অয়ন দাস লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
অয়ন দাস লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

রক্ত তামসী - অয়ন দাস


রক্ত তামসী
অয়ন দাস
 

 


..১..

 ভারী সুন্দর হয়েছে সরোবর খানা। পশ্চিমদিকের ঘন অরণ্য আর পূবের রাজপ্রাসাদ। এই দুয়ের মধ্যে রয়েছে টলটলে জলে কানায় কানায় ভর্তি এই সরোবর। 

একটা সময় মজে গিয়ে সামান্য এক পুস্করিণীর ন্যায় মুখ লুকোতো প্রাসাদ প্রাঙ্গনের ওপারে। রাজ অট্টালিকার জাঁকজমকের সাথে সেটা বড়োই বেমানান লাগতো।

শেষে মহারাজ অমর সিং একদিন উঠে পড়ে লাগলেন এটির সৌন্দর্যায়ন করতে। ভার পড়লো প্রবীণ মন্ত্রী প্রয়াগনাথের ওপর। প্রথমটায় একটু ইতস্তত করলেও মন্ত্রী মহোদয় যখন বুঝতে পারলেন মহারাজ একটু বেশিই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন তাঁর ওপর, মাথা পেতে দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। হাজার হোক,অমর সিং কে ছোট থেকে দেখে আসছেন তিনি। একপ্রকার অভিভাবকই বলা চলে তাঁকে। তাই সমস্যায় পড়লে বা সর্বশেষ পরামর্শ হিসেবে প্রয়াগনাথ এখনো কাঞ্চনগড়ের প্রধান ভরসা।

প্রয়াগনাথ অবশ্য নিরাশ করেননি। কাজটা যে সফল ভাবে প্রতিপন্ন করেছেন তিনি, বৃদ্ধ প্রয়াগনাথ নিজেও খুব ভালো করে জানেন। তিনি রাজমন্ত্রী। যেকোনো দায়িত্ব তাঁর ওপর নিশ্চিন্তে দিয়ে দেওয়া যায় তা বিলক্ষণ জানেন মহারাজ। এর আগেও এমন বহুকাজ তিনি পোক্ত হস্তে সামলেছেন। এটা তো তুচ্ছ একটা ব্যাপার। আসলে বয়স বেড়েছে বলেই হয়তো আজকাল অল্পতেই অহেতুক চিন্তা করেন। 

সরোবরের চেহারা পাল্টে এখন রীতিমতো এক বিস্ময়কর চিত্রপটের অবতারণা করে যেন। যেটা ছিল নিতান্তই একটা মরে যাওয়া ডোবা, এখন তার অপার নীল জলরাশিতে প্রতিফলিত হয় অস্তগামী সূর্যের লালিমা।

রাজপ্রাসাদের দ্বিতলে ঝুলন্ত বারান্দায় এসে দাঁড়ালে এক অসাধারণ দৃশ্য ফুটে ওঠে। স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো জলরাশি, কত গভীর আর বিরাট তার পরিধি। তার মধ্যে মাছের খেলা, মাছরাঙার ছোঁ মেরে শিকার ধরা দেখে যারপরনাই খুশি হন মহারাজ আর তাঁর আদরের রাজকন্যা রঞ্জাবতী। ওঁদের চিত্ত হয় বিগলিত।

একসময় সেই খুশির খবর পৌঁছয় বৃদ্ধ প্রয়াগনাথের কাছেও। তিনিও পুলকিত হয়ে ওঠেন। এই আনন্দ আর সন্তোষের চেয়ে বড় কোনো পুরস্কার যে হয় না।

সরোবরের ধারে বসে বসে এসব ভাবছিলেন, হঠাৎই শুনতে পেলেন ঘোড়ার খুরের শব্দ। দুজন রাজসৈনিক এগিয়ে আসছেন তাঁরই দিকে। অবাক চোখে তাকালেন প্রয়াগনাথ।

ঘোড়ার পিঠ ঠেকে নেমে এল এক সৈনিক। বলল, "মহারাজ আপনাকে তলব করেছেন মহোদয়।"

বৃদ্ধ মন্ত্রী ভাবলেন নিশ্চয় মহারাজ তাঁর ওপর খুশি হয়েছেন। তাই বোধহয় হাঁক পড়েছে। মৃদু হেসে বললেন,  "আমি ঠিক জানতুম যে মহারাজ আমায় অবশ্যই স্মরণ করবেন। তা কি এক্ষুনি যেতে হবে ?"

-" আজ্ঞে হ্যাঁ মন্ত্রীমশাই, তেমনই আদেশ পেয়েছি", উত্তর দিলো সৈনিক।
-" বেশ তবে চলো", বলে উঠে পড়লেন প্রয়াগনাথ।

প্রয়াগনাথকে নিয়ে যখন দুজন সেপাই দ্রুত অশ্বচালনা করে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে প্রাসাদ অভিমুখে ধাবিত হল, কাঞ্চনগড়ের আকাশে সূর্য অনেকখানি হেলে পড়েছে পশ্চিমাভিমুখে। সরোবরের জলে শেষ বিকেলের পড়ন্ত রোদ রক্ততিলক এঁকে আসন্ন প্রদোষের আবাহন করছে।

..২..

রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেই প্রয়াগনাথ বুঝলেন পরিস্থিতি বেশ থমথমে। মহারাজ অমর সিং একাগ্রচিত্তে বসে কিছু ভাবছেন। দুচোখে তাঁর সাংঘাতিক ভ্রুকুটি। ব্যাপার তো ভালো ঠেকছে না। প্রয়াগনাথ জিজ্ঞেস করলেন,
-" কোন দুঃসংবাদ আছে নাকি মহারাজ ? আপনাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে! "

-" চিন্তার তো কারণ রয়েছে মন্ত্রিমশাই। আজ এই নিয়ে পাঁচ পাঁচটি বাচ্চা হারিয়ে গেল। আর আশ্চর্য ভাবে সবাই ঠিক ওই জঙ্গলের দিক থেকেই উধাও হয়ে যাচ্ছে। এতে দুশ্চিন্তার অন্ত থাকছে না আমার", বেজার মুখ করে কথাগুলো বললেন মহারাজ।

প্রয়াগনাথ শুনে একটু আশ্চর্যান্বিত হলেন। বললেন, 
-" সেকি মহারাজ জল তাহলে এতদূর গড়িয়েছে! কিন্তু তাহলে তো একটা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এখুনি কিছু করা দরকার।"
-" সেই উদ্দেশ্যেই আপনাকে ডাকা। ইতিপূর্বে বহু সংকটকালীন পরিস্থিতিতে আপনার সদবুদ্ধি কাজে লেগেছে। এবারেও কিছু একটা ভাবতেই হবে। এবং লক্ষ্য রাখতে হবে যেন প্রজাগণ অযথা আতঙ্কিত না হয়ে পড়ে", মন্ত্রীমশাইকে পাশে পেয়ে একটু আশাবাদী হয়ে কথাগুলো বললেন মহারাজ।

প্রয়াগনাথ দৃঢ় কন্ঠে জানালেন,
-" আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো মহারাজ।" 

বৃদ্ধ প্রয়াগনাথ এবার গম্ভীর হয়ে ভাবতে লাগলেন। সমস্যা সত্যি গুরুতর। একটা উপায় না করলেই নয়। এমতাবস্থায়  প্রত্যেকে যখন এই আপদকালীন পরিস্থিতিতে কী উপায়ে সমাধান বেরোবে সেই নিয়ে আলোচনায় মশগুল, ঠিক তখনই এক তরুণ রাজপুত্র যিনি এতক্ষন রাজসভার এক স্থানে বসে এই গুরুগম্ভীর কথাবার্তা শুনছিলো। এবার বলে উঠলো,
-" মহারাজ আমায় যদি আজ্ঞা দেন আমি নিজে একবার ওই জঙ্গল তল্লাশি করে দেখতে পারি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওই জঙ্গলের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে সব রহস্যের সমাধান। "

প্রয়াগনাথ এই তরুণের দিকে একবার তাকালেন। 

শাল্বকুমার। 

পড়শি রাজ্য নিবাত পুরের মহারাজ মাধব সিংহের পুত্র এই শাল্বকুমার। কয়েকদিন আগেই রঞ্জাবতীর সাথে এই তরুণ রাজকুমারের বাগদান সম্পন্ন হয়েছে। তার পর বহুদিন এই গৃহেই বসবাস করে আসছে শাল্বকুমার। তার উৎসাহ দেখে রাজামশাই বললেন,
- কিন্তু তুমি যা বলছো তা যে কতটা কঠিন কাজ তা জানো? শ্বাপদ সঙ্কুল ওই অরণ্যে ওভাবে খানাতল্লাশী করা কিন্তু...।"

মহারাজের কথা শেষ হয়না। শাল্বকুমার বলে ওঠে, 
-" আমায় একবার সুযোগ দিন না মহারাজ।"

 অমর সিং খানিক ভাবলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন,
-" না না তুমি একা গিয়ে বিপদে পড়তে পারো। সে কাজ নেই।"

