রক্ত তামসী - অয়ন দাস


রক্ত তামসী
অয়ন দাস
 

 


..১..

 ভারী সুন্দর হয়েছে সরোবর খানা। পশ্চিমদিকের ঘন অরণ্য আর পূবের রাজপ্রাসাদ। এই দুয়ের মধ্যে রয়েছে টলটলে জলে কানায় কানায় ভর্তি এই সরোবর। 

একটা সময় মজে গিয়ে সামান্য এক পুস্করিণীর ন্যায় মুখ লুকোতো প্রাসাদ প্রাঙ্গনের ওপারে। রাজ অট্টালিকার জাঁকজমকের সাথে সেটা বড়োই বেমানান লাগতো।

শেষে মহারাজ অমর সিং একদিন উঠে পড়ে লাগলেন এটির সৌন্দর্যায়ন করতে। ভার পড়লো প্রবীণ মন্ত্রী প্রয়াগনাথের ওপর। প্রথমটায় একটু ইতস্তত করলেও মন্ত্রী মহোদয় যখন বুঝতে পারলেন মহারাজ একটু বেশিই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন তাঁর ওপর, মাথা পেতে দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। হাজার হোক,অমর সিং কে ছোট থেকে দেখে আসছেন তিনি। একপ্রকার অভিভাবকই বলা চলে তাঁকে। তাই সমস্যায় পড়লে বা সর্বশেষ পরামর্শ হিসেবে প্রয়াগনাথ এখনো কাঞ্চনগড়ের প্রধান ভরসা।

প্রয়াগনাথ অবশ্য নিরাশ করেননি। কাজটা যে সফল ভাবে প্রতিপন্ন করেছেন তিনি, বৃদ্ধ প্রয়াগনাথ নিজেও খুব ভালো করে জানেন। তিনি রাজমন্ত্রী। যেকোনো দায়িত্ব তাঁর ওপর নিশ্চিন্তে দিয়ে দেওয়া যায় তা বিলক্ষণ জানেন মহারাজ। এর আগেও এমন বহুকাজ তিনি পোক্ত হস্তে সামলেছেন। এটা তো তুচ্ছ একটা ব্যাপার। আসলে বয়স বেড়েছে বলেই হয়তো আজকাল অল্পতেই অহেতুক চিন্তা করেন। 

সরোবরের চেহারা পাল্টে এখন রীতিমতো এক বিস্ময়কর চিত্রপটের অবতারণা করে যেন। যেটা ছিল নিতান্তই একটা মরে যাওয়া ডোবা, এখন তার অপার নীল জলরাশিতে প্রতিফলিত হয় অস্তগামী সূর্যের লালিমা।

রাজপ্রাসাদের দ্বিতলে ঝুলন্ত বারান্দায় এসে দাঁড়ালে এক অসাধারণ দৃশ্য ফুটে ওঠে। স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো জলরাশি, কত গভীর আর বিরাট তার পরিধি। তার মধ্যে মাছের খেলা, মাছরাঙার ছোঁ মেরে শিকার ধরা দেখে যারপরনাই খুশি হন মহারাজ আর তাঁর আদরের রাজকন্যা রঞ্জাবতী। ওঁদের চিত্ত হয় বিগলিত।

একসময় সেই খুশির খবর পৌঁছয় বৃদ্ধ প্রয়াগনাথের কাছেও। তিনিও পুলকিত হয়ে ওঠেন। এই আনন্দ আর সন্তোষের চেয়ে বড় কোনো পুরস্কার যে হয় না।

সরোবরের ধারে বসে বসে এসব ভাবছিলেন, হঠাৎই শুনতে পেলেন ঘোড়ার খুরের শব্দ। দুজন রাজসৈনিক এগিয়ে আসছেন তাঁরই দিকে। অবাক চোখে তাকালেন প্রয়াগনাথ।

ঘোড়ার পিঠ ঠেকে নেমে এল এক সৈনিক। বলল, "মহারাজ আপনাকে তলব করেছেন মহোদয়।"

বৃদ্ধ মন্ত্রী ভাবলেন নিশ্চয় মহারাজ তাঁর ওপর খুশি হয়েছেন। তাই বোধহয় হাঁক পড়েছে। মৃদু হেসে বললেন,  "আমি ঠিক জানতুম যে মহারাজ আমায় অবশ্যই স্মরণ করবেন। তা কি এক্ষুনি যেতে হবে ?"

-" আজ্ঞে হ্যাঁ মন্ত্রীমশাই, তেমনই আদেশ পেয়েছি", উত্তর দিলো সৈনিক।
-" বেশ তবে চলো", বলে উঠে পড়লেন প্রয়াগনাথ।

প্রয়াগনাথকে নিয়ে যখন দুজন সেপাই দ্রুত অশ্বচালনা করে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে প্রাসাদ অভিমুখে ধাবিত হল, কাঞ্চনগড়ের আকাশে সূর্য অনেকখানি হেলে পড়েছে পশ্চিমাভিমুখে। সরোবরের জলে শেষ বিকেলের পড়ন্ত রোদ রক্ততিলক এঁকে আসন্ন প্রদোষের আবাহন করছে।

..২..

রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেই প্রয়াগনাথ বুঝলেন পরিস্থিতি বেশ থমথমে। মহারাজ অমর সিং একাগ্রচিত্তে বসে কিছু ভাবছেন। দুচোখে তাঁর সাংঘাতিক ভ্রুকুটি। ব্যাপার তো ভালো ঠেকছে না। প্রয়াগনাথ জিজ্ঞেস করলেন,
-" কোন দুঃসংবাদ আছে নাকি মহারাজ ? আপনাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে! "

-" চিন্তার তো কারণ রয়েছে মন্ত্রিমশাই। আজ এই নিয়ে পাঁচ পাঁচটি বাচ্চা হারিয়ে গেল। আর আশ্চর্য ভাবে সবাই ঠিক ওই জঙ্গলের দিক থেকেই উধাও হয়ে যাচ্ছে। এতে দুশ্চিন্তার অন্ত থাকছে না আমার", বেজার মুখ করে কথাগুলো বললেন মহারাজ।

প্রয়াগনাথ শুনে একটু আশ্চর্যান্বিত হলেন। বললেন, 
-" সেকি মহারাজ জল তাহলে এতদূর গড়িয়েছে! কিন্তু তাহলে তো একটা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এখুনি কিছু করা দরকার।"
-" সেই উদ্দেশ্যেই আপনাকে ডাকা। ইতিপূর্বে বহু সংকটকালীন পরিস্থিতিতে আপনার সদবুদ্ধি কাজে লেগেছে। এবারেও কিছু একটা ভাবতেই হবে। এবং লক্ষ্য রাখতে হবে যেন প্রজাগণ অযথা আতঙ্কিত না হয়ে পড়ে", মন্ত্রীমশাইকে পাশে পেয়ে একটু আশাবাদী হয়ে কথাগুলো বললেন মহারাজ।

প্রয়াগনাথ দৃঢ় কন্ঠে জানালেন,
-" আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো মহারাজ।" 

বৃদ্ধ প্রয়াগনাথ এবার গম্ভীর হয়ে ভাবতে লাগলেন। সমস্যা সত্যি গুরুতর। একটা উপায় না করলেই নয়। এমতাবস্থায়  প্রত্যেকে যখন এই আপদকালীন পরিস্থিতিতে কী উপায়ে সমাধান বেরোবে সেই নিয়ে আলোচনায় মশগুল, ঠিক তখনই এক তরুণ রাজপুত্র যিনি এতক্ষন রাজসভার এক স্থানে বসে এই গুরুগম্ভীর কথাবার্তা শুনছিলো। এবার বলে উঠলো,
-" মহারাজ আমায় যদি আজ্ঞা দেন আমি নিজে একবার ওই জঙ্গল তল্লাশি করে দেখতে পারি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওই জঙ্গলের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে সব রহস্যের সমাধান। "

প্রয়াগনাথ এই তরুণের দিকে একবার তাকালেন। 

শাল্বকুমার। 

পড়শি রাজ্য নিবাত পুরের মহারাজ মাধব সিংহের পুত্র এই শাল্বকুমার। কয়েকদিন আগেই রঞ্জাবতীর সাথে এই তরুণ রাজকুমারের বাগদান সম্পন্ন হয়েছে। তার পর বহুদিন এই গৃহেই বসবাস করে আসছে শাল্বকুমার। তার উৎসাহ দেখে রাজামশাই বললেন,
- কিন্তু তুমি যা বলছো তা যে কতটা কঠিন কাজ তা জানো? শ্বাপদ সঙ্কুল ওই অরণ্যে ওভাবে খানাতল্লাশী করা কিন্তু...।"

মহারাজের কথা শেষ হয়না। শাল্বকুমার বলে ওঠে, 
-" আমায় একবার সুযোগ দিন না মহারাজ।"

 অমর সিং খানিক ভাবলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন,
-" না না তুমি একা গিয়ে বিপদে পড়তে পারো। সে কাজ নেই।"

শাল্বকুমার কিন্তু নাছোড়বান্দা। সে বললো,
-" কিন্তু মহারাজ রহস্য তো ওই জঙ্গলেই। এভাবে বসে আলোচনা করার চেয়ে একবার গিয়ে দেখলে হত না। পরে যদি দেরি হয়ে যায়।"

 প্রয়াগনাথ দেখলেন ছেলেটার কোথায় যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। তিনি বললেন,
-" মহারাজ রাজকুমার শাল্ব ঠিক বলেছেন। ওখানে আমাদের সেপাই পাঠাতেই হবে। এবং তা রাত্রে। যাতে কেউ জানতে না পারে। প্রজাদের অজান্তে একাজ সারতে হবে আমাদের। আর তাছাড়া উনি তো একা যাবেন না। আমাদের সৈন্যরা ওঁর সাথেই থাকবে।"

শাল্বকুমার কৃতজ্ঞ চিত্তে বৃদ্ধ মন্ত্রীর দিকে একবার তাকালো। যেন এতদিন কিছু একটা করতে মুখিয়ে ছিল সে। যাতে করে প্রমান দিতে পারে সে এই রাজপরিবারের সুযোগ্য জামাতা। আজ সেই সুযোগ দুয়ারে অপেক্ষমান। তা হাতছাড়া করতে কোনোমতে রাজী নয় রাজকুমার। 

মহারাজ প্রথমে একটু দোটানায় ছিলেন। কিন্তু শাল্বকুমারের দুর্দমনীয় সাহস আর উৎসাহ দেখে মত বদলাতে বাধ্য হলেন। কুমার বলবান, দূরদর্শী- সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। দেখাই যাক না একটা সুযোগ দিয়ে।

আসলে রাজমশাইয়ের মন সায় দিচ্ছিলো না কিছুতেই। হাজার হোক তাঁর একমাত্র কন্যার হবু স্বামী সে। কিন্তু শেষমেশ শাল্বকুমারের কথাই রইলো। মন্ত্রিমশাইয়ের অভয়ে মবারাজ অমর সিং সায় দিয়েই দিলেন।

ঠিক হলো পরদিন সন্ধ্যাকালেই রাজকুমার শাল্ব তার সেনাবাহিনী নিয়ে এই নৈশ অভিযানে ব্রতী হবে। এই অদৃশ্য শত্রু দমন কার্যে সেই অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দেবে। সঙ্গে অবশ্য অভিজ্ঞ সেনাপতিরাও থাকবেন। যে করেই হোক এই বিপদ থেকে রক্ষা করতেই হবে। এমন প্রতিজ্ঞা নিয়ে তবেই সভা ছাড়লো রাজকুমার শাল্ব।

..৩..

রাজপ্রাসাদ থেকে নিজ গৃহে ফেরার পরই প্রয়াগনাথ বুঝলেন পুত্র বলকিনাথ এখনো বাইরে। এই পুত্রটিকে নিয়ে প্রয়াগনাথের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। সে যেন কিছুতেই কোনো নিয়ম কানুন মানতে চায় না। মাঝে মাঝেই এমন দিনকয়েকের জন্য উধাও হয়ে যায়। কোথায় যে থাকে, কী করে তা তিনি পিতা হয়েও বুঝতে পারেন না।

ও জন্মলগ্ন থেকেই মাতৃহারা। তাই ছোট থেকেই যেন বড্ড জেদি, একগুঁয়ে। একবার যেটা ভেবে নেয়, সেটা সে করেই ছাড়ে। একবার তো রাজদ্রোহের কবলে পড়তে পড়তেও বেঁচে গিয়েছিল, সেও তার পিতারই অনুকল্যাণে। কিন্তু তার পরেও বলকিনাথের কোনো পরিবর্তন হয় নি। তাই বৃদ্ধ পিতা একরকম হাল ছেড়ে দিয়েছেন। পুত্রের খবর রাখা তাঁর পক্ষে একপ্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু পিতার এই চিন্তার একফোঁটাও কি পুত্র বলকিনাথের মধ্যে প্রতিফলিত হয় ? বোধহয় না। নইলে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত পিতাকে ছেড়ে শিমুল পাহাড়ের গায়ে জঙ্গলের এই গোপন আস্তানায় এমন ঘোরতর সাধনায় মগ্ন হতে পারতো না।

বেদে বুড়ির কাছে তন্ত্রবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী না হওয়া পর্যন্ত তার শান্তি নেই। কাঞ্চনগড়ের রাজকন্যার কাছে সেই যেদিন অপমানিত হয়েছিল, তার পর থেকেই তাকে হস্তগত করতে উঠে পড়ে লেগেছে সে। সোজা উপায়ে হবে না জেনেই এই বাঁকা উপায়টি বেছে নিয়েছে।

আর নেবে নাই বা কেন ? কী দোষ ছিল তার ? বংশ কৌলিন্যে খাটো নাকি এক মামুলী মন্ত্রীর ছেলে বলে অবজ্ঞা, কোনটা ?

