেন। বিশুর সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্প হলো। গ্রামের হল হকিকত জানলো। আমি কলকাতার রাস্তাঘাট, ট্রেন, অলিগলি বুঝে নিলাম। তারপর ওকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়ে ঝাড়াহাতপা হয়ে বেরিয়ে পড়লাম নিরুদ্দেশের উদ্দ্যেশে।”
পাগলা দাদু এবার থামলেন। চারিদিকে নিস্তব্ধতা। শুধু ট্রাক্টরের একটানা ঘরঘর আওয়াজ।

“কিন্তু দাদু তোমার সেই বিশেষ ক্ষমতাটা তুমি কি করে পেলে সেটা তো বললে না?” বলল প্যাঙলাদা।
― কোন বিশেষ ক্ষমতা বলতো?



Keya Chatterjee