শাল্বকুমার কিন্তু নাছোড়বান্দা। সে বললো,
-" কিন্তু মহারাজ রহস্য তো ওই জঙ্গলেই। এভাবে বসে আলোচনা করার চেয়ে একবার গিয়ে দেখলে হত না। পরে যদি দেরি হয়ে যায়।"

 প্রয়াগনাথ দেখলেন ছেলেটার কোথায় যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। তিনি বললেন,
-" মহারাজ রাজকুমার শাল্ব ঠিক বলেছেন। ওখানে আমাদের সেপাই পাঠাতেই হবে। এবং তা রাত্রে। যাতে কেউ জানতে না পারে। প্রজাদের অজান্তে একাজ সারতে হবে আমাদের। আর তাছাড়া উনি তো একা যাবেন না। আমাদের সৈন্যরা ওঁর সাথেই থাকবে।"

শাল্বকুমার কৃতজ্ঞ চিত্তে বৃদ্ধ মন্ত্রীর দিকে একবার তাকালো। যেন এতদিন কিছু একটা করতে মুখিয়ে ছিল সে। যাতে করে প্রমান দিতে পারে সে এই রাজপরিবারের সুযোগ্য জামাতা। আজ সেই সুযোগ দুয়ারে অপেক্ষমান। তা হাতছাড়া করতে কোনোমতে রাজী নয় রাজকুমার। 

মহারাজ প্রথমে একটু দোটানায় ছিলেন। কিন্তু শাল্বকুমারের দুর্দমনীয় সাহস আর উৎসাহ দেখে মত বদলাতে বাধ্য হলেন। কুমার বলবান, দূরদর্শী- সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। দেখাই যাক না একটা সুযোগ দিয়ে।

আসলে রাজমশাইয়ের মন সায় দিচ্ছিলো না কিছুতেই। হাজার হোক তাঁর একমাত্র কন্যার হবু স্বামী সে। কিন্তু শেষমেশ শাল্বকুমারের কথাই রইলো। মন্ত্রিমশাইয়ের অভয়ে মবারাজ অমর সিং সায় দিয়েই দিলেন।

ঠিক হলো পরদিন সন্ধ্যাকালেই রাজকুমার শাল্ব তার সেনাবাহিনী নিয়ে এই নৈশ অভিযানে ব্রতী হবে। এই অদৃশ্য শত্রু দমন কার্যে সেই অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দেবে। সঙ্গে অবশ্য অভিজ্ঞ সেনাপতিরাও থাকবেন। যে করেই হোক এই বিপদ থেকে রক্ষা করতেই হবে। এমন প্রতিজ্ঞা নিয়ে তবেই সভা ছাড়লো রাজকুমার শাল্ব।

..৩..

রাজপ্রাসাদ থেকে নিজ গৃহে ফেরার পরই প্রয়াগনাথ বুঝলেন পুত্র বলকিনাথ এখনো বাইরে। এই পুত্রটিকে নিয়ে প্রয়াগনাথের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। সে যেন কিছুতেই কোনো নিয়ম কানুন মানতে চায় না। মাঝে মাঝেই এমন দিনকয়েকের জন্য উধাও হয়ে যায়। কোথায় যে থাকে, কী করে তা তিনি পিতা হয়েও বুঝতে পারেন না।

ও জন্মলগ্ন থেকেই মাতৃহারা। তাই ছোট থেকেই যেন বড্ড জেদি, একগুঁয়ে। একবার যেটা ভেবে নেয়, সেটা সে করেই ছাড়ে। একবার তো রাজদ্রোহের কবলে পড়তে পড়তেও বেঁচে গিয়েছিল, সেও তার পিতারই অনুকল্যাণে। কিন্তু তার পরেও বলকিনাথের কোনো পরিবর্তন হয় নি। তাই বৃদ্ধ পিতা একরকম হাল ছেড়ে দিয়েছেন। পুত্রের খবর রাখা তাঁর পক্ষে একপ্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু পিতার এই চিন্তার একফোঁটাও কি পুত্র বলকিনাথের মধ্যে প্রতিফলিত হয় ? বোধহয় না। নইলে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত পিতাকে ছেড়ে শিমুল পাহাড়ের গায়ে জঙ্গলের এই গোপন আস্তানায় এমন ঘোরতর সাধনায় মগ্ন হতে পারতো না।

বেদে বুড়ির কাছে তন্ত্রবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী না হওয়া পর্যন্ত তার শান্তি নেই। কাঞ্চনগড়ের রাজকন্যার কাছে সেই যেদিন অপমানিত হয়েছিল, তার পর থেকেই তাকে হস্তগত করতে উঠে পড়ে লেগেছে সে। সোজা উপায়ে হবে না জেনেই এই বাঁকা উপায়টি বেছে নিয়েছে।

আর নেবে নাই বা কেন ? কী দোষ ছিল তার ? বংশ কৌলিন্যে খাটো নাকি এক মামুলী মন্ত্রীর ছেলে বলে অবজ্ঞা, কোনটা ?

বলকিনাথের মনে হয় ওসব কিছুই না, রাজকুমারীর গুমোরই হল প্রধান কারণ তাকে তাচ্ছিল্য করবার।

অমন অপ্সরাতুল্য রূপ দেখে একদিন আচম্বিতে প্রেম নিবেদন করে বসেছিল সে। রাজকুমারী রঞ্জাবতী তখন সখীদের সাথে শিবমন্দিরে পুজো দিতে এসেছিলো। কোনো এক ফাঁকে কমল দীঘির পারে দাঁড়িয়েছিলো কয়েক মুহূর্ত। তখনই বলকিনাথ সামনে এসে দাঁড়ায়।

বলকিনাথের হঠকারী কথায় হয়তো একটু অসংলগ্নতা লক্ষ্য করেছিলো রাজকুমারী। প্রত্যুত্তরে মন্ত্রীপুত্রকে বলেছিল,
-" আপনার দুঃসাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। আপনি এক সামান্য মন্ত্রী পুত্র। আর আমি এই রাজ্যের রাজকন্যা।"

বলকিনাথ খানিকটা হতবাক হয়ে পড়ে প্রথমে। তার তো অন্য কোনো মতলব ছিলো না। সে প্রকৃত অর্থেই প্রেম নিবেদন করতে চেয়েছিলো। প্রেমের মানদন্ড যে কোনো কালেই জাতিভেদ বা বর্ণভেদে হয়না। 

বিস্মিত হয়ে বলকিনাথ বলে,
-" এ কী বলছেন রাজকুমারী ! প্রণয়ে কি গোত্র বিচার করা চলে ? তাছাড়া আমার তো কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই। আপনাকে আ..আমি যে...!"

রাজকুমারী গর্জে উঠেছিলো, " চুপ করো দুর্বিনীত। একজন বাগদত্তা রাজকন্যার সাথে এমন কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তার জন্য তোমায় আমি কী করতে পারি জানো ?"

-" না না রঞ্জাবতী। আপনি ভুল বুঝছেন। ওই রাজকুমার অপেক্ষা বেশি সুখী রাখবো আপনাকে আমি। এ আমার অঙ্গীকার রইলো।"
-" এতো সাহস ? ওই মুখে আমার নাম নিলে তোমার সর্বনাশ হবে। নীচ, আমি কিনা কাঞ্চনগরের মহারাজ অমর সিংয়ের কন্যা। আর তুমি এসেছ এই দুঃসাহস দেখাতে ! আজই তোমায় রাজদ্রোহের কারণে অভিযুক্ত করবো আমি। সৈন্য গণ বন্দী করো এই শয়তানকে।"
-" না না শোনো এ কাজ...এই এই কী করছো ছাড়ো", সেপাইদের চিৎকারে বলকিনাথের মিনতি চাপা পড়ে যায়। 

এক সামান্য মন্ত্রীর পুত্র কিনা সে রাজ্যের রাজকন্যার দিকে হাত বাড়ায়, তাও যেখানে রাজকন্যা বাগদত্তা। সৈন্যরা কোনোমতেই রেওয়াত করে না বলকিনাথকে।

টেনে হিঁচড়ে সকলের সামনে দিয়ে যখন মন্ত্রীপুত্রকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো, বলকিনাথ হুঙ্কার দিয়ে ওঠে,
-" ভুল করলে রাজকুমারী। এই অন্যায়ের প্রতিশোধ আমি নেবই। কাউকে ছাড়বো না আমি, কাউকে ছাড়বো না।"

..৪..