বলকিনাথের মনে হয় ওসব কিছুই না, রাজকুমারীর গুমোরই হল প্রধান কারণ তাকে তাচ্ছিল্য করবার।

অমন অপ্সরাতুল্য রূপ দেখে একদিন আচম্বিতে প্রেম নিবেদন করে বসেছিল সে। রাজকুমারী রঞ্জাবতী তখন সখীদের সাথে শিবমন্দিরে পুজো দিতে এসেছিলো। কোনো এক ফাঁকে কমল দীঘির পারে দাঁড়িয়েছিলো কয়েক মুহূর্ত। তখনই বলকিনাথ সামনে এসে দাঁড়ায়।

বলকিনাথের হঠকারী কথায় হয়তো একটু অসংলগ্নতা লক্ষ্য করেছিলো রাজকুমারী। প্রত্যুত্তরে মন্ত্রীপুত্রকে বলেছিল,
-" আপনার দুঃসাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। আপনি এক সামান্য মন্ত্রী পুত্র। আর আমি এই রাজ্যের রাজকন্যা।"

বলকিনাথ খানিকটা হতবাক হয়ে পড়ে প্রথমে। তার তো অন্য কোনো মতলব ছিলো না। সে প্রকৃত অর্থেই প্রেম নিবেদন করতে চেয়েছিলো। প্রেমের মানদন্ড যে কোনো কালেই জাতিভেদ বা বর্ণভেদে হয়না। 

বিস্মিত হয়ে বলকিনাথ বলে,
-" এ কী বলছেন রাজকুমারী ! প্রণয়ে কি গোত্র বিচার করা চলে ? তাছাড়া আমার তো কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই। আপনাকে আ..আমি যে...!"

রাজকুমারী গর্জে উঠেছিলো, " চুপ করো দুর্বিনীত। একজন বাগদত্তা রাজকন্যার সাথে এমন কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তার জন্য তোমায় আমি কী করতে পারি জানো ?"

-" না না রঞ্জাবতী। আপনি ভুল বুঝছেন। ওই রাজকুমার অপেক্ষা বেশি সুখী রাখবো আপনাকে আমি। এ আমার অঙ্গীকার রইলো।"
-" এতো সাহস ? ওই মুখে আমার নাম নিলে তোমার সর্বনাশ হবে। নীচ, আমি কিনা কাঞ্চনগরের মহারাজ অমর সিংয়ের কন্যা। আর তুমি এসেছ এই দুঃসাহস দেখাতে ! আজই তোমায় রাজদ্রোহের কারণে অভিযুক্ত করবো আমি। সৈন্য গণ বন্দী করো এই শয়তানকে।"
-" না না শোনো এ কাজ...এই এই কী করছো ছাড়ো", সেপাইদের চিৎকারে বলকিনাথের মিনতি চাপা পড়ে যায়। 

এক সামান্য মন্ত্রীর পুত্র কিনা সে রাজ্যের রাজকন্যার দিকে হাত বাড়ায়, তাও যেখানে রাজকন্যা বাগদত্তা। সৈন্যরা কোনোমতেই রেওয়াত করে না বলকিনাথকে।

টেনে হিঁচড়ে সকলের সামনে দিয়ে যখন মন্ত্রীপুত্রকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো, বলকিনাথ হুঙ্কার দিয়ে ওঠে,
-" ভুল করলে রাজকুমারী। এই অন্যায়ের প্রতিশোধ আমি নেবই। কাউকে ছাড়বো না আমি, কাউকে ছাড়বো না।"

..৪..

সেদিন কেউই নূন্যতম দয়া দেখায়নি বলকিনাথের প্রতি। বদলে তার কপালে দুর্বিষহ ঘৃণা আর অপমান জুটেছিলো অনবরত। 

রাগে দুঃখে হতাশায় পাগল হয়ে গিয়েছিল বলকিনাথ। কিছুতেই মানতে পারেনি সে এমন কান্ড হতে পারে তার সাথে। 

যদিও তেমন ক্ষতি তার হয়নি। কারণ তার পিতা প্রয়াগনাথ এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে সাময়িক সমস্যার সমাধান করেছিলেন। কিন্তু রাজাদেশে তাকে শহরের বাইরে স্থান দেওয়া হয়েছিল। সে একপ্রকার নির্বাসনই বটে।

তারপরেও লোকচক্ষুর আড়ালে পিতা প্রয়াগনাথ তাকে নিজগৃহে সকলের অজান্তে মাঝে মাঝে ডেকে নিয়ে আসেন, কিছুদিন রেখে দিয়ে অন্তঃত পিতৃধর্ম পালনের যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। শুধু বলকিনাথ যেন স্থির থাকতে পারে না। সর্বদাই প্রতিশোধ স্পৃহায় জ্বলতে থাকে। তাই নিভৃতে সাধনা করে চলেছে আজ বেশ কয়েক বছর। উদ্দেশ্য তন্ত্রবলে বলীয়ান হয়ে এই রাজ্য, রাজা, রাজকন্যার দ্বারা হওয়া যাবতীয় হেনস্থার বদলা নেওয়া।


বেদে বুড়ি এসে ধমক দেয় বলকিনাথকে,
-" ওইভাবে মন চঞ্চল করে হবে গা ? তোর নাকি সাধন হবে এইভাবে ?         ছো: !!!" 

বলকিনাথ অসহ্য ভাবে উঠে পড়ে। সত্যি তার মন অসম্ভব আনচান করছে। বার বার মনে হচ্ছে কবে তার শরীরের জ্বালা জুড়োবে, কবে তার প্রতিশোধ পূর্ণ হবে। এই সাধনা সফল হলে সে হবে যাবতীয় শক্তির অধীশ্বর। ভুত, প্রেত, ডাকিনী, শাখিনী সব হবে তার করায়ত্ত। কালাজাদুর একচ্ছত্র সম্রাট হবে সে। বনবে মহাযোগী বলকিনাথ। 

তারপর হাকিনী আহ্বানে ডেকে নিয়ে আসবে সেই রাজকন্যাকে। বশীভূত করে রাখবে। প্রথমে রাজা, তারপর গোটা রাজ্য সব একে একে প্রোথিত হবে তার চরণতলে। তখন রাজকন্যা কোন ছাড় ! কুৎসিত লোভে চিকচিক করে ওঠে তার দুচোখ।

 সঙ্গে সঙ্গে চমক ভাঙে বেদে বুড়ির কথায়,
-" বলি কালকের তিথি মনে আছে তো। কালই সেই বিশেষ তিথি। কৃষ্ণ পক্ষের অষ্টমী। তোর সাধনা সম্পূর্ণ হবে কাল।"

বলকিনাথ উদাস ভাবে উত্তর দেয় ,
-" জানি মা"
-" জানিস যখন এমন বিচ্ছিরি মুখ করে আছিস কেন রে হতভাগা?" বুড়ি দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ওঠে।

-" না না মা। ও কিছু না।"
-" শোন বাপু, মনের জোরটাই আসল। এমন চঞ্চল হলে চলবে না কো। বলি সব জোগাড় হয়েছে ?"
-" হ্যাঁ মা, আমার সব উপকরণ সংগ্রহ করা হয়ে গেছে", অস্থির ভাবে পায়চারি করতে করতে বলে উঠল বলকিনাথ। 

এই বেদে বুড়িকে সে মা বলেই ডাকে। তার কাছেই পেয়েছে তন্ত্রের গূঢ় মন্ত্রখানি। আজ সাধনায় শেষ লগ্নে সমস্ত উপকরণ সংগ্রহ করেছে। শুধু বাকি একটাই জিনিস। একটা লাশ। পূর্ণ বয়স্ক একটা মৃতদেহের ওপর করতে হবে শব সাধনা। তবেই পরিপূর্ণ হবে এতদিনের এত অক্লান্ত চেষ্টা।

..৫..

রাতের প্রহর কেটে যাচ্ছে দ্রুত। আরো গভীরতর অমানিশায় এই জঙ্গল ঢেকে যাচ্ছে। বেদে বুড়ির কথা অনুযায়ী আজই সাধনার শেষ চরণটি পূর্ণ করতে হবে। সাধনা একবার সফল হলেই এই পৃথিবীর সর্বোত্তম ক্ষমতাটি অর্জিত হবে। তারপর তার বদলা সম্পূর্ণ হবে। এরপরেই প্রয়োগ করবে একটি  মোক্ষম বাণ। মারণ ক্রিয়ায় রাজামশাই ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের বিনাশ করবে প্রথমে। তারপর যে রাজকন্যা তাকে একদিন তিরস্কার করেছিল, যার জন্য তাকে শহর ছেড়ে এতদূর পালিয়ে আসতে হয়েছে তাকে বশীভূত করে নিজের অভীষ্ট সিদ্ধি করবে সে।

বলকিনাথই হবে এই কাঞ্চনগড়ের পরবর্তী সম্রাট। আর রাজকুমারী রঞ্জাবতী হবে তার পাটরানী। আর যদি নিতান্তই বাধ সাধে বিধি, তবে রঞ্জাবতীকে নিজের পায়ের তলায় দাসী হিসেবে প্রক্ষেপ করবে। যে তার হতে পারেনি সে আর কারো হতে পারে না। কখনো না।

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল বলকিনাথ। লক্ষ্য নিকটেই। কিন্তু এই সর্বশেষ ধাপটাই হলো সবচেয়ে কঠিন। শবসাধনায় এতটুকু ভুল ত্রুটি সাধকের মৃত্যু পরোয়ানা ডেকে আনতে পারে।

 বেদে বুড়ি তাকে অঘোর মার্গে এই সাধনার কথা বলেছে। লাশ কোনো স্ত্রীর হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু এই পাণ্ডব বর্জিত এলাকায় হঠাৎ করে মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া খুব মুশকিল। এদিকে শহরে ঢোকার উপক্রম করলেই রাজপেয়াদার হাতে পড়ার সম্ভবনা বিলক্ষণ রয়েছে। তাহলে উপায় ?

সাতপাঁচ চিন্তা করতে করতেই হঠাৎ একটা ক্রূর চিন্তা খেলে গেলো বলকিনাথের মাথায়।

মনে মনে বলকিনাথ ভাবলো, এর পর হয়তো দুনিয়া তাকে বিশ্বাস ঘাতক বলবে। সে বলুক, বলকিনাথ থোড়াই ওসবের তোয়াক্কা করেছে কখনো। আর যে উপায় নেই। এই নৃশংসতাই অঘোর মার্গের প্রথম শিক্ষণ। আজ নাহয় হোক তার মহরত।

ধীর পায়ে বলকিনাথ এগিয়ে গেলো বেদে বুড়ির কাছে।

-" এসেছিস ?", চোখ বুজেই বলে উঠলো বেদে বুড়ি।

বলকিনাথ প্রচন্ড সংযত কন্ঠে বললো, " আদেশ করুন মা।"

বুড়ি চোখ বুজে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসেছিলো এতক্ষণ। এবার চোখ খুলে বললো, " বোস এখানে। সবকিছু জোগাড় হয়েছে? পাঁঠার মাংস, মদ ভুজ্জি ?"
" হ্যাঁ মা। সব কিছু", বললো বলকিনাথ।
" বেশ, আর মড়াটা এনেছিস ? বাসী পচা আনিস নি তো ?"

বলকিনাথ চুপচাপ রয়েছে দেখে বেদে বুড়ি ধমকে ওঠে,
-" কীরে আঁটকুনির ব্যাটা, মড়া এনেছিস ?"

বলকিনাথের চোখ দুটো চকচক করে উঠল। অশীতিপর বুড়ির বয়স তো কম হয়নি। মন্ত্র যা শেখার তা শিখেই নিয়েছে। এখন বুড়িকে রাস্তা থেকে সরাতে পারলে তারই লাভ। তাহলে তন্ত্রসাধনায় তার সমতুল্য আর কেউ থাকবেনা। মনে মনে এতক্ষণ যা ফন্দি এঁটেছিলো, সেটা প্রতিপন্ন করতে মনস্থির করলো এক লহমায়।

ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে এসে সজোরে তার গলাটা চেপে ধরল বলকিনাথ। একফোঁটা চিৎকার করার সময় পেল না বুড়ি।
দাঁতে দাঁত চেপে বললো বলকিনাথ, 
-" মড়া তো আমি তোকেই বানাবো রে বুড়ি। তারপর তোর ওপরেই আমি সাধনা করবো।"

দম আটকে এলো বেদে। অতিকষ্টে ' শয়তান' শব্দটা বললো অস্ফুটে। দুই কষ বেয়ে তখন গ্যাজলা বেরিয়ে গেছে। কিন্তু বলকিনাথের বলিষ্ঠ দুই হাত থেকে রেহাই মিললো না বুড়ির।

কয়েক মুহূর্তের ছটফটানি, তারপরই সব শেষ।

..৬..