সেদিন কেউই নূন্যতম দয়া দেখায়নি বলকিনাথের প্রতি। বদলে তার কপালে দুর্বিষহ ঘৃণা আর অপমান জুটেছিলো অনবরত। 

রাগে দুঃখে হতাশায় পাগল হয়ে গিয়েছিল বলকিনাথ। কিছুতেই মানতে পারেনি সে এমন কান্ড হতে পারে তার সাথে। 

যদিও তেমন ক্ষতি তার হয়নি। কারণ তার পিতা প্রয়াগনাথ এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে সাময়িক সমস্যার সমাধান করেছিলেন। কিন্তু রাজাদেশে তাকে শহরের বাইরে স্থান দেওয়া হয়েছিল। সে একপ্রকার নির্বাসনই বটে।

তারপরেও লোকচক্ষুর আড়ালে পিতা প্রয়াগনাথ তাকে নিজগৃহে সকলের অজান্তে মাঝে মাঝে ডেকে নিয়ে আসেন, কিছুদিন রেখে দিয়ে অন্তঃত পিতৃধর্ম পালনের যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। শুধু বলকিনাথ যেন স্থির থাকতে পারে না। সর্বদাই প্রতিশোধ স্পৃহায় জ্বলতে থাকে। তাই নিভৃতে সাধনা করে চলেছে আজ বেশ কয়েক বছর। উদ্দেশ্য তন্ত্রবলে বলীয়ান হয়ে এই রাজ্য, রাজা, রাজকন্যার দ্বারা হওয়া যাবতীয় হেনস্থার বদলা নেওয়া।


বেদে বুড়ি এসে ধমক দেয় বলকিনাথকে,
-" ওইভাবে মন চঞ্চল করে হবে গা ? তোর নাকি সাধন হবে এইভাবে ?         ছো: !!!" 

বলকিনাথ অসহ্য ভাবে উঠে পড়ে। সত্যি তার মন অসম্ভব আনচান করছে। বার বার মনে হচ্ছে কবে তার শরীরের জ্বালা জুড়োবে, কবে তার প্রতিশোধ পূর্ণ হবে। এই সাধনা সফল হলে সে হবে যাবতীয় শক্তির অধীশ্বর। ভুত, প্রেত, ডাকিনী, শাখিনী সব হবে তার করায়ত্ত। কালাজাদুর একচ্ছত্র সম্রাট হবে সে। বনবে মহাযোগী বলকিনাথ। 

তারপর হাকিনী আহ্বানে ডেকে নিয়ে আসবে সেই রাজকন্যাকে। বশীভূত করে রাখবে। প্রথমে রাজা, তারপর গোটা রাজ্য সব একে একে প্রোথিত হবে তার চরণতলে। তখন রাজকন্যা কোন ছাড় ! কুৎসিত লোভে চিকচিক করে ওঠে তার দুচোখ।

 সঙ্গে সঙ্গে চমক ভাঙে বেদে বুড়ির কথায়,
-" বলি কালকের তিথি মনে আছে তো। কালই সেই বিশেষ তিথি। কৃষ্ণ পক্ষের অষ্টমী। তোর সাধনা সম্পূর্ণ হবে কাল।"

বলকিনাথ উদাস ভাবে উত্তর দেয় ,
-" জানি মা"
-" জানিস যখন এমন বিচ্ছিরি মুখ করে আছিস কেন রে হতভাগা?" বুড়ি দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ওঠে।

-" না না মা। ও কিছু না।"
-" শোন বাপু, মনের জোরটাই আসল। এমন চঞ্চল হলে চলবে না কো। বলি সব জোগাড় হয়েছে ?"
-" হ্যাঁ মা, আমার সব উপকরণ সংগ্রহ করা হয়ে গেছে", অস্থির ভাবে পায়চারি করতে করতে বলে উঠল বলকিনাথ। 

এই বেদে বুড়িকে সে মা বলেই ডাকে। তার কাছেই পেয়েছে তন্ত্রের গূঢ় মন্ত্রখানি। আজ সাধনায় শেষ লগ্নে সমস্ত উপকরণ সংগ্রহ করেছে। শুধু বাকি একটাই জিনিস। একটা লাশ। পূর্ণ বয়স্ক একটা মৃতদেহের ওপর করতে হবে শব সাধনা। তবেই পরিপূর্ণ হবে এতদিনের এত অক্লান্ত চেষ্টা।

..৫..

রাতের প্রহর কেটে যাচ্ছে দ্রুত। আরো গভীরতর অমানিশায় এই জঙ্গল ঢেকে যাচ্ছে। বেদে বুড়ির কথা অনুযায়ী আজই সাধনার শেষ চরণটি পূর্ণ করতে হবে। সাধনা একবার সফল হলেই এই পৃথিবীর সর্বোত্তম ক্ষমতাটি অর্জিত হবে। তারপর তার বদলা সম্পূর্ণ হবে। এরপরেই প্রয়োগ করবে একটি  মোক্ষম বাণ। মারণ ক্রিয়ায় রাজামশাই ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের বিনাশ করবে প্রথমে। তারপর যে রাজকন্যা তাকে একদিন তিরস্কার করেছিল, যার জন্য তাকে শহর ছেড়ে এতদূর পালিয়ে আসতে হয়েছে তাকে বশীভূত করে নিজের অভীষ্ট সিদ্ধি করবে সে।

বলকিনাথই হবে এই কাঞ্চনগড়ের পরবর্তী সম্রাট। আর রাজকুমারী রঞ্জাবতী হবে তার পাটরানী। আর যদি নিতান্তই বাধ সাধে বিধি, তবে রঞ্জাবতীকে নিজের পায়ের তলায় দাসী হিসেবে প্রক্ষেপ করবে। যে তার হতে পারেনি সে আর কারো হতে পারে না। কখনো না।

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল বলকিনাথ। লক্ষ্য নিকটেই। কিন্তু এই সর্বশেষ ধাপটাই হলো সবচেয়ে কঠিন। শবসাধনায় এতটুকু ভুল ত্রুটি সাধকের মৃত্যু পরোয়ানা ডেকে আনতে পারে।

 বেদে বুড়ি তাকে অঘোর মার্গে এই সাধনার কথা বলেছে। লাশ কোনো স্ত্রীর হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু এই পাণ্ডব বর্জিত এলাকায় হঠাৎ করে মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া খুব মুশকিল। এদিকে শহরে ঢোকার উপক্রম করলেই রাজপেয়াদার হাতে পড়ার সম্ভবনা বিলক্ষণ রয়েছে। তাহলে উপায় ?

সাতপাঁচ চিন্তা করতে করতেই হঠাৎ একটা ক্রূর চিন্তা খেলে গেলো বলকিনাথের মাথায়।

মনে মনে বলকিনাথ ভাবলো, এর পর হয়তো দুনিয়া তাকে বিশ্বাস ঘাতক বলবে। সে বলুক, বলকিনাথ থোড়াই ওসবের তোয়াক্কা করেছে কখনো। আর যে উপায় নেই। এই নৃশংসতাই অঘোর মার্গের প্রথম শিক্ষণ। আজ নাহয় হোক তার মহরত।

ধীর পায়ে বলকিনাথ এগিয়ে গেলো বেদে বুড়ির কাছে।

-" এসেছিস ?", চোখ বুজেই বলে উঠলো বেদে বুড়ি।

বলকিনাথ প্রচন্ড সংযত কন্ঠে বললো, " আদেশ করুন মা।"

বুড়ি চোখ বুজে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসেছিলো এতক্ষণ। এবার চোখ খুলে বললো, " বোস এখানে। সবকিছু জোগাড় হয়েছে? পাঁঠার মাংস, মদ ভুজ্জি ?"
" হ্যাঁ মা। সব কিছু", বললো বলকিনাথ।
" বেশ, আর মড়াটা এনেছিস ? বাসী পচা আনিস নি তো ?"

বলকিনাথ চুপচাপ রয়েছে দেখে বেদে বুড়ি ধমকে ওঠে,
-" কীরে আঁটকুনির ব্যাটা, মড়া এনেছিস ?"

বলকিনাথের চোখ দুটো চকচক করে উঠল। অশীতিপর বুড়ির বয়স তো কম হয়নি। মন্ত্র যা শেখার তা শিখেই নিয়েছে। এখন বুড়িকে রাস্তা থেকে সরাতে পারলে তারই লাভ। তাহলে তন্ত্রসাধনায় তার সমতুল্য আর কেউ থাকবেনা। মনে মনে এতক্ষণ যা ফন্দি এঁটেছিলো, সেটা প্রতিপন্ন করতে মনস্থির করলো এক লহমায়।

ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে এসে সজোরে তার গলাটা চেপে ধরল বলকিনাথ। একফোঁটা চিৎকার করার সময় পেল না বুড়ি।
দাঁতে দাঁত চেপে বললো বলকিনাথ, 
-" মড়া তো আমি তোকেই বানাবো রে বুড়ি। তারপর তোর ওপরেই আমি সাধনা করবো।"

দম আটকে এলো বেদে। অতিকষ্টে ' শয়তান' শব্দটা বললো অস্ফুটে। দুই কষ বেয়ে তখন গ্যাজলা বেরিয়ে গেছে। কিন্তু বলকিনাথের বলিষ্ঠ দুই হাত থেকে রেহাই মিললো না বুড়ির।

কয়েক মুহূর্তের ছটফটানি, তারপরই সব শেষ।

..৬..

শাল্বকুমার ও তার সেনাবাহিনী ততক্ষণে নৈশঅভিযানে বেরিয়ে পড়েছে। লক্ষ্য একটাই- এতদিন ধরে ঘটে আসা নানাবিধ অপহরণ ও অপরাধের বিনাশ সাধন যা বেশ কিছুদিন ধরেই হয়ে চলেছে জঙ্গলের কোনো অজ্ঞাত আততায়ীর দ্বারা।

পথ বিপদসংকুল। তাতে আবার শ্বাপদের ভয়ও রয়েছে। কিন্তু শাল্বকুমার অবিচল ভাবে এগিয়ে চলেছে। যেভাবেই হোক অভীষ্ট লক্ষ্যে তাকে পৌঁছতে হবেই। মহারাজকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির অমর্যাদা কোনো মতেই করবে না সে।

বৃদ্ধ প্রয়াগনাথও এই অভিযানে শাল্বকুমারের সাথে রয়েছেন। তাঁর সন্দেহ আপন পুত্রের প্রতিই। সে যে তন্ত্র সাধনার জন্য নরবলি দিতেও পারে, এমনটা অনেক দিন ধরেই সন্দেহ করেছিলেন তিনি। একদিন এক বেদে বুড়ির সাথে জঙ্গলে দেখেওছিলেন পুত্রকে। তাদের উপাচার দেখে বড়োই আশ্চর্য হয়েছিলেন। বিভিন্ন মরা পশুপাখির হাড় মাংস আর রক্ত। এ কি স্বাভাবিকতার লক্ষণ ? মোটেও না। তবে কি কোনো নিষিদ্ধ তন্ত্রের প্রতি ঝুঁকেছে সে ? কে জানে! প্রশ্ন করেও সদুত্তর মেলেনি পুত্রের কাছ থেকে।

প্রয়াগনাথ জানেন যে পথ সে অবলম্বন করেছে তা শুধু ভয়ঙ্কর নয় ঘৃণ্যও বটে। তাই যতই তিনি পিতা হন, দেশের স্বার্থে, দশের কল্যাণে যদি নিজের পুত্রকে সাজা দিতেও হয়, তাও তিনি পিছপা হবেন না। 


ওদিকে বলকিনাথের শব সাধনার সমস্ত উপকরণ প্রস্তুত। প্রথমে বুড়ির লাশটাকে ভালো করে সুগন্ধী জল দিয়ে স্নান করিয়ে ধুপ ও ধুনো দিয়ে শোধন করে যথাস্থানে এনে রাখলো।

রাতের শেষ প্রহর আসন্ন। এবারে বলকিনাথ বসবে সাধনায়। একে একে সমস্ত উপাচার গুছিয়ে নিয়ে বসল। তার পরনে কৌপিন। সামনে জ্বলছে ধুনীর আগুন। সামনে কোনো প্রাণীর রক্ত সমন্বিত একটি পাত্র। সেই থেকে একটু রক্ত কনিষ্ঠ আঙ্গুলে নিয়ে তাই দিয়ে আঁকল এক একটি ত্রিভুজ। তারপর ঠিক উল্টো করে আরো একটি ত্রিভুজ এঁকে চক্রাকারে পরিবৃত করল যা দিয়ে আসলে ছটি কোণকে ঘেরাটোপ দেওয়া হল। দুটি ত্রিভুজ থেকে উৎপন্ন ছটি কোণেই রাখা হল বিচিত্র উপকরণ- সাপের লেজ, ইঁদুরের পা, মোষের মাংস প্রভৃতি ছটি বস্তু।

তারপরই মৃতদেহ থেকে এক খন্ড মাংস ও দেহরোম নিয়ে ধুনীর আগুনে অর্পণ করল। শুরু হলো এক ভয়ংকরতম সাধনা- হাকিনী সাধনা।

বলকিনাথ উঠে বসলো শবের ওপর। তারপর দুই হাতের তর্জনী ও কনিষ্ঠ আঙ্গুল নিজের নাভীদেশের কাছে এনে পরস্পরের সাথে ছোঁয়াল। মনে মনে কল্পনা করতে লাগলো এক বিশেষ অন্ত্রের- রক্তসূর্য্যচক্র। আর শুরু হল গুরুগম্ভীর গলায় এক হাড়হিম করা পুজো পাঠ। প্রথমে মায়ের পুজো, চিবিয়ে চিবিয়ে কর্কশ কণ্ঠে উচ্চারিত হতে লাগলো এক একটি মন্ত্র-

।। ওঁ শ্রীঁ ক্লীঁ হ্রীঁ ঐঁ বজ্রবৈরোচনীয়ে হুঁ হুঁ ফট্ স্বাহা ।।
।। ওঁ শ্রীঁ ক্লীঁ হ্রীঁ ঐঁ বজ্রবৈরোচনীয়ে হুঁ হুঁ ফট্ স্বাহা ।।


তারপরই এক অশরীরির আবাহনী মন্ত্রে রাতের বনভূমি শিহরিত হয়ে উঠতে লাগল বারবার। সেই সাথে ধুনীর আগুনে নিক্ষিপ্ত হতে থাকল একের পর এক আহুতি। 

এ এক অনন্য সাধনা। সফল হলে মোক্ষলাভ, নইলে নিশ্চিত মৃত্যু।

সাধনার  অন্তিম লগ্নে চূড়ান্ত মোক্ষের আশায় কাতর হয়ে শবের উদ্দেশ্যে পুষ্প অর্পণ করতে লাগলো সে। বুঝতেও পারল না কখন তার শিয়রে এসে উপস্থিত হয়েছে শাল্বকুমার ও তার সেনাবাহিনী।

প্রয়াগনাথ নিজের পুত্রকে এই অবস্থায় দেখে চমকে উঠলেন। বুড়ির মৃতদেহ দেখেই তাঁর বুঝতে বাকি রইল না এখানে ঠিক কী হচ্ছে। সামনেই হাঁড়ি কাঠ। হয়তো বাচ্চাগুলোর বলি দেওয়া হয়েছিল এখানেই। তাঁর পুত্রই তবে হত্যাকারী!

শাল্বকুমারের আর তর সইলো না। কোমর থেকে অসি বের করে তছনছ করে দিতে লাগলো সমস্ত উপকরণ পুজো সামগ্রী। 

ঠিক তখনই চোখ খুলল বলকিনাথ।

দুচোখে যেন নরকের আগুন জ্বলছে তার। চিবিয়ে চিবিয়ে প্রশ্ন করল,
-" কে তুই ? এত বড় সাহস আমার পুজোর জিনিস ভেঙে দিস !"

শাল্বকুমারের চোখে ভয়ের লেশমাত্র নেই। গর্জে উঠলো, 
-" বন্ধ করো এসব পুজো পাঠ। একের পর এক বাচ্চা এই জঙ্গলে উধাও হয়েছে। তুমি নির্ঘাত জানো সে ব্যাপারে। বলো আমায় ? কী করছো এসব?" 

হিমশীতল কন্ঠে কথাগুলো শুনেও কোনও উত্তাপ দেখা দিলো না বলকিনাথের অন্তরে। তখনও ভাঁটার মত জ্বলছে তার দুই চোখ। তার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না যে এমন ঘোরতর জঙ্গলেও তাকে বাধার মুখে পড়তে হবে।

শাল্বকুমার উদ্যত তলোয়ার দেখিয়ে আবারও বলল,
-" চুপ করে থেকো না। বলতে তোমাকে হবেই। নইলে সাক্ষাৎ মৃত্যু। ওই হাঁড়িকাঠ প্রমাণ করছে তুমি নরবলি দিয়েছ নির্ঘাত।"

অদূরে একটা হাঁড়িকাঠের দিকে নির্দেশ করলো শাল্বকুমার

বলকিনাথ বিশ্রী হেসে জবাব দিল,
-" রাজকুমার তুমি জানো না কী করছ। ওই বাচ্চারা কেউ মরে নি। ওদের মায়ের কাছে অর্ঘ্য দিয়েছি। মা ওদের রক্তপান করে খুশি হয়েছেন। "

প্রয়াগনাথ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তার মানে তাঁর সন্দেহই সঠিক। বলকিনাথই এসবের মূলে রয়েছে। যাকে তিনি রাজরোষ থেকে বাঁচিয়েছিলেন, যে তাঁর আপন রক্ত সেই কিনা এত বড় ষড়যন্ত্রে সামিল! কিন্তু এই মৃতদেহটি কার ? মনে হচ্ছে এ সেই বেদে বুড়ি! একেও কি তাঁর পুত্রই হত্যা করেছে ? কিন্তু এসব কেন করেছে সে, তার কিছুই বুঝতে পারছেন না তিনি।

উত্তর অবশ্য তিনি শীঘ্রই পেলেন। শাল্বকুমারের অস্ত্র দেখে বিন্দুমাত্র ভীত না হয়ে বলকিনাথ বলে উঠল,
-" এই রাজ্য আর তোদের থাকবে না। সাধনাবলে আমিই হবো অধীশ্বর। তাই বলছি সরে যা। বাধা দিলেই মায়ের কোপ নেমে আসবে এই রাজ্যে। এই যে দেখছিস বেদে বুড়ির লাশ। এই আমার গুরুমা। আজ তাঁর দেহের ওপর সাধনা করেই আমার অপমানের বদলা নেব। আমি তন্ত্র সাধক বলকিনাথ। আমার পুজোয় বিঘ্ন ঘটাতে আসিস না।"

শাল্বকুমার রাগে ফুঁসছিলো। এতবড় কথা। রাগত কন্ঠে বলে উঠলো
- " শেষবারের মত বলছি এসব বন্ধ করে চল আমার সাথে। তুমি যা করছ তা অন্যায়।"

-" আর রঞ্জাবতী যে আমায় সেদিন তিরস্কার করল সেটা অন্যায় নয় ? কী দোষ আমার ? আমি মন্ত্রী পুত্র এটাই আমার অপরাধ ?" রক্তচক্ষু হয়ে বললো বলকিনাথ। 

শাল্বকুমার এই কালা সাধনার উপাসকের মুখে তার নিজের বাগদত্তার নাম শুনে থমকে গেল। এত বড় সাহস! তার সামনে তারই প্রেমিকার নাম নেয়। নাঃ এর কোনো ক্ষমা নেই। এই পাপিষ্ঠ খুনি, অপহরক, বিশ্বাসঘাতক। এর শাস্তি একটাই, মৃত্যু।

প্রচন্ড রাগে দিশাহারা হয়ে বললো শাল্বকুমার,
-" কী বললি তুই শয়তান ? রঞ্জাবতীর নাম মুখে আনিস ? এত বড় আস্পর্ধা ?"