শাল্বকুমার ও তার সেনাবাহিনী ততক্ষণে নৈশঅভিযানে বেরিয়ে পড়েছে। লক্ষ্য একটাই- এতদিন ধরে ঘটে আসা নানাবিধ অপহরণ ও অপরাধের বিনাশ সাধন যা বেশ কিছুদিন ধরেই হয়ে চলেছে জঙ্গলের কোনো অজ্ঞাত আততায়ীর দ্বারা।

পথ বিপদসংকুল। তাতে আবার শ্বাপদের ভয়ও রয়েছে। কিন্তু শাল্বকুমার অবিচল ভাবে এগিয়ে চলেছে। যেভাবেই হোক অভীষ্ট লক্ষ্যে তাকে পৌঁছতে হবেই। মহারাজকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির অমর্যাদা কোনো মতেই করবে না সে।

বৃদ্ধ প্রয়াগনাথও এই অভিযানে শাল্বকুমারের সাথে রয়েছেন। তাঁর সন্দেহ আপন পুত্রের প্রতিই। সে যে তন্ত্র সাধনার জন্য নরবলি দিতেও পারে, এমনটা অনেক দিন ধরেই সন্দেহ করেছিলেন তিনি। একদিন এক বেদে বুড়ির সাথে জঙ্গলে দেখেওছিলেন পুত্রকে। তাদের উপাচার দেখে বড়োই আশ্চর্য হয়েছিলেন। বিভিন্ন মরা পশুপাখির হাড় মাংস আর রক্ত। এ কি স্বাভাবিকতার লক্ষণ ? মোটেও না। তবে কি কোনো নিষিদ্ধ তন্ত্রের প্রতি ঝুঁকেছে সে ? কে জানে! প্রশ্ন করেও সদুত্তর মেলেনি পুত্রের কাছ থেকে।

প্রয়াগনাথ জানেন যে পথ সে অবলম্বন করেছে তা শুধু ভয়ঙ্কর নয় ঘৃণ্যও বটে। তাই যতই তিনি পিতা হন, দেশের স্বার্থে, দশের কল্যাণে যদি নিজের পুত্রকে সাজা দিতেও হয়, তাও তিনি পিছপা হবেন না। 


ওদিকে বলকিনাথের শব সাধনার সমস্ত উপকরণ প্রস্তুত। প্রথমে বুড়ির লাশটাকে ভালো করে সুগন্ধী জল দিয়ে স্নান করিয়ে ধুপ ও ধুনো দিয়ে শোধন করে যথাস্থানে এনে রাখলো।

রাতের শেষ প্রহর আসন্ন। এবারে বলকিনাথ বসবে সাধনায়। একে একে সমস্ত উপাচার গুছিয়ে নিয়ে বসল। তার পরনে কৌপিন। সামনে জ্বলছে ধুনীর আগুন। সামনে কোনো প্রাণীর রক্ত সমন্বিত একটি পাত্র। সেই থেকে একটু রক্ত কনিষ্ঠ আঙ্গুলে নিয়ে তাই দিয়ে আঁকল এক একটি ত্রিভুজ। তারপর ঠিক উল্টো করে আরো একটি ত্রিভুজ এঁকে চক্রাকারে পরিবৃত করল যা দিয়ে আসলে ছটি কোণকে ঘেরাটোপ দেওয়া হল। দুটি ত্রিভুজ থেকে উৎপন্ন ছটি কোণেই রাখা হল বিচিত্র উপকরণ- সাপের লেজ, ইঁদুরের পা, মোষের মাংস প্রভৃতি ছটি বস্তু।

তারপরই মৃতদেহ থেকে এক খন্ড মাংস ও দেহরোম নিয়ে ধুনীর আগুনে অর্পণ করল। শুরু হলো এক ভয়ংকরতম সাধনা- হাকিনী সাধনা।

বলকিনাথ উঠে বসলো শবের ওপর। তারপর দুই হাতের তর্জনী ও কনিষ্ঠ আঙ্গুল নিজের নাভীদেশের কাছে এনে পরস্পরের সাথে ছোঁয়াল। মনে মনে কল্পনা করতে লাগলো এক বিশেষ অন্ত্রের- রক্তসূর্য্যচক্র। আর শুরু হল গুরুগম্ভীর গলায় এক হাড়হিম করা পুজো পাঠ। প্রথমে মায়ের পুজো, চিবিয়ে চিবিয়ে কর্কশ কণ্ঠে উচ্চারিত হতে লাগলো এক একটি মন্ত্র-

।। ওঁ শ্রীঁ ক্লীঁ হ্রীঁ ঐঁ বজ্রবৈরোচনীয়ে হুঁ হুঁ ফট্ স্বাহা ।।
।। ওঁ শ্রীঁ ক্লীঁ হ্রীঁ ঐঁ বজ্রবৈরোচনীয়ে হুঁ হুঁ ফট্ স্বাহা ।।


তারপরই এক অশরীরির আবাহনী মন্ত্রে রাতের বনভূমি শিহরিত হয়ে উঠতে লাগল বারবার। সেই সাথে ধুনীর আগুনে নিক্ষিপ্ত হতে থাকল একের পর এক আহুতি। 

এ এক অনন্য সাধনা। সফল হলে মোক্ষলাভ, নইলে নিশ্চিত মৃত্যু।

সাধনার  অন্তিম লগ্নে চূড়ান্ত মোক্ষের আশায় কাতর হয়ে শবের উদ্দেশ্যে পুষ্প অর্পণ করতে লাগলো সে। বুঝতেও পারল না কখন তার শিয়রে এসে উপস্থিত হয়েছে শাল্বকুমার ও তার সেনাবাহিনী।

প্রয়াগনাথ নিজের পুত্রকে এই অবস্থায় দেখে চমকে উঠলেন। বুড়ির মৃতদেহ দেখেই তাঁর বুঝতে বাকি রইল না এখানে ঠিক কী হচ্ছে। সামনেই হাঁড়ি কাঠ। হয়তো বাচ্চাগুলোর বলি দেওয়া হয়েছিল এখানেই। তাঁর পুত্রই তবে হত্যাকারী!

শাল্বকুমারের আর তর সইলো না। কোমর থেকে অসি বের করে তছনছ করে দিতে লাগলো সমস্ত উপকরণ পুজো সামগ্রী। 

ঠিক তখনই চোখ খুলল বলকিনাথ।

দুচোখে যেন নরকের আগুন জ্বলছে তার। চিবিয়ে চিবিয়ে প্রশ্ন করল,
-" কে তুই ? এত বড় সাহস আমার পুজোর জিনিস ভেঙে দিস !"

শাল্বকুমারের চোখে ভয়ের লেশমাত্র নেই। গর্জে উঠলো, 
-" বন্ধ করো এসব পুজো পাঠ। একের পর এক বাচ্চা এই জঙ্গলে উধাও হয়েছে। তুমি নির্ঘাত জানো সে ব্যাপারে। বলো আমায় ? কী করছো এসব?" 

হিমশীতল কন্ঠে কথাগুলো শুনেও কোনও উত্তাপ দেখা দিলো না বলকিনাথের অন্তরে। তখনও ভাঁটার মত জ্বলছে তার দুই চোখ। তার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না যে এমন ঘোরতর জঙ্গলেও তাকে বাধার মুখে পড়তে হবে।

শাল্বকুমার উদ্যত তলোয়ার দেখিয়ে আবারও বলল,
-" চুপ করে থেকো না। বলতে তোমাকে হবেই। নইলে সাক্ষাৎ মৃত্যু। ওই হাঁড়িকাঠ প্রমাণ করছে তুমি নরবলি দিয়েছ নির্ঘাত।"

অদূরে একটা হাঁড়িকাঠের দিকে নির্দেশ করলো শাল্বকুমার

বলকিনাথ বিশ্রী হেসে জবাব দিল,
-" রাজকুমার তুমি জানো না কী করছ। ওই বাচ্চারা কেউ মরে নি। ওদের মায়ের কাছে অর্ঘ্য দিয়েছি। মা ওদের রক্তপান করে খুশি হয়েছেন। "

প্রয়াগনাথ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তার মানে তাঁর সন্দেহই সঠিক। বলকিনাথই এসবের মূলে রয়েছে। যাকে তিনি রাজরোষ থেকে বাঁচিয়েছিলেন, যে তাঁর আপন রক্ত সেই কিনা এত বড় ষড়যন্ত্রে সামিল! কিন্তু এই মৃতদেহটি কার ? মনে হচ্ছে এ সেই বেদে বুড়ি! একেও কি তাঁর পুত্রই হত্যা করেছে ? কিন্তু এসব কেন করেছে সে, তার কিছুই বুঝতে পারছেন না তিনি।

উত্তর অবশ্য তিনি শীঘ্রই পেলেন। শাল্বকুমারের অস্ত্র দেখে বিন্দুমাত্র ভীত না হয়ে বলকিনাথ বলে উঠল,
-" এই রাজ্য আর তোদের থাকবে না। সাধনাবলে আমিই হবো অধীশ্বর। তাই বলছি সরে যা। বাধা দিলেই মায়ের কোপ নেমে আসবে এই রাজ্যে। এই যে দেখছিস বেদে বুড়ির লাশ। এই আমার গুরুমা। আজ তাঁর দেহের ওপর সাধনা করেই আমার অপমানের বদলা নেব। আমি তন্ত্র সাধক বলকিনাথ। আমার পুজোয় বিঘ্ন ঘটাতে আসিস না।"

শাল্বকুমার রাগে ফুঁসছিলো। এতবড় কথা। রাগত কন্ঠে বলে উঠলো
- " শেষবারের মত বলছি এসব বন্ধ করে চল আমার সাথে। তুমি যা করছ তা অন্যায়।"

-" আর রঞ্জাবতী যে আমায় সেদিন তিরস্কার করল সেটা অন্যায় নয় ? কী দোষ আমার ? আমি মন্ত্রী পুত্র এটাই আমার অপরাধ ?" রক্তচক্ষু হয়ে বললো বলকিনাথ। 

শাল্বকুমার এই কালা সাধনার উপাসকের মুখে তার নিজের বাগদত্তার নাম শুনে থমকে গেল। এত বড় সাহস! তার সামনে তারই প্রেমিকার নাম নেয়। নাঃ এর কোনো ক্ষমা নেই। এই পাপিষ্ঠ খুনি, অপহরক, বিশ্বাসঘাতক। এর শাস্তি একটাই, মৃত্যু।

প্রচন্ড রাগে দিশাহারা হয়ে বললো শাল্বকুমার,
-" কী বললি তুই শয়তান ? রঞ্জাবতীর নাম মুখে আনিস ? এত বড় আস্পর্ধা ?"

হা হা করে হাসতে থাকে বলকিনাথ। তারপর সাপের মতো হিসহিসে গলায় বলে ওঠে,
- " শোন রে মূর্খ। তোদের দিন ঘনিয়ে এসেছে। আমার পিতার মতো কাপুরুষ আমি নই। রঞ্জাবতীকে আমি বশীভূত করেই ছাড়বো। ওকে আমি না পেলে কাউকে পেতে দেবো না আর। আমার সাধনায় বিঘ্ন ঘটিয়েছিস। কাউকে রেহাই দেব না।"

..৭..

দূর থেকেই এসব শুনছিলেন প্রয়াগনাথ। বিপদ আসন্ন দেখে ছুটে এলেন। তারপর নিজের পুত্রের এই সাংঘাতিক কার্যকলাপ দেখে খানিকক্ষণ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর বললেন,
-" এ কী অনাসৃষ্টি করছিস বলকি! এ কাজ করিস না। ক্ষমা চা এখুনি, আমি বলছি তুই এখনই ক্ষমা চাইবি।"

বলকিনাথ তখন উন্মাদ হয়ে উঠেছে। বললো,
-" কীসের ক্ষমা? তোমরা সবাই নিকৃষ্ট। এমনকি তুমি নিজেও পিতা। তোমাদের জন্যই আজ আমি এখানে। রাজা রাজ্য রাজকন্যা কিছুই আমার সাথে নেই। কিন্তু আমিও ছাড়ব না। সব কিছু এই সাধনবলেই করায়ত্ত করব। হাকিনী কে আহ্বান করবো আমি।"

শাল্বকুমার খানিক থমকে গেছিল প্রয়াগনাথকে দেখে। এই ঘৃণ্য লোকটি মন্ত্রী মশাইয়ের পুত্র !

প্রয়াগনাথ কিন্তু চিনতে পারেন না তাঁর আপন পুত্রকে। এত জিঘাংসা জমেছিলো তার মনে! এতো বিদ্বেষ! এ যে ক্ষতি বই অন্য কিছু করবে না কারো। নাঃ বলকিনাথ ক্ষমারও অযোগ্য। 

আরক্ত নয়নে তিনি রুখে দাঁড়ালেন পুত্রের সামনে। বললেন,
- "তবে রে শয়তান! তোর এত সাহস ? কী ভেবেছিস তুই হাকিনী আহ্বানে সবাইকে বশীভূত করবি? তাহলে শোন। আমিও এক ন্যায় নিষ্ঠ ব্রাহ্মণ। আমার কাছে দেশ আগে, কর্তব্য আগে। এই হাকিনী ডাকিনী এদের ওপরেও আছেন আর এক মহাশক্তি। মহাডামরি ভৈরবী। তিনি পরব্রহ্ম। মহাকালের ধারক। তাঁর উপাসক আমি। আমায় তুই ভয় দেখাচ্ছিস ? যতই তুই আমার পুত্র হ, তোর পাপের ভাগীদার আমি অবশ্যই হতে পারি না।"

-" রঞ্জাবতী আমার। তাকে কাউকে পেতে দেব না। সে শুধুই আমার। আমায় তিরস্কার করলেও আমি তাকে ছাড়বো না। কেউ আটকাতে পারবে না। দেখি তুমি কতবড় শক্তির উপাসক", বলেই বলকিনাথ আবারো সাধনার প্রস্তুতি নিতে উদ্যত হয়।

শাল্বকুমার এতক্ষণ সবই শুনছিলো। এতক্ষণ মন্ত্রী পুত্র বলে খানিক আড়ষ্ট হয়ে পড়লেও ওই কথা গুলো শুনে আর নিজেকে সামলাতে পারল না। রাজধর্ম আগে, তারপর বাকি সমস্ত।

- " তবে রে শয়তান", বলে সবেগে অসি চালনা করল সে বলকিনাথের দিকে। 

কিন্তু ধূর্ত বলকিনাথ বোধহয় তৈরি হয়েই ছিলো। মুহূর্তে সরে গেলো নিজের পিতার দিকে। তারপরই পার্শ্ববর্তী এক সৈনিককে সপাটে ধাক্কা মেরে তার তরোয়াল হস্তগত করে আপন পিতাকেই পেছন থেকে জাপটে ধরে অসিখানা প্রয়াগনাথের কন্ঠনালীর একদম কাছে ধরে শান্ত গলায় বললো,
- " রাজকুমার আমায় তুমি এখনো চেনো নি। সাধনায় বিঘ্ন ঘটালে আমি ছেড়ে কথা বলবো না। তার জন্য নিজের পিতাকেও রেওয়াত করবো না আমি।"

সহসা এমন পরিস্থিতিতে শাল্বকুমার থতমত খেয়ে গেলো। লোকটা এভাবে প্রতি আক্রমণ করবে এ যে ধারণার অতীত। 

প্রয়াগনাথ তখনও রাগে ফুঁসছিলেন। ওই অবস্থাতেই বললেন, 
-" থামলে কেন কুমার। চালায় অসি। আমি মরলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু এই নরাধমটিকে শেষ করে দাও। ওটাই রাজাদেশ, সে যতোই আমার পুত্র হোক না কেন।"

আপামর সৈন্য সামন্তরাও থমকে গেছে। কী করবে কেউ কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। বলকিনাথ অসম্পূর্ণ সাধনা ছেড়ে নিজের কুটিল বুদ্ধিতে সকলকে কাবু করে ফেলেছে। শাল্বকুমারও অসহায়ের মতো তাকিয়ে। 

বলকিনাথ আবার বলে উঠলো, 
- " এবার কী করবে রাজকুমার? রক্তপাত হবেই। কিন্তু মরবে তোমরা। আমিই..." 