হা হা করে হাসতে থাকে বলকিনাথ। তারপর সাপের মতো হিসহিসে গলায় বলে ওঠে,
- " শোন রে মূর্খ। তোদের দিন ঘনিয়ে এসেছে। আমার পিতার মতো কাপুরুষ আমি নই। রঞ্জাবতীকে আমি বশীভূত করেই ছাড়বো। ওকে আমি না পেলে কাউকে পেতে দেবো না আর। আমার সাধনায় বিঘ্ন ঘটিয়েছিস। কাউকে রেহাই দেব না।"

..৭..

দূর থেকেই এসব শুনছিলেন প্রয়াগনাথ। বিপদ আসন্ন দেখে ছুটে এলেন। তারপর নিজের পুত্রের এই সাংঘাতিক কার্যকলাপ দেখে খানিকক্ষণ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর বললেন,
-" এ কী অনাসৃষ্টি করছিস বলকি! এ কাজ করিস না। ক্ষমা চা এখুনি, আমি বলছি তুই এখনই ক্ষমা চাইবি।"

বলকিনাথ তখন উন্মাদ হয়ে উঠেছে। বললো,
-" কীসের ক্ষমা? তোমরা সবাই নিকৃষ্ট। এমনকি তুমি নিজেও পিতা। তোমাদের জন্যই আজ আমি এখানে। রাজা রাজ্য রাজকন্যা কিছুই আমার সাথে নেই। কিন্তু আমিও ছাড়ব না। সব কিছু এই সাধনবলেই করায়ত্ত করব। হাকিনী কে আহ্বান করবো আমি।"

শাল্বকুমার খানিক থমকে গেছিল প্রয়াগনাথকে দেখে। এই ঘৃণ্য লোকটি মন্ত্রী মশাইয়ের পুত্র !

প্রয়াগনাথ কিন্তু চিনতে পারেন না তাঁর আপন পুত্রকে। এত জিঘাংসা জমেছিলো তার মনে! এতো বিদ্বেষ! এ যে ক্ষতি বই অন্য কিছু করবে না কারো। নাঃ বলকিনাথ ক্ষমারও অযোগ্য। 

আরক্ত নয়নে তিনি রুখে দাঁড়ালেন পুত্রের সামনে। বললেন,
- "তবে রে শয়তান! তোর এত সাহস ? কী ভেবেছিস তুই হাকিনী আহ্বানে সবাইকে বশীভূত করবি? তাহলে শোন। আমিও এক ন্যায় নিষ্ঠ ব্রাহ্মণ। আমার কাছে দেশ আগে, কর্তব্য আগে। এই হাকিনী ডাকিনী এদের ওপরেও আছেন আর এক মহাশক্তি। মহাডামরি ভৈরবী। তিনি পরব্রহ্ম। মহাকালের ধারক। তাঁর উপাসক আমি। আমায় তুই ভয় দেখাচ্ছিস ? যতই তুই আমার পুত্র হ, তোর পাপের ভাগীদার আমি অবশ্যই হতে পারি না।"

-" রঞ্জাবতী আমার। তাকে কাউকে পেতে দেব না। সে শুধুই আমার। আমায় তিরস্কার করলেও আমি তাকে ছাড়বো না। কেউ আটকাতে পারবে না। দেখি তুমি কতবড় শক্তির উপাসক", বলেই বলকিনাথ আবারো সাধনার প্রস্তুতি নিতে উদ্যত হয়।

শাল্বকুমার এতক্ষণ সবই শুনছিলো। এতক্ষণ মন্ত্রী পুত্র বলে খানিক আড়ষ্ট হয়ে পড়লেও ওই কথা গুলো শুনে আর নিজেকে সামলাতে পারল না। রাজধর্ম আগে, তারপর বাকি সমস্ত।

- " তবে রে শয়তান", বলে সবেগে অসি চালনা করল সে বলকিনাথের দিকে। 

কিন্তু ধূর্ত বলকিনাথ বোধহয় তৈরি হয়েই ছিলো। মুহূর্তে সরে গেলো নিজের পিতার দিকে। তারপরই পার্শ্ববর্তী এক সৈনিককে সপাটে ধাক্কা মেরে তার তরোয়াল হস্তগত করে আপন পিতাকেই পেছন থেকে জাপটে ধরে অসিখানা প্রয়াগনাথের কন্ঠনালীর একদম কাছে ধরে শান্ত গলায় বললো,
- " রাজকুমার আমায় তুমি এখনো চেনো নি। সাধনায় বিঘ্ন ঘটালে আমি ছেড়ে কথা বলবো না। তার জন্য নিজের পিতাকেও রেওয়াত করবো না আমি।"

সহসা এমন পরিস্থিতিতে শাল্বকুমার থতমত খেয়ে গেলো। লোকটা এভাবে প্রতি আক্রমণ করবে এ যে ধারণার অতীত। 

প্রয়াগনাথ তখনও রাগে ফুঁসছিলেন। ওই অবস্থাতেই বললেন, 
-" থামলে কেন কুমার। চালায় অসি। আমি মরলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু এই নরাধমটিকে শেষ করে দাও। ওটাই রাজাদেশ, সে যতোই আমার পুত্র হোক না কেন।"

আপামর সৈন্য সামন্তরাও থমকে গেছে। কী করবে কেউ কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। বলকিনাথ অসম্পূর্ণ সাধনা ছেড়ে নিজের কুটিল বুদ্ধিতে সকলকে কাবু করে ফেলেছে। শাল্বকুমারও অসহায়ের মতো তাকিয়ে। 

বলকিনাথ আবার বলে উঠলো, 
- " এবার কী করবে রাজকুমার? রক্তপাত হবেই। কিন্তু মরবে তোমরা। আমিই..." 

বলকিনাথের কথা শেষ হলো না। অকস্মাৎ ঝড় উঠলো যেন। সেকি হাওয়ার তান্ডব! এই নিবিড় অরণ্যে প্রতিটি গাছ এমন প্রচন্ড দুলতে লাগলো যেন প্রলয় এসেছে। আর ঠিক তখনই সবার চোখ পড়লো সেই বেদে বুড়ির মৃতদেহের ওপর। 

একি! সেটা যে এখন সটান উঠে বসেছে। মুখে প্রচন্ড এক রাগ, তীব্র ঘৃণার আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। চোখ দুটো লাল। মরা মানুষের দেহে যেন নতুন করে প্রাণ সঞ্চার হয়েছে আবার। 

বলকিনাথ পর্যন্ত এ দৃশ্য দেখে চমকে উঠলো। সে হাঁ হাঁ করে সাধন স্থলের দিকে দৌড়লো। কিন্তু না , ততক্ষনে যা হবার তা হয়ে গেছে। হাকিনী তন্ত্রে অসম্পূর্ণ সাধনা মহাবিপদ ডেকে আনে। আর তার জন্য সবথেকে বড় মাশুল দিতে হয় স্বয়ং সাধককে। 

 হাকিনী এখন বেদে বুড়ির দেহে অধিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সে যে ক্ষুধার্ত। তাকে যে সাধনপ্রক্রিয়ায় ডাকা হয়েছে তাতে খুঁত থেকে গেছে। এবারে যে বলকিনাথকে তার পরিণাম ভুগতেই হবে।

প্রচন্ড হাওয়ার দাপটে ছিটকে পড়লো বলকিনাথ। চারদিকে ভয়ানক সব চিৎকার, অশরীরিদের আর্তনাদ আকাশ বাতাস বিদারিত করে দিচ্ছে। বলকিনাথ হাজার চেষ্টা করেও উঠতে পারলো না।  

হাকিনীকে নিয়ন্ত্রণ করা অতি বড় তান্ত্রিকেরও অসাধ্য। বলকিনাথ সেখানে কোন ছাড়! 