বলকিনাথের কথা শেষ হলো না। অকস্মাৎ ঝড় উঠলো যেন। সেকি হাওয়ার তান্ডব! এই নিবিড় অরণ্যে প্রতিটি গাছ এমন প্রচন্ড দুলতে লাগলো যেন প্রলয় এসেছে। আর ঠিক তখনই সবার চোখ পড়লো সেই বেদে বুড়ির মৃতদেহের ওপর। 

একি! সেটা যে এখন সটান উঠে বসেছে। মুখে প্রচন্ড এক রাগ, তীব্র ঘৃণার আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। চোখ দুটো লাল। মরা মানুষের দেহে যেন নতুন করে প্রাণ সঞ্চার হয়েছে আবার। 

বলকিনাথ পর্যন্ত এ দৃশ্য দেখে চমকে উঠলো। সে হাঁ হাঁ করে সাধন স্থলের দিকে দৌড়লো। কিন্তু না , ততক্ষনে যা হবার তা হয়ে গেছে। হাকিনী তন্ত্রে অসম্পূর্ণ সাধনা মহাবিপদ ডেকে আনে। আর তার জন্য সবথেকে বড় মাশুল দিতে হয় স্বয়ং সাধককে। 

 হাকিনী এখন বেদে বুড়ির দেহে অধিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সে যে ক্ষুধার্ত। তাকে যে সাধনপ্রক্রিয়ায় ডাকা হয়েছে তাতে খুঁত থেকে গেছে। এবারে যে বলকিনাথকে তার পরিণাম ভুগতেই হবে।

প্রচন্ড হাওয়ার দাপটে ছিটকে পড়লো বলকিনাথ। চারদিকে ভয়ানক সব চিৎকার, অশরীরিদের আর্তনাদ আকাশ বাতাস বিদারিত করে দিচ্ছে। বলকিনাথ হাজার চেষ্টা করেও উঠতে পারলো না।  

হাকিনীকে নিয়ন্ত্রণ করা অতি বড় তান্ত্রিকেরও অসাধ্য। বলকিনাথ সেখানে কোন ছাড়! 

বেদে বুড়ির দেহটা এখন শূন্যে উঠে ভাসছে। এক নারকীয় হাসি তার মুখে। কুৎসিত কদাকার সেই মুখ কী বীভৎস ! যেন পাতাল থেকে উঠে আসা এক রাক্ষুসী।

 হঠাৎই প্রচন্ড রাগে, সেই ভয়াল দর্শন প্রেতযোনী ঝাঁপিয়ে পড়লো বলকিনাথের ওপর। 

তারপর সজোরে তার ঘাড়টা ধরে উল্টো দিকে মোচড় দিয়ে দিল। বলকিনাথের কোনো কিছুই করার অবকাশ রইলো না। চলচ্ছক্তিহীন দেহটা সটান ভূপাতিত হল। সঙ্গে সঙ্গেই একটা ধোঁয়ার কুন্ডলি বেদে বুড়ির শরীর থেকে বের হয়ে পাক খেতে খেতে আকাশে মিলিয়ে গেলো।

একটা আর্তনাদ আর ধপ করে একটা শব্দ হতেই প্রয়াগনাথ দেখলেন তার পুত্র ধরাশায়ী হয়ে পড়ে রয়েছে। একটা রুধির ধারা ফিনকি দিয়ে বের হলো বলকিনাথের মুখ থেকে।

প্রয়াগনাথ আর পারলেন না নিজেকে ধরে রাখতে। পুত্রের এমন অবস্থায় ভেঙে পড়লেন তিনি। হোক সে তান্ত্রিক, কালা জাদুর অধিকারী, হোক সে রাজদ্রোহি; তবুও তো সে তার পুত্র। বলকিনাথের ভূপাতিত দেহ আঁকড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন প্রয়াগনাথ। তখনও সে দেহে অল্প প্রাণের লক্ষণ রয়েছে। ঠোঁট দুটো অল্প ফাঁক করে মৃত্যুপথযাত্রী বলকিনাথ বলে উঠল,
-" সব মরবে, মহামারী হয়ে শেষ হয়ে যাবে। এ আমার অভিশাপ। রঞ্জাবতী শুধুই আমার। এ জন্মে , পরের জন্মে, সব জন্মে। "

তারপরই সব শেষ। চারিদিক শান্ত হয়ে এলো। গভীর অরণ্যের এই নিভৃতস্থানে পড়ে রইলো এক ভয়ঙ্কর উপাসকের দেহ আর কয়েকটা মানুষজন। সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছু মহীরুহ আর অন্ধকারের এক মিশমিশে আচ্ছাদন। 

শাল্বকুমার কোনো ভাষা খুঁজে পেল না প্রয়াগনাথকে সান্ত্বনা দেবার। শুধু অন্ধকারে নিভু নিভু ধূনির আগুনের ম্লান আলোয় দেখলো বৃদ্ধ প্রয়াগনাথ অসহায়ের মতো আকুলি বিকুলি করছে। আজ যে তিনি নির্বংশ হলেন।

..৮..

কিন্তু কাঞ্চনগড় রক্ষা পায়নি এরপর। বলকিনাথের কালাজাদুর প্রভাব ছিল অমোঘ। বেদে বুড়ি তাকে কিছু তন্ত্র গুণ নিশ্চই প্রদান করেছিলো; তাই বোধহয় কিছুদিনের মধ্যেই এক সাংঘাতিক মহামারী গ্রাস করল গোটা কাঞ্চনগড়কে। 

কেউ বাঁচে না। একে একে সব প্রজা, এমনকি রাজপরিবারের সকলেই প্রাণ হারালো। সবশেষে রঞ্জাবতীও সেই ভয়াবহ মহামারীর শিকার হয়ে অভিশাপের কলা পূর্ণ করল। ধ্বংস হয়ে গেল কাঞ্চনগড় নগরী। 

বেঁচে রইলেন শুধু প্রয়াগনাথ। কেন জানি না মহামারীর প্রকোপ তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি। হয়তো পুত্র হয়ে এমন কিছু করে গিয়েছিল বলকিনাথ যাতে একমাত্র তার পিতাই বেঁচে থাকে, নাকি সকলকে মরতে দেখে পিতাকে তার সাক্ষী হয়ে থাকবার অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিলো তা ঈশ্বরই জানেন। সে ছিলো এক মহাতামসের উপাসক। রক্ত ছাড়া যে অর্ঘ্য দিতে পারতো না। চেয়েছিলো মহামোক্ষ। বদলে জুটেছিল ভয়ানক এক মৃত্যু। মরণ যাত্রায় দেওয়া কালাভিশাপ ফলে গিয়েছিল অক্ষরে অক্ষরে। 

প্রয়াগনাথের আর কোনো খবর পাওয়া যায় নি। তবে কানাঘুষো শোনা যায় তিনি নাকি পরে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। সব কিছু চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে দেখে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন একসময়। 

কেউই সঠিক বলতে পারে না তাঁর সম্বন্ধে। শুধু আশপাশের অনেক জায়গায় আজও আড়াইশো বছর পরে কান পাতলে শোনা যায় এক অসহায় বৃদ্ধের কাতর আর্তনাদ, এক অপরিসীম হাহাকার। যিনি সবকিছুর বিনিময়ে নিজের কর্তব্যে অবিচল থাকতে চেয়েছিলেন। হয়তো এই ভীষন কর্তব্যপরায়ণতাই তাঁর জীবনে এক ভয়ংকর অভিশাপ হয়ে নেমে এসে সবকিছু ছাড়খার করে দিয়েছিলো।

সমাপ্ত।
অলঙ্করণ :-  প্রিয়াঙ্কা সরকার
 

 

না-মানুষী ভাষা - হৈমন্তী ভট্টাচার্য

 না-মানুষী ভাষা
হৈমন্তী ভট্টাচার্য


 


বৈশাখের খর গরমের দুপুরে তেঁতুল দিয়ে মাজা বাসনের মত চকচকে রোদ থাকলে কী হবে, দমকা হাওয়ায় সুপুরি গাছগুলো এ ওর গায়ে গিয়ে পড়ছে। চোখ বন্ধ করে পাতার আওয়াজ শুনলে মনে হয় ঝিরঝির করে জল পড়ছে। বুধানী বাগচী বাড়ির বাঁধানো কলপাড়ে চৌবাচ্চার কলে ঝপাঝপ বাসন ধুয়ে তুলল। তারপর ন্যাতাটা কেচে পাঁচিলের ওপর ফেলতেই বাড়ির পেছনের দিকের সানসেটের দিকে নজর পড়ল। একটা ছোট্ট কালো মতন দড়ি নড়ছে যেন। সাপ নাকি! চোখের চারপাশের কোঁচকানো চামড়া আরো কুঁচকে ঠাহর করে দেখল, না, সাপ নয়, তবে কিসের একটা লেজ, লোমহীন সরুপানা। পায়ের পাতার ওপর উঁচু হয়ে বুধানী গলাটা যদ্দুর সম্ভব ঘুরিয়ে দেখবার চেষ্টা করল। সাপ নয়, তবে কি বেঁজি?

     বুধানী মুখ তুলে দেখল দোতলার সামনের দিকের বারান্দাটা ফাঁকা। একটু আগে অবধি বুলবুলি দিদি বসে ছিল। ইদানিং বড্ড চুপচাপ হয়ে গেছে মেয়েটা। বিয়ের একবছর পর বিয়োতে গিয়ে আঁতুড়েই চার দিনের ছেলে মরে গেল। তারপর নয় নয় করে পাঁচ বছর কেটে গেছে। কীরকম মনমরা হয়ে থাকে আজকাল। বাপের বাড়ি এসেছে সংক্রান্তি কাটাতে।

  বেঁজিই হবে, উবু হয়ে বাসনগুলো হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে একবার তাকাতেই বড় বড় গোল গোল পুঁতির মত দুটো চোখের সাথে চোখাচুখি । একটা ছোট্ট লোমশ কালচে মাথা একবার উঁকি দিয়েই দেওয়ালের আড়ালে চলে গেল ঝট করে।
-"ও হরি এ তো হুনুমানের ছানা।"

-"হুনুমানের পাল এসেছে, সব বড়ি আচার তুলে নাও গো ছাদ থেকে।" বুধানীর সাবধানবাণী শুনে আশপাশের বাড়ির ছাদে জানালায় কয়েকটা মুখ দেখা গেল, "কই গো?"

নদে জেলার হাঁসখালিতে অবশ্য হনুমান আসা কোনো নতুন খবর নয়। এ তো কলকাতা নয়, যে হনুমান দেখতে হলে চিড়িয়াখানায় টিকিট কাটতে হবে। এখানে দিব্যি হনুমান দলবল নিয়ে পাড়া টহল দিতে বের হয়। পালের গোদা মস্ত বড় হনু তার লেজটা পিঠের উপর বাঁকিয়ে ইংরেজি আলফাবেট সি এর মত করে লাফ দিয়ে এ বাড়ি থেকে ওবাড়ির ছাদে তাণ্ডব করে। মাদি হনু পেটে ছানাকে আঁকড়ে ধরে খোসা ছাড়িয়ে কলা খায় আর পথ চলতি মানুষকে মুখ ভ্যাংচায়। ছাদ বাগানের লেবু বেগুন, বাড়ি আচার খেয়ে কলাগাছ আমগাছ ধ্বংস করে দল বিদায় নিয়ে যায় অন্যপাড়ায়।

বুধানীর সাবধান বাণীতে বাড়ির বউ ঝিরা গলা বাড়িয়ে কোনো হনুমান দেখতেই পেল না। পাশের বাড়ির ক্লাস ফাইভের পিকলু দোতলার জানলা থেকে বুধানীকে বলল, "তুমি হুনুমান বলছ কেন? ইস্কুলে শিখিয়েছে হনুমান। হনু মানে হল চোয়াল।"

-"থাম দিকি।" বুধানী ফোকলা মুখের ঠিক সামনে পাটিতে মুড়ির মত লেগে থাকা দাঁতটা ঠোঁটে দুবার ঘষে চারপাশ ভালো করে দেখে নিল। নাহ চারপাশের গাছ গাছালিতে বড় মেজো সেজো গোদা কোনো হনুমান দেখা যাচ্ছে না তো। তবে সানসেটের ওপর ওই ছানাটা এল কোথা থেকে?

এ বাড়ির ভেতর থেকে বাগচীবৌদি বলে উঠল, "কী হয়েছে রে বুধানী?"

-"হুনুমানের ছানা গো, তোমাদের জানলার ওপরে।"
বাগচী গিন্নী গ্রিলের দরজা খুলে লাল রোয়াকের ওপর দিয়ে এগিয়ে বুধানীর পাশে এসে দাঁড়ালেন,"কই রে?"

-"ছোট্ট ছানা গো", পাশের বাড়ির ছাদ থেকে  পিকলু বলে উঠল, "মনে হয় কাল যে হনুর দলটা এসেছিল, তাদের কারোর বাচ্চা। হয়ত লাফ দিতে গিয়ে পড়ে গেছে।"

-"তুই দেখতে পাচ্ছিস? আশে পাশে ওর মা আছে?"

পাশের দুটো বাড়ির ছাদ থেকে পিকলু আর বিন্তি চারপাশ ভালো করে দেখে বলল, "না গো।"

ক্রমশ চারপাশের বাড়ির ছাদে,আর পাঁচিলের বাইরে পাড়ার ছেলে পিলে ভিড় জমালো।
-"দেখো কত টুকুনি বাচ্চা। আহা গো।"
চার বছরের ভণ্ডুলকে ওর মা আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, "ওই দেখ , আরেকটু বড় হলে তোর মত হবে।"

দুবাড়ির ছাদ থেকে পিকলু আর বিন্তি তর্ক জুড়েছে।
পিকলু বেশ জোর গলায় বলল, "শোন হনুমান সীতা দেবীকে খুঁজতে গিয়ে ল্যাজ জ্বালিয়ে লঙ্কায় আগুন লাগিয়েছিল । তারপর সেই লেজটা মুখে পুরে ওর মুখটা পুড়ে কালো হয়ে গেছে। তাই হনুর মুখ কালো।"

বিন্তি চশমার আড়াল থেকে টেরা চোখে তাকিয়ে বলল, "তোর মুণ্ডু, হনুমান সূর্যের কাছে পড়তে গিয়েছিল। সূর্যের তো অনেক কাজ। তখন হনু বলল, আপনি রথ চালান, আমি আপনার দিকে মুখ করে পেছন দিকে ছুটব, আর আপনি যা বলবেন শিখব।সূর্যের রথের দিকে তাকিয়ে পেছন দিকে দৌড়ে দৌড়ে শিক্ষা নিয়েছিল বলে রোদে পুড়ে মুখ কালো হয়ে গেছে।"

পিকলু মানবে না, "তুই ভুল জানিস। এটা আমার দাদু বলেছে।"

-"না রে হনুমান, তুই ভুল জানিস। আমায় মা এই গল্পটা বলেছে।"

ওদিকে হনুমানের ছানা তো এত মানুষ জন দেখে ভয়ে আরো সিঁটিয়ে গেছে। কি করা যায় ছানাটাকে বাঁচানোর জন্য সেই বিষয়ে জল্পনা শুরু হল।
-"কী হবে বল তো? গোটা একদিন পড়ে আছে আটকে। এভাবে থাকলে তো না খেয়েই মরে যাবে।"

-"বাহাদুর পুর বিট অফিসে ফোন করা যাক।" ঝটপট ফোন হল বনদফতরে। কিন্তু লোক কম। তাই দেরি হবে আসতে।

বুলবুলি ইতিমধ্যে পায়ে পায়ে মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। খুব খুঁটিয়ে দেখে মনে হল ছানাটা পেছনের পা বা কোমরটা নাড়তে পারছে না। এতক্ষণ , প্রায় একদিন ওই সানসেটে আটকে আছে। আরো কত দেরি হবে কে জানে! বুলবুলি ভিড়ে দাঁড়ানো যুবকদের উদ্যেশ্যে বলল, "ওকে নামানোর ব্যবস্থা কর দিকি তোরা।"

-"মানুষ গায়ে হাত দিলে যদি ওর মা না নেয়!"
বাগচী গিন্নী আমতা আমতা করে বললেন।

-"মা যদি নিতই, তাহলে কি রেখে চলে যেত? যেত নি। এ হল জানোয়ারের মর্জি। আগেও দেকিচি, কোনো কোনো ছানাকে মা কাচেও নেয় না, দুদও দেয় না। মেরে ফেলে ।আবার অনেক সময়ে মায়ের দূর ছাইতে এমনিই না খেয়ে ছানা মরে যায়।" বুধানী বেশ বিজ্ঞের মত বলে উঠল।

-"একটু ওকে নামিয়ে দে সন্তু", বুলবুলির গলায় মিনতি।
জোয়ান ছেলে সন্তু পাঁচিলের খাঁজে পা রেখে তরতর করে উঠে গিয়ে হাত বাড়াতেই ছানাটা ভয়ে "চি চি" করে ডেকে উঠল।
-"সাবধানে। ওর পিঠে ব্যথা আছে মনে হয়", বুলবুলি নীচ থেকে ডেকে বলল।

বেশ কসরত করে ছানাকে নামানো হল। বুধানী বলে উঠল,"জয় বজরংবলী"। গোল গোল চোখদুটো কাঁচের গুলির মত ঝকঝকে। বুলবুলি স্থির চোখে চেয়ে রইল।  ঠিকই আন্দাজ করেছিল। পেছনের পায়ের নিচের দিকে আর পেটে বেশ খানিকটা জায়গা লোম উঠে ভেতরকার লালচে মাংস বেরিয়ে আছে। রস জমে আটকে আছে লোমের সাথে। হয়ত  পড়ে গিয়ে জখম হয়েছে। পুরো শরীরটা ব্যথায় নাড়াতে পারছে না ।অল্প ঘাড় নেড়ে প্রাণীটা ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকাচ্ছে।

-"বিট অফিসের লোকজন কখন আসবে কে জানে!"
জল খাওয়ানোর চেষ্টা হল মগে করে। সরু ধারায় মুখের কাছে ফেললেও গালে পৌঁছল না, গড়িয়ে গেল। এক্কেবারে নেতিয়ে গেছে। ঘাড় তুলে হাঁ করেও জল খেতে পারছে না। বুধানী ঠোঁট ছড়িয়ে বলল, "এ বাঁচবে নি গো।"

বুলবুলি আর দাঁড়ালো না। প্রায় দৌড়ে বাড়ি থেকে তুলোর প্যাকেট আর জলের বোতল নিয়ে ফিরে এল। পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে চৌবাচ্চার বাঁধানো পাড়ে বসে পড়ে বলল, "আমার কোলে একটু আস্তে করে তুলে দাও দিকি।"

বুলবুলির কোলে এসে ছানাটা গোল গোল চোখে দেখছে। বুলবুলি তুলো সরু করে জলে ভিজিয়ে মুখের কাছে এনে আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিতেই ফোঁটায় ফোঁটায় জল পড়ল ছানাটার মুখে,"না হাঁ কর"। আস্তে আস্তে হাঁ করে জল খেতে লাগল ছানাটা।

বুধানী বলল, "আহা কত তেষ্টা পেয়েছিল বল দিনি।"

বুলবুলির জামা ভিজে উঠেছে গড়িয়ে পড়া জলে। ছানাটা অল্প উসখুস করে উঠল। বুলবুলি ছানাটাকে কোল থেকে নামাতে যেতেই সে ছোট্ট ছোট্ট আঙ্গুল দিয়ে জামাটা আঁকড়ে ধরল,"কি হল, ছাড়"। আরেকবার নামাতে গেলে ছানাটা আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরল জামা। বাগচী গিন্নী মুখ টিপে হেসে বললেন, "তোকে পছন্দ হয়েছে। ওই জন্য আঁকড়ে আছে।"

বুলবুলি একদৃষ্টে প্রাণীটার ভীত ছোট্ট ছোট্ট চোখওয়ালা হালকা রোমশ মুখটার দিকে তাকিয়ে অল্প হাসল। গোল গোল অবুঝ চোখে অবলা মরণাপন্ন প্রাণীটাও ওকে দেখছে অদ্ভুত নির্ভরতায়।

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। বিনবিনে গান গাইতে গাইতে মশার ঝাঁক দল বেঁধে ঘুরছে মাথার ওপর। বুলবুলি মানবশিশুর মত করে কোলে জড়িয়ে নিল ছানাটাকে। বুলবুলির নখ অসাবধানে অল্প ছুঁয়ের গেল প্রাণীটার লালচে ক্ষতয়। "ইস, ষাট ষাট" বুলবুলির কালো চোখদুটোর দৃষ্টি নরম হয়ে উঠল। তার মুখের রেখায় লালচে সূর্যের আলো । উঠে দাঁড়িয়ে  বলল, "বুধানী পিসি একবার ঘরে এসো তো। টাকা দিচ্ছি। দুধের ফিডিং বোতল আর এক প্যাকেট দুধ এনে দাও তো।"

******

-"বুলবুলি রে, এবার নিশ্চিন্ত । বিট অফিসের লোক এসে গেছে।" বাগচী গিন্নী ঘরে ঢুকলেন।
বুলবুলি একমনে ছানাটাকে বোতলে দুধ খাওয়াচ্ছে বোতলে। চক চক শব্দ করে অবিকল মানবশিশুর মত দুধ খাচ্ছে ছানাটা। বুলবুলি মায়ের দিকে তাকালো। মুখ দেখে মনে হল না সে নিশ্চিন্ত হয়েছে। সাবধানে পুরো দুধটা খাইয়ে ফাঁকা বোতল নামিয়ে রাখল মাটিতে। তারপর গলায় উদ্বেগ নিয়ে বলল, "ওরা নিয়ে গিয়ে যত্ন করবে তো?"

-"আরে হ্যা। ওদের কত পশুদের ডাক্তার আছে।"
-"ওকে যদি না দিই, ও থাকুক না আমার কাছে। আমি যত্ন করে সুস্থ করে ছেড়ে দেব।" বুলবুলির গলার স্বরে কাতরতা এমন ভাবে ফুটে উঠল যে বাগচী গিন্নী নির্বাক হয়ে রইলেন। মেয়ের মাথায় হাত রেখে নরম সুরে বললেন, "তা কি হয় রে? ওরা ওর ঠিক মত চিকিৎসা করবে। যদি আমাদের কাছে মরে যায়?"
-"মরবে না। আমি ঠিক মায়ের মত  যত্ন করে ওকে বাঁচাবো। আমি ওকে ছাড়ব না কারোর কাছে।" বুলবুলির গাল বেয়ে বড় বড় জলের ফোঁটা নীরবে গড়িয়ে পড়ল।

বাগচী গিন্নী কী বলবেন বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন,
-"শোন মা ,জানোয়ারের ভালোবাসা মানুষের মত নয়। এই যে তুই ওর সেবা করলি, ও ঠিক এই বাড়ি আর তোকে মনে রাখবে। সুস্থ হয়ে জঙ্গলে চলে যাবার পর দেখবি আবার তোর কাছে ঠিক একদিন আসবে। তোর হাত থেকে খেয়ে যাবে।" মেয়ের চুলে আঙ্গুল ডুবিয়ে আদর করতে লাগলেন। সন্তানহীন আত্মজার কষ্ট তিনি মর্মে মর্মে বোঝেন। জলভরা চোখে তিনি মনে মনে মেয়েকে আশীর্বাদ করে বললেন,"অবলা প্রাণীর সেবা করলে ভগবানের সেবা হয়। দেখিস মা ষষ্ঠীর পুত আসবে এবার তোর কোল আলো করে। তোর বুক ফাঁকা থাকবে না।"

বিট অফিসের লোকজন খাঁচায় ভরে নিল ছানাটাকে। যাবার আগেও বুলবুলির জামাটা আঙ্গুলে শক্ত করে ধরা ছিল। অবুঝ চোখ দুটো যেন বলছিল, "রাখো না তোমাদের কাছে আমায়।" বুলবুলি কান্না গিলে আদর করে বলল, "যা বাবু, সুস্থ হয়ে আসিস আবার। আমিও খোঁজ নেব তুই কেমন রইলি।"

অন্ধকারে ঢাকা রাস্তায় বন দফতরের গাড়ি বাঁক নিয়ে ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে গেল।  বাগচী গিন্নী জোড়হাত মাথায় ঠেকিয়ে বললেন, "ওই টুকু বাচ্চা , যেন রক্ষা পায় ।ঠাকুর তুমি দেখো।" বুলবুলি জলভরা চোখে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল। দুটো নামানুষী চোখের নির্ভরতার ভাষা তার শূন্য বুকের মধ্যে আশ্রয় খুঁজে বেড়াতে লাগল। নাহ, বড্ড মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছিল ছানাটা একবেলাতেই। ফেরার অপেক্ষা করলে ও কী সত্যিই ফিরবে! হয়ত ফিরবে না। একেবারে ভুলেই যাবে।

বুলবুলি চোয়াল শক্ত করল, তাকেও ভুলতে হবে, এক্কেবারে ভুলতে হবে।
 

****সমাপ্ত**** 

অলঙ্করণ :-  প্রিয়াঙ্কা সরকার



অন্য পূজো - শাশ্বতী মুন্সী


 অন্য পূজো
 শাশ্বতী মুন্সী 
 

 
 