বেদে বুড়ির দেহটা এখন শূন্যে উঠে ভাসছে। এক নারকীয় হাসি তার মুখে। কুৎসিত কদাকার সেই মুখ কী বীভৎস ! যেন পাতাল থেকে উঠে আসা এক রাক্ষুসী।

 হঠাৎই প্রচন্ড রাগে, সেই ভয়াল দর্শন প্রেতযোনী ঝাঁপিয়ে পড়লো বলকিনাথের ওপর। 

তারপর সজোরে তার ঘাড়টা ধরে উল্টো দিকে মোচড় দিয়ে দিল। বলকিনাথের কোনো কিছুই করার অবকাশ রইলো না। চলচ্ছক্তিহীন দেহটা সটান ভূপাতিত হল। সঙ্গে সঙ্গেই একটা ধোঁয়ার কুন্ডলি বেদে বুড়ির শরীর থেকে বের হয়ে পাক খেতে খেতে আকাশে মিলিয়ে গেলো।

একটা আর্তনাদ আর ধপ করে একটা শব্দ হতেই প্রয়াগনাথ দেখলেন তার পুত্র ধরাশায়ী হয়ে পড়ে রয়েছে। একটা রুধির ধারা ফিনকি দিয়ে বের হলো বলকিনাথের মুখ থেকে।

প্রয়াগনাথ আর পারলেন না নিজেকে ধরে রাখতে। পুত্রের এমন অবস্থায় ভেঙে পড়লেন তিনি। হোক সে তান্ত্রিক, কালা জাদুর অধিকারী, হোক সে রাজদ্রোহি; তবুও তো সে তার পুত্র। বলকিনাথের ভূপাতিত দেহ আঁকড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন প্রয়াগনাথ। তখনও সে দেহে অল্প প্রাণের লক্ষণ রয়েছে। ঠোঁট দুটো অল্প ফাঁক করে মৃত্যুপথযাত্রী বলকিনাথ বলে উঠল,
-" সব মরবে, মহামারী হয়ে শেষ হয়ে যাবে। এ আমার অভিশাপ। রঞ্জাবতী শুধুই আমার। এ জন্মে , পরের জন্মে, সব জন্মে। "

তারপরই সব শেষ। চারিদিক শান্ত হয়ে এলো। গভীর অরণ্যের এই নিভৃতস্থানে পড়ে রইলো এক ভয়ঙ্কর উপাসকের দেহ আর কয়েকটা মানুষজন। সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছু মহীরুহ আর অন্ধকারের এক মিশমিশে আচ্ছাদন। 

শাল্বকুমার কোনো ভাষা খুঁজে পেল না প্রয়াগনাথকে সান্ত্বনা দেবার। শুধু অন্ধকারে নিভু নিভু ধূনির আগুনের ম্লান আলোয় দেখলো বৃদ্ধ প্রয়াগনাথ অসহায়ের মতো আকুলি বিকুলি করছে। আজ যে তিনি নির্বংশ হলেন।

..৮..

কিন্তু কাঞ্চনগড় রক্ষা পায়নি এরপর। বলকিনাথের কালাজাদুর প্রভাব ছিল অমোঘ। বেদে বুড়ি তাকে কিছু তন্ত্র গুণ নিশ্চই প্রদান করেছিলো; তাই বোধহয় কিছুদিনের মধ্যেই এক সাংঘাতিক মহামারী গ্রাস করল গোটা কাঞ্চনগড়কে। 

কেউ বাঁচে না। একে একে সব প্রজা, এমনকি রাজপরিবারের সকলেই প্রাণ হারালো। সবশেষে রঞ্জাবতীও সেই ভয়াবহ মহামারীর শিকার হয়ে অভিশাপের কলা পূর্ণ করল। ধ্বংস হয়ে গেল কাঞ্চনগড় নগরী। 

বেঁচে রইলেন শুধু প্রয়াগনাথ। কেন জানি না মহামারীর প্রকোপ তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি। হয়তো পুত্র হয়ে এমন কিছু করে গিয়েছিল বলকিনাথ যাতে একমাত্র তার পিতাই বেঁচে থাকে, নাকি সকলকে মরতে দেখে পিতাকে তার সাক্ষী হয়ে থাকবার অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিলো তা ঈশ্বরই জানেন। সে ছিলো এক মহাতামসের উপাসক। রক্ত ছাড়া যে অর্ঘ্য দিতে পারতো না। চেয়েছিলো মহামোক্ষ। বদলে জুটেছিল ভয়ানক এক মৃত্যু। মরণ যাত্রায় দেওয়া কালাভিশাপ ফলে গিয়েছিল অক্ষরে অক্ষরে। 

প্রয়াগনাথের আর কোনো খবর পাওয়া যায় নি। তবে কানাঘুষো শোনা যায় তিনি নাকি পরে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। সব কিছু চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে দেখে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন একসময়। 

কেউই সঠিক বলতে পারে না তাঁর সম্বন্ধে। শুধু আশপাশের অনেক জায়গায় আজও আড়াইশো বছর পরে কান পাতলে শোনা যায় এক অসহায় বৃদ্ধের কাতর আর্তনাদ, এক অপরিসীম হাহাকার। যিনি সবকিছুর বিনিময়ে নিজের কর্তব্যে অবিচল থাকতে চেয়েছিলেন। হয়তো এই ভীষন কর্তব্যপরায়ণতাই তাঁর জীবনে এক ভয়ংকর অভিশাপ হয়ে নেমে এসে সবকিছু ছাড়খার করে দিয়েছিলো।

সমাপ্ত।
অলঙ্করণ :-  প্রিয়াঙ্কা সরকার
 

 

ধারাবাহিক - মহাপ্রস্থানের পথে - -অয়ন দাস

 

ধারাবাহিক
 
 
 
 মহাপ্রস্থানের পথে
অয়ন দাস


 
|| অষ্টম  পর্ব  ||


 -৪০-

বিপদ কখনো বলে কয়ে, দিন ক্ষন মেনে আসে না। সেটা আসে অতর্কিতে, আচমকা।
ওসলা পৌঁছে, সেখানে তাঁবু ভাড়া করে গোটা রাতটা কাটিয়ে দেবার পরও যখন কোনো সমস্যা হলো না, শ্রীময়ীরা একটু নিশ্চিন্ত ভাবে ব্যাপারটা হাল্কা ভাবে নিয়েছে, তখনই গোলমালটা হলো।

সকালে ওসলাতে বেশ খোঁজখবর করা হলো খানিকটা। কিন্তু শঙ্কর বাবুর কোনো হদিশ পাওয়া গেলো না। কাজেই এর পরবর্তী গন্তব্য, হর কী দুনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো ওরা। এপথ আরো বেশি বিপদ সঙ্কুল। যত ওপরে চলেছে ওরা, জঙ্গল যেন আরো বেশি বৈচিত্র্যময় ময় হয়ে ধরা দিচ্ছে। পাইন, সিডার, ওকের বনে মেঘের দল খেলা করছে মাঝে মাঝেই। আজও একদম সামনে গাইড ছেলেটি, আর ওর পেছনে শ্রীময়ী। সবশেষে রাতুল আর ডঃ শর্মা। লোকজনের ভিড় একেবারে নেই বললেই চলে।

শ্রীময়ীর মনে কালকের মতোই খটকাটা যেন বার বার এসে ধাক্কা দিচ্ছে। কোথায় যে গোলমাল টা হচ্ছে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। হর কি দুনের প্রায় কাছাকাছি এসে এবারে ধাঁ করে মনে পড়ে গেল। প্রফেসর নন্দীর হত্যা রহস্যের সময় যখন ওনার সেক্রেটারিকে জেরা করছিলো শ্রীময়ী, সেক্রেটারি ছেলেটির ঘাড়ের কাছে একটা বিশেষ উল্কি দেখেছিলো। সূর্যোদয়ের উল্কি আঁকা যেটা হুবহু এখন এই গাইড ছেলেটার ঘাড়ের কাছে দেখতে পাচ্ছে। এবার বুঝতে পারলো কেন ওর সন্দেহ হচ্ছিলো এতক্ষণ। তার মানে কাল থেকে যে গাইড সেজে এতদূর নিয়ে এলো সে বিকাশ ওরফে বৃষকেতু। আর তাই যদি হয় সুশান্ত বাবুর আশেপাশে থাকাটাও আশ্চর্যের নয়।

খানিক এগিয়েই শ্রীময়ী থমকে দাঁড়ালো। রাতুল আর ডঃ শর্মা কে ইশারায় থামতে বললো। ইতিমধ্যে বৃষকেতু খানিকটা এগিয়ে গেছে। কী সন্দেহ হওয়ায়, থমকে পিছন ফিরে তাকালো।

শ্রীময়ী ইস্পাত কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস বললো, " ছদ্মবেশে আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না বিকাশ বাবু ওরফে বৃষকেতু সিং। ঠিক কী মতলবে আমাদের সাথে এতটা এলে বলোতো ?"

বৃষকেতু কিছু বলার আগেই দেখতে পেল শ্রীময়ীর হাতে মুহূর্তের মধ্যে একটা পিস্তল এসে পড়েছে। সেটা উঁচিয়ে ধরে কথাগুলো বলছে শ্রীময়ী।

-৪১-

বৃষকেতুর মুখে ক্রূর একটা হাসি খেলা করছে। বুঝতে পারলো আর লুকিয়ে লাভ নেই। এক এক করে নকল দাড়ি গোঁফ পাগড়ি খুলে ধীর কন্ঠে বললো, " সত্যের খোঁজে এসেছি ম্যাডামজী। আমার পরিবারের একটা জিনিস এতদিন ধরে লুকিয়ে রাখা হয়েছে সেটার খোঁজ যে আমার চাই।"
-" শাট আপ", ফোঁস করে ওঠে শ্রীময়ী, " একটা খুনীর মুখে এসব সত্যের কথা মানায় না। এবারে তোমার ভবলীলা সাঙ্গ হবার সময় হয়েছে যে। "

বৃষকেতু নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পিস্তলের সামনেও সেভাবে ভ্রূক্ষেপ করছে না সে। শ্রীময়ীর পেছনে রাতুল আর ডঃ শর্মা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

এমন সময় একটা কান ফাটানো শব্দ হলো, মনে হলো যেন কোনো বিস্ফোরণ হলো। শব্দের অভিঘাত এতটাই ছিলো যে বেশ কয়েকটা পাথর পাশের পাহাড়ি ঢাল দিয়ে গড়িয়ে পড়লো।

পরমুহূর্তেই শ্রীময়ী হাত চেপে ধরে বসে পড়লো। একটা গুলি ওর পিস্তল ছুঁয়ে চলে গেল আর পিস্তলটা বেশ কিছুটা দূরে ছিটকে পড়লো। সজোরে একটা প্রতিঘাত নিমেষে শ্রীময়ীকে কাবু করে দিলো।

পাহাড়ের আড়াল থেকে একটা রিভলবার নিয়ে বেরিয়ে এলেন সুশান্ত সেনগুপ্ত। এতক্ষন আড়াল থেকে সবটা প্রত্যক্ষ করছিলেন। এবার মওকা বুঝে আত্মপ্রকাশ করলেন এই গোটা কর্মকান্ডের আসল খলনায়ক।
-" অনেকক্ষণ ধরেই নাটকটা দেখছি ম্যাডাম। এবারে যে আমার হাতেই যবনিকা পড়বে এ নাটকের", চিবিয়ে চিবিয়ে কথা গুলো বললেন সুশান্ত সেনগুপ্ত।

-" স্কাউন্দ্রেল, কী ভেবেছেন এত করে পার পেয়ে যাবেন ? তাহলে আপনার ধারণা ভুল মিঃ সেনগুপ্ত", ব্যথায় অধীর হয়ে গিয়েও শ্রীময়ী নিতান্ত মনের জোরে এখনো কথাগুলো বলার সাহস পাচ্ছে।

রাতুল ক্রমশ পিছিয়ে আসছিলো। গুলির শব্দে যেখানে পাথর গুলো পড়েছিল, সেদিকেই এক পা এক পা এগোচ্ছিল এমনভাবে যাতে কেউ বুঝতে না পারে। অন্তঃত একটা পাথরও এ অবস্থায় সাংঘাতিক কোনো অস্ত্র হতে পারে, এটা ওর মনের কোণে ঘুরছিলো। কোনভাবে যদি কিছু করা যায়....।

বৃষকেতু দাঁড়িয়ে রয়েছে চুপ করে। অপেক্ষা করছে পরবর্তী আদেশের জন্য। সুশান্ত বাবু আরো এগিয়ে এলেন খানিকটা। জিভ দিয়ে চুক চুক করে একটা বিশ্ৰী শব্দ করে বললেন, " তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি শ্রীময়ী ব্যানার্জি। এই অবস্থাতেও তোমার মুখে এত বড় বড় কথা বলতে সাহস পাচ্ছ কী করে ? কিন্তু আর যে সময় দেওয়া যাবে না। বৃষকেতু তোমার ফেলে রাখা কাজ টা এবার সেরেই ফেলো আর দেরি কেন। আগে ওই ছেলে মেয়ে দুটোকে খতম কর। তারপর ডঃ শর্মার কাছ থেকে ফলকটা উদ্ধার করতে হবে যে। ওই ফলকের মধ্যেই লুকিয়ে সেই মহা শক্তিশালী অস্ত্রের বীজমন্ত্র যা ব্যবহার করলে গোটা পৃথিবীকে নিজের পদতলে আনা যায়। কম সাধনা করিনি এই পঁচিশ বছর ধরে। আজ আমার সেটা চাই। খালি হাতে তো আর আমি ফিরবো না।"

-৪২-

ডঃ শর্মা চিৎকার করে বললেন, " আপনি পাগল হয়ে গেছেন। ওভাবে কেউ কোনো বীজমন্ত্র দিয়ে কিছু করতে পারে না। তারজন্য দরকার হয় এক গুহ্য জ্ঞানের, কঠিন তপসাধনার যার কোনটাই আপনার মধ্যে নেই।"
-" আঃ... চুপ একদম। বৃষকেতু দেরি করো না। যা বলছি করো", বলে উদ্ভ্রান্তের মতো শূন্যে গুলি চালালো সুশান্ত বাবু।

গুলির শব্দ আর তার মুহুর্মুহু প্রতিধ্বনি কান যেন ঝালাপালা করে দেয়। বৃষকেতু এগিয়ে আসতেই রাতুল একদম পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। এরই মধ্যে দুটো পাথর সবার অলক্ষিতে হাতে তুলে নিয়েছে সে। শ্রীময়ীকে দেখে কষ্ট লাগছিলো। বেচারা রীতিমতো কাতরাচ্ছে যন্ত্রণায়।

ডঃ শর্মা বললেন, " বৃষকেতু তোমাকে দেখে আমার ভূদেব সিংয়ের ছেলের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। মুখের আদল কী সাংঘাতিক এক রকম যা এই পঁচিশ বছর পরও বার বার ভাবাচ্ছে আমায়। তুমি যেই হও, জেনে রেখো ভূদেব সিংয়ের মৃত্যু একটা হত্যা কান্ড ছিলো। আর তার জন্য দায়ী এই সুশান্ত সেনগুপ্ত। সেদিন আগুন লাগিয়ে ফলকটা হাতানোর তালে ছিলো কিন্তু পারেনি। আজ আবার সেটা নিতে এত কাঠখড় পুড়িয়ে এখানে এসেছে। কিন্তু জেনে রেখো সেটা সুরক্ষিত আছে। কোনো বিপদের আঁচ এসে লাগেনি।"

বৃষকেতু থমকে দাঁড়ালো। এ কী শুনছে সে। এতদিন যা যা শুনে এসেছে সব বুঝি ভুল। সুশান্ত বাবু তাকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন মিথ্যার আধারে। এ যে অসম্ভব।

-" থামলে কেন তুমি। ওসব মিথ্যে কথা। রাতুল আর শ্রীময়ী কে হত্যা করো আগে। ওটাই তোমার কর্তব্য। জেনে রেখো এটা আগে থেকেই সুনির্দিষ্ট। এতে তোমার কোনো হাত নেই। এরা সবাই এক একটা দুষ্ট আত্মা মাত্র। এদের মুক্তি তোমার হাতেই। যা করছো তা ধর্ম যুদ্ধের অংশ মাত্র", বলে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে সুশান্ত সেনগুপ্ত।

বিচলিত বৃষকেতু অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ডঃ শর্মা বলতে থাকেন, " মহান কর্ণের বংশধর ছিলেন ভূদেব সিং ঢিলোঁ। ওঁর মৃত্যুর জন্য যে দায়ী তার কথায় বিশ্বাস করো না তুমি। এটা পাপ। এতে কখনও মুক্তি হয় না।"

বিকেলের পড়ন্ত রোদ সামনের উপত্যকায় ঠিকরে পড়ছিলো। একটা মেঘের চাদর সামনে যাবার রাস্তাটা ঢেকে দিয়েছিল এতক্ষণ। রোদ পড়তেই আস্তে আস্তে মেঘ কেটে যেতে লাগলো। আর সেই আলো আঁধারী তে একজন মানুষকে দেখতে পেলো সবাই।

মুখে দাড়ি গোঁফের জটলা, পরনে গেরুয়া বসন। আশ্চর্য উজ্জ্বল চোখদুটো দেখে সবার আগে শ্রীময়ী চিৎকার করে উঠলো, " বাবা....!"