 গলির চৌমাথার মোড়ে গাড়িটা এসে দাঁড়াতে ভাড়া মিটিয়ে ক্যাব থেকে নেমে পড়লো মালবিকা | কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ এবং ডানহাতে ধরা ভারী  বিগ শপারটা নিয়ে মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলো বাড়ির সদরে | কলিং বেলের সুইচে আলতো চাপ দিতে সুরেলা ধ্বনির অনুরণন ভেসে এলো দরজার ওপ্রান্ত থেকে | একটু অপেক্ষার পরে শাশুড়ি মা দরজা খুলতে সিঁড়ির নিচ দিয়ে ভেতরে ঢুকে বাঁ-হাতি দেওয়ালের এক সাইডে ভ্যানিটি ব্যাগটা বিগ শপারের ওপরে রাখলো | তারপর হাত-পা ধুয়ে ব্যাগ দুখানা রেখে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসতে এক গ্লাস ঠান্ডা জল বৌমার দিকে এগিয়ে দিয়ে  উল্টোদিকের সোফায় বসলেন হেমলতা দেবী | পুরো জলটা পান করতে ঘর্মাক্ত শরীরের গরম ভাব খানিক জুড়োলো | মালবিকার ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে হেমলতাদেবী বললেন,
 -" খুব পরিশ্রম গেলো না.. তা, এতো দেরি হলো যে.. সব কেনাকাটা আজই করে নিলে?"
 -" হ্যাঁ মা, কিনতে যখন গেছি তাই আর কিছু বাকি রাখলাম না.. হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলে স্কুলে আর ছুটি পাবো না.. তাছাড়া ভাদ্রের বিজবিজে গরমে ভিড় ঠেলে বারবার যেতেও বিরক্ত লাগে..!"
-" তা যা বলেছো, পূজো এলেই যেন কেনাকাটার হিড়িক লেগে যায়.. নাও, এবার তোমার ছেলেপুলেদের সামলাও দিকি নি, বিকেল থেকে মা কখন আসবে, কতগুলো জামা নিয়ে আসবে, আমাদের নিয়ে গেলো না কেন --- প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে দিলো আমায়.."

ওনার কথা শেষ হওয়া মাত্র দোতলার সিঁড়ি দিয়ে দুপদাপ করে নেমে একছুটে সোজা ড্রয়িং রুমে ঢুকে কোনো দিকে না তাকিয়ে মায়ের দু'পাশে বসে পড়লো চার মিনিটের ছোট-বড় দুই ভাইবোন | মালবিকার যমজ সন্তান -- তাতান আর তুতুন | দু' জোড়া হাতের আদরের ভঙ্গির বাহুডোরে তার শরীরের ক্লান্তি নিমেষে উধাও | ওই অবস্থায় আবদ্ধ থেকে নরম স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,
 -" সারাদিন দুষ্টুমি করিস নি তো.. খেয়েছিস ঠিক মতো? "
 -" একটুও দুষ্টু করি নি মা... ঠাম্মি কাঁটা ছাড়িয়ে দিতে মাছ দিয়ে সব ভাত খেয়ে নিয়েছি আমরা.. ", একসাথে বললো দুজনে |
 -" বাহ্.. কিন্তু লক্ষ্মী সোনার ঠাম্মিকে অতো প্রশ্ন করে জ্বালাতন করছিলে কেন? আমি তো বলেই গেছি কোথায় যাচ্ছি কেন যাচ্ছি.. ভিড় আর রাস্তায় জ্যাম ছিল বলে ফিরতে দেরি হয়ে গেলো..
 হাতের বন্ধন শিথিল করে ঠাম্মির দিকে বারেক তাকিয়ে নিলো তাতান | বলে,
 -" ঠাম্মি যে কিছুতেই বলছিলো না আমাদের জন্য জামা প্যান্ট কিনে আনবে কিনা.."
 -" তোদের পুজোর পোশাক তো কেনা হয়ে গেছে.."
 -" সে তো দুটো বাবা দিয়েছে, পিসি আর জেঠু একটা করে, মামারবাড়িটা বাকি আছে আর মাসি এখনো দেয় নি.. "
দাদার কথার খেই ধরে নেয় তুতুন | দুঃখী স্বরে বললো,
-" তুমি কিন্তু এবারে একটাই জামা কিনে দিলে মা..!"

 দুই হাতের বেড়ে ছেলেমেয়েকে কাছে টেনে মালবিকা বোঝায়,

 বাবা, মায়েরা অনেক টাকা উপার্জন করলেই যে পুজোতে গন্ডা খানেক জামা কিনে দেবে, এটা কক্ষনো ভেবে রাখবি না..পাঁচ দিন পুজোতে পড়ার মতো জামা হলেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়.. কখনো ভেবেছিস, যেসব ছোট ছেলেমেয়েরা সিগন্যাল, বাস স্টপেজে ঘুরে ঘুরে হাত পেতে ভিক্ষা করে পয়সা চেয়ে খাবার কিনে খায়, তারা ক'টা জামা পায় পূজোতে কিংবা আদৌ পায় কি না! সারাবছরই যাদের লোকের ফেলে দেওয়া পুরনো ছেঁড়া, রং চটা জামা পরে কাটাতে হয়, তারা যে নতুন জামা পাওয়ার কথা ভাবতেই পারে না.. অর্থের জোর আছে এমন লোকেদের উচিত এইসব পথশিশুদের জন্য সাধ্যমতো কিছু করা.. পুষ্টিকর খাবার, পোশাক, দেওয়া, প্রয়োজনে কোনো সংগঠন বা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা.. তাই এবারে একটা জামা কম হলে সেই টাকায় যদি ৪/৫টি শিশুকে জামা কিনে দিই, তাতে কি তোদের মন খারাপ হবে?

সোফার সামনে রাখা পোশাকে ঠাসা বিগ শপারটার দিকে তাকিয়ে তুতুন বললো,
 -" ওতে কি তাহলে সব ওদেরই জামা,প্যান্ট আছে..!"
বোনের মনোভাব অন্যদিকে ঘোরাতে তাতান বলে ওঠে,
 -" শুনলি না মা কি বললো.. ওরাও আমাদের মতো মায়ের দেওয়া নতুন জামা পরে ঠাকুর দেখবে..
 -" প্যান্ডেলে গিয়ে তোরা যেভাবে ঠাকুর দেখিস, আনন্দ করিস, ভালো ভালো খাবার খাস, ওরা সেসবের কিচ্ছু পায় না বলেই তো এ বছরটা শুধু ওদের জন্যই আলাদা পুজোর বন্দোবস্ত করেছি আমরা.. ", বললো মালবিকা |
 -" তোমাদের অফিসের মাঠে পূজো হবে বলেছো, তাহলে বাবার মামবাড়ির দূর্গা পূজোতে যাবে না তুমি? ", বালকসুলভ প্রশ্ন উচ্চারিত হয় তাতানের কণ্ঠে | একটু ভেবে নিয়ে মালবিকা উত্তর দেন,
 -" যাবো তো বটেই.. তবে অন্যবারের মতো যে থাকতে পারবো না, পূজোর কিছু দায়িত্ব আমাকেও  নিতে হয়েছে, তবে অষ্টমী বা নবমীর দিন যখন হোক ঠাকুর দর্শন করে আসবো.. ",

 বৌমার কথায় স্মিত হাসেন হেমলতা দেবী |

 পেশায় স্কুল শিক্ষিকা(ভূগোল) মালবিকা বসুরায় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত | সহকারী সভাপতি | সারা বছর এই সংগঠন বিভিন্ন  জনকল্যাণমূলক প্রকল্প ভিত্তিক কাজ করে থাকে | এবারে তারা ঠিক করেছেন, পথশিশুদের নিয়ে দূর্গাপূজো করবে | সংগঠনের নানা কাজে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর শহরের ঘিঞ্জি বস্তি, গ্রাম-গ্রামান্তরে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ছুটে যায় প্রতিনিধিরা | চলতি বছর তেমনই এক প্রকল্পের কাজে দলের প্রতিনিধিত্ব করে বাঁকুড়ার কুলতলি গ্রামে গিয়ে মালবিকা দ্যাখে, ছোটদের কেউ অপটু হাতে সযত্নে প্রতিমা গড়ছে, কেউ বানাচ্ছে শোলার ফুল, আবার কেউ করছে দরমার কাজ | কৌতূহল বশে জিজ্ঞেস করতে ১২ বছরের মন্টু জানায়,
 -" বাবা ঠাকুরদাকে মাটির ঠাকুর বানাতে দেখেই শিখে নিয়েছি | মনের কল্পনায় মূর্তি গড়তে ভালো লাগে.. "
 বোঝে, মাটির তাল নিয়ে খেলতে খেলতে ছোট্ট আঙ্গুল গুলো অজান্তেই কারিগরিতে দক্ষ হয়ে উঠেছে | তাদের এই সহজাত দক্ষতাকে অভিনব রূপে ব্যবহার করার ভাবনা আসে মালবিকা'র মাথায় |

 সংগঠনের সভাপতি এবং সকল প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে স্থির হয় অফিসের পাশের খোলা মাঠে দূর্গা পূজোর আয়োজন করা হবে | কুমোরটুলির অর্ডারী প্রতিমা নয়, গ্রামের খুদে মৃৎশিল্পীদের তৈরী একচালায় সপরিবারে দেবী দূর্গা পূজিত হবেন | ঠাকুর গড়বে প্যান্ডেলের ভেতরে বসে | অন্দরসজ্জায় থাকবে বালক-কিশোরদের হাতের কাজের ছোঁয়া | গ্রাম থেকে এসে এই সময়টা অফিসের অব্যবহৃত ঘরে থাকবে ওরা এবং খাওয়ার খরচা ব্যয় হবে সংগঠনের ফান্ড থেকে |

 দাতাগোষ্ঠী, স্থানীয় অবস্থাপন্ন ব্যক্তিদের সহায়তায় বেসরকারি সংগঠনের ফান্ডে অর্থের সংকুলান হয় না | বিভিন্ন মানব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত করে থাকেন | মালবিকা'র স্বামীও প্রতি মাসে সংগঠনের তহবিলে অর্থ দান করেন | সমাজসেবী সত্ত্বা, উদার হৃদয়, কর্মোদ্যমী প্রয়াস -- এ হেনো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী স্ত্রী'র জন্য গর্ব অনুভব করেন চিরদীপ বসুরায় |

 কারিগরি বিদ্যে আর শিল্প-শৈলীর মেলবন্ধনে অপূর্ব সুন্দর প্রতিমা গড়ে নাবালক শিল্পীরা | বাঁশ, দরমা দিয়ে বানানো প্যান্ডেলের অভ্যন্তরীণ সাজে লাগে শোলা কেটে রং-তুলি বুলিয়ে তৈরী নকশাদার চিত্রালংকার | রাত নামলে শহর ভেসে যাওয়া উজ্জ্বল আলোর রোশনাইয়ের মাঝে জাঁকজমকহীন মণ্ডপে শোলার ফুলের ভেতর জ্বলে ওঠে রঙিন টুনি লাইট |

  জনা ৫০ পথশিশু এবং গ্রামের ওইসব ছোট  ছেলেমেয়েদের মধ্যে হাফ/ফুল শার্ট, হাফ/ফুল প্যান্ট, ফ্রক, স্কার্ট টপ, চুড়িদার ইত্যাদি পোশাক বিতরণ করা হয় মহালয়ার দিন | ভাত, লুচি, খিচুড়ি, লাবড়া, আলুর দম, ফুলকপির তরকারি, মাছ, মাংস, পায়েস, দই, মিষ্টি.. পাঁচদিন ধরে  চারবেলা পাত পেড়ে খাওয়ানো হলো পূজোর ঢালাও খাবার |

  শিশু, বালক বয়সী একঝাঁক কচিদের হাসি-মজা- কলরোলে মণ্ডপের ভেতর এবং প্যান্ডেলের বাহির মুখরিত হয় অনাবিল আনন্দ-তরঙ্গে | রোদ ঝলমলে পূজো প্রাঙ্গন জুড়ে  আন্দোলিত হয় খুশির গন্ধ মাখা শরতের মনোরম বাতাস | নতুন ছন্দে উৎসব উপভোগের অভিপ্রায়ে মালবিকার সন্তানেরাও এই ক'টি দিন সংগঠন-মাঠের পূজোয় সামিল হয় |

 মৃৎশিল্প এবং হস্তশিল্পের কল্যাণে কলকাতার ঠাকুর দর্শনের সুযোগ মিললো গ্রামীণ জনপদের বাসিন্দাদের | আর নিজেদের পূজোর আনন্দ-আহ্লাদে মেতে উঠলো কলকাতার ঠিকানাহীন পথবাসীরা |

 শহরের সঙ্গে গ্রামকে মিশিয়ে দেওয়ার মানবতা'র পূজোয় ধ্বনিত হলো মনুষ্যজাতির জয়গান |
 
....................
অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি

 

হেমন্তের বৃষ্টি - সংগ্রামী লাহিড়ী

 

হেমন্তের বৃষ্টি
সংগ্রামী লাহিড়ী
 

 


ছোট্ট ভক্সওয়াগন গাড়িটা ছুটছে ঘণ্টায় সত্তর মাইল গতিতে, পঁচানব্বই নম্বর হাইওয়ে ধরে, নিউ জার্সির দিকে। রবিবারের বিকেল, রাস্তা ফাঁকা। গ্রীষ্মের দিনে অনেকক্ষণ আলো থাকে। সন্ধে হতে ন'টা বাজবে। ড্রাইভারের সিটে আমি, অর্থাৎ এই নিরীহ সাংবাদিক সোমনাথ। পাশে সুমিতা। নিউ জার্সির নামকরা কবি। খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে দিকে দিকে। আজ ছিল ফিলাডেলফিয়ায় সাহিত্যসভা।
সুমিতা আর আমি একসঙ্গে যাদবপুরের ইংরেজি অনার্স। আমার মত গুটিকয়েক ছেলে ছিল ইংরেজি ক্লাসের মাইনরিটি। ঝকঝকে, ফ্যাশনেবল মেয়েরা ওড়না উড়িয়ে, জিন্স-টিশার্টে হিল্লোল তুলে ঘুরে বেড়াত। আমরা ভেবলুর মত দেখতাম। সাহিত্য ভালোবেসে পড়তে আসার হ্যাপা কি কম? বাড়ি থেকে বলেই দিয়েছিল, "পড়াশুনোর শেষে চাকরি যদি জোটাতে না পারো, তাহলে বাড়ির হোটেলের দরজা বন্ধ।"
সেই ভয়ে ভীত আমরা কয়েকজন দিনরাত এক করে পড়াশোনা করি। নেট, স্লেটএর চিন্তায় রাতের ঘুম উড়ে যায়।  
অন্যদিকে সুমিতার মত সহপাঠিনীরা দেদার আড্ডা মারে, লেটেস্ট ফ্যাশন ট্রেন্ডের খবরাখবর রাখে, কফিহাউসে গিয়ে খায় ও খাওয়ায়। সেইসঙ্গে দুর্ধর্ষ রেজাল্টও করে। পড়ে কখন, সে এক রহস্য!
একদিন জিজ্ঞেস করতে ঝাড়া দু'মিনিট আমার দিকে চোখ সরু করে চেয়েছিল।
আমি তো ঘাবড়ে টাবড়ে একাকার! কী জানি বাবা, কী ভুল বলে ফেলেছি, খোদায় জানে!
আশ্বস্ত করে আমায় পিঠ চাপড়ে দিল, "ওই কফিহাউসেই তো আদ্ধেক পড়াশোনা হয়ে যায় রে, আসিস একদিন, বসিস আমাদের আড্ডায়।"
চমকে উঠি, "আমি? না না..."
সে আড্ডায় যাদবপুরের উজ্জ্বল সব নক্ষত্ররা আলো ছড়ান।। কেউ ফিল্ম ডিরেক্টর হবেন, গুটিকয়েক ফিল্ম বানিয়ে ইতিমধ্যেই কলেজ ফেস্টে খ্যাতিলাভ করেছেন। কেউ বা বিজ্ঞাপন জগত আলো করবেন বলে এখন থেকেই কপিরাইটিং করেন। কেউ আবার আগুন-ঝরানো বিপ্লবী। কলেজ থেকে একবার বেরোনোর অপেক্ষা, তারপরেই বিপ্লব সংঘটিত হবে।
এঁদের জগতে আমার মত মফস্বলি বাঙাল যে একান্তই বেমানান, সে জ্ঞান আমার আছে। ওসব আড্ডায় ওই সুমিতার মত মেয়েদেরই মানায়।
দূরে দূরেই ছিলাম। এবং কী আশ্চর্য, আমার মত ক্যাবলাকান্তর জন্যে সুমিতার হৃদয়ে কোথাও একটুকু জায়গা ছিল। বন্ধুত্বের জায়গা, সহমর্মিতার জায়গা। ওই সব আলো-জ্বলা টেবিল ছেড়ে মাঝে মাঝেই আমায় টেনে নিয়ে যেত ক্যামপাসের মাঠে। সবুজ ঘাসে বসে চলত সাহিত্যের আলোচনা। দুজনের একটা ব্যাপারে খুব মিল - লেখালেখি। নতুন যা লেখা হল, তা একে অন্যকে শোনানো চাইই চাই। আমার লেখার প্রথম পাঠিকা সুমিতা, সুমিতার প্রথম পাঠক আমি। এ নিয়মের নড়চড় হত না। পড়া এবং কঠোর সমালোচনা। নিজেদের লেখাকে নির্দয় কাটাছেঁড়া না করলে শান্তি নেই।
কবিত্বশক্তি সুমিতারই বেশি। শব্দ নিয়ে অনায়াসে খেলতে পারে, তাকে গেঁথে গেঁথে অনুপম ব্যঞ্জনায় গড়ে তোলে ভাবনার সৌধ। কবিতায় তাকে আমি কোনোদিন এঁটে উঠতে পারিনি। কিন্তু লেখার হাতটি আমারও মন্দ নয়। আমি গোল দিতাম নন-ফিকশন গদ্যে। প্রবন্ধ, প্রতিবেদনে আমি স্বচ্ছন্দ। রম্যরচনাতেও হাত পাকাচ্ছি তখন। কোনো লেখা পড়ে সুমিতা হয়তো বলল, "দিব্যি হয়েছে, দশে দশ।"
আমি সন্দিহান, "কোনো কমেন্ট নেই? যাহ, তুই পড়িসনি ভালো করে।"                    
তেড়েমেড়ে উঠত সুমিতা, "ধুত্তেরি, ভালো হলে ভালো বলতেও পারবো না? কী জ্বালা!!"
তেমনি সুমিতার কবিতার প্রশংসা করলেই খ্যাঁক করে উঠত, "মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবি না তো? পড়ে বল কোথায় খামতি আছে।"  
অন্ত্যমিল না গদ্যকবিতা, সাবলীলতা নাকি চমকে-দেওয়া শব্দবন্ধ - এসব নিয়েই কাটত অনেকটা সময়। এহেন সুমিতা একদিন বেনারসি পরে বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়ল। আমরা কব্জি ডুবিয়ে নেমন্তন্ন খেলাম।
সুমিতার মনোহরণ করেছিল ঝিলের ওপারে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের একটি সুপাত্র। আমাদেরই ব্যাচ, আমরা সবাই চিনি তাকে। ভাস্কর অতি ভালোমানুষ। নিজেকে আড়ালে রাখতে পারলেই বাঁচে। ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিপার্টমেন্টে বেশ ওপরের দিকেই থাকে তার নাম। ভারি বন্ধুবৎসল। প্রায়ই নিজের গাঁটের পয়সায় আমাদের খাওয়াত। বিয়ের পর ব্যাঙ্গালোরে ভাগলবা হল দুজনেই। ততদিনে আমি খবরের কাগজে চাকরি নিয়েছি, সাংবাদিক। রাতের শিফটে ডিউটি।  দিনে ঘুমোই, রাত জেগে কাজ করি। বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। কেই বা আর রাত জেগে জেগে আমার সঙ্গে গল্প করবে?
তারপর ভাগ্যই একদিন আটলান্টিক পার করে দিল। কাগজের করেসপন্ডেন্ট হয়ে নিউ ইয়র্ক অফিসে ট্রান্সফারের কথা জেনে আগেই মনে হয়েছিল সুমিতার কথা। সে যে নিউ জার্সিতে, সেটুকু খবর আমার কাছে ছিল।      
ফোনে ধরলাম একদিন। ওপাশ থেকে লাফিয়ে উঠল, "কী বললি? নিউ ইয়র্ক অফিস? এক্ষুনি আয়, এক্ষুনি আয়! উফ, কত্তোদিন বাদে তোকে দেখব বল তো?"
"কবে আসছিস? কতদিন থাকবি?"  পাশ থেকে পরিচিত খুশি-খুশি গলা। ভাস্কর।        
তারপর এই নিউ জার্সিতে আবার দেখা। সুমিতা প্রতিষ্ঠিত কবি, নিউ জার্সিতে রীতিমতো পরিচিত মুখ। পুরোনো বন্ধুত্ব চাগাড় দিয়ে উঠতে দেরি হল না। বন্ধুবৎসল ভাস্করের কোনোই পরিবর্তন হয়নি, বরং আতিথেয়তার বহর আরো বেড়েছে। বিদেশে বেশ কিছুকাল বসবাসের ফলে রান্নায় তার চমৎকার হাত পেকেছে। কারণে অকারণে ডাক পাঠায়। ফলে তাদের বাড়িতেই আমার সিংহভাগ সময় কাটে। ভাস্করের কিচেনের চা ও সুস্বাদু 'টা' সহযোগে ঘণ্টার পর ঘন্টা কবিতা আর সাহিত্য আলোচনায় অতিবাহিত হয়। সেই যাদবপুরের মাঠে-বসা দিনগুলিই ফিরে এল বুঝি বা।
ভাস্কর নিজের অফিসে তিনখানা মনিটর আর দুটো কিবোর্ড সাজিয়ে ইলেকট্রনের জগতে মশগুল থাকে। মাঝে মাঝে এসে একটু ফোড়ন কেটে যায়। টিপটে চা শেষ হলে ভর্তি করে দেয়। সত্যিই অতিথিবৎসল।      
নিউ জার্সি-নিউ ইয়র্ক অঞ্চলের বিভিন্ন সাহিত্যবৈঠকে সুমিতার নিয়মিত যাতায়াত। সেসব সভায় আমি খুব আনন্দের সঙ্গেই তার সঙ্গী হলাম। এ ব্যবস্থায় ভাস্কর যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সাহিত্য বা কবিতা জিনিসগুলো সে তেমন ভালো বোঝে না। নেহাত অনিচ্ছায়ই মাঝে মাঝে সুমিতার সঙ্গী হত। গৃহশান্তি বজায় রাখতে হবে তো? আমায় পেয়ে তার সে যন্ত্রণার অবসান হল।
তবে এত কষ্ট করেও শান্তি বোধহয় আর থাকছে না।
নিত্য যাতায়াতের পথে সুমিতার গজগজানি। শুনে শুনে আমি ক্লান্ত। আজও চলছিল ধারাবিবরণী।
"কিচ্ছু করে না, জানিস? সারাক্ষণ নিজের অফিসঘরটায় তিনখানা মনিটর সাজিয়ে বসে থাকে!"
এতটা অনৃতভাষণ মেনে নিতে সত্যিই কষ্ট হল। "কেন, তোর বাড়িতে গেলে ভাস্করই তো চা খাওয়ায়, স্ন্যাক্স এনে দেয়। কত যত্ন করে! তু্ই তো শুধু সোফায় বসে আড্ডা মারিস!"
তেড়েফুঁড়ে উঠল, "হ্যাঁ, তোদের সামনে তো ঐরকম একটা ইমেজ তৈরী করে রাখে। এদিকে যে বাড়ির উনখুষ্টি কাজ আমি করি?"
"সে না হয় একটু করলিই। ডিভিশন অফ লেবার বলে একটা কথা আছে তো? ভাস্কর যা যা করে তার সব কি তু্ই করিস? তোর বাড়ির নোংরা ফেলে ভাস্কর। গার্বেজ ব্যাগ হাতে তোকে তো একদিনও দেখিনি আমি?"
"ম্যাগো! আমার ঘেন্না করে!"
"তারপর দেখ, তোর পার্সোনাল ব্লগটা তো ভাস্করই বানিয়ে দিল! যেখানে তু্ই কবিতা লিখিস আর লোকে আহা-উহু করে!"      
"হুঁহ, তোর তো চোখে শুধু ওগুলোই পড়ে! জানিস, সেদিন বললাম, বাগানে আগাছাগুলো উপড়ে দিতে। দিলই না!"
সর্বনাশ! সুমিতা এবার খুবই বিপজ্জনক দিকে যাচ্ছে! বাগান তার প্রাণ। এই অভিযোগ থেকে ভাস্করকে রক্ষা করার মত এলেম আমার নেই। ঝটপট কথা ঘোরাই, "তোর ডালিয়াগুলো ফুটল? সেদিন যে দেখলাম কুঁড়ি এসেছে?"
"হ্যাঁ রে, গাছ ঝেঁপে ফুল একেবারে! আর কী রং! একেকটা ফুলে একের বেশি শেড! ভাবতে পারবি না..." মনের মত বিষয় পেয়ে কলকলিয়ে উঠেছে।
রাস্তায় চোখ রেখে আমি ঘাড় নাড়ি। আড়ালে ডেকে ভাস্করকে একটু ধমকে দিতে হবে। এতদিন ঘর করছিস, একটু মানিয়ে গুছিয়ে চলতে পারিস না হাঁদা?
বাড়িতে নামিয়ে দিলাম। ভাস্কর বেরিয়ে এসেছে, "চা খেয়ে যা। আড়াইঘন্টা গাড়ি চালিয়ে এলি।"
"খাওয়া।" আরাম করে বসেছি সোফায়।
সুমিতা মনে করাল, "পরের শনিবার কিন্তু নিউ জার্সিতেই। কবিতা ক্লাবের সেশন।"
মাথায় ঝড়াকসে বুদ্ধি খেলে গেল, "পরের শনিবার তো হবে না রে, আমার ডিউটি আছে।"
"তাহলে আর কী, আমি একাই..." সুমিতা নিমেষে নিবে যায়।  
"না না, একা যাবি কেন? ভাস্করটা আছে কি করতে? ভাস্কর, এই ব্যাটা ভাস্কর!" হাঁক পাড়ি আমি।
"ষাঁড়ের মত চেঁচাতে হবে না। সব শুনতে পাচ্ছি আমি।" কাপ-প্লেট-টিপট নিয়ে গুছিয়ে বসল।
"শুনেছিস তো? যাক!" আমি নিশ্চিন্ত।
"কিন্তু আমি তো যাচ্ছি না? আমার অন্য কাজ আছে।"    
সুমিতার মুখ আঁধার।
আমি তাড়াতাড়ি সামাল দিই, "কী এমন তোমার কাজ যে তুমি বৌকে সঙ্গ দিতে পারো না?"
"সঙ্গ দিলেও গালি খাবো, না দিলেও গালি।" ভাস্কর গোঁয়ারের মত বলে।
"কাউক্কে যেতে হবে না। একাই যাবো আমি।" সুমিতা ফেটে পড়ে। "আমি চললাম ওপরে। মাথা ধরেছে।"
সত্যিই গটগটিয়ে চলে গেল নিজের শোবার ঘরে।
"এমন করে কেউ বলে?" আমার খারাপ লাগছে।
"ছাড় তো!" ভাস্কর কেমন নির্বিকার!
আমি একটু ধন্দে পড়ে যাই। উঠে পড়ি। কাল সোমবার। সকাল সকাল কাজে বেরোনো। সারাসপ্তাহ চূড়ান্ত ব্যস্ততা। প্রেশার কুকার জীবন। সপ্তাহান্তে একসঙ্গে সময় কাটানো, গল্প আর আড্ডার মধ্যেই তো বেঁচে থাকার রসদ কুড়িয়ে নেওয়া। সে রসদে কি টান পড়ছে ভাস্কর আর সুমিতার সংসারে? কি জানি!
এমন করেই গড়িয়ে চলে দিন। কাজের চাপ বেড়েছে আমার। সবসময় নিউ জার্সি আসতেও পারি না। সব সাহিত্যসভায় যাওয়াও হয়ে ওঠে না।
সুমিতার কবিখ্যাতি বেড়েছে। সেইসঙ্গে নতুন নতুন বন্ধু। ভক্তমণ্ডলী ঘিরে থাকে।
একদিন ভাস্করকে ধরে বললাম, "বৌকে একটু মনোযোগ দে। যে রেটে বিখ্যাত হচ্ছে সুমিতা,কেউ যদি ইলোপ করে?"
শুনে সে কী ঘর ফাটিয়ে হাসি! থামতেই চায় না। "ইলোপ? কে করবে?"
"কেন, আমিই যদি করি? তু্ই তোর গুহায় বসে থাকিস। আমিই তো সুমিতার সঙ্গে এখানে ওখানে যাই!"
"আরে কর, কর! ক্ষতি কী? গো অ্যাহেড ম্যান!" আবার সেই গা-জ্বালানো হাসি।
মরুকগে, আমার কী? আমি কি ওদের সম্পর্কের জিম্মেদারি নিয়েছি?          
এই করে করেই কেটে যায় গ্রীষ্মের তিনটে মাস। ফসল উঠে গেছে ক্ষেত থেকে।  হেমন্তের রং ধরেছে পাতায়। ফল কালার। উজ্জ্বল কমলা, হলুদ, লাল রঙের আগুন লেগেছে বনে বনে। ঝরে যাবার আগে রঙের খেলা।
সুমিতাই সেদিন ফোন করল।        
"মেরিল্যান্ডের কবি-সম্মেলনের উদ্যোক্তারা নেমন্তন্ন করেছেন। আমার কবিতা নিয়ে আলোচনার জন্যে একটা স্পেশ্যাল সেশন রাখতে চান।"
"বলিস কী রে?" আমি উচ্ছ্বসিত। "দারুণ খবর! তোর তো দিকে দিকে জয়জয়কার!"  
"আমি সেই আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি। আমার কবিতা নিয়ে প্রশ্নের জবাব দেব।"
"বাঃ, বাঃ, বিরাট সম্মান। তু্ইই তাহলে সেদিন কবিদের মধ্যমণি" আমি সত্যি খুশি।
মেরিল্যান্ডের কবি-সম্মেলন উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে ঐতিহ্যশালী ও পুরোনো কবিতার আড্ডা। বাছাই করা কবিরা ডাক পান। সামনের মাসেই সেই সভা।  
"ভাস্কর আমার সঙ্গে যাবে না। কবি হিসেবে আমার এতবড় সম্মান, এমন দিনেও ওর নাকি কাজ আছে।   আমায় বলেই দিল, অত কবিতা শুনলে ওর নাকি মাথা ধরবে!" সুমিতার গলা ভেঙে আসে। "আমি তো ওকে সবজায়গায় যেতে বলছি না, বলছি কি? তা বলে এমন একটা বিশেষ দিনেও থাকবে না?"  
আমি কীই বা বলি। খারাপ লাগছে। সুমিতার সেন্টিমেন্টটা অযৌক্তিক নয়।
তবু সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করি, "ভাস্কর ছেলেটা তো খুবই ভালো, তবে ওয়্যারলেস টেকনোলজি নিয়ে এমনই ডুবে আছে যে সামনাসামনি তারের মধ্যে দিয়ে আসা সিগন্যালগুলো ওর অ্যান্টেনায় আর ধরা পড়ে না।"
"থাম তো তুই, চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা!" সুমিতা দাবড়ে দেয়। "ঠিকাছে, আমিও দেখে নেব। মেরিল্যান্ড থেকে ফিরেই ডিভোর্স। এর আর নড়চড় নেই। তুই ল'য়ারের খোঁজ লাগাবি। তোদের মত জার্নালিস্টদের কত চেনাজানা। একটু জিজ্ঞেস করলেই খবর পেয়ে যাবি।"
ফোন নামিয়ে রাখল।  
অবশেষে এল সেই দিন। মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোর শহরে সপ্তাহান্তের কবি-সম্মেলনে সুমিতার কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আলোচনা হল। দেশ বিদেশ থেকে সুখ্যাত কবিরা মঞ্চে এসে তার কবিতার বিশ্লেষণ করলেন। সুমিতার কবিতায় এক অদ্ভুত সাবলীলতা আছে। চরণ থেকে চরণে, পংক্তি থেকে পংক্তিতে অনায়াসে গড়িয়ে চলে কবিতার মূল সুরটি। সবাই প্রশংসা করলেন। সুমিতা লজ্জা লজ্জা মুখে তার কবিতা লেখার গল্প বলল। যাদবপুরের খোলা মাঠে আমাদের দুই বন্ধুর লেখালেখি, প্রথম পড়া আর কাটাছেঁড়ার কথাও বাদ গেল না।
বিকেল নাগাদ ফেরার পথ ধরেছি। মেরিল্যান্ড ছেড়ে পেনসিলভ্যানিয়াতে ঢুকছি, এমন সময় নামল আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। কোন এক ঘূর্ণিঝড় তার পথ বদলে আমাদের সামনে এসে উপস্থিত। সামনেটা বেবাক সাদা। কিছুই প্রায় দেখা যায় না। ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগোচ্ছি। সামনে, পেছনে, ডাইনে বাঁয়ে - কোনদিকেই দৃষ্টি চলে না। যাকে বলে হোয়াইট আউট কন্ডিশন। খুব বিপজ্জনক।    
খুব সতর্ক হয়ে চালাচ্ছি। পাশে সুমিতা চুপচাপ। আজ মুখে কুলুপ এঁটেছে। কলকলানি নেই। নিয়মমাফিক ভাস্করের নিন্দেমন্দ নেই। বৃষ্টির যা দাপট, নিউ জার্সি পৌঁছতে ঢের সময় লাগবে।
সুমিতাকে বলি, "ভাস্করকে ফোন করে জানিয়ে দে, যেতে দেরি হচ্ছে। নইলে চিন্তা করবে।"  
জবাব দিল না।
আড়চোখে তাকাই।  এ আবার কী ভাববিলাস?        
খানিক পরেই শুনি ফোন করছে।  
"বল, কেমন হল।" ভাস্করের গলা।
"তোর সে খবরে দরকার কী? ফোন করেছিস একবারও?" অভিমান উথলে ওঠে।
"আরে, তুই সভার মুখ্য আকর্ষণ, ভি আই পি, তোকে কি যখন তখন ফোন করে বিরক্ত করা যায়?"
"মিথ্যে কথাগুলো একটু কম বলবি? শোন, আজ 'মাটির কাছাকাছি' কবিতাটা পড়লাম, বুঝলি?"                  
"ও।"
"ও আবার কী?" সুমিতা উত্তেজিত। "সেদিনই তো তোকে বললাম, অমিত্রাক্ষর ছন্দ নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করছি। মনে নেই?"
"ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! সেটাই পড়লি?"
"সবাই ভালো বলল, জানিস? একদম নতুন রকমের কবিতা!"
"আচ্ছা, আচ্ছা, তু্ই বাড়ি আয় আগে। একটা সারপ্রাইজ আছে।“
“কী?"  
"সামনের বসন্তের জন্যে টিউলিপ আর ড্যাফোডিলের বাল্ব কিনে আনলাম। ড্রাইভওয়ের ধারে সার দিয়ে বসিয়ে দেব।"
"সত্যি? টিউলিপ আর ড্যাফোডিল? আমার যে কতদিনের শখ..."
"সে তো জানিই। ভাবলাম তোদের তো ফিরতে দেরি আছে, যাই, কিনে নিয়ে আসি। হেমন্তেই তো ওদের বসাতে হয়, তাই না?"
"হ্যাঁ, এইসময় বসালে বসন্তে চারপাশ আলো করে ফুল ফুটবে।"
“যাক, আর কথা নয়। সাবধানে চালিয়ে আয়। যা বৃষ্টি, রাস্তার নিশ্চয়ই খুব খারাপ অবস্থা।"
"হ্যাঁ রে, ডাইনে বাঁয়ে কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না।"
"বাড়ির কাছাকাছি এলে বরং একটা ফোন করিস। চা বসাব। তোর ফেভারিট আদা-এলাচের চা।"
ফোন রেখে দিল।
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। সুমিতা সিটে মাথা রেখেছে। চোখ বোজা। অবশেষে বৃষ্টির দাপট একটু কমেছে। আকাশ-ভাঙা থেকে কমে এখন ঝরঝর মুখর বাদর ধারা।  সন্ধে ঘনিয়ে আসছে।                    
"ফোনটা কর।" আমি মনে করালাম।
"আবার কাকে?" খেঁকিয়ে উঠল।
"ওই যে, ভাস্কর চা বসাবে বলেছিল? তোর বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছি।"
"ছিঃ সোমনাথ!" সুমিতা এবার সত্যিই আহত হয়েছে। "সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো কি আস্তে আস্তে লোপ পাচ্ছে? কবিতা সম্মেলনে মন ভরল না তোর? কে কোথায় চা খাওয়াবে বলেছে, সেই আশায় বসে আছিস?" ব্যথিত নয়নে তাকাল আমার পানে।  
আমি চেপে গেলাম। ভাস্করের বুদ্ধিশুদ্ধির ওপর আমার সম্পূর্ণ ভরসা আছে। আমাদের ফেরার সময়টা ও ঠিকই আন্দাজ করে নেবে। রেডি রাখবে চা এবং অনবদ্য সব 'টা'। মনে মনে সেকথা ভেবে বেশ আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু মুখে বলা চলবে না।
অবশেষে সুমিতার বাড়ি। ড্রাইভওয়েতে গাড়ি ঢুকল। বৃষ্টি পড়ছে, জলে থৈথৈ করছে লম্বা ড্রাইভওয়ে।
ছাতাটা এগিয়ে দিই, "এই নে, নাম।"
"তুই থাম!" দাবড়ে দিল আমায়। আমি ভ্যাবাচ্যাকা।
ফোন লাগিয়েছে, "অ্যাই শুনছিস?"
"হ্যাঁ, বল। চা বসিয়েছি।"
"এসে আমায় নিয়ে যা।"
"তার মানে? কোথায় তোরা?"
"এই তো, ড্রাইভওয়েতে।"
"তাহলে? বাড়ি ঢুকে পড়!"
"না, তুই আয় ছাতা নিয়ে। এত বৃষ্টিতে আমি নিজে নিজে যেতে পারব না।"
"ওহো, দাঁড়া, দাঁড়া, এক্ষুণি যাচ্ছি।"
আমি ছাতা হাতে করে বেকুবের মত গাড়িতে বসে আছি।
বাড়ির দরজা খুলে গেল। ভাস্কর বেরিয়ে এল। মাথায় একখানি ছাতা, হাতেও একখানি। দু'পা এগিয়েছে কী এগোয়নি, পাশ থেকে চেঁচিয়ে সুমিতার সাবধানবাণী, "দাঁড়া, দাঁড়া, আর এগোসনি, পিছল হয়ে আছে সামনেটা। পড়ে যাবি। আমি যাচ্ছি, তুই দাঁড়া ওখানে।"
“দাঁড়াব? তুইই তো এসে নিয়ে যেতে বললি?” ভাস্কর থমকে গেছে।
"আঃ, যা বলছি শোন, ওখানেই দাঁড়া। পা পিছলে পড়বি শেষে, কেলেঙ্কারি হবে একটা।"
আমার হাত থেকে ছাতাটা একটানে নিয়ে নিল সুমিতা, "কী তখন থেকে ধরে আছিস, দে না আমার হাতে।"
ছাতা মাথায় দিয়ে পা টিপেটিপে এগোচ্ছে বাড়ির দিকে। ভাস্করও অবশ্য থেমে নেই, সেও আসছে সামনে। অবশেষে ড্রাইভওয়ের মাঝামাঝি দুজনের মিলন। বৃষ্টির সুবাসভরা সন্ধ্যায় এক ছাতার তলায় হাঁটছে দু'জন। অভিমান ধুয়ে যাচ্ছে। দুটি হৃদয় কাছাকাছি। হেমন্তের উজ্জ্বল রং ওদের ঘিরে আছে।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ি থেকে নেমে এগোলাম। ছাতা নেই আমার। তাতে কী? বাড়ি ঢুকলেই গরমাগরম চা অপেক্ষা করে আছে। ভাস্করের নিজের হাতে তৈরি। একটুখানি আদা, কয়েকটি এলাচ আর অনেকখানি ভালোবাসার সুগন্ধে ভরপুর।

সমাপ্ত
অলঙ্করণ :-  প্রিয়াঙ্কা সরকার