-৪৩-

প্রতিদিনের মতোই বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন শঙ্করনাথ। ব্যানার্জি বা বন্দ্যোপাধ্যায়টা কবেই নাম থেকে মুছে গেছে। রোজই হর কি দুন থেকে এই চত্বরটা একটু হাঁটাহাঁটি করেন। ফাঁকাই থাকে জায়গাটা। খুব কম মানুষজন এদিকে আসেন। কিন্তু আজ এত জটলা কেন ? দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন তিনি। আর তখনই দেখলেন দৃশ্যটা- বহুদিনের পুরোনো বন্ধু বিধান শর্মা আর দুটি ছেলে মেয়েকে কব্জা করেছে এক বন্দুকধারী আর তার সহকারী।

মেয়েটাকে খুব চেনা লাগছে যে।

আরো খানিকটা এগিয়ে যেতেই বুকটা ধড়াস করে উঠলো। একি! এ যে তাঁর নিজের সন্তান। তাঁর আদরের শ্রীময়ী।


শঙ্করনাথকে দেখে শ্রীময়ী চিৎকার করে উঠতেই সুশান্ত সেনগুপ্ত একটু হকচকিয়ে গেলো। আর ঠিক এই সুযোগটাই খুঁজছিলো রাতুল। হাতের পাথরটা সবেগে নিক্ষেপ করলো।
অব্যর্থ লক্ষ্য।
সুশান্ত বাবুর হাতের রিভলবারটা ছিটকে পড়ে গেলো। রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন তিনি। দৌড়ে গিয়ে রিভলবারটা হাতে তুলে নিলো রাতুল।

অবাক হয়ে গেছে বৃষকেতু নিজেও। শঙ্কর বাবুকে সে বিলক্ষণ চেনে। তার আপন ফুপরজী। উমা ফুফার স্বামী। ছোটবেলায় কতই না আদরের ছিলো সম্পর্কটা। আজ এতদিন পর এই অবস্থায় তাঁকে দেখে বিস্মিত হয়ে গেলো।

শঙ্কর বাবু বুঝতে পারলেন সবটাই।

-" আজও তুমি ফলকটার জন্য এতটা লোভী। শুধুমাত্র নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বৃষকেতু কে ব্যবহার করেছ তুমি", গর্জে উঠলেন শঙ্কর বাবু।

সুশান্ত বাবু তখন রাতুলের কব্জায়। তখনও রাগে দুঃখে কাঁপছেন। বৃষকেতুর রক্তচক্ষু যেন তাঁকে ভস্ম করতে চাইছে। এতদিন যাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে এলো, সে যে এতবড় শয়তান, নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাকে এতটা নীচে নামালো, সেসব ভেবে নিজের ওপর ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হলো বৃষকেতুর।

সুশান্ত রাগে ফুসছিলেন। শঙ্কর বাবু বলতে লাগলেন, " সেদিন জনার্দন তোমার মতি গতি বুঝে গিয়ে সাবধান করতে ডেকেছিল ভূদেবকে। আমার সাথে ওর সবসময়ই যোগাযোগ ছিলো, সে যতই আমি লোথালে না গিয়ে থাকি। সেই জন্যই তাঁবুতে ওদের ডাকা হয়েছিলো।
আর তুমি কিনা সেই সুযোগে আগুন লাগিয়ে চলে এলে। এত লোভ। কিন্তু এত করেও তো ওটা তুমি পাবে না। পেলেও অবশ্য তুমি কিছুই করতে পারতে না। বীজমন্ত্র বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই। ব্রহ্মশির অস্ত্র কি অত সহজে হস্তগত করা যায়"

-" বেশ করেছি। আমি জানি আমি কী করেছি। বৃষকেতু বোকার মতো এমব কথা বলছে....", মাঝপথেই কথা বন্ধ হয়ে গেলো সুশান্ত সেনগুপ্তর।

দু দুটো গুলি ওঁর বুক আর পেট লক্ষ্য করে চালিয়েছে বৃষকেতু। একটা 'আঁক' করে শব্দ হলো আর গুলির প্রতিঘাতে সুশান্ত বাবুর দেহটা ছিটকে পড়ে গেল সুপিন নদীর অতল খাদে।

-" ত্রি-বিধম নরকসিয়েদম দ্বারাম নাসনম আত্মহঃ কামঃ ক্রোধস তথা লোভাস তাসমাদ তত ত্রয়ম তায়জেত", কথা গুলো ছিটকে বেরোলো বৃষকেতুর মুখ থেকে। তারপরই নিজের পিস্তলটা ফেলে দিয়ে ধপ করে বসে পড়লো সে।

অর্থাৎ লালসা, ক্রোধ এবং লোভ এই তিনটি মানুষকে জাহান্নামের দিকে পরিচালিনা করে। প্রত্যেক বুদ্ধিমান লোককে এগুলি ত্যাগ করতে হবে কারণ এগুলো আত্মার অবক্ষয়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া বই অন্য কিছু করে না।

-৪৪-

হাঁটু মুড়ে বসে রয়েছে বৃষকেতু সিং ঢিলোঁ। হাউ হাউ করে কাঁদছে সে। সে জানে, যে পাপ করেছে তার কোনো প্রায়শ্চিত্ত হয় না। হয় না কোনো ক্ষমা।

তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে অনেকজন। শ্রীময়ী, রাতুল, ডঃ শর্মা, শঙ্কর বাবু। বহুদিন পর মেয়েকে দেখতে পেয়ে শঙ্কর বাবুর চোখের জল যেন বাঁধ মানতে চায় না। শ্রীময়ীও কাঁদছে অঝোরে। আর বেচারা বৃষকেতু, সে যখন জানলো শ্রীময়ী সম্পর্কে তার বোন হয়, যাকে এতক্ষণ ওই শয়তান সুশান্ত সেনগুপ্তর প্ররোচনায় এতদিন হত্যার পরিকল্পনা করছিল, মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল যেন।

ঠিক তখনই সাংঘাতিক একটা কান্ড ঘটে গেলো। এতক্ষণ পরপর গুলির শব্দ হওয়ার পরই আশপাশের পাথর গুলো কেমন যেন নড়বড় করছিলো, মাটি আলগা হয়ে ওপর থেকে গড়িয়ে আসছিলো। এবার হঠাৎ সশব্দে বেশ বড়সড় কিছু পাথরের চাঁই ধেয়ে এলো ওদের দিকে। সে কী গগন বিদারিত করা আওয়াজ। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ধস নামছে।

যে যেদিকে পারলো ছিটকে গেলো। সরলো না শুধু একজন। বৃষকেতু। নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো, আর অচিরেই সেই পাহাড়ি ধস তাকে ঠেলে দিলো অতল খাদের মধ্যে, যেখানে সুশান্ত বাবুও চিরতরে বিলীন হয়ে গেছেন। সকলে চিৎকার করে উঠলেও কেউ কিছুই করতে পারলো না।

একেই বোধহয় নিয়তি বলে। কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হতেই দেখা গেলো রাস্তার ওপর ধস নেমে সামনে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ পাশে শ্রীময়ী, রাতুল আর ডঃ শর্মা, আর অন্যদিকে শঙ্কর বাবু। তিনি আবারও দূরে চলে গেলেন। মুখে একটা অমায়িক হাসি নিয়ে হাত নাড়লেন তিনি। এর অর্থ বড় কষ্টদায়ক। ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধে উঠে সমাজের জন্য সুরক্ষা প্রদান করা যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো সুশান্ত সেনগুপ্ত জন্ম না নিতে পারে।

শ্রীময়ী চিৎকার করে ডাকতে গেলো। কিন্তু শঙ্কর বাবু ফিরলেন না আর। যে দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে এতটা পথ এসেছেন, যে মায়া চিরতরে ত্যাগ করেছেন, আর সে পথে আসতে চাইলেন না। শ্রীময়ী এগোতে গিয়েও পারলো না। স্বয়ং হিমালয় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে।

অস্ফুটে একবার ' বাবা' বলে ডেকে উঠলো শ্রীময়ী। কিন্তু না ফিরলেন না তিনি। সব কিছু ত্যাগ করেছেন যে তিনি। নিজের আত্মজার জন্যও ধর্ম থেকে বিচ্যুত হতে পারেন না আর।

-৪৫-

ধীরে ধীরে হর কি দুনের দিকে পা বাড়ালেন শঙ্করনাথ। সামনে দেখা যাচ্ছে এক বিস্তীর্ণ উপত্যকা। আশ্চর্য রঙ্গীন সব পুষ্পের সমাহার। সত্যি যেন ঈশ্বরের বাগান।

শঙ্কর বাবু এগিয়ে যেতে লাগলেন সেই দিকে, যে পথ চলে গেছে স্বর্গরোহিনী শৃঙ্গের দিকে। ডঃ শর্মা মনে মনে প্রণাম জানালেন বন্ধুবরকে। শ্রীময়ী জীবনে দ্বিতীয়বার বাবাকে হারালো এই নিয়ে। রাতুল এসে ওর মাথায় হাত রাখতেই ভেঙে পড়লো ওর বুকে।

ফলকটা সারাজীবনের মতো অলক্ষিতেই থেকে গেলো। সেই বোধহয় ভালো হলো। কিছু জিনিস প্রকাশ্যে না আসাই মঙ্গল। দ্বাপর যুগের স্বাক্ষর নিয়ে কলিযুগ চলে যাচ্ছে নিভৃতে।

দূরে সূর্য ডুবছে বিলম্বিত লয়ে। আর আশিষ মাখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে তারই এক বংশধরের সর্বাঙ্গে, শ্রীময়ী আঁকড়ে ধরে থাকে রাতুলকে। বড় ভরসার জায়গা ওর। বাবাকে হারিয়েছে চিরতরে। রাতুলকে যেন হারাতে না হয় কখনও।

বিকেলের পড়ন্ত রোদে স্বর্গরোহিনীর সোনালী চূড়া ঝলমল করছে। এটাই মহাপ্রস্থানের পথ। আর শঙ্কর বাবু যেন স্বার্থক যুধিষ্ঠিরের মতো এগিয়ে যাচ্ছেন সে পথে। তার নীরব সাক্ষী হয়ে তিনটি প্রাণী দাঁড়িয়ে থাকে হিমালয়ের কোলে।


:::::::: সমাপ্ত :::::::::


 

Ayan